শার্লক হোমস: দি অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য ইঞ্জিনিয়ার্স থাম্ব
শার্লক হোমসের সমীপে দুটো কেস আমি নিজেই নিয়ে এসেছিলাম। একটা মি. হেথার্লির বুড়ো আঙুল সংক্রান্ত, আর একটা কর্নেল ওয়ার্বার্টনের পাগলামি। দুটির মধ্যে অনেক বেশি অদ্ভুত আর নাটকীয় ছিল প্রথমটা।
১৮৮৯ সালের গরমকালের ঘটনা। সবে বিয়ে করেছি। বেকার স্ট্রিটের বাসা ছেড়ে চলে এসেছি, ডাক্তারি বেশ জমে উঠেছে। হোমসের কাছে প্রায়ই যাই, ওর বোহেমিয়ান স্বভাবটা ভাঙবার চেষ্টা করি।
ডাক্তারি করতাম প্যাডিংটন স্টেশনের কাছে। কাছেই স্টেশনের অনেক কর্মচারী আসত অসুখ সারাতে। এদের মধ্যে একজনের একটা ছিনেজোঁক যন্ত্রণা এমনভাবে সারিয়ে দিয়েছিলাম যে ভদ্রলোক অষ্টপ্রহর আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে থাকতেন। প্রায় রুগি পাঠিয়ে দিতেন আমার কাছে।
একদিন সকাল সাতটার একটু আগে পরিচারিকা এসে বললে স্টেশন থেকে দুজন লোক এসেছেন। তাড়াতাড়ি জামাকাপড় পরে নেমে এলাম। জানি তো, রেলের কেস কখনোই সামান্য হয় না দেরি করা যায় না।
সিঁড়ি দিয়ে নামছি, এমন সময়ে ঘর থেকে আমার সেই পূর্বপরিচিত গার্ড ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে দিলেন।
ফিসফিস করে বললেন, এনেছি ওঁকে। ভালোই আছেন।
এমনভাবে কথাটা বললেন যেন একটা অদ্ভুত প্রাণীকে এইমাত্র বন্ধ করে এলেন বসার ঘরে।
বললাম, কী ব্যাপারটা বলবেন তো?
নতুন রুগি। যাতে পালিয়ে না-যান, তাই নিজেই নিয়ে এলাম। কাজ শেষ হল। এখন চলি, বলে ধন্যবাদ জানানোর ফুরসত পর্যন্ত না-দিয়ে উধাও হলেন গার্ড সাহেব।
ঢুকলাম কনসাল্টিং রুমে। দেখলাম, টেবিলের পাশে বসে এক যুবক। বয়স খুব জোর পঁচিশ। মুখ ফ্যাকাশে, উদবেগে অস্থির। একটা হাতে রক্তভেজা রুমাল জড়ানো।
বললেন, ডক্টর, সাতসকালে টেনে তোলার জন্য দুঃখিত। কাল রাত্রে একটা সিরিয়াস অ্যাক্সিডেন্টে পড়েছিলাম। ভোরের ট্রেনেই চলে এসেছি। স্টেশনে ডাক্তারের খোঁজ করেছিলাম–এক ভদ্রলোক এখানে নিয়ে এলেন। আমার কার্ড টেবিলেই আছে।
চোখ বুলোলাম কার্ডে।
মি. ভিক্টর হেথার্লি
হাইড্রলিক ইঞ্জিনিয়ার
১৬এ, ভিক্টোরিয়া স্ট্রিট (চারতলা)
লাইব্রেরি-চেয়ারে বসতে বসতে বললাম, বসিয়ে রাখার জন্যে কিছু মনে করবেন না। সারারাত ট্রেন জার্নির ধকল তো কম নয়। বড্ড একঘেয়ে লাগে।
না না, একঘেয়ে রাত একে বলে না, বলতে বলতে পাগলের মতো হাসতে লাগলেন ভদ্রলোক। সে কী হাসি! সারাশরীর দুলে দুলে উঠতে লাগল। দেখেই শঙ্কিত হল আমার ডাক্তারি সত্তা।
থামুন! তাড়াতাড়ি এক গেলাস জল এগিয়ে দিলাম বটে, কিন্তু কাজ হল না। বিরাট সংকট পেরিয়ে আসার পরেই যেমন হিস্টিরিয়ায় পেয়ে বসে অনেককে, উনিও সেইভাবে উন্মাদের হাসি হেসে চললেন আপন মনে। আস্তে আস্তে অবশ্য সামলে নিলেন নিজেকে।
বললেন জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে, আচ্ছা আহাম্মক তো আমি।
জলের গেলাসে একটু ব্র্যান্ডি ঢেলে খাইয়ে দিতেই রং ফিরে এল ভদ্রলোকের রক্তহীন গালে।
আঃ, বাঁচলাম! ডক্টর, এবার আমার আঙুলটা, মানে, আঙুলটা, যেখানে থাকার কথা–সেই জায়গাটা দেখুন।
বলে, খুলে ফেললেন রক্তমাখা রুমালের পট্টি। আমার মতো শক্ত ধাতের মানুষও শিউরে উঠল সেই দৃশ্য দেখে। বীভৎস! চারটে আঙুলই কেবল দেখা যাচ্ছে বুড়ো আঙুলটার জায়গায় কেবল স্পঞ্জের মতো দগদগে মাংস আর হাড় ঠেলে বেরিয়ে আছে–গোড়া থেকে কুপিয়ে বা ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ।
সর্বনাশ! নিশ্চয় খুব রক্ত বেরিয়েছে?
