অয়োময় - হুমায়ূন আহমেদ
বদরুল আলম সাহেব তারাবীর নামাজ পড়তে যাবেন–কি মনে করে যেন বাংলা ঘরে উঁকি দিলেন। ঘর অন্ধকার। অথচ তিনি সন্ধ্যাবেলায় মাগরেবের নামাজে দাঁড়াবার আগেই বলেছিলেন বাংলা ঘরে যেন বাতি দেয়া হয়। এরা কেউ কথা শোনে না। রাগে তাঁর শরীর কাঁপতে লাগল। ইদানীং তাঁর এই সমস্যা হয়েছে, রেগে গেলে শরীর কাঁপে।
বাংলা ঘরে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব ব্যাপার। বিকট দুর্গন্ধ। মানুষের শরীর পচে গেলে এমন ভয়াবহ ব্যাপার হয় কে জানত। দুর্গন্ধ নাকের ভিতর দিয়ে ঘ্যাঁৎ করে মাথায় চলে যায়। মাথা ঝিম ঝিম করে। তারপরই বমি বমি ভাব হয়। বদরুল আলম সাহেব রুমাল দিয়ে নাক ঢাকলেন। ঘরে ঢোকার আগেই ঢাকা উচিত ছিল। দেরী হয়ে গেছে। তাঁর মেজাজ আরো খারাপ হল। বাংলা ঘরে ঢোকা উচিত হয়নি। কিছুক্ষণ আগে ভাত খেয়েছেন, খাবার দাবার বমি হয়ে যেতে পারে। তাঁর স্ত্রীকে বলেছিলেন এখন ভাত না দিতে। তারাবী পড়ে খাবেন। এটা শুনল না। কেউ আজকাল তার কথা শুনছে না।
তিনি নাকে রুমাল চাপা দিয়েই ডাকলেন–এ্যাই, এ্যাই।
কোন সাড়া পাওয়া গেল না। মরে গেছে নাকি? আশ্চর্য, একটা মানুষ। অর্ধেকটা শরীর পচে গেছে তবু মরার নাম নেই। উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সের ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছে। বলেছে, হাসপাতালে রেখে কি করবেন। বড় জোর দুই দিন, বাড়িতে নিয়ে যান। বাড়িতে আত্মীয় স্বজনের মাঝখানে আরাম করে মরবে।
আর গাধাগুলি তাকে নিয়ে এসে তাঁর বাংলা ঘরে শুইয়ে দিয়েছে। কী যন্ত্রণা। এটা কি তার বাড়ি ঘর? গাধাগুলির সাহস দেখে তিনি স্তম্ভিত। বাংলা ঘর দশ কাজে ব্যবহার হয়। লোকজন আসে। সেখানে আধা পচা মানুষ এনে শুইয়ে দিল। বিকট গন্ধে বাংলা ঘরের ত্রিসীমানায় এখন কেউ যেতে পারে না। নাড়িভূঁড়ি উল্টে আসে।
তিনি আরো উঁচু গলায় ডাকলেন–এ্যাই, এ্যাই।
কোন জবাব পাওয়া গেল না। তিনি কিছুক্ষণ কান পেতে রইলেন। নিঃশ্বাস ফেলার শব্দও আসছে না। নড়াচড়ার শব্দও নেই। মারা গেছে বোধ হয়। আশ্চর্য এই বাড়ির লোকজনের কাণ্ডজ্ঞান। এখন মরে তখন মরে একটা মানুষ, তার ঘরে সন্ধাবেলা বাতি দেয় নি। অথচ তিনি নিজে জায়নামাজে দাঁড়াবার আগে বলেছেন। যেন বাতি দেয়া হয়। কতক্ষণ আগে মরেছে কে জানে। অন্ধকার ঘর, কে জানে শিয়াল কুকুরে টেনে নিয়ে গিয়ে হয়তো খেয়ে ফেলেছে।
তিনি নাক থেকে রুমাল সরাতেই ভক করে আরও খানিকটা গন্ধ ঢুকে গেল। তিনি বিশেষ গ্রাহ্য করলেন না। দেয়াশলাইয়ের কাঠি ধরালেন। ঘর খানিকটা আলো হল।
না মরে নি। পিট পিট করে তাকাচ্ছে। ডাক্তার বলে দিয়েছে দ’দিনের বেশী। টিকবে না। আজ হল তের দিন। আজকাল ডাক্তারগুলির কি রকম বিদ্যা-বুদ্ধি। যে রুগীর দু’দিন বাঁচার কথা সে তের দিন বাঁচে কি করে?
