শার্লক হোমস: দ্য গ্লোরিয়া স্কট
শীতকাল। রাত হয়েছে। অগ্নিকুণ্ডের পাশে বসে গা তাতাচ্ছি আমি আর শার্লক হোমস।
এমন সময়ে হোমস বললে, ‘ওয়াটসন, এই কাগজগুলো পড়ে দেখো। অসাধারণ কেস “গ্লোরিয়া স্কট’-এর সব কথা লেখা আছে। আর এই খবরটা পড়েই আঁতকে উঠে মারা গিয়েছিলেন সমাজের মাথা ট্রেভর।’
ড্রয়ার খুলে একটা রংচটা ছোট্ট চোঙা বার করল বন্ধুবর। ভেতর থেকে বেরোল স্লেট পাথরের মতো ধূসর একটুকরো কাগজ।
কাগজটায় টানা হাতে লেখা একটা বিচিত্র সংবাদ :
‘খেল মুরগি আবার খতম। মুরগিওলা বুড়ো হাডসন কাঁদছে। যত্তোসব গাধার দল। বলে কিনা চালান দিয়েছে লন্ডনে। বলছে, প্রাণপ্রিয় মুরগি নিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালাও। তোমার মুরগিও মরবে।’
এ কী গোলকধাঁধা! আমার ভ্যাবাচ্যাকা মুখ দেখে খুক খুক করে শুষ্ক হাসি হাসল হোমস। বললাম, এ তো দেখছি একটা আবোল-তাবোল ব্যাপার। আঁতকে ওঠার মতো তো কিছু না।
কিন্তু এই খবর পড়েই ধড়াস করে পড়ে মারা গেছেন একজন শক্তসমর্থ বুড়ো ভদ্রলোক।
কেসটা আমাকে পড়তে বলছ কেন?
কারণ এই হল আমার জীবনের প্রথম কেস।
নিমেষে জাগ্রত হল আমার কৌতুহল। শার্লক হোমসের প্রথম মামলা নিয়ে অনুসন্ধিৎসা ছিল বরাবর।
পাইপ টানতে টানতে ও বলল, কলেজে থাকতে আমার বন্ধু বলতে ছিল একজনই— ভিক্টর ট্রেভর। কারো সঙ্গে মিশতাম না। ঘরে বসে নিজের পড়া নিয়ে থাকতাম, তরবারি যুদ্ধ আর মুষ্টিযুদ্ধ ছাড়া আর কোনো ব্যায়ামে ঝোঁকও ছিল না।
ভিক্টরের বুলটেরিয়ার কুকুরটা একদিন আমার পায়ে কামড়ে দেয়। পা নিয়ে শুয়ে রইলাম দশদিন। খোঁজখবর নিতে আসত ভিক্টর। সেই থেকেই নিবিড় হল বন্ধুত্ব। ছুটি কাটানোর জন্যে নেমন্তন্ন করল ওর দেশের বাড়িতে— নরফোকের ডনিথর্পে।
জায়গাটা ভালো। ছোট্ট গ্রাম হলেও বেশ ছিমছাম। মাছধরা আর বুনো হাঁস শিকার নিয়ে একটা মাস দিব্যি কাটিয়ে নেওয়া যায়। লাইব্রেরিতে বাছাই-করা বইয়ের সংগ্রহ। সব দিক দিয়ে ছুটি কাটানোর আদর্শ জায়গা।
ভিক্টরের বুড়ো বাবা মানুষটা চমৎকার। ও অঞ্চলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদার তিনি। বিপত্নীক। ভিক্টর ছাড়া সংসারে আর কেউ নেই। এক মেয়ে ছিল— ডিপথেরিয়ায় মারা গেছে। বৃদ্ধ হলেও বেশ শক্তসমর্থ। নীল-নীল চোখে ভয়ংকরের ইশারা। রোদেপোড়া তামাটে রং। সারাজীবন তিনি প্রকৃতির মধ্যে কাটিয়েছেন— যা কিছু শিখেছেন, সারাপৃথিবীতে টহল দিয়ে শিখেছেন– বই-পড়া-বিদ্যে বিশেষ নেই। গ্রামের লোক কিন্তু তাকে মাথায় করে রাখে দরাজ হৃদয়ের জন্যে। ‘ডনিথর্পে যাওয়ার দিনকয়েক পরের ঘটনা। রাত্রে খাওয়ার পর টেবিলে বসে গল্পগুজব করছি। আমার বিশ্লেষণী শক্তি আর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার গল্প বলছিল ভিক্টর। তখনও অবশ্য জানতাম না এ-শক্তিকে ভবিষ্যতে কী কাজে লাগাব।
ভিক্টরের বাবা সব শুনে মুচকি হেসে বললেন, বেশ তো, আমার সম্বন্ধে দেখি কী বলতে পার।
আমি বললাম, গত এক বছর ধরে মার খাবার ভয়ে আধখানা হয়ে আছেন আপনি।
হাসি মিলিয়ে গেল বুড়োর মুখ থেকে। চোখ বড়ো বড়ো করে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন আমার দিকে। তারপর ঢোক গিলে বললেন, খাটি কথা। গত বছর চোরাশিকারীদের দলটা তছনছ করার পর থেকেই আমাকে চোরাগোপ্ত করার ফিকিরে ঘুরছে ওরা। স্যার এডওয়ার্ড হবিকে তো ছুরিও মেরেছে। আমাকে হুশিয়ার থাকতে হয় সেই কারণেই। কিন্তু বাবা হোমস, তুমি জানলে কী করে?
