শিক্ষামূলক গল্প: তিন যুবকের নিয়ত
গল্পটি বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) যুবক বয়সের। যারা আল্লাহর ওলিদের সাথে বেআদবি করেন, সেসকল ভাই-বোনদের জন্য এই ঘটনায় একটি শিক্ষা বা উপদেশ রয়েছে।
কুতুবে জামান হযরত আব্দুল কাদের জিলানী রহঃ। তাঁরই যৌবনকালের একটি ঘটনা। একদিন তিনি এক বুযুর্গের সাথে মুলাকাত করতে যাচ্ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন আরো দু’জন লোক। ওদের গন্তব্যও সেই একই জায়গায়।
চলতে চলতে ওরা পরস্পর কথা বলছিল। হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) ওদের কথা চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলেন। নিজ থেকে তিনি কিছুই বলছিলেন না।
কথা হচ্ছিল বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। আলোচনা থেকে কোনো কিছু বাদ যাচ্ছিল না। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, রাষ্ট্রীয়-সব ধরনের কথাই স্থান পাচ্ছিল ওদের আলাপচারিতায়।
সঙ্গী দু’জনের একজনের নাম-ইবনুস সাকা। বেশিরভাগ কথা সে-ই বলছিল। তাঁর মুখ থেকে খৈ ফুটছিল যেন।
কথা-বার্তায় এক পর্যায়ে সে তাঁর সাথীকে জিজ্ঞেস করল, ভাই! তুমি কী উদ্দেশ্যে বুযুর্গের খেদমতে যাচ্ছ?
জবাবে সে বলল, আমি কেবল একটি উদ্দেশ্য নিয়ে সেখানে যাচ্ছি। আর তাহলো—রিযিকের প্রশস্ততার জন্য দোয়া চাওয়া। এবার তোমার উদ্দেশ্য বলো।
উত্তরে ইবনুস সাকা বলল, আমি এক বড় উদ্দেশ্য নিয়ে সেখানে যাচ্ছি। আমার উদ্দেশ্য হলো, বুযুর্গকে পরীক্ষা করা। তিনি কোন মাপের বুযুর্গ তা দেখার জন্যই আমার এ দীর্ঘ সফর। এ জন্যেই আমি এত কষ্ট স্বীকার করছি। সেখানে যাওয়ার পর তুমি দেখবে, আমি বুজুর্গকে এমন প্রশ্ন করব, যার উত্তর দেওয়া তাঁর জন্য মোটেও সহজ হবে না। তাছাড়া তিনি কি শুধু বুযুর্গ, নাকি আলেমও তা পরখ করাও আমার উদ্দেশ্য।
আলাপ-আলোচনার এ পর্যায়ে পৌঁছে ওরা হযরত আব্দুল কাদের জিলানী রহঃ-এর দিকে মনোনিবেশ করল। জিজ্ঞেস করল, ভাই! আমরা কেন বুযুর্গের খেদমতে যাচ্ছি তা তো তুমি শুনেছ। এবার বলতো তোমার নিয়তটা কি?
হযরত আব্দুল কাদের জিলানী রহঃ বললেন—বুযুর্গের খেদমতে হাজির হয়ে স্বীয় আত্মার সংশোধন এবং তাঁর কাছ থেকে দোয়া নেওয়ার জন্যই যাচ্ছি। আল্লাহ যেন তাঁর উসীলায় আমার উপর সদয় হন। আমার প্রতি রহম করেন—এটাই আমার উদ্দেশ্য। এছাড়া আমার আর কোনো উদ্দেশ্য নেই।
ওরা তিনজন দীর্ঘ পথ সফর করে একসময় সেই আল্লাহ ওয়ালার দরবারে উপস্থিত হলো।
এদিকে আল্লাহর এই অলী তাঁর খেদমতে যুবক তিনজনের উপস্থিত হওয়ার আগেই কাশফের মাধ্যমে ওদের অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে ফেলেছিলেন। তাই তিনি তাদেরকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই একে একে প্রত্যেকের প্রশ্নের জবাব দিতে লাগলেন।
দুনিয়াবী সম্পদের আশায় যে লোকটি এসেছিল, তাকে হযরত বললেন, আমি তোমার পায়ের নিচে স্বর্ণের স্তুপ দেখতে পাচ্ছি।
যেহেতু একথা দ্বারা লোকটির মূল উদ্দেশ্য অর্জিত হয়ে গেল তাই নিজ থেকে রিজিকের প্রশস্ততার জন্য তাকে আর দোয়া চাইতে হলো না।
প্রথম ব্যক্তির কাজ শেষ করে বুযুর্গ এবার ইবনুস সাকার প্রশ্নগুলো উল্লেখ করলেন। তারপর এগুলোর জবাব দিলেন। বলতে লাগলেন, প্রথম প্রশ্নের জবাব হলো এই। আর দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব হলো এই।
