শার্লক হোমস: ‘দ্য ম্যান উইথ দ্য টুইসটেড লিপ’
১৮৮৯ সালের জুন মাস। রাত হয়েছে। হাই তুলে ভাবছি এবার শোওয়া যাক, এমন সময়ে এক ভদ্রমহিলা এল বাড়িতে। মুখে কালো ওড়না।
ভদ্রমহিলা ঘরে ঢুকেই দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল আমার বউকে।
ড়ুকরে উঠে বললে, বড়ো বিপদে পড়েছি রে! বাঁচাতেই হবে!
ওড়না সরিয়ে অবাক হয়ে গেল আমার গিন্নি, কেট হুইটনি যে! কী ব্যাপার?
কেট হুইটনি ও আমার স্ত্রী এক ক্লাসে পড়েছে, অনেকদিনের বন্ধু। ওর স্বামীটি দারুণ নেশাখোর। আফিমের রস মিশিয়ে তামাক খাওয়া ধরেছিল শখ করে, এখন আর ছাড়তে পারে না। আমি ওদের পারিবারিক চিকিৎসক।
কাঁদতে কাঁদতে কেট বললে, উনি আজ দু-দিন বাড়ি ফেরেননি। নিশ্চয় বার অফ গোল্ডে পড়ে আছেন।
বার অফ গোল্ড নেশার আড্ডা। যত রাজ্যের কুলি মজুর যায় সস্তায় কুঁদ হয়ে থাকতে। ও-রকম একটা বীভৎস জায়গায় কেট একলা যেতে চায় না স্বামীকে আনতে, তাই দৌড়ে এসেছে। আমার কাছে।
কেটকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। নিজেই একটা ভাড়াটে গাড়ি নিয়ে গেলাম বার অফ গোল্ডে। জায়গাটা লন্ডন ব্রিজের পূর্বদিকে জেটির পাশে একটা সংকীর্ণ অন্ধকার গলির মধ্যে।
সরু গুহার মতো একটা রাস্তা দিয়ে নামলাম নেশার আড্ডায়। কী বীভৎস কদর্য পরিবেশ ভাষায় বর্ণনা দেওয়া যায় না! নীচু ছাদ, লম্বা ঘর। আফিংয়ের বাদামি ধোঁয়ায় চোখ চলে না। ম্যাড়মেড়ে আলোয় কোনোমতে দেখলাম সারি সারি লোক এলিয়ে রয়েছে নানা ভঙ্গিমায়। ঘোলাটে নিপ্রাণ চোখ। ছোটো ছোটো আগুনের টুকরো জ্বলছে দপ দপ করে–আফিং পুড়ছে। অর্থহীন বুকনি শোনা যাচ্ছে। এক কোণে জ্বলন্ত কাঠকয়লার সামনে একজন রোগা, লম্বা, বুড়ো মুঠিতে চিবুক আর হাঁটুতে হাত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আগুনের দিকে।
আমি আড্ডায় পা দিতেই একজন চাকর আফিংয়ের নল এনে ধরল আমার সামনে। আমি সরিয়ে নিলাম। খুঁজে বার করলাম কেটের নেশাখোর স্বামীকে। আমাকে দেখেই ভীষণ অবাক হয়ে বললে, আরে ওয়াটসন যে! কটা বাজে বল তো?
রাত এগারোটা!
সে কী! কী বার আজকে?
শুক্রবার।
বল কী! এর মধ্যে দু-দিন পেরিয়ে গেল! না, না, নিশ্চয় ভুল বলছ–এই তো ক-ঘণ্টা হল বসেছি, মাত্র ক-টা টাইপ খেয়েছি।
ওকে টেনে নিয়ে বেরিয়ে আসার সময় হঠাৎ জামায় টান পড়ল।
ফিসফিস করে কে যেন বললে, এগিয়ে গিয়ে ফিরে তাকাও।
চমকে উঠলেও এক-পা এগিয়ে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম। দেখি, সেই রোগা, শুকনো, পিঠ-বাঁকা বুড়োটা ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে আছে আগুনের দিকে। দু-হাঁটুর মাঝে আফিংয়ের নল–যেন খসে পড়েছে শিথিল হাত থেকে। আড়াল করে দাঁড়াতেই চক্ষের নিমেষে ঘটল রূপান্তরটা। দেখলাম, বুড়ো আর নেই। সে জায়াগায় সিধে হয়ে বসে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে প্রিয় বন্ধু শার্লক হোমস। চোখের ঘোলাটে ভাব, কপালের বলিরেখা, সারাদেহের বার্ধক্য নিমেষে তিরোহিত হয়েছে।
আর একটু হলে চেঁচিয়ে উঠতাম। ইশারায় এগিয়ে আসতে বলে আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেল হোমস আবার নজদেহে বলিরেখাঙ্কিত মুখে, নিষ্প্রভ চোখে মিশে গেল সারি সারি নেশাখোরদের ভিড়ে।
খাটো গলায় বললাম, এখানে কী করতে এসেছ?