আপনার লাঠি দেখে। লাঠির ওপর খোদাই করা তারিখটা একবছর আগেকার। একবছর আগে কেনা লাঠির মাথায় কিন্তু ছাদা করে তরল সিসে ঢেলে সাংঘাতিক হাতিয়ার বানিয়েছেন। মারধরের ভয় না-থাকলে এ-রকম অস্ত্র অষ্টপ্রহর কেউ সঙ্গে রাখে না।
আর কী জান বল?
বয়সকালে খুব বক্সিং লড়েছেন।
নাক দেখে বললে বুঝি? ঘুসি খাওয়া থ্যাবড়া নাক নাকি?
কান দেখে বললাম। বক্সারদের কানের মতো আপনার কানও চেপটা আর পুরু।
আর কিছু?
খোড়াখুড়ি করে হাতে কড়া ফেলেছেন।
সোনার খনি থেকেই যে এত টাকা করেছি।
নিউজিল্যান্ডে ছিলেন এককালে।
এক্কেবারে ঠিক।
জাপানেও ছিলেন।
ঠিক, ঠিক।
এমন একজনকে আপনি চিনতেন যাকে আপনি মন থেকে ঝেড়ে ফেলবার অনেক চেষ্টা করছেন। তার নামের প্রথম দুটো অক্ষর— জে. এ.
চেয়ার ছেড়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালেন মি. ট্রেভর। বিশাল নীল চোখে ভয়ংকর চেয়ে রইলেন আমার দিকে। তারপরেই দড়াম করে মুখ থুবড়ে পড়লেন এটোকাটা ছড়ানো টেবিলের ওপর। দেখলাম, অজ্ঞান হয়ে গেছেন।
এ-রকম একটা কাণ্ড হবে ভাবতেই পারিনি। যাই হোক, চোখ-মুখে জল দেওয়ার পর তো উঠে বসলেন।
কীভাবে এত অনুমান কর জানি না। কিন্তু পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা হওয়ার ক্ষমতা তোমার আছে। এবং গোয়েন্দাগিরিই তোমার পেশা হওয়া উচিত। গল্পের বা বাস্তবের কোনো গোয়েন্দাই তোমার কাছে পাত্তা পাবে না।
ওয়াটসন, সেই প্রথম মনে হল, শখ করেও যদি এই বিশ্লেষণী শক্তিকে কাজে লাগাই, দু-পয়সা রোজগার করা অসম্ভব হবে না।
মি, ট্রেভর বললেন– এত কথা জানলে কী করে, হোমস? দেখলাম, চোখের তারায় তখনও আতঙ্ক থিরথির করে কাপছে।
বললাম, আপনি আস্তিন গুটােতেই দেখেছি কনুইয়ের ভাঁজে “জে.এ.” এই অক্ষর দুটাে উল্কি দিয়ে লেখা। কিন্তু বেশ আবছা। ছাল তুলে লেখাটা মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। তাই বললাম, এককালে নামটা আপনার প্রাণে গাঁথা ছিল, পরে ভুলতে চেয়েছেন।
শুনে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন মি. ট্রেভর। বললেন, আশ্চর্য ক্ষমতা বটে তোমার!
