সোনার শিকল – আশাপূর্ণা দেবী


এক দেশের এক রাজপুত্র। বেজায় তার শিকারের শখ, শিকার পেলে তিনি আর কিছু চান না। একদিন শিকার করতে গিয়ে এক হরিণের পিছু ছুটতে ছুটতে তিনি ফেললেন বনের মধ্যে পথ হারিয়ে, সঙ্গী সাথী কে যে কোনখানে রইলো তার আর সন্ধান নেই। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে; কি করেন, শিকার করা হরিণটাকে একটা গাছতলায় ফেলে রেখে, ঘোড়াটাকে একটা গাছের গুড়ির সঙ্গে বেঁধে, রাজপুত্র এদিক ওদিক ঘুরতে লাগলেন। হঠাৎ কানে এলো, একটি মিষ্টি বাশির সুর, যেন সে সুরে গাছের পাতা, নদীর পানি সব শিউরে শিউরে উঠছে! সুর ক্রমেই নিকট হয়ে এলো। বনের পথ বেয়ে একটি ছেলে আসছে রাখালের বেশে, মাথায় পাখির পালক, গলায় বনফুলের মালা, হাতে বাশি। রাজপুত্রকে দেখেই সে বাঁশি থামিয়ে থমকে দাড়ালো।

রাজপুত্র বললেন, বাহ! বেশতো তুমি বাজাও! এই বনের মধ্যেই তুমি থাকো নাকি ?
ছেলেটি হাত তুলে বললো, ওই যে বাঁশ-ঝাড়টার ওপারে আমাদের ঘর। তুমি বুঝি পথ হারিয়েছো?
রাজপুত্র বললেন, হ্যা, পথ হারিয়েছি, সঙ্গীদেরও হারিয়েছি।
-ভারি মুস্কিল তো!

ছেলেটি হেসে বললো, আজ বুঝি কেবল হারাবারই পালা। আমিও পোষা হরিণটিকে হারিয়ে ফেলে খুজে বেড়াচ্ছি। আমার বাঁশি শুনলেই সে ঠিক আসবে। রাজপুত্রের প্রাণটা কেঁপে উঠলো। তার মারা হরিণটা নয় তো?

রাজার ছেলের গর্ব এই রাখাল ছেলেটির সামনে কেমন যেন নুয়ে পড়লো; তিনি ভয়ে ভয়ে একবার যেই গাছতলার দিকে তাকালেন; সঙ্গে সঙ্গে রাখাল-ছেলের দৃষ্টিও সেইদিকে পড়লো। তখন চাদ উঠেছে, গাছের পাতার ফাকে ফাকে জ্যোৎস্নার টুকরো এসে মৃত হরিণের রক্ত মাখা দেহে ছড়িয়ে পড়ে কি যেন একটা ভয়ঙ্কর ভাব জাগিয়ে তুলছিলো, দু’জনের বুকই শিউরে উঠলো। কিন্তু পরক্ষণেই ছুটে গিয়ে মরা হরিণের গায়ে আছড়ে পড়ে রাখাল ছেলেটির সে কি কান্না! সে কান্না শুনে বনের পশুপাখি, গাছপালা, নদীর জল, আকাশের চাদও যেন নিথর হয়ে রইলো। রাজপুত্র কেঁদে ফেললেন। পশুর রক্তে চিরদিন যার অন্তরে আনন্দেরই সৃষ্টি করেছে, আজ সেই হৃদয় রাখাল-ছেলের কাতর কান্নায় গলে গেলো। তিনি তার হাত ধরে অনেক করে ক্ষমা চাইলেন। রাখাল-ছেলে তার অনুতাপ দেখে ক্ষমা না করে থাকতে পারলো না। তখন দু’জনে সেই খোলা আকাশের তলায়, মুক্ত উদার প্রান্তরে চাদকে সাক্ষী মেনে, হাতে হাত রেখে বন্ধুত্ব পাতালেন। রাখাল-ছেলে মরা হরিণটি সস্নেহে বুকে তুলে নিয়ে আগে আগে চললো, রাজার ছেলেও ঘোড়া খুলে নিয়ে তার পিছন পিছন চলতে লাগলেন।

