মাই আঙ্কল জুল - গী দ্যা মোপাসা


মুখভর্তি পাকা, দাড়িওয়ালা এক ভিক্ষুক আমাদের সামনে এসে ভিক্ষা চাইল। আমার বন্ধু যোসেফ দাভোখসকে পাঁচ ফ্রায়ের নোট ভিক্ষে দিতে দেখে আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম। কিছুটা আপনমনেই ও বলতে লাগল, এই বুড়ো বদমাশটা এমন একটা স্মৃতি মনে করিয়ে দিল, আজও আমাকে যেটা তাড়া করে ফেরে। যদি…।

একটু থেমে কী ভেবে আবার বলল, তোমাকে গল্পটা বলা যায়। বলেই ফেলি।

‘আমরা ছিলাম হার্ভে এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা। গরিব ছিলাম আমরা খুব। দিন আনি দিন খাই-এই রকম অবস্থা। বাবা ছিলেন একটা সওদাগরি অফিসের কেরানি। বেদম খাটতেন আর অনেক রাত করে বাড়ি ফিরতেন। কিন্তু খাটনির তুলনায় আয় ছিল খুব কম। আমার আবার দুটো বড় বোনও ছিল। আমার মা ছিলেন দারিদ্র্যের অসুখে ভুগে ভুগে ভেঙে পড়া এক বদমেজাজি, মহিলা। প্রায়ই বাবাকে যা-তা বলে বকাবকি করতেন আর স্কার্ফে মুখ গুজে গজরাতে গজরাতে সমস্ত দুর্দশার জন্য বাবাকে দায়ী করতেন। ওই সময়গুলোতে বাবার চেহারা দেখে আমার ভীষণ মায়া লাগত। ডান হাতটা দিয়ে কপালের ঘাম মুছে ঝেড়ে ফেলার ভঙ্গি করতেন বাবা। যেন ওভাবেই সব হতাশা ঝেড়ে ফেলতে চাইতেন। আমি বাবার দুঃখগুলো বেশ বুঝতে পারতাম।

আমাদের সবকিছু চলত অনেক হিসাবনিকাশ করে। কারও বাড়িতে দাওয়াত খেতেও যেতাম না, নিজেদের দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানোর সামর্থ্য নেই বলে। দরকারি জিনিসপত্র কম দামে কেনার জন্যে দোকানের পিছনে ফেলে রাখা প্রায় বাতিল মালগুলো থেকে কেনাকাটা করতাম। বোনেরা নিজেরা নিজেদের জামাকাপড় বানিয়ে নিত। আর দামি দামি রেশমি কাপড় আর হালফ্যাশনের গল্প করত। আমাদের দৈনিক খাবারের মেনুতে ছিল তেলতেলে একরকমের সুপ আর নানারকম সস মাখানো গরুর মাংস। বলা হত, ওগুলো নাকি শরীরের জন্য ভাল। কিন্তু আমার মোটেই ভাল্লাগত না, ভীষণ স্বাদহীন, একঘেয়ে লাগত। ভয়ঙ্কর কিছু দৃশ্যের অবতারণা হত যখন কোনভাবে আমার পাজামা ছিড়ে যেত বা জামার বোতাম খুলে পড়ে হারিয়ে যেত। মায়ের পিটুনি খেতে খেতে শুনতে হত কীভাবে বাবার সাথে বিয়ে হওয়ার কারণে তার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে।

