গুড্ডুবুড়ার ভীষণ বিপদ - আনিসুল হক
গুড্ডুবুড়া খানিকক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকল। কাকদের বাসা বানানো দেখতে লাগল। কাকেরা বাসায় কত কী আনছে। তার। খড়। দড়ি। কার যেন একটা ভাঙা চুড়িও এনেছে তারা।
তারপর গেল তার বাবার পড়ার ঘরে। এই ঘরে অনেক বই। বাবা খুব বই পড়েন। একটা বড় টেবিল আছে। আর আছে একটা পুরোনো আমলের চেয়ার। এই চেয়ারটা নাকি দাদার বাবা নাকি বাবার দাদার আমলের। শাল কাঠের তৈরি চেয়ার। ভীষণ ভারী।
চেয়ারের পেছনে হেলান দেওয়ার জায়গাতে কাঠের ফ্রেম। তিনটা কাঠের লাঠি আড়াআড়িভাবে সেই ফ্রেমে লাগানো।
দুটি লাঠির মধ্যখানে বেশ ফাঁক। গুড্ডুবুড়া ভাবল, এই ফাঁকে কি মাথা ঢুকিয়ে দেওয়া সম্ভব?
গুড্ডুবুড়া চেয়ারের কাঠের ফ্রেমের ফাঁকে নিজের মাথাটা ঢোকানোর চেষ্টা করতে লাগল।
মনে হয় ঢুকবে। নাহ্, ঢুকবে না।
আচ্ছা দেখি না চেষ্টা করে।
গুড্ডুবুড়া বাবার দাদার বা দাদার বাবার পুরোনো চেয়ারের পেছনের কাঠের ফ্রেমের দুই কাঠের বারের মধ্যখানের ফাঁকের মধ্যে নিজের মাথা ঢুকিয়ে দিতে পারল।
বাহ্। এই তো পেরেছি—গুড্ডুবুড়া মনে মনে বলল।
এবার মাথাটা বের করতে হয়!
কিন্তু মাথা আর কিছুতেই বের হয় না। সে মাথা এ–কাত করে, ও–কাত করে। চেয়ারের পেছনের কাঠের ফোকর থেকে তার মাথা আর কিছুতেই বের হয় না।
এখন সে করবটা কী!
চেয়ারটাও ভীষণ ভারী। সে যে চেয়ারটা দুই হাতে তুলে মায়ের ঘরে নিয়ে যাবে; মাথাটা ভেতরে রেখেই, তা–ও তো তার পক্ষে সম্ভব নয়। তার ঘাড় টনটন করছে। এখন কী হবে!
গুড্ডুবুড়া কাঁদতে লাগল।
কাঁদলে কী হবে। কেউ তো তার কান্না শুনতে পাচ্ছে না। মা ঘুমিয়ে আছেন। আর না ঘুমালেই–বা কী। এই ঘরে তো তিনি এখন আসবেন না। এটা বাবার পড়ার ঘর। বাবা অফিস থেকে ফিরে রাত আটটার দিকে এই ঘরে আসেন।
এখন কী হবে? গুড্ডুবুড়া চিৎকার করে মাকে ডাকতে লাগল। ‘মা, মা…’
তার কথা কেউ শুনছে না। বরং তার বাবার বইয়ের ফাঁকে একটা টিকটিকি ডেকে উঠল টিকটিক…
মা ঘুম থেকে উঠলেন। দেখলেন, গুড্ডুবুড়া পাশে নেই। তিনি হাঁক ছাড়লেন, ‘গুড্ডু, গুড্ডু…’
কোথাও গুড্ডুর কোনো সাড়াশব্দ নেই। তিনি ভয় পেয়ে গেলেন। বাথরুমে উঁকি দিলেন। ডাইনিং রুমে এলেন। রান্নাঘরে তল্লাশি করলেন। ‘গুড্ডু গুড্ডু…।’ মায়ের বুক ধড়াস ধড়াস করে কাঁপতে লাগল। কোথায় গেল ছেলেটা। ঘর থেকে একা একা বেরিয়ে গেল নাকি!
