পানি-রহস্য - হুমায়ূন আহমেদ
মবিন সাহেব বাগানের ফুল গাছে পানি দিচ্ছিলেন। তাঁর সামনে জয়নাল দাঁড়িয়ে আছে। অনেকক্ষণ ধরেই আছে, মাঝে মাঝে খুকখুক করে কাশছে, পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটিতে নকশা কাটছে, মুখে কিছু বলছে না। মবিন সাহেব বললেন, কিছু বলবি নাকি রে জয়নাল? জয়নাল লজ্জিত মুখে হাসল। সে অল্পতেই লজ্জা পায়।
মবিন সাহেব বললেন, আজ কাজকর্ম নেই?
জে না।
জয়নালের বয়স চল্লিশের ওপরে। বিয়ে-টিয়ে করেনি। একা মানুষ। এক কামারের দোকানে কাজ করে। হাপর চালায়, কয়লায় ফুঁ দেয়। রাতে ঐ দোকানের একপাশে চট বিছিয়ে ঘুমিয়ে থাকে।
মবিন সাহেব বছরখানিক আগে কামারের দোকানে একটা শাবল বানাতে দিয়েছিলেন। জয়নাল তাকে বসিয়ে রেখে শাবল বানিয়ে নিল। নামমাত্র দাম দিল। সেই সূত্রে পরিচয়। মবিন সাহেবের মনে হয়েছে জয়নাল অতি ভদ্র, অতি সজ্জন একজন মানুষ। একটু বোধহয় বোকা। তাতে কিছু যায়-আসে না। চালাক বদলোকের চেয়ে বোকা সজ্জন ভালো। সে ছুটিছাঁটার দিনে মবিন সাহেবের বাড়িতে আসে। কিছু বলে না, মাথা নিচু করে মেঝেতে চুপচাপ করে থাকে। মবিন সাহেব তাঁর নাতনিদের সঙ্গে গল্প-গুজব করেন, সে গভীর আগ্রহ নিয়ে শুনে। আজও বোধহয় গল্প শোনার লোভেই এসেছে। মবিন সাহেব গাছের গোড়ায় পানি ঢালতে ঢালতে বললেন, কি রে জয়নাল, কিছু বলবি?
জয়নাল মাথা চুলকাতে লাগল। পায়ের বুড়ো আঙুলে নকশা কাটা আরো দ্রুত হলো। বার কয়েক খুকখুক করে কাশল।
কিছু বলার থাকলে বলে ফেল। এত লজ্জা কীসের?
ঐ গল্পটা আবার শুনতে আইছি।
মবিন সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, কোন গল্প?
পানির উপরে দিয়া যে হাঁটে…
একবার তো শুনেছিস, আবার কেন?
মনটা টানে।
মবিন সাহেব তাঁর নাতনিদের টলস্টয়ের বিখ্যাত একটা গল্প বলেছিলেন। যে গল্পে কয়েক জন বেঁটে ধরনের সাধুর কথা আছে। তারা এক নির্জন দ্বীপে বাস করতো, নিজেদের মতে করে আল্লাহর নাম-গান করতো। সমুদ্রের ওপর দিয়ে পায়ে হেঁটে যাবার অদ্ভুত ক্ষমতা তাদের ছিল। এই গল্প জয়নালও শুনেছে। বোকা মানুষ, হয়তো ভালো করে বুঝতে পারেনি। এখন ভালোমতো বুঝতে চায়।
মবিন সাহেব বললেন, বস আমার সামনে, গল্পটা আবার বলি।
জয়নাল বসল। মবিন সাহেবের কাছ থেকে খুরপাই টেনে নিয়ে মাটি কুপাতে লাগল। তাকে নিষেধ করে লাভ হবে না। সে কাজ না করে থাকতে পারে না। সে যতবার আসে এটা-সেটা করে দেয়।
মবিন সাহেব গল্প শুরু করলেন। জয়নাল নিবিষ্ট মনে শুনছে। গল্প শেষ হবার পর সে নিশ্বাস ফেলে বলল, উনারা সাধু ছিলেন?
হ্যাঁ, সাধু ছিলেন। সাধারণ মানুষ তো আর পানির ওপর হাঁটতে পারে না।
পারে না কেন স্যার?