তা বেরিয়েছে। অজ্ঞানও হয়ে গিয়েছিলাম। অনেকক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখলাম তখনও রক্ত পড়ছে। তাই রুমাল দিয়ে কবজি পেঁচিয়ে ধরে গাছের সরু ডাল দিয়ে পাকিয়ে পাকিয়ে রক্তপড়া বন্ধ করেছি।
চমৎকার! সার্জন হওয়া উচিত ছিল আপনার।
তরল পদার্থের গতিবিজ্ঞান জানি বলেই পেরেছি। হাইড্রলিক্স আমার বিষয়।
ক্ষতস্থান পরীক্ষা করে বললাম, খুব ভারী আর ধারালো কোনো অস্ত্রের কোপ পড়েছে মনে হচ্ছে?
মাংস কাটা ছুরি বলতে পারেন।
অ্যাক্সিডেন্ট?
মোটেই না।
বলেন কী! খুনের চেষ্টা নাকি?
তার চাইতেও বেশি।
ভয় দেখিয়ে দিলেন দেখছি।
স্পঞ্জ দিয়ে ক্ষতস্থান ধুয়ে মুছে ব্যান্ডেজ করে দিলাম। যন্ত্রণায় ঠোঁট কামড়ে চুপ করে শুয়ে রইলেন ভদ্রলোক।
কাজ শেষ হলে বললাম, এ নিয়ে আর কথা নয়–নার্ভ সইতে পারবে না।
তা কি হয়? এখুনি গিয়ে সব পুলিশকে বলতে হবে। বুড়ো আঙুল নেই বলেই হয়তো বিশ্বাস করবে অসাধারণ এই কাহিনি। বিশ্বাস করলেও রহস্য ভেদ করতে পারবে কি না সন্দেহ–কেননা সূত্র তো জোগাতে পারব না।
রহস্যের গন্ধ পেয়ে নিমেষে জাগ্রত হল আমার কৌতূহল। বললাম, আরে মশাই, কুট সমস্যার সমাধান চান তো আমার বন্ধু শার্লক হোমসের কাছে আগে যান না কেন।
নিশ্চয় যাব। পুলিশকেও আমার দরকার।
তাহলে চলুন।
বসবার ঘরে বসে পাইপ টানছিল শার্লক হোমস। প্রাতরাশ খাওয়ার আগে যে-পাইপ খায়, সেই পাইপ। তার মানে, ব্রেকফাস্ট এখনও খাওয়া হয়নি। টাইমস কাগজ মেলে ধরে হারানো-প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশ কলমের খবর পড়ছিল একমনে।
একসঙ্গে খেলাম তিনজনে। নবাগতকে একটা সোফায় শুইয়ে হাতের কাছে জল মিশোনো ব্র্যান্ডির গেলাস রাখল।
বললে, মি. হেথার্লি, আপনার অভিজ্ঞতা যে মামুলি অভিজ্ঞতা নয়, তা আপনাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ক্লান্তি বোধ করলে গেলাসে চুমুক দেবেন। বলুন এবার কী হয়েছে।
মি. হেথার্লি বললেন, বেশি সময় নেব না আপনার। ক্লান্তি কেটে গেছে ডাক্তারের চিকিৎসায়। পেটে খাবার পড়ায় এখন বেশ চাঙা বোধ করছি।
আমি অনাথ ব্যাচেলর। একলা থাকি। পেশায় হাইড্রলিক ইঞ্জিনিয়ার। সাত বছর কাজ করেছি একটা কোম্পানিতে। অভিজ্ঞতা প্রচুর হয়েছে। তারপর বাবার মৃত্যুর পর হাতে কিছু টাকা আসায় চাকরি ছেড়ে দিলাম। ঠিক করলাম স্বাধীনভাবে ব্যাবসা করব। ঘর নিলাম ভিক্টোরিয়া স্ট্রিটে।
দু-বছর স্রেফ মাছি তাড়ালাম বলতে পারেন। রোজগার প্রায় শূন্য। হতাশ হয়ে পড়লাম শেষকালে। বেশ বুঝলাম, আমার দ্বারা ব্যাবসা হবে না।
গতকাল কেরানি এসে খবর দিলে, এক ভদ্রলোক দেখা করতে চান আমার সঙ্গে। ভিজিটিং কার্ডে দেখলাম ভদ্রলোকের নাম–কর্নেল লাইস্যান্ডার স্টার্ক।
কর্নেল ঘরে ঢুকলেন প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই। মাঝারি আকার, কিন্তু ভীষণ রোগা। মুখটা সরু হয়ে নাক চিবুকে ঠেকেছে। চামড়া ঠেলে গালের হনু উঁচু হয়ে রয়েছে। কিন্তু রু নন। চোখ উজ্জ্বল, পদক্ষেপ চটপটে। বয়স তিরিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে।
জার্মান উচ্চারণে বললেন, মি. হেথার্লি, আপনি শুধু দক্ষ নন, গোপন কথা গোপনে রাখতে পারেন–এই সুপারিশ শুনেই দৌড়ে এসেছি আপনার কাছে।
তোষামোদে গলে গেলাম আমি, কে বলেছে বলুন তো?
উনিই বললেন–নামটা নাই-বা শুনলেন। তবে শুনেছি আপনার তিনকুলে কেউ নেই, আপনি বিয়ে করেননি, লন্ডনে একলা থাকেন।
সবই তো সত্যি, বললাম আমি, কিন্তু তার সঙ্গে আমার কাজের কী সম্পর্ক বুঝছি না।
সম্পর্ক আছে বই কী, এখুনি শুনবেন। কিন্তু কাজটা অত্যন্ত গোপনীয়। আপনি যদি ফ্যামিলি নিয়ে থাকতেন, তাহলে এ-গোপনীয়তা আপনার কাছে আশা করতাম না।
কথা দিচ্ছি যা বলবেন, তা কেউ জানবে না।
সন্দিগ্ধ চোখে যেন আমার ভেতর পর্যন্ত দেখে নিলেন ভদ্রলোক। এ-রকম তীক্ষ্ণ্ণ চাহনি কখনো দেখিনি।
কথা দিচ্ছেন?
