সঙ্কট মোচন – আশাপূর্ণা দেবী
যাবার সময় আরামে যাওয়া হলো। ছোটমামা নিজের গাড়ি করে পৌছে দিলেন। সম্প্রতি নতুন গাড়ি কিনেছেন ছোটমামা। নিজে থেকেই বললেন, অফিসার্স ক্লাবে যাবে তোমরা? কি সেখানে? নজরুল জয়ন্তী? ঠিক আছে, আমার গাড়িতেই চলো না, এই তো পথ আমার।
ছোটমামার যে ওইটাই পথ, সেটা আমরাও জানতাম, মনের মধ্যে খেলছিলো সে কথা, কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারছিলাম না। কি জানি, যদি আমার গাড়িওয়ালা আলমগীর কাকার মতো বলে বসেন, বলছিস যখন, তখন নিশ্চয়ই পৌছে দেবো, তবে আমি তো এখন টানা সেখানে যাচ্ছিনা, পল্টনে একটা দরকার আছে সেটা সেরে যাবো ভাবছিলাম। থাক, ও আর একদিন হবে। একটু অসুবিধে হবে; এই আর কি!
বলাবাহুল্য তবুও আলমগীর কাকার গাড়িতে সেদিন চড়তেই হয়েছিলো আমাদের।
থাক তোমার অসুবিধা ঘটিয়ে যেতে চাই না বলে অপমান তো করতে পারিনা গুরুজনকে?
কুইনিন মিকশ্চার খাওয়ার মুখ আর মন নিয়ে গাড়িতে উঠেছিলাম। কাজেই আজ আর ছোটমামাকে বলিনি। কিন্তু ছোটমামা নিজেই বললেন কথাটা।
ভাগ্য ভাল বললেন। নাহলে কোনো শুক্রবার বিকেলে একখানা ট্যাক্সি যোগাড় করা তো কম দুরুহ হতো না। হয়তো গাড়ি পেয়ে অফিসার্স ক্লাবে পৌছোতে আমাদের ক্লাবের নজরুল জয়ন্তীর অর্ধেকই শেষ হয়ে যেতো।
মহোৎসাহে ঠিক হয়ে নিলাম, আমি, সেজআপু, সেজ আপুর জামাই আর সেজআপুর নদেরচাঁদ ছেলেটি!
হ্যা, ওকে আমি নদেরচাঁদই বলি। তিন বছরের ছেলে একেবারে গুণের আধার।
স্বর্গ মর্ত পাতাল, ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান, বায়ু পিত্ত কফ, আজ কাল পরশু, সাপ ব্যাং মাছ কী নেই ওর মধ্যে? কী না গজগজ করছে ওর মগজে?
আমার যে খুব একটা ইচ্ছে ছিলো ওকে নিয়ে যাই তা নয়, নিয়ে যেতে বাধ্য হলাম সেজো জামাইবাবুর রাগ করার ভয়ে। ছেলে যে একেবারে ওঁর চোখের মণি, গলার হার, প্রাণের পুতুল! কাজেই শুধু নিয়ে যাওয়াই নয়, এমন ভাব দেখাতে হলো যেন ওকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া আর বিচিত্রানুষ্ঠান শোনাই আমাদের আজকে অভিযানের একমাত্র লক্ষ্য।
জামাইবাবুর অলক্ষ্যে মাকে অবশ্য একবার বলেছিলাম, মা তুমি ওকে রাখো না? বলোনা যে, ওকে অনেকক্ষণ না দেখে তোমার মন কেমন করবে।
মা দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে শিউরে উঠে বললেন, মাফ করো। তোমার ভাগ্নেকে সামলাই, এই বুড়োহাড়ে সে শক্তি নেই।
সেদিন তোর বোন আমার কাছে রেখে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল। বাবা, চোখে ঘেটুফুল দেখিয়ে ছেড়েছে।
অগত্যাই বলতে বাধ্য হই, চলুন জামাইবাবু, চলোতো নদেরচাঁদ, বলে গাড়িতে উঠলাম।
নদেরচাঁদ অবশ্য ঠেলে গিয়ে সামনে বসলো, তাই সে বসে গাড়ি চড়ার চেয়ে গাড়ি চালানোতেই তার ঝোক বেশি। শিখ ড্রাইভারের গায়ে ঘেসেও বসে ও। তারপর চললো ওর অভ্যাসমতো প্রশ্নজাল নিক্ষেপ ।
এটা কি …ওটা কি?…এ কেন ?…ও কেন? সোজা রাস্তায় যাচ্ছোনা কিজন্য?.. খালি খালি গাড়ি থামিয়ে দাড়াচ্ছো কিজন্যে? পেট্রল দিয়ে কি হয়! গাড়িতে আলো কেন জ্বলে? ইত্যাদি ইত্যাদি।
ব্যস তারপরেই ছোটমামাকে ঠেলাঠেলি আমার তো সব শেখা হয়ে গেছে, এবার তুমি সরো, চাকাটা আমায় দাও-চালাই। তুমি চালাবে? হতবুদ্ধি ছোটমামা বলেন, বুড়ো হও, তখন চালিও।
নদেরচাঁদ রেগে আগুন হয়ে বললো, তখন তো তুমি মরে যাবে। তোমার গাড়ি ভেঙে যাবে। গাড়ি কোথায় পাবো আমি?