এখানে–ওখানে খুঁজে কী মনে করে তিনি গেলেন গুড্ডুর বাবার পড়ার ঘরে।গুড্ডু গুড্ডু…
ওই তো ছেলেটা চেয়ারের পেছনের ফ্রেমের ফাঁকে মাথা ঢুকিয়ে ঘুমিয়ে আছে! ঘুমিয়ে আছে, নাকি অজ্ঞান হয়ে গেছে।
গুড্ডু গুড্ডু…মা হাঁক ছাড়লেন। গুড্ডুর ঘুম ভেঙে গেল। সে মাথা তুলতে গেল। ঘাড়ে আটকে গেল কাঠের ফ্রেম। ‘মা, আমার মাথা আটকে গেছে…’ কাঁদতে কাঁদতে বলল গুড্ডুবুড়া।
কেমন করে আটকাল!
আমি মাথাটা কাত করে ধরলাম। আর চেয়ারটা তার মধ্যে মাথাটা টেনে নিল। চেয়ারটা ভালো না, মা।
কতক্ষণ এইভাবে আছিস!
জানি না। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
এখন এই মাথাটা বের করা যাবে কী করে? মা আস্তে আস্তে তার মাথাটা ধরে বললেন, ‘বের কর।’
গুড্ডু বের করার চেষ্টা করতে লাগল। মা তার মাথা ধরে সাহায্য করছেন। কিন্তু মাথা কিছুতেই বের হচ্ছে না। আটকে যাচ্ছে।
মা নিজেই এবার কাঁদতে লাগলেন।
কী করবেন? গুড্ডুবুড়ার বাবাকে ফোন করবেন? গুড্ডুবুড়ার বাবা অফিসে। তিনি এই খবর শুনলে আঁতকে উঠবেন। আর কী করা যায়!
নিচে দারোয়ান আছে, কেয়ারটেকার আছে। তাদের কি ফোন করে ডেকে আনবেন? তা–ই করা ভালো।
তিনি ইন্টারকম ফোনে কল করলেন নিচের গেটে। ‘এই, একজন আসো তো আমার বাসায়। একটা ছোটখাটো বিপদ হয়েছে।’
গুড্ডুবুড়া ভাবতে লাগল, এভাবেই কি তার জীবনটা চলে যাবে? সে সারা জীবন তার মাথা রেখে দেবে চেয়ারের ফ্রেমের ফাঁকে। এখানেই সে খাবে। এখানেই সে ঘুমাবে। এখানেই সে পটি করবে। এখানেই সে বড় হবে। তার দাড়ি–গোঁফ গজাবে।
একটু পরে এল কেয়ারটেকার আংকেল। মা আর কেয়ারটেকার আংকেল দুজনে মিলে খানিক চেষ্টা করল গুড্ডুর মাথা বের করার। করা গেল না।
বরং চাপাচাপিতে গুড্ডুবুড়ার ঘাড়ের পেছনে খানিকটা ছিলেও গেল।
দারোয়ান আংকেল বলল, ‘আমি একটা কাঠমিস্ত্রি ডাইকা আনি। সে আইসা একটা কাঠ খুইলা দিক। তাইলে মাথা বাইর হইয়া আইব।’
উপায় না দেখে গুড্ডুর মা বললেন, ‘আচ্ছা ডেকে আনো একটা মিস্ত্রি।’
এই চেয়ার যদি কাটা হয়, গুড্ডুর বাবা খুব মন খারাপ করবে। এটা তার দাদার আমলের চেয়ার।
মা তখন ফোন করলেন গুড্ডুর বাবাকে। ‘শুনেছ গুড্ডুর বাবা, ইয়ে মানে একটা ছোটখাটো বিপদ হয়েছে।’
কী বিপদ?
গুড্ডু…
গুড্ডুর কী হয়েছে?
গুড্ডু ভালো আছে। তবে…
কী তবে?
তবে একটা ঝামেলা করেছে?
কী ঝামেলা?
বলছি।
কী? পেস্ট মনে করে রঙের টিউবের রং দিয়ে দাঁত মেজেছে?
না।
তাহলে গাজরের হালুয়া ভেবে মরিচবাটা খেয়েছে?
না।
শিং মাছের হাঁড়িতে হাত দিয়েছে?
না।
তাহলে?
ওর মাথা তোমার দাদার চেয়ারের পেছনের কাঠের ফাঁকে ঢুকিয়েছে। আর বের হচ্ছে না।
কী মুশকিল।
এখন ও তো খুব কষ্ট পাচ্ছে। কী করি?
