বীণার অসুখ – হুমায়ূন আহমেদ
বীণার বয়স একুশ। সে লালমাটিয়া কলেজে বি.এ. সেকেন্ড ইয়ারে পড়ত। বীণার মামা ইদরিশ সাহেব একদিন হঠাৎ বললেন, বীণা তাের কলেজে যাবার দরকার নেই। বাসায় থেকে পড়াশােনা কর। পরীক্ষার সময় পরীক্ষা দিলেই হবে। কলেজে আজকাল কী পড়াশােনা হয় তা তাে জানাই আছে। যাওয়া-না-যাওয়া একই।
বীণা ঘাড় নেড়ে ক্ষীণ স্বরে বলল, জি আচ্ছা।
মামার কথার উপর কথা বলার সাহস বীণার নেই। তার পড়াশােনার যাবতীয় খরচ মামা দেন। গত বছর গলার একটা চেন বানিয়ে দিয়েছেন। তা ছাড়া তার বিয়ের কথা হচ্ছে। বিয়ে যদি ঠিকঠাক হয় সেই খরচও মামাকেই দিতে হবে। বীণার বাবা প্যারালাইসিস হয়ে দেশের বাড়িতে পড়ে আছেন। তাঁর পক্ষে একটা টাকাও খরচ করা সম্ভব না। তিনি সবার কাছ থেকে টাকা নেন। কাউকে কিছু দেন ।
ইদরিশ সাহেব বললেন, বীণা, তুই আমাকে এক গ্লাস শরবত বানিয়ে দে। আর শােন, কলেজে না-যাওয়া নিয়ে মনটন খারাপ করিস না। মন খারাপের কিছু নাই।
“জি আচ্ছা মামা।
বীণা শরবত আনতে চলে গেল। তার মনটা অসম্ভব খারাপ। কলেজ বন্ধ করে দেবার কোনাে কারণ সে বুঝতে পারছে না । জিজ্ঞেস করার সাহসও নেই। দিনের পর দিন ঘরে বসে থেকেই বা সে কী করবে? শরবত বানাতে-বানাতে তার মনে হল-হয়তাে তার বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে গেছে। গফরগাঁয়ের ঐ ছেলে শেষপর্যন্ত
হয়তাে রাজি হয়েছে। হয়তাে ওরা বলেছে— মেয়েকে কলেজে পাঠাবেন না। বিয়ে ঠিকঠাক হলে ছেলেপক্ষের লােকজন অদ্ভুত অদ্ভুত শর্ত দিয়ে দেয়।
গফরগাঁয়ের ঐ ছেলেটাকে বীণার একেবারেই পছন্দ হয় নি। কেমন যেন পশুপশু চেহারা। সােফায় বসেছিল। দুই হাঁটুতে দুহাত রেখে। মুখ একটু হাঁ হয়ে ছিল। সেই হাঁ-করা মুখের ভেতর কালাে কুচকুচে জিহ্বা। বীণার দিকে এক পলক তাকাতেই বীণার বুক ধ্বক করে উঠল। মনে হল একটা পশু জিভ বের করে বসে আছে । তার নাকে আঁঝাল গন্ধও এসে লাগল। গন্ধ ঐ লােকটার থেকে আসছিল। টক দুধ এবং পােড়া কাঠের গন্ধ একত্রে মেশালে যেরকম গন্ধ হয় সেরকম একটা গন্ধ। গা কেমন ঝিমঝিম করে।
লােকটা তাকে কোনাে প্রশ্ন করল না। শুধু পলকহীন চোখে তাকিয়ে রইল। বীণার একবার মনে হল, লােকটার চোখে হয়তাে পাতা নেই । সাপের যেমন চোখের পাতা থাকে না সেরকম। লােকটার সঙ্গে বয়স্ক যে দুজন মানুষ এসেছিলেন তারা অনবরত কথা বলতে লাগলেন। একজন বীণাকে ডাকতে লাগলেন— আন্টি। চুল-দাড়ি পাকা বয়স্ক একজন লােক যদি আন্টি ডাকে তখন ভয়ংকর রাগ লাগে। কোনাে কথারই জবাব দিতে ইচ্ছা করে না। বীণা অবিশ্যি সব প্রশ্নের জবাব দিল। কারণ, মামা তার পাশেই বসে আছেন । মামা বসেছেন সােফার ডানদিকে, সে বাদিকে। প্রশ্নের জবাব না-দেয়ার কোনাে উপায়ই নেই।
‘তারপর আন্টি’ রবিঠাকুর কত সনে নােবেল পুরস্কার পান তা জানা আছে?
