দেনাপাওনা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


পাঁচ ছেলের পর যখন এক কন্যা জন্মিল তখন বাপমায়ে অনেক আদর করিয়া তাহার নাম রাখিল নিরুপমা । এ গোষ্ঠীতে এমন শৌখিন নাম ইতিপূর্বে কখনো শোনা যায় নাই । প্রায় ঠাকুরদেবতার নামই প্রচলিত ছিল — গণেশ কার্তিক পার্বতী তাহার উদাহরণ ।

এখন নিরুপমার বিবাহের প্রস্তাব চলিতেছে । তাহার পিতা রামসুন্দর মিত্র অনেক খোঁজ করেন কিন্তু পাত্র কিছুতেই মনের মতন হয় না । অবশেষে মস্ত এক রায়বাহাদুরের ঘরের একমাত্র ছেলেকে সন্ধান করিয়া বাহির করিয়াছেন । উক্ত রায়বাহাদুরের পৈতৃক বিষয়-আশয় যদিও অনেক হ্রাস হইয়া আসিয়াছে কিন্তু বনেদি ঘর বটে ।

বরপক্ষ হইতে দশ হাজার টাকা পণ এবং বহুল দানসামগ্রী চাহিয়া বসিল । রামসুন্দর কিছুমাত্র বিবেচনা না করিয়া তাহাতেই সম্মত হইলেন ; এমন পাত্র কোনোমতে হাতছাড়া করা যায় না ।

কিছুতেই টাকার জোগাড় আর হয় না । বাঁধা দিয়া , বিক্রয় করিয়া , অনেক চেষ্টাতেও হাজার ছয়-সাত বাকি রহিল । এ দিকে বিবাহের দিন নিকট হইয়া আসিয়াছে ।

অবশেষে বিবাহের দিন উপস্থিত হইল । নিতান্ত অতিরিক্ত সুদে একজন বাকি টাকাটা ধার দিতে স্বীকার করিয়াছিল , কিন্তু সময়কালে সে উপস্থিত হইল না । বিবাহসভায় একটা তুমুল গোলযোগ বাধিয়া গেল । রামসুন্দর আমাদের রায়বাহাদুরের হাতে-পায়ে ধরিয়া বলিলেন , “ শুভকার্য সম্পন্ন হইয়া যাক , আমি নিশ্চয়ই টাকাটা শোধ করিয়া দিব । ” রায়বাহাদুর বলিলেন , “ টাকা হাতে না পাইলে বর সভাস্থ করা যাইবে না । ”

এই দুর্ঘটনায় অন্তঃপুরে একটা কান্না পড়িয়া গেল । এই গুরুতর বিপদের যে মূল কারণ সে চেলি পরিয়া , গহনা পরিয়া , কপালে চন্দন লেপিয়া চুপ করিয়া বসিয়া আছে । ভাবী শ্বশুরকুলের প্রতি যে তাহার খুব-একটা ভক্তি কিংবা অনুরাগ জন্মিতেছে , তাহা বলা যায় না ।

ইতিমধ্যে একটা সুবিধা হইল । বর সহসা তাহার পিতৃদেবের অবাধ্য হইয়া উঠিল । সে বাপকে বলিয়া বসিল , “ কেনাবেচা-দরদামের কথা আমি বুঝি না; বিবাহ করিতে আসিয়াছি, বিবাহ করিয়া যাইব । ”

বাপ যাহাকে দেখিল তাহাকেই বলিল , “ দেখেছেন মহাশয় , আজকালকার ছেলেদের ব্যবহার। ” দুই-একজন প্রবীণ লোক ছিল , তাহারা বলিল , “ শাস্ত্রশিক্ষা নীতিশিক্ষা একেবারে নাই , কাজেই । ”

বর্তমান শিক্ষার বিষময় ফল নিজের সন্তানের মধ্যে প্রত্যক্ষ করিয়া রায়বাহাদুর হতোদ্যম হইয়া বসিয়া রহিলেন । বিবাহ একপ্রকার বিষণ্ন নিরানন্দ ভাবে সম্পন্ন হইয়া গেল ।