সেইদিন থেকে কিন্তু বুড়ো সন্দেহের চোখে দেখতে লাগলেন আমাকে। সবসময় ভয়, যেন আরও অনেক জেনে ফেলেছি বা জেনে ফেলতে পারি। ভিক্টরসুদ্ধ ব্যাপারটা লক্ষ করেছিল।
বলেছিল, বাবা দেখছি আর কোনোদিনই তোমাকে নিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারবে না।
ভদ্রলোকের অস্বস্তি ক্রমশ বেড়েই চলেছে দেখে ঠিক করলাম চলে আসব। ডনিথর্প ছাড়ব বলে ঠিক করলাম। সেইদিনই অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল।
বাগানে বসে ছিলাম তিনজনে। এমন সময়ে ঝি এসে বললে, একটা লোক মি. ট্রেভরের সঙ্গে দেখা করতে চায়— এখুনি। মি. ট্রেভর তাকে আনতে বললেন।
ঝি-য়ের পেছন পেছন এল একটা বেঁটে মতন শুকনো চেহারার কুটিল-মুখ লোক। চালচলনে চাকরবাকরের মতো ত্ৰস্ত। হাঁটছে খুঁড়িয়ে। পোশাক সস্তা। হলদে দাঁতে নোংরা কুচুকুরে হাসি। হাত দেখে মনে হয় নাবিক।
লোকটাকে দেখেই হেঁচকি তুলে দৌড়ে বাড়ির ভেতর চলে গেলেন মি. ট্রেভর— ফিরে যখন এলেন, মুখে ব্র্যান্ডির গন্ধ পেলাম।
চোখ কুঁচকে নোংরা হাসিতে এটাে করা মুখে ঠায় চেয়ে রইল লোকটা। ক্রুর কন্ঠে বললে, চিনতে অসুবিধে হচ্ছে?
আরে, হাডসন নাকি!
আজ্ঞে হ্যাঁ, তিরিশ বছর পর দেখা। বেশ তো ঘরবাড়ি বানিয়ে জাকিয়ে বসেছেন দেখছি। শুকনো মাংস আর ক-দিন চিবেই বলুন তো?
তাই কি হয়? তাই কি হয় ? বলেই হেট করে লোকটার কানে কানে কী যেন বললেন মি. ট্রেভর। তারপর জোর গলায় বললেন, পুরোনো দিনের কথা কি ভোলা যায়? যাও, রান্নাঘরে গিয়ে পেট ভরে খেয়ে নাও। তারপর এখানেই চাকরি নিয়ে থেকে যাও।
বাঁচালেন! জাহাজের চাকরিটা গিয়ে অবদি হাত খালি। তাই ভাবলাম আপনার বা মি. বেডোজের কাছে গেলে নিশ্চয় একটা হিল্পে হয়ে যাবে।
মি. বেডোজের ঠিকানাও জানো?
সব জানি। পুরোনো দোস্তরা যে কোথায় আছে, সে-খবর রাখি, বলে কুটিল হাসি হাসতে হাসতে ঝি-য়ের পেছন পেছন বিদেয় হল লোকটা।
বিড়বিড় করে মি. ট্রেভর বললেন, খনিতে যাওয়ার সময়ে জাহাজে আলাপ হয়েছিল।
তারপর উঠে গেলেন বাড়ির মধ্যে, কিছুক্ষণ পরে গিয়ে দেখলাম মদ খেয়ে বেশি হয়ে পড়ে আছেন। আমি থাকায় ভিক্টর খুব অস্বস্তিতে পড়েছে দেখলাম। পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই কদর্য লাগল। পরের দিনই চলে এলাম লন্ডনে। ছুটির শেষের দিকে, মানে সাত সপ্তাহ পরে ভিক্টরের টেলিগ্রাম পেলাম। এখুনি যেতে হবে ডনিথর্পে।
এক ঘোড়ায় টানা হালকা গাড়ি নিয়ে স্টেশনে এসেছিল ভিক্টর। চেহারা দেখে চমকে উঠলাম। উদবেগ উৎকণ্ঠায় শুকিয়ে গেছে, যেন প্রচণ্ড ধকল সয়েছে এই দুটি মাস। প্রাণোচ্ছলতা ওর বৈশিষ্ট্য— কিন্তু তার চিহ্নমাত্র দেখলাম না— একেবারে ভেঙে পড়েছে।
আমাকে দেখেই প্রথমে বললে, হোমস, বাবা মরতে বসেছে।
সেকী!
স্নায়ুতে দারুণ চোট লেগেছে। বাড়ি ফিরে গিয়ে দেখব হয়তো আর নেই।
হঠাৎ চোট লাগল কেন?
সেই যে লোকটা বাড়িতে এসেছিল, মনে আছে?
