প্রাণের চেয়েও মান বড় - শিক্ষামূলক ঘটনা


অনেকদিন আগের কথা। আরবদেশে তখন খলিফাদের আমল। সিরিয়ার রাজধানী দামেশক-এ রোমকবাহিনীর সঙ্গে আরববাহিনীর এক লড়াই শুরু হলো। কেউ কাউকে হারাতে পারছে না। দুই দলের বহু সৈন্য মরছে, জখম হচ্ছে। সেদিন সূর্য প্রায় ডুবুডুবু করছে। দুই দলে চলছে তুমুল লড়াই। হঠাৎ রোমকবাহিনীর কিছু সৈন্য পেছন দিকে গিয়ে আরববাহিনীর উপর হামলা চালাল। আরবের সৈন্যদল এ হামলায় দিশাহারা হয়ে গেল। এরকম বিপদ হবে তারা কেউ ভাবতে পারেনি। আরববাহিনীর লোকেরা নানা দিকে ছিটকে পড়ল। কেউ নিরাপদ জায়গায় গিয়ে জড়ো হলো। হাতিয়ার ফেলে দিয়ে কেউ কেউ পালিয়ে গেল পাহাড়ে। রোমক সৈন্যরা আরবদের ঘাঁটিতে এসে মনের খুশিতে লুটপাট চালাল। ধনরত্ন-হাতিয়ার সবকিছুই লুটে নিল তারা। এমনকি ঘোড়া, তবু এসবও তারা লুট করল। কিন্তু আরবসৈন্যদের সঙ্গে পরিবারের যে মেয়েরা এসেছিল, তাদেরই বিপদ হলো সবচেয়ে বেশি। রোমকবাহিনী ঐ মেয়েদেরকে বন্দি করে নিয়ে গেল। তখন রাত নেমে এসেছে। মনে হচ্ছে, দুনিয়াটা যেন কালো চাদরে ঢাকা। সেদিনের মতো লড়াই থেমে গেছে। সকলেই ক্লান্ত । রাত শেষ হয়ে দিনের আলো ফুটলেই আবার লড়াই শুরু হবে। রোমকবাহিনীর সেনাপতি আদেশ দিলেন, তাঁবু ফেলে সবাই জিরিয়ে নাও। কাল সকালে জোর লড়াই হবে। আরববাহিনী বন্দি মহিলাদের উদ্ধার করার জন্য জান দিয়ে লড়াই করবে। যাক, সে তো কালকের কথা। আজকের মতো সবাই বিশ্রাম নাও। বন্দি মেয়েদের সকলকে একটা তাঁবুতে জড়ো করে সাবধানে রাখবে। ধনরত্ন যা এনেছি, পরে আমি সবাইকে ভাগ করে দেব। তবে ভুলো না, কাল সকালে জোর লড়াই হবে।

এসব কথা বলে সেনাপতি নিজের তাবুতে ফিরে গেলেন। বন্দি আরব মেয়েদেরকে একটা তাবুতে ঢুকিয়ে তার দরজা ভালোমতো আটকে দেয়া হলো। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইল একজন সৈনিক। তার হাতে নাঙা তলোয়ার। রাত তখন অনেক। বন্দি আরব মেয়েদের চোখে ঘুম নেই। মনে তাদের ভয়। এই বন্দিদশা কবে শেষ হবে কে জানে! তারা নানাজনে নানা কথা বলছে। এমন সময় একজন মেয়ে উঠে দাঁড়ালেন। দেখে মনে হচ্ছিল, যেন আগুনের একটি শিখা জ্বলছে। তার দুই চোখের তারায় আগুনঝরা চাহনি। সাহসী এই নারী সবাইকে ডেকে বললেন, এখন আমরা শত্রুর হাতে বন্দি। তাদের হাতের খেলার পুতুল। কিন্তু আমরা তো বীরের জাতি। হতে পারি আমরা মেয়ে, কিন্তু পুরুষদের চেয়ে আমরা কম কীসে? নীরবে চোখের পানি ফেলে আমরা কি দুশমনের হাতে অপমান সইব? বলো বোনেরা আমার, তোমরা কি এমনি করে অসহায়ের মতো বসে থাকবে? বলো আমাকে, তোমরা লড়াই করে প্রাণ দিতে পারবে? প্রাণের চেয়ে মানই তো বড়। তাহলে কেন চুপচাপ বসে থাকব। আমরা? এসো, আমরা দুশমনদের এ বন্দিশালা ভেঙে বেরিয়ে যাই। আমরা বীরের মতো লড়াই করব। খোদা আমাদের সহায় হবেন।

