লিও টলস্টয়ের গল্প: এক টুকরো রুটি


লিও টলস্টয় রুশ সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক; এমনকি তাকে বিশ্ব সাহিত্যেরও অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জ্ঞানার্জনে অসীম আগ্রহী; অদম্য অনুসন্ধিৎসু, অফুরন্ত জীবনীশক্তির অধিকারী ও কর্মোদ্যমী এই বিখ্যাত মানুষটির জন্ম ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের ৯ সেপ্টেম্বর রাশিয়ার টুলা প্রদেশে। টলস্টয়ের পুরো নাম কাউন্ট লেভ নিকোলায়েভিচ টলস্টয়

তিনি মানুষের মধ্যে জীবনবোধ, মনুষ্যত্ববোধ, নীতিবোধ জাগ্রত করতে চেয়েছিলেন। টলস্টয় তাঁর সময়ের বিশিষ্ট প্রগতিবাদী বৈপ্লবিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদ।

এক টুকরো রুটি

একদিন ভোরবেলা এক গরিব চাষী লাঙল নিয়ে মাঠে এসেছে জমি চাষ করতে। তার সঙ্গে আছে এক টুকরো রুটি, খিদে পেলে নাশতা করবে। গায়ের জামা খুলে তা দিয়ে রুটিখানা জড়িয়ে সে রেখে দিল এক ঝোপের আড়ালে। তারপর লাঙল চালাতে লাগল।

কিছুক্ষণ পর লাঙল টেনে ঘোড়াটা ক্লান্ত হয়ে উঠল, চাষীরও বেশ খিদে পেল। তখন চাষী ঘোড়াটা ছেড়ে নাশতা করবে বলে ঝোপের কাছে এল। কিন্তু জামাটা খুলেই সে অবাক! দেখে রুটির টুকরোটি সেখানে নেই। সে খোঁজাখুঁজি করতে লাগল, জামা তুলে ঝাড়ল কিন্তু রুটিখানা সত্যিই নেই। অবাক চাষী ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারল না।

সে মনে মনে ভাবল, তাজ্জব ব্যাপার তো! কাউকে কোথাও দেখতে পেলাম না অথচ রুটিটা নেই! নিশ্চয়ই কেউ চুপিচুপি এসে ওটা নিয়ে পালিয়েছে।

আসলে চাষী যখন কাজে ব্যস্ত ছিল তখন এক শয়তান এসে এ-কাণ্ড করে গেছে। শয়তান তখনও ঝোপের আড়ালে বসে ছিল। কটি হারিয়ে চাষী কীভাবে গালাগালি করে তাই সে শুনবে। শুনে আমোদ পাবে।

রুটির টুকরোটি হারিয়ে চাষীর মনে খুব দুঃখ হল বটে কিন্তু সে মনে মনে বলল : যাকগে, কী আর করা যাবে। আমি তাই বলে খিদেয় মরে যাব না। যার দরকার ছিল নিশ্চয়ই এমনি কোনো লোক ওটা নিয়েছে। যেই নিয়ে থাক যেন লোকটার উপকার হয়।

এই বলে উঠে সে কুপের কাছে গেল। সেখান থেকে পানি খেয়ে বিশ্রাম করল কিছুক্ষণ। বিশ্রামের পরে আবার লাঙল জুতে জমি চাষ করতে লাগল।

এই দেখে শয়তানের কিন্তু মন খারাপ হয়ে গেল। মন খারাপ হবারই কথা। সে ভেবেছিল, রুটির টুকরোটি না-পেয়ে চাষী ভয়ানক রেগে যাবে। রেগে গিয়ে গালাগালি শুরু করবে যা তা বলে। কিন্তু চাষীকে দিয়ে সেরকম কোনো অন্যায় কাজই সে করাতে পারল না। শয়তান অবশেষে তাদের সরদারের কাছে গিয়ে সব খুলে বলল।