ছোট্ট একখানি কুঁড়েঘর কৃষকের বাড়ি। কিন্তু রাজার ছেলে সেই কুঁড়েখানি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। ছাদের আলোয় তকতকে ঝকঝকে বাড়িটি যেন হাসছে। ঝরঝরে মেটে উঠানটাতে গোটাকতকন ফুলগাছ একেবারে ফুলের ভারে নুয়ে পড়েছে। রাজার ছেলের মনে হলো, তাদের রাজপুরীর বিশাল বাগানের সৌন্দর্য এর কাছে কতো তুচ্ছ। রাখালের মা- মা আর ছেলে—আর কেউ নেই। রাখাল ছেলেটির মায়ের প্রাণভরা কতো স্নেহ ও মমতা! রাজপুত্রের নিজের মায়ের কথা মনে পড়লো। সেই একশো দাসী তার মাকে যেন ঘিরে থাকে, তাদের দেখেই ভয় হয়। আর এই নেহাৎ সাদাসিধে মাকে যেন সত্যি আপন বলে মনে হয়!

তিনি খাবার খেতে দু’জনকেই এমন আদর করে কাছে ডাকলেন যেন দুজনেই তার ছেলে। গরিবের ঘরের খাবার আয়োজন নিতান্তই সামান্য কিন্তু রাজার ছেলের মুখে লাগলো যেন অমৃত। রাতদিন দাসী চাকরের খবরদারিতে যার জীবন কেটেছে, তার কাছে আজ এই সত্যিকারের মায়ের হাতের স্নেহটুকু যেন তার মনে বেহেশতের তৃপ্তি ঢেলে দিলো। মেটে ঘরের মেঝেতে জীর্ণ শয্যায় শুয়ে যে আরাম তিনি পেলেন সোনার খাটে মখমলের শয্যায় শুয়েও তিনি জীবনে কখনো সে আরাম পান নি।

পূর্বের অভ্যাসমতো সকালবেলা রাজকুমারের যখন ঘুম ভাঙলো, তখন রাজার ছেলে রাখাল-ছেলের মার কাছ থেকে বনের ফলমূল আর কপিলা গাইয়ের মিষ্টি ঘন দুধ তৃপ্তির সঙ্গে খেয়ে, নিজের সঙ্গী সাথীদের খোজার চেষ্টায় বেরোলেন; রাখাল-ছেলে ততোক্ষণে বনফুলের মালা পরে মাথায় পাখির পালক গুজে, বাসন্তী রঙের চাদর উড়িয়ে সেজেগুজে উপস্থিত হলো রাজপুত্রকে এগিয়ে দেবে বলে। বনের সীমানা পার হতেও হলো না, রাজপুত্রের দেশ থেকে একদল লোক হাতি-ঘোড়া-সেপাই-শাস্ত্রী নিয়ে বনের পথে আসতে, দেখা গেলো সকলের শেষে একটি সুন্দর শ্বেত হস্তীকে সুন্দর সাজে সাজিয়ে, তার পিঠের হাওদায় মতির ঝালর ঝুলানো রাজকুমারের সোনার সিংহাসন পেতে, আসছেন বুড়ো মন্ত্রী মশাই। চুলকাচা বুদ্ধিপাকা ধরণের জনকয়েক রাজসভাসদ সঙ্গে এসেছে। দেখেই তো রাজার ছেলের বুক উঠলো কেঁপে—কি ব্যাপার?

খানিক কান্নাকাটির পর বুড়ো মন্ত্রীমশাই জানালেন যে, মহারাজ স্বর্গীয় হয়েছেন হঠাৎ, কাজেই যুবরাজই এখন স্বরং রাজা। বুড়ো মন্ত্রী কাজে ইস্তফা দিয়ে বায়তুল্লায় হজ্জ্বে যাবেন, কাজেই একজন নতুন মন্ত্রী যেন তিনি খুজে নেন। রাজকুমার পড়লেন মহা বিপদে। হঠাৎ মনের মতো কাউকে বাছাই করাও তো সহজ নয়। প্রবীণ সভাসদদের অনেকেই মনে মনে মন্ত্রীপদের আশা পোষণ করতেন, কিন্তু নতুন রাজা যুবা-বুড়ো সবাইকে নিরাশ করে তরুণ রাখাল ছেলেটিকেই নিজে মন্ত্রী করে নিলেন।

সকলে তো অবাক! রাখালের ছেলে – সে কিনা মন্ত্রী!