আরে আস্তে কথা বল। বন্ধুটাকে বিদেয় করো আগে–কথা আছে।
গাড়ি দাঁড় করিয়ে এসেছি যে।
ও-গাড়িতেই বাড়ি পাঠিয়ে দাও। গাড়োয়ানকে বল তোমার ঘরণীকেও যেন খবর দেয়–আজ রাতটা আমার সঙ্গেই কাটাবে।
শার্লক হোমসের কথার অন্যথা কখনো করতে পারিনি এতই প্রবল ওর ব্যক্তিত্ব। তা ছাড়া বন্ধুবরের নতুন অ্যাডভেঞ্চার সম্বন্ধে কৌতূহলও পেয়ে বসল আমাকে। বাইরে এসে গাড়োয়ানকে বুঝিয়ে বললাম, কী করতে হবে, বউকে কী বলতে হবে। তারপর একটু দাঁড়ানোর পরেই দেখলাম নেশার আড্ডা থেকে টলতে টলতে বেরিয়ে আসছে ছদ্মবেশী শার্লক হোমস।
পাশাপাশি হেঁটে দুটো রাস্তা পেরিয়ে আসার পর এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে পিঠের কুঁজ ঝেড়ে ফেলে সিধে হয়ে দাঁড়াল হোমস এবং অট্টহেসে বললে, ভাবছ বুঝি কোকেনের সঙ্গে এরপর আফিং ধরলাম?
ওখানে তোমাকে দেখে খুবই অবাক হয়েছি।
আমিও কম হইনি তোমাকে দেখে।
আমি তো এসেছি ওই বন্ধুটার সন্ধানে।
আর আমি এসেছি এক শত্রুর সন্ধানে।
শত্রু! কোন শত্রু?
যার সন্ধানে এসেছি, তাকে স্বমূর্তি নিয়ে খুঁজতে গেলে ঝামেলায় পড়তাম লস্করটা শাসিয়ে রেখেছিল। তাই এসেছিলাম ছদ্মমূর্তিতে। এই বাড়ির পেছনে পলের জেটির কোণে একটা চোরা দরজা দিয়ে রাতের অন্ধকারে কত লাশ যে পাচার হয়ে যায়, কেউ তার হিসেব রাখে না। টেমস নদীর ধারে এর চাইতে ভয়ংকর মানুষখুনের জায়গা আর নেই। নেভিল সিনক্লেয়ারের লাশও হয়তো ওইখান দিয়েই পাচার হয়েছে। যাক সে-কথা, গাড়িটা গেল কোথায়?
বলে,মুখে আঙুল পুরে শিস দিয়ে উঠল হোমস–অন্ধকারে ভেসে এল আর একটা শিসের আওয়াজ। একটু পরেই ঘড় ঘড় শব্দে একটা একঘোড়ার হালকা গাড়ি এসে দাঁড়াল সামনে।
ওয়াটসন, আসবে নাকি?
যদি কাজে লাগি, নিশ্চয় আসব।
বিশ্বাসী সহয়োগীর দরকার সবসময়েই, বিশেষ করে যদি সে জীবনীকার হয়। সিডার্সে আমি যে-ঘরে আছি, সেখানে খাট আছে দু-খানা–কাজেই তোমার অসুবিধে হবে না।
সিডার্সে কেন?
ওখানেই থাকেন মি. সেন্ট ক্লেয়ার। তদন্ত করছি ওখান থেকেই।
কিন্তু ব্যাপারটা কী? আমি যে এখনও অন্ধকারে।
অন্ধকার এখুনি কাটবে, বন্ধু। নাও উঠে পড়ো। জন, তোমাকে আর দরকার নেই। এই নাও আধ ক্রাউন। কাল এগারোটায় এসো।
হোমস নিজেই চাবুক হাঁকিয়ে ঘোড়া ছোটাল এঁকাবেঁকা, অন্ধকার রাস্তা দিয়ে। তন্ময় হয়ে রইল আপন চিন্তায় একটা কথাও বলল না শহর ছাড়িয়ে না-আসা পর্যন্ত।
তারপর যেন সম্বিৎ ফিরে পেল। মনে হল চিন্তার ফসল ফলছে–মনের ধাঁধা কেটেছে। তামাকের পাইপ ধরিয়ে বললে, ওয়াটসন, সত্যিই তুমি আদর্শ সহযোগী। কী চমৎকার চুপ করে ছিলে এতক্ষণ। ক্ষমতা আছে বটে। কিন্তু মুশকিল কী জানো, ভদ্রমহিলাকে কী বলে বোঝাই যে সর্বনাশ যা হবার তা হয়েই গেছে।
আমি কিন্তু এখনও আঁধারে।
বলছি, বলছি। সূত্র পেয়েছি অনেক, কিন্তু এমন জড়িয়ে রয়েছে যে খুলতে পারছি না। সব গুলিয়ে যাচ্ছে।
বেশ তো, খুলেই বলো না।
১৮৮৪ সালের মে মাসে নেভিল সেন্ট ক্লেয়ার নামে এক অবস্থাপন্ন ভদ্রলোক এসে লীতে বাড়ি ঘরদোর কিনে বেশ বড়োলোকের মতোই বসবাস শুরু করেন। কিছুদিন পরে ওই তল্লাটেরই একটি মেয়ে বিয়ে করেন এবং দুটি বাচ্চাও হয়। ভদ্রলোক ব্যাবসাসূত্রে রোজ সকালে লন্ডন যান। বিকেল পাঁচটা চোদ্দোর গাড়িতে ফিরে আসেন। বয়স ৩৭। সচ্চরিত্র। খাঁটি ভদ্রলোক—পাড়ায় সুনাম আছে। ব্যাঙ্কে টাকা আছে।
