উজির ও বাদশাহর ছেলের গল্প
কোন এক দেশে এক বাদশাহ রাজত্ব করতেন। তার একটা ছেলে ছিল। শিকার আর ঘোড়ায় চড়ার দিকে তার ছিল খুব ঝোঁক। এক উজির সেই ছেলের দেখাশোনা করতেন। কিন্তু এই কাজটা উজির মোটেও সম্মানের চোখে দেখতেন না।তিনি মনে করতেন এসব ছোট কাজ করে তার সম্মান নষ্ট হচ্ছে।এ থেকে তিনি রেহাই পাওয়ার পথ খুঁজতে লাগলেন।
এক সকালে উজির বাদশাহের ছেলেটাকে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে শিকারে বেরোলেন। পথে তাদের সামনে বিচিত্র চেহারার এক জস্তুকে দেখতে পেলেন তারা। হতচ্ছাড়াটা পথ আগলে দাঁড়িয়ে ছিল। বাদশাহের ছেলে দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে চলল সেই অদ্ভুত জন্তুটাকে ধরার জন্য কিন্তু পারল না। সেটা চোখের পলকে কোথায় যেন গা-ঢাকা দিল। রাজকুমার পথ হারিয়ে ফেলল। পথ হারিয়ে ভয়ে রাজকুমার কাঁদতে কাঁদতে হাঁটতে লাগল। কিছুদূর যেতেই পথের ধারে এক সুন্দরী মেয়েকে সে দেখতে পেল।সেও ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। রাজকুমার মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করল—কে গো তুমি? এমন করে কাঁদছ কেন?
মেয়েটি বলল—আমি হিন্দের শাহজাদী। আমার দলের লোকদের হারিয়ে ফেলেছি। বড়ই অসহায় হয়ে পড়েছি।”
রাজকুমার হিন্দের শাহজাদীকে নিজের ঘোড়ার পিঠে তুলে নিল। কিছুদূর গিয়ে পথে একটা ভাঙাচোরা পোড়ো বাড়ি দেখতে পেল।
শাহজাদী ঘোড়া থামাতে বলল। রাজকুমার ঘোড়া থামালে শাহজাদী বলল, আমি একটু দেশে আসি ওই ছোট্ট ঘরটিতে কেউ আছে কিনা। যদি কেউ থেকে থাকে তবে তার কাছে থেকে বন থেকে বের হওয়ার পথ জেনে আসব। সে বাড়িটার ভেতরে ঢুকে গেল। রাজকুমার ঘোড়া নিয়ে সদর-দরজায় দাঁড়িয়ে রইল। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও শাহজাদী ফিরছেন না দেখে তার কৌতুহল হ’ল। ঘোড়াটাকে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে পোড়ো বাড়িটার ভেতরে ঢুকে গেল। আড়াল থেকে দেখতে পেল, শাহজাদী এক রাক্ষসীর রূপ ধারণ করেছে। ঘরের ভেতরে আরো দুটে রাক্ষসী দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে। বুড়ো আর বুড়ি রাক্ষসী। মেয়েটা বলল –‘আজ তোমাদের জন্য একটা মোটাসোটা মানুষ ধরে এনেছি। তাকে খেয়ে আমাদের আজ পেট ভরে যাবে।
বুড়ি-রাক্ষসী বলল—তাই বুঝি? কোথায় রেখেছিস বেটি? নিয়ে আয় । তার খেয়ে পেট ঠান্ডা করি।”
কথাগুলো কানে যেতেই রাজকুমারের কলিজা শুকিয়ে গেল। কোনরকমে সে জীবন নিয়ে পালাতে চেষ্টা করল। পারল না। এরই মধ্যে রাক্ষসী-মেয়েটা আগের সে রূপবতীর চেহারা নিয়ে দরজার বাইরে চলে এসেছে। রাজকুমারকে বলল—কি ব্যাপার তোমার চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ, কাঁপছ, ব্যাপার কি?’
—“বোধ হয় আমি শক্রর ডেরায় এসে পড়েছি।
—শত্রুর ডেরায় ?
তুমিই তো বলেছিলে তুমি নাকি বাদশাহের ছেলে। বাদশাহের ছেলেরা তো বীর হয়। তুমি তাদের তোমার শক্তিদিয়ে পরাজিত করছ না কেন?