‘জি না।’
‘উনিশশ তেরাে। অবিশ্যি উনি উনিশশ তেরােতে না পেয়ে ঊনিশশ’ একত্রিশে পেলেও কিছু যেত আসত না। তবু তারিখটা জানা দরকার। এটা হচ্ছে জেনারেল নলেজ । মেয়েরা শুধু রান্নাবান্না করবে তা তাে না—তাদের পৃথিবীতে কী হচ্ছে না হচ্ছে তাও তাে জানতে হবে। কী বলেন আন্টি?’
‘জি।’
‘আন্টি, আপনি খবরের কাগজ পড়েন?”
না।
‘এইটা হচ্ছে মেয়েদের একটা কমন দোষ। কোনাে মেয়ে খবরের কাগজ পড়েন না। আপনি কেন খবরের কাগজ পড়েন না, না-পড়ার কারণটা কী, আমাদের একটু বলুন তাে আন্টি?
বীণা কিছু বলল না। মামা পাশে বসে আছেন এই ভয়েই বলল না— কারণ মামা খবরের কাগজ রাখেন না বলেই খবরের কাগজ পড়ে না। এই তথ্যটা এঁদের জানানাে নিশ্চয়ই ঠিক হবে না। মামা রাগ করবেন।
ইদরিশ সাহেব বললেন, মা বীণা ইনাদের চা-মিষ্টি দাও।
চার-পাঁচ জাতের মিষ্টি টেবিলে সাজানাে। বীণা প্লেটে উঠিয়ে উঠিয়ে সবার দিকে এগিয়ে দিল। লােকটাকে যখন দিতে গেল তখন লােকটা অদ্ভুত একধরনের শব্দ করল। থাবার মতাে বিশাল হাত বাড়িয়ে মিষ্টির থালা নিল । বীণার গায়ে সত্যি-সত্যি কাঁটা দিয়ে উঠল । সে মনে-মনে বলল, আল্লা এই লােকটা যেন আমাকে পছন্দ না করে। আল্লা এই লােকটা যেন আমাকে পছন্দ না করে। লােকটা বীণাকে পছন্দ করল কি করল না কিছুই বােঝা গেল না। ইদরিশ সাহেব এই প্রসঙ্গে বাসার কারাে সঙ্গেই কোনাে আলাপ করলেন না। ইদরিশ সাহেবের এই হল স্বভাব । বাসার কারাের সঙ্গেই কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলবেন না। নিজে যা ভালাে কইবেন তাই করবেন।
এই যে তিনি আজ বীণার কলেজে যাওয়া বন্ধ করলেন— এর কারণ তিনি কাউকে বলবেন না । ইদৱিশ সাহেবের জীবনের মূলমন্ত্র হচ্ছে, নারীজাতির সঙ্গে কোনাে বিষয় নিয়ে আলাপ না-করা। নারীজাতির সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলােচনার ফল এটাই-সময় নষ্ট। কি দরকার সময় নষ্ট করে?
ইদরিশ সাহেবের বাসায় তিনি ছাড়া সবই মেয়ে। সব মিলিয়ে সাতজন মেয়ে। ইদরিশ সাহেবের স্ত্রী, চার কন্যা, তার এক ছােট বােন এবং কাজের একটি মেয়ে। তাঁর বাসায় দুটো বিড়াল থাকে। এই বিড়াল দুটিও মেয়ে-বিড়াল। সঙ্গত কারণেই ইদরিশ সাহেব বাসায় যতক্ষণ থাকেন মনমরা হয়ে থাকেন। চারদিকে মেয়েজাতি নিয়ে বাস করতে তাঁর ভালাে লাগে না। তিনি তাঁর ব্যবসা, তার পরিকল্পনা কিছুই কাউকে বলেন না। দিন পনেরাে বীণার খুব ভয়ে-ভয়ে কাটল। কে জানে হয়তো লােকটা তাকে পছন্দ করে ফেলেছে। তার চেহারা এমন কিছু খারাপ না, পছন্দ করতেও পারে। রঙ মােটামুটি ফরসা। চোখদুটা মায়ামায়া, লম্বা হালকা-পাতলা শরীর। সাজলে তাকে ভালােই দেখায়। পছন্দ করে ফেললে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। বীণা বেশ কয়েকবার লজ্জায় মাথা খেয়ে তার মামিকে জিজ্ঞেস করেছে মামি, মামা কী কিছু বলেছে?