গত সোমবার ভদ্রলোক লন্ডন রওনা হওয়ার সময়ে বলে গেলেন ছেলের জন্যে একবাক্স চৌকো কাঠ নিয়ে ফিরবেন–খেলনার বাড়ি তৈরির জন্যে। বেরিয়ে যাওয়ার পরেই একটা টেলিগ্রাম এল একটা দামি পার্সেল এসেছে, জাহাজঘাটা থেকে ছাড়িয়ে আনতে হবে। মিসেস সিনক্লেয়ার নিজেই লন্ডনে গেলেন। পার্সেল ছাড়িয়ে জাহাজ কোম্পানির অফিস থেকে বেরোলেন চারটে পঁয়ত্রিশে। জায়গাটা মোটেই ভালো নয়। জাহাজঘাটা তো। তোমার সঙ্গে যেখানে আজ দেখা হল, তার কাছেই। তাই গাড়ির সন্ধানে এদিক-ওদিক তাকাতে গিয়ে হঠাৎ কানে ভেসে এল একটা চাপা ভয়ার্ত চিৎকার। চমকে উঠলেন ভদ্রমহিলা। চোখ তুলতেই দেখলেন একটা দোতলা বাড়ির জানলায় দাঁড়িয়ে তার স্বামী হাত নাড়ছেন–কী যেন বলতে চাইছেন। মুখ-চোখ ভয়ে উত্তেজনায় ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। গায়ে কোট আছে, কিন্তু বাঁ-কলার নেই। আফিংয়ের আড্ডাটা এই বাড়ির তলাতেই–যেখানে আজ তুমি গেছিলে।
ভীষণ ঘাবড়ে গেলেন মিসেস সিনক্লেয়ার। একটু বুঝলেন যে স্বামী বিপদগ্রস্ত। তৎক্ষণাৎ দিশেহারা হয়ে ছুটলেন বাড়ির ভেতরে। কিন্তু দোতলায় ওঠা আর হল না। সিঁড়ি থেকেই বদমাশ লস্করটা তার একজন স্যাঙাতকে নিয়ে বার করে দিল তাকে বাড়ির বাইরে।
ছুটতে ছুটতে রাস্তা থেকে পুলিশ ডেকে এনে ফের বাড়িতে ঢুকলেন মিসেস সিনক্লেয়ার। কিন্তু দোতলায় উঠে দেখা গেল সেখানে থাকে একজন কদাকার পঙ্গু। সিনক্লেয়ার বলে কেউ নাকি সেখানে আসেনি, একবাক্যে বললে লস্কর আর বীভৎস-দর্শন পঙ্গুটি।
এই সময়ে একটা আবিষ্কার করে বসলেন মিসেস সিনক্লেয়ার। চিৎকার করে দৌড়ে গেলেন টেবিলের দিকে। দেখা গেল সেখানে একবাক্স কাঠের চৌকো ব্লক পড়ে রয়েছে এই খেলনাটাকেই বাড়ি ফেরার সময়ে কিনে আনবেন বলেছিলেন মি. সিনক্লেয়ার।
এবার সন্দেহ হল পুলিশের। ঘরদোর খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, বাড়ির পেছনেই টেমস নদী। একটা জানলা সেইদিকেই এবং জানলার গরাদে কাঁচা রক্তের দাগ। শোবার ঘরেও পাওয়া গেল মি. সিনক্লেয়ারের ঘড়ি, টুপি, মোজা, জুতো–কেবল তাকে বাদে। অথচ জামাকাপড়ে এমন কোনো চিহ্ন নেই যা দেখে বোঝা যায় দারুণ একটা ধস্তাধস্তি হয়ে গেছে।
লস্করটার পূর্ব ইতিহাস সুবিধের নয়। তার আচরণ সন্দেহজনক সিঁড়ির মুখে সে-ই পথ আটকেছিল মিসেস সিনক্লেয়ারের। বিকলাঙ্গ ভাড়াটে হিউ বুন সম্বন্ধে সে কোনো খবর রাখে না–মি. সিনক্লেয়ারের জামাকাপড় কীভাবে ওখানে গেল, তাও জানে না।
কদাকার বিকট ভাড়াটে লোকটা আসলে পেশাদার ভিখিরি। রাস্তার মোড়ে রোজ বসে টুপি পেতে। চকচকে কালো চোখ, একমাথা কমলা রঙের চুল, মুখে যেন কথার খই ফুটছে, মুখজোড়া একটা ভীষণ কাটার দাগ আছে–চামড়া গুটিয়ে যাওয়ার ফলে ওপরের ঠোঁটটা বেঁকে উঠে গেছে ওপরদিকে। পুলিশের চোখে ধূলো দেওয়ার জন্যে বেশ কিছু মোমের দেশলাই নিয়ে বসে থাকে রোজ একই জায়গায়। লক্ষ করেছি ওর ওই বীভৎস চেহারার অনুপাতে চটপটে চতুর কথাবার্তা আর কালো চোখের চাহনির জন্যে অন্য ভিখিরিদের চেয়ে ওর দিকেই নজর পড়ে বেশি। রোজগারও বেশি। মনে রেখো, এই লোকই থাকে আফিং আড্ডার দোতলায় যেখানে শেষবারের মতো দেখা গেছে মিস্টার সিনক্লেয়ারকে।
কিন্তু বিকৃত যার অঙ্গ, তার দ্বারা এ কাজ কি সম্ভব?