দিচ্ছি।
হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠলেন কর্নেল। বোঁ করে ছুটে গেলেন দরজার কাছে। এক ঝটকায় পাল্লা খুলে দেখলেন, বাইরে কেউ নেই।
ফিরে এসে বললেন, কেরানিগুলো মাঝে মাঝে বড় আড়ি পাতে। যাক এবার কাজের কথায় আসা যাক। বলে চেয়ারটা আমার কাছে সরিয়ে এনে আবার সেইরকম জিজ্ঞাসু চিন্তাবিষ্ট চোখে চেয়ে রইলেন আমার পানে।
মাংসহীন লোকটার বিচিত্র আচরণে একটু ভয় পেলাম। মনটা বিদ্রোহী হল। অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলে ফেললাম–যা বলবার, তাড়াতাড়ি বলুন। আমার সময়ের দাম আছে।
উনি বললেন, এক রাতে পঞ্চাশ গিনি রোজগার করতে চান?
নিশ্চয়ই।
কাজটা আসলে ঘণ্টাখানেকের। একটা হাইড্রলিক স্ট্যাম্পিং মেশিন বিগড়েছে। গোলমালটা কোথায় কেবল দেখিয়ে দেবেন।
খুবই সামান্য কাজ। দক্ষিণাটা সেই তুলনায় ভালোই।
তা ঠিক। আজ রাতেই শেষ ট্রেনে তাহলে আসছেন?
কোথায়?
আইফোর্ডে। রীডিং স্টেশন থেকে সাত মাইল দূরে। প্যাডিংটন থেকে ট্রেনে চাপলে পৌঁছে যাবেন সোয়া এগারোটায়।
বেশ যাব।
আমি গাড়ি নিয়ে আসব স্টেশনে। রাতটা ওখানেই কাটাবেন।
ফিরতি ট্রেন পাব না?
শেষ ট্রেনে যেতে বলছি কারণ আছে বলেই। এইসব অসুবিধের জন্যেই পঞ্চাশ গিনি দিচ্ছি আপনার মতো অল্পবয়সি অজানা মানুষকে। এখনও ভেবে দেখুন।
ভেবে দেখলাম। পঞ্চাশ গিনি ছাড়া যায় না। বললাম, ঠিক আছে, আপনার কথাই রইল। কিন্তু একটু খুলে বলুন কী করতে হবে আমাকে।
কেউ আড়ি পাতছে না তো?
না, না। নির্ভয়ে বলুন।
জানেন নিশ্চয় সাজিমাটি জিনিসটা দারুণ দামি। ইংলন্ডের দু-এক জায়গা ছাড়া পাওয়া যায় না।
শুনেছি!
কিছুদিন আগে রীডিং থেকে মাইল দশেকের মধ্যে ছোট্ট একটা জায়গা কিনেছিলাম। কপালজোরে সাজিমাটির স্তর আবিষ্কার করলাম সেই জমিতে। তারপর দেখলাম, আমার জমিতে যে-স্তর আছে, তার চাইতেও বেশি স্তর আছে ডাইনে বাঁয়ে আমার প্রতিবেশীদের জমিতে। কিন্তু তারা জানে না সোনার খনির চাইতে দামি জিনিস রয়েছে মাটির তলায়। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করলাম, আমার জমি থেকে প্রথমে কিছু সাজিমাটি তুলে দু-পয়সা রোজগার করব! সেই টাকায় প্রতিবেশীদের জমি কিনে নেব। গোপনে কাজ সারার জন্যে একটা হাইড্রলিক প্রেস কিনেছি। কিন্তু পাছে কথাটা পাঁচ কান হয়, তাই কাউকে কিছু জানাইনি। আপনাকেও বলব, আইফোর্ড যাচ্ছেন আজ রাতে কাউকে বলবেন না।
আমি বললাম–সবই বুঝলাম। শুধু বুঝলাম না সাজিমাটি তোলার জন্যে হাইড্রলিক প্রেসের দরকার কী। ওটা তো গর্ত খুঁড়ে তুলতে হয়।
আমাদের একটা নিজস্ব পদ্ধতি আছে। মাটি চেপে ইট বানিয়ে পাচার করি যাতে কেউ জানতে না-পারে, উঠে দাঁড়ালেন কর্নেল। আপনাকে সব কথাই বললাম। আইফোর্ডে সোয়া এগারোটায় তাহলে আসছেন?
নিশ্চয়।
কাকপক্ষীও যেন না-জানে,বলে শেষবারের মতো আবার সেই অন্তর্ভেদী, জিজ্ঞাসু চাহনি দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ আমাকে যেন এফোঁড়-ওফেঁড় করলেন ভদ্রলোক। তারপর করমর্দন করে এস্তে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।
খুব অবাক হলাম কর্নেলের প্রস্তাবে। মাঝরাতে নিয়ে যেতে চান, কাকপক্ষীকে জানাতে চান না, দশগুণ পারিশ্রমিক দিতে চান। সাজিমাটির গল্পটাও যেন নেহাতই গল্প–বিশ্বাস করতে মন চায় না। যাই হোক, খেয়ে নিয়ে রওনা হলাম ট্রেন ধরতে।
আইফোর্ড পৌঁছোলাম এগারোটার পর। প্ল্যাটফর্মে নামলাম কেবল আমিই। লণ্ঠন হাতে ঘুমন্ত একজন কুলি ছাড়া কাউকে দেখলাম না। বাইরে আসার পর দেখলাম অন্ধকারে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে কর্নেল। আমার হাত খামচে ধরে গাড়ির মধ্যে টেনে তুললেন, জানলা বন্ধ করে দিলেন, তক্তায় টোকা মারতেই ঘোড়া ছুটল ঊর্ধ্বশ্বাসে।
একটাই ঘোড়া? শুধোল হোমস।
রংটা দেখেছিলেন?