এভাবে এক এক করে সবগুলো প্রশ্নের জবাব দিয়ে অবশেষে তিনি ইবনুস সাকাকে লক্ষ্য করে বললেন, আমি তোমার কপালে কুফুরীর নিদর্শন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। আমি দেখতে পাচ্ছি, অচিরেই তুমি ইসলাম ত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে যাবে।
আল্লাহর কি মর্জি! বুযুর্গ লোকটির কথা যথাযথ বাস্তবায়ন হয়ে গেল। তিনি যেরূপ বলেছিলেন শেষ পর্যন্ত ঘটনা এরূপই ঘটল। ইবনুস সাকা ছিল তৎকালীন খলীফার বার্তাবাহক। তাকে বিশেষ *সংবাদ* দিয়ে সম্রাট হিরাক্লিয়াসের নিকট পাঠানো হয়েছিল। সম্রাট তাঁর জ্ঞান-গরিমা দেখে খুব আপ্যায়ন করলেন। এমনকি বড় আলেম হওয়ার কারণে তাকে তিনি দেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত করলেন। ফলে ইবনুস সাকা সে দেশেই থেকে যায়।
দিন যায় রাত আসে। আবার রাতের পরে দিন। এভাবে কিছু দিন যাওয়ার পর সেখানে এক তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যায়। যার কারণ হচ্ছে, বুযুর্গের সাথে বেআদবীমূলক আচরণ। সে যে বলেছিল যে, বুযুর্গকে প্রশ্ন করবে এবং দেখবে সে আলেম কি না? এটুকুতেই তাঁর সব নিঃশেষ হয়ে গেল। যার ফলশ্রুতিতে ইবনুস সাকা সম্রাট হিরাক্লিয়াসের এক মেয়ের প্রেমে পড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত সেই মেয়েকে পাওয়ার জন্য ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করে। কুফুরীতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। আর এ অবস্থায়ই সে মৃত্যুর মুখে পতিত হয়। নাউযুবিল্লাহ!
যাহোক, বুযুর্গ লোকটি ইবনুস সাকার সাথে কথাবার্তা শেষ করে আব্দুল কাদের জিলানী রহঃ কে উদ্দেশ্যে করে বললেন, বাছা! আমি দেখতে পাচ্ছি, তুমি বাগদাদের মিম্বরে বসে আছ।
আর বলছ—“আমার এই কদম সমস্ত আওলিয়াদের গর্দানের উপর।” তুমি একথা বলার পর দেখতে পেলাম যে, উপস্থিত আওলিয়াগণ নিজ নিজ গর্দান তোমার দিকে ঝুঁকিয়ে দিচ্ছেন।
বুযুর্গের এই কাশফ একদিন সত্যি সত্যিই বাস্তবায়িত হয়েছিল। একবার হযরত আব্দুল কাদের জিলানী রহঃ বাগদাদের শাহী মিম্বরে বসে বয়ান করছিলেন। বয়ানের এক পর্যায়ে হঠাৎ তাঁর অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ে—“আমার এই কদম সমস্ত আওলিয়াদের গর্দানের উপর’। এ কথা শুনামাত্র উপস্থিত বুযুর্গগণ স্বীয় গর্দান ঝুঁকিয়ে দিলেন। কেউ কেউ গর্দান ঝুঁকাতে ঝুঁকাতে বললেন—‘বরং আমার মাথা এবং চোখের উপরও।
*প্রিয় পাঠক-পাঠিকা!* দুই যুবক তো তাদের নিজ নিজ নিয়ত অনুসারে ফলাফল লাভ করেছে। আর যেহেতু ইবনুস সাকার নিয়তটা কেবল মন্দই ছিল না, আল্লাহর অলীদের সাথে বেয়াদবীমূলকও ছিল তাই সে হিদায়েত থেকে বঞ্চিত হয়ে বেঈমান হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে। তাই আসুন, আল্লাহর অলীদেরকে আমরা দিল থেকে শ্রদ্ধা করি এবং একমাত্র আত্মার সংশোধনের নিয়তেই তাদের দরবারে হাজির হই। অন্য কোনো নিয়তে নয়। আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন। আমীন। [পছন্দিদা ওয়াকিয়াত]
*লেখকঃ* মাওলানা মুফীজুল ইসলাম
বইঃ আদর্শ যুবক যুবতি ১ (হৃদয় গলে সিরিজ)
Post a Comment