সামান্য একটু খুঁড়িয়ে চলে–তা ছাড়া স্বাস্থ্য ভালোই। ডাক্তারি মতে কিন্তু যাদের একটা প্রত্যঙ্গ পড়ে যায়, অন্য প্রত্যঙ্গের জোরে তার অভাব পুষিয়ে নেয়।
তারপর?
হিউ বুনকে সঙ্গেসঙ্গে গ্রেপ্তার করা উচিত ছিল। গ্রেপ্তার যখন করা হল, তার আগেই বদমাশ ওই লস্করটার সঙ্গে তার শলাপরামর্শ হয়ে গেছে, বুনের জামার হাতায় রক্তের দাগ কেন–এ-প্রশ্নের উত্তরে সে বললে, আঙুল কেটে গেছে বলে। সেই রক্তই জানলার গরাদেও লেগেছে। মি. সিনক্লেয়ার নামধারী যাকে দেখেছেন বলে চেঁচাচ্ছেন মিসেস সিনক্লেয়ার–সে-রকম কেউ তার ঘরে আসেনি। ভদ্রমহিলার মতিভ্রম অথবা দৃষ্টিভ্রম–দুটোর একটা ঘটেছে।
পুলিশ ইনস্পেকটর বুদ্ধি করে বাড়িতে থেকে গেলেন জোয়ারের জল নেমে গেলে কাদায় কিছু পাওয়া যায় কি না দেখবার জন্যে। পেলেনও। একটা কোট। মি. সিনক্লেয়ারের। ডেডবডি কিন্তু পাওয়া গেল না। কোটের পকেটে কী ছিল আন্দাজ করতে পার?
না।
রাশি রাশি খুচরো পয়সা। কোট ভেসে যায়নি ওই কারণেই ভারী হয়ে গিয়েছিল। মড়াটা ভেসে গেছে।
কিন্তু কোট সমেত একটা মড়াকে ফেলে দেওয়া হল জলে–বাদবাকি জামা জুতো মোজা পাওয়া গেল ওপরের ঘরে–এটাই-বা কী ব্যাপার?
ধরো, মড়াটা আগে জানলা দিয়ে ফেলেছে বুন। তারপর ভিক্ষের পয়সা দিয়ে কোটটাকে ভারী করেছে–এমন সময়ে নীচে চেঁচামেচি শুনে তাড়াতাড়ি করে অন্য জামাকাপড় শোয়ার ঘরে লুকিয়ে রেখে কোটটাকে ফেলে দিয়েছে জানলা দিয়ে যাতে ভারী বলে কাদায় আটকে যায়।
তা হতে পারে।
বুন এখন হাজতে। কিন্তু কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না মরতে মি. সিনক্লেয়ার আফিংয়ের আড্ডায় গেলেন কেন। বুন লোকটাও শান্ত স্বভাবের ভিখিরি–আজ পর্যন্ত কোনো বেচাল দেখা যায়নি। সব মিলিয়ে এমন রহস্যের গোলকধাঁধা সৃষ্টি হয়েছে যে খেই পাচ্ছি না।
কথা বলতে বলতে গাড়ি পৌঁছে গেল সিডার্সে। নুড়িবিছানো পথ ধরে একটা বড়ো বাড়ির দিকে এগোল গাড়ি। দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন স্বর্ণকেশী এক ভদ্রমহিলা। দুজন পুরুষ মূর্তিকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে অস্ফুট হর্ষধ্বনি করে উঠেছিলেন। তারপরেই আমাকে দেখে আর হোমসের কালো মুখ লক্ষ করে মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল।
কী খবর আনলেন? ভালো, না খারাপ?
দুটোর কোনোটাই নয়।
আমার সঙ্গে ভদ্রমহিলার পরিচয় করিয়ে দিলেন হোমস। বাড়ির ভেতর যাওয়ার পর খাবার ঘরে ঢুকলাম।
তারপরেই আচমকা জিজ্ঞেস করলেন মিসেস সিনক্লেয়ার, মি. শার্লক হোমস, আপনাকে দু-একটা কথা সোজা জিজ্ঞেস করব, সোজা উত্তর দেবেন। ঘোরপ্যাচের দরকার নেই। ধাক্কা সইবার মতো শক্ত ধাত আমার আছে–মূছা যাব না।
কী ব্যাপার বলুন তো?
আমার স্বামী বেঁচে আছে?
হকচকিয়ে গেল শার্লক হোমস। হেলান দিয়ে বসল ঝুড়ি-চেয়ারে। কার্পেটে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ্ণচোখে তাকিয়ে ফের বললেন মিসেস সিনক্লেয়ার, খুলে বলুন!
খুলেই বলছি ম্যাডাম, আমি জানি না।
কী মনে হয় আপনার? মারা গেছে?
সেইরকম মনে হয়।
খুন হয়েছে?