মানুষের ওজন পানির চেয়ে বেশি। আর্কিমিডিসের একটা সূত্র আছে। তুই তো বুঝবি না। লেখাপড়া না জানলে বুঝানো মুশকিল।
জয়নাল বিনীত গলায় বলল, আমি লেখাপড়া জানি। ক্লাস থিরি পাস করছিলাম। পাঁচের ঘরের নামতা জানি।
পাঁচের ঘরের নাম জানলে হবে না, আরো পড়াশোনা জানা লাগবে।
জি আচ্ছা। স্যার আইজ উঠি।
আচ্ছা যা।
জয়নাল উঠে দাঁড়াল তবে চলে গেল না। আবারো খুকখুক করে কাশতে লাগল। মনে হচ্ছে সে আরো কিছু বলতে চায়। মবিন সাহেব বললেন, কিছু বলবি?
জয়নাল বিব্রত গলায় বলল, সাধু হওয়ার নিয়মটা কী?
কেন, তুই কি সাধু হতে চাস নাকি?
জয়নাল মাথা নিচু করে ফেলল। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে সাধু হতে চায়।
মবিন সাহেব বললেন, সাধু হওয়া বড়ই কঠিন। নির্লোভ হতে হয়। পরের মঙ্গলের জন্যে জীবন উৎসর্গ করতে হয়। তারা কখনও মিথ্যা বলে না। সাধারণ মানুষ মিথ্যা না বলে থাকতে পারে না। সামান্য হলেও মিথ্যা বলতে হয়।
জয়নাল প্রায় ফিসফিস করে বলল, স্যার, আমি মিথ্যা বলি না।
ভালো। খুব ভালো।
আমার কোনো লোভও নাই।
মবিন সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, তুই তো তাহলে সাধুর পর্যায়ে চলেই গেছিস।
জয়নাল লজ্জা পেয়ে বলল, স্যার যাই?
আচ্ছা যা। আরে শোন শোন, একটু দাঁড়া।
মবিন সাহেব ঘর থেকে একটা পুরনো কোট এনে দিলেন। কোটের রঙ জ্বলে গেছে, হাতের কাছে পোকায় কেটেছে। তবু বেশ গরম। জয়নাল ব্যবহার করতে পারবে। মবিন সাহেব লক্ষ করেছেন এই শীতেও জয়নাল পাতলা একটা জামা পরে থাকে। খালি পায়ে হাঁটে।
জয়নাল কোট পেয়ে অভিভূত হয়ে গেল। তার চোখে পানি এসে গেল। সে নিচু হয়ে মবিন সাহেবকে কদমবুসি করল।
কোট যেদিন দিলেন সেদিন সন্ধ্যাতেই মবিন সাহেবের সঙ্গে জয়নালের আবার দেখা। কোট গায়ে দিয়ে জয়নাল একেবারে ফিটফাট বাবু। সে রাস্তার মোড়ে উবু হয়ে বসে একটা কুকুরকে পাউরুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে দিচ্ছে। ফিসফিস করে কুকুরকে বলছে, খা বাবা খা। কষ্ট কইরা খা। পরের বার তোর জন্যে গোস্ত যোগাড় করব। না খাইলে শইল্যে বল হইব না।
মবিন সাহেব ধমকে দাঁড়ালেন।
কী করছিস রে জয়নাল?
কিছু না স্যার।
কুকুরকে পাঁউরুটি খাওয়াচ্ছিস, ব্যাপারটা কী?
এ স্যার হাঁটাচলা করতে পারে না। দুইটা ঠেং ভাঙা, লুলা হইয়া আছে। ঠেং-এর ওপর দিয়া গাড়ি চইল্যা গেল।
তুই কি রোজ একে খাইয়ে যাস?
মবিন সাহেব দেখলেন কুকুরটার আসলেই অন্তিম দশা। মনে হচ্ছে শুধু পা, কোমরও ভেঙেছে। নিম্ন শ্রেণীর বলেই এখনও বেঁচে আছে। মানুষ হলে মরে যেত।
জয়নাল কিছু বলল না। হাসল। মবিন সাহেব বললেন, পাউরুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে মুখে তুলে দেবার দরকার কী? সামনে ফেলে দে— নিজেই খাবে।
জি আচ্ছা।
জয়নাল পাউরুটি ফেলে মবিন সাহেবের সঙ্গে সঙ্গে আসতে লাগল। মবিন সাহেব বললেন, কোটে শীত মানে?