কিন্তু তবুও প্রতিটি ছুটির দিনে আমরা আমাদের সবচেয়ে ভাল জামাকাপড় পরে বন্দর এলাকায় জেটির কাছে ঘুরতে বের হতাম। বাবা পরত ফ্রক-কোট, উঁচু হ্যাট আর দস্তানা। মাও বাবার হাত ধরে ঘুরতে বেরবেন বলে বেশ দাপুটে ভঙ্গিতেই প্রস্তুতি নিতেন। বোনেরা শুধু ইশারার অপেক্ষায় থাকত কখন বেড়াতে বের হবে সবাই। প্রায়ই শেষ মুহূর্তে বাবার কোটের আস্তিনে বা কোথাও বিশ্রী ধরনের কোন দাগ চোখে পড়ত। মোটা কাপড়ে বেনজিন লাগিয়ে সেই দাগ দূর করার চেষ্টা করতেন মা। বাবা হ্যাট আর শার্ট পরে অপেক্ষা করত কোর্টটা পরিষ্কার আর দাগহীন হওয়ার জন্য। মা হাতের দস্তানা খুলে লেগে পড়তেন পরিষ্কার করতে।

বেশ আয়োজন করেই বেরতাম আমরা। আমার বোনেরা থাকত সবার সামনে। হাত ধরাধরি করে হাসাহাসি করতে করতে সুখি ভঙ্গিতে হাঁটত ওরা। দু’জনেরই যে বিয়ের বয়স হয়েছে এটা যেন গোটা শহরকে জানানো চাই। মায়ের ডানদিকে বাবা আর বামদিকে থাকতাম আমি। আমার আজও বেশ পরিষ্কার মনে আছে। ছুটিরদিন এর বিকেলে আমার গরিব বাপ-মাকে একটু যেন অন্যরকম লাগত। আত্মবিশ্বাসী ভদ্রলোকদের মত মেরুদণ্ড সোজা করে মাপা মাপা পায়ে হাঁটত বাবা। মায়ের চোখেমুখে ফুটে থাকত অন্য একধরনের আভা। ছোট হলেও বুঝতাম সবকিছু কতটা মেকি।

আর প্রতি রোববারেই, জেটিতে দাড়িয়ে যখন আমরা দূর দূরান্তের অচেনা দেশ থেকে ভেসে আসা জাহাজ গুলোকে ফিরতে দেখতাম, বাবা বারবার বলা সেই একটা কথাই বলে উঠতেন, ‘এই জাহাজটায় জুল ফিরে এলে কী মজাই না হত!’ জুল চাচা আমার বাবার ছোট ভাই। একসময়ে তিনি নাকি ছিলেন পরিবারের বখাটে ছেলে। আর এখন বাবার চোখে তিনি শেষ আশার আলো। চাচাকে কখনও দেখিনি আমি। ছোটবেলা থেকেই বাবার মুখে চাচার কথা এত বেশি শুনে এসেছি যে আমার মনের মধ্যে তার জ্যান্ত ছবিটা যেন ভাসত। বিশ্বাস ছিল প্রথম দেখায়ই আমি তাকে চিনতে পারব। আমেরিকা রওনা হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তার সমস্ত খুঁটিনাটি বর্ণনাই আমার মাথায় এমন ভাবে গেঁথে গিয়েছিল। যদিও চাচার ওই সময়কার বর্ণনা কেন যেন বেশ রেখেঢেকেই দেওয়া হত। হয়তো পারিবারিক পুঁজি বা টাকাপয়সা নিয়ে কোন দ্বন্দ্ব ছিল বলে। শুনেছি উত্তরাধিকার সূত্রে বাবার প্রাপ্য সম্পত্তির খানিকটা অংশ হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন চাচা।

অনেক বছর আগে সওদাগরি জাহাজে কাজ নিয়ে হার্ভে থেকে আমেরিকার নিউ ইয়র্কে পাড়ি জমিয়েছিলেন চাচা। সেখানে গিয়েই নাকি ব্যবসাপাতি শুরু করেছিলেন। চিঠিতে লিখেছিলেন যে, খুব শিগগির তিনি বাবার টাকা ফেরত দেয়ার মতন সঞ্চয় করতে পারবেন। এই চিঠি পড়ে নাকি পুরো পরিবারেই বেশ একটা সাড়া পড়ে গিয়েছিল। জুল চাচা রাতারাতি বখাটে ছোকরা থেকে দক্ষ, সৎ আর কর্মঠ মানুষের মর্যাদা পেয়ে গেলেন। পরিবারের সবাই তার কথা গর্ব করে বলে বেড়াতে লাগল।