চেষ্টা করো। ঢুকেছে যখন বেরও হবে।
হচ্ছে না। শোনো, আমি মিস্ত্রিকে খবর দিয়েছি। কাঠমিস্ত্রি আসছে।
কাঠমিস্ত্রি কী করবে?
তোমার চেয়ারের একটা কাঠ একটু খুলবে। গুড্ডুর মাথা বের হয়ে গেলে আবার লাগিয়ে দেবে।
গুড্ডুর বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন, ‘দেখো, গুড্ডু যেন আবার ব্যথা না পায়।’
আধা ঘণ্টা পর মিস্ত্রি এল। তার আগে গুড্ডু বলল, ‘মা, একটু পানি দাও।’
পানি কীভাবে খাবি?
তাও তো ঠিক।
মা তখন স্ট্র এনে দিলেন। গুড্ডু স্ট্র দিয়ে গেলাস থেকে পানি খেল।
মা বললেন, ‘একটা কি বিস্কুট দেব?’
না, মা।
গুড্ডুবুড়ার এই সমস্যার কথা তোমরা জানো। সে কিছু্ই খেতে চায় না। না খেয়ে থাকতে থাকতে তার শরীর হয়ে পড়েছে দেশলাইয়ের কাঠি। শুধু মাথাটাই যা ওর একটু বড়।
না খেতে খেতে ওর বুদ্ধিও গেছে শুকিয়ে।
কাঠমিস্ত্রি এল। তার সহকারী এল। তারা করাত বের করল। হাতুড়ি বের করল। বাটাল বের করল।
গুড্ডুবুড়া কাঁদতে লাগল, ‘এখন কি আমার মাথা কেটে ফেলবে?’
মিস্ত্রি আংকেল বলল, ‘না না। মাথা ক্যান কাটব বাবু? দেখি, তোমার মাথাটা কীভাবে বাইর করা যায়?’
কাঠমিস্ত্রি তার সহকারীকে বলল, ‘কাশেম, ধর তো চেয়ারটা। বাবু, তুমি মাথাটা আস্তে আস্তে সোজা করো। আমরা চেয়ার তুইলা বাইর কইরা নিব।’
আস্তে আস্তে তারা চেয়ার তুলে ধরে তিন–চারবারের চেষ্টায় বের করে আনতে সক্ষম হলো।
গুড্ডুবুড়া মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল।
মা মিস্ত্রিকে ৫০০ টাকা দিলেন। মিস্ত্রি আংকেল বলল, ‘না না। লাগব না। আমরা তো কিছু করি নাই।’
মা বললেন, ‘অনেক উপকার করেছেন। নিন।’
এরপর আর কী করা যাবে? গুড্ডুবুড়াকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন তার মা। ডাক্তার সবকিছু দেখেশুনে পরীক্ষা করে বললেন, ‘গুড্ডুর সব ঠিক আছে। তবে ও খায় না। খায় না বলে ওর ব্রেইন কাজ করে না। ওকে খেতে হবে। সব খেতে হবে। ভাত খেতে হবে, রুটি খেতে হবে। মাছ খেতে হবে, মাংস খেতে হবে। শাক খেতে হবে, সবজি খেতে হবে। ডিম খেতে হবে, দুধ খেতে হবে। ফলমূল খেতে হবে। আর খেলতে হবে। তাহলেই ও ঠিক হয়ে যাবে।’
গুড্ডুবুড়া এবার ডাক্তারের কথা শুনল। সে ঠিকভাবে খায়। আর প্রচুর খেলে। এখন গুড্ডুবুড়া আর বোকা নয়। সে এখন বুদ্ধিমান গুড্ডুবুড়া।
এর মধ্যে বাসায় একটা হলুস্থুল পড়ে গেছে।
মা বারান্দায় বসে রোদ পোহাচ্ছিলেন শীতের দুপুরে। চুল মেলে দিয়ে রোদ্দুরে শুকাচ্ছিলেন।
কানের দুল দুটো খুলে রেখেছিলেন সামনের টুলটায়। একটুখানি ঘরের ভেতরে গিয়ে পানি খেয়ে আবার ফিরে এসেছেন বারান্দায়। চিরুনি চালিয়ে চিরুনির গায়ে আটকে থাকা চুলগুলো তিনি বের করছেন।
এ সময় তাঁর মনে হলো, তাঁর কানের দুল দুটো তো টুলে রেখেছেন। তাকিয়ে দেখলেন, একটা দুল নেই।
কী সর্বনাশের কথা! এক মিনিটে তাঁর দুল কে নেবে! তাঁরা থাকেন আটতলায়। বারান্দায় গ্রিল নেই। তবে এক মিনিটে কারও পক্ষে এই বারান্দায় এসে দুল নিয়ে চলে যাওয়া সম্ভব নয়। কী ব্যাপার, ভূত-প্রেতের কাণ্ড নাকি!
