ঋণ পরিশোধ - মোহাম্মদ নাসির আলী
তখন বাদশাহ আকবরের রাজত্বকাল। দিল্লিতে তাঁর রাজধানী। ইতিহাসে নিশ্চয়ই পড়েছ, বাদশাহ আকবর খুব বুদ্ধিমান ছিলেন, রাজ্য চালাবার দক্ষতাও তাঁর যথেষ্ট ছিল। যদিও নিজে তেমন বিদ্বান ছিলেন না, তবুও বিদ্বান ব্যক্তিত্বকে যথেষ্ট কদর করতেন তিনি। গুণী, বিদ্বান, বুদ্ধিমান লােকদের জাতি-ধর্ম বিচার না করে নিজের দরবারে এনে তিনি পরম সমাদরে ঠাই দিতেন। আবুল ফজল, মােল্লা দোপিয়াজা, রাজা মানসিংহ, খান খানান, কবি গঙ্গা, ফৈজী, তানসেন, বীরবল ও তোডরমল- এই নয় জন বিশেষ জ্ঞানীলােক ছিলেন তাঁর দরবারে। তাদের ভেতর গীতশিল্পী, চিত্রশিল্পী, রাজনীতিবিদ, হাস্যরসিক, ইতিহাসবিদ-সবাই ছিলেন। এক-এক বিষয়ে এক-একজন ছিলেন যেন একটি অমূল্য রত্ন। তাই তাঁদের নয় জনের দলটিকে বলা হত নবরত্ন।
বাদশাহ আকবরের এ-নবরত্নের এক জন ছিলেন এক গরিব ব্রাহ্মণ। তিনি হাস্যরসিক ছিলেন আর খুব গল্প বলে আসর জমাতে পারতেন। তাই যতই দিন যেতে লাগল বাদশাহ এ-ব্রাহ্মণের ওপর ততই খুশি হয়ে উঠলেন। একদিন তার গল্প শুনে তিনি বললেন : তােমার গল্প শুনে আজ যেমন হেসেছি, তেমন জীবনে কোনােদিন হেসেছি বলে তাে মনে পড়ে না। তুমি যা বখশিশ চাইবে, তা-ই দেব তােমাকে। কী চাও তুমি?
ব্রাহ্মণ তখন উঠে বাদশাহকে কুর্নিশ করে বললেন : শাহানশাহ, সত্যিই যদি গরিবের ওপর খুশি হয়ে থাকেন, তা হলে আপনার জল্লাদকে হুকুম করুন আমার পিঠে চাবুকের একশ ঘা দিতে। তা-ই হবে আমার মনের মতাে বখশিশ।
বাদশাহ এ-কথা শুনে তাজ্জব হয়ে চেয়ে রইলেন তার মুখের দিকে। আমীর-ওমরাহ যাঁরা হাজির ছিলেন তাঁরাও অবাক! কে কবে শুনেছে চাবুকের ঘা চেয়ে নিতে বখশিশের বদলে?
বাদশাহ পুনরায় বললেন : কী তুমি চাও ঠিক করে বল। চাবুকের ঘা কি কখনও বখশিশ হতে পারে? নিশ্চয়ই তুমি হাসি-তামাশা করছ।
ব্রাহ্মণ করজোড়ে বললেন : হুজুরের সঙ্গে হাসি-তামাশা করব তেমন বেয়াদব আমি নই। হয়তাে আমিই প্রথম ব্যক্তি যে জাঁহাপনার কাছে এমন আজব ধরনের বখশিশ চেয়ে নিতে পারি। কিন্তু আমি সত্যিই বলছি, একান্ত যদি আমাকে বখশিশ দিতে হয় তবে যা চেয়েছি তা-ই দিন। আর তা যদি না দিতে হয়, কিছুই দেবেন না জঁহাপনা।
বাদশাহ কিছুতেই রাজি হন না বেকসুর একটা লােকের পিঠে চাবুক মারার হুকুম দিতে। বখশিশ দিতে চেয়ে সাজা কী করে দেবেন?
