মামার বাড়ি – স্বপনবুড়ো
প্রবেশিকা পরীক্ষা শেষ করে অভিরাম জেদ ধরল‚ এবার সে মামার বাড়ি যাবেই। এত বয়স হয়েছে অথচ একবারও মামাবাড়ি যায়নি। খাস কলকাতার বাস‚ আর মামারা থাকে অজ গ্রামে। পশ্চিম বাঙলার ছোট একটা রেল-স্টেশনে নেমে বারো মাইল গোরুর গাড়ীর পথ মামাবাড়ির মাথাভাঙা গ্রাম। হয়তো সেই কারণেই মা–ও যায়নি কখনো। অথচ শুনেছে‚ এককালে মামারা নাকি জমিদার ছিল। এখন কিছুই নেই অবশ্য। শুধু পুরোনো দিনের মস্ত বাড়িটা ছাড়া।
অভিরামের বায়নার কাছে বাবা–মায়ের কোনো আপত্তিই ধোপে টিকল না। ফের কখন মায়ের মতি পালটায়‚ সেই আশংকায় সেও দেরি না করে একদিন শ্রীদুর্গা বলে বেরিয়ে পড়ল মামাবাড়ির উদ্দেশ্যে।
মাথাভাঙা গ্রামে তার মামাবাড়ির এককালে খুব হাঁক-ডাক ছিল। এখন বাড়ির লোকজন সব মরতে মরতে এসে দাঁড়িয়েছে ছোটমামা আর ছোটমামিতে। দুজনেরই অনেক বয়েস। ছেলেপুলে নেই। বিরাট তিন-মহল বাড়িতে দুটি প্রাণী কোনো রকমে দিন গুজরান করেন।
রওনা হবার আগে অভিরামের বাবা তার ছোটমামার নামে টেলিগ্রাম করে দিয়েছিলেন। তাই আশা ছিল, স্টেশনে গোরুর গাড়ী থাকবে।
ছোট লাইন, ছোট গাড়ী। সেদিন ভিড়ও বেশী ছিল না। কয়েকটি বুড়োগোছের লোক পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে কাছাকাছি স্টেশনগুলিতে নেমে গেল। বাকি রইলেন একটি ভদ্রলোক‚ বয়েসে অভিরামের চাইতে বেশ বড়ো। ক্রমাগত বিড়ি ফুঁকছেন আর দুলছেন। গাড়ীতে একমাত্র অভিরামকে দেখে আলাপ জমিয়ে নিলেন।
শুধোলেন, তা খোকাবাবু, কোথায় চলেছ তুমি?
—আমি খোকাবাবু নই, আমার নাম অভিরাম চট্টোপাধ্যায়।
বেশ! বেশ! তা অভিরামবাবু, কতদূর যাওয়া হবে শুনি?
—যাব আমার মামাবাড়ি মাথাভাঙা।
ভদ্রলোক এইবার কৌতূহলী হয়ে তাকালেন।
—মাথাভাঙা! আমিও তো মাথাভাঙা যাচ্ছি। কোন বাড়িতে যাবে তুমি?
অভিরাম এইবার নড়েচড়ে বসল। তাহলে মামাবাড়ির গ্রামের একজন লোক পাওয়া গেল। জবাব দিল, আমার ছোটমামার নাম শ্ৰীশক্তিসুন্দর চক্রবর্তী।
নামটা শুনেই ভদ্রলোক কেমন চমকে উঠলেন। তারপর মুখের ভাবটা চট করে বদলে নিয়ে বললেন, ও! চক্কোত্তি-বাড়ি যাচ্ছ! বেশ বেশ। কিন্তু তোমার বাবা–মা ওখানে যেতে মানা করেননি?
অভিরাম হেসে ফেলে বলল, বারে! মামাবাড়ি যেতে বারণ করবেন কেন? ম্যাট্রিক পরীক্ষা হয়ে গেছে‚ কিছুদিন মামাবাড়ি থেকে আসব‚ একটা নতুন জায়গাও তো দেখা হবে।
ভদ্রলোক চোখ বুজে বিড়ি টানতে টানতে মাথা নেড়ে আপন মনেই যেন বললেন, তা যদি থাকতে পার, সে ত ভালো কথাই!