সেজআপুর দিকে তাকাই, দেখি সেজআপু রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে অন্যমনস্কভাবে। কতো কষ্টে যে ছোটমামা আত্মরক্ষা বা গাড়ি রক্ষা করে আমাদের পোছে দিলেন। নামার সময়ে বললেন, মীরা তোর ছেলেটা তো আশ্চর্য ইন্টেলিজেন্ট! এ ছেলে কালে-ভবিষ্যতে নির্ঘাৎ দারোগা হবে।
মনে মনে বললাম ও ছেলে যে ভবিষ্যতে কী হবে ছোটমামা আল্লাহই ভালো জানে!
যাক, অফিসার্স ক্লাবে ঢুকে নিজেদের চেয়ার দখল করে বসলাম। একটু দেরি হয়ে গেছে দেখছি আসতে। অবশ্য ভালোই হয়েছে। সভাপতি আর প্রধান অতিথির বস্তৃতা শেষ গেছে। শুরু হল বিচিত্রানুষ্ঠান আর যা ভেবেছিলাম তাই। তার সঙ্গে আমাদের চেয়ার থেকে চললো বিচিত্র শব্দানুষ্ঠান। মানে আলো কিঞ্চিত কমিয়ে দেয়া মাত্রই নদেরচাঁদ চেচায়, এতো অন্ধকার কেন? আমার ভয় করছে।
আলো সবগুলো জ্বলে উঠলেই বলে, বাতি এতো গুলো কেন? আমার চোখ জ্বালা করছে।
গান শুরু হলে বলে, বাহারি মেয়েগুলো নাচছে না কেন? নাচ চলতে থাকলে বলে, আগের মেয়ে গুলো গাইছে না কেন? শেষ অবধি যন্ত্রসঙ্গীতের সময়ে এমন যন্ত্রণা দিতে শুরু করলো যে, জামাইবাবুর গোসার ভয়ে ভুলে বলে ফেললাম, চল তোকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়ে আসি। পর মুহুর্তেই অবশ্য জামাইবাবু থামালেন আমায়, ভয় দেখিও না হে, ভয় দেখিও না। ছোটো ছেলেকে ভয় দেখানো অপরাধ। অগত্যা আমি চুপ। হঠাৎ এক ছোকড়া স্টেজে এসে বসলো তবলার খেল দেখাতে।
তবলা লহড়া! তবলা লহরা!
মনে হলো, এতোক্ষণে তো নদেরচাঁদের মনের মতো অনুষ্ঠান শুরু হলো কারণ মহোৎসাহে চেয়ারে দাড়িয়ে উঠে পাশের প্রৌঢ় ভদ্রলোকের টাকে তবলার খেল শুরু করে দিলো নদেরচাঁদ।
আর বসে থাকা চললো না।
আশে পাশের লোকের বদন তো সর্বক্ষণ আমাদের দিকেই ছিলো। এবার বচন ছিটকে আসতে লাগলো রিভলবারের গুলির মতো। এরকম বেয়াড়া ছেলে নিয়ে এখানে কেন ? এ ছেলের উপযুক্ত জায়গা তো মশাই চিড়িয়াখানা। ছেলে নিয়ে আদর দেখাতে হয় তো মাঠে যান না। এতোখানি বয়সেও এমন একখানা চিজ তো দেখিনি বাবা!
আর পারলাম না। বললাম, সেজআপু, তোমরা অভিনয় দেখো! আমি একে নিয়ে চলে যাচ্ছি। সেজআপু বললো, আহ, তুই দেখবি না?