—‘ওরা মানুষ নয়। আমার গায়ের নরম মাংসের দিকে এদের নজর ”
কথা জানতে পেরে গেছে? তবে তো একে ভুলিয়ে ভালিয়ে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যাওয়া যাবে না। এবার রাজকুমারকে লক্ষ্য করে বলল—“তবে এক কাজ কর, ঈশ্বরের নাম কর। একমাত্র তিনিই যদি পারেন তোমায় রক্ষা করবেন। ’
রাজকুমার এবার হাঁটুগেড়ে, চো্খ বন্ধু করে বসে ঈশ্বরের নাম করতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে চোখ খুলে দেখে মেয়েটা এরই মধ্যে পালিযে গেছে!
রাজকুমার সুযোগ বুঝে সেখান থেকে দৌড়ে পালাল। প্রাসাদে ফিরে সে তার বাবার কাছে ঘটনার বিবরণ দিল। সব শুনে বাদশাহ তো রেগে একেবরে আগুন! উজির নিজের কাজে গাফিলতি করার জন্যই তার ছেলে বিপদে পড়েছিল। এমনও হতে পারে এর সঙ্গে উজিরের কোন চক্রান্ত আছে। বাদশাহ তখনই উজিরকে ডেকে তাঁর গর্দান নেবার আদেশ দিলেন।
গল্প শেষ করে উজির বাদশাহ উনানকে বললেন— জাঁহাপনা, আমার মনে যদি এরকম কোন কুমতলব রয়েছ প্রমাণ হয় তবে আপনি আমাকে যে শাস্তি দেবেন হাসিমুখে তা বরণ করে নেব। এরপরও আমি বলছি, যাকে আপনি মুক্ত হাতে হাতে পুরস্কার দিয়ে তার মন ভরতে চাইছেন, সে আপনার শত্ৰু ছাড়া বন্ধু অবশ্যই নয়। আপনি শুনে রাখুন, সে ভিনদেশের গুপ্তচর। সে আপনাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করছে।
বাদশাহ বললেন—তবে আমার এখন কর্তব্য কি?
দরবারে আপনার সামনে তাকে হাজির হতে বলুন হুজুর। যত শীঘ্র সম্ভব তার গর্দান নেবার ব্যবস্থা করুন। আপনার গায়ে কাঁটার আঁচড় দেওয়ার আগেই তার জীবন নিয়ে নিন।’
বাদশাহের নির্দেশে এবার হেকিম রায়ান-এর খোঁজে দূত ছুটল। রায়ান খবর পেয়ে নিজেই ব্যস্ত হয়ে দরবারে ছুটে এলেন। হতভাগ্য তো জানেনও না মৃত্যু তার চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। কেবল হাত বাড়িয়ে আঁকড়ে ধরার সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে।
বাদশাহ উনান গম্ভীর স্বরে বললেন—আপনি কি জানেন হেকিম সাহেব, গর্দান দেওয়ার জন্য আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছি?
—“কিন্তু আমার অপরাধ কি তা তো অবশ্যই বলবেন, আশা করি।”
—আমার সভাসদরা আমাকে বলেছে, আপনি নাকি গুপ্তচর! আমাকে গোপনে হত্যা করার জন্য এই রাজসভায় এসেছেন। যদি এটা সত্যি হয় তবে আমার জীবন বাঁচাতে হলে আপনাকে আগেভাগেই হত্যা করতে হবে।’ কথা বলতে বলতে বাদশাহ করতালি দিয়ে ঘাতককে ডাকলেন। ঘাতক এসে কুনির্শ করে বাদশাহের সামনে দাঁড়াল। বাদশাহ উনান বললেন– এ বিশ্বাসঘাতকের এখনই গর্দান নাও।
হেকিম রায়ান সবিস্ময়ে বললেন—জাঁহাপনা, আমি আপনাকে কঠিন রোগ থেকে বাঁচিয়েছি। তার প্রতিদান দিচ্ছেন আমার গর্দান নিয়ে ? চমৎকার আপনার বিবেক, চমৎকার আপনার মানবিকতা!’
বাদশা বললেন—“আমার শেষ কথা শুনুন হেকিম সাহেব, আপনার ওপর থেকে আমার বিশ্বাস উবে গেছে। সামান্য একটা লাঠির সাহায্যে চিকিৎসা করে আপনি যখন আমার এমন কঠিন অসুখ সারিয়ে তুলতে পেরেছেন তখন আপনার অসাধ্য কোন কাজই নেই। তাই আপনার গর্দান নেবার মাধ্যমেই আমি আমার জীবনের নিরাপত্তা আনতে চাই। ফুলের গন্ধ বা অন্য কোনকিছুর গন্ধ শুকিয়েও আমাকে হত্যা করা আপনার পক্ষে অসাধ্য নয় ?