ভদ্রলোকের কথাবার্তা অভিরামের আদৌ ভালো লাগল না। মামাবাড়ি কে না থাকতে পারে? ওর বন্ধু-বান্ধবের কাছে কত তাদের মামাবাড়ির গল্প শুনেছে। সেখানে কত আদর-যত্ন, কত মজা! নিশ্চয় তার ছোটমামার সঙ্গে ভদ্রলোকের ঝগড়া আছে! নইলে এমন কথা কেউ বলে নাকি!
ট্রেনে চলতে চলতেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। ভদ্রলোক বললেন, নাঃ, ভোগালে দেখছি। সারা রাস্তা কাদা ভেঙে বাড়ি যেতে হবে।
অভিরাম বলল, আমার জন্যে গোরুর গাড়ী আসবে মামাবাড়ি থেকে। আপনি তাতেও যেতে পারেন।
এই সংবাদে ভদ্রলোক ভারী খুশী হয়ে উঠলেন। বললেন, তাহলে ত খুব ভালোই হয়।
অভিরাম মনে মনে হাসল। এবার নিশ্চয়ই লোকটা আর তার মামাবাড়ির নিন্দে করবে না।
মাথাভাঙা স্টেশনে যখন গাড়ী এসে পৌঁছল, তখন বেশ রাত হয়ে গেছে। স্টেশন থেকে বেরুতেই চষা ভিজে মাটির গন্ধ ঠাণ্ডা বাতাসে পাওয়া গেল। দুই পাশের ঝোপ-ঝাড়-জঙ্গলে রাশিরাশি জোনাকি যেন পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে লণ্ঠন ধরে।
কিন্তু কোথায় মামাবাড়ির গোরুর গাড়ী? ভদ্রলোক অবশ্য হাঁক-ডাক শুরু করে দিলেন।
অন্ধকারে খুলে রাখা একখানি গোরুর গাড়ীর ভেতর থেকে একজন চাষি গোছের লোক বেরিয়ে এল। লোকটার বয়স ঠাহর করা শক্ত। চোখের ভ্রূগুলি কুঁচকে গেছে। মাথার সব চুল সাদা।
ট্রেনের ভদ্রলোক তাকে দেখতে পেয়ে বললেন, এই যে তুফান, তাহলে তুমিই গাড়ী নিয়ে এসেছ?
তুফান লোকটা কোন জবাব দিল না। গাড়ীর ভেতরে মুখ গুঁজে একটা ডিবে জ্বালিয়ে গাড়ীর তলায় ঝুলিয়ে দিল। তারপর আপনমনেই বলল, জল এসে পড়েছিল। কখন যে ঘুমিয়ে গেছি টের পাইনি।
তারপর অভিরামের কাছে এসে শুধোল, এই বুঝি আমাদের দিদিমণির ছেলে? রাজপুত্রের মতো ছেলে হয়েছে! বেঁচে-বর্তে থাক। হঠাৎ অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিজেকেই যেন জিজ্ঞেস করল, তা এই বন-বাদাড়ে বেড়াতে আসা কেন? দুনিয়ায় কি আর জায়গা ছিল না!