বহু কষ্টে মেজাজ সামলে বললাম, আমরা ঢাকার লোক, ফাংশন অনেক দেখেছি, অনেক দেখবো। অনুষ্ঠান নিয়েই আছে ঢাকা। আমার জন্যে হা-হুতাশের দরকার নেই, তোমরা দেখো। জামইাবাবু বেদনাতুর কণ্ঠে বললেন, আহা, খোকা দেখবে না! কী ফূর্তি করে দেখছিলো।
আমি যেন সে কথা শুনতেই পাইনি, উৎসাহ দেখিয়ে বলি, আয় নদেরচাঁদ, ট্যাক্সি চড়বি আয়। ট্যাক্সি চড়তে নদেরচাঁদ এক পায়ে খাড়া। ট্যাক্সি চড়বো বললে ও জাহান্নামে যেতেও প্রস্তুত।
বেরিয়ে পড়লাম।
বেরিয়ে ফুটপাথের ধারে দাড়ালাম।
দাড়ালাম মানে কি ?
তীর্থের কাকের মতো দাড়িয়েই রইলাম। দশ মিনিট…বিশ মিনিট…আধ ঘন্টা..এক ঘন্টা, দেড় ঘণ্টা.. কিন্তু কোথায় ট্যাক্সি? মানে, কোথায় খালি ট্যাক্সি?
কোথায় সেই লাল আলোর মুকুটধারিণী ট্যাক্সি।
নেই নেই; অন্ধকার! সবাই পেট ভর্তি লোক নিয়ে ছুটছে।
কতোক্ষণ আর দাড়াবে, কতোকাল?
ক্রমেই রাত বাড়ছে। নাকের সামনে দিয়ে অনবরত সাঁ সাঁ করে ট্যাক্সি বেরিয়ে যাচ্ছে হয়তো একটিমাত্র আরোহী নিয়েও। খালি কিনা বুঝতে না পেরে মুক্তকণ্ঠে উর্ধ বাহু হয়ে ছুটে গিয়ে পরিত্রাহি চেঁচাচ্ছি, ট্যাক্সি—ট্যাক্সি। তারপর লজ্জা পেয়ে সরে আসছি। রাস্তার লোক হাসছে। হতাশ হয়ে বলি, আজ ট্যাক্সি নেই; চল নদেরচাঁদ, ট্রামে যাই। বলামাত্রই নদেরচাঁদ ফুটপাথে বসে পড়ে বলে, না-আ-আ-আমি ট্যাক্সি চড়বো ।
–দেখছিস তে ট্যাক্সি নেই।
–ওই তো যাচ্ছে।
–ও তো সব লোক ভর্তি।
–ওদের টেনে নামিয়ে দাও না।
–চমৎকৃত হয়ে বলি, টেনে নামাবো কি করে? ছুটে চলে যাচ্ছে না গাড়িগুলো?
–ইট মেরে থামাও না গাড়ি।
–বাঃ, বেশ তো! ওরা ভাড়া করেছে না গাড়ি?
–নদেরচাঁদ বলে, আর আমরা বুঝি ভাড়া করতে পারবো না?
–পাচ্ছি না যে।
—তুমি একটা বোকা বুদ্ধ! বলে ওঠে নদেরচাঁদ, সবাই পাচ্ছে, তুমিই পাচ্ছো না কেবল ।
–আমি বুদ্ধ! স্তম্ভিত হয়ে বলি।
–না তো কি! চেচিয়ে ওঠে নদেরটাদ, ওই তো, ওই যাচ্ছে আরে, ও যে মানুষের নিজেদের গাড়ি।
নদেরচাঁদ ফুটপাথে বসে পড়ে বলে, আমি লোকেদের গাড়িতেই চড়বো তবে।
ভিড় জমে ওঠার ভয়ে মোড়ে চলে যাই। এ মোড় থেকে অন্য মোড়ে। হা করে দাড়িয়ে থাকি। কিন্তু ট্যাক্সি কই? ক্রমশঃ রাত বেড়ে ওঠে, রাস্তা ঝিমঝিমে হয়ে যায়। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি নো ট্যাক্সি।
নো ট্যাক্সি!
এ রকম অবস্থা আর কারোর কখনো ঘটেছে কিনা জানি না, আমার অন্তত ঘটেছে। সমস্ত ট্যাক্সি সমাজ যেন আমাকে, বিশেষ করে আমাকেই বয়কট করেছে। সত্যি, জীবনে এতো অপদস্থ কখনো হইনি। কারণ নদেরচাঁদ তখন প্রবল আন্দোলন শুরু করেছে। খিদে পেয়েছে। দাড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে না।
কাতর হয়ে বলি, ভালো কি আমারই লাগছে রে, দেখছিস তো? চল বাবা, বাস-গাড়িতেই চলে যাই।
—না—আ-আ-নদেরচাঁদ সমস্ত রাস্তা সচকিত করে বললো, ট্যাক্সি চড়বো।
কান পাকড়ে টেনে এক থাপ্পড় বসাবার বাসনা অতিকষ্টে পরিহার করে বলি, পাচ্ছি না, দেখছিস তো ?