পরে একদিন জেটি এলাকায় বাবার চেনা এক জাহাজের ক্যাপ্টেন এসে জানিয়েছিল যে, নিউ ইয়র্কে নাকি চাচা বেশ বড় একটা দোকানের মালিক হয়েছেন আর ব্যবসাও ভালই চলছে।

দু’ বছর পর এল বাবাকে লেখা চাচার দ্বিতীয় চিঠিটা।

প্রিয় ফিলিপ,
আমার ভালবাসা নিয়ো। কেমন আছ তোমরা? এই চিঠিটা এই জন্য লিখছি যেন তোমরা আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা না কর। আমার শরীর ভাল আছে। ব্যবসার অবস্থাও ভাল। আগামীকাল একটা লম্বা বাণিজ্য সফরে দক্ষিণ আমেরিকা রওনা হব। চিঠি না পেলে দুশ্চিন্তা কোরো না। যথেষ্ট অর্থ সম্পদ হলেই আমি ফিরে আসব। আমার ধারণা, তার আর বেশি দেরি নেই। অচিরেই হয়তো আমরা একত্রে সুখ-শান্তির সচ্ছল জীবন শুরু করতে পারব।

সবাইকে আমার ভালবাসা জানিয়ো।

ইতি
তোমার ছোট ভাই জুল দাভোখস

চিঠিটা যেন আমাদের পরিবারের জন্য ঐশীবাণী। বারবার করে পড়া হত আর চেনা পরিচিত সবাইকে ডেকে ডেকে দেখানো হত। সচ্ছল জীবনের স্বপ্নের জাল বুনতে শুরু করত গোটা পরিবার। সুখি ভবিষ্যতের স্বপ্ন। দামি পোশাক আর ভদ্রস্থ একটা ঘরের স্বপ্ন। আমার চোখে চাচা ততদিনে স্বপ্নের নায়ক। দুঃসাহসী এক বীর যেন। আমার জীবনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল তার মত একটা মানুষ হওয়া।

পরের দশ বছর জুল চাচার কোন খবরই পাওয়া গেল না। কিন্তু তাও সময়ের সাথে বাবারও প্রত্যাশা যেন বেড়েই চলছিল। এমনকী মাকেও মাঝে মাঝে বলতে শুনতাম, জুল ফিরলেই সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। আর প্রতি রোববারে, জেটিতে দাঁড়িয়ে বাবা কয়লার ধোয়া উড়িয়ে এগিয়ে আসতে থাকা জাহাজগুলোর দিকে তাকিয়ে সেই একই কথা বলতেন, এই জাহাজে জুল ফিরে এলে কী ভালই না হত! আমরাও আশা করতাম হয়তো একদিন দেখা যাবে, কোন এক জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে আমার সুঠামদেহী জুল চাচা হাতের রুমাল নাড়তে নাড়তে বাবাকে চিৎকার করে ডাকছেন।

আমার বাবা মা জুল চাচার ফিরে আসার ব্যাপারে এতটাই নিশ্চিত ছিলেন যে, অসংখ্য পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন চাচার জমানো টাকাপয়সার কথা চিন্তা করে। এমনকী চাচার টাকায় তারা ইনগোভিল-এর কাছে একটা বাড়ি কিনে ফেলার পরিকল্পনা পর্যন্ত করে ফেললেন। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারব না বাবা বাড়ি কেনার ব্যাপারে দালালদের সাথে কথাবার্তা বলাও শুরু করে দিয়েছিলেন কিনা।
আবার দু’বোনের মধ্যে বড়জনের বয়স ততদিনে আটাশ। আর ছোটজনের চব্বিশ। তবু তাদের বিয়ের কোন নামনিশানা দেখা যাচ্ছিল না। ব্যাপারটা পরিবারের সবার জন্য বেশ দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়াল।