তামাটে।
ক্লান্ত ঘোড়া?
না, না, বেশ তাজা, চকচকে।
তারপর?
গাড়ি ছুটল প্রায় এক ঘণ্টা। কর্নেল বলেছিলেন সাত মাইল পথ। আমার তো মনে হল বারো মাইল। রাস্তা খুব খারাপ। লাফাতে লাফাতে যাচ্ছিল গাড়ি। ওপরদিকে উঠলে বুঝতে পারতাম না–রাস্তা এবড়োখেবড়ো থাকার জন্যে কেবল লাফাচ্ছিল। জানলা বন্ধ থাকায় কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। কর্নেল কথা বলছিলেন না। সমানে অন্তর্ভেদী চোখে চেয়ে ছিলেন আমার দিকে। তারপর কাকর বিছানো পথের ওপর দিয়ে এসে গাড়ি থামল। আমরা নামলাম। বাড়িটাকে ভালো করে দেখবার আগেই ভেতরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হল।
ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কর্নেল দেশলাই খুঁজতে লাগলেন। এমন সময়ে অন্ধকারের মধ্যে আলো দেখা গেল। ল্যাম্প হাতে এক ভদ্রমহিলা। খুব সুন্দরী। পরনের পোশাকটিও দামি। বিদেশি ভাষায় কী যেন জিজ্ঞেস করল কর্নেলকে। একটিমাত্র ছোট্ট শব্দে জবাব দিলেন কর্নেল। শুনেই এমন আঁতকে উঠল মেয়েটি যে আর একটু হলেই ল্যাম্প খসে পড়ে যেত হাত থেকে। কর্নেল কানে কানে কী বলে তাকে ঠেলে বার করে দিলেন ঘরের বাইরে–ল্যাম্প নিয়ে ফিরে এলেন আমার কাছে।
পাশের ঘরে একটা দরজা খুলে আমাকে বসতে বললেন সেখানে। ঘরে একটা গোল টেবিলের ওপর ছড়ানো কতকগুলো জার্মান বই। ল্যাম্পটা একটা হার্মোনিয়ামের ওপর রেখে এখুনি আসছি বলে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন ভদ্রলোক।
জার্মান বইগুলোর মধ্যে দুটো বই বিজ্ঞানের, বাকিগুলো কবিতার। জানলা খুলতে গিয়ে দেখি আড়াআড়িভাবে খিল দিয়ে আঁটা খড়খড়ি। খোলে কার সাধ্য। আইফোর্ড থেকে মাইল দশেক দূরে এসেছি ঠিকই কিন্তু পুবে, না পশ্চিমে, উত্তরে, না দক্ষিণে বোঝার সাধ্য নেই। কোথাও কোনো আওয়াজ নেই। চরাচর নিস্তব্ধ। বাড়ি নিস্তব্ধ। শুধু একটা সেকেলে ঘড়ি চলার টিক টিক আওয়াজ আসছে ভেতর থেকে।
আচমকা নিঃশব্দে খুলে গেল ঘরের দরজা। ভয়ার্ত মুখে ল্যাম্প হাতে ঘরে ঢুকল সুন্দরী সেই মহিলাটি। এমনভবে পাঙাসপানা মুখে বার বার পেছনে চাইতে লাগল যে আতঙ্কে অবশ হয়ে এল আমার হৃৎপিণ্ড।
আঙুল নেড়ে আমাকে কথা বলতে বারণ করে ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে বললে, আমি হলে পালাতাম। এখানে থাকতাম না।
কিন্তু ম্যাডাম, মেশিন না-দেখে যাই কী করে?
থেকে কোনো লাভ নেই। এই দরজা দিয়ে পালান। আমি মুখ টিপে হাসছি দেখে এগিয়ে এসে দু-হাত এক করে বললে চাপা গলায়, ভগবানের নামে বলছি, এখুনি পালান–আর দেরি করবেন না!
আমি আবার একটু একরোখা টাইপের বাধা পেলে গোঁ আরও বেড়ে যায়। এসেছি পঞ্চাশ গিনি রোজগার করতে এতটা পথ বেরিয়ে অনেক ধকল সয়ে–খামোকা ফিরে যেতে যাব কেন? হাতের কাজ শেষ না-করেই বা পালাতে যাব কেন? মহিলাটির মাথায় ছিট আছে নিশ্চয়। তাই মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলাম, আমি যাব না। আবার কাকুতিমিনতি করতে যাচ্ছে ভদ্রমহিলা, এমন সময়ে দড়াম করে দরজা বন্ধ করার আওয়াজ হল ওপরতলায়। সিঁড়িতে শোনা গেল অনেকগুলো পায়ের আওয়াজ। কান খাড়া করে শুনেই নিঃসীম নৈরাশ্যে দু-হাত শূন্যে ছুঁড়ে চকিতে নিঃশব্দে ফের অন্ধকারেই মিলিয়ে গেল ভদ্রমহিলা।
ঘরে ঢুকলেন কর্নেল লাইস্যান্ডার স্টার্ক আর একজন বেঁটে মোটা ভদ্রলোক। এঁর নাম ফার্গুসন–আলাপ করিয়ে দেওয়ার পর জানলাম। ভদ্রলোকের থুতনিতে মাংস ডবল ভাজ খেয়ে ঝুলছে–তার ওপর চিঞ্চিলা-জন্তুর কোমল ধূসর রোমের মতো দাড়ি।১৩
কর্নেল বললেন, মি. ফার্গুসন আমার ম্যানেজার আর সেক্রেটারি। ভালো কথা, দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে গেছিলাম না?
