অশরীরী সুর - হুমায়ূন আহমেদ


দুই বছর আগের কথা (জানুয়ারি, ২০০৯)। লেখার টেবিলে বসেছি। টেবিলে A4 সাইজের কাগজ আছে, বলপয়েন্ট আছে, চায়ের কাপ এবং কাপের পাশে সিগারেটের প্যাকেট আছে। সবচেয়ে বড় কথা, মাথায় গল্প আছে। লিখতে বসে দেখি, কলম চলছে না। শরীরের যে মাসলগুলো আঙুল চালায়, তারা আড়ষ্ট।

বাসায় রবি নামের একটি কাজের ছেলে আছে, তার দায়িত্ব শাওনের কুকুরের দেখাশোনা করা। আমার অবস্থা দেখে সে কোলের কুকুর ফেলে ছুটে এল। অনেকক্ষণ হাতে ম্যাসাজ করল। আঙুল টেনে দিল। হাতের আড়ষ্ট ভাব দূর হলো না। নিষাদ তার মাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে আনন্দিত গলায় বলল, মা! বাবার একটা হাত নষ্ট হয়ে গেছে। একমাত্র শিশুরাই যেকোনো দুর্ঘটনায় আনন্দ পায়।

আমার পাশের ফ্ল্যাটে অন্যপ্রকাশের স্বত্বাধিকারী মাজহার থাকে। আমার ডান হাত অচল শুনে তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। সামনে বইমেলা। অন্যপ্রকাশের এখন কী হবে? মাজহার করিৎকর্মা মানুষ। আমার অবস্থা দেখে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেল। এক ঘণ্টারও কম সময়ে ফিরে এল। না, ডাক্তার নিয়ে আসেনি। সে এসেছে একটা মিনি ক্যাসেট রেকর্ডার নিয়ে। ক্যাসেট রেকর্ডার চার ঘণ্টা চলবে।

আমি হাতে না লিখে মুখে মুখে বলব। গল্প বা উপন্যাস রেকর্ড হয়ে যাবে। মাজহারের লোকজন ক্যাসেট প্লেয়ার বাজিয়ে গল্প-উপন্যাস লিখে ফেলবে।

আমি চেষ্টা করলাম। একসময় লক্ষ করলাম, মূল গল্প থেকে সরে আবোলতাবোল কথা বলছি। ক্যাসেট প্লেয়ার বন্ধ করে দেওয়া হলো। বিকেলে গেলাম ডাক্তারের কাছে। তারা X-Ray সহ অনেক কিছু করল। ডাক্তাররা কিছু বের করতে পারল না।

কিন্তু আমি সমস্যা বের করে ফেললাম। মানসিক কোনো ব্যাপার ঘটেছে। ডান হাত দিয়ে আমি দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালাতে পারছি, কাগজে আঁকিবুঁকি করতে পারছি; কিন্তু লিখতে পারছি না। অর্থাৎ আমার মস্তিষ্ক চাইছে না যে আমি লিখি। মস্তিষ্ক চাইছে না বলেই সে হাতে লেখার কোনো সিগন্যাল পাঠাচ্ছে না। এর চিকিৎসা অত্যন্ত সহজ। মনকে নির্ভার করতে হবে। নুহাশপল্লীতে টানা কয়েক দিন থাকতে হবে। নুহাশপল্লীর বৃক্ষরাজি আমাকে সুস্থ করে তুলবে।

রাত ১২টায় সবাইকে নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। তার আগে ছোট্ট একটা কাজ করলাম, মাজহারের ক্যাসেট রেকর্ডার চালু করে শোবার ঘরের খাটে রেখে দিলাম। শাওন বলল, এর মানে কী?

আমি বললাম, ক্যাসেট রেকর্ডারটা রাত ১২টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত আশপাশের সব শব্দ রেকর্ড করবে। অশরীরীরা যদি কোনো কথা বলে, তাও রেকর্ড হয়ে যাবে। ভূত-প্রেতের সঙ্গে এই পদ্ধতিতে যোগাযোগ করাকে বলে EVP (Electronic Voice Phenomena).