শ্বশুরবাড়ি যাইবার সময় নিরুপমাকে বুকে টানিয়া লইয়া বাপ আর চোখের জল রাখিতে পারিলেন না । নিরু জিজ্ঞাসা করিল , “ তারা কি আর আমাকে আসতে দেবে না , বাবা । ” রামসুন্দর বলিলেন , “ কেন আসতে দেবে না মা । আমি তোমাকে নিয়ে আসব । ”

রামসুন্দর প্রায়ই মেয়েকে দেখিতে যান কিন্তু বেহাইবাড়িতে তাঁর কোনো প্রতিপত্তি নাই । চাকরগুলো পর্যন্ত তাঁহাকে নিচু নজরে দেখে । অন্তঃপুরের বাহিরে একটা স্বতন্ত্র ঘরে পাঁচ মিনিটের জন্য কোনোদিন-বা মেয়েকে দেখিতে পান , কোনোদিন-বা দেখিতে পাননা ।

কুটুম্বগৃহে এমন করিয়া আর অপমান তো সহা যায় না । রামসুন্দর স্থির করিলেন যেমন করিয়া হউক টাকাটা শোধ করিয়া দিতে হইবে ।

কিন্তু যে ঋণভার কাঁধে চাপিয়াছে তাহারই ভার সামলানো দুঃসাধ্য । খরচপত্রের অত্যন্ত টানাটানি পড়িয়াছে; এবং পাওনাদারদের দৃষ্টিপথ এড়াইবার জন্য সর্বদাই নানারূপ হীন কৌশল অবলম্বন করিতে হইতেছে ।

এ দিকে শ্বশুরবাড়ি উঠিতে বসিতে মেয়েকে খোঁটা লাগাইতেছে । পিতৃগৃহের নিন্দা শুনিয়া ঘরে দ্বার দিয়া অশ্রুবিসর্জন তাহার নিত্যক্রিয়ার মধ্যে দাঁড়াইয়াছে ।

বিশেষত শাশুড়ির আক্রোশ আর কিছুতেই মেটে না । যদি কেহ বলে , “ আহা , কী শ্রী । বউয়ের মুখখানি দেখিলে চোখ জুড়াইয়া যায় । ” শাশুড়ি ঝংকার দিয়া উঠিয়া বলে , “ শ্রী তো ভারি । যেমন ঘরের মেয়ে তেমনি শ্রী । ”

এমন-কি , বউয়ের খাওয়াপরারও যত্ন হয় না । যদি কোনো দয়াপরতন্ত্র প্রতিবেশিনী কোনো ত্রুটির উল্লেখ করে , শাশুড়ি বলে , “ ঐ ঢের হয়েছে । ” অর্থাৎ বাপ যদি পুরা দাম দিত তো মেয়ে পুরা যত্ন পাইত । সকলেই এমন ভাব দেখায় যেন বধূর এখানে কোনো অধিকার নাই , ফাঁকি দিয়া প্রবেশ করিয়াছে ।

বোধ হয় কন্যার এই-সকল অনাদর এবং অপমানের কথা বাপের কানে গিয়া থাকিবে । তাই রামসুন্দর অবশেষে বসতবাড়ি বিক্রয়ের চেষ্টা করিতে লাগিলেন ।

কিন্তু ছেলেদের যে গৃহহীন করিতে বসিয়াছেন সে কথা তাহাদের নিকট হইতে গোপেনে রাখিলেন । স্থির করিয়াছিলেন , বাড়ি বিক্রয় করিয়া সেই বাড়িই ভাড়া লইয়া বাস করিবেন ; এমন কৌশলে চলিবেন যে , তাঁহার মৃত্যুর পূর্বে এ কথা ছেলেরা জানিতে পারিবে না ।

কিন্তু ছেলেরা জানিতে পারিল । সকলে আসিয়া কাঁদিয়া পড়িল । বিশেষত বড়ো তিনটি ছেলে বিবাহিত এবং তাহাদের কাহারো-বা সন্তান আছে । তাহাদের আপত্তি অত্যন্ত গুরুতর হইয়া দাঁড়াইল , বাড়ি বিক্রয় স্থগিত হইল ।

তখন রামসুন্দর নানা স্থান হইতে বিস্তর সুদে অল্প অল্প করিয়া টাকা ধার করিতে লাগিলেন । এমন হইল যে , সংসারের খরচ আর চলে না ।