শেষ পর্যন্ত ভাগ্যক্রমে ছোটজনের একটা পাণিপ্রার্থী জুটে গেল। বাবার অফিসেরই এক কেরানি। টাকা পয়সা তেমন একটা নেই। দেখতে শুনতেও আহামরি কিছু না। তবু যাচাই বাছাইয়ের পরিস্থিতি ছিল না। আমার মনে হয় জুল চাচার চিঠিটা ওই কেরানি ব্যাটাকে কায়দা করে দেখানোর পরই হয়তো সে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে বিয়েতে মত দিয়েছিল।

তাকে বেশ ভাল রকম সমাদর করা হলো। ঠিক হলো বিয়েটা হয়ে গেলে পরে সবাই মিলে জার্সিতে বেড়াতে যাব। আমাদের মতন গরিবদের জন্য তখন জার্সিতে বেড়াতে যাওয়া স্বপ্নের মতন। জার্সি যদিও খুব দূরে নয়। স্টিমারে চড়ে সেই দ্বীপে যাওয়া যায়। দ্বীপটা ইংরেজদের অধীনে। অর্থাৎ আমাদের মতন ফরাসিদের জন্য সেটা বিদেশই বটে। এদিকে জার্সিতে বেড়াতে যাওয়ার ব্যাপারটা আমাদের মধ্যে একটা বদ্ধমূল বাতিকের মতন হয়ে দাঁড়াল। সারাক্ষণই আমরা স্বপ্নে দেখতাম স্টিমারে চড়ে জার্সিতে বেড়াতে যাওয়ার। অপেক্ষার অজস্র প্রহর শেষে স্বপ্নের সেই দিনটি এল। আমার চোখে এখনও পরিষ্কার ভার্সছে; যেন এই তো গতকালকের ঘটনা। বাবা খুব তোড়জোড় করে স্টিমারে মালামাল উঠানো তদারক করছিলেন। বাবার পরনে সেই ফ্রককোটটাই। তাতে হালকা বেনজিনের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। মনে করিয়ে দিচ্ছিল সেই রোববার বিকেলগুলোর কথা। মা উদ্বিগ্নমুখে বড় বোনের হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আর সদ্য বিবাহিত আমার ছোট বোনটি আর তার কেরানি বর হাত ধরাধরি করে ধীরে সুস্থে পিছনে পিছনে আসছিল।

স্টিমার ছাড়ল অবশেষে। জেটি থেকে নাক ঘুরিয়ে সবুজ মার্বেল রঙয়ের সমুদ্রের দিকে এগোল। আমরা বেশ গর্বিত আর সুখী ভ্রমণকারীদের মতন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম উপকূলরেখার ফিকে হয়ে আসা। বড় স্টিমার। অনেক যাত্রী। বাবার হঠাৎ চোখে পড়ল দুটো লোক দু’জন ধোপদুরস্ত পোশাক পরা মহিলার জন্য ঝিনুক কিনছে। এক বুড়োটে নাবিক ঝিনুকের খোলস ছুরি দিয়ে খুলছিল আর লোকদুটোর হাতে তুলে দিচ্ছিল। লোক দুটো আবার সেগুলো মহিলা দু’জনের দিকে এগিয়ে দিচ্ছিল। মহিলা দুইজন আবার বেশ কেতাদুরস্ত ভঙ্গিতে রুমাল দিয়ে ঝিনুকের খোলের কিনারা ধরে মুখ বাড়িয়ে দিয়ে এমন ভাবে খাচ্ছিল যেন পোশাকে না লেগে যায়। খাওয়া শেষে খোলসগুলো আবার সমুদ্রেই ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছিল। আমার বাবা বলেন, সবাই মিলে ঝিনুক খাওয়া যেতে পারে। মহিলা দু’জনের খাওয়ার ভঙ্গি দেখে আমাদেরও খেতে ইচ্ছে করছিল। বাবা উপরের ডেকে গিয়ে মা আর আমার বোনদেরকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন তারা খেতে চায় কিনা।