বীণার মামি হাসিনা পৃথিবীর সরলতম মহিলা। অতি সহজ কথাও তিনি বুঝেন না।
একটু ঘুরিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলে এমনভাবে তাকান যে, মনে হয় অথই জলে পড়েছেন। বীণার সহজ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন— কিসের কথা রে ?
“ঐ যে শুক্রবার যে আসল?
‘কে আসল শুক্রবার?’
‘তিনজন লােক আসল না?
‘তিনজন লােক আবার কখন আসল?
‘বিয়ের আলাপ নিয়ে আসল না?
“ও আচ্ছা–মনে পড়েছে। না, কিছু বলে নাই। তাের মামা কি কখনাে কিছু বলে? হঠাৎ একদিন শুনবি বিয়ের দিন-তারিখ হয়ে গেছে। তাের মামা আগেভাগে কিছু বলবে? কোনােদিন না।’
বীণা আতঙ্কে-আতঙ্কেই ভয়াবহ কিছু দুঃস্বপ্নও দেখল। এই দুঃস্বপ্নগুলির প্রতিটিতে তার বিয়ে হয় সুন্দর ছেলের সঙ্গে। বাসরঘরে সে আর ছেলেটা থাকে আর সবাই চলে যায়। লজ্জায় সে মাথা নিচু করে থাকে। তখন তার স্বামী আদুরে গলায় বলে– লজ্জায় দেখি মরে যাচ্ছ। এই, তাকাও না আমার দিকে, তাকাও।
সে তাকায়। তাকাতেই তার গায়ের রক্ত হিম হয়ে যায়। মানুষ কোথায়, একটা কুকুরের মতাে পশু থাবা গেড়ে বসে আছে। হা-করা মুখের ভেতর কুচকুচে কালাে একটা জিহ্বা। জিহ্বা মাঝে মাঝে মুখের ভেতর থেকে বের হয়ে আসছে। পশুটার মুখ ছুঁচালাে । তার গা থেকে টক দই আর পােড়া কাঠের গন্ধ ভেসে আসছে। স্বপ্নে মানুষ গন্ধ পায় না। কিন্তু বীণা এই জাতীয় স্বপ্নে গন্ধ পেত। তীব্র কটুগন্ধেই এক সময় ঘুম ভেঙে যেত।
প্রায় দেড়মাস এরকম আতঙ্কে কাটল । তারপর আতঙ্ক হঠাৎ করেই কেটে গেল। কারণ ইদরিশ সাহেব এক ছুটির দিনের দুপুরে ভাত খেতে-খেতে বললেন, বিয়েটা ভেঙে দিলাম।
হাসিনা বললেন, কার বিয়ে ভেঙে দিলে?
‘বীণার, ঐ যে তিনজন এসেছিল শুক্রবার। খুব চাপাচাপি করছিল। মেয়ে নাকি তাদের খুব পছন্দ। ওদের বাড়ির অবস্থা ভালাে। গফরগাঁয়ে কাপড়ের ব্যবসা আছে। গ্রামের বাড়িতে ধান-ভাঙা কল দিয়েছে। বড়-বড় আত্মীয়স্বজন।
‘তাহলে বিয়ে ভেঙে দিলে কেন?’
‘ছেলের গায়ে বিশ্রী গন্ধ। ঘােড়ার আস্তাবলে গেলে যেমন গন্ধ পাওয়া যায়। সেই রকম । যে ক’বার এই ছেলে আমার কাছে এসেছে এরকম গন্ধ পেয়েছি । কী দরকার?
