মৃত্যুচক্র – মার্ক টোয়েন


অলিভার ক্রমওয়েলের সময়ের কাহিনী। কমনওয়েলথ সেনাবাহিনীতে তার সমসাময়িক পদস্থ অফিসারদের মধ্যে ত্রিশ বছর বয়স্ক কর্নেল মেফেয়ার ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। সতের বছর বয়সে সামরিক জীবনের শুরু করে যুদ্ধে দীর্ণ পিঙ্গল শরীর নিয়ে তখন কর্নেল এই অল্প বয়সেও একজন নিপুণ সৈনিক। বহু রণক্ষেত্রে তিনি যুদ্ধ করেছিলেন এবং নিজের শৌর্য প্রদর্শন করে ক্রমে ক্রমে সেনাবাহিনীতে উচচপদ ও সাধারণ্যে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। কিন্তু তবু এই মুহূর্তে গভীর অস্থিরতায় নিমগ্ন, তার ভাগ্যের ওপর কোথেকে এক ছায়া নেমে এসেছে।

শীতার্ত সন্ধ্যায় তখন বাইরে ঝড়ের মাতলামো আর অন্ধকার। ভেতরে বিষন্ন নির্জনতা। কারণ, কর্নেল এবং তার তরুণী স্ত্রী তখন কথার উত্তাপে তাদের বেদনাকে অপসারিত করার চেষ্টা করে নিশ্চুপ। অপরাহ্নের পাঠের অধ্যায় আর প্রার্থনা সমাপ্ত করে তখন তাদের হাতে হাত রেখে নির্জন হয়ে বসে চুল্লির আগুনের দিকে চেয়ে থাকা, চিন্তার আলস্যে নিজেদের সমর্পিত করে অপেক্ষায় দীর্ঘ প্রহর গোনা ছাড়া আর কোনো কাজ ছিল না। তারা জানতেন, তাদের অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে আর সে-কথা চিন্তা করেই কর্নেলের স্ত্রী থরথর করে কেঁপে উঠল এক সময়। সাত বছর বয়সের কন্যা অ্যাবি ছিল তাঁদের প্রাণপ্রতিম একমাত্র সন্তান। এক্ষুণি হয়তো সে আসবে শুভরাত্রির বিদায়-চুমু খেতে। আর সেজন্যই বোধ হয় কর্নেল এই বিষন্ন নীরবতা ভাঙলেন। বললেন,
: অন্তত ওর জন্যে তোমার চোখের পানি এবার মুছে ফেল। এস, আমরা সব ভুলে সুখী হই। অল্পক্ষণের জন্য হলেও যা ঘটবে, তাকে ভুলে থাকতে হবে আমাদের। বেশ, তাই হবে। কান্নায় ভেঙে পড়লেও আমি সব ভুলে যাব। নিঃসঙ্গ হয়ে অন্ধকারে ডুবে থাকব।।

: হ্যা, আমাদের নিয়তিকে আমরা গ্রহণ করব, বহন করৰ অবিচলিত ধৈর্যে। জানব তিনি যা করেন, তা-ই সত্যিকারের ন্যায় আর সত্যিকারের দয়া।
: তার ইচ্ছাই পূর্ণ হবে। আমার সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে আমি তাই কামনা করি— আমার সমস্ত হৃদয় দিয়ে আমি যদি তাই বলতে পারতাম! যদি পারতাম, এই প্রিয় হাত যাকে আমি শেষবারের মতো স্পর্শ করছি, চুমু খাচ্ছি—
: লক্ষ্মীটি চুপ কর, ওই সে আসছে।
রাত্রিবাস পরিহিত কোঁকড়ানো চুল ছোট্ট একটি শরীর দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করল। ছুটে গেল বাবার দিকে। আর ছোট্ট মেয়েকে বুকে চেপে ধরে বারবার চুমু খেলেন কর্নেল মেফেয়ার।
: তুমি আমাকে ওভাবে চুমু খাচ্ছ কেন বাবা? আমার চুল যে নষ্ট হয়ে যাবে।
: না মা, আমাকে ক্ষমা কর। আমি আর ওভাবে চুমু খাব না।
: সত্যি বাবা, সত্যি করে বল, তুমি দুঃখ পেয়েছ?
: তুই নিজে বুঝতে পারছিস না, মা। কর্নেল এবার নিজের দু-হাতে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন।
বাবার এই করুণ অবস্থা দেখে ছোট্ট মেয়ে এবার কেঁদে উঠল। বাবার হাত-দুটো নিজের হাত দিয়ে টেনে বলল,
: না বাবা তুমি কেঁদো না, কেঁদো না। আমি তোমাকে দুঃখ দিতে চাইনি বাবা। আমি আর কোনোদিন এমনটি বলব না। বাবা তুমি কেঁদো না।
বাবার হাত দুটো টেনে এবার খানিকটা সরিয়ে আনল অ্যাবি। বাবার চোখ-দুটো দেখতে পেল। আর দেখেই উচ্চকণ্ঠে বলে উঠল, ; তুমি কী দুষ্টু বাবা! তুমি একটুও কাঁদছ না। তুমি একটুও দুঃখ পাওনি। তুমি শুধু শুধু আমাকে বোকা বানাচ্ছে। আমি আর তোমার কাছে থাকব না। এই আমি মায়ের কাছে চললাম। এই বলে অ্যাবি সত্যি বাবার কোল থেকে নেমে যাচ্ছিল। কিন্তু ওর বাবা এবার ওকে দু-হাতে কাছে টেনে আনলেন। জড়িয়ে ধরে বললেন,
: না মা, তুই আমাকে ছেড়ে যাবি না। আমি দুষ্টু ছিলাম, এটা স্বীকার করছি কিন্তু আর আমি দুষ্ট থাকব না, মা। আর তুই আমাকে যা শাস্তি দিবি, আমি তা মেনে নেব। বল মা, বল।
ছোট্ট মেয়ে অ্যাবি তক্ষুনি শান্ত হয়ে এল। আগের সেই প্রফুল্লতা ফিরে এল তার মুখে। বাবার গালে সে তার ছোট্ট হাত দিয়ে আদর করতে করতে বলল,
: তবে একটা গল্প বল-না বাবা, একটা খুব ভালো গল্প।
বাইরে কেমন একটা শব্দ হল অকস্মাৎ। সবারই নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল প্রায়! উৎকর্ণ হল সবাই। বাতাসের উদ্দামতার মধ্যে সহসা বুঝি ক্ষীণ পায়ের শব্দ শোনা গেল। ক্রমশ সেই শব্দ নিকট থেকে নিকটতর হল, তারপর ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। নিঃসঙ্গ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল সবাই। আর কর্নেল তার ছোট্ট মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন,
: একটা গল্প, না মা? খুশির গল্প?
: না বাবা, খুশির গল্প নয়, একটা খুব ভয়ানক গল্প।
বাবা একটা খুশির গল্প বলতে চাইলেন। কিন্তু মেয়ে নাছোড়বান্দা। সে ভয়ানক একটা গল্প শুনবেই। বাবার সঙ্গে তার শর্ত ছিল সে যা চাইবে তাই হবে। বাবা তার একজন খ্যাতনামা সৈনিক। তিনি কথা দিয়েছেন সে কথা রাখতেই হবে। ছোট্ট মেয়ে এবার বলল, না বাবা, আমাদের সবসময় খুশির গল্প শোনা উচিত নয়। ধাই-মা বলে, মানুষের সব সময় খুশিতে কাটে না। আচ্ছা বাবা, এটা কি সত্যি? ধাই-মা তাই বলে বাবা। তুমি বল-না, সত্যি কি না?
মা কেমন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তাঁর সমস্ত চিন্তা তার আগেকার সেই অস্থিরতায় নিমজ্জিত হল। শান্ত গলায় বললেন, হ্যা মা এটা সত্যি। আমাদের দুঃখ আসে। করুণ, কিন্তু তবু এটা সত্যি মা।