অহেতুক খরচের কথা ভেবে মা দ্বিধা করলেও, বোনেরা আগ্রহভরে খেতে চাইল। মা বেশ কায়দা করে বললেন যে পেট খারাপের ভয়ে তিনি খাবেন না। আর মেয়েদেরকে সাবধান করলেন যেন কম কম খায়-মহলে আবার বদহজম হতে পারে। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যোসেফ তো আবার ওসব পছন্দই করে না। আমি পরে মায়ের চড় খাওয়ার ভয়ে কিছু বললাম না। মায়ের কাছেই দাঁড়িয়ে রইলাম। মন খারাপ হয়ে গেল। দেখলাম বাবা তার দুই মেয়ে আর জামাইকে নিয়ে ওই বুড়ো ঝিনুকওয়ালার দিকে রওনা হলেন। উপর থেকে দেখা যাচ্ছিল ওদের।
কীভাবে পোশাকে না লাগিয়ে কায়দা করে খেতে হবে দেখাতে গিয়ে প্রথমেই বাবা তার ফ্রককোটের উপরে খানিকটা লাগিয়ে ফেললেন। কারণ মুখে দেয়ার শেষ মুহূর্তে তার হাত কেঁপে উঠেছিল। অত দূর থেকেও পরিষ্কার দেখলাম। স্পষ্ট দেখলাম বাবার চোখের চাহনি বদলাতে। কয়েক পা পিছিয়ে ঝিনুক বিক্রেতা বুড়ো লোকটার দিকে উলটো ঘুরে দ্রুত আমাদের দিকে ছুটে এসে হাঁপাতে লাগলেন। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠলেন, “ঝিনুকওয়ালার চেহারা একদম আমাদের জুলের মতন। হুবহু মিল।’
‘কোন জুল?’ মা হঠাৎ করে কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলেন।

‘আরে, আমার হোট ভাই জুল। যদি না জানতাম যে ও আমেরিকাতে আছে আর বেশ ভালই ব্যবসাপাতি করছে, তা হলে তো ওই ঝিনুকওয়ালা ব্যাটাকেই জুল মনে করতাম। বাবার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।’

‘ধ্যাত্তেরি!’ মা বেশ জোরেসোরেই যেন বলতে চাইলেন। ‘জানোই তো ওটা জুল না, তবে এই ভাবে হুড়মুড়িয়ে এসে বলার কী আছে?’
কিন্তু বাবা তবু বলে চললেন, ‘ক্ল্যারিস, তুমি গিয়ে দেখে আসোগে। নিজের চোখকে বিশ্বাস হবে না, জুলের সাথে এত মিল ওর চেহারায়।’
মা দেখার জন্য এগোলেন। আমিও দেখতে গেলাম লোকটাকে। বয়স্ক, নোংরা, মুখ বলিরেখায় ভরা-এক মনে নীচের দিকে তাকিয়ে ঝিনুকের খোলস খুলছে। আর কোনদিকে তাকাচ্ছে না। ছেঁড়া তালি দেয়া একটা জামা পরা। দেখলাম মায়েরও চোখমুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। ফিরে এসেই বাবাকে ফিসফিস করে বলতে লাগলেন, ‘আমার মনে হয় এটা জুলই। ষাও স্টীমারের সারেংকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে জেনে নাও লোকটার পরিচয়। হতচ্ছাড়াটা আবার আমাদের চিনে না ফেললেই হয়।’

বাবার পিছনে পিছনে আমিও এগোলাম। আমার কেমন যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। এ কীভাবে সম্ভব!