অতটা বলব না। হতেও পারে।
কবে মারা গেছে বলে মনে হয়?
সোমবার।
মি. হোমস, এ-চিঠি তাহলে আজকে তার কাছ থেকে পেলাম কী করে বলতে পারেন?
ইলেকট্রিক শক খেলে মানুষ যেমন ছিটকে যায়, সেইভাবে তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে চেঁচিয়ে উঠল শার্লক হোমস, বলেন কী!
এক টুকরা কাগজ নাড়তে নাড়তে হাসিমুখে বললেন মিসেস সিনক্লেয়ার, হা, আজই পেয়েছি।
দেখতে পারি?
নিশ্চয়।
সাগ্রহে কাগজটা হাত থেকে ছিনিয়ে নিল হোমস। আমিও গিয়ে দাঁড়ালাম পাশে। ডাকঘরের ছাপ গ্রেভসএন্ডের তারিখ সেই দিনেরই।
হাতের লেখা তো দেখছি জঘন্য, যেমন মোটা, তেমনি ধ্যাবড়া, আপন মনেই বললে হোমস। এ নিশ্চয় আপনার স্বামীর নয়?
না, কিন্তু খামের মধ্যে যেটি এসেছে, সেটি আমার স্বামীই লিখেছে।
ঠিকানা লেখবার সময়ে একে-ওকে জিজ্ঞেস করতে হয়েছে দেখছি।
কেন বললেন?
নামটা লেখা হয়েছে বেশ ঘন কালো কালিতে–আপনা থেকেই শুকিয়ে গেছে। বাকি লেখাটা ধূসর রঙের–তার মানে ব্লটিং পেপার ব্যবহার করা হয়েছে। নামধাম একটানা লিখে গিয়ে ব্লটিংপেপার চেপে ধরলে নামের জায়গাটা কেবল এত নিকষ কালো হত না। অর্থাৎ নাম লেখার পর ঠিকানা জানবার জন্যে সবুর করতে হয়েছে। ব্যাপারটা সামান্য কিন্তু সামান্য ব্যাপারের মধ্যেই বেশি গুরুত্ব থাকে। এবার চিঠি নিয়ে পড়া যাক। আরে! আরে! চিঠি ছাড়াও খামের মধ্যে আরও কিছু একটা পাঠানো হয়েছিল দেখছি।
আংটি–আমার স্বামীর।
চিঠির লেখা আপনার স্বামীর তো?
হ্যাঁ। খুব তাড়াতাড়ি লিখলে এইভাবে লেখে।
চিঠিখানা পড়ল হোমস, সুপ্রিয়া, ভয় পেয়ো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। বিরাট একটা ভুল হয়েছে। শুধরোতে সময় লাগবে। ধৈর্য ধরো।–নেভিল। পেনসিল দিয়ে লেখা হয়েছে অক্টেড সাইজের বইয়ের পুস্তনিতে–কাগজে জলছাপও দেখছি না। হুম! ডাকে ফেলেছে আজকে–যে ফেলেছে তার বুড়ো আঙুলটা রীতিমতো নোংরা। বাঃ! খামের মুখ যে সেঁটেছে, তার আবার তামাক চিবোনোর অভ্যেসও আছে। লেখাটা তাহলে আপনার স্বামীর?
নিশ্চয়।
চিঠি যখন আজকে ডাকে ফেলা হয়েছে, তখন অন্ধকারে আলো দেখা যাচ্ছে তবে পুরোপুরি বিপদমুক্ত হয়েছেন–এ-কথা বলা যায় না।
বেঁচে তো আছে।
সেটা বলাও মুশকিল। হাতের লেখা নকল হতে পারে। আঙুল থেকে আংটিও খুলে নেওয়া যেতে পারে।
কিন্তু আমি বলব হাতের লেখা ওরই।
হয়তো চিঠি লিখেছিলেন আগে, ডাকে ফেলা হয়েছে আজকে। এর মাঝে অনেক কিছুই ঘটতে পারে।
আপনি বড়ো ভয় দেখান, মি. হোমস। এত বড়ো সর্বনাশ হলে আমি টের পেতাম না বলতে চান? জানেন, যাওয়ার দিন পাশের ঘরে হাত কেটে ফেলেছিল, খাবার ঘরে বসে ঠিক টের পেয়েছিলাম, মনে হল, নিশ্চয় কিছু একটা হয়েছে ওর। দৌড়ে গিয়ে দেখি সত্যিই আঙুল কেটে বসে আছে। মারা গেলে তো বুঝতে পারবই।
ঠিক কথা। অনেক সময়ে দেখা গেছে মেয়েদের মন যুক্তিকেও টেক্কা দেয়। কিন্তু বেঁচেই যদি আছেন তো চিঠি লিখতে গেলেন কেন? আসতে কী হয়েছে?
সেইখানেই তো ধোঁকা লাগছে।
আচ্ছা, দোতলার সেই বাড়িটায় আপনি ওঁকে খোলা জানলা দিয়ে দেখেছিলেন, তাই না?
হ্যাঁ।
জানলা খোলা থাকা সত্ত্বেও আপনাকে নাম ধরে না-ডেকে শুধু চেঁচিয়ে উঠলেন কেন? চেঁচানিটা কী ধরনের? বিপদে পড়ে সাহায্য চাওয়ার মতো কি?