হাসিনা দুঃখিত মুখ করে বললেন, আহা গন্ধের জন্যে বিয়েটা বাতিল করে দিলে। ভালােমতাে সাবান দিয়ে গােসল দিলেই তো গন্ধ চলে যায়।
ইদরিশ সাহেব কড়া গলায় বললেন, যা বােঝ না তা নিয়ে কথা বলবে না । তুমি রোজ গিয়ে গোসল করিয়ে আসবে নাকি? মেয়েছেলে মেয়েছেলের মতাে থাকবে। সবকিছুর মধ্যে কথা বলবে না।
‘রাগ করছ কেন? রাগ করার মতাে কী বললাম?
চুপ। আর একটা কথাও না।’
ইদরিশ সাহেবের দুর্ব্যবহারে হাসিনা কাঁদতে বসেন। তবে বীণার আনন্দের সীমা থাকে না। যাক শেষপর্যন্ত লােকটির সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে না। মামার প্রতি কতজ্ঞতায় বীণার মন ভরে যায়। মামা কথা না বললেও মানুষ খারাপ না। কে জানে এই যে তাকে কলেজে যেতে নিষেধ করেছেন এরও কোনাে ভালাে দিক নিশ্চয়ই আছে। মামা যদি শুধু কারণটা বলত। কিন্তু মামা বলবে না। অদ্ভুত মানুষ ।
নিতান্তই আকস্মিকভাবে বীণা তার কলেজ বন্ধ হবার রহস্য জেনে ফেলল। ইদরিশ সাহেব বীণার বাবাকে চিঠিতে কারণটা জানিয়েছেন। খামে ভরার আগে এই চিঠি বীণা পড়ে ফেলল।
পাকজনাবেষু দুলাভাই,
আমার সালাম জানিবেন। পর সমাচার এই যে, বীণার কলেজে যাওয়া একটি বিশেষ কারণে বন্ধ করিতে হইয়াছে । বীণা ইহাতে কিঞ্চিৎ মনে কষ্ট পাইয়াছে । কিন্তু ইহা ছাড়া অন্য উপায় দেখিলাম না। এখন আপনাকে কারণ বলিতেছি।
জোবেদ আলী নামক গফরগাঁয়ের জনৈক যুবকের সহিত বীণার বিবাহের আলাপ হইয়াছিল । পাত্রপক্ষের, বিশেষ করিয়া পাত্রের, বীণাকে খুবই পছন্দ হইয়াছিল। একটি বিশেষ কারণে বিবাহের প্রস্তাব বাতিল করিয়া দিতে হইয়াছে। এখন কিছুটা সমস্যা দেখা দিয়াছে। উক্ত জোবেদ আলী প্রায়শই বীণাকে অনুসরণ করিয়া কলেজ পর্যন্ত যায়। ইহা আমার কাছে অত্যন্ত সন্দেহজনক বলিয়া মনে হইল। আজকালকার ছেলেদের মতিগতির কোনো ঠিক নাই। একবার এ্যাসিড জাতীয় কিছু দেয় তাহা হইলে সর্বনাশের কোনাে শেষ থাকিবে না। যাহা হউক আপনি তাহার বি.এ. পরীক্ষা নিয়া কোনাে চিন্তা করিবেন না। আমি কলেজের প্রিন্সিপ্যালের সহিত আলাপ করিয়াছি। তিনিও বলিয়াছেন কোনাে অসুবিধা হইবে না। আগেকার মতো কলেজগুলি পার্সেন্টেজ নিয়া ঝামেলা করে না। আপনার শরীরের হাল অবস্থা এখন কী? শরীরের যত্ন নিবেন। বীণাকে লইয়া অযথা চিন্তাগ্রস্ত হইবেন না।
চিঠি পড়ে বীণার গা কাপতে লাগল। কী সর্বনাশের কথা! ঐ লােক তার পেছনে পেছনে যায়। কই, সে তাে একদিনও টের পায় নি। আর তার মামার কি উচিত ছিল না ঘটনাটা তাকে জানানাে? সে এখন কলেজে যাচ্ছে না ঠিকই কিন্তু অন্য জায়গায় তাে যাচ্ছে। আগে জানলে তাও যেত না। ঘরে বসে থাকত। অবশ্যই মামার উচিত ছিল ঘটনাটা তাকে জানানাে।
বীণাকে খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে বলা ঠিক হবে না । সে যদি বুদ্ধিমতী মেয়ে হত তাহলে চট করে বুঝে ফেলত তাকে ঘটনাটা জানানাের জন্যেই ইদরিশ সাহেব খামে ভরার আগে চিঠিটা দীর্ঘ সময় টেবিলে ফেলে রেখেছিলেন। এই জাতীয় ভুল তিনি কখনাে করেন না।
বীণা বাড়ি থেকে বের হওয়া পুরােপুরি বন্ধ করে দিল। আগের ভয়ের স্বপ্নগুলি আবার দেখতে লাগল। এবারের স্বপ্নে আরাে সব কুৎসিত ব্যাপার ঘটতে লাগল । এমন হল যে, ঘুমুতে পর্যন্ত ভয় লাগে।
হাসিনা বলেন, কী হয়েছে তাের বল তাে?