সারেং লোকটা বেশ লম্বা, রোগাটে চেহারা। মস্ত বড় গোঁফটা যেন নাকের নীচে ঝুলছে, স্টিমারের ব্রিজে দাঁড়িয়ে ছিল এমন ভঙ্গিতে যেন বিশাল একটা জাহাজের ক্যাপ্টেন সে.। বাবা বেশ সমীহ নিয়ে কথা বলতে গেলেন। প্রথমে ক্যাপ্টেন’কে জাহাজের প্রশংসা করে কিছু কথা বলায় লোকটা বেশ খুশিই হয়ে উঠল। বাবা নানান কথা বলতে লাগলেন। জার্সি দ্বীপটার আকার, জনসংখ্যা, দেখার মত জিনিস ইত্যাদি নানান বিষয়ে। আমাদের স্টিমারটার নাম ছিল ‘দ্য এক্সপ্রেস’। তারা এরপর ‘দ্য এক্সপ্রেস’ নিয়ে গল্প জুড়ে দিল। অনেকক্ষণ একথা সেকথার পর বাবা বেশ ইতস্তত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, আপনার জাহাজে যে বুড়ো ঝিনুক-বিক্রেতাকে দেখলাম, বেশ আজব চরিত্র বলে মনে হলো তাকে। চেনেন নাকি লোকটাকে? সারেঙের মুখে বিরক্তির চিহ্ন দেখা দিল। জবাব দিল, ওটা একটা ফরাসি বাউণ্ডুলে। গত বছর আমেরিকায় দেখা হয়েছিল। ফালতু লোক। বলেছিল হার্ভের বন্দর এলাকায় নাকি তার আত্মীয়স্বজন আছে। কিন্তু সে ফিরতে চায় না, সেখানে নাকি তার অনেক ধার দেনা। নাম বলেছিল জুল। জুল দাখমশ বা জুল দাখশ এরকম কিছু একটা নাম, বেশ আয় রোজগার নাকি করেছিল সে ওখানে। সব খুইয়েছে। আমার তো মনে হয় সব বাজে কথা। অকর্মার ধাড়ি একটা। তবু মায়া লাগল..’

বাবার চেহারায় রাগ ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। লম্বাটে মুখটায় অবশেষে ক্লান্তির একটা অভিব্যক্তি ফুটে উঠল। ক্লান্তির নাকি স্বপ্নভঙ্গের-কে জানে! আর আমার কী মনে হচ্ছিল? সে কথা নাই বা শুনলে।

‘হুমম, তাই তো দেখা যাচ্ছে। বিড়বিড় করে বললেন বাবা। ক্যাপ্টেন, আপনার সাথে কথা বলে ভাল লাগল’-বলেই হেটে চলে এলেন। বাবার সাথে সাথে আমিও। এভাবে হঠাৎ চলে আসায় সারেং আমাদের গমনপথের দিকে একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল-পিছনে ফিরে দেখেছিলাম। বাবা মায়ের কাছে ফিরে এসে সব খুলে বললেন। গজগজ করতে করতে বললেন, ‘এটা আর কেউ নয়, আমার গুণধর ভাই। এখন কী করা যায় বল তো?’

‘ছেলেমেয়েদেরকে ওই হতচ্ছাড়ার কাছ থেকে সরিয়ে আনো।’ মা তাড়াহুড়ো করে বললেন। যোসেফ তো জেনেই ফেলল। কিন্তু দেখতে হবে জামাইটা যেন না জানতে পারে বা কিছুতেই যেন কোন সন্দেহ না জাগে।।

বাবার হতভম্ব ভাবটা তখনও কাটেনি। হায় রে কপাল। বিড়বিড় করছেন তিনি। মা হঠাৎ রেগে উঠলেন, ‘আমি জানতাম বদমায়েশটা জীবনে কিছুই করতে পারবে না। শেষ পর্যন্ত হয়তো আমাদের ঘাড়ে এসে জুটবে। তোমাদের বংশের কাছ থেকে এর চেয়ে আর কী-ই বা আশা করা যায়?’