–কেন পাচ্ছো না?
–কি করে বলবো?
–তুমি ওদের টাকা দিচ্ছো না, তাই আসছে না। অম্লান বদনে বলে তিন বছরের ছেলেটা।
রেগে উঠে বলি, এলে তবে তো টাকা দেবো? লোক চড়িয়ে ছুটে চলে যাচ্ছে, কাকে টাকা দেবো রে?
–তোমায় দেখেই ওরা বুঝতে পারছে, তুমি টাকা দেবে না।
সমস্ত শরীর রাগে বিমঝিম করতে থাকে ।
হতাশভাবে বলি, বাপ নদেরচাঁদ, কাল তোমাকে অনেক ট্যাক্সি চড়াবো। আজ ট্রামে চলো।
–না-আ-আ-আ!
-বড়ো বড়ো রসগোল্লা খাওয়াবো।
-না-আ-আ।
–অনেক ঘুড়ি কিনে দেবো।
-না-আ-আ-আ।
পথ চলতে চলতে লোক থমকে দাড়িয়ে পড়ে! আর পারি না। সহ্যেরও একটা সীমা থাকে আরকি। সে সীমা অতিক্রম করলে কে পারে স্থির থাকতে? টেনে একটি লম্বা চড় কষিয়ে দিতে হাত তুলি, সহসা নদেরচাঁদ ছাগল ছানালাফিয়ে-চলার ভঙ্গীতে টেনে লাফিয়ে ফুটপাথ থেকে প্রায় রাস্তায় নেমে পড়ো পড়ো হয়ে চিৎকার করে ওঠে, ওই তো ওই তো, ওই একটা লাল দাগকাটা গাড়ি আসছে। ওইটা চড়বো আমি।
লাল দাগকাটা গাড়ি! সেটা আবার কী?
চোখ ফিরিয়ে দেখি, দূরে মোড়ের কাছে আসছে একখানা রেডক্রসের গাড়ি
-ওই গাড়িতে চড়বো আমি, ওই লাল দাগকাটা গাড়িটায় চড়বো।
পাছে রাস্তায় নামে তাই প্রবল হ্যাচ কায় ওর একটা হাত টেনে ধরে রেখে খিচিয়ে উঠি, ওটা চড়বি মানে? ওটা কি ট্যাক্সি, ওতে হাত পা ভাঙলে চড়ে লোকে, ওরা চড়িয়ে নিয়ে যায়। পড়ে হাত পা ভাঙ্গো, তাহলে তুলে নিয়ে যাবে।
কথা শেষ হয়েছে, আর পর মুহুর্তে—নাঃ পর মুহুর্তের কথা ঠিক বর্ণনা করবার সাধ্য আমার নেই। জীবনেও হবে না। কারণ ঠিক সেই সময়টার কথা ভাবতে গেলেই আমার চোখ কান মাথা মন বোঁ বোঁ করে ঘুরে ওঠে।
যে মুহুর্তে নদেরচাঁদের মন-ভোলানো সেই লাল দাগকাটা গাড়িটা কাছাকাছি এসে গেছে ঠিক সেই মুহুর্তে আমার হাতে একটা প্রবল হ্যাচকা টান অনুভব করলাম, ব্যস, তারপর আমার হাত ফাক, মন ফাকা, বিশ্বজগৎ ফাকা!
শুধু নদেরচাঁদের শানানো গলায় একটা কথা কানে এলো, তবে আমি হাত পা-ই ভাঙবো। তারপর বাড়ি!
সেজআপু আর সেজো জামাইবাবু ফিরে এসেছেন বাসে চড়েই। বসে আছেন ঘরের মাঝখানে, আশেপাশে গোল হয়ে বাড়ির সবাই। সকলের মুখেই এক কথা, একটা এক ফোটা ছেলেকে একটু ভুলিয়ে ভালিয়ে সামলাতে পারলি না? এই কাণ্ড করলো? কী উত্তর দেবো?
