ইসলামিক গল্প: পিতা মাতার খেদমতের প্রতিদান


আজ থেকে বহুকাল পূর্বের কথা। তখনকার যুগে যােগাযােগ ব্যবস্থা এত উন্নত ছিল না। ছিল না বাস, ট্রেন, লঞ্চ, প্রাইভেট কার ও উড়ােজাহাজের ন্যায় অত্যাধুনিক যােগাযােগ ব্যবস্থা। লােকজন সাধারণতঃ ঘােড়া কিংবা উটের উপর আরােহণ করেই একস্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করত।

হযরত সুলাইমান (আ.) ছিলেন আল্লাহর নবী।-আল্লাহ পাক তাকে দান করেছিলেন এক অসাধারণ ক্ষমতা। তিনি বিশাল তখতের উপর বসে অল্প সময়ের মধ্যে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারতেন। তাঁর সফর হতাে আকাশ পথে, সঙ্গে থাকতাে অসংখ্য অনুসারী ও ভক্তবৃন্দের দল। সমস্ত সৃষ্টি জগত তার কথা শুনতে ও মানতাে।

একদিন হযরত সুলাইমান (আ.) সাথী সঙ্গীদের নিয়ে সফর করছিলেন। পথিমধ্যে ছিল একটি বিশাল সমুদ্র। সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার সময় হঠাৎ হযরত সুলাইমান (আ.) এর দৃষ্টি পানির উপর পড়ল। তিনি লক্ষ্য করে দেখলেন, এক জায়গার পানি খুব দ্রুত ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু আশে পাশের পানি একেবারেই স্থির। এ দৃশ্য অবলােকন করে তিনি ভাবলেন, নিশ্চয়ই এখানে কোন রহস্য আছে। রহস্য উৎঘাটনের জন্য প্রথমে তিনি বাতাসকে থামতে হুকুম করলেন। বাতাস থেমে গেল। তারপর ইফরিত নামক জীনকে বললেন, সমুদ্রের যে স্থানে পানি ঘূর্ণিপাক খাচ্ছে তুমি সেখানে ডুব দিয়ে রহস্য তালাশ কর।

জীনটি সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ পালন করল। সে ডুব দিয়ে সমুদ্রের তলদেশে পৌছে দেখতে পেল, সেখানে গম্বুজ আকৃতির ছােট একটি কুব্বা আছে। কুব্বাটি খুবই সুন্দর কারুকার্য খচিত। সে উহাকে সঙ্গে নিয়ে তৎক্ষণাৎ হযরত সুলাইমান (আ.) এর নিকট ফিরে এলাে।

সুলাইমান (আ.) কুব্বাটি দেখে খুবই আশ্চর্য বােধ করলেন। তিনি আল্লাহর নিকট দুআ করে বললেন, হে আল্লাহ! তুমি তােমার অপরিসীম কুদরত দ্বারা এই কুব্বার দরজা খুলে দাও এবং আমাদের সামনে এর রহস্য উদঘাটন কর। দুআ শেষ হওয়ার সাথে সাথে কুব্বার দরজা খুলে গেল। দেখা গেল, উহার ভিতরে এক সুন্দর সুদর্শন যুবক সিজদায় পড়ে আছে।

হযরত সুলাইমান (আ.) জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে?
ফিরিশতা?
জিন?
না মানুষ?
যুবক উত্তরে বলল,
আমি মানুষ।

প্রশ্নঃ তুমি কিসের বদৌলতে এত বড় মর্যাদা লাভ করেছ?

উত্তরঃ পিতা-মাতার খেদমতের কারণেই আমি এতবড় মর্যাদা লাভ করেছি।

প্রশ্নঃ তােমার খেদমতের একটু বিবরণ শুনাবে কি?