হ্যাঁ, হ্যাঁ।
আস্ত শয়তান যে, একটা দিনও শান্তি পাইনি সেদিন থেকে। তার জন্যেই বাবার আজ এই অবস্থা। চলো, যেতে যেতে বলছি।
গাড়িতে উঠে বসলাম। ভিক্টর বললে, বাবা ওকে প্রথমে মালির কাজ দেয়, সে-কাজে ওর মন উঠল না, বাবা তখন খাসচাকরের কাজ দিল তাকে। তারপর থেকে বাড়ির চাকরবাকররা অতিষ্ঠ হয়ে উঠল ওর ব্যবহারে। দিনরাত অশ্রাব্য গালিগালাজ, মাতলামি কাহাতক আর সওয়া যায়। পুরো বাড়িটাই যেন তার, এমনি একটা ভাব দেখাতে লাগল সবসময়। অপমানে গা রি-রি করত যখন দেখতাম বাবার সবচেয়ে ভালো বন্দুক নিয়ে বাবারই নৌকোয় চেপে শিকারে বেরোচ্ছে। এমন একটা ইতরামি একটা বিদ্রুপের ভাব ফুটে বেরোত ওর প্রতিটি কথা আর কাজে যে কতবার ভেবেছি মেরে পাট করে দিই রাসকেলকে। দিলেই বরং ভালো করতাম— বাড়তে দেওয়াটাই ভুল হয়েছে।
একদিন অপমান করে বসল আমার বাবাকেই– আমার সামনে! সেদিনই ঘাড় ধাক্কা দিলাম ঘর থেকে। ভীষণ চোখে বেরিয়ে গেল সে। পরদিন বাবা এসে বললে, হাডসনের কাছে আমাকে ক্ষমা চাইতে হবে। বললে, ‘খুব ঝামেলায় পড়েছি, ভিক্টর। একদিন সব জানতে পারবি।’ সারাদিন ঘর থেকে বেরোল না। দেখলাম, একনাগাড়ে লিখে চলেছে।
সন্ধের দিকে হাডসন এল ঘরে। আমরা তখন খাওয়া সেরে বসে আছি। বাজখাই গলায় বললে, এখানে আর নয়। এবার চললাম মি. বেডোজের কাছে। তিনিও আমাকে মাথায় তুলে রাখবেন।
বাবা যেন সিটিয়ে গেল কথাটা শুনে। বলল, রাগ করে যাচ্ছ না তো?
বিষ-চোখে আমার দিকে তাকিয়ে হাডসন বললে, এখনও কিন্তু ক্ষমা চাওয়া হয়নি আমার কাছে।
ভিক্টর, বাবা হুকুম দিল আমাকে, ‘হাডসনের মতো লোক হয় না। ক্ষমাটা চেয়ে নাও।’
আমি বেঁকে বসলাম। রক্ত চোখে তাকিয়ে ‘দেখে নেব’ বলে শাসিয়ে বেরিয়ে গেল হাডসন। আধঘণ্টা পর বিদেয় হল বাড়ি থেকে।
সেইদিন থেকে বাবা যেন অস্থির হয়ে পড়ল। সারারাত ঘুমোত না। ঘরে পায়চারি করত। গতকাল একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল। ফোডিব্রিজ পোস্টাপিসের ছাপ-মারা একটা খাম এল বাবার নামে। চিঠিটা পড়েই বাবা কপাল ঠুকতে ঠুকতে উন্মাদের মতো ঘরময় দৌড়োতে লাগল।
মুখের একপাশ থেকে— দারুণ আঘাতে স্ট্রোক হয়ে গেছে। ডাক্তার এল। পক্ষাঘাত ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ল। সেই থেকে এখনও পর্যন্ত জ্ঞান ফেরেনি। জানি না ফিরে গিয়ে জীবিত অবস্থায় দেখতে পাব কি না।
কী সাংঘাতিক কথা! কী ছিল চিঠিতে?
বলতে বলতে গাড়ি পৌছে গেল বাড়িতে। পড়ন্ত আলোয় দেখলাম সব জানলা বন্ধ। কালো পোশাক পরা ডাক্তার বেরিয়ে এল বাইরে।
বললেন, ভিক্টর, তুমি বেরিয়ে যাওয়ার পরেই উনি দেহ রেখেছেন। মৃত্যুর আগে জ্ঞান ফিরে পেয়ে তোমাকে একটা কথা বলতে বলে গেছেন।
শোকে দুঃখে ভিক্টর তখন পাথর। কোনোমতে বলল, কী?