হাত নাড়াটা সেই ধরনের।
এমনও তো হতে পারে আপনাকে দেখে তাজ্জব হয়ে গিয়ে দু-হাত শুন্যে উঠিয়েছিলেন?
অসম্ভব কিছু নয়।
তারপরেই কেউ যেন পেছন থেকে হ্যাচকা টান মেরে সরিয়ে নিল?
যেভাবে দুম করে সরে গেল জানলা থেকে, মনে হল পেছনে কেউ ছিল–টেনে নিল। নিজেই লাফ মেরে পেছিয়ে গেছেন কি না জানছেন কী করে? ঘরে ঢুকেও তো আর কাউকে দেখেননি?
বিকট চেহারার সেই লোকটা ছিল–নিজে কবুল করেছে।
ওই অঞ্চলে বা ওখানকার আফিংয়ের আড্ডায় উনি আগে কখনো যেতেন?
না।
আর কথা হল না। খাওয়ার পর ঢুকলাম শোবার ঘরে। খাটের ওপর বালিশ আর কুশন সাজিয়ে তার ওপর আয়েশ করে বসল হোমস–সামনে রাখল অনেকখানি তামাক। বুঝলাম সারারাত তামাক খাবে আর ধ্যান করবে কূট-সমস্যা নিয়ে। চোখে ঘুম নামার সময়েও দেখলাম শিবনেত্র হয়ে ঠায় বসে–গল গল করে নীলচে ধোঁয়া উঠছে কড়িকাঠের দিকে।
ভোরবেলা চোখ মেলে দেখলাম, ঠিক এইভাবেই বসে আছে সে শুধু যা সামনের তামাকস্তূপ উধাও হয়েছে।
চলো ওয়াটসন, একটু বেরোনো যাক, প্রসন্ন কণ্ঠ হোমসের কাল রাতের সমস্যাপীড়িত মুখচ্ছবিও আর নেই।
তখন ভোর চারটে। বাড়ির কেউ ওঠেনি। সহিসকে গাড়ি প্রস্তুত করতে বলে এল হোমস। জামা-জুতো পরতে পরতে বললে, ওয়াটসন, ইউরোপের সবচেয়ে হাঁদারাম লোকটা এখন তোমার সামনে। সমস্যার সমাধান করে এনেছি বললেই চলে–চাবির সন্ধান পাওয়া গেছে।
চাবিটি এখন কোথায়?
কলতলায়। সেখান থেকে নিয়ে আমার ব্যাগে রেখেছি। দেখি এবার সমস্যার তালা খুলতে পারি কি না!
গাড়ি ছুটল লন্ডন অভিমুখে। যেতে যেতে হোমস শুধু বললে, কেসটা খুবই বিচিত্র। প্রথমটা খুবই ধাঁধায় ফেলেছিল।
থানায় পৌঁছে ইনস্পেকটর ব্র্যাডস্ট্রিটের ঘরে ঢুকল হোমস।
বলল, হিউ বুন এখন হাজতে তো?
হ্যাঁ। খুব শান্ত ধরনের আসামি–কিন্তু এত নোংরা যে কহতব্য নয়।
কেন বলুন তো?
আরে মশাই কিছুতেই মুখের তেলকালি ধোয়াতে পারলাম না। কোনোমতে কেবল হাতজোড়া বোয়ানো গেছে।
এখন একবার দেখা যাবে?
আসুন।
ব্যাগ হাতে ইনস্পেকটরের পেছন পেছন চলল হোমস এল হাজতখানায়। আমি আছি সঙ্গে। সরু করিডর–দু-পাশে সারি সারি বন্ধ দরজা। একটা দরজার ওপর থেকে তক্তা সরিয়ে ইনস্পেকটর বললে–ঘুমোচ্ছে এখনও।
আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে ঘুমোচ্ছে ভিখিরি হিউ বুন। সে কী মুখ! দুনিয়ার কদর্যতা জড়ো হয়েছে বক্র ওষ্ঠ আর বিরাট ক্ষতচিহ্নটার মধ্যে। চোখ থেকে থুতনি পর্যন্ত কেটে গিয়েছিল–ক্ষতস্থান শুকিয়ে যেতে চামড়া টেনে ধরেছে। ওপরের ঠোঁট উলটে গেছে। তিনটে দাঁত বেরিয়ে পড়েছে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও যেন দাঁত খিচিয়ে রয়েছে। দারুণ জ্বলজ্বলে এক মাথা লালচে চুল কপাল আর চোখ ঢেকে রেখেছে। গায়ে রঙিন শার্ট আর ছেড়া কোট। ননাংরামি দিয়েও কুৎসিত মুখ ঢাকা যায়নি।