জে স্যার, মানে।
কোট গায়ে দিয়ে খালি গায়ে হাঁটাহাঁটি ভালো দেখায় না। এক জোড়া স্যান্ডেল কিনে নিস।
জে আচ্ছা।
বাসায় আসিস। পুরনো এক জোড়া জুতা দিয়ে দেব। তোর পায়ে লাগলে হয়। তোর যা গোদা পা!
জয়নাল হেসে ফেলল। গোদা পা বলায় সে মনে হলো খুব আনন্দ পেয়েছে। মবিন সাহেব বললেন, তুই আমার পেছনে পেছনে আসছিস কেন?
স্যার, একটা কথা জিজ্ঞেস করব।
জিজ্ঞেস কর।
উনাদের নাম কী স্যার?
কাদের নাম কী? পরিষ্কার করে বল।
সাধু। যারা পানির ওপর দিয়ে হাঁটে।
এখনও সেই গল্প মাথায় ঘুরছে? সাধুদের কোনো নাম দেয়া নেই, তবে যিনি এই গল্প লিখেছেন তাঁর নাম টলস্টয়। মস্ত বড় লেখক।
বড় তো স্যার হইবই। সত্য কথা লেখছে। পানির উপরে হাঁটা সহজ ব্যাপার তো না। আচ্ছা স্যার, এই দুনিয়ায় সর্বমোট কয়জন লোক আছে যারা পানির উপরে হাঁটতে পারে?
মবিন সাহেব উত্তর দিলেন না। বোকা লোকদের সব প্রশ্নের উত্তর দিতে নেই। উত্তর দিতে গেলে ঝামেলায় পড়তে হবে। জয়নালও উত্তরের জন্যে চাপাচাপি করল না। মবিন সাহেবকে তাঁর বাড়ির গেট পর্যন্ত আগিয়ে দিল।
এতদিন ঠাণ্ডায় চলাফেরা করে জয়নালের কিছু হয়নি। গরম কোর্ট পাবার তিন দিনের মাথায় তার ঠাণ্ডা লেগে গেল। প্রথমে সর্দি-জ্বর, তারপর একেবারে শয্যাশায়ী। খবর পেয়ে মবিন সাহেব দেখতে গেলেন। খুপড়ি ঘরের এক কোনায় সে চটের ওপর পড়ে আছে। তার গায়ে কোট। কোট পেয়েই সে যে গায়ে দিয়েছে আর বোধহয় খুলেনি। অন্যপাশে হাপরের গনগনে আগুন। এরকম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পশুও থাকতে পারে না। মবিন সাহেব দুঃখিত গলায় বললেন, কেমন আছিস রে?
জয়নাল হাসিমুখে বলল, খুব ভালো আছি স্যার।
এই বুঝি তোর ভালো থাকার নমুনা? গায়ে জ্বর আছে?
জে না।
মবিন সাহেব জয়নালের কপালে হাত দিয়ে চমকে উঠলেন, গা পুড়ে যাচ্ছে! চিকিৎসা কি হচ্ছে?
জয়নাল জবাব দিল না। তার মানে চিকিৎসা কিছু হচ্ছে না। অবস্থা যা তাতে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা দরকার। মবিন সাহেবের পক্ষে রোগী নিয়ে টানাটানি করাও সম্ভব না। তার নিজের কাজকর্ম আছে।
তোর আত্মীয়স্বজন এখানে কে আছে?
কেউ নাই স্যার।
খাওয়া-দাওয়া কে দিয়ে যায়?
চায়ের দোকানের একটা ছেলে আছে, ইয়াকুব নাম, হে দেয়। বড় ভালো ছেলে। অন্তরে খুব মুহব্বত।
ছেলেটাকে বলবি আমার সঙ্গে যেন দেখা করে।
জি আচ্ছা।
চিন্তা করিস না তোর চিকিৎসার ব্যবস্থা আমি করব।
জয়নালের চোখে পানি এসে গেল। মানুষ এত ভালো হয়! সে শার্টের হাতায় চোখ মুছতে মুছতে বলল, স্যারের কাছে একটা আবদার ছেল।
বল কী আবদার?
ঐ গল্পটা যদি আরেকবার বলতেন। গল্পটা শোনার জন্যে মন টানতাছে।
কোন গল্প?
পানির উপরে দিয়ে যে হাঁটতো।
ঐ গল্প তো শুনেছিস, আবার কেন?