মা খুব ভয় পেলেন। ফোন করলেন, গুড্ডুর বাবাকে, ‘শোনো গুড্ডুর বাবা, একটা ঘটনা ঘটেছে। আমার না খুব ভয় লাগছে। বারান্দার টুলের ওপর কানের দুল দুটো খুলে রাখলাম, এখনই দেখি একটা নাই।’
বাবা বললেন, ‘দেখো, কোথায় রেখেছ। ভুলে অন্য কোথাও রেখেছ নিশ্চয়ই।’
মা এখানে–ওখানে খুঁজলেন।
পাওয়া গেল না। আশ্চর্য তো। বাড়িতে ভূত থাকে নাকি!
গুড্ডুবুড়া এল সেই সময়। স্কুল থেকে এসে সে বেল টিপল।
মা দরজা খুললেন।
এখন তো গুড্ডুবুড়া চালাক গুড্ডুবুড়া। মা বললেন, ‘গুড্ডু, হাতমুখ ধো। ভাত খা। তারপর আমার একটা সমস্যার সমাধান করে দে।’
কী সমস্যা মা?
ভালো করে সাবান দিয়ে হাতমুখ ধুতে ধুতে গুড্ডু বলল।
আমি বারান্দার টুলে দুটো কানের দুল রেখেছি। ঘরে এসে এক গ্লাস পানি খেয়ে আবার গেছি। দেখি আমার একটা দুল নাই।
গুড্ডু বলল, ‘চলো তো দেখি বারান্দায় গিয়ে।’
গুড্ডু সব দেখল।
মা বললেন, ‘আগে ভাত খা। তারপর আস্তে আস্তে সমাধান কর।’
গুড্ডুবুড়া বলল, ‘আচ্ছা দাও ভাত।’
খেতে খেতে সে বলল, ‘মা, মাছের তরকারিটা খুব ভালো হয়েছে। আচ্ছা আরেকটু ডাল দাও তো…শোনো, আমরা সিসি টিভি চেক করতে পারি। তাতে বোঝা যাবে, কেউ বাইরের পাইপ বেয়ে উঠেছিল কি না। কোনো চোর…পাশের বারান্দা থেকে আসা সম্ভব। তাতেও একটা মই দুই বারান্দার মধ্যে পাততে হবে। সেটা দুই মিনিটে সম্ভব না। আমার মনে হয়, বাইরের কেউ না। ভেতরের কেউ। ভেতরে ছিলে কেবল তুমি। তুমি ভুলে অন্য কোথাও রাখোনি তো?’
আমি গুড্ডুবুড়ুার মা। আমি তো বোকা হতে পারিই। কিন্তু আমি তো ঠিকঠাকভাবে খাওয়াদাওয়া করি।
কাক ডেকে উঠল, কা কা।
গুড্ডুবুড়া বলল, ‘মা পেয়েছি। চলো তোমাকে দেখাচ্ছি।’
কী বলিস!
চলো বারান্দায়।
বারান্দায় গিয়ে গুড্ডু বলল, ‘ওই যে কাকের বাসাটা দেখছ, ওইখানে আছে তোমার দুল।’
কাক তখন ওখানে বসে আছে।
হ্যাঁ মা। আমি দেখেছি, কাক চুড়ি এনে রেখেছে বাসায়।
একটু পরে কাকটা উড়ে উঠল। তখন মা আর গুড্ডু দুজনেই ভালো করে তাকিয়ে দেখতে পেল, ভেতরে দুলটা দেখা যাচ্ছে।
এসির মিস্ত্রিকে খবর দেওয়া হলো। তার নাম মাহবুব। মাহবুব বলল, ‘এক সেকেন্ড।’ সে বারান্দায় গিয়ে একলহমায় সানশেডের কাছে চলে গেল একটা পাইপ ধরে। তারপর কাকের বাসা থেকে দুলটা নিয়ে পকেটে রেখে চলে এল আধা মিনিটেই।
Post a Comment