বিউটিফুল, তাই না? বলে ইনস্পেকটর।
সেইজন্যেই তো তৈরি হয়ে এসেছি–রূপটাকে ফুটিয়ে তোলা দরকার। বলে ব্যাগ খুলে একটা বিরাট স্পঞ্জ বার করল হোমস।
এ আবার কী? হেসে ফেলে ইনস্পেকটর।
আস্তে খুলুন দরজাটা–শব্দ না হয়।
প্রায় নিঃশব্দে চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলে দিল ইনস্পেকটর। ঘরের কোণে জলপাত্রে স্পঞ্জ ড়ুবোল হোমস এবং আচমকা গায়ের জোরে ঘষতে লাগল ঘুমন্ত বন্দির মুখখানা।
সেইসঙ্গে সে কী চিৎকার, আলাপ করিয়ে দিই আসুন, ইনিই নিখোঁজ মি. নেভিল সিনক্লেয়ার।
যেন ম্যাজিক দেখলাম চোখের সামনে। স্পঞ্জের জোরালো ঘর্ষণে দেখতে দেখতে যেন একটা খোসা উঠে গেল ভিখিরিটার মুখ থেকে ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেল তেলকালি আর দগদগে কাটার দাগটা। হ্যাচকা টানে অন্তর্হিত হল লাল টকটকে পরচুলা।
লজ্জায় অপোবদনে বিছানায় উঠে বসল খাঁটি ভদ্রলোকের চেহারা নিয়ে এক ব্যক্তি। পরমুহূর্তেই বুঝল–খেল খতম। আর্ত চিৎকার করে আছড়ে পড়ল বিছানায়।
ইনস্পেকটর হতবাক হয়ে গেছিল। এখন যেন সম্বিৎ ফিরে পেল, আরে সর্বনাশ! ইনিই তো নেভিল সিনক্লেয়ার ছবিতে এই চেহারাই তো দেখেছি।
বিছানা ছেড়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে মরিয়া সুরে নেভিল সিনক্লেয়ার বললেন, বেশ করেছি। আমার বিরুদ্ধে যদি কোনো অভিযোগ থাকে তো বলুন।
অভিযোগ? মুচকি হেসে ইনস্পেকটর বলল, সেটা তো প্রায় আত্মহত্যার অভিযোগ হয়ে দাঁড়ায় নিজেই নিজেকে গুমখুন করেছেন।
হোমস বললে, না তা নয়। অভিযোগটা স্ত্রীকে ঠকানোর। তাকে সব বলা উচিত ছিল।
কী করে বলি বলুন, যদি ছেলে-মেয়েরা জেনে ফেলে? মাথা কাটা যাবে যে।
এখন কি আর কিছু চাপা থাকবে। কেলেঙ্কারি যদি এড়াতে চান তো থানায় এজাহার দিয়ে যান ইনস্পেকটর মনে করলে আদালত পর্যন্ত ব্যাপারটা গড়াতে দেবেন না। আপনিও ছাড়া পাবেন।
ককিয়ে উঠলেন সিনক্লেয়ার, বলল, বলব, সব বলব। এ-কথা ছেলে-মেয়েদের কানে উঠলে বাড়িতে আর মুখ দেখাতে পারব না। তার চাইতে ফাঁসিতে মরা ভালো।
শুনুন কী হয়েছিল ব্যাপারটা! এক সময়ে আমি খুব দেশ বেড়িয়েছি, অভিনয় করেছি, সাংবাদিকতাও করেছি। লেখাপড়াও করেছিলাম ভালোভাবে। একদিন ভিখিরিদের নিয়ে প্রবন্ধ লেখার ফরমাশ হল আমার ওপর। ভেবে দেখলাম, ভিখিরিদের নাড়িনক্ষত্র জানতে হলে ভিখিরি সাজাই ভালো। অভিনয় করতে জানতাম বলে ভিখিরির ছদ্মবেশটা ধরলাম ভালোই, ভিক্ষেও করলাম সারাদিন, খুচরো পয়সা গুনতে গিয়ে চোখ কপালে উঠল! মাত্র সাত ঘণ্টায় ছাব্বিশ শিলিং চার পেনি!