সরদার তার কথা শুনে ভয়ানক রেগে উঠল, তুমি চাষীকে রাগাতে পারলে না তো কী করে এলে? তুমি দেখছি নিজের কাজই বুঝতে পারো না! চাষী আর তাদের বউ-ঝিরা যদি এমন ভালোমানুষ হয়ে ওঠে তাহলে শয়তানদের ঠাই হবে কোথায় ? কাদের নিয়ে আমাদের কাজ-কারবার চলবে? এরকম করলে তো চলবে না। শিগগির আবার ফিরে যাও। গিয়ে ঠিকমতো কাজ করে এসো। যদি তিনবছর সময়ের মধ্যে তুমি এ-চাষীকে বিপথে না-আনতে পারে তবে তোমাকে আর দলে রাখব না, হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি।

সরদারের কথায় শয়তান ভয় পেয়ে গেল। তক্ষুনি সে আবার নেমে এল পৃথিবীতে। এসে ভাবতে লাগল, কী উপায় সে করবে। কী করে লোকটাকে দিয়ে খারাপ কাজ করাবে। ভাবতে ভাবতে একটা মতলব শয়তানের মাথায় এল। চমৎকার মতলব!

সে একজন মজুর সাজল। মজুর সেজে কাজ করতে গেল সেই গরিব চাষীর বাড়ি। প্রথম বছরে সে চাষীকে পরামর্শ দিল শুধু নিচু জমিতে ফসল বুনতে। চাষী তার কথা শুনে নিচু জমিতে ফসল বুনল। ফলে কী হল?

সে বছর বৃষ্টি হল খুব কম। সবার ফসলই রোদে জ্বলেপুড়ে নষ্ট হয়ে গেল। এদিকে সেই গরিব চাষীর দ্বিগুণ ফসল ফলল সেবার। ফলে সারাবছর খেয়েও তার অনেক শস্য বেঁচে গেল। বাড়তি শস্য বিক্রি করে অনেক টাকা পেল সে।

পরের বছর চাষীকে শয়তান পরামর্শ দিল সবচেয়ে উঁচুভূমিতে ফসল বুনতে। চাষী তাই করল। সেবার কিন্তু গ্রীষ্মের সময় বৃষ্টি হল খুব বেশি। সবার ক্ষেতের ফসলই বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে গেল। আর চাষী উঁচুজমির ফসল আগের বছরের চেয়েও ভালো হল। এবার খেয়ে বেঁচে গেল আরও বেশি ফসল। এত বাড়তি ফসল দিয়ে চাষী কী করবে ভেবেই পেল না।

শয়তান তখন চাষীকে এক নতুন পথ বাতলে দিল। শস্য থেকে কী করে ভদকা মদ তৈরি করতে হয় তাই শিখিয়ে দিল তাকে।

চাষীর তখন মহানন্দ। ভদকা তৈরি করে সে নিজে তো খেতে লাগলই বন্ধুদেরও ডেকে খাওয়াতে লাগল।

শয়তান তখন মনের আনন্দে তার সরদারকে গিয়ে বলল, এতদিনে আমার মনের বাসনা পূরণ করে এসেছি। সেবার ঠকেছিলাম, এবার আর ঠকাতে পারেনি।

সরদার সহজ পাত্র নয়। সে বলল, দাঁড়াও, একবার আমার নিজের চোখে ব্যাপারটা দেখে আসতে দাও।

এই বলে সরদার নেমে এল চাষীর বাড়ি। এসে দেখল, চাষী তার সব ধনী–বন্ধুদের দাওয়াত করে এনেছে। বাড়িতে এনে ভদকা খেতে দিয়েছে। চাষীর বউ মেহমানদের ভদকা বিলিয়ে দিচ্ছে। ভদকার পাত্র নিয়ে একটি টেবিলের পাশ দিয়ে যেতে যেতে ধাক্কা লেগে তার খানিকটা মেঝেয় পড়ে গেল হঠাৎ। তাই দেখে চাষী রেগে বলে ওঠল, ও কী করেছ বোকা মেয়েমানুষ কোথাকার! একি তোমার ময়লা পানি পেয়েছ যে ইচ্ছেমতো খানিকটা মেঝেতে ঢেলে দেবে? যতসব বে-আক্কেলে মেয়েমানুষ।

