রম্য গল্প: মন্টু মামার বিয়ে
স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতেই মা বললেন, ‘দারুণ একটি খবর আছে তোর জন্য।’ আমি আগ্রহের সাথে মায়ের নিকটে গিয়ে বললাম, ‘কী খবর, বলো না?’
‘তোর মন্টু মামার বিয়ে।’ মা বললেন।
আমি কাঁধ থেকে স্কুল ব্যাগটি নামাতে নামাতে বললাম, ‘আমি যাবো না, তুমি যাও।’
মা আার বিশেষ কিছু বললেন না। আমিও আর আগ্রহ দেখালাম না। ‘যাবো না’ কথাটি যত সহজে বলেছি, আসলে বিষয়টা তত সহজ না। আমি কথাটি ইচ্ছে করে বলিনি। মামার বিয়েতে আনন্দ করতে কার না মন চায়? আমারও ইচ্ছে করে মামার বিয়ের বরযাত্রী যেতে। খুব ইচ্ছে হয় রং মেখে ঢং সাজতে। কিন্তু যত বার মামার বিয়ের কথা বলে স্কুল থেকে ছুটি নিয়েছি, ততবার যাওয়া হয়নি। যখনি যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতাম তখনই কেউ না কেউ সকালে এসে খবর দিয়ে যেত আপাতত বিয়েটা হচ্ছে না। একেই বলে বাড়া ভাতে ছাই দেওয়া। পরের দিন স্কুলে গিয়ে স্যারের মুখোমুখি হতে হয়। কারা যেন স্যারকে বলে আমি নাকি মিথ্যে বলে ছুটি নিয়েছি? ওদের-বা কী করে দোষ দিই? স্কুলে না গিয়ে আমাকে যে ওরা খেলতে দেখেছে। স্যারকে সব ঘটনা বলতেই ক্লাসে হাসির রোল পড়ে যায়। এভাবে আমাকে বেশ কয়েকবার অপমান হতে হয়েছে।
কয়েকটি হওয়া বিয়ে এভাবে মামা নিজে ভেঙ্গে দিয়েছেন। এইতো গতবারের কথা, মামার এই কা-কারখানা দেখে বাবা নিজে দেখাশোনা করে একটি বিয়ে ঠিক করলেন। মামা বাবাকে বেশ ভয় পায়। তাই বাবার মুখের সামনে কিছু বলতে পারেননি। বাবা দিনক্ষণ ঠিকঠাক করে তবেই এসেছিলেন।
বিয়ের দিন সকালবেলা মামা একটু কেমন যেন অস্থির আচরণ করছিলেন। তবুও বাবার ভয়ে কিছুই বলতে পারেননি। অবশেষে আমরা বিয়ে বাড়িতে পৌঁছালাম। প্রথমে সবাইকে এক গ্লাস শরবত দিলো। কিছুক্ষণ পর হালকা নাস্তাও দিলো। আমি নাস্তা খেয়ে বিয়ে বাড়িটা এক চক্কর দিয়ে আসতেই বাবা বললেন, ‘ কোথাও যাবি না, তোর মামার কাছে গিয়ে বসে থাক।’ আমি কোনো কথা না বলে চুপচাপ মামার কাছে গিয়ে বসলাম। দুপুর গড়িয়ে এলো। খুব খিদে পেল। বিয়ে বাড়ির নিয়ম হলো বিয়ে পড়ানোর আগে ভাত দেওয়া যাবে না। তাই বিয়ে পড়ানো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আমি একটি সুযোগ নিলাম। মামার কাছে বাবাকে বসতে দেখে আমি বিয়ে বাড়ির লোকজনকে বললাম, ‘আমি আপনাদের হবু জামাইয়ের একমাত্র ভাগ্নে।
আমার খিদেই পেট চুচু করছে।’ এতটুকু বলতেই খাবার নিয়ে হাজির। বরের ভাগ্নে বলে কথা। সেখানে আমার একটা গুরুত্ব আছে। খাবার খেয়ে মামার কাছে গিয়ে বসলাম আমি। কিছুক্ষণ পর বাড়িতে ইমাম সাহেব এসে হাজির হলেন। বিয়ে পড়ানোর জন্য তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। মামা হঠাৎ পেটে হাত দিয়ে বললেন, ‘ইস, পেটে কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠছে। দুলাভাই একটু বাইরে যেতে হবে।’
বাবার চাচ্ছেন না এখন মামা বাইরে যাক, কিন্তু বাবার ভয় আছে যদি প্যান্টে ইয়ে করে ফেলে?
বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘সময় পেলি না? যা তাড়াতাড়ি সেরে আয়, ইমাম সাহেব চলে এসেছেন।’
বদনাটা নিয়ে পাশের পাটক্ষেতে ঢুকে পড়লেন মামা। আমি পাহারাদার হিসেবে বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম। বাবার নির্দেশ। বেশ খানিক সময় পার হলো। মামা বের হচ্ছেন না। বাবা দিশামিশা না পেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সে কই?’ আমি পাটের ক্ষেতের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললাম, ‘ঐ দিকে ঢুকেছে।’ বাবা কয়েকবার ডাক দিয়ে কোনো উত্তর পেলেন না। বিরক্ত হয়ে নিজেই পাটক্ষেতের ভিতর ঢুকে পড়লেন। অবশেষে মামাকে না পেয়ে বদনাটা হাতে করে বেরিয়ে এলেন। হা হা হা… আমি আর হাসি সামলাতে পারলাম না। বাবা রেগে আগুন হয়ে গেলেন। মামা পালিয়েছেন। মামার বুদ্ধি কাজে লেগেছে। আমি হাসিটা থামিয়ে বাবার পিছু নিলাম।
বিয়ে বাড়িতে বেশ ঝামেলা বেঁধে গেল। বাবাকে বেশ অপমান অপদস্ত করা হলো। বাবা নিরুপায় হয়ে বিয়ে বাড়ির সমস্ত খচ্চা দিয়ে তারপর এসেছিলেন। খাবার না খেয়েও জরিমানা? কপাল ভালো যে কিছুটা খেয়েছিলাম। জরিমানা লাগে লাগুক, আমাদের সবাইকে মার খেতে হয়নি সেই ঢের।
মামা সেই যে পালিয়েছিলেন, তারপর কয়েক দিন বাড়ি ফেরেননি।
সেই থেকে বাবা নিজ থেকে আর কখনো মন্টু মামার বিয়ের বিষয়ে নাক গলাননি। মাঝে মাঝে মা একটু-আধটু নাক গলান। কী করবে, ছোট ভাই বলে কথা। তাও আবার একমাত্র ভাই।
রাতের খাবার খেতে বসে বাবা বললেন, ‘শুনলাম, তুই নাকি তোর মামার বিয়েতে যাবি না?’
‘হুম।’ আমি বললাম।
‘আচ্ছা ঠিক আছে যেতে যখন চাচ্ছিস না তখন জোর করবো না। স্কুলে যেতে হবে না, বাড়িতেই থাকবি। আমরা দুয়েক দিনের মধ্যেই ফিরে আসবো।’
‘আমরা মানে? বাবা তুমিও যাচ্ছো নাকি?’
‘হুম।’
আমি কখনো ভাবতেই পারিনি বাবা আবার মামার বিয়েতে যাবেন।
বাবা বললেন, ‘কীরে, কী ভাবছিস? এবার বিয়েতে না গেলে সত্যি সত্যিই বিয়ে খাওয়াটা তোর কপালে নেই। সারা জীবন তোকে আপসোস করতে হবে। আর বলতে হবে কতবার গেলাম বিয়েটা হলো না, আর এই একবার গেলাম না বিয়েটা হয়ে গেল! তখন কিন্তু আমাদের দোষ দিস না।’
মায়ের দিকে তাকাতেই মা মিচমিচ করে হাসছেন। এজন্যই মা তখন কিছুই বললেন না। বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘মামার বিয়ে বলে কথা, না গেলে হয়? আমি না গেলে জমবেই না।’ ‘না, না, তোকে যেতে হবে না, তুই গিয়ে কী করবি? তারচে বরং তুই বাড়ি পাহারা দে।’ বাবা আমাকে রাগাবার জন্য বলেছেন এ কথা। আমি উঠে পড়লাম। মা বললেন, ‘কীরে, খাওয়াটা শেষ কর।’ বললাম, ‘বড় একখানা দরখাস্ত লিখতে হবে। মামার বিয়ের জন্য ছুটি চেয়ে আবেদন। মামার বিয়ে।’
বাবা আর মা হাসতে লাগলেন।
বিয়ে বাড়িতে একটুআধটু হৈহুল্লোড়তো হবেই। তাও আবার মন্টু মামার বিয়ে বলে কথা। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ দেখতে এসেছে। পূর্বের তুলনায় এবার গাঁয়ের লোকজনের ভিড় একটু বেশিই। অন্য গাঁয়ের লোকজন এসেছে দেখতে। এর প্রধান আকর্ষণ হলো, এবার বরযাত্রী যাবে নৌকায় করে। আমি মায়ের কাছ থেকে শুনলাম এই ব্যবস্থা বাবা করেছেন। মেয়েরা নৌকায় ভয় পায় তাই এবার কোনো মেয়েমানুষ নেওয়া হয়নি। আমাকেও নিতো না। নানি অনেক করে বলার পর নৌকায় উঠালো। নৌকায় উঠে বললাম, ‘বাবা, নৌকায় চড়তে আমার খুব ভালো লাগে।’ যদিও ভয় করে। তবুও ভালো লাগার ভান করে বললাম।