বীণা ফ্যাকাশে হাসি হেসে বলে, কই কিছু হয় নি তাে?
তুই তাে শুকিয়ে চটি জুতা হয়ে যাচ্ছিস। তাের তাে আর বিয়েই হবে না। এ রকম শুকনাে মেয়েকে কে বিয়ে করবে বল? গায়ে গােশত না থাকলে ছেলেরা মেয়েদের পছন্দ করে না। ছেলেগুলি হচ্ছে বদের বদ। ঝাঁটা মারি এদের মুখে।
বীণার বন্দিজীবন কাটতে লাগল । মেয়েরা যে-কোনাে পরিস্থিতিতে নিজেকে খুব সহজে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। বীণাও খাপ খাইয়ে নিল। সারাদিন তিন কামরার ঘরেই সময় কাটে । বাইরের বারান্দায় ভুলেও যায় না। বাইরের বারান্দায় দাঁড়ালে রাস্তার অনেকটা চোখে পড়ে। তার ভয় বারান্দায় দাড়ালে যদি লােকটাকে দেখে ফেলে।
এত সাবধানতার পরও একদিন দেখা হয়ে গেল। বারান্দায় কাপড় শুকোতে দেয়া হয়েছে। হাসিনা বললেন— বৃষ্টি এসেছে, কাপড়গুলি নিয়ে আয় তো বীণা।
বীণা কাপড় আনতে গিয়ে পাথরের মতাে জমে গেল। বাড়ির সামনের রাস্তাটার অপর পাশে জারুল গাছের নিচে লােকটা দাঁড়িয়ে আছে । তাকিয়ে আছে বীণার দিকে। মুখ হাঁ হয়ে আছে। দাঁড়িয়ে আছে খানিকটা কুঁজো হয়ে। বীণাকে দেখেই সে দ্রুত রাস্তা পার হয়ে এপাশে চলে এল। হাত ইশারা করে কী যেন বলল। বীণা চিৎকার করে ঘরে ঢুকল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তার জ্বর উঠে গেল একশ তিন।।
হাসিনা বললেন, এটা কেমন কথা। লােকটা তাে বাঘও না, ভালুকও না। তাকে দেখে এত ভয় পাওয়ার কী আছে ?
বীণা বিড়বিড় করে বলল, আমি জানি না মামি। কেন এত ভয় লাগছে আমি জানি না। আপনি আমাকে ধরে বসে থাকেন। কেমন যেন লাগছে মামি ।
ইদরিশ সাহেব সন্ধ্যাবেলা ঘরে ফিরে সব শুনলেন। কাউকে কিছুই বললেন না। সহজ ভঙ্গিতে খাওয়াদাওয়া করলেন। বড় মেয়েকে অঙ্ক দেখিয়ে দিলেন। রাত সাড়ে নটার সময় বললেন, একটা স্যুটকেসে বীণার কাপড় গুছিয়ে দাও তাে। রাত এগারােটায় বাহাদুরাবাদ এক্সপ্রেস । বীণাকে দেশের বাড়িতে রেখে আসি।
হাসিনা হতভম্ব হয়ে বললেন, আজ রাতে?