গুমোট লাগছিল বলে খুলেছি, বললাম আমি।
সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে কর্নেল বললেন–তাহলে চলুন মেশিনটা দেখে আসা যাক।
টুপিটা পরে নিই।
না, না টুপি পরার দরকার নেই। মেশিন বাড়ির মধ্যেই আছে।
সে কী কথা। বাড়ির মধ্যে সাজিমাটি খোঁড়েন নাকি?
আরে না। এখানে শুধু চেপেচুপে ইট বানাই। অত কথায় দরকার নেই। আপনি শুধু মেশিনটা দেখে বলে দিন গলদটা কোথায়।
ল্যাম্প হাতে কর্নেল চললেন আগে, আমি আর ফার্গুসন পেছনে। বাড়ি তো নয়, একটা গোলকধাঁধা। ঘোরানো সিঁড়ি, নীচু দরজা, সরু গলির যেন আর শেষ নেই। ওপরতলায় এ কার্পেট বা ফার্নিচারের চিহ্নমাত্র নেই। পলেস্তারা খসা দেওয়ালে ছাতলা পড়েছে। ভদ্রমহিলার হুঁশিয়ারিতে কর্ণপাত না-করলেও চোখ রেখেছি দুজনের ওপর বাইরে যদূর সম্ভব নির্বিকার। ফাগুসন লোকটাকে মনে হল স্বদেশবাসী। বেশ মুষড়ে রয়েছে যেন, কথা একদম বলছে না।
অবশেষে একটা ছোট্ট নীচু দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন কর্নেল। ঘরখানা চৌকোনা। এত ছোটো যে একসঙ্গে তিনজনের ঠাঁই হয় না। কাজেই ফার্গুসন রইলেন বাইরে–আমি গেলাম কর্নেলের পেছন পেছন।
উনি বললেন–আমরা এখন হাইড্রলিক প্রেসের মধ্যে দাঁড়িয়ে। পায়ের তলা ধাতুর। মেঝের সঙ্গে চিঁড়েচেপটা হয়ে যাব যদি এখন কেউ মেশিনটা চালিয়ে দেয়–কেননা মাথার ওপরকার ছাদটা আসলে পিস্টনের তলার দিক—হু-হু করে নেমে আসবে নীচে কয়েক টন চাপ দিয়ে। মেশিনটা আগের মতো মসৃণভাবে আর চলছে না–শক্তি কমে গেছে। কেন এ-রকম হচ্ছে, সেইটুকুই কেবল দেখিয়ে দিন।
ল্যাম্পটা হাতে নিয়ে মেশিন পরীক্ষা করলাম। সত্যিই দানবিক মেশিন। বাইরে গিয়ে হাতল টিপে মেশিন চালালাম। সোঁ-সোঁ আওয়াজ শুনেই বুঝলাম লিক আছে কোথাও। দেখলাম, পাশের একটা সিলিন্ডার থেকে জল বেরিয়ে যাচ্ছে। একটা রাবারের পটি শুকিয়ে যাওয়ায় ড্রাইভিং-রড ঠিকমতো কাজ করছে না। শক্তির ঘাটতি দেখা দিয়েছে সেই কারণেই। কর্নেলকে দেখিয়ে দিলাম গলদটা এবং বুঝিয়ে দিলাম কীভাবে মেরামত করতে হবে। কান খাড়া করে সব শুনলেন তিনি। তারপর আমি ভেতরে ঢুকলাম নিজের কৌতূহল চরিতার্থ করার জন্যে। দেখলাম, দেওয়াল কাঠের কিন্তু মেঝে একখানা বিরাট লোহার পাত দিয়ে তৈরি। সাজিমাটি চেপে ইট বানানোর গল্পটা যে একেবারেই কল্পিত, তার প্রমাণ রয়েছে মেঝেতে। একটা ধাতুর স্তর লেগে রয়েছে সেখানে। এইরকম একটা দানবিক মেশিন দিয়ে সাজিমাটি চেপে ইট বানানো তাহলে হয় না। খুঁটিয়ে দেখছি ধাতুর স্তরটা কী, এমন সময়ে অস্ফুট জার্মান বিস্ময়োক্তি শুনলাম পেছনে। সচমকে ফিরে দেখি, বিবর্ণ মাথা হেঁট করে আমার কাণ্ড দেখছেন কর্নেল।
কী করছেন?