বাবা বললেন, ‘সাবধানে থাকিস মাঝ নদীতে নৌকা দুলতে পারে।’
চারটি নৌকা হেলে দুলে চলতে লাগল। কনের বাড়ি নদীর ঐপাড়ে। নদীটা পার হতে প্রায় আড়াই তিন ঘন্টা সময় লাগে। শুনলাম এই বিয়েতেও মামার মতামত নেই। কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন নদী পার হয়ে যেতে যদি কোনো দিন ঝড়ের কবলে পড়েন, তাহলে তো জীবন শেষ।
আমি আর বাবা মন্টু মামার নৌকায় ছিলাম। মামার মুখের দিকে তাকালাম। বেচারা চুপচাপ বসে আসেন। মনে হয় মামা ভাবছেন আগে কনের বাড়ি যাই, তারপর দেখবো কে বিয়ে দেয়।
নৌকা নদীর মাঝ বরাবর এলে বাবা মাঝিকে থামাতে বললেন। হঠাৎ দেখতে পেলাম কিছুদূর আরও দুটো নৌকা এদিকেই আসছে। নৌকা দুটো আমাদের নৌকার নিকটে আসতেই দেখি ঐ নৌকার ভিতরে মামার বিয়ের ঘটক কুদ্দুস বসে আছে।
মামা পরিস্থিতি দেখে লাফিয়ে উঠে বললেন, ‘এটা কী হচ্ছে দুলাভাই? মাঝ নদীতে নৌকা থামালেন কেন?’
‘কেন আবার, তোর বিয়ে।’
‘এখানে বিয়ে? নৌকায়?’
‘হুম, গতবার বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে গিয়ে কী অপমানটা না করেছিস। তাই আর স্থলে তোকে বিশ্বাস করতে পারছি না, ভাবলাম বিয়েটা জলের উপরেই হোক। যাতে করে অন্তত বিয়ের আসর থেকে পালাতে না পারিস।’
বাবা দুজনকে ইশারা করতেই দুজন লোক মামাকে বোগল দাবা করে ধরে বসিয়ে রাখল। যাতে পানিতে লাফ দিতে না পারে।’
মামা কিছুক্ষণ নড়াচড়া করে উপায় না পেয়ে চুপচাপ বসে রইলেন।
চারিদিকে অথৈ পানি। কোনোভাবে পালানোর উপায় নেই। এজন্যই বলি এত অপমানিত হয়েও এই বিয়েতে বাবার এতো আগ্রহ কেন? এসব ব্যবস্থা বাবা নিজে থেকেই করেছেন। মামার প্রতি একটু মায়া হচ্ছিল। তারপরও নৌকায় বিয়ে! অকল্পনীয় ঘটনা। নৌকায় চডে বিয়ে করতে যাওয়া ঠিক আছে কিন্তু নদীর মাঝে নৌকায় চড়ে অথৈ পানিকে সাক্ষী রেখে কবুল বলা আমার কল্পনার বাইরে।
এই অদ্ভুত ধরনের বিয়ে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ বিয়ে। এরপর থেকে পড়ালেখার চাপে মামা বাড়ি তেমন আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। গত কয়েক দিন হলো মামার ছেলের সুন্নতে খাৎনা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। মামা সত্যিই একজন সহজ সরল মানুষ। আমাকে পাশে বসিয়ে বললেন, ‘ভাগ্নে, আগে যদি বুঝতাম বাবা ডাক কত মধুর তাহলে উপযুক্ত বয়সেই বিয়ে করতাম।’ মামা আবেগআপ্লুতো হয়ে গেলেন। আমি প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বললাম, ‘মামা, বলোতো আমাকে একা রেখে তুমি কীভাবে পাটের ক্ষেত ভেঙ্গে বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে এসেছিলে?’
আমার কথা শুনে মামা যে কি হাসি দিয়েছিলেন বলে বোঝাতে পারব না। যখনই আমাকে ঘটনাটি বলতে শুরু করেন, তখনই হাসির রোল পড়ে যায়। একটি লাইনও বলতে পারেন না। থাক-না অজানা সেই পালিয়ে আসার গল্প। কথাগুলো নাহয় মামাকে হাসাবার জন্য জমা হয়ে থাক।
লেখক: মুহাম্মদ বরকত আলী
Post a Comment