ইদরিশ সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, আজ রাতে নয় তাে কি পরশু রাতে না কি? জোবেদ হারামজাদা বড় বিরক্ত করছে। আমি আরাে কয়েকদিন দেখেছি।
‘আজ রাতে যাওয়ার দরকার কী, কাল যাও। বীণার জ্বর।
‘জ্বরের সঙ্গে কাপড় গােছানাের সম্পর্ক কী? কাপড় তাে তুমি গোছাবে। তােমার গায়ে তাে জ্বর নেই।’
হাসিনা কাপড় গুছিয়ে দিলেন। তার স্বামীকে তিনি চেনেন। কথাবার্তা বলে লাভ হবে না। বীণা একশ দুই পয়েন্ট ফাইভ জ্বর নিয়ে বাহাদুরাবাদ এক্সপ্রেস উঠল। বাড়িতে পৌঁছতে পৌছতে সেই জ্বর বেড়ে হল একশ চার পয়েন্ট ফাইভ। ইদরিশ সাহেব ছুটি নিয়ে যান নি । বীণাকে রেখে পরদিনই তাকে আসতে হল। বীণা সপ্তাহখানিক জ্বরে ভুগে কঙ্কালের মতাে হয়ে গেল । মুখে রুচি নেই। যা খায় তাই বমি করে ফেলে দেয়। রাতে ঘুম হয় না। প্রায় রাতই জেগে-জেগে কাটিয়ে দেয়। চোখের পাতা এক হলেই ভয়ংকর সব স্বপ্ন দেখে।
এই সময় তার ভয়ের অসুখ হয়। সারাক্ষণই ভয় লাগে। কোনাে কারণ ছাড়াই। বাতাসে জানালার পাট নড়ে উঠল— বীণার হৃৎপিণ্ড লাফাতে শুরু করে। সে আতঙ্কে অস্থির হয়ে যায়। প্রচণ্ড ঘাম হয় ।
বীণাদের এই বসতবাড়িটা খুবই পুরানাে। বীণার দাদা এক হিন্দু-ব্যবসায়ীর কাছ থেকে খুব শস্তায় এই বাড়ি কিনে নিয়েছিলেন। অনেকখানি জায়গা নিয়ে বাড়ি । পুরাে জায়গাটা দেয়াল দিয়ে ঘেরা। সংস্কারের অভাবে দেয়াল জায়গায়-জায়গায় ভেঙে পড়েছে। দোতলায় ঘরের বেশির ভাগই ব্যবহারের উপযােগী নয় । একতলার তিনটা ঘর শুধু ব্যবহৃত হয়। দোতলার ঘর তালাবদ্ধ থাকে। একটা ঘরে বীণার বাবা এমদাদ সাহেব থাকেন। প্যারালাইসিসের কারণে এই ঘর থেকে বের হবার তাঁর কোনাে উপায় নেই। অন্য একটা ঘরে বীণা এবং বীণার দূর-সম্পর্কের মামি মরিয়ম থাকেন। ঘরের কাজকর্ম করার জন্যে বাতাসী নামের কমবয়সী একটা মেয়ে থাকে। তার চোখে অসুখ আছে। রাতে সে কিছুই দেখে না।
বাড়িতে মানুষ বলতে এই চারটি প্রাণী। সন্ধ্যার পর থেকেই বীণার ভয়-ভয় করে। দোতলার বারান্দায় কিসের যেন শব্দ হয়। মনে হয় খড়ম পড়ে কেউ যেন হাঁটে। বীণা জানে ইদুর শব্দ করছে— তবু তার ভয় কাটে না। দুর্বল নার্ভের কারণেই হয়তাে আতঙ্কে তার শরীর কাঁপতে থাকে। সে ফিসফিস করে বলে— কিসের শব্দ মামি?
মামি ঘরের কাজ করতে করতে নির্বিকার গলায় বলেন, জানি না।
‘মনে হয় ইদুরের শব্দ, তাই না মামি?
‘অন্য কিছু হইতেও পারে।’
অন্য কিছু কী?
‘সইন্ধ্যা বেলায় এরার নাম নেওন নাই মা। খারাপ বাতাস হইতে পারে।
‘খারাপ বাতাস?’