মাথায় রক্ত চড়ে গেল। ভুলিয়ে আনার জন্যে, চিৎকার করে বললাম, সাজিমাটির তারিফ করছি। সত্যি কথাটা বললে আরও ভালো পরামর্শ দিতে পারতাম কিন্তু।
বলেই বুঝলাম ভুল করেছি। মুখটা কঠিন হয়ে গেল কর্নেলের, নরকের আগুন জ্বলে উঠল দুই চোখে।
এখুনি জানবেন সত্যি কথাটা, বলেই এক লাফে বেরিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে চাবি দিয়ে দিলেন কর্নেল। পাল্লায় লাথি ঘুসি মেরে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে চললাম আমি।
আচমকা নৈঃশব্দ্য খান খান করে দিয়ে জাগ্রত হল হাতল টেপবার ঝনৎকার আর জল বেরিয়ে যাওয়ার সোঁ-সোঁ শব্দ। মেশিন চালিয়ে দিয়েছেন কর্নেল। কালো ছাদটা ঝাঁকি মেরে নামতে শুরু করেছে নীচের দিকে। মেঝে পরীক্ষা করার সময়ে ল্যাম্পটা মেঝের ওপর রেখেছিলাম বলে হাতটা খালি ছিল। দু-হাতে পাল্লা খোলার চেষ্টা করলাম, কাকুতিমিনতি করলাম। কিন্তু ফল হল না। হাত বাড়ালেই তখন ছাদ ছুঁতে পারছি–মানে এক মিনিট লাগবে আমাকে মাংসপিণ্ড বানাতে। মাথা তুলে যখন দাঁড়াতেও পারছি না, ভাবছি শুয়ে পড়লেই বরং শিরদাঁড়া সমেত একেবারেই থেতলে যাব। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মরার চাইতে ভালো। এমন সময়ে হৃৎপিণ্ড তুড়ুক নাচ নেচে উঠল একটা জিনিস দেখে।
কাঠের দেওয়াল একটু একটু ফাঁক হয়ে গেল। একটা হলদে আলোর আভা দেখা গেল। দরজা! লাফ দিয়ে সেঁধিয়ে গেলাম ফাঁকটা দিয়ে। দরজাও বন্ধ হল, পেছনে ল্যাম্প গুড়ো করে ধাতুতে ধাতুতে মিলে যাওয়ায় ঝন ঝনাৎ শব্দও শুনলাম।
সম্বিৎ ফিরে পেলাম কবজিতে টান পড়ায়। ডান হাতে ল্যাম্প ধরে বাঁ-হাতে আমার কবজি ধরে হিড় হিড় করে টানছে পরমাসুন্দরী সেই মহিলাটি। আমি পড়ে আছি একটা সংকীর্ণ গলির পাথুরে মেঝেতে।
এসে পড়বে ওরা! তাড়াতাড়ি।
এবার আর অন্যথা হল না। হাঁচড়পাঁচড় করে দাঁড়িয়ে উঠে ছুটলাম তার পেছনে। গলিখুঁজি পেরিয়ে ছুটতে ছুটতে দুজন পুরুষের উচ্চকণ্ঠের চিৎকার শুনলাম। ভদ্রমহিলা ঘাবড়ে গেলেন। ঝট করে দরজা খুলে ঢোকালেন একটা শোবার ঘরে। জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে চাদের আলো।
লাফান! আর পথ নেই!
মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই সরু গলির অপর প্রান্তে দেখা গেল ল্যাম্প হাতে ঝড়ের মতো দৌড়ে আসছেন কর্নেল তার এক হাতে মাংসকাটা কসাইয়ের ছুরি। আমি ততক্ষণে জানলার গোবরাট ধরে বাইরে ঝুলে পড়েছি–কিন্তু ভদ্রমহিলাকে ফেলে পালাতে মন চাইছে না। যদি দেখি ওর ওপর অত্যাচার চলছে, তাহলে প্রাণ যায় যাক, উঠে যাব ঘরে।
মহিলাটিকে ঠেলে সরিয়ে দিতে গেলেন কর্নেল কিন্তু পারলেন না। তাকে আঁকড়ে ধরে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ইংরেজিতে ভদ্রমহিলা বললেন, ফ্রিৎস! ফ্রিৎস! গতবার তুমি কথা দিয়েছিলে! আর হবে না বলেছিলে। ওঁকে ছেড়ে দাও! উনি কাউকে কিছু বলবেন না!
তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে এলিজ? আমাদের সবাইকে শেষ করে ছাড়বে ওই লোক। অনেক বেশি দেখে ফেলেছে। সরো! বলে এক ধাক্কায় ভদ্রমহিলাকে সরিয়ে দিয়ে জানলার সামনে ছিটকে এসে কোপ মারলেন ছুরি দিয়ে। আমি সবে গোবরাট থেকে হাত তুলতে গেছি, এমন সময়ে কোপ পড়ল গোবরাটে–একটা সাংঘাতিক তনু-মন-অবশ-করা যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ল অণুতে পরমাণুতে। আমি পড়ে গেলাম বাগানে।
পড়ে গেলেও জ্ঞান হারাইনি। উঠেই দৌড়োতে লাগলাম ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে। অনেকটা মুহ্যমানের মতো। কান ঝাঁ-আঁ করছে, মাথার মধ্যে যেন লক্ষ ঝঝর বাজছে। এই সময়ে যন্ত্রণাটা আবার চিড়িক দিয়ে ওঠায় বুড়ো আঙুলের দিকে তাকাতে গিয়ে দেখি আঙুলটাই নেই! দেখেই মাথা ঘুরে গেল। রুমাল দিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়াটা বন্ধ করতে গিয়ে আরও যেন কীরকম হয়ে গেলাম। গোলাপ ঝোঁপের মধ্যে টলে পড়ে গেলাম।