অভিরামের ভারী মজা লাগে এই পাড়াগেঁয়ে লোকদের কথা শুনে। ওদেরই না হয় গ্রাম ভালো লাগে না! কিন্তু শহরে যারা চিরকাল থাকে, গ্রাম তাদের পক্ষে নিশ্চয়ই নতুন জায়গা! আর, মামাবাড়িতে বেড়াতে আসতে কে না চায়? তবে কি ছোটমামা ভারী কৃপণ? নইলে সকলের মুখেই এই একই রকম কথা কেন? আচ্ছা, দেখাই যাক না কৃপণতার নমুনাটা! ফিরে গিয়ে মাকে খুব খ্যাপানো যাবে তাহলে।
গাড়ী চলছে তখন। তুফানও সমানে বকবক করে চলেছে। সেকালের মামাবাড়ির গল্প। তিন-মহলা বাড়ি লোকজনে গমগম করত একসময়। বারো-মাসে তেরপার্বণ! দোল-দুর্গোৎসব ঘটা করে হত। হিন্দু-মুসলমান প্রজা সব একসঙ্গে প্রসাদ পেত। চক্কোত্তি-বাড়িতে নিত্যি-নতুন যাত্রা, পাঁচালী, কেত্তন, খ্যামটা, বাই-নাচ লেগেই থাকত। দশটা গ্রামের লোক হুমড়ি খেয়ে পড়ত এই বাড়িতে। এই তিন-মহলা বাড়ির সঙ্গে পুকুরই ছিল পাঁচটা। বাইরে তিনটে আর অন্দরে দুটো। আত্মীয়-স্বজন অতিথি‚ ফকির কারো কামাই ছিল না! তুফান এই বাড়িতে ঢুকেছিল চৌদ্দ বছর বয়েসে লাঠিয়াল হিসেবে, আজও সে চক্কোত্তি-বাড়ির মায়া কাটাতে পারেনি। গোরুর গাড়ী চালায়। ধানী জমি থেকে ধান বয়ে নিয়ে আসে। পুকুরগুলোর মাছ বিক্রির ব্যবস্থা করে।
—এই ভাবে দিন চলে যাচ্ছে একরকম করে। অভিরামের মাকে সে কোলেকাঁখে করে মানুষ করেছে। তারও তিনকুলে কেউ নেই, ছোটবাবুরও কোনো ছেলেপিলে হল না! তাই কেউ কাউকে ছাড়তে পারে না। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই ভাবেই বোধ করি চলবে।
ভদ্রলোক খানিকটা আগেই নেমে গিয়েছিলেন। সারাটা পথ তিনি বিশেষ কোনো কথাই বলেননি। আর অভিরাম চোখ দুটি বড়ো বড়ো করে কেবলি তুফানের কথা গিলেছে আর ক্রমাগত হুঁ–হাঁ করে গেছে।
অবশেষে গাড়ী এসে ঢুকল চক্কোত্তি-বাড়ির বাইরের মহলের প্রাঙ্গণে। চারদিকে যে-নক্সা-কাটা লোহার রেলিং ছিল, ভেঙে খসে পড়েছে। বিরাট বাড়িটা যেন রূপকথার গল্পের নিঝুম পুরী। তিন মহল বাড়ির একেবারে শেষ প্রান্তে মামা-মামি থাকেন। গোটা কয়েক উঠোন আর ভাঙা দরজা পেরিয়ে সেখানে পৌঁছুতে হয় ওরা ঢুকবার সঙ্গে সঙ্গে কতকগুলো বাদুড় ডানা ঝটপট করে উড়ে গেল। চামচিকের দল ভাঙা কার্নিশের পাশে পাখা ঝাপটাতে লাগল।
তুফানের পেছন পেছন অভিরাম চোখ-ভরা কৌতূহল আর মন-ভরা স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলে। এই তার মামাবাড়ি! একদিন এখানে হাজার হাজার ঝাড়লণ্ঠন জুলে উঠত। যাত্রা-গানে, পাঁচালীর পদে, কীর্তনের করতলে মুখরিত হয়ে উঠত। আজ শুধুই যেন ধ্বংসস্তূপ!