কতদিনের পুরানাে বাড়ি। উপরের ঘরগুলান খালি পইড়া থাকে। কেউ বাত্তি দেয় না। ঘরে বাত্তি না দিলে খারাপ বাতাসের আনাগােনা হয়।
‘বাতি দেয় না কেন? বাতি দিলেই তাে হয়। কাল থেকে রােজ সন্ধ্যায় বাতি দিবেন মামি।
‘আইচ্ছা দিমুনে। অখন ঘুমাও।
বীণা শুয়ে থাকে। ঘুম আসে না। রাত যতই বাড়তে থাকে দোতলায় শব্দ ততই বাড়তে থাকে। সেইসঙ্গে যুক্ত হয় বীণার বাবার গােঙানি । গভীর রাতে তিনি হাঁটুর ব্যথায় গােঙানির মতাে শব্দ করেন। সেই শব্দও বীণার কানে অমানুষিক শব্দ বলে মনে হয়। যেন বীণার বাবা নয়। অন্য কেউ শব্দ করছে। সেই অন্য কেউ মানুষগােত্রীয় নয়। একধরনের চাপা হাসিও শােনা যায়।
বীণদের স্নানঘর মল ঘর থেকে অনেকটা দূরে। স্নানঘর বীণার খুব প্রিয়। শ্যাওলা ধরা দেয়াল-ঘেরা ছােট্ট চারকোণা একটা জায়গা। ভেতরে চৌবাচ্চা আছে। স্নানঘরের ছাদটা ছিল টিনের। গত আশ্বিন মাসের ঝড়ে টিনের ছাদ উড়ে গেছে। সেই ছাদ আর ঠিক করা হয় নি। গােসলের সময় মাথার উপর থাকে খােলা আকাশ। ঠিক দুপুরবেলায় সূর্যের ছায়া পড়ে চৌবাচ্চার পানিতে। মগ ডুবালেই চৌবাচ্চা থেকে আলাে ঠিকরে পড়ে চারদিকের সবুজ দেয়ালে। বীণার বড় ভালাে লাগে। দুপুরবেলা বীণার অনেকখানি সময় এই গােসলখানায় কেটে যায়। রােজই মনে হয় গ্রামের বাড়িতে এসে ভালােই হয়েছে। রাতের তীব্র অতিঙ্কের কথা তখন আর মনে থাকে না।
এক দুপুরবেলায় এই গােসলখানাতেই অস্বাভাবিক একটা ব্যাপার ঘটল। বীণা গােসল করছে। চারদিকে সুনসান নীরবতা। ঘন নীল আকাশের ছায়া পড়েছে চৌবাচ্চায়। বীণার চমৎকার লাগছে । শরীরটা আগের মতাে দুর্বল লাগছে না। সে আপন মনে খানিকক্ষণ গুনগুন করল ।
বীণা মাথায় পানি ঢালল। ঠাণ্ডা পানি। শরীর কেঁপে উঠল । আর তখনি সে অদ্ভুত গন্ধ পেল। অদ্ভুত হলেও গন্ধ চেনা, এই গন্ধ সে আগেও পেয়েছে। বীণা আতঙ্কে অভিভূত হয়ে পড়ল। নির্জন গোসলখানায় এই গন্ধ এল কোত্থেকে? পােড়া কাঠকয়লার সঙ্গে মেশা নষ্ট দুধের মিশ্র গন্ধ। বীণা মগ ছুড়ে ফেলে গােসলখানার দরজায় আছড়ে পড়ল। দরজা খুলে দৌড়ে পালিয়ে যেতে হবে। আর এক মুহূর্তও এখানে থাকা যাবে না । এক মুহূর্তও না ।
আশ্চর্যের ব্যাপার! বীণা দরজা খুলতে পারল না। ছিটকিনি নামানাে হয়েছে। বীণা প্রাণপণে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে অথচ দরজা এক চুলও নড়ছে না। যেন কেউ তাকে আটকে ফেলেছে। বীণা চিৎকার করবার চেষ্টা করল। গলা দিয়ে শব্দ বেরুল না।
শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দরজায় ধাক্কা দিল । দরজা তাে নড়লই না, কোনাে শব্দ পর্যন্ত হল না। অথচ ঘরে অন্য একরকম শব্দ হচ্ছে। যেন কী একটা পড়ছে চৌবাচ্চায়। টুপটাপ শব্দ। বৃষ্টির ফোটার মতাে।
কী পড়ছে? ‘কিসের শব্দ হচ্ছে?