শয়তান তখন সরদারকে ইশারায় ব্যাপারটা দেখিয়ে বলল, এবার দেখ, এ লোকই একদিন একমাত্র সম্বল তার রুটির টুকরোটি হারিয়ে একটুও অস্থির হয়নি। আর আজ ?

চাষী কিন্তু তখনও এই নিয়ে বউয়ের সঙ্গে রাগারাগি করেই চলেছে। বউয়ের হাত থেকে পাত্রটি ছিনিয়ে নিয়ে সে নিজেই তখন মদ বিলাতে শুরু করেছে। এমন সময় সেখানে এসে ঢুকল সে-গাঁয়েরই এক গরিব লোক। তাকে দাওয়াত করা হয় নি। মাঠে কাজ করে লোকটা বাড়ি ফিরছিল। যেতে যেতে এখানে এসে ঢুকেছে। ঘরে ঢুকেই সবাইকে অভিবাদন করে সে একপাশে বসে মদ খাওয়া দেখতে লাগল। সারাদিন কাজ করে লোকটা খুব পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে। তৃষ্ণাও পেয়েছে বেশ। সে ভাবছিল, এ-সময় একফোটা মদ পেলে বেশ হত। চেয়ে চেয়ে দেখে তৃষ্ণাটা তার বেড়েই চলেছে। কিন্তু চাষী তার দিকে একফোটা মদও দিতে রাজি নয়। সে বরং বলে উঠল, যাকে-তাকে ভদকা বিলানো আমার কাজ নয়।

চাষীর মুখে একথা শুনে শয়তানের সরদার খুব খুশি। কিন্তু শয়তান নিজে খুশি হয়েছে আরও বেশি। তাই হাসতে হাসতে সে সরদারকে বলল, চুপ করো একটু, আরও মজা দেখতে পাবে এক্ষুনি।

মেহমানরা সবাই ভদকা খেয়েছে। বাড়িঅলা চাষীও খেয়েছে মনের সুখে। ভদকা খেয়ে যত রাজ্যের সত্যিমিথ্যে আবোলতাবোল গল্প শুরু করেছে সবাই মিলে।

শয়তানের সরদার সব শুনছে আর মনে মনে শয়তানের বুদ্ধির প্রশংসা করছে। সে বলছে, একটু মদ খেয়েই যদি লোকগুলো শিয়ালের মতো একে অপরকে ঠকাতে চেষ্টা করে তাহলে আমাদের মুঠোর ভেতর এসে পড়তে আর বাকি কী?

শয়তান বলল, আরেকটু থামো। দেখে নাও এরপর কী মজা শুরু হয়। আরেক গ্লাস করে সবাইকে খেতে দাও। তখন দেখবে মজা। এখন ওরা শিয়ালের মতো লেজ নাড়ছে আর একে অপরকে খুশি করতে চাইছে। এরপর দেখবে, এরাই হয়েছে সব এক একটা ভয়ানক নেকড়ে বাঘ!

আরও এক গ্লাস করে সবাই যখন খেল তখন তাদের মুখে তুবড়ি ছুটছে। গল্প-গুজবের পরিবর্তে এবার আরম্ভ হয়েছে চিৎকার। রাগের মাথায় একজন আরেকজনকে যা-খুশি বলছে। একটু পরেই শুরু হল হাতাহাতি আর মারামারি। একজনের নাকের উপর আরেক জনের ঘুষি। বাড়িঅলাও এসে যোগ দিল মেহমানদের সঙ্গে। সে মারও খেল আচ্ছারকম।

শয়তানের সরদার অতি-আনন্দে তামাশা দেখতে লাগল। আর মনে মনে বলে উঠল, চমৎকার তো!