নিরু বাপের মুখ দেখিয়া সব বুঝিতে পারিল । বৃদ্ধের পক্ক কেশে, শুষ্ক মুখে এবং সদাসংকুচিত ভাবে দৈন্য এবং দুশ্চিন্তা প্রকাশ হইয়া পড়িল । মেয়ের কাছে যখন বাপ অপরাধী তখন সে অপরাধের অনুতাপ কি আর গোপন রাখা যায় । রামসুন্দর যখন বেহাইবাড়ির অনুমতিক্রমে ক্ষণকালের জন্য কন্যার সাক্ষাৎলাভ করিতেন তখন বাপের বুক যে কেমন করিয়া ফাটে, তাহা তাঁহার হাসি দেখিলেই টের পাওয়া যাইত ।

সেই ব্যথিত পিতৃহৃদয়কে সান্ত্বনা দিবার উদ্দেশে দিনকতক বাপের বাড়ি যাইবার জন্য নিরু নিতান্ত অধীর হইয়া উঠিয়াছে । বাপের ম্লান মুখ দেখিয়া সে আর দূরে থাকিতে পারে না । একদিন রামসুন্দরকে কহিল , “ বাবা , আমাকে একবার বাড়ি লইয়া যাও । ” রামসুন্দর বলিলেন , “ আচ্ছা । ”

কিন্তু তাঁহার কোনো জোর নাই — নিজের কন্যার উপরে পিতার যে স্বাভাবিক অধিকার আছে, তাহা যেন পণের টাকার পরিবর্তে বন্ধক রাখিতে হইয়াছে । এমন-কি , কন্যার দর্শন সেও অতি সসংকোচে ভিক্ষা চাহিতে হয় এবং সময়বিশেষে নিরাশ হইলে দ্বিতীয় কথাটি কহিবার মুখ থাকে না ।

কিন্তু মেয়ে আপনি বাড়ি আসিতে চাহিলে বাপ তাহাকে না আনিয়া কেমন করিয়া থাকে। তাই , বেহাইয়ের নিকট সে সম্বন্ধে দরখাস্ত পেশ করিবার পূর্বে রামসুন্দর কত হীনতা , কত অপমান , কত ক্ষতি স্বীকার করিয়া যে তিনটি হাজার টাকা সংগ্রহ করিয়াছিলেন , সে ইতিহাস গোপন থাকাই ভালো ।

নোট-কখানি রুমালে জড়াইয়া চাদরে বাঁধিয়া রামসুন্দর বেহাইয়ের নিকট গিয়া বসিলেন । প্রথমে হাস্যমুখে পাড়ার খবর পাড়িলেন । হরেকৃষ্ণের বাড়িতে একটা মস্ত চুরি হইয়া গিয়াছে , তাহার আদ্যোপান্ত বিবরণ বলিলেন। নবীনমাধব ও রাধামাধব দুই ভাইয়ের তুলনা করিয়া বিদ্যাবুদ্ধি ও স্বভাব সম্বন্ধে রাধামাধবের সুখ্যাতি এবং নবীনমাধবের নিন্দা করিলেন ; শহরে একটা নূতন ব্যামো আসিয়াছে , সে সম্বন্ধে অনেক আজগবি আলোচনা করিলেন ; অবশেষে হুঁকাটি নামাইয়া রাখিয়া কথায় কথায় বলিলেন , “ হাঁ হাঁ, বেহাই , সেই টাকাটা বাকি আছে বটে । রোজই মনে করি , যাচ্ছি অমনি হাতে করে কিছু নিয়ে যাই, কিন্তু সময়কালে মনে থাকে না । আর ভাই , বুড়ো হয়ে পড়েছি । ” এমনি এক দীর্ঘ ভূমিকা করিয়া পঞ্জরের তিনখানি অস্থির মতো সেই তিনখানি নোট যেন অতি সহজে অতি অবহেলে বাহির করিলেন । সবেমাত্র তিন হাজার টাকার নোট দেখিয়া রায়বাহাদুর অট্টহাস্য করিয়া উঠিলেন ।