ছোটমামা আর ছোটমামি তার অপেক্ষায় লণ্ঠন জ্বালিয়ে বসেছিলেন। নইলে এ বাড়িতে সন্ধ্যের পর কেউ নাকি জেগে থাকে না‚ বেলাবেলি খাওয়া-দাওয়ার পালা ঢুকিয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ে। ভোর হবার আগে কেউ ওঠে না।
মামা-মামির দিকে তাকিয়ে প্রায় চমকে উঠল অভিরাম। মানুষের এমন চেহারা হয়! বাড়ির মতো ওঁরাও যেন কোনো নিঝুম পুরীর প্রাণী! এইমাত্র যেন দু-জনের দেহে প্রাণ ফিরে এসেছে। সাদা ফ্যাকাসে দেহে রক্ত আছে মনে হয় না। এমন দেহ কফিন বা মড়ার খাটেই দেখা যায়। অভিরাম এই প্রথম মামাবাড়ি এল‚ অথচ তেমন উচ্ছ্বাস নেই কারো ভিতর। কথা বলতেও যেন কষ্ট। কথার চাইতে চোখের ইশারাতেই ওনারা কাজ সারছিলেন বেশি।
অভিরামও খুব ক্লান্ত তখন। বেশী কথা বলবার ইচ্ছে তারও ছিল না। কিছু খেয়ে শুয়ে পড়তে পারলেই বাঁচে।
হাতমুখ ধুয়ে আসতেই ছোটমামি নিঃশব্দে খাবারের জন্য আসন পেতে দিলেন। প্রচুর খাবারের আয়োজন। খেতের ধানের সরু চালের ভাত, পুকুরের মাছ, মাছের মুড়ো, ছানার ডালনা, গোয়ালের গোরুর দুধের সুন্দর পায়েস, ঘরে পাতা দৈ-সন্দেশ‚ সব মামিমার নিজের হাতের তৈরি। খেতে খেতে অভিরাম ভাবতে লাগল, এমন সব টাটকা খাবার খেয়েও মামা-মামির চেহারা রক্তশূন্য কেন? এই বাড়িটায় গল্পে পড়া রক্তচোষা বাদুড় আছে নাকি? দেহের সব রক্ত শুষে নেয়?
নিঝুম থমথমে বিরাট তে-মহলা বাড়ি। মামা-মামি যদি কিছু না বলেন, তবে তুফানের কাছ থেকেই এই বাড়ির সব গল্প ফের শুনতে হবে।
খাওয়া হতে ছোটমামা মামিকে বলেন, আমাদের ঘরেই অভিরামের বিছানা করে দাও। অনেক রাত হয়ে গেছে।
অভিরাম মাথা নেড়ে আপত্তি জানিয়ে বলল, না-না, এক ঘরে তিনজনে থাকবার কি দরকার? ওই ত দোতলার ঘরগুলি খালি পড়ে আছে। তারই একটাতে আমি বিছানা পেতে নেব। খোলা হাওয়া না হলে আমার আবার ঘুম আসে না।
ছোটমামা আর ছোটমামি এমন ভাবে পরস্পরের মুখের দিকে তাকালেন যেন, এই রকম অদ্ভুত কথা তারা কখনো শোনেননি।
ছোটমামা আবার মৃদু আপত্তি তুললেন‚ ওপরে একা একা থাকবার দরকার কি? আমাদের সঙ্গে এক ঘরে শুলেই তো হয়।
কিন্তু অভিরাম কোনো কথাই শুনল না। খিদের মুখে প্রচুর খাওয়া হয়ে গেছে। এখন খোলা হাওয়ায় হাত-পা ছড়িয়ে গা গড়িয়ে দিতে পারলে বাঁচে।
মামা-মামির আপত্তি বিশেষ কানে না তুলে দোতলার একটা দক্ষিণ-খোলা ঘরে শোওয়ার ব্যবস্থা করে নিল অভিরাম। নিচে থেকে এক একবার দমকা হাওয়ায় রজনীগন্ধার মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছিল। জানলার তলাতেই বোধ হয় ফুলের বাগান। অন্ধকারে কিছু চোখে পড়ে না, শুধু মাথার ওপরকার আকাশে অসংখ্য তারা ঝিকিমিকি করতে থাকে।
কালপুরুষ একদিকে ঢলে পড়েছে। রাত্রি গভীর। রজনীগন্ধার গন্ধমাখা মিষ্টি হাওয়া মায়ের ঘুমপাড়ানি গানের মতো অতি সহজেই অভিরামকে ঘুম পাড়িয়ে দিল।
অনেক রাতে ঘুমের ভেতর একটা মৃদু অথচ স্পষ্ট গানের কলি শুনে অভিরামের তন্দ্রা, কেটে গেল। ঘুম ভাঙলেও চট করে সে তাকাতে পারল না।
তার পাশের ঘরের থেকেই গানটা ভেসে আসছে। হঠাৎ চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল, তার ঘর আর পাশের ঘরের মধ্যে যে বড় দরজাটা বন্ধ ছিল, সেটা একেবারে খোলা। তারই ভেতর দিয়ে মৃদু আলোকে চোখে পড়ছে, এক মহিলা গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে সোনার কাজ করা দামি চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াচ্ছেন। মহিলার সার গায়ে জড়োয়ার ভারি গয়না। নাকে ঝকমক করছে শিকলি টানা মস্ত মতিদার নথ। গা ভরতি এত গয়না পরা মহিলা অভিরাম আগে দেখেনি।
এ বাড়িতে ছোটমামা আর মামি ছাড়া কেউ থাকে না‚ এই কথাই সে জানত। হয়ত ছোটমামির কোনো আত্মীয় এসেছেন হালে। তাহলে তো ওপরে এসে শোয়া ঠিক হয়নি। বিছানা থেকে উঠে নীচের ঘরে যাবে কিনা ভাবছে‚ হঠাৎ খেয়াল হল শোবার সময় তো ঘরে আলো নিবিয়ে শুয়েছিল। ফের কে জ্বালল!