ডাক্তার বললেন, কাগজপত্র জাপানি ক্যাবিনেটের পেছনে রইল।
ডাক্তারের সঙ্গে ভিক্টর গেল ভেতরে— বাবার মৃতদেহের কাছে।
প্রায়ান্ধকার ঘরে বসে মি. ট্রেভরের দুর্দান্ত অতীত এবং আমার মুখে “জে.এ.” নামের আদ্যক্ষর বৃত্তান্ত শুনেই তার জ্ঞান হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা ভাবতে লাগলাম। কদাকার হাডসনের আবির্ভাবে তিনি ভয় পেয়েছিলেন, হাডসন চলে যাওয়ার পর আরও ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। মি. বেডোজের কাছে গিয়ে এই হাডসন তাহলে ব্ল্যাকমেলিং শুরু করেছে এবং চিঠিখানায় সেই খবর পেয়েই নিশ্চয় আর সইতে পারেননি। চিঠিখানা দেখতে পেলে এ-রহস্যের কিনারা করা যেত। এমন সময় ঝি এল আলো হাতে— পেছনে ভিক্টর। ওর হাতে একরাশ কাগজপত্র আর একটা চিঠি– সবই তোমাকে এনে দিলাম। চিঠিখানা তখনই পড়লাম : ‘খেল মুরগি এবার খতম। মুরগিওলা বুড়ো হাডসন কাঁদছে। যত্তো সব গাধার দল। বলে কিনা চালান দিয়েছে লন্ডনে। বলছে, প্রাণ প্রিয় মুরগি নিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালাও। তোমার মুরগিও মরবে।’
প্রথমবার পড়ে তোমার মতোই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। আবার পড়লাম। নিশ্চয় সংকেতে লেখা চিঠি। আগেই আঁচ করেছিলাম। শব্দগুলো আসলে বেড়াজাল— আসল মানেটাকে ঢেকে রেখে দিয়েছে। “মুরগি” কথাটার বিশেষ কোনো অর্থ কি ঠিক করা ছিল আগে থেকে? “হাডসন’ শব্দটা দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে পত্ৰলেখক মি. বেড়োজ— হাডসন নয়। পেছন থেকে পড়লাম। একটা শব্দ ছেড়ে ছেড়ে পড়লাম। তার পরেই ফরসা হয়ে গেল। দেখলাম প্রথম শব্দের পর দুটাে করে শব্দ ছাড়তে হবে।
ছোট্ট চিঠি। কিন্তু ভয়ংকর। বুড়ো ট্রেভর অকারণে ঘায়েল হননি।
চিঠিটা এই— খেল খতম। হাডসন সব বলে দিয়েছে। প্রাণ নিয়ে পালাও। মরবে।
ভিক্টরকে জিজ্ঞেস করলাম, মি. বেডোজ কে?
ফি বছর শরৎকালে বাবা ওখানে যেত শিকার করতে।
এ-চিঠি তিনিই লিখে তোমার বাবাকে সাবধান করে দিয়েছেন। তিনি নিজেও বিপদে পড়েছেন। হাডসন কী এমন গোপন কথা ফাঁস করে দিয়েছে যার জন্যে দুজন সন্ত্রান্ত মানুষ এতটা ভয় পেয়েছেন, তা জানা দরকার।
ভিক্টর বললে, হোমস, সে-কাহিনি নিশ্চয় বড়ো মুখ করে বলার নয়, নিশ্চয় বিরাট কোনো অপরাধের ইতিহাস। জানি কলঙ্কের শেষ থাকবে না। ‘হাডসন দেখে নেব’ বলে শাসিয়ে যাওয়ার পর বাবা সব লিখেছিল। তুমি পড়ো, আমার সাহস নেই।
ওয়াটসন, সেদিন যেভাবে এই কাগজ থেকে আশ্চর্য সেই কাহিনি ভিক্টরকে পড়ে শুনিয়েছিলাম, আজও তোমাকে সেইভাবে পড়ে শোনাচ্ছি। শোনো। ওপরে লেখা : “১৮৮৫ সালের আটই অক্টোবর ফলমাউথ থেকে গ্লোরিয়া স্কট জাহাজ রওনা হওয়ার পর ১৫০ ২৯ নর্থ ল্যাটিচিউডে ও ২৫° ১৪” ওয়েস্ট লঙ্গিচিউডে পৌছে ছয়ই নভেম্বর জাহাজ ধ্বংস হয় কীভাবে, তার বর্ণনা।’