যাই হোক, অভিজ্ঞতাটা হঠাৎ একদিন কাজে লেগে গেল। দেনার দায়ে রাতের ঘুম উড়ে গেছিল। পঁচিশ পাউন্ড দেনা মিটিয়ে দিলাম দশ দিনের ভিক্ষের টাকায়।
এরপর থেকেই পুরোপুরি ভিক্ষাবৃত্তি শুরু করলাম। প্রথমটা একটু দোটানায় পড়েছিলাম। অন্তর্দ্বন্দ্ব লেগেছিল টাকার লোভ আর আত্মসম্মানে। শেষ পর্যন্ত সহজে টাকা রোজগারের লোভ আর ছাড়তে পারলাম না। সাংবাদিকতা করেও এত টাকা কখনো পাব না। রোজ বাড়ি থেকে বেরোতাম ভদ্রলোক সেজে, আফিংয়ের আড্ডার দোতলায় ভিখিরি সাজতাম, বিকেল হলে ওখান থেকেই ফের ভদ্রলোক সেজে বাড়ি ফিরতাম। লস্করটার মুখ বন্ধ রেখেছিলাম পয়সা খাইয়ে।
এইভাবেই একদিন বাড়ি কিনলাম, বিয়ে করলাম, বাবা হলাম। আমার রোজগার এখন বছরে সাতশো পাউন্ড। আমার চেহারা আর কথার জন্যেই এত রোজগার সম্ভব হয়েছে।
গত সোমবার ভিখিরির সাজপোশাক ছেড়ে ভদ্রলোক সাজছি, এমন সময়ে জানলা দিয়ে রাস্তায় স্ত্রীকে দেখলাম। এদিক-ওদিক কাকে খুঁজছে দেখে ভড়কে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠি। সঙ্গেসঙ্গে জানলা থেকে সরে এসে লস্করকে বলি স্ত্রীকে যেন ওপরে উঠতে না-দেয়। নীচে যখন চেঁচামেচি চলছে, আমি তখন নতুন করে ভিখিরি সাজছি–এ এমনই ছদ্মবেশ যে বউ পর্যন্ত ঠকে যাবে জানতাম। কিন্তু পাছে পুলিশের হাঙ্গামা হয়, তাই খুচরো পয়সা দিয়ে কৌটোটা ভারী করে ফেলে দিলাম নদীতে। অন্য জামাকাপড়গুলো ফেলবার আগেই এসে হাজির হল পুলিশ। গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই লস্করটাকে একটা চিঠি লিখে দিই স্ত্রীর নামে সেইসঙ্গে খুলে দিয়েছিলাম হাতের আংটিটা যাতে উদবেগে না-থাকে।
চিঠি তো পেয়েছেন কালকে।
কালকে। সে কী! তাহলে এই সাতটা দিন তো ভীষণ উদবেগে কেটেছে বেচারির।
লস্করের পেছনে পুলিশ ঘুরছিল যে–চিঠিখানা তাই কাউকে দিয়ে কালকে পোস্ট করেছে, বললে ইনস্পেকটর। যাই হোক, ব্যাপারটা আমি ধামাচাপা দিতে পারি যদি এ-কাজ জন্মের মতো ছেড়ে দেন। হিউ বুন হওয়া আর চলবে না।
কথা দিচ্ছি।
মি. হোমস, এতবড়ো ধাঁধাটা সমাধান করলেন কী করে বলুন তো?
বালিশের পাহাড়ে বসে এক আউন্স তামাককে ধোঁয়া বানিয়ে, বলে হাসতে হাসতে আমাকে নিয়ে থানা থেকে বেরিয়ে এল শার্লক হোমস।
————-
টীকা
১. বক্রোষ্ঠ ব্যক্তির রহস্য : দ্য ম্যান উইথ দ্য টুইস্টেড লিপ ১৮৯১-এর ডিসেম্বর মাসের স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। নিউইয়র্কের স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনে এই গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল দ্য স্ট্রেঞ্জ টেল অব আ বেগার নামে ১৮৯২-এর জানুয়ারি সংখ্যায়।
২. আফিমের রস : পপি-গাছের কঁচা বীজের থেকে নিষ্কাষিত আফিমের রস বা লডেনাম (Laudanum) ভিক্টোরীয় ইংলন্ডে বেদনানাশক হিসেবে ব্যবহৃত হত।
৩. লন্ডন ব্রিজের : প্রথম লন্ডন ব্রিজ টেমস নদীর ওপর নির্মিত হয়, রোমান শাসকদের রাজত্বে ৪৩ খ্রিস্টাব্দে। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধবিগ্রহ প্রভৃতির পর এই ব্রিজের বহুবার মেরামত এবং পুনর্নির্মাণ ঘটেছে। টেমসের ওপরে লন্ডনে প্রথম প্রস্তর নির্মিত সেতুটির নির্মাণ শেষ হয় ১২০৯ সালে। ওই ব্রিজের সামান্য উত্তরে অবস্থিত যে-সেতুর কথা বর্তমান কাহিনিতে বলা হয়েছে, সেটি তৈরি হয় ১৮৩১-এ।
৪. আফিং-এর নল : লম্বা নলের প্রান্তে আটকানো ধাতব বাটির মধ্যে আফিম রেখে নলের অপর প্রান্ত দিয়ে আফিং সেবন করা হয়। আফিং সংক্রান্ত নানাবিধ বিধিনিষেধ থাকলেও ইংরেজরা চিন এবং অন্যান্য দেশে নিয়মিত আফিং রপ্তানি করে এসেছে।
৫. একঘোড়ার হালকা গাড়ি : এই গাড়ি সম্ভবত ডগ-কার্ট। দু-চাকার এই গাড়িতে পিঠোপিঠি অবস্থায় দুজনের বসবার ব্যবস্থা। পিছনের আসনটি ভাঁজ করে কুকুর নিয়ে যাওয়ার কাজে ব্যবহৃত হত, তাই এই গাড়ির নাম ডগ-কার্ট হয়েছে।
৬. অক্টেভ সাইজের : ছাপা কাগজ আট ভাজ করে সেলাই করা বই। দু-ভাজের বইকে ফোলিয়ো সাইজ এবং চার ভজের বইকে কোয়ার্টা সাইজ বলা হয়।
৭. ইনস্পেকটর ব্র্যাডস্ট্রিট : এই গল্প ছাড়া দ্য ব্লু কার্বাঙ্কল এবং দ্য ইঞ্জিনিয়ার্স থাম্ব গল্পে ইনস্পেকটর ব্র্যাডস্ট্রিটকে দেখা গিয়েছে। তবে প্রত্যেক ক্ষেত্রেই ইনস্পেকটরের পোস্টিঙের অঞ্চল বদলে যেতে দেখা যায়।
Post a Comment