এখন বলা চলে না, ওটি কি এক ফোটা? সে যে মহাসমুদ্র! না, আমার কিছুই বলা শোভা পায় না।
সেজআপু অনেকবারের পর আরো একবার শিউরে উঠে বলে, এ সবের কিছুই হতো না, যদি আমাদের কাছেই থাকতো। সেজো জামাইবাবু আমার দিকে তীব্র দৃষ্টিপাত করে বললেন, কলকাতার বাবুর প্রেষ্টিজে বাধলো যে কী না, ছেলে দুষ্টুমি করেছে! কচি ছেলে দুষ্টুমি করবে না তো কি মালা জপ করবে? কলকাতার ছেলেরা করে না দুষ্টুমি?
আমার কাছে উত্তর নেই।
কারণ, না হয় বিপদ হয়নি, হলে কী না হতে পারতো!
কিন্তু হঠাৎ কয়লা থেকে হীরে ঝলসানো, মরুভূমি থেকে ঝরনা বের হলো!
নদেরচাঁদ চৌকিতে বসে পা দোলানো থামিয়ে, হঠাৎ আমার কাছে এসে আমার গলাধরে বলে উঠলো, সবাই মিলে মামুকে বকছো কেন তোমরা? আমিই তো চালাকি করে পড়ে গিয়ে ওই হাত-পা ভাঙার গাড়িটাকে ধরলাম। পড়ে গেলাম বলেই তো ওরা গাড়িটা থামালো, আর আমার হাত-পা ভেঙেছে ভেবে গাড়িতে তুলে নিলো। মিছিমিছি অজ্ঞান হয়েছিলাম তো আমি!
-তা তো হয়েছিলে, সেজআপু রেগে উঠে বলে, আর যদি গাড়ির তলায় পড়তিস?
নদেরচাঁদ বীরবিক্রমে বলে ওঠে, ইস, পড়বো কেন? আমি তো চালাকি করে ফুটপাথের ওপর পড়েছিলাম। ওরা তুলে নিয়ে বাড়িতে পোছে দিলে বুঝি ভালো হয় না? ট্যাক্সি চড়ার মতোই তো মজা লাগে ।
মজা হয়তো নদেরচাঁদের লেগেছিলো, তবে আমার নয়। কিন্তু একথা সত্যি, ট্যাক্সির সঙ্কট ঘুচিয়ে দিয়েছিলো নদেরচাঁদ ও পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পথের লোক হৈ হৈ করে উঠেছিলো। আর ঘ্যাচ করে থেমে গিয়েছিলো রেডক্রসের গাড়িটা। তা রাস্তায় পড়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ছেলেটাকে তো ওরা তুলবেই, গাড়িতেই তুলে নেবে! পরহিত ব্রতই যখন কাজ ওদের। কিন্তু ওরা কি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পেরেছিলো, ওই তিন বছরের ছেলেটা এতো বিচ্ছু যে, অজ্ঞানের ভান করেছিলো!
–চোখ বুজে না থাকলে ওরা যে ভাববে, হাত-পা ভাঙেনি আমার। বাড়ি এসে বললো নদেরচাঁদ। তাই তো চোখ বুজে ছিলাম।
চোখ খুলেছিলো নদেরচাঁদ গাড়ি খানিকটা চলার পর। চলছিলো সেই গাড়ি অবশ্য মেডিকেল কলেজের দিকেই, কিন্তু গতি ফেরাতে হলো। নদেরচাঁদ আচমকা চোখ খুলে উঠে বসে চেঁচাতে শুরু করলো, মা’র কাছে যাবে।
ওরা অনেক করে বুঝালো, বললো, মা’র কাছে যাবে, তার আগে একবার ডাক্তারের কাছে যেতে হবে তো? তিনি ওষুধ দেবেন কিন্তু নদেরচাঁদ কথায় ভিজবার চিঁড়ে নয়। তাই চেঁচানির মাত্রা আরো বাড়ালো, কেন ওষুধ দেবেন? আমার কি কিছু ভেঙেছে? এইতো সব আস্তই আছে। এই তো হাত, এই তো পা।
শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে বাড়িতেই পৌছে দিয়ে গেলে তারা। সই নিলো আমার। বাড়ি থেকে নিলো বাবার, দাদার। যাতে এরপর আর না আমরা নালিশ করতে যাই, রেডক্রসের গাড়ি কর্তব্য কর্মে অবহেলা করেছে বলে।
ওরা চলে যেতেই নদেরচাঁদ কান্না-টান্না থামিয়ে সহজ গলায় বললো, দেখলে, কেমন বাড়ি চলে এলাম, আর দাড়িয়ে থাকতে হলো না রাস্তায়।
এখনও তেমনি সহজ গলায় বললো, তোমাকে বেশ ভাড়া দিতে হলো না। খুব মজা—না, মামা?
Post a Comment