নিশ্চয় অনেকক্ষণ জ্ঞান হারিয়ে ছিলাম। জ্ঞান ফিরে এলে দেখলাম চাদ চলে গেছে, ভোরের আলো দেখা দিয়েছে। সবচেয়ে অবাক কাণ্ড আমি পড়ে আছি বড়োরাস্তার একটা ঝোঁপের ধারে দূরে রেল স্টেশনের বাড়ি। আশেপাশে কোথাও গত রাতের সেই রহস্যনিকেতন বা বাগিচার চিহ্নমাত্র নেই।
হাতটা আবার ঝন ঝন করে উঠতে চেয়ে দেখলাম। স্বপ্ন নয়। সত্যিই কাল রাতে ভয়ংকর মৃত্যুর মুখে পড়েছিলাম কিন্তু মরিনি।
টলতে টলতে স্টেশনে গেলাম। সেই কুলিটা ছিল। কিন্তু কর্নেল লাইস্যান্ডার স্টার্ক বলে কাউকে সে চেনে না। কাল রাতে কোনো গাড়িও দেখেনি।
ছ-টার একটু পরেই লন্ডন পৌঁছোলাম। স্টেশন থেকে আঙুল ড্রেস করতে গিয়ে ডক্টর ওয়াটসনের কাছে আপনার কথা শুনলাম। সবই বললাম, এখন বলুন কী করব।
কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে বসে রইলাম। অসাধারণ কাহিনি সন্দেহ নেই। তারপর হোমস উঠে গিয়ে মোটা খাতা পেড়ে আনল তাক থেকে। খবরের কাগজের কাটিং সেঁটে রাখে খাতাটায়।
বললে, এক বছর আগে একটা বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল। শুনুন।
ন-তারিখে ছাব্বিশ বছর বয়স্ক হাইড্রলিক ইঞ্জিনিয়ার মি. জেরেমিয়া হেলিং নিখোঁজ হয়েছেন। রাত দশটার সময়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যান–আর পাওয়া যায়নি। পোশাক ইত্যাদি, ইত্যাদি। ব্যস! এই তো বোঝা গেল! এক বছর আগে এইভাবেই মেশিন মেরামত করেছিলেন কর্নেল।
কী সর্বনাশ! ভদ্রমহিলা তাহলে এর কথাই বলছিলেন! বললেন বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠহীন রুগি।
নিশ্চয়। কর্নেল লোকটা পয়লা নম্বরের মরিয়া লোক–ঠান্ডা মাথার বদমাশ। পথের কাঁটা দূর করতে কোনো পন্থা অবলম্বনেই পেছপা নন। প্রত্যেকটা সেকেন্ড এখন অমূল্য। চলুন, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে আগে যাওয়া যাক। সেখান থেকে দল বেঁধে যাব আইফোর্ড।
ঘণ্টা তিনেক পরে ট্রেনে চেপে বসলাম আমি, শার্লক হোমস, ইনস্পেকটর ব্র্যাডস্ট্রিট, হাইড্রলিক ইঞ্জিনিয়ার এবং একজন সাদা পোশাকি পুলিশ। ব্র্যাডস্ট্রিট একটা সামরিক ম্যাপ১৬ বিছিয়ে আইফোর্ডকে মাঝে রেখে কম্পাস দিয়ে বৃত্ত আঁকছিলেন চারধারে।
বললেন, এই নিন দশ মাইল ব্যাসার্ধের বৃত্ত। এর মধ্যেই পড়বে। দশ মাইলই তো?
আধঘণ্টা টেনে গিয়েছিলাম গাড়িতে।
অজ্ঞান অবস্থায় এতটা পথ বয়ে এনেছিল?
নিশ্চয় তাই। আবছা মতন মনে আছে কারা যেন বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল আমাকে।
আমি বললাম, বাগানে আপনাকে অজ্ঞান অবস্থায় পেয়ে ছেড়ে দিল কেন বুঝছি না।
ব্র্যাডস্ট্রিট বললেন, এখুনি তা বোঝা যাবে। আগে জানা দরকার সেই বাড়িটা কোথায়।
শান্তকণ্ঠে হোমস বললে, আমি দেখিয়ে দিতে পারি।
তাই নাকি! তার মানে, মনে মনে আপনি ঠিক করেই ফেলেছেন জায়গাটা কোথায়। বেশ, দেখা যাক আপনার সঙ্গে একমত হতে পারি কি না। আমি বলব বাড়িটা দক্ষিণে ওইদিকেই লোকজন কম।
হাইড্রলিক ইঞ্জিনিয়ার বললেন, পুবদিকে।
পশ্চিম দিকে, বললে সাদা পোশাকি ভদ্রলোক, নিরালা গ্রামগুলো তো ওইদিকেই।
উত্তর দিকে, বললাম আমি, কেননা পাহাড় নেই ওদিকে। মি. হেথার্লি বলেছেন, গাড়ি ওপর দিকে উঠেছে বলে একবারও মনে হয়নি।
শার্লক হোমস বললে, ভুল করলেন প্রত্যেকেই। বলে আঙুলে রাখল বৃত্তের ঠিক মাঝখানে, এইখানে খুঁজলে পাবেন সেই বাড়ি।
দম আটকে এল যেন হেথার্লির, কিন্তু বারো মাইল পথ তো গিয়েছি!