শুনতে মন চায়।
জ্বরে মরে যাচ্ছিস, গল্প শুনতে হবে না। বিশ্রাম কর। ঘুমুতে চেষ্টা কর।
জে আচ্ছা।
পরে দিয়া গুম না স্যার, ঘটনা
মবিন সাহেব উঠে দাঁড়ালেন, জয়নাল বলল, স্যার, আমরা যারা সাধারণ মানুষ তারার জন্যে পানির উপরে দিয়া হাঁটা কি আল্লাপাক নিষেধ কইরা দিছে?
নিষেধ-টিষেধ কিছু না। মানুষ পানির ওপর দিয়ে হাঁটতে পারে না, কিন্তু মাকড়সা পারে। আবার মানুষ উড়তে পারে না কিন্তু পাখি উড়তে পারে। একেক জনের জন্যে একেক ব্যবস্থা এই হলো ব্যাপার।
জয়নাল চোখ-মুখ উজ্জ্বল করে বলল, কিন্তু স্যার, কেউ-কেউ পানির উপরে দিয়া হাঁটতে পারে।
মবিন সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, না তো। মানুষ আবার পানির ওপর দিয়ে হাঁটবে কি! তা ছাড়া তার দরকারইবা কি? মানুষের জন্যে নৌকা আছে। জাহাজ আছে।
তারপরও স্যার কেউ-কেউ পানির উপরে হাঁটে। আপনে নিজেই বলছেন।
আরে গাধা, আমি যা বলেছি সেটা হলো গল্প।
জয়নাল বিছানায় উঠে বসল। উত্তেজিত গলায় বলল, গল্প না স্যার, ঘটনা সত্য। কোনো কোনো মানুষ পানির উপরে দিয়া হাঁটতে পারে, কিছু হয় না, খালি পায়ের পাতাটা ভিজে।
চুপ করে ঘুমা তো, গাধা।
জয়নাল কাতর গলায় বলল, হাত জোড় কইরা আপনেরে একটা কথা বলি স্যার। আমি নিজেই পানির উপর দিয়ে হাঁটতে পারি। সত্যই পারি। এই কথা কোনো দিন কেউরে বলি নাই, আইজ আপনেরে বললাম। স্যার, ঘটনাটা আপনেরে বলি?
মবিন সাহেব অনাগ্রহের সঙ্গে বললেন, আচ্ছা আজ থাক, আরেক দিন শুনব।
আমার খুব শখ বিষয়টা আপনেরে বলি। আপনে হইলেন জ্ঞানী মানুষ, আপনে বুঝবেন। বড়ই আচানক ঘটনা।
ঘটনা আরেক দিন শুনব। আজ সময় নেই। রাতের ট্রেনে নেত্রকোনা যাব।
জি আচ্ছা, স্যার।
মবিন সাহেব জয়নালের কথার কোনো গুরুত্ব দিলেন না। প্রবল জ্বরে মাথা চড়ে গিয়েছে। আবোল-তাবোল বকছে। মবিন সাহেব বললেন, জয়নাল, আমি যাচ্ছি, চায়ের দোকানের ছেলেটা আসলে পাঠিয়ে দিস। রাত দশটার আগেই যেন আসে। দশটার সময় আমি চলে যাব।
জি আচ্ছা, স্যার।
চায়ের দোকানের কোনো ছেলে মবিন সাহেবের কাছে এলো না। তিনি চলে গেলেন নেত্রকোনা। তিন দিন পার করে ফিরলেন। এসেই জয়নালের খোঁজ নিলেন। সে আগের জায়গায় নেই। জ্বর প্রবল হওয়ায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
কামারশালার মালিক সতীশ বলল, অবস্থা সুবিধার না। শ্বাসকষ্ট হইতেছে।
মবিন সাহেব বললেন, ডাক্তার কী বলল? ওর হয়েছে কী?
নিওমোনিয়া। খুব খারাপ নিওমোনিয়া। ডাক্তার বলছে বাঁচে কিনা বাঁচে ঠিক নাই। তবে চিকিৎসা হইতেছে।
বলো কি!
স্যার, জয়নাল হইল গিয়া আফনের পাগলা কিসিমের মানুষ। শইলের কোনো যত্ন নাই। আমার এইখানে আছে দশ বছর। এই দশ বছরে তারে গোসল করতে দেখি নাই। পানির বিষয়ে তার নাকি কি আছে। সে পানির ধারে কাছে যায় না।
যায় না কেন?