—জাঁহাপনা, আপনার বিচারে এ-পুরস্কার কি আমার কাজের উপযুক্ত প্রাপ্য বলে মনে করব ?
—মৃত্যু—হ্যা, মৃত্যুই আপনার একমাত্র প্রাপ্য।’
হেকিম রায়ান নিঃসন্দেহ হলেন, মৃত্যু তার কাছাকাছি। নিশ্চিন্ত মৃত্যুর চিন্তায়, তার দু’ চোখ দিয়ে বেয়ে পানির ধারা নেমে এল সবই আমার কর্মের ফল।আগ বাড়িয়ে উপকার করতে এসে নিজের জীবন দিতে হচ্ছে। একেই বলে মন্দ ভাগ্য। কি চমৎকার বিচার। সবই আমার কপালের দোষ!
ঘাতক হেকিম রায়ানকে আর কিছু বলার বা ভাববার সুযোগ না দিয়ে আচমকা একটি কালো কাপড় দিয়ে তার চোখ দুটো বেঁধে ফেলল। তারপর কোমর থেকে এক ঝটকায় তরবারি খুলে নিয়ে তাকে আঘাত করতে উদ্যত হ’ল।
হেকিম রায়ান আর্তনাদ করে বললেন—এ আপনি করছেন কি জাহাপনা। মৃত্যুর আদেশ তুলে নিন!আমাকে মুক্তি দিন। নইলে ঈশ্বর আপনাকে ক্ষমা করবেন না। তিনি নিশ্চয় এই অপরাধের জন্য আপনাকে শাস্তি দেবেন।’
—বাদশাহ উনান একবার যে হুকুম দেয় তা কি করে ফিরিয়ে নিতে হয় তার জানা নেই।”
—হায় ঈশ্বর! এই কি তোমার বিচার! এ যে সেই কুমীরের শয়তানীর মত কাণ্ড ঘটতে চলেছে!’
বাদশা উনান বললেন—‘কুমীরের গল্পটা কি বলুন তো শুনি।
—না জাঁহাপনা, জীবন দেওয়ার আগে আপনাকে সে-কাহিনী আর না-ই বা শোনালাম, দয়া করে আমাকে মুক্তি দিন, ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করবেন ?
হেকিম রায়ান যখন মরার জন্য নিজের মনকে তৈরী করছেন, ঠিক তখনই রাজদরবারের মধ্য থেকে কয়েকজন বললেন বাদশাহ, আপনি একি করছেন? যে মানুষটি আপনাকে এত কষ্ট করে, সেবা করে আপনার কিঠন রোগ ভাল করল, তাকেই কিনা আপনি মৃত্যুদন্ড দিচ্ছেন। ঈশ্বরের দোহাই এটা করবেন না। দয়া করে তাকে মুক্ত করে দিন।
বাদশাহ উনান গর্জে উঠলেন—অসম্ভব! আপনারা জানেন লোকটি যাদু ক্ষমতার অধিকারী ! যে লোক সামান্য উপায়ে আমার কঠিন রোগকে সারিয়ে তুলেছে সে অতি সহজেই আমার জীবনও নিয়ে নিতে পারে। তাকে বাঁচিয়ে রেখে রেখে আমি আমার নিজের পায়ে কুড়ুল মারতে পারব না। তাকে হত্যা করা ছাড়া আমার আর কোন উপায় নেই।’
কাঁদতে কঁদিতে হেকিম এবার বললেন—জাঁহাপনা, জান যখন এবার দিতেই হবে তখন কিছুসময়ের জন্য আমাকে একবারটি আমার বাসায় যাবার অনুমতি দিন। ঘরদোর এলামেলো রেখেই আমি আপনার খরব পেয়ে ছুটে এসছিলাম। সেগুলো সব গোছগাছ করে বন্ধু ও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে শেষ বিদায় নিয়ে আপনার দরবারে আবার ফিরে আসব, কথা দিচ্ছি।’
বাদশাহ তখন হাকিমের দিকে তাকালেন। হেকিম বলে চললেন-—জাঁহাপনা, আমার ঘরে কতকগুলো হেকিমী বই রয়েছে। সেগুলো নিয়ে এসে মৃত্যুর আগে আপনার হাতে তুলে দিতে চাই। সেগুলোতে অনেক রোগের কথা আর তাদের চিকিৎসার পরামর্শও দেওয়া রয়েছে।’
—বই ? কেমন বই সে-সব ?