মেয়েটির কথা শুনে আরব মেয়েদের ভাঙা প্রাণে সাহস জাগল। দুশমনের বিরুদ্ধে লড়তে সবাই তৈরি। কিন্তু খালি হাতে লড়াই চলে না। চাই হাতিয়ার। মেয়েরা শেষে তাঁবুর সব খুঁটি ভেঙে ফেলল। সেগুলো দিয়ে তৈরি হলো লাঠি। আর পাথরের টুকরো তো চারদিকেই ছড়ানো। কাজেই আর ভাবনা কীসের? লাঠি আর পাথরের টুকরো হাতে নিয়ে মেয়েরা সাজল রণসাজে। তাঁবুর পাহারাদার এর কিছুই টের পেল না।

রাত্রি শেষ। চারদিকে কারও কোনো আওয়াজ নেই। সব নিঝুম। তাঁবুর বাইরে পাহারাদাররা ঘুমে ঢুলছে। বন্দি আরব মেয়েরা তাবুর দরজা ভেঙে একসাথে বেরিয়ে এলো। প্রথমেই তারা লাঠির এক ঘায়ে পাহারাদারকে কাবু করে ফেলল। তারপর রোমকবাহিনীর যে-ই তাদেরকে বাধা দিতে এলো, পাল্টা আঘাতে সে-ই কাবু হয়ে পড়ল। তারা ভাবতেও পারেনি, এভাবে বন্দি মেয়েরা বিদ্রোহ করে দরজা ভেঙে বেড়িয়ে আসবে। তাদের তাঁবুগুলোতে হৈচৈ পড়ে গেল। সাজ সাজ রব উঠল। রোমক সৈন্যরা ভাবল, আরব সৈন্যরা হয়তো কোনোদিক দিয়ে এসে হামলা করেছে। কিন্তু তাঁবুর বাইরে তো কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তারা অবাক হয়ে দেখল, বন্দি আরব মেয়েরা লাঠি আর পাথরের টুকরো হাতে নিয়ে তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কারও কারও হাতে তলোয়ার আর বর্শা। সেগুলো তারা পাহারাদার রোমক সৈন্যদের হাত থেকে কেড়ে নিয়েছে। দুই দলে শুরু হলো তুমুল লড়াই।

এদিকে আরববাহিনীর শিবিরে কারও চোখে ঘুম নেই। তাদের কারও মা, কারও বোন, কারও মেয়ে রোমকবাহিনীর হাতে বন্দি। সবার মনে ভয়, না জানি মেয়েদের কত অপমান করা হবে।

একদল সাহসী আরব রাতের অন্ধকারেই ঘোড়ায় চড়ে বেরিয়ে এসেছে। বন্দিশালায় হানা দিয়ে তারা মেয়েদেরকে উদ্ধার করে আনবে। মহাবীর খালেদ তাদের দলের নেতা। সাথে আছেন সেনাপতি জেরার। জেরার ছুটেছেন সবার আগে। বন্দি মেয়েদের মধ্যে আছেন জেরারের বোন। বোনের অমঙ্গল চিন্তায় তিনি দিশাহারা।। রোমকবাহিনীর তাঁবুর কাছে পৌছেই জেরার দেখলেন, সেখানে ভয়ানক লড়াই চলছে। বন্দি মেয়েরা বীরের মতো লাঠি আর তলোয়ার হাতে আঘাত হানছে দুশমনদের উপর। জেরার সৈন্যদের নিয়ে লড়াকু মেয়েদের সাথে যোগ দিলেন। জেরারের বোন তার লাঠির আঘাতে রোমকবাহিনীর সেনাপতি পিটারের ঘোড়ার পা ভেঙে দিলেন। অমনি সেনাপতি ঘোড়া থেকে পড়ে গেলেন মাটিতে। সাথে সাথে জেরার তালোয়ার দিয়ে পিটারকে আঘাত করলেন। দুশমনেরা এবার ভয় পেয়ে পালাতে লাগল। শেষে তাদের পরাজয় হলো। বন্দি মেয়েরা যে বীরের মতো লড়াই করেছে এজন্য আরব সৈন্যদের মনে খুব আনন্দ হলো। যে মেয়েটি বন্দিশিবিরে মেয়েদেরকে লড়াই করতে ডাক দিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন সেনাপতি জেরারের বোন। তার নাম খাওলা। ইসলামের ইতিহাসে একজন বীর নারী হিসেবে তার নাম সোনার অক্ষরে লেখা আছে।

No comments