বদরুল আলম সাহেব বললেন, বেঁচে আছো?
ইউনুস বলল, জ্বে আছি।
যা যখন এ্যাই বললাম, তখন কথা বললে না কেন?
ইউনুস জবাব দিল না। সে কথা বলেনি ভয়ে। বদরুল আলম সাহেবকে সে বড় ভয় পায়। তাছাড়া সে এই বাড়ির কামলাও না। সে কাজ করত পুব-পাড়ায়। তারা তাকে রাখতে রাজি না হওয়ায় সবাই মিলে এই বাড়িতে রেখে গেছে। বদরুল আলম সাহেবও রাখতে রাজি হননি। দু’দিনের বেশী টিকবে না শুনে কিছু বলেন নি। তাছাড়া রমজান মাস।
বদরুল আলম সাহেব রাগী গলায় বললেন, ঘরে বাতি দেয় নাই?
দিছিল, নিভ্যা গেছে।
কুপীর বাতি। বাতাসে নিভে যাওয়ারই কথা। বাংলা ঘরে এখন কেউ আসে, কাজেই হারিকেন দেয়া বিপদজনক। চোর এসে নিয়ে যাবে। এই লোক। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে, কিছু করতে পারবে না।
ভাত দিয়েছে?
জ্বে দিছে।
আচ্ছা ঠিক আছে।
ঘর থেকে বেরুবার আগে তিনি আবার কুপী জ্বেলে দিয়ে গেলেন। যতক্ষণ থাকে থাকুক।
মসজিদে সবাই তাঁর জন্যে অপেক্ষা করছিল। তিনি যাওয়া মাত্র তারাবীর নামাজ শুরু হল। নামাজ শেষ হতে তেমন সময় লাগল না কিন্তু দোয়া আর যেন শেষ হতেই চায় না। এক দোয়ায় বাংলা, উর্দু,আরবী, নানান ভাষা। এই মৌলানা সাহেবের চাকরি এখনো স্থায়ী হয়নি। রমজানে মাসে তাঁর কাজকর্ম দেখে তারপর স্থায়ী করা হবে তেমন কথা হয়েছে।
ব্যাটা সে কারণেই দোয়ার মাধ্যমে কাজ কর্ম দেখাচ্ছে। দোয়ার শেষ পর্যায়ে আবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না। বড়ই বিরক্তিকর।
বদরুল আলম সাহেব ঠিক করে রাখলেন আজ মৌলানাকে দু’একটা কথা বলবেন। তিনি মসজিদ কমিটির সভাপতি। তার পক্ষে এইসব বলা ভাল দেখায় না, তবু বলতে হবে। মানুষের কাজ কর্ম আছে। সারারাত জেগে দোয়া পড়লে তো হবে না। মৌলানা সাহেব দোয়ার শেষ পর্যায়ে চলে এসেছেন–ওগো পেয়ারা নবীর পেয়ার দোস্ত, তোমার কাছে হাত না তুললে আমরা কার কাছে হাত তুলব? কারণ তুমি নিজেই তো কোরান মজিদে বলেছ–
মারাজ্বাল বাহরাইনি ইয়ালতাক্কিইয়া-ন
অর্থাৎ–তিনি বহমান রেখেছেন দু’টি বিশাল জলরাশিকে …
বাইনহুমা–বারযাখু
অর্থাৎ–তাদের দু’য়ের মাঝে রয়েছে কুদরতী পর্দা …
বদরুল আলম সাহেবের বিরক্তির সীমা রইল না।
আজ রাতের দোয়া মনে হচ্ছে শেষ হবে না।
মৌলানাকে সাবধান করে দিতে হবে। কিছু না বলায় লাই পেয়ে যাচ্ছে।
দোয়া শেষ হল। বদরুল আলম সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, মৌলানা সাহেব আপনার সংগে একটা কথা ছিল। তাঁর গলার স্বরই মৌলানা আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ল। তিনি কি বলবেন তা না শুনেই বলল, আপনের কথা মত আমি গেছিলাম। সে রাজি হয় না। এই কাজ তো জবরদস্তিতে হয় না। যদি বলেন আইজ না হয় আরেকবার যাব।
আপনে কিসের কথা বলতেছেন?