কিছু বলে না, খালি হাসে। তবে স্যার, পাগল কিসিমের লোক হইলেও মানুষ ভালো। ধরেন, আমার এইখানে পইড়া ছিল পেটেভাতে। ব্যাবসাপাতি নাই, তারে কী দিমু কন। নিজেই চলতে পারি না। কিন্তু স্যার, এই নিয়া কোনো দিন একটা কথা সে আমারে বলে নাই। আমারে না জানাইয়া সে মাঝে মাঝে ইস্টিশনে কুলির কাম করতো। হেই পয়সা দিয়া তর্ক করতো জানেন স্যার?
কী করতো?
দুনিয়ার যত কাউয়ারে পাঁউরুটি কিন্যা খাওয়াইতো।
কেন?
বললাম না স্যার, পাগল কিসিমের লোক। তয় মনটা পানির মতো পরিষ্কার।
মবিন সাহেব তাকে হাসপাতালে দেখতে গেলেন। বিছানায় মরার মতো পড়ে আছে। জ্বরে আচ্ছন্ন। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। বুক কামারের হাপরের মতোই ওঠানামা করছে। মবিন সাহেব বললেন, কেমন আছিস রে জয়নাল?
জয়নাল অনেক কষ্টে চোখ মেলে বলল, স্যার, ভালো আছি।
ভালো আছি বলছিস কোন আন্দাজে? তুই তো মরতে বসেছিস রে গাধা।
জয়নাল থেমে থেমে বলল, আপনারে একটা ঘটনা বলব স্যার। ঘটনাটা না বললে মনটা শান্ত হইব না।
কী ঘটনা?
পানির উপরে দিয়া হাঁটনের ঘটনা। আমি স্যার সাধু না, পির-ফকিরও না, কিন্তু আমি…।
জয়নাল হাঁপাতে লাগল। তার কপাল দিয়ে টপটপ করে ঘাম পড়তে লাগল। মবিন সাহেব বললেন, এখন বিশ্রাম কর তো। তোর ঘটনা সবই শুনব।
আপনে স্যার জ্ঞানী মানুষ, আপনে শুনলে বুঝবেন। যা বলব সবই সত্য। আমি জীবনে মিথ্যা বলি নাই। আমি স্যার পানির উপরে দিয়া হাঁটতে পারি। খালি পায়ের পাতা ভিজে আর কিছু হয় না। বিরাট রহস্য স্যার…।
শুনব, তোর বিরাট রহস্য মন দিয়ে শুনব। এখন ঘুমুতে চেষ্টা কর। তোর শরীরের যে অবস্থা দেখছি…
কুত্তাটার জন্যে মনটা টানে স্যার। পাও ভাঙা, নিজে যে হাঁইট্যা-চইড়া খাইবে সেই উপায় নাই। কেউ দিলে খায়, না দিলে উপাস থাকে। বোবা প্রাণী, কাউরে বলতেও পারে না।
আচ্ছা, আমি কুকুরটার খোঁজ নিব।
আপনের অসীম মেহেরবানি।
তুই নাকি কাকদের পাউরুটি ছিঁড়ে খাওয়াস, এটা সত্যি নাকি?
জয়নাল লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসল। মবিন সাহেব বললেন, কাককে পাঁউরুটি খাওয়ানোর দরকার কী? ওদের তো আর খাবারের অভাব হয়নি। ওদের ডানাও ভাঙেনি।
জয়নাল বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, কাউয়ারে কেউ পছন্দ করে না। আদর কইরা কাউয়ারে কেউ খাওন দেয় না। এই ভাইব্যা…
আচ্ছা, ঠিক আছে। তুই আর কথা বলিস না। শুয়ে থাক। আমি কাল এসে আবার খোঁজ নেব।
আপনের মতো দয়ার মানুষ আমি আর এই জীবনে দেখি নাই। জয়নালের চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল।
.
মবিন সাহেব পরদিন তাকে আবার দেখতে গেলেন। অবস্থা আগের চেয়ে অনেক খারাপ হয়েছে। চোখ লাল। বুক যেভাবে ওঠা-নামা করছে তাতে মনে হয় শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। রাতে ডাক্তাররা অক্সিজেন দেবার চেষ্টা করেছেন। তাতে তার খুব আপত্তি। কিছুতেই সে নাকের ওপর বাটি ধরবে না। আমি বললাম, কেমন আছিস রে জয়নাল?