EVP নিয়ে পৃথিবীজুড়ে মাতামাতির শুরুটা করেন সুইডেনের একজন অপেরা গায়ক, নাম ফ্রেডরিখ জারগেনসন (Fredrich Jurgenson)। তিনি তাঁর স্টকহোমের বাড়ির জানালায় একটা রেকর্ডার বসান। তিনি চাইছিলেন পাখিদের গান রেকর্ড করবেন। গায়কের বাড়িটি গ্রামে। চারদিকে লোকালয় নেই। অতি নির্জন। গায়ক রেকর্ডার বসিয়ে শহরে চলে এলেন। শহরে নানা ব্যস্ততায় সারা দিন কাটিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলেন। রেকর্ডার চালালেন। সেখানে প্রচুর পাখির গান আছে, তবে তার সঙ্গে অদ্ভুত ব্যাপারও আছে। একটি পুরুষকণ্ঠ বলছে, ‘পাখিরা রাতে গান করে।’ অপেরা গায়ক হতভম্ব। পুরুষকণ্ঠ কোত্থেকে এল? তিনি দিনের পর দিন রাতের পর রাত শূন্য বাড়িতে ক্যাসেট রেকর্ডারে শব্দ রেকর্ড করতে থাকলেন। পুরুষকণ্ঠ আবারও পাওয়া গেল। সে এবার সরাসরি ফ্রেডরিখ এবং তাঁর কুকুর কেরিনো (carino)-কে উদ্দেশ্য করে কথা বলছে। ফ্রেডরিখ তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বই লিখলেন। এই বই পড়ে উৎসাহিত হলেন লেটভিয়ান সাইকোলজিস্ট কনস্টানটিন রোদিভ (Konstantin Ravdive)। তিনি সত্তর হাজারের বেশি ভয়েস রেকর্ড করলেন। একটি বই লিখলেন, নাম Amazing Experiment in Electronic Communication with the dead.

বইটি বেস্ট সেলার হলো। পৃথিবীজুড়েই EVP নিয়ে হৈ চৈ শুরু হলো। নানা EVP সোসাইটি হলো। ইন্টারনেটের মাধ্যমে সোসাইটিরা যুক্ত হলো একে অন্যের সঙ্গে।

ভূতের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপার ক্যাসেট রেকর্ডারের কারণে অনেক সহজ হয়ে গেল। একটি নির্জন বাড়ি, একটা ক্যাসেট রেকর্ডার।

এখন দেখা যাক বিজ্ঞান EVP নিয়ে কী বলে? EVP-কে সরাসরি ভুয়া বলে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না, কারণ ভূতের কথা তো রেকর্ড করা। বিজ্ঞান বলছে-

১. ক্যাসেট রেকর্ডারের রেডিও সিগন্যাল রিসিভার থাকে। রেকর্ডার মাঝেমধ্যে রেডিও সিগন্যাল রিসিভ করে বলে অশরীরী কণ্ঠ শোনা যায়।

২. ক্যাসেট রেকর্ডারের আশপাশে রাখা কোনো বস্তুও বেতারকেন্দ্রের সিগন্যাল ধরতে পারে। রেডিও সিগন্যাল রিসিভ করার যন্ত্র খুব সাধারণ। দুটি ধাতব বস্তু খুব কাছাকাছি এলেই হলো। সেমি কন্ডাকটার মানেই রেডিও সিগন্যাল রিসিভার। অনেকের দাঁতের ফিলিংও রেডিও সিগন্যাল রিসিভার হিসেবে কাজ করে। দাঁতের ভেতর থেকে রেডিও স্টেশনের কার্যক্রম শোনা যায়।

৩. EVP হিসেবে যেসব রেকর্ডিং পাওয়া যায়, তার সবই অর্থহীন হিজিবিজি শব্দ। মানুষ হিজিবিজি আওয়াজে অর্থ খুঁজে পায়। আকাশের মেঘের স্তূপ দেখে মানুষ কল্পনা করে এটা পাখি, এটা হাতি। শব্দের বেলাতেও একই রকম কল্পনা।

৪. পৃথিবীর আয়ানোস্ফেয়ারের অস্বাভাবিকতায় এক জায়গার শব্দ অন্য জায়গায় চলে যেতে পারে। কিছু কিছু EVP-র ক্ষেত্রে তা-ই হয়তো ঘটেছে।

নুহাশপল্লীতে তিন দিন কাটিয়ে আমি ঢাকায় ফিরলাম। হাত সচল হয়েছে। ‘মধ্যাহ্ন’ নামের উপন্যাস শুরু করেছি। ক্লান্তিহীন লেখা চলছে।

পাঠকরা নিশ্চয়ই জানতে আগ্রহী আমার অশরীরী কণ্ঠ রেকর্ড এক্সপেরিমেন্টের কী হলো? আমি বলতে চাইছি না। সব কিছু বলতে নেই।

‘The ghost of Roger Casement
Is beating on the door.’
W. B. yeats

No comments