চারপাশে চোখ ফেরাল অভিরাম। কোথাও লণ্ঠন বা অন্য কিছু দেখতে পেল না। তাহলে ঘরে আলোর উৎস কোথায়? অবাক হয়ে যখন ভাবছে‚ হঠাৎ উঁচু থেকে একটা বেলোয়াড়ি ঝাড়লণ্ঠন সশব্দে ভেঙে পড়লে যেমন শব্দ হয়, সেই জাতীয় একটা আওয়াজে চমকে উঠে পাশের ঘরের দিকে তাকাতেই অভিরাম শিউরে উঠল।
সেই মহিলাটি হঠাৎ ফিরে তাকিয়েছেন। দেখতে এত সুন্দরী‚ কিন্তু মাথা থেকে শুরু করে চোখের ভ্রু পৰ্যন্ত কে যেন দায়ের কোপে কেটে ফেলেছে‚ ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ছে। ও তাকাতে মহিলাটি খিল খিল করে হেসে উঠলেন।
সেই হাসি শুনে অভিরামের মনে হল বরফের মতো ঠাণ্ডা জলে সে যেন তলিয়ে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস নেবার ক্ষমতা পৰ্যন্ত নেই।
যখন জ্ঞান হল, তাকিয়ে দেখল ঘর আগের মতোই আবার অন্ধকার। সেই অন্ধকারের ভিতর কাছেই ফিস্ ফিস্ কথাবার্তার শব্দ। কারা যেন বিছানার কাছে হেঁটে বেড়াচ্ছে। অনেক লোক। অন্ধকারে চেষ্টা করেও কাউকে দেখতে পেল না।
বেজায় ঘাবড়ে গিয়ে অভিরাম বিছানা থেকে উঠে ছুটে পালাতে যাবে‚ টের পেল তার সারা শরীর যেন বিছানার সঙ্গে আটকে গেছে। নড়বার ক্ষমতা নেই! ঘাড় ও পিঠের পাশ দিয়ে কুলকুল করে ঘাম ছুটছে‚ কিন্তু পাশ ফেরবার কিম্বা মুছে নেবার ক্ষমতাটুকুও লোপ পেয়েছে!
থম হয়ে পড়ে আছে। হঠাৎ পাশের ঘরের দিকে চোখ পড়তে দেখল ফের সেই মৃদু আলো!
কয়েকজন ভদ্রলোক ঘরের মেঝেতে খেতে বসেছেন। দেখে মনে হয় খুব বড়লোক। হাতে ঝকমক করছে দামি আংটি। গলায় সোনার চেন‚ কোঁকড়া চুল, গৌর বর্ণ। পরনে দামি ধুতি-শার্ট। নানা রকম খাদ্যের আয়োজন করা হয়েছে। থালার পাশে সারি সারি বাটি। অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল অভিরাম। হঠাৎ নজরে পড়ল মানুষগুলির পেছনে তরোয়াল আর লাঠি হাতে দুশমন চেহারার কতকগুলি ষণ্ডামতো লোক উঁকিঝুঁকি মারছে। তারপর মুহূর্তেই বুক-ফাটা চীৎকার‚ বাঁচাও বাঁচাও‚ খুন! খুন!