বলিলেন , “ থাক্‌, বেহাই , ওতে আমার কাজ নেই । ” একটা প্রচলিত বাংলা প্রবাদের উল্লেখ করিয়া বলিলেন , সামান্য কারণে হাতে দুর্গন্ধ করিতে তিনি চান না ।

এই ঘটনার পরে মেয়েকে বাড়ি আনিবার প্রস্তাব কাহারো মুখে আসে না — কেবল রামসুন্দর ভাবিলেন , ‘ সে-সকল কুটুম্বিতার সংকোচ আমাকে আর শোভা পায় না । ‘ মর্মাহতভাবে অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া অবশেষে মৃদুস্বরে কথাটা পাড়িলেন । রায়বাহাদুর কোনো কারণমাত্র উল্লেখ না করিয়া বলিলেন , “ সে এখন হচ্ছে না । ” এই বলিয়া কর্মোপলক্ষে স্থানান্তরে চলিয়া গেলেন ।

রামসুন্দর মেয়ের কাছে মুখ না দেখাইয়া কম্পিতহস্তে কয়েকখানি নোট চাদরের প্রান্তে বাঁধিয়া বাড়ি ফিরিয়া গেলেন । মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিলেন , যতদিন না সমস্ত টাকা শোধ করিয়া দিয়া অসংকোচে কন্যার উপরে দাবি করিতে পারিবেন ততদিন আর বেহাইবাড়ি যাইবেন না ।

বহুদিন গেল । নিরুপমা লোকের উপর লোক পাঠায় কিন্তু বাপের দেখা পায় না । অবশেষে অভিমান করিয়া লোক পাঠানো বন্ধ করিল — তখন রামসুন্দরের মনে বড়ো আঘাত লাগিল , কিন্তু তবু গেলেন না ।

আশ্বিন মাস আসিল । রামসুন্দর বলিলেন , ‘ এবার পূজার সময় মাকে ঘরে আনিবই , নহিলে আমি —’ খুব একটা শক্ত রকম শপথ করিলেন ।

পঞ্চমী কি ষষ্ঠীর দিনে আবার চাদরের প্রান্তে গুটিকতক নোট বাঁধিয়া রামসুন্দর যাত্রার উদ্যোগ করিলেন । পাঁচ বৎসরের এক নাতি আসিয়া বলিল , “ দাদা , আমার জন্যে গাড়ি কিনতে যাচ্ছিস ? ” বহুদিন হইতে তাহার ঠেলাগাড়িতে চড়িয়া হাওয়া খাইবার শখ হইয়াছে , কিন্তু কিছুতেই তাহা মিটিবার উপায় হইতেছে না । ছয় বৎসরের এক নাতিনী আসিয়া সরোদনে কহিল , পূজার নিমন্ত্রণে যাইবার মতো তাহার একখানিও ভালো কাপড় নাই ।

রামসুন্দর তাহা জানিতেন , এবং সে সম্বন্ধে তামাক খাইতে খাইতে বৃদ্ধ অনেক চিন্তা করিয়াছেন । রায়বাহাদুরের বাড়ি যখন পূজার নিমন্ত্রণ হইবে তখন তাঁহার বধূগণকে অতি যৎসমান্য অলংকারে অনুগ্রহপাত্র দরিদ্রের মতো যাইতে হইবে , এ কথা স্মরণ করিয়া তিনি অনেক দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়াছেন ; কিন্তু তাহাতে তাঁহার ললাটের বার্ধক্যরেখা গভীরতর অঙ্কিত হওয়া ছাড়া আর-কোনো ফল হয় নাই ।

দৈন্যপীড়িত গৃহের ক্রন্দনধ্বনি কানে লইয়া বৃদ্ধ তাঁহার বেহাইবাড়িতে প্রবেশ করিলেন । আজ তাঁহার সে সংকোচভাব নাই ; দ্বাররক্ষী এবং ভৃত্যদের মুখের প্রতি সে চকিত সলজ্জ দৃষ্টিপাত দূর হইয়া গিয়াছে , যেন আপনার গৃহে প্রবেশ করিলেন । শুনিলেন , রায়বাহাদুর ঘরে নাই , কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিতে হইবে । মনের উচ্ছ্বাস সংবরণ করিতে না পারিয়া রামসুন্দর কন্যার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন । আনন্দে দুই চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল । বাপও কাঁদে, মেয়েও কাঁদে ; দুইজনে কেহ আর কথা কহিতে পারে না । এমন করিয়া কিছুক্ষণ গেল । তার পরে রামসুন্দর কহিলেন , “ এবার তোকে নিয়ে যাচ্ছি মা । আর কোনো গোল নাই । ”