রাজপুরীর এই ঐশ্বর্য সমারোহ আর বিপুল কোলাহলের মধ্যে রাখাল বালকের প্রাণ উদাস হয়ে যেতো। মনে পড়তো, তার শ্যামল স্নিগ্ধ ছায়ায় ঘেরা পাতার কুটিরখানি, চিকনকালো কপিলা গাইটি, নদীর তীর, বনের পথ, পাখির ডাক, চাঁদের আলো, আর তার সেই দুঃখিনী মা, যিনি উদাস প্রাণে দিন গুনছেন ।

সেদিনটা ছিলে একাদশীর রাত। আকাশের বুকে স্নিগ্ধ, চাঁদটি তার উজ্জ্বল আলোর ধারা ছড়িয়ে পৃথিবীর বুক আলোয় ভরিয়ে দিচ্ছে। রাজবাড়ির বাগানে একটা শিশুগাছের ডালে বসে কোন একটা নাম-না-জানা পাখি করুণ সুরে সারা বন আকুল করে তুলেছে !

নতুন আমের বোলের সুগন্ধে মেতে বাতাসটাও যেন মাতোয়ারা!
নতুন রাজা তখন মন্ত্রণা গৃহে বসে কিভাবে তিনি নতুন নতুন রাজ্য জয় করবেন, তারই ফন্দি আঁটছেন।

-ডাকো নতুন মন্ত্রীকে।

মন্ত্রী এলেন, হাতে তার রাজার দেওয়া শিরোপা আর মন্ত্রী হওয়ার সাজসজ্জা।
রাজা বললেন, কি বন্ধু, কেমন লাগছে?

রাখাল ছেলে সেই সাজ-সজ্জা মাটিতে নামিয়ে রেখে ধীরে ধীরে বললো, বন্ধু, বিদায় দাও আমায়।
রাজা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, সে কি বন্ধু। কেন এ অভিমান! কে কি বলেছে তোমায়?

কেউ কিছু বলেনি বন্ধু, তোমার দেওয়া এ গৌরবের ভার আর আমি বইতে পারছি না। আমায় ছুটি দাও, আমার মায়ের কোলে ফিরে যাই আমি।
আচ্ছা সখা, তুমি তোমার মাকে নিয়ে এসো না, তাহলে তো আর কোনোই ভাবনা থাকে না?

রাখাল-ছেলে হাসলো, আর বললো, বন্ধু, এখানে এলে দু’দিনেই মা আমার শুকিয়ে যাবেন। ক্ষমা করো সখা। তোমার এ পাষাণপুরীতে সব আছে, শুধু নেই প্রাণ। এখানকার বাতাসটাও যেন বন্দী-ভয়ে ভয়ে আসে, চুপি চুপি যায়। এখানে থাকলে দুদিনেই আমি পাপল হয়ে যাবো–আমার চাই মুক্তি, প্রাণ, ভরা মুক্তি–রাজ-ঐশ্বর্য, মানসন্ত্রম ধুলোর মতো ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বনের দুলাল তার রঙিন উত্তরীয় উড়িয়ে, বাশি বাজাতে বাজাতে বনে ফিরে গেলো।

আবার মহা আনন্দে রাজার প্রাণটাও একমুহুর্তের জন্যে চঞ্চল হয়ে উঠলো সুদুর বনের উদ্দেশে, মনে পড়লো, সেই একদিনের পাওয়া সরল সুন্দর জীবন।

যেখানে একটা তুচ্ছ হরিণ শিশুর রক্ত মানুষের চোখে অশ্রুর ধারা বইয়ে দেয়। আর এখানে এই সভ্য সমাজে মানুষের রক্তপানের কল্পনায় মানুষের কি উল্লাস! বন্ধু সত্যিই বলেছে, হৃদয়হীন এই পাষাণপুরী; আমার ইচ্ছে হচ্ছে ছুটে গিয়ে বন্ধুর সঙ্গ নিই, এখানকার এই ঐশ্বর্যের বোঝাঁ ঝেড়ে ফেলে হালকা হই। কিন্তু হায়! রাজার পায়ে যে সোনার শিকল বাধা। রাখাল-ছেলে যা অনায়াসেই ফেলে চলে যেতে পারে, রাজার ছেলের তা ছাড়বার সাধ্য কই?

No comments