দরবারে নানারকম লােকই ছিল। কেউ-কেউ ছিল হিংসুটে। অল্পদিন হল ব্রাহ্মণ এসেছেন শাহি দরবারে; কিন্তু এরই ভেতর তিনি বাদশাহর প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছেন। ব্রাহ্মণের এ-সৌভাগ্যে তারা তাকে হিংসে করত। হিংসেয় জ্বলেপুড়ে মরত। তাদেরই একজন টিস্পনী কাটল : হয়তাে বামুন ভেবেছে, চাবুকের পিটুনি খেয়ে ওর বুদ্ধি আরও খুলবে।
ব্রাহ্মণ তার দিকে ফিরে বললেন : সত্যিই তা-ই। সেজন্যই ওস্তাদ তাঁর শাগরেদদের বেতের পিটুনি দেন। কোনাে-না-কোনাে লােক পিটুনি খেয়েই শেখে। রােগ সারাতে পিটুনি যে কেমন ভালাে ওষুধ একটু পরেই আপনারা তা দেখতে পাবেন।
বাদশাহ দেখলেন উপায়ান্তর নেই। ব্রাহ্মণ নাছােড়বান্দা, কিছুতেই তাঁর কথার নড়চড় হতে দেবেন না।
অবশেষে নাচার হয়ে তিনি ব্রাহ্মণের পিঠে চাবুক মারতেই হুকুম দিলেন।
জল্লাদ এসে বেচারা ব্রাহ্মণকে চাবুক মারতে শুরু করল- শপাং শপাং। পাশ ঘা মারবার পরে হঠাৎ ব্রাহ্মণ হাত উঠিয়ে বলে উঠলেন : থামাে, থামাে, আর নয়।
বাদশাহও বললেন : থামাও থামাও, আর মেরাে না। এবার বুঝি বামুনের সুবুদ্ধির উদয় হয়েছে!
ব্রাহ্মণ বললেন : শাহানশাহ এবার আমার ঋণ পরিশােধের পালা। আমার এক বন্ধু আছে, তার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছি, আমার বখশিশের অর্ধেক আমি তাকে দেব। আমার সেই বন্ধুটিকে এবার এখানে আনতে অনুমতি দিন। সে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
ব্রাহ্মণের কথা শুনে আবার সবাই অবাক হয়ে রইল। বাদশাহ ভাবলেন, একটা রহস্য আছে এর ভেতর। তাই অনুমতি দিতে বিলম্ব হল না। ব্রাহ্মণ তখন বাইরে গিয়ে ডেকে নিয়ে এলেন দেউড়িতে পাহারারত বিশালদেহী এক দারােয়ানকে। এনে বললেন ; এই আমার সেই বন্ধু, শাহানশাহ। আমার বখশিশের অর্ধেক প্রাপ্য এ বন্ধুটির।
দারােয়ানকে দেখে বাদশাহ আকবর তাজ্জব হয়ে গেলেন। ব্যাপার কী! তাঁর দারােয়ান কী করে এ বিদেশী ব্রাহ্মণের বন্ধু হতে পারে?