–রোগ ও তার চিকিৎসা দুই পাবেন।
আমার গর্দান নেওয়ার পর কিতাবের তিন নম্বর পাতা খুলে তিন নম্বর লাইনটির দিকে চোখ রাখলে দেখবেন আমার কাটা মাথা কথা বলবে।’
—সে কী কথা! এ যে অবিশ্বাস্য কাণ্ড। মাথা ধড় থেকে নামিয়ে দিলে সেটি কথা বলবে! এ কী ভূতুড়ে কাণ্ডরে বাবা!
‘হ্যা। আমি সারাজীবনে যেসব অলৌকিক বিদ্যা অর্জন করেছি এটি তাদেরই একটি বিশেষ বিদ্যা।’
বাদশাহ উনান-এর কৌতুহল হল। প্রহরীকে নির্দেশ দিলেন,কড়া প্রহরায় হেকিম রায়ানকে তার বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য।
হেকিম রায়ানকে তাঁর বাসা থেকে ঘুরিয়ে কড়া পাহারায় দরবারে নিয়ে এল। তার এক হাতে অনেক পুরনো বইপত্তর আর অন্য হাতে ঔষধের বাক্স। কিছু ধূলো জাতীয় ওষুধ রয়েছে বাক্সটিতে। এবার বাক্সটি থেকে সামান্য মিহি গুড়ো ওষুধ একটি বড় পাত্রে ঢেলে বাদশাহকে বললেন—হঁজুর, ধড় থেকে আমার কাটামাথা নামিয়ে দেবার পর রক্ত বন্ধ করার জন্য মাথাটিতে সামান্য ঔষধ লাগিয়ে দেবেন। আর এ-ই সেই বই। তবে আমার গর্দান না হওয়া পর্যন্ত এ বই ভুলেও খুলবেন না যেন। কাটা মাথাটির রক্ত বন্ধ হয়ে যাবার পর বইটি খুলে বইয়ের তিন নম্বর পাতাটি বের করবেন।
বাদশা উনান বইটি হাতে পেয়ে আর সহ্য করতে পারছিলেন না। তিনি হাকিমকে গর্দান দেওয়ার আগেই বইটির দুটি পাতা খুলে দেখলেন। কিন্তু বাদশা অবাক হয়ে দেখলেন, প্রথম দুটি পাতাতে কিছুই নেই। কোন কিছুই লেখা নেই। তখন বাদশা রেগে দিয়ে হাকিম কে বললেন, এ তি মশকরা হাকিম সাহেব। বইটিতে তো কিছুই লেখা নেই।’
হাকিম মুচকি হাসি হেসে বললেন, জাঁহাপনা আপনি দয়া করে বইটির পাতা উল্টাতে থাকুন। অবশ্যই দেখতে পাবেন।
বাদশা বইটির পাতা উল্টাতে থাকলেন আর যতই পাতা উল্টাচ্ছেন ততই বাদশার শরীর অবশ হয়ে আসছিল। একমসময় বাদশা অবশ হয়ে মেঝেতে পড়ে গেলেন। তাঁর মুখ দিয়ে ফেনা উঠতে লাগল। মরার আগে শুধু একটি কথাই বললেন,‘বিষ!’।
জেলে এবার দৈত্যের দিকে ফিরে বললেন—হে দৈত্য, বল তো এ- গল্প থেকে তুমি কোন শিক্ষা লাভ করলে? যে মানুষ সব সময় ভাল কাজ করেন সে মানুষকে ঈশ্বর সবসময় রক্ষা করেন। তুমি বিনা দোষে আমার জীবন নিতে চেয়েছিলে। তিনি তোমাকে উচিত শিক্ষাই দিলেন।”
শাহরাজাদ গল্প শেষ করলে তার ছোটবোন দুনিয়াজাদ হেসে বলে উঠল—চমৎকার! তুমি এমন সুন্দর করে গল্প বলতে পার যেন হাজার বছর ধরে তোমার মুখে গল্প শুনি বোন!’
বেগম শাহরাজাদ বললেন—বোন, এর চেয়েও সুন্দর সুন্দর গল্প আমার জানা আছে। যদি জীবন বাঁচে তবে এর চেয়ে ঢের ভাল ভাল সব গল্প তোমাকে শোনাতে পারব।
বাদশাহ শারিয়ার বিবি শাহরাজাদ-এর কোলে মাথা রেখে ঘুমোতে লাগলেন।
পরদিন ষষ্ঠ রজনী। রাত্রে আবার বাদশাহ শারিয়ার অন্দরমহলে, বেগম শাহরাজাদ-এর কাছে এলেন।
শাহরাজাদ আবার গল্প বলা শুরু করলেন…
Post a Comment