প্রিয় ভিক্টর, যে-অপরাধ আমি করেছিলাম, তার শাস্তি পেতে চলেছি। মানসম্মান ধুলোয় লুটোতে চলেছে। সব তোমাকে জানিয়েছি। পড়বার পর পুড়িয়ে ফেলো।
হয় আমাকে গ্রেপ্তার হতে হবে অথবা আঘাতের আকস্মিকতায় মারা যেতে পারি। সেক্ষেত্রে এ-কাহিনি নিয়ে লুকোছাপার আর দরকার নেই।
‘আমার নাম ট্রেভর নয়… জেমস আর্মিটেজ। অদ্যক্ষর,“জে.এ.”। কনুইয়ের ভাঁজে উল্কি দিয়ে লেখা আদ্যক্ষর দুটো মুছে ফেলার চেষ্টা করেও পারিনি, তোমার বন্ধু ধরে ফেলেছিল। ভয় হয়েছিল, হয়তো আমার গুপ্ত কাহিনি সে জানে।
জেমস আর্মিটেজ নামে আমি লন্ডনের এক ব্যাঙ্কে চাকরি করার সময়ে ব্যাঙ্কের তহবিল তছরূপ করি। একটা দেনা শোধ করার জন্যেই এই কুকর্ম করেছিলাম। আর একটা টাকা পাওয়ার আশা ছিল, সেটা পেলেই ব্যাঙ্কের টাকা ব্যাঙ্কে ফিরিয়ে দিতাম, কেউ জানতে পারত না।
কিন্তু সব ফাস হয়ে গেল. প্রত্যাশিত টাকা আর পেলাম না। চুরির দায়ে মাত্র তেইশ বছর বয়সে সাঁইত্রিশ জন অপরাধীর সঙ্গে শেকলে বেঁধে আমাকে চালান করা হল অস্ট্রেলিয়ায়, গ্লোরিয়া স্কট জাহাজে।
জাহাজটা কাঠের। ভীষণ ভারী। সেকেলে জাহাজ বলে চীনদেশে চায়ের কারবারে কাজে লাগত। সবসুদ্ধ লোক ছিল এক-শো। আটত্রিশ জন কয়েদি… বাদবাকি নাবিক, সৈন্য আর জাহাজি অফিসার। সময়টা ১৮৫৫ সাল। ‘ক্রিমিয়ার যুদ্ধ’ চলছে। কয়েদি জাহাজের অভাবে এই জাহাজটাই কাজে লাগাল সরকার।
কয়েদি জাহাজ নয় বলেই ঘরের দেওয়াগুলো হালকা কাঠ দিয়ে তৈরী, তেমন মজবুত নয়। আমার পাশের ঘরে সাড়ে ছ-ফুট লম্বা একজন কয়েদি থাকত। ভীষণ হুল্লোড়বাজ। সব সময়ে হইচই করত। দেমাকি। পরিষ্কার মুখ, পাতলা নাক, চওড়া চোয়াল। মনের জোর যে খুব বেশি, ওই অবস্থাতেই অত ফুর্তি দেখেই বোঝা যেত। একদিন রাতে কানের কাছে শুনলাম তার খাটো কণ্ঠস্বর।
দেখি কি, মাঝের পাতলা দেওয়াল ফুটাে করে ফেলে মুখ বাড়িয়ে আছে সে। পরিচয় হল তখনই। নাম তার জ্যাক প্রেন্ডারগাস্ট। বড়ো ঘরের ছেলে। কিন্তু অপকর্মে ওস্তাদ। লন্ডনের বেশ কয়েকটা কারবারি মানুষের পকেট হালকা করে দিয়েছিল অদ্ভুত কৌশলে।
ওর মুখেই শুনলাম, ধরা পড়লেও সে নগদ আড়াই-লক্ষ পাউন্ড সে লুকিয়ে রেখেছে পরে ভোগ করবে বলে। ফিসফিস করে বললে, ওহে, তুমি কি মনে কর এই পচা কাঠের চীনে জাহাজে আমি মরতে এসেছি? টাকা যখন আছে, তখন তা ভোগও করব। দেখ না কী করি, ঠিক পালাব। তোমারও একটা হিল্পে হবে।