কিন্তু তখনও শয়তান বলছে, আরেকটু সবুর করো। আরেক গ্লাস পেটে পড়তে দাও, তারপর দেখবে মজা। এখন ওরা লড়াই করছে নেকড়ের মতো। এরপর করবে শূকরের মতো।

তৃতীয় গ্লাস খেয়ে সত্যিই লোকগুলো জানোয়ারের মতো ব্যবহার করতে লাগল। অদ্ভুত ধরনের চিৎকার শুরু করল তারা। অকারণে শুধুই চিৎকার করছে, কেউ কারোর কথায় কান দিচ্ছে না।

এরকমভাবে কিছুক্ষণ কাটিয়ে তারা বাড়ি ফিরতে লাগল। কেউ একাই টলতে টলতে হেলেদুলে চলতে লাগল, অনেকে দুজন বা তিনজনের দল বেঁধে বাড়িওলা চাষী দরজা অবধি এসেছিল তাদের বিদায় দিতে। সেখানে সে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল কাদায়। মাথা থেকে পা অবধি সারা গা তার লেপটে গেল কাদার ভেতর। মুখ গুঁজে পড়ে সে ঠিক শূকরের মতো ঘোঁত ঘোত করত লাগল।

তাই দেখে শয়তানের সরদার আরও খুশি। সে শয়তানকে বলল, ভারি মজার জিনিস তৈরি করেছ তুমি। রুটির ব্যাপারে যে ভুলটুকু করেছিলে, ভদকা তৈরি করে সে-ভুল শুধরে গেল তোমার। কিন্তু এখন বলো তো, কী করে এই আজব জিনিসটা তুমি তৈরি করেছ? প্রথমে বুঝি দিয়েছ শিয়ালের রক্ত, তাই শিয়ালের মতো করছিল লোকগুলো। তারপর বুঝি দিয়েছ নেকড়েবাঘের খানিকটা রক্ত, তাতেই নেকড়ের স্বভাব পেয়েছিল ওরা। আর সবশেষে দিয়েছ শূকরের রক্ত, তাই ঘোঁত ঘোঁত করছিল ওরা ঠিক শূকরের মতোই।

শয়তান মাথা নেড়ে বলল, না, সেসব কিছুই না। প্রথমে আমি শুধু বুঝতে পেরেছিলাম, চাষী তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত ফসল পেয়েছে। জানোয়ারের রক্ত মানুষের মধ্যে আগে থেকেই ছিল। যতক্ষণ অবধি সে শুধু প্রয়োজনীয় ফসল পেয়েছে ততক্ষণ সেই জানোয়ারের স্বভাব চাপা পড়েছিল। সে সময় চাষী তার শেষ সম্বল একটুকরো রুটি হারিয়েও কোনও অনাসৃষ্টি কাণ্ড বাধায়নি। কিন্তু যখন থেকে তার ফসল খেয়েদেয়ে বাড়তি হতে লাগল তখনই সেই বাড়তি ফসল দিয়ে সে আমোদ করার উপায় খুঁজতে লাগল। আমি তখনই তাকে সেই আমাদের পথ দেখিয়ে দিলাম, মদ পানের আনন্দ। তারপর যখন থেকে সে ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ দান এই ফসলকে মদে পরিণত করে তাই পান করতে লাগল তখন থেকেই তার ভেতরকার শিয়াল, নেকড়ে ও শূকর মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। সে যদি শুধু ভদকা খেতে শুরু করে তবে বন্যপই হয়ে উঠবে দুচার দিন পরে।

শয়তানের কথা শুনে এবার কিন্তু সরদারের মন খুশিতে ভরে উঠল। মনের খুশিতে শয়তানের বুদ্ধির তারিফ করতে করতে সে চলে গেল।

No comments