বীণা হতভম্ব হয়ে দেখল টকটকে লালবর্ণের রক্ত পড়ছে চৌবাচ্চায় । চৌবাচ্চার পানি ক্রমেই ঘােলা হয়ে উঠছে। কেউ একজন খােলা ছাদে বসে আছে। রক্ত পড়ছে তার গা থেকে । বীণা সেই দৃশ্য দেখতে চায় না। সে কিছুতেই উপরের দিকে তাকাবে না। সে জানে উপরের দিকে তাকালেই ভয়ংকর কিছু দেখবে। এমন ভয়ংকর কিছু যা ব্যাখ্যার অতীত, অভিজ্ঞতার অতীত।
ভারী, শ্লেষ্মাজড়িত স্বরে কেউ-একজন খােলা ছাদে বসে আছে। রক্ত পড়ছে তার গা থেকে। ডাকল বীণা, ও বীণী। শব্দ উপর থেকে আসছে। কেউ-একজন বসে আছে গােসলখানার দেয়ালে। যে বসে আছে তাকে বীণা চেনে। না-দেখেও বীণা বলতে পারছে কে বসে আছে।
‘ও বীণা, বীণা।
বীণা তাকাল । হ্যা, ঐ লােকটিই বসে আছে। তবে লােকটির মুখ পশুর মতাে নয়। মায়ামাখা একটি মুখ। বড় বড় চোখদুটি বিষন্ন ও কালাে। লােকটি পা ঝুলিয়ে বসে আছে। পা দুটি অস্বাভাবিক-থ্যাতলানাে। চাপচাপ রক্ত সেই ঘঁতলানাে পা বেয়ে চৌবাচ্চার জলে পড়ছে। লােকটি ভারী শ্লেষ্মাজড়িত স্বরে ডাকল—-বীণা, ও বীণা।
বীণা জ্ঞান হারাল।
তার জ্ঞান ফিরল তৃতীয় দিনে জামালপুর সদর হাসপাতালে। চোখ মেলে দেখল আরাে অনেকের সঙ্গে বিছানার পাশে ইদরিশ সাহেব বসে আছেন। তাঁকে। টেলিগ্রাম করে আনানাে হয়েছে।
ইদরিশ সাহেব গভীর মমতার সঙ্গে বললেন, কী হয়েছে রে মা? বীণা ফুপাতে-ফুপাতে বলল, ভয় পেয়েছি মামা।
ইদরিশ সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, ভয় পাবারই কথা। ঐ জংলা বাড়িতে আমি নিজেই ভয় পাই, আর তুই পাবি না? এখানে থাকার দরকার নেই । চল আমার সঙ্গে ঢাকায়। ঢাকায় গিয়ে আবার কলেজে যাওয়া-আসা শুরু কর। ঐ। ছেলে আর তােকে বিরক্ত করবে না। বেচারা ট্রাক এ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে।
বীণা চোখ বন্ধ করে ফেলল ।
ইদরিশ সাহেব নিজের মনেই বললেন, পায়ের উপর দিয়ে ট্রাক চলে গেছিল। দুটা পা-ই ছাতু হয়ে গেছে। হাসপাতালে নেয়ার আঠারাে ঘণ্টা পরে মারা গেছে । খবর পেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম । না-গেলে অভদ্রতা হয়।
ইদরিশ সাহেব খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ছেলেটা খারাপ ছিল না। বুঝলি? খামােখাই আজেবাজে সন্দেহ করেছি। অতি ভদ্র ছেলে। তাের কথা জিজ্ঞেস করল । বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করল ।
বীণার খুব ইচ্ছা করল বলতে—আমার কথা কী জিজ্ঞেস করল মামা? সে বলতে পারল না।
ইদরিশ সাহেব বললেন, ছেলেটার এ্যাকসিডেন্টের খবর তার অঞ্চলে পৌছামাত্র সেখানের সব লােক এসে উপস্থিত। হাজার-হাজার মানুষ। হাউমাউ করে কাঁদছে। দেখবার মতাে একটা দৃশ্য। বুঝলি বীণা, আমরা মানুষের বাইরেটাই শুধু দেখি । অন্তর দেখি না। এটা খুবই আফসােসের ব্যাপার। তাের যাতে ভালাে বিয়ে হয় এইজন্যে আমাকে কিছু টাকাও দিয়ে গেছে। না’ করতে পারলাম না । একটা মানুষ মারা যাচ্ছে, কী করে ‘না’ বলি । ঠিক না?
Post a Comment