তাহলে সেই রকম একটা গল্প বল, বাবা। যেন আমরা ভাবতে পারি আমরাই সেই গল্পের লোক। এমন গল্প বাবা, যাতে আমরা ভয়ে কাঁপতে থাকি। মা, তুমি আরো কাছে এসে বস। আমার একটা হাত ধর। যাতে আমরা ভয়টাকে কাটাতে পারি। এবার তুমি শুরু কর, বাবা।

কর্নেল নিজেই ইচ্ছে করে একটু নড়েচড়ে বসলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন, একদা এক সময়ে তিনজন কর্নেল ছিলেন!
: হ্যায় আল্লাহ। আমি কর্নেলদের জানি। তুমিই তো একজন কর্নেল, বাবা। বল।
: একবার এক যুদ্ধে সেই কর্নেলরা একটা আইন ভঙ্গ করলেন।
বাবার কথা শুনে ছোট্ট মেয়ে অ্যাবি আনন্দিত হয়ে লাফিয়ে উঠল। বাবার দিকে মুখ তুলে বলল,
: কী ভাঙল, বাবা? কোনো খাওয়ার জিনিস? মা আর বাবা দুজনেই এবার স্মিতভাবে প্রায় হেসে উঠলেন। তারপর বাবা বললেন : না মা, ঠিক তার উল্টো! সেই কর্নেলরা তাদের যা করা উচিত নয়, তাই করেছিলেন।
: কী করেছিলেন?
: না মা! যুদ্ধে যখন হেরে যাচ্ছে ঠিক তেমনি সময় ওদেরকে বলা হয়েছিল শত্রুসৈন্যের ওপর একটা প্রচণ্ড আক্রমণের ভান করতে যাতে করে কমনওয়েলথ বাহিনী নিরাপদে পশ্চাদপসরণ করবার সুযোগ পায়। কি অতি উৎসাহী সেই তিনজন কর্নেল আক্রমণের ভান না করে শুক্রসৈন্যের ওপর সত্যি সত্যি আক্রমণ করে বসল। আর ঋড়ের মতন সেই আক্রমণে শত্রুসৈন্য বিপর্যস্ত হয়ে পরাজিত হল। লর্ড জেনারেল তাই তাদের ওপর খুব বিরক্ত হলেন, তালের প্রশংসাও করলেন খুব–তারপর তাদের অপরাধের বিচারের জন্য তিনজনকেই লন্ডনে পাঠিয়ে দিলেন।
: তুমি কি মহান ক্রমওয়েলের কথা বলছ, বাবা?
: হ্যা, মা।।
: আমি তাকে দেখেছি, বাবা। আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যখন তিনি বিরাট ঘোড়ায় চড়ে রাজসিকভাবে চলে যান তার সমস্ত সৈন্য-সামন্ত নিয়ে—তখন দেখতে কী অপূর্ব লাগে। আমি ঠিক তোমাকে বোঝাতে পারব না বাবা। কিন্তু মনে হয় যেন তিনি পরিতৃপ্ত নন। তাকে দেখে সবাই ভয় পায়। আমার কিন্তু একটুও ভয় লাগে না, বাবা। একটুও না।
: তারপর সেই কর্নেলদের বন্দি করে নিয়ে আসা হল লন্ডনে। শেষবারের মতো তাদের নিজেদের পরিজনের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেয়া হল।
হঠাৎ আবার সেই পায়ের শব্দ শোনা গেল। সবাই উৎকর্ণ হয়ে উঠল। আবার