তারপর জানলাম বারোজন কয়েদি সঙ্গে জাহাজ দখলের ষড়যন্ত্র করেছে জ্যাক প্রেন্ডারগাস্ট। আমার বাঁ-পাশের কেবিনের ইভান্স বলে কয়েদিও আছে সেই দলে। সে এখন দক্ষিণ ইংলন্ডে রাজার হালে থাকে, আমার মতোই নাম পালটেছে।
ষড়যন্ত্রের মূল হোতা জাহাজের পুরুত ঠাকুর স্বয়ং, জ্যাকের পরোনো দোস্ত। জলের মতো টাকা ঢেলে সে হাত করেছে নাবিকদের। দুজন ওয়ার্ডার আর দুজন মেট-ও হাতে এসে গেছে। সৈন্য, ডাক্তার, ক্যাপ্টেন, লেফটেন্যান্টদের নিয়ে পাঁচশজন জানে না এই চক্রান্ত-কাহিনি, তারাই আমাদের শত্রু। এই কয়েকজনকে খতম করে জাহাজ দখল করতে হবে।
গুণধর পুরুত-ঠাকুর গোড়া থেকে নাবিক সাজিয়ে মারদাঙ্গা-স্যাঙাতদের জাহাজে তুলেছিল। এখন কয়েদিদের ঘরে ঘরে ব্যাগভরতি ধর্মের বইয়ের সঙ্গে দিয়ে গেল উকো পিস্তল, বারুদ আর গুলি। প্রত্যেকের বালিশের নীচে জমা হল অস্ত্রশস্ত্র।
যেদিন জাহাজ দখল করা হবে বলে ঠিক হয়েছিল, তার আগেই কিন্তু লেগে গেল হাঙ্গামা। সমুদ্রে রওনা হওয়ার তিন হস্তা পরে সন্ধের দিকে একজন অসুস্থ কয়েদিকে দেখতে এসেছিল ডাক্তার। বালিশের তলায় হাত ঠেকে যেতে পিস্তল দেখে ষাঁড়ের মতো চেঁচিয়ে ওঠে সে। বেগতিক দেখে তৎক্ষণাৎ তাকে বেঁধে ফেলা হয় বিছানায়। পিস্তল হাতে ছুটে বেরিয়ে যায় কয়েদিরা। দমাদম গুলি চালিয়ে জনা ছয়েককে খুন করে ফেলা হয় চক্ষের নিমেষে। ক্যাপ্টেনের খুলি উড়িয়ে দেয় পুরুত-ঠাকুর নিজে।
ব্যস, জাহাজ দখলে এসে গেল ভেবে আনন্দে আত্মহারা সবাই। বড়ো কেবিনে মদের বোতল খুলে সবাই যখন গলায় মদ ঢালছি, এমন সময়ে এক ঝাঁক গুলি উড়ে এল ঘরের মধ্যে। ধোঁয়া কেটে গেলে দেখা গেল আমাদের ন-জন রক্তাক্ত অবস্থায় ছটফট করছে মেঝের ওপর— টেবিলে রক্ত আর মদ গড়িয়ে যাচ্ছে।
দেখেই প্রেন্ডারগাস্ট বিকট চেঁচিয়ে মূর্তিমান শয়তানের মতো ধেয়ে গেল বাইরে। অসীম সাহস তার। জাহাজের পেছনে ঘরের ঘুলঘুলি ভেঙে লেফটেন্যান্ট দশ জন সৈন্য নিয়ে গুলিবর্ষণ করেছিল আমাদের ওপর। বন্দুকে নতুন করে গুলি ভরবার সময় পর্যন্ত দিল না প্রেন্ডারগাস্ট। আমাদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পাঁচ মিনিটেই সব শেষ হয়ে গেল।
প্রেন্ডারগাস্টের কাঁধে তখন যেন শয়তান ভর করেছে। আহত সৈন্যদেরও তুলে ছুড়ে ফেলে দিল জলে। একজন জখম অবস্থাতেও সাঁতরে আসছে দেখে গুলি করে উড়িয়ে দিল খুলি। বেঁচে রইল কেবল কয়েকজন ওয়ার্ডার, মেট আর ডাক্তার— মোট পাঁচজন।
এই পাঁচজনকে মেরে ফেলা হবে কি বাঁচিয়ে রাখা হবে- এই নিয়ে ঝগড়া লাগল আমাদের মধ্যে। নৃশংস প্রেন্ডারগ্রাস্ট আর তার পিশাচ স্যাঙাতরা পাঁচজনকেই খতম করে দিতে চাইল। কিন্তু আমরা পাঁচজন কয়েদি আর তিনজন নাবিক নিরস্ত্র কাউকে খুন করতে চাইলাম না। সশস্ত্র সৈন্যদের মারা যায়— এদের ছেড়ে দেওয়া হোক।