অভিরামের ওঠবার ক্ষমতা নেই। তবু দুই চোখ বিস্ফারিত করে দেখল, যমদূতের মতো ষণ্ডা লোকগুলি খেতে বসা মানুষগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। দেখতে দেখতে লাল রক্তে থালার ভাত রাঙা হয়ে গেল। সোনার গয়নাগুলি কাড়াকাড়ি করে তারা ছিনিয়ে নিতে লাগল।
বুক-ফাটা চীৎকার আর শয়তানের অট্টহাসি সেই তে-মহলা বাড়ির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে বৃথাই ছুটে বেড়তে লাগল। তারই ভিতর কোথাও একটা বেড়াল ম্যাও ম্যাও করে বিকট শব্দে ডাকতে লাগল
অভিরামের কিছু আর মনে নেই তারপর। সূচিভেদ্য অন্ধকারের মধ্যে তলিয়ে গেল আবার!
কার যেন একটা গরম দীর্ঘনিঃশ্বাস কানের পাশ দিয়ে ঘাড়ে এসে লাগতে ফের সাড় ফিরে এল অভিরামের।
গতকাল অনেকটা পথ ট্রেনে। তার ওপর ছোটমামির আদরে খাওয়া হয়েছে প্রচুর। অভিরামের মনে হল‚ সবটাই হয়তো নিছক স্বপ্ন। কাল মামিকে বলতে হবে, রাত্রে এত খাওয়ার আয়োজন করলে চলবে না। অন্ধকারে বালিশটা আঁকড়ে আবার পাশ ফিরে শুতে যাবে অভিরামের মনে হল এক ঝাঁক চামচিকে উড়ে বেড়াচ্ছে ঘরের ভিতর। অন্ধকারে সেই শব্দ। ঘরের কোণে, আলমারি কাচে, বড় বড় ছবির আশেপাশে কেবলি ডানা ঝাপটে ত্রস্তে উড়ে বেড়াচ্ছে। অশুভ কিছু ইঙ্গিত পেয়েছে যেন!
জানালার পাশেই কি-গাছের একটা মরা ডাল হাওয়ায় দুলে উঠল ওই সময়। একটা কাল পেঁচা এমন বিকট স্বরে চীৎকার করে উঠল যে, অভিরামের অন্তরাত্মা পর্যন্ত কেঁপে গেল।
এই জন্যই কি মামা–মামি উপরের ঘরে শুতে মানা করেছিল? উঠে যে নিচে ছোটমামার ঘরে চলে যাবে সেই উপায়ও নেই এখন! কে যেন তার দেহে স্ক্রু এঁটে দিয়েছে। নড়বার শক্তি নেই। এই জন্যেই কি তার মামা-মামি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে পারে না? কোনো কায়াহীন কি তাদের দেহের রক্ত শুষে নিচ্ছে রোজ রাত্তিরে?
