কাক – অনন্য সাঈদ
দিশা এই শহরে থাকে। চাইলেই তার সাথে দেখা করা যায়। ভাবতেই সুখ সুখ লাগে। ঘুম ভাঙার পরেও বিছানা ছাড়তে মন চায় না। একটা অলসতা জড়িয়ে ধরে সোয়েবকে। হাতের কাছের সেলফোনটাকে আত্মীয় আত্মীয় মনে হয়। স্ক্রিন সেভারের ছবিটির ঠোঁটে চুমু খেতে ঠোঁট বাড়ায় সে। সাথে সাথেই বেজে ওঠে কলিং টিউন। সর্বনাশ, ও টের পেয়ে যায়নি তো!
হ্যালো।
হু।
এই হু কি, তুমি কই?
দারফুরে।
এইটা আবার কই?
সুদানে।
ফাইজলামি করবা না একদম। দশমিনিট সময়। টাউন হলে আসো।
বললাম তো আমি সুদানে আছি, আসতে সময় লাগবো।
রাত্রেই বললে পারতা ঘুরবা না, এত ভাব নেয়ার তো কিছু নাই।
রাত্রে যদি জানতাম দারফুর রিলিফ ক্যাম্পে খাবারের জন্য লাইন দিতে হবে তাহলে আগেই জানাতাম।
মানে কি?
মানে আম্মা বাসায় নাই। পেট চোঁ চোঁ। এই ভোর বেলা খালি পেটে একজন সুন্দরী মহিলার সাথে দেখা করা ঠিক হবে?
এই মহিলা বলবা না। আমি বালিকা। কচি খুকি!
হ। তুমি কচি। কচি কুমড়া। দয়া করে আমাকে হাফ এন আওয়ার টাইম দাও। কচি কুমড়া ভাজি করে খাবার প্রিপারেশান নিয়ে আসি।
অক্কে দেয়া হলো। জাস্ট হাফ এন আওয়ার। বাই।
বাই।
শহরের মানুষের ঘুমভাঙা নিয়ে বহু মিথ আছে। গ্রামের লোকেরা মনে করে, শহরের লোকেরা দশটা-বারোটা পর্যন্ত নাকডেকে ঘুমায়। বেলা গড়ালে ব্রাশ করে হালকা নাস্তা করে। আসলে ঘটনা উল্টা। শহরের লোকেদের ইঁদুর দৌড় শুরু হয় সেই ভোর থেকে। স্কুল, কোচিং, অফিসে গন্তব্যমুখী দীর্ঘ যাত্রা। তবে বেকারদের কথা ভিন্ন। তাদের রাত শুরু হয় একটার পর আর দিন শুরু হয় বেলা বারোটার পর।
দিশা ঘুম থেকে ওঠে সকাল সাতটায়। জামার ওপর ওড়না চাপায়। ব্রাশ হাতে বারান্দায় দাঁড়ায়। তিন রুমের ছোট্ট বাসা। এল বারান্দা। সে থাকে তিন নাম্বার রুমে। কয়েক কদম হাঁটলেই উঠানের এক কোণায় গোলাপের দুটো চারা। সে মগে করে পানি দেয়। বাসার দেয়ালের ওপর দিয়ে আকাশ দেখে। আসলে সে দেখে বিদ্যুতের তারে বসে থাকা অনেকগুলো কাক।
দিশা প্রায়ই বলে, আমার ঘুম ভাঙে কাকের ডাকে। ঘুম ভেঙে দেখি, কাক চেঁচাচ্ছে নাহলে তোমার কল বেজে চলেছে ক্রিং ক্রিং করে।
সোয়েব বলে, আমার ঘুম ভাঙে পাখির ডাকে। হয় ভেন্টিলেটরের চড়ুই কিচিরমিচির করে, নাহলে তোমার কল বাজে।
তো, আমি কি পাখি? সে মোবাইলের কল লিস্টে দিশার নাম্বার দেখায়।
দেখো।
কি?
পাখি। অ্যাংরি বার্ড।
সে হাসে। প্রাণখোলা হাসি। এই মেয়েটি হাসলেই সোয়েবের অচেনা অচেনা লাগে। কেমন যেন ঘোর সৃষ্টি হয়। আসলে যা সৃষ্টি হয় তার নাম মায়া। মুগ্ধতা বেড়ে যায়। সংযমী পুরুষের মতো সিদ্ধান্ত নেয় খুব জলদি বিয়ে করে ফেলবে। বিয়ের পর তারা হানিমুন করবে বগুড়ায়। বৈরাগীর ভিটায়। সেখানে তারা একরাত ক্যাম্প ফায়ার করবে। শীতের রাতে সে আর দিশা দুজন দুজনকে দেখবে। মধ্যরাতে যখন তাদের ঘুম ঘুম পাবে, সে দিশার কোলে মাথা রেখে স্থির আকাশ দেখবে। তাকে একটি অনুরোধ করবে। জীবনে এই একটি অনুরোধ অন্তত তাকে রাখতেই হবে।
দিশা বলবে, কি?
সোয়েব বলবে, হাসি।
হাসি?
হু হাসি। আজ সারারাত তোমার হাসি শুনবো।
পাগল।
সোয়েব পাগলের মতই আচরণ করবে। আকাশের দিকে দু`হাত প্রসারিত করে আবৃত্তি করবে:
যদি ভালোবাসা পাই শীতের রাতের শেষে মখমল দিন পাব
যদি ভালোবাসা পাই পাহাড় ডিঙাবো আর সমুদ্র সাঁতরাবো
যদি ভালোবাসা পাই আমার আকাশ হবে দ্রুত শরতের নীল
যদি ভালোবাসা পাই জীবনে আমিও পাব মধ্য অন্ত্যমিল।
তার খুব জানতে ইচ্ছে করে, দিশা তখন কি করবে? সোয়েব জানে ও কবিতা পছন্দ করে না। তাদের তর্ক হয়।
আচ্ছা তুমি কবিতা পছন্দ করো না কেন?
আমার ভালো লাগে না।
সত্যি?
একদম সত্যি।
বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে শোয়েব ভাবে, সে আসলেই একটা কাক। বিদ্যুতের তারে বসে একটানা আবৃত্তি করে চলেছে। আর দিশা উঠোনে দাঁড়িয়ে কটমট করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
এই কাক যাহ্। হুস।
Post a Comment