আপনে যে বলছিলেন তওবা করাইতে। তওবা করতে রাজি হয় না।
এতক্ষণ বদরুল আলম সাহেবের মনে পড়ল। মৌলনাকে গত সপ্তাহে বলেছিলেন যেন ইউনুসকে দিয়ে তওবা করানো হয়। একবার তওবা করে ফেললে তিনদিনের ভেতর ঘটনা ঘটে যায়। তাঁর ধারনা ছিল, মৌলানা তওবা করিয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে তওবা করায়নি।
তওবা করতে চায় না কেন?
ভয় পায়। মরতে চায় না।
তওবার সাথে বাঁচা-মরার কী সম্পর্ক? জন্মমৃত্যুতে আল্লাহর হাতে। আপনি এখনি চলেন। তওবা করিয়ে দেন। আমি সামনে থাকলে অরাজি হবে না।
জ্বি আচ্ছা।
তাছাড়া এখন মৃত্যু হলে তার জন্যে শুভ। রমজান মাসে মৃত্যু সরাসরি জান্নাতের দরজা–কি বলেন আপনারা।
সবাই হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। একজন বলল, এর জন্য আপনি যা করছেন তা বাপ-মাও করত না। বাপ মা’র অধিক করছেন আপনি।
বদরুল আলম সাহেব উদাস গলায় বললেন, আমি তো করার কেউ না। যার করার তিনিই করেন। আমরা হলাম উপলক্ষ। ঐ দিন মিয়া বাড়ির কুদুস সাহেব আসছিলেন। তিনি বললেন, আপনি করছেন কি? অরে অন্য কোনখানে ফালায়ে দিয়ে আসেন। আমি বললাম, রমজান মাসে এই রকম কথা মুখে আনবেন না কুদুস সাহেব।
ইউনুসকে এক ধমক দিতেই সে তওবা করতে রাজি হয়ে গেল। মৌলানা সাহেব বললেন, এইবার আল্লাহপাক তোমাকে আজাব থেকে মুক্তি দিবেন। তাছাড়া তুমি এখন সাত দিনের শিশুর মত পবিত্র। সরাসরি জান্নাতে দাখিল হবে। বুঝতে পারলা?
জে পারছি।
কারো উপরে কোন দাবি দাওয়া রাখবো না। দাবী দাওয়া তুইল্যা নাও।
জ্বে-আচ্ছা।
বললে তো হবে না। বল কারো উপরে কোন দাবী দাওয়া নাই।
কারো উপরে কোন দাবী-দাওয়া নাই।
মৌলানা সাহেব থাকেন মসজিদে। মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে তাঁকে মসজিদের পাশেই একটা ঘর তুলে দেয়ার কথা। এখনো তোলা হয়নি। সবই অবশ্যই নির্ভর করছে বদরুল আলম সাহেবের উপর। তিনি একবার হা বললেই হয়। মৌলানা সাহেব মসজিদে যাবার আগে বদরুল আলম সাহেবের সংগে দেখা করে গেলেন। বদরুল আলম সাহেব বললেন, তওবা ঠিক ঠাক হয়েছে?
জ্বি
অবস্থা কি দেখলেন?
সময় ঘনায়ে আসছে। তওবার পরে তিন দিনের বেশী টিকে না। তবে এ তাও ঠিকবে না।
হয়েছে কি?
জানি না। শরীর পচে যাচ্ছে এইত দেখি। গন্ধে থাকা মুশকিল।
এদিকে সাতাশ রোজায় মেয়ে, মেয়ে-জামাই আসতেছে।
মৌলানা দৃঢ় স্বরে বলল, এ এক দুই দিনের বেশী নাই।
তওবা পড়ানোর চতুর্থ দিনেও দেখা গেল ইউনুস বেঁচে গেছে। প্রশ্ন করলে চিচি করে জবাব দেয়। তবে অবস্থা যে খুব খারাপ তা বোঝা যায়। আগে শরীরের পচা দুর্গন্ধ বাংলা ঘরের আশে পাশেই সীমাবন্ধ ছিল এখন তা ভেতর বাড়ি পর্যন্ত গেছে।
সেনিটারী ইন্সপেক্টরের পরামর্শে ঘরের চারদিকে প্রচুর ফিনাইল দিয়েছেন, তাতেও গন্ধ যাচ্ছে না। তাছাড়া বাংলা ঘরের চারপাশে এখন শিয়াল ঘুরাফিরা করে। মানুষ পচা গন্ধের আর্কষণ এড়াতে পারে না।
বদরুল আলম সাহেব নাকে রুমাল চাপা দিয়ে দেখতে গেলেন, কি রে অবস্থা কি?