এমন সময়ে রামসুন্দরের জ্যেষ্ঠপুত্র হরমোহন তাঁহার দুটি ছোটো ছেলে সঙ্গে লইয়া সহসা ঘরে প্রবেশ করিলেন । পিতাকে বলিলেন , “ বাবা , আমাদের তবে এবার পথে ভাসালে ? ”

রামসুন্দর সহসা অগ্নিমূর্তি হইয়া বলিলেন , “ তোদের জন্য কি আমি নরকগামী হব । আমাকে তোরা আমার সত্য পালন করতে দিবি নে ? ” রামসুন্দর বাড়ি বিক্রয় করিয়া বসিয়া আছেন ; ছেলেরা কিছুতে না জানিতে পায় , তাহার অনেক ব্যবস্থা করিয়াছিলেন , কিন্তু তবু তাহারা জানিয়াছে দেখিয়া তাহাদের প্রতি হঠাৎ অত্যন্ত রুষ্ট ও বিরক্ত হইয়া উঠিলেন ।

তাঁহার নাতি তাঁহার দুই হাঁটু সবলে জড়াইয়া ধরিয়া মুখ তুলিয়া কহিল , “ দাদা আমাকে গাড়ি কিনে দিলে না ? ”

নতশির রামসুন্দরের কাছে বালক কোনো উত্তর না পাইয়া নিরুর কাছে গিয়া কহিল , “ পিসিমা , আমাকে একখানা গাড়ি কিনে দেবে ? ”

নিরুপমা সমস্ত ব্যাপার বুঝিতে পারিয়া কহিল , “ বাবা , তুমি যদি আর এক পয়সা আমার শ্বশুরকে দাও তা হলে আর তোমার মেয়েকে দেখতে পাবে না , এই তোমার গা ছুঁয়ে বললুম । ”

রামসুন্দর বলিলেন , “ ছি মা , অমন কথা বলতে নেই । আর, এ টাকাটা যদি আমি না দিতে পারি তা হলে তোর বাপের অপমান, আর তোরও অপমান । ”

নিরু কহিল , “ টাকা যদি দাও তবেই অপমান । তোমার মেয়ের কি কোনো মর্যাদা নেই । আমি কি কেবল একটা টাকার থলি , যতক্ষণ টাকা আছে ততক্ষণ আমার দাম। না বাবা , এ টাকা দিয়ে তুমি আমাকে অপমান কোরো না । তা ছাড়া আমার স্বামী তো এ টাকা চান না । ”

রামসুন্দর কহিলেন , “ তা হলে তোমাকে যেতে দেবে না , মা । ”

নিরুপমা কহিল , “ না দেয় তো কী করবে বলো । তুমিও আর নিয়ে যেতে চেয়ো না । ”

রামসুন্দর কম্পিত হস্তে নোটবাঁধা চাদরটি কাঁধে তুলিয়া আবার চোরের মতো সকলের দৃষ্টি এড়াইয়া বাড়ি ফিরিয়া গেলেন ।

কিন্তু রামসুন্দর এই-যে টাকা আনিয়াছিলেন এবং কন্যার নিষেধে সে টাকা না দিয়াই চলিয়া গিয়াছেন , সে কথা গোপন রহিল না । কোনো স্বভাবকৌতূহলী দ্বারলগ্নকর্ণ দাসী নিরুর শাশুড়িকে এই খবর দিল । শুনিয়া তাঁহার আর আক্রোশের সীমা রহিল না ।

নিরুপমার পক্ষে তাহার শ্বশুরবাড়ি শরশয্যা হইয়া উঠিল । এ দিকে তাহার স্বামী বিবাহের অল্পদিন পরেই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হইয়া দেশান্তরে চলিয়া গিয়াছে; এবং পাছে সংসর্গদোষে হীনতা শিক্ষা হয় এই ওজরে সম্প্রতি বাপের বাড়ির আত্মীয়দের সহিত নিরুর সাক্ষাৎকার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হইয়াছে ।

