বোকা সাথী – জসীম উদ্দীন
এক ছিল নাপিত। তার সঙ্গে এক জোলার ছিল খুবই ভাব। নাপিত লোকের চুল-দাঁড়ি কামিয়ে বেশী পয়সা উপার্জন করতে পারত না। জোলাও কাপড় বুনে বেশী পয়সা লাভ করতে পারে না। দুই জনেরই সংসারে খুব টানাটানি যাচ্ছিল। আর টানাটানি বলে কারও বউই কাউকে দেখতে পারে না। এটা কিনে আন নাই, ওটা কিনে আন নাই, বলে বউরা দিনরাতই শুধু খিটির মিটির করে। কাঁহাতক (কতক্ষণ) আর এই জ্বালা-যন্ত্রণা সহ্য করা যায়।
একদিন জোলা গিয়ে নাপিতকে বলে, “বউ-এর জ্বালায় আর তো বাড়িতে টিকতে পারছি না।”
নাপিত জবাব দিল, “ভাইরে! আমারও সেই একই কথা। দেখোনা আজ পিছার (ঝাড়ুর) বাড়ি দিয়ে আমার পিঠের ছাল আর রাখে নাই।”
জোলা জিজ্ঞাসা করে, “আচ্ছা ভাই, এর কোনো বিহিত করা যায় না?”
নাপিত বলে, “চল ভাই, আমরা দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে যাই। সেখানে বউরা আমাদের খুঁজেও পাবে না; আর জ্বালাতনও করতে পারবে না।”
সত্যি সত্যিই একদিন তারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেল। এদেশ ছাড়িয়ে ওদেশ ছাড়িয়ে যেতে যেতে তারা এক বিজন বন-জঙ্গলের মধ্যে এসে পড়ল। এমন সময় হালুম হালুম করে এক বাঘ এসে তাদের সামনে খাড়া। ভয়ে জোলা তো ঠির ঠির করে কাঁপছে।
নাপিত তাড়াতাড়ি তার ঝুলি থেকে একটি আয়না বের করে বাঘের মুখের সামনে ধরে বলল, “এই বাঘটা তো আগেই ধরেছি। জোলা! তুই দড়ি বের কর। সামনের বাঘটাকেও বেঁধে ফেলি।”
বাঘ আয়নার মধ্যে তার নিজের ছবি দেখে ভাবল, “এরা না জানি কত বড় পালোয়ান। একটা বাঘকে ধরে রেখেছে। আবার আমাকেও বেঁধে রাখতে দড়ি বের করছে।”
এই না ভেবে বাঘ লেজ উঠিয়ে দিল চম্পট। জোলা তখনও ঠির ঠির করে কাঁপছে। বনের মধ্যে আঁধার করে রাত আসল। ধারে-কাছে কোনো ঘর-বাড়ি নাই। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলে বাঘের পেটে যেতে হবে। সামনে ছিল একটা বড় গাছ। দুইজনে যুক্তি করে সেই গাছে উঠে পড়ল।
এদিকে হয়েছে কি?
সেই যে বাঘ ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিল, সে গিয়ে আর সব বাঘদের বলল, “ওমুক গাছের তলায় দুইজন পালোয়ান এসেছে। তারা একটা বাঘকে ধরে রেখেছে। আমাকেও বাঁধতে দড়ি বের করছিল। এই অবসরে
আমি পালিয়ে এসেছি। তোমরা কেউ ওই পথ দিয়ে যেও না।”
বাঘের মধ্যে যে মোড়ল- সেই জাদরেল বাঘটি বলল, “কিসের পালোয়ান? মানুষ কি বাঘের সাথে পারে? চল, সকলে মিলে দেখে আসি।”
জঙ্গী বাঘ-সিঙ্গি বাঘ-মামদু বাঘ-খুঁতখুঁতে বাঘ-কুতকুতে বাঘ- সকল বাঘ তর্জন-গর্জন করে সেই গাছের তলায় এসে পৌছল। একে তো অন্ধকার রাত, তার উপরে বাঘের হুঙ্কার- অন্ধকারে জোড়া জোড়া বাঘের চোখ জ্বলতেছে। তাই না দেখে জোলা তো ভয়ে ভয়ে কেঁপে অস্থির।
নাপিত যত বলে, “জোলা! একটু সাহসে ভর কর!”