জ্বে ভাল।
ভাল হলেই ভাল।
রাইতে বড় ভয় লাগে।
ভয় লাগে কেন?
কি যেন চাইরপাশে ঘুরাফিরা করে। চউক্ষে দেখি না, খালি কথা শুনি।
মৌলানা সাহেব এসব শুনে বললেন, সময় ঘনায়ে আসছে। আজরাইল চাইরপাশে ঘুরাফিরা করে।
মৌলানার উপর বিরক্তিতে বদরুল আলম সাহেবের গা জ্বলে যায়। কি সব কথা, আজরাইল ঘুরাফিরা করে। ব্যাটা তওবাটা ঠিকমত পড়িয়েছে কি-না কে জানে।
মৌলানা সাহেব?
জ্বি।
তওবা কি টিকঠাক পরানো হয়েছে?
জ্বি তা হইছে।
দেখেন আরেকবার পড়াবেন কি-না। কষ্ট পাচ্ছে এই জন্যে বলতেছি, অন্য কিছু না।
আইজ আরেকবার পড়ায়ে দিব। কোন অসুবিধা নাই। তওবা দিনের মধ্যে দুইবারও পড়ানো যায়। কোন অসুবিধা নাই। এই প্রসংগে রসুলাল্লাহর একটা হাদিস আছে। পেয়ারা নবী বলেছেন ..
আচ্ছা থাক। আরেকদিন শুনব।
মৌলানা সাহেব বললেন, অনেক সময় মনের মধ্যে কোন আফসোস থাকলে জ’ব বাইর হইতে চায় না। জিজ্ঞেস কইরা দেখা দরকার কিছু খাইতে চায় কি না। কাউরে দেখতে চায় কিনা।
আচ্ছা এটা খোঁজ নিব।
দ্বিতীয়বার তওবার কথা শুনে ইউনুস বেশ অবাক হল। চি-চি করে বলল, একবার তো করছি। তওবার পরে কোন পাপ কাজ করি নাই।
মৌলানা সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, নাফরমানী কথা বলবা না। পাপ কাজ করছ কি কর নাই তার বিচার তোমার উপরে না, আল্লাহ পাকের উপরে।
আবার তওবা পড়ানো হল। বদরুল আলম সাহেব তওবা পড়ানোর শেষে খোঁজ নিতে এলেন, কিরে শইল কেমন?
জ্বে ভাল।
কিছু খাইতে মনে চায়?
জ্বে না।
মনে চাইলে বল।
তেঁতুলের পানি দিয়া ভাত খাইতে মনে চায়।
তাকে তেঁতুলের পানি দিয়ে ভাত খেতে দেয়া হল। ভাত খাওয়া শেষ হবার সংগে সংগেই শ্বাসকষ্ট শুরু হল। বুক হাঁপরের মত উঠা-নামা করছে। চোখ মনে হয় বের হয়ে আসছে। বদরুল আলম সাহেব মৌলানাকে খবর দিয়ে রাখলেন। ভালমন্দ কিছু হলে দিনের মধ্যেই দাফন কাফন শেষ করতে হবে।
দিনে কিছুই হল না। রাতে শ্বাসকষ্ট মনে হল খানিকটা কমে এসেছে।
মৌলানা সাহেব ঘুমুতে গেলেন। যাবার আগে বদরুল আলম সাহেবকে বলে গেলেন, আরো একটা দিন দেখতে হবে।
বদরুল আলম সাহেব শুকনো গলায় বললেন, আর একদিন পরে কি?
অমাবশ্যা লাগতেছে। অমাবশ্যার টান সহ্য হবে না।
বদরুল আলম সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, একদিকে বলেন আজরাইলের কথা, আরেকদিকে বলেন অমাবশ্যার কথা। আজরাইল কি পূর্ণিমা অমাবশ্যা দেখে ঘুরাফিরা করে?
অমাবশ্যার রাতে ইউনুসের অবস্থা খুবই খারাপ হল। বুকের ভেতর থেকে গোঁ গোঁ শব্দ বেরুচ্ছে। মুখে ফেনা ভাঙছে। রাত যে কাটবে না, তা বোঝাই যাচ্ছে। বদরুল আলম সাহেবের স্ত্রীও শাড়ির আঁচলে মুখ চেপে এক সময় ইউনুসকে দেখে গেলেন। খাবার প্লেটে পড়ে আছে। ইউনুস ছুঁয়েও দেখেনি। তিনি বললেন, এর মুখে তোমরা পানি দাও, দেখছ না ঠোট চাটতেছে। আহারে।
ভোরবেলা বদরুল আলম সাহেব খোজ নিতে গেলেন।
কী রে অবস্থা কী?