ভাবতে গিয়ে এই অবস্থার ভিতরেও হেসে ফেলল। আজকের যুগের ছেলে সে। এসব আজগুবি ভুতুড়ে ব্যাপার সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারবে না। সকালবেলা স্নান সেরে ভালো করে মাথা ঠাণ্ডা করতে হবে।
আবার পাশ ফিরে শোয় অভিরাম।
কিন্তু আবার ঘাড়ের উপর সেই গরম নিঃশ্বাস। মনের ভুল অবশ্যই। তবু চোখ মেলে তাকিয়েছিল অভিরাম। মুহূর্তে কেঁপে উঠল শরীর।
আপাদমস্তক সাদা থান-পরা এক মহিলা তার শিয়রে স্থির হয়ে বসে আছে। একটু আগেও তো ছিল না! অভিরাম বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে আছে‚ মহিলা নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালেন। হাতছানি দিয়ে ডাকলেন ওকে।
দারুণ বিস্ময়ে অভিরাম দের পেল‚ খানিকক্ষণ আগেও তার যে দেহ পাথরের মতো অসাড় হয়ে পড়েছিল, অজান্তেই কখন উঠে বসেছে।
অন্ধকারে আবার সেই হাতছানি অস্পষ্টভাবে ফুটে উঠল।
অভিরাম উঠে দাঁড়াল এবার। হাতছানি উপেক্ষা করার ক্ষমতা নেই তার।
দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে লাগল। থান–পরা ওই মহিলা কে? এখানে কখন এল‚ একবারও মনে হল না। কী এক দুর্নিবার আকর্ষণে সে সিঁড়ি দিয়ে নেমে একের পর এক ভাঙা দরজা পার হয়ে মহলের পর মহল পেছনে ফেলে একেবারে ডানদিকের বাগানে এসে উপস্থিত হল। খানিক দূরে সাদা থান-পরা মহিলা ফের হাতছানি দিয়ে ডাকল ওকে। এগিয়ে আসতে বলল। বাগানের প্রান্তে জীর্ণ এক কুয়ো। কাছে গিয়ে সেই মহিলা হঠাৎ লাফিয়ে পড়ল সেই কুয়োর ভিতর। পিছনে অভিরাম মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগোতে লাগল।
কুয়োর মুখের অনেকটা একটা আশস্যাওড়া গাছের ঝাঁকড়া ডালপালায় ঢাকা। অমোঘ হাতছানির টানে অভিরামও হাজির হল সেই কুয়োর কাছে।
কুয়োর মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে তাকেও। মনে হচ্ছে, ওই কুয়োয় ডুব দিলে তার দেহ শীতল হবে। অস্ফুট কণ্ঠে সে বলল, আসছি‚ আসছি আমি…
ভাঙা কুয়োর পাড়ে এসে দাঁড়িয়েছে অভিরাম। এত অন্ধকার, তবু কুয়োর ভেতর থেকে সেই হাতছানি চোখে পড়ছে!
লাফিয়ে পড়তে যাবে, এমন সময় দূর থেকে চীৎকার শোনা গেল‚ খোকাবাবু, পালাও—পালাও…
তুফান ডাকছে তার কুঁড়েঘরের দাওয়া থেকে। তিন-মহলা দালানে সে শোয় না। বাইরে কুঁড়ে তৈরি করে থাকে।
নিচে সেই শীতল হাতছানি‚ আর দূর থেকে তুফানের চীৎকার! হঠাৎ যেন ঘুম থেকে জেগে উঠল অভিরাম!!
তাইত! এ কি করতে যাচ্ছিল সে! পোড়ো অতল কুয়োর মধ্যে সে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল!
তখনও তুফানের চীৎকার ভেসে আসছে‚ খোকাবাবু, পালাও—পালাও…
আর এক মুহূর্ত সেখানে না দাঁড়িয়ে অভিরাম তার মামাবাড়ি ছেড়ে পাগলের মতো রাস্তা দিয়ে ছুটতে লাগল। পেছনে একটা অট্টহাসি তাকে কেবলি ব্যঙ্গ করে অনুসরণ করতে লাগল যেন!
হাঃ—হাঃ–হাঃ…
কতক্ষণ ছুটেছে একেবারেই খেয়াল নেই। হঠাৎ একটা লোকের গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়তে চমকে উঠল। আরে! এ তো গতকালের সেই ট্রেন-যাত্রী ভদ্রলোক!
উনি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, একি অভিরামবাবু, সক্কালবেলা মামাবাড়ি ছেড়ে পাগলের মতো কোথায় ছুটেছ?
অভিরাম তার প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না। শুধু তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
ভদ্রলোক তার হাত ধরে বললেন, তোমার রাতের ঘোর কাটেনি এখনো। চলো আমার সঙ্গে। সকালের ট্রেন ধরতে আমিও স্টেশনের দিকেই যাচ্ছি।
অভিরামের সাড় কিছুটা যেন ফিরে এসেছে তখন। বলল‚ হ্যাঁ‚ আমিও ফিরে যাব। আমায় নিয়ে চলুন।
ভদ্রলোক চলতে চলতে বললেন, তোমার ভাগ্য ভালো, তাই ওই তে-মহলা বাড়ির গ্রাস থেকে ফিরে এসেছ!