ছ-মাইল গেছেন, ছ-মাইল এসেছেন। আপনিই বললেন, ঘোড়ার গা চকচক করছিল, ক্লান্ত মোটেই ছিল না। বারো মাইল খারাপ রাস্তা পেরিয়ে কোনো ঘোড়াকেই ও অবস্থায় দেখা যায় না।
মাথা চুলকোতে চুলকাতে ব্র্যাডস্ট্রিট বললেন, খুব ধোঁকা দিয়েছে মনে হচ্ছে। দলটার কাজকারবার এবার আন্দাজ করা যাচ্ছে।
জাল টাকার কারবার, বললে হোমস। রুপোর নকল হিসেবে খাদ মিশোনো যে-ধাতু লাগে, সেটি তৈরির জন্যেই দরকার ওই মেশিন।
ব্র্যাডস্ট্রিট বললেন, নকল আধ ক্রাউন মুদ্রায় বাজার ছেয়ে ফেলেছে, এমন একটা দলের কীর্তি আমাদের কানে এসেছে। রীডিং পর্যন্ত তাদের হদিশ পেয়েছি–এবার বাছাধনদের ছাড়ছি না।
কিন্তু পুলিশের হাতে পড়বার পাত্র তারা নয়। ব্র্যাডস্ট্রিটের মনোবাঞ্ছা আর পূর্ণ হল না। আইফোর্ডে ট্রেন যখন ঢুকছে, তখনই দেখলাম অস্ট্রিচ পাখির পালকের মতো রাশি রাশি ধোঁয়ার কুণ্ডলী আকাশ ছেয়ে ফেলেছে। বড়ো বড়ো গাছপালার আড়ালে দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন।
বাড়ি পুড়ছে নাকি? গাড়ি থামলে পর স্টেশন মাস্টারকে জিজ্ঞেস করলেন ইনস্পেকটর।
আজ্ঞে, হ্যাঁ।
আগুন লাগল কখন।
রাত্রে।
বাড়িটা কার?
ডক্টর বেচারের।
ডক্টর বেচার কি জাতে জার্মান, খুব রোগা, খাড়া লম্বা নাক?
স্টেশন মাস্টার তো হেসেই অস্থির।
বলল, আজ্ঞে না, ডক্টর বেচার জাতে ইংরেজ। খাঁটি ভদ্রলোক। তবে ওঁর বাড়িতে একজন বিদেশি রুগি থাকেন–পেটে কিছু সয় বলে মনে হয় না।
তাড়াতাড়ি একটা গাড়ি নিয়ে রওনা হলাম আগুনের দিকে। গিয়ে দেখলাম বিরাট একটা বাড়ি জানলাসমেত দাউ দাউ করে পুড়ছে৮। বাগানে দমকল বাহিনী বৃথাই আগুনকে বাগে আনবার চেষ্টা করছে।
দেখেই চেঁচিয়ে উঠলেন হেথার্লি, ওই তো সেই বাড়ি। এই হল কঁকর বিছানো পথ, ওই গোলাপি ঝোপে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলাম আমি, আর ওই জানলাটা থেকে লাফ দিয়েছিলাম নীচে।
হোমস বললে, ভালো শোধই নিলেন আপনি। যে-ল্যাম্পটা মেশিন ঘরে রেখে এসেছিলেন, গুড়িয়ে যাবার পর সেই আগুন কাঠের তক্তায় গিয়ে লাগে। তখন আপনার পেছন নিতে গিয়ে অত কেউ খেয়াল করেনি–পরে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে দেখে সব ফেলে পালিয়েছে–এতক্ষণে এক-শো মাইল দূরে চলে গেছে বলতে পারেন।
হোমসের কথাই সত্যি হল শেষ পর্যন্ত। নৃশংস জার্মান বা বিষণ্ণ ইংরেজের খবর আর পাওয়া যায়নি। তবে সেইদিনই ভোরের দিকে ভারী ভারী বাক্স বোঝাই একটা গাড়িকে রীডিং স্টেশনের দিকে যেতে দেখেছিল একজন চাষি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা গেল কোথায়, তা শার্লক হোমস পর্যন্ত মাথা খাঁটিয়ে বার করতে পারেননি।
বাড়িটার গোলকধাঁধার মতো গলিখুঁজি দেখে তাজ্জব হয়ে গিয়েছিল দমকল বাহিনী, চোখ কপালে উঠেছিল ওপরতলার জানলার গোবরাটে একটা মানুষের বুড়ো আঙুল দেখে। সন্ধে নাগাদ আগুন নিভল বটে, কিন্তু ততক্ষণে ছাদ ধ্বসে পড়েছে, অভিশপ্ত মেশিনটাও নিশ্চিহ্ন হয়েছে। বারবাড়িতে পাওয়া গেল কিছু নিকেল আর টিন। পাওয়া গেল না কেবল মুদ্রা নিশ্চয় পাচার হয়ে গিয়েছে ভোরের সেই গাড়িতে।
হাইড্রলিক ইঞ্জিনিয়ার প্রাণে বেঁচে গেলেন কীভাবে এবং কে-ই বা তাকে বয়ে নিয়ে গেলেন বড়োরাস্তায়–সে-রহস্য পরিষ্কার হল নরম মাটিতে দু-জোড়া পদচিহ্ন আবিষ্কারের পর। একজোড়া খুব ছোটো, আর একজোড়া বেশ বড়ো। অর্থাৎ মহিলাটি ইংরেজ ভদ্রলোকের সাহায্যে ইঞ্জিনিয়ারকে ধরাধরি করে নিয়ে আসে বাইরে। নীরব প্রকৃতি ভদ্রলোকের মন অতটা নিষ্ঠুর নয়, খুন জখমের প্রবৃত্তি নেই বলেই ভদ্রমহিলার মিনতি তাঁকে স্পর্শ করেছে।
লন্ডনগামী ট্রেনে উঠে বসে ক্ষোভের সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ার বললেন, ভালো কারবার করে গেলাম বটে! পঞ্চাশটা গিনি তো পেলামই না–রেখে গেলাম বুড়ো আঙুলখানা!
কিন্তু পেলেন অভিজ্ঞতা, হেসে বলল শার্লক হোমস। এই গল্প শুনিয়ে ব্যাবসা জীবনে আপনার সুনাম বাড়িয়ে নেবেন খন।
Post a Comment