এই সময়ে নিরুর একটা গুরুতর পীড়া হইল । কিন্তু সেজন্য তাহার শাশুড়িকে সম্পূর্ণ দোষ দেওয়া যায় না । শরীরের প্রতি সে অত্যন্ত অবহেলা করিত । কার্তিক মাসের হিমের সময় সমস্ত রাত মাথার দরজা খোলা , শীতের সময় গায়ে কাপড় নাই । আহারের নিয়ম নাই । দাসীরা যখন মাঝে মাঝে খাবার আনিতে ভুলিয়া যাইত তখন যে তাহাদের একবার মুখ খুলিয়া স্মরণ করাইয়া দেওয়া , তাহাও সে করিত না । সে-যে পরের ঘরের দাসদাসী এবং কর্তাগৃহিণীদের অনুগ্রহের উপর নির্ভর করিয়া বাস করিতেছে , এই সংস্কার তাহার মনে বদ্ধমূল হইতেছিল । কিন্তু এরূপ ভাবটাও শাশুড়ির সহ্য হইত না । যদি আহারের প্রতি বধূর কোনো অবহেলা দেখিতেন তবে শাশুড়ি বলিতেন , “ নবাবের বাড়ির মেয়ে কিনা। গরিবের ঘরের অন্ন ওঁর মুখে রোচে না । ” কখনো-বা বলিতেন , “ দেখো-না একবার , ছিরি হচ্ছে দেখো-না , দিনে দিনে যেন পোড়াকাঠ হয়ে যাচ্ছে । ”

রোগ যখন গুরুতর হইয়া উঠিল তখন শাশুড়ি বলিলেন , “ ওঁর সমস্ত ন্যাকামি । ” অবশেষে একদিন নিরু সবিনয়ে শাশুড়িকে বলিল , “ বাবাকে আর আমার ভাইদের একবার দেখব , মা । ”

শাশুড়ি বলিলেন , “ কেবল বাপের বাড়ি যাইবার ছল । ”

কেহ বলিলে বিশ্বাস করিবে না — যেদিন সন্ধ্যার সময় নিরুর শ্বাস উপস্থিত হইল , সেইদিন প্রথম ডাক্তার দেখিল এবং সেইদিন ডাক্তারের দেখা শেষ হইল ।

বাড়ির বড়োবউ মরিয়াছে , খুব ধুম করিয়া অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হইল । প্রতিমা-বিসর্জনের সমারোহ সম্বন্ধে জেলার মধ্যে রায়চৌধুরিদের যেমন লোকবিখ্যাত প্রতিপত্তি আছে , বড়োবউয়ের সৎকার সম্বন্ধে রায়বাহাদুরদের তেমনি একটা খ্যাতি রটিয়া গেল — এমন চন্দনকাষ্ঠের চিতা এ মুলুকে কেহ কখনো দেখে নাই । এমন ঘটা করিয়া শ্রাদ্ধও কেবল রায়বাহাদুরদের বাড়িতেই সম্ভব এবং শুনা যায় , ইহাতে তাঁহাদের কিঞ্চিৎ ঋণ হইয়াছিল ।

রামসুন্দরকে সান্ত্বনা দিবার সময় তাহার মেয়ের যে কিরূপ মহাসমারোহে মৃত্যু হইয়াছে , সকলেই তাহার বহুল বর্ণনা করিল ।

এ দিকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চিঠি আসিল , “ আমি এখানে সমস্ত বন্দোবস্ত করিয়া লইয়াছি , অতএব অবিলম্বে আমার স্ত্রীকে এখানে পাঠাইবে । ” রায়বাহাদুরের মহিষী লিখিলেন , “ বাবা, তোমার জন্যে আর-একটি মেয়ের সম্বন্ধ করিয়াছি , অতএব অবিলম্বে ছুটি লইয়া এখানে আসিবে । ”

এবারে বিশ হাজার টাকা পণ এবং হাতে হাতে আদায় ।

No comments