বাবা চুপ।

মা বললেন, ‘যোসেফের কাছে টাকা দাও। ও দাম মিটিয়ে আসুক। হতভাগাটা এখন আমাদেরকে চিনে ফেললেই যোলোকলা পূর্ণ হবে। চলো আমরা সবাইকে নিয়ে অন্যদিকে সরে পড়ি।’

মা আমার হাতে পাঁচ ফ্রায়ের একটা নোট তুলে দিয়ে জাহাজের অন্যদিকে বাবাকে নিয়ে চলে যেতে লাগলেন। আমার বোনেরা তখনও বাবার ফিরে আসার জন্য ওখানেই অপেক্ষা করছিল। বাবার বদলে আমাকে দেখে অবাক হলো। আমি বললাম, মায়ের শরীরটা হঠাৎ খারাপ করেছে। জিজ্ঞেস করলাম ঝিনুকওয়ালা কত টাকা পাবে। ঝিনুকওয়ালা লোকটার কাছে গিয়ে আমি প্রায় নিজের অজান্তেই আরেকটু হলে তাকে চাচা বলে ডেকে উঠতে গিয়েছিলাম। আমি তাকে পাঁচ ফ্রায়ের নোটটা দিলাম। খুচরো কিছু টাকা ফেরত পেলাম। লোকটাকে ভাল করে দেখলাম। হাত দুটো শীর্ণ, চেহারায় পরাজিত বার্ধক্যের ছাপ। মনে মনে অবাক হয়ে ভাবছি, এটা আমার চাচা! আমার বাবার ছোট ভাই, মানে আমার চাচা! আমার কল্পনার দুঃসাহসী নায়ক! আমার কল্পনার মানুষটার সাথে তুলনা করছি আর অবাক হচ্ছি। এই তো আমার বাবার মতন লম্বাটে মুখ, মাঝারি গড়ন। রক্তের সম্পর্কের ছায়া? কে জানে!

আমি একটা খুচরো মুদ্রা লোকটাকে বকশিশ দিলাম। সে মৃদু গলায় আমাকে ধন্যবাদ দিল। খোদা তোমার রহম করুক, বাবা। ভিক্ষুকের মত গলায় বলল সে আমার মনে হতে লাগল আমেরিকাতেও আমার স্কুলে চাচা হয়তো ভিক্ষে করেই বেড়াতেন। আমার বোনেরা আমার বকশিশ দেয়ার উদারতা দেখে বেশ অবাক হলো। আমি দুই ফ্রা ফেরত দিলাম এসে বাবাকে।

মা বললেন, তিন ফ্রা খরচ হলো কীভাবে?
বললাম, আমি একটা আধুলি, বকশিশ দিয়েছি লোকটাকে।

মা আমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললেন, তুই পাগল হয়েছিস নাকি? ওই বদমায়েশটাকে দিয়েছিস বকশিশ! বাবার দিকে চোখ পড়তেই মা চুপ মেরে গেলেন। তাদের জামাই না আবার হঠাৎ এসে শুনে ফেলে এই ভয়ে।

কিছুক্ষণ পরই স্টিমার থেকে জার্সির উপকূলরেখা দেখা গেল। আমার খুবই ইচ্ছে করছিল জুল চাচার কাছে ছুটে যেতে। আমার শৈশবের কল্পনার নায়ক ছিল যে লোকটা, তাকে সান্তনা দিয়ে কিছু বলে আসতে মন চাইছিল। কিন্তু ততক্ষণে তাকে আর দেখা গেল না। আর ক্রেতা না পেয়ে হয়তো সরে পড়েছে।

জাহাজ থেকে নামার আগ পর্যন্ত বাবা মা খুব ভয়ে ভয়ে ছিল আবার না দেখা হয়ে যায়। কিন্তু…কিন্তু আমি আমার বাবার সেই ভাইকে জীবনে আর কোনদিন দেখিনি।

অবশেষে আমার বন্ধু যোসেফ দাভখশ ধীরকণ্ঠে বলল, এ জন্যেই দেখবে, আমি প্রায়ই ফকির দেখলে পাঁচ ফ্রা ভিক্ষে দেই।

No comments