ব্রাহ্মণ তখন সব কথা বুঝিয়ে বলতে লাগলেন : দিল্লি থেকে অনেক দূরে কালপী নামক এক গ্রামে আমার বাস। অত্যন্ত গরিব আমি। বরাবর শাহানশাহর গুণগ্রাহিতার কথা শুনে আসছি। কিন্তু শাহি দরবারে হাজির হবার ভাগ্য বা সুবিধা কখনও হয়নি। একবার তাই ভারি ইচ্ছে হল দিল্লি আসতে। তারপর সত্যি একদিন পায়ে হেঁটে দিল্লি এসে হাজির হলাম। অনেক দূর হেঁটে অত্যন্ত ক্লান্ত হয়েছি, কিন্তু মনে তবু অপার আনন্দ, এতদিনে মনের বাসনা পূর্ণ হল। দিল্লি এলাম। একপা-দুপা করে শাহি-মহলের দিকে ভয়ে-ভয়ে এগােচ্ছি। দেউড়ির কাছে আসতেই পথ আগলে দাঁড়াল হুজুরের বিশালবপু এই দারােয়ান।
ধমক দিয়ে বলল : কোথায় যাচ্ছ? আমি চমকে গেলাম। মিনতি করে বললাম : অনেক দূরদেশ থেকে পায়ে হেঁটে এসেছি বাবা, শাহানশাহ আকবরকে একটিবার চোখে দেখতে। আমার এ-কথায় দারােয়ানের মন ভিজল না। সে অনেক টাকা বখশিশ চেয়ে বসল। বখশিশ না পেয়ে কাউকেই নাকি সে দরবারে ঢুকতে দেয় না। এদিকে আমার সঙ্গে নেই একটিও কানাকড়ি। কী বখশিশ দেব দারােয়ানকে? অবশেষে ভাবতে-ভাবতে হঠাৎ এক বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়। বলালাম : ট্র্যাকে যে কিছু নেই তাে দেখতেই পাচ্ছ। তবে হ্যাঁ, আশা আছে বাদশাহর দরবারে ঢুকে তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারলে কিছু এনাম নিশ্চয়ই পাব। যা-কিছু আমি পাই তার অর্ধেক তােমাকে দেব বলে ওয়াদা করছি। আমার এ-সঙ্গত প্রভাবে তুজুরের দয়ালু দারােয়ান রাজি হল। রাজি হয়ে আমাকে দরবারে ঢুকতে দিল। সে-অবধি দরবারে যাতায়াত করছি। এতদিন হুজুরের নেকনজর আমার ওপর পড়েনি বলে ঋণ শােধেরও কোনাে উপায় হয়নি। এ দারােয়ানের দিন কেটেছে আশায় আশায়। তুজুরের দয়ায় আজ আমার সে-ঋণ পরিশােধের সুযােগ এসেছে।
এটুকু বলে ব্রাহ্মণ হতভম্ব দারােয়ানের দিকে চেয়ে বললেন : বাদশাহ খুশি হয়ে আজ আমাকে একশ চাবুকের ঘা বখশিশ দিতে রাজি হয়েছেন। তার অর্ধেক আমি নিয়েছি। এবার বাকি অর্ধেক তােমাকে দেওয়ার পালা।
ব্রাহ্মণের কথা শুনে উপস্থিত আরও অনেকে দারােয়ানের নামে নালিশ করল। তারাও দারােয়ানকে বখশিশ দিয়েই দরবারে ঢুকেছে।
এসব শুনে আকবর গেলেন ভীষণ চটে। তিনি হুকুম দিলেন : ওকে আচ্ছা করে পাশ ঘা চাবুক মেরে রাজ্যের বাইরে তাড়িয়ে দাও।
চাবুকের পিটুনি দেওয়ার কথা শুনে যে-লােকটা ব্রাহ্মণকে ঠাট্টা করছিল, এবার তার দিকে ফিরে ব্রাহ্মণ বললেন : চাবুকের ঘা খেয়ে মানুষের জ্ঞানবুদ্ধি বাড়ে কিনা, দারােয়ানকে দেখে শিখে নিন।
সেদিনই দারােয়ানকে চাবুক মেরে তাড়িয়ে দেওয়া হল। এ- ব্রাহ্মণ লােকটি কে তােমরা বােধহয় বুঝতে পেরেছ। ইনিই বিখ্যাত হাস্যরসিক বীরবল। দরবারের অনেকেই তাকে ভালােবাসত। বাদশাহ্ সেদিন থেকে তাঁকে নবরত্নের এক জন করে নিলেন। তাকে অনেক টাকা বখশিশ দিলেন।
Post a Comment