কথা কাটাকাটি চরমে পৌছোতে প্রেন্ডারগ্রাস্ট আমাদের একটা নৌকোয় চেপে বিদেয় হতে বললে। আমরা সেই ব্যবস্থাই মেনে নিলাম। চার্ট আর অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে ভেসে পড়লাম নৌকোয়।
ইভান্স আর আমি চার্ট দেখে নৌকো চালাচ্ছি, এমন সময়ে দেখলাম প্রচণ্ড শব্দে গ্লোরিয়া স্কট ফেটে উড়ে গেল। মেঘগর্জনের মতো গুরু গুরু শব্দ ধেয়ে গেল দিকে দিকে- ব্যাঙের ছাতার মতো কালো ধোঁয়া ঠিকরে গেল আকাশের দিকে।
তক্ষুনি নৌকো ঘুরিয়ে দাঁড় টেনে চললাম সেইদিকে। গিয়ে যখন পৌঁছোলাম, গ্লোরিয়া স্কট ততক্ষণে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই।
হতাশ হয়ে ফিরে আসছি, এমন সময়ে আর্ত চিৎকার শুনে ফিরে দেখি ভাঙা কাঠের ওপর শুয়ে আছে একজন ছোকরা নাবিক। নাম হাডসন। সারাশরীর পুড়ে গেছে। অপরিসীম ক্লান্ত। পরের দিন সকালে তার মুখে শুনলাম কী কাণ্ড ঘটেছিল গ্লোরিয়া স্কটে। পাঁচজনকে একে একে খুন করা হয়। ডাক্তারের টুটি কাটে প্রেন্ডারগাস্ট স্বয়ং। একজন মেট বাঁধন খুলে পালিয়ে যায় জাহাজের খোলে। সেখানে এক-শোটা বারুদভরতি পিপের পাশে জ্বলন্ত দেশলাইয়ের কাঠি নিয়ে সে হুমকি দিয়েছিল, কাছে এলেই বারুদে আগুন দেবে। তারপরেই ঘটে প্রলয়ংকর বিস্ফোরণ। হাডসনের বিশ্বাস, দেশলাইয়ের আগুন নয়… মারমুখো কয়েদিদের পিস্তলের গুলি ফসকে গিয়ে লেগেছিল একটা পিপেতে।
যাই হোক, গ্লোরিয়া স্কট ধ্বংস হল এইভাবে। পরের দিন অস্ট্রেলিয়াগামী একটা জাহাজে ঠাঁই পেলাম আমরা। সিডনি পৌছে নাম পালটে নিলাম আমি আর ইভান্স। খনি অঞ্চলে গেলাম। বিদেশিদের মধ্যে মিশে গেলাম। নিজেদের আগের পরিচয় মুছে গেল। অনেক টাকা নিয়ে দেশে ফিরলাম, জমিদার হলাম। কুড়ি বছর শান্তিতে কাটানোর পর মূর্তিমান উপদ্রব হয়ে এল সেই হাডসন— যাকে ভাঙা কাঠের ওপর থেকে তুলে এনে প্রাণে বাঁচিয়েছিলাম।
সে জানে আমার দুর্বলতা কোথায়। কেন তাকে রাগাতে চাই না। তাই ভয় দেখিয়ে চলে গেছে। ভিক্টর, তোমার সহানুভূতি যেন আমি পাই।’
এর নীচে কাঁপা হাতে লেখা— সংকেতে খবর পাঠিয়েছে বেডোজ— হাডসন সব ফাঁস করে দিয়েছে!
ওয়াটসন, এই হল গ্লোরিয়া স্কট জাহাজের অত্যাশ্চর্য কাহিনি। ভিক্টরের মন ভেঙে যায়। টেরাইতে চলে যায় চাষবাসের কাজ নিয়ে। বেডোজ আর হাডসন দুজনের আর খবর পাওয়া যায়নি। হয় হাডসন বেডোজকে খুন করেছে, অথবা বেডোজ হাডসনকে খুন করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। মি. ট্রেভর কিন্তু স্রেফ আতঙ্কে মারা গিয়েছিলেন– হাডসন আদৌ পুলিশে খবর দেয়নি— মিথ্যে ভয় দেখিয়েছিল।
ওয়াটসন, যদি মনে কর, আমার এই প্রথম রহস্যভেদের কাহিনি কাজে লাগাতে পারো।
Post a Comment