অভিরাম অবাক হয়ে ভদ্রলোকের মুখের দিকে শুধু তাকিয়ে রইল শুধু।
দেখে ভদ্রলোক বললেন, আচ্ছা শোনে তাহলে। তোমার দাদামশায়ের বাবা একজন নামকরা জমিদার ছিলেন। নামকরা জমিদার মানেই দুর্দান্ত ডাকাত। সেকালে ডাকাতি করেই ওনারা বিস্তর জমিদারী ভোগ করতেন।
একবার তোমার দাদামশায়ের বাবা ঝড়-জলের রাত্তিরে এক ধনী পরিবারকে আশ্রয় দেন। তাঁরা পুজোর ছুটিতে নিজেদের দেশে যাচ্ছিলেন। খুব ধুমধাম করে পুজো করবেন বলে সঙ্গে নিয়েছিলেন বহু টাকা, মেয়ে–বউদের গা ভরতি গয়না।
চকোত্তিদের বিরাট জমিদার বাড়ির দোতলায় তাদের থাকবার ব্যবস্থা হল। খাওয়া-দাওয়ার প্রচুর আয়োজন করা হল। কিন্তু যখন তারা খেতে বসলেন, জমিদারের ঠগির দল সবাইকে আক্রমণ করে পশুর মতো হত্যা করল। চক্কোত্তির ঠগিরা তাদের টাকা আর গয়নাগাটি ছিনিয়ে নিয়ে মৃত দেহগুলি রাতারাতি বাগানে পুঁতে ফেলল। এমন আগেও হয়েছে অনেক। লুঠের টাকাতেই তো তাঁদের রমরমা। কিন্তু ব্যতিক্রম হয়ে গেল সেবার।
মা দুর্গার পুজো করতে গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিলেন সেই রাতের অতিথি পরিবার। মা দূর্গার অভিশাপ লেগেছিল হয়তো। সেই থেকে অন্ধকার রাত্তিরে নিশির ডাকে বিছানা ছেড়ে উঠে চক্কোত্তি-বাড়ির কত মানুষ যে বাগানের কুয়োতে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ হারিয়েছে, তার আর লেখাজোখা নেই। আজ সেই তিন-মহলা বাড়ি শ্মশান হয়ে গেছে। তোমার ছোটমামা চক্কোত্তি-বাড়ির শেষ বংশধর। কোনো ছেলেপুলে হয়নি।
অভিরাম রুদ্ধ নিঃশ্বাসে এই গল্প শুনছিল। ভদ্রলোক থামতে বলল‚ উপরতলায় এমন বিপদ‚ অথচ মামা–মামি কেউই সেকথা খুলে বললেন না কেন?
ভদ্রলোক বললেন‚ ওই ভয়ানক ভুতুড়ে বাড়িতে বাস করে ওনারাও সম্ভবত সেই অর্থে তেমন সুস্থ নেই। রাত নামলে কেউ কথাও বলেন না। বেরও হন না। ওই ভূতের বাড়ি আগলে পড়ে থাকেন। যাবতীয় কাজের জন্য তুফান রয়েছে। সে কিন্তু রাতে ওই বাড়ির ভিতরে যায় না। বাইরে ছোট এক কাঁচা ঘর আছে। সেখানেই থাকে।
থামলেন ভদ্রলোক। ইতিমধ্যে স্টেশনের পথে অনেক দূর চলে এসেছে ওরা। পূব আকাশে দিগন্তের কাছে সূর্য সবে উঁকি দিচ্ছে। রাতের অন্ধকার বিদায় নিয়েছে।
ভদ্রলোকের সঙ্গে পথ চলতে চলতে অভিরাম ফেলে আসা পথের দিকে একবার তাকাল। এই শেষ। মামাবাড়িতে সে আর আসবে না কখনো।
Post a Comment