জয়নাল ফ্যাঁসফ্যাঁস গলায় বলল, খুব ভালো আছি স্যার। খুব ভালো। ঘটনাটা বলব?
কী ঘটনা?
পানির উপরে দিয়া হাঁটনের ঘটনা। না বইল্যা যদি মইরা যাই তা হইলে একটা আফসোস থাকব। বলি—? কাছে আইস্যা বসেন। আমি জোরে কথা বলতে পারতেছি না।
মবিন সাহেব কাছে এসে বসলেন। জয়নাল ফিসফিস করে প্রায় অস্পষ্ট গলায় বলতে লাগল–
ছোটবেলা থাকাই স্যার আমি পানি ভয় পাই। বেজায় ভয়। আমি কোনো দিন পুসকুনিতে নামী নাই, নদীতে নামী নাই। একবার মামারবাড়ি গিয়েছি, মামার বাড়ি হলো সান্দিকোনা–বাড়ির কাছে নদী। খুব সুন্দর নদী। আমি সন্ধ্যাকালে নদীর পাড় দিয়া হাঁটাহাঁটি করি। একদিন হাঁটতেছি— হঠাৎ শুনি খচমচ শব্দ। নদীর ঐ পাড়ে একটা গরুর বাচ্চা পানিতে পড়ে গেছে। গরু-ছাগল এরা কিন্তু স্যার জন্ম থাইক্যা সাঁতার জানে। এরা পানিতে ডুবে না। কিন্তু দেখলাম, এই বাচ্চাটা পানিতে ডুইব্যা যাইতেছে। একবার ডুবে, একবার ভাসে। পায়ের মধ্যে দড়ি পেঁচাইয়া কিছু একটা হইছে। বাচ্চাটা এক একবার ভাইস্যা উঠে আমার দিকে চায়। আমাকে ডাকে। তার ডাকের মধ্যে কী যে কষ্ট। আমার মাথা হঠাৎ আউলাইয়া গেল। আমি যে সাঁতার জানি না, পানি ভয় পাই কিছুই মনে রইল না দিলাম দৌড়। এক দৌড়ে বাচ্চার কাছে গিয়া উপস্থিত। পানি থাইকা বাচ্চাটারে টাইন্যা তুইল্যা দেহি আমি নিজে পানির উপরে দাঁড়াইয়া আছি। আমি নদী পার হইছি হাইট্যা, আমার পায়ের পাতাটা খালি ভিজছে। আর কিচ্ছু ভিজে নাই–এখন স্যার আপনে আমারে বলেন বিষয় কী? ঘটনা কী?
মবিন সাহেব বললেন, এরকম কি আরো ঘটেছে?।
জে না, সেই প্রথম, সেই শেষে। আর কোনো দিন আমি পানিতে নামী নাই। এখন আপনে যদি বলে আরেকবার পানিতে নাইম্যা দেখব। তয় আমি তো সাধুও না— পীর-ফকিরও না…
মবিন সাহেব বলেলেন, কে বলতে পারে! তুই হয়তো বিরাট সাধু–তুই নিজে তা জানিস না।
জয়নাল কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি স্যার সাধারণ মানুষ। অতি সাধারণ, তয় স্যার, সাধু হইতে আমার ইচ্ছা করে। খুব ইচ্ছা করে।
মবিন সাহেব বললেন, আর কথা বলিস না জয়নাল। তোর কষ্ট হচ্ছে, শুয়ে থাক।
আমার কুত্তাটারে পাইছিলেন?
খোঁজ করছি— এখনও পাইনি। পেলে ভাত খাইয়ে দেব। চিন্তা করিস না। রাতে এসে খোঁজ নিয়ে যাব।
জয়নাল হাসল। তৃপ্তির হাসি, আনন্দের হাসি।
রাতে খোঁজ নিতে এসে মবিন সাহেব শুনলেন জয়নাল মারা গেছে। মবিন, সাহেব অত্যন্ত মন খারাপ করে হাসপাতালের বারান্দায় এসে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখলেন রাজ্যের কাক বারান্দায় লাইন বেঁধে বসে আছে। তাদের চেয়ে একটু দূরে বসে আছে কোমরভাঙা কুকুর। কীভাবে সে এতদূর এসেছে কে জানে?
মবিন সাহেব দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। এই জগতে কত রহস্যই না আছে! কোনো দিন কি এইসব রহস্যভেদ হবে?
(সমাপ্ত)
Post a Comment