উত্তরঃ হ্যা, শুনুন তাহলে।

প্রশ্নঃ হুম বল ।

উত্তরঃ আমি সর্বদাই পিতা-মাতার খেদমত করতাম। এক সময় আব্বাজান ইন্তেকাল করেন। আম্মাজান তখন বুড়াে হয়ে গেলেও হাঁটাচলা করতে পারতেন। কিন্তু কয়েক বছর যাওয়ার পর তিনি চলন শক্তি একেবারেই হারিয়ে ফেললেন। কারাে সাহায্য ছাড়া কিছুই করতে পারতেন না। তখন থেকেই আমি তাকে পিঠের উপর নিয়ে চলতাম। তার যেন কোন ধরণের কষ্ট না হয়, সেদিকে আমি সতর্ক দৃষ্টি রাখতাম। একদিন আমার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে আমার মা আল্লাহর নিকট দুআ করলেন।

বললেন, হে আল্লাহ! তুমি আমার সন্তানকে অল্প জিনিসে সন্তুষ্ট রাখিও এবং আমার মৃত্যুর পর তার বাসস্থান আসমান ও জমীন ব্যতীত অন্য কোন জায়গায় দান করিও।

কিছুদিন পর আম্মাজান দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন। তার ইন্তেকালের পর একদিন আমি সমুদ্রের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ সেখানে একটি কুব্বা দেখতে পেলাম। কুব্বাটি দেখে আমার মনে কৌতূহল জাগলাে। আমি ধীরপদে সেখানে যেতেই উহার দরজা খুলে গেল। আমি ভিতরে প্রবেশ করলাম সাথে সাথে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। এরপর থেকে আমার জানা নেই যে, আমি কোথায় আছি।

এই কুব্বার ভিতরে তােমার রিযিকের ব্যবস্থা কিরূপে হয়? হযরত সুলাইমান (আ.) পুনরায় প্রশ্ন করলেন।

যখন আমার ক্ষুধা লাগে, তখন আল্লাহ তা’আলা এই কুব্বার এক পাশে একটি ফলবান বৃক্ষ তৈরী করে দেন। আমি উক্ত বৃক্ষের ফল খেয়েই ক্ষুধা নিবারণ করি। আর যখন আমার পিপাসা লাগে তখন এই কুব্বার দেয়াল থেকে দুধের চেয়ে সাদা, মধুর চেয়ে মিষ্টি ও বরফের চেয়ে ঠান্ডা পানি বের হয়। সেই পানি পান করেই তৃষ্ণা মিটাই।

– এর ভিতর তুমি রাত দিন কিভাবে বুঝ?

– যখন ভাের হয় তখন কুব্বাটি সাদা হয়ে যায়। তখন আমি বুঝি যে, এখন দিন শুরু হয়েছে। আর সূর্য ডুবে গেলে কুব্বাটি অন্ধকার হয়ে যায়। তখন আমি বুঝি যে, রাত শুরু হয়েছে। এভাবেই আমি দিন রাতের পার্থক্য করে থাকি।

অতঃপর হযরত সুলাইমান পুনরায় দুআ করলেন। ফলে কুব্বার দরজা আগের মত বন্ধ হয়ে গেল।

মুহতারাম পাঠক! আলােচ্য ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, পিতা মাতার খেদমত করার কারণে যুবকটি এমন এক বিরল সম্মান লাভ করেছে যা সাধারণতঃ মানুষ পায় না। কারণ সমুদ্রের তলদেশে নির্জন নিরিবিলি পরিবেশে দীর্ঘদিন যাবত একাগ্রচিত্তে আল্লাহর ইবাদত করার সুযােগ পাওয়া-এ তাে চাট্টিখানি কথা নয়। ইয়ামেনের অধিবাসী নবী প্রেমিক হযরত ওয়াইস করণী (র.) -এর ঘটনা অনেকেরই জানা। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সাথে সাক্ষাত করার জন্য উদগ্রীব ছিলেন।

কিন্তু তার বৃদ্ধামাতার সেবার প্রয়ােজন ছিল বিধায় তিনি আল্লাহর নবীর দর্শন লাভের জন্য মদীনায় যেতে পারেন নি। কিন্তু মায়ের খেদমতের কারণে আল্লাহ পাক তাকে এমন মর্যাদা দান করেছিলেন যে, পরবর্তীতে বিশিষ্ট সাহাবীগণ পর্যন্ত তার দ্বারা দুআ করাতেন। হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে পিতামাতার খেদমত করে তাদের সন্তুষ্টি অর্জনের তাওফীক দাও। আমীন।

No comments