ইউনুস চিঁ চিঁ করে বলল, জে ভাল।
শ্বাসকষ্ট নাই? জ্বে না।
বদরুল আলম সাহেবের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। ইউনুস বলল, রাইতে একটা শিয়াল ঢুকছিল। পাও হাতে কামড় দিছে। আইজ আপনে বইল্যা দিবেন হাতের কাছে যেন একটা লাঠি দেয়। আর একটা হারিকেন।
বদরুল আলম সাহেব কিছুই বললেন না। তার মেজাজ রোজার সময় এমনিতেই চড়া থাকে। আজ সেই মেজাজ আকাশে চড়ে গেল।
তিনি ইফতারির সময় মজনুকে বলে দিলেন, ইউনুসের হাতের কাছে যেন একটা লাঠি দেয়া হয়। আর একটি হারিকেন। মজনু এ বাড়ির কামলা। তার উপর দায়িত্ব ইউনুসকে খাবার দাবার দিয়ে আসা। এই কাজটা তার খুবই না-পছন্দ, কারণ ইউনুস এখন আর নিজে নিজে খেতে পারে না। খাবার মুখে তুলে দিতে হয়। ঘেন্নায় মজনুর বমি আসার উপক্রম হয়।
মজনু বলল, ইউনুস হারামজাদা বিরাট বজ্জাত।
বদরুল আলম সাহেব তাকালেন। কেন বজ্জাত সেটা শুনতে চান।
মজনু বলল, মৌলানা সাব যে দুই-দুইবার তওবা করাইলেন, কোনবারই এই হারামজাদা তওবা করে নাই। মৌলানা সাব তারে যে কথা বলছেন, হে মনে মনে উল্টা কথা বলেছে।
তোকে বলেছে কে?
হে নিজেই বলেছে। তওবা করলে জেবন শেষ এই জন্য।
বলিস কি?
হারামজাদা বিরাট বজ্জাত।
মাগরেবের নামাজের পর বদরুল আলম সাহেব ইউনুসকে দেখতে গেলেন।
ইউনুসের হাতের কাছে লাঠি। হারিকেন জ্বলছে।
কিরে তুই না-কি তওবা করস নাই?
ইউনুস চুপ করে রইল।
ক্যান করস নাই? আল্লাহর সাথে মশকরা? হারামজাদা, তুইতো বিরাট বদ।
ইউনুস ক্ষীণ স্বরে বলল, মরতে মন চায় না।
দীর্ঘ সময় বদরুল আলম সাহেব ইউনুসের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার একটা পা ফুলে কোল বালিশের মত হয়ে গেছে। এই পায়েই বোধ হয় শিয়াল কামড়েছে।
ইউনুস বলল, আপনে যদি বলেন তাইলে আরেকবার ঠিকমত তওবা করি।
থাক, তার আর দরকার নাই। তোর যখন অতই বাঁচনের শখ, দেখি একটা চেষ্টা কইরা। চল, তোরে ময়মনসিং নিয়া যাই। দেখি কি অবস্থা।
ইউনুস মনে হয় কথাগুলি ঠিক বুঝতে পারে না। ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে থাকে।
বদরুল আলম সাহেব রাতেই মহিষের গাড়ির ব্যবস্থা করেন। প্রথমে যেতে হবে নেত্রকোণা, নেত্রকোণা থেকে ময়মনসিংহ। সেখানে ডাক্তাররা জবাব দিলে নিতে হবে ঢাকা।
মহিষের গাড়ি রওনা হল রাত আটটায়। অঞ্চলের সমস্ত মানুষকে অবাক করে দিয়ে তিনিও সংগে চললেন। অনেক দৌড়াদৌড়ি ছোটাছুটির ব্যাপার আছে। ছেলে ছোকরাদের উপর ভরসা করা যায় না।
ইউনুস?
জ্বে।
ঝুলে থাক। হাল ছাড়িস না, আমি আছি।
ইউনুসের চোখ দিয়ে পানি পড়ে। সে প্রাণপণে ঝুলে থাকতে চেষ্টা করে। মহিষের গাড়ি দ্রুত এগিয়ে যায়।
Post a Comment