জোলা ততই কাঁপে। তখন নাপিত দড়ি দিয়ে জোলাকে গাছের ডালের সঙ্গে বেঁধে রাখল।
কিন্তু তারা দুইজন গাছের মগডালে আছে বলে বাঘ তাদের নাগাল পাইতেছে না। তখন জাদরেল বাঘ আর সব বাঘদের বলল, “দেখ তোরা একজন আমার পিঠে ওঠ- তার পিঠে আর একজন ওঠ- তার পিঠে আর একজন ওঠ- এমনি করে উপরে উঠে হাতের থাবা দিয়ে এই লোক দু’টিকে নামিয়ে নিয়ে আয়।”
এইভাবে একজনের পিঠে আর একজন তার পিঠে আর একজন করে যেই উপরের বাঘটি জোলাকে ছুঁতে যাবে, অমনি ভয়ে ঠির ঠির করে কাঁপতে কাঁপতে দড়িসহ জোলা তো মাটিতে পড়ে গিয়েছে।
উপরের ডাল হতে নাপিত বলল, “জোলা! তুই দড়ি দিয়ে মাটির উপর হতে জাদরেল বাঘটিকে আগে বাঁধ, আমি উপরের দিক হতে একটা একটা করে সবগুলি বাঘকে বাঁধতেছি।”
এই কথা শুনে নিচের বাঘ ভাবল আমাকেই তো আগে বাঁধতে আসবে। তখন সে লেজ উঁচিয়ে দে দৌড়- তখন এ বাঘের উপরে পড়ে ও বাঘ, সে বাঘের উপরে পড়ে আর এক বাঘ।
নাপিত উপর হতে বলে, “জোলা মজবুত করে বাঁধ- মজবুত করে বাঁধ। একটা বাঘও যেন পালাতে না পারে।” সব বাঘই ততক্ষণে পালিয়ে সাফ।
বাকী রাতটুকু কোনোরকমে কাঁটিয়ে পরদিন সকাল হলে জোলা আর নাপিত বন ছাড়িয়ে আর এক রাজার রাজ্যে এসে উপস্থিত হল।
রাজা রাজসভায় বসে আছেন। এমন সময় নাপিত জোলাকে সঙ্গে নিয়ে রাজার সামনে গিয়ে হাজির।
“সালাম, মহারাজ!”
রাজা বললেন, “কি চাও তোমরা?”
নাপিত বলল, “আমরা দুইজনই বীর পালোয়ান। আপনার এখানে চাকরি চাই।”
রাজা বললেন, “তোমরা কেমন বীর তা পরখ না করলে তো চাকরি দিতে পারি না? আমার রাজবাড়িতে আছে দশজন কুস্তিগীর, তাদের যদি কুস্তিতে হারাতে পার তবেই চাকরি মিলবে।”
নাপিত বলল, “মহারাজের আশীর্বাদে নিশ্চয়ই তাদের হারিয়ে দিব।”
তখন রাজা কুস্তি পরখের একটি দিন স্থির করে দিলেন। নাপিত বলল, “মহারাজ! কুস্তি দেখার জন্য তো কত লোক জমা হবে। মাঠের মধ্যে একখানা ঘর তৈরি করে দেন। যদি বৃষ্টি-বাদল হয়, লোকজন সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিবে।”
রাজার আদেশে মাঠের মধ্যে প্রকাণ্ড খড়ের ঘর তৈরি হল। রাত্রে নাপিত চুপি চুপি গিয়ে তার ক্ষুর দিয়ে ঘরের সমস্ত বাঁধন কেটে দিল। প্রকান্ড খড়ের ঘর কোনোরকমে থামের উপরে দাঁড়িয়ে রইল।
পরদিন কুস্তি দেখতে হাজার হাজার লোক জমা হয়েছে। রাজা এসেছেন-রাণী এসেছেন-মন্ত্রী, কোটাল, পাত্রমিত্র কেউই বাদ নাই।
মাঠের মধ্যখানে রাজবাড়ির বড় বড় কুস্তিগীরেরা গায়ে মাটি মাখিয়ে লড়াইয়ের সমস্ত কায়দাগুলি ইস্তেমাল করছে।
এমন সময় কুস্তিগীরের পোশাক পরে নাপিত আর জোলা মাঠের মধ্যখানে উপস্থিত। চারিদিকের লোকে তাদের দেখে হাততালি দিয়ে উঠল।
নাপিত তখন জোলাকে সঙ্গে করে লাফিয়ে একবার এদিকে যায় আবার ওদিকে যায়। আর ঘরের এক একখানা চালা ধরে টান দেয়। হুমড়ি খেয়ে ঘর পড়ে যায়। সভার সব লোক অবাক।
রাজবাড়ির কুস্তিগীরেরা ভাবে, “হায় হায়, না জানি এরা কত বড় পালোয়ান। হাতের একটা ঝাকুনি দিয়ে এত বড় আটচালা ঘরখানা ভেঙ্গে ফেলল। ইহাদের সঙ্গে লড়তে গেলে ঘরেরই মতো তারা আমাদের হাত-পাগুলোও ভেঙ্গে ফেলবে। চল আমরা পালিয়ে যাই।”
তারা পালিয়ে গেলে নাপিত তখন মাঠের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে বুক ফুলিয়ে রাজাকে বলল, “মহারাজ! জলদি করে আপনার পালোয়ানদের ডাকুন। দেখি! তাদের কার গায়ে কত জোর।”
কিন্তু কে কার সঙ্গে কুস্তি লড়ে? তারা তো আগেই পালিয়েছে। রাজা তখন নাপিত আর জোলাকে তাঁর রাজ্যের সেনাপতির পদে নিযুক্ত করলেন।
সেনাপতির চাকরি পেয়ে জোলা আর নাপিত তো বেশ সুখেই আছে। এর মধ্যে কোথা হতে এক বাঘ এসে রাজ্যে মহা উৎপাত লাগিয়েছে। কাল এর ছাগল নিয়ে যায়, পরশু ওর গরু নিয়ে যায়, তারপর মানুষও নিয়ে যেতে লাগল। রাজা তখন নাপিত অর জোলাকে বললেন, “তোমরা যদি এই বাঘ মারতে পার তবে আমার দুই মেয়ের সঙ্গে তোমাদের দুইজনের বিবাহ দিব।”
নাপিত বলল, “এ আর এমন কঠিন কাজ কি? তবে আমাকে পাঁচ মণ ওজনের একটি বড়শি আর গোটা আষ্টেক পাঠা দিতে হবে।”
রাজার আদেশে তখন পাঁচ মণ ওজনের একটি লোহার বড়শি তৈরি হল। নাপিত তখন লোকজনের নিকট হতে জেনে নিল, কোথায় বাঘের উপদ্রব বেশি, আর কোন সময় বাঘ আসে।
তারপর নাপিত সেই বড়শির সঙ্গে সাত আটটা পাঁঠা গেঁথে এক গাছি লোহার শিকলে সেই বড়শি আটকে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখল। তারপর জোলাকে সঙ্গে নিয়ে গাছের মগ ডালে উঠে বসে রইল।
অনেক রাত্রে বাঘ এসে সেই বড়শিসমেত পাঁঠা গিলতে গিয়ে বড়শিতে আটকে গিয়ে তর্জন গর্জন করতে লাগল। সকাল হলে লোক ডেকে নাপিত আর জোলা লাঠির আঘাতে বাঘটিকে মেরে ফেলল।
রাজা ভারি খুশী। তারপর নাপিত আর জোলার সঙ্গে তাঁর দুই মেয়ের বিবাহ দিয়ে দিল। বিবাহের পরে বউ নিয়ে বাসর ঘরে যেতে হয়। জোলা একা বাসর ঘরে যেতে ভয় পায়। নাপিতকে সঙ্গে যেতে অনুরোধ করে।
নাপিত বলে, “বেটা জোলা! তোর বাসর ঘরে আমি যাব কেমন করে? আমাকেও তো আমার বউ-এর সঙ্গে ভিন্ন বাসর ঘরে যেতে হবে। তুই কোনো ভয় করিস না। খুব সাহসের সঙ্গে থাকবি।”
এই বলে জোলাকে বাসর ঘরের মধ্যে ঠেলে দিল।
বাসর ঘরে গিয়ে জোলা এদিকে চায়- ওদিকে চায়। আহা-হা কত ঝাড়-কত লণ্ঠন ঝিকিমিকি জ্বলতেছে। আর বিছানা ভরে কত রঙের ফুল। জোলা কোথায় বসিবে তাই ঠিক করতে পারে না। তখন অতি শরমে (লজ্জিতভাবে) পাপোশখানার উপর কুচিমুচি হয়ে (জড়সড় হয়ে) বসে জোলা ঘামতে লাগল।
কিছুক্ষণ বাদে হাতে পানের বাটা নিয়ে, পায়ে সোনার নুপুর ঝুমুর ঝুমুর বাজিয়ে পঞ্চসখী সঙ্গে করে রাজকন্যা এসে উপস্থিত। জোলা তখন ভয়ে জড়সড়। সে মনে করল, পৌরাণিক কালের কোন প্রাণী যেন তাঁকে কাটতে এসেছে। সে তখন তাড়াতাড়ি উঠে রাজকন্যার পায়ে পড়ে বলল, “আম্মাজান। আমার কোনো অপরাধ নাই। সকলই ঐ নাপিত বেটার কারসাজি।”
রাজকন্যা সবই বুঝতে পারল। কথা রাজার কানেও গেল। রাজা তখন জোলা আর নাপিতকে তাড়িয়ে দিলেন। নাপিত রেগে বলে, “বোকা জোলা। তোমার বোকামীর জন্য অমন চাকরিটা তো গেলই- সেই সঙ্গে রাজকন্যাও গেল।”
জোলা নাপিতকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তা গেল-গেল! চল ভাই, দেশে গিয়ে বউদের লাথিগুতা খাই। সে তো গাঁ-সওয়া হয়ে গেছে। এমন সন্দেহ আর ভয়ের মধ্যে থাকার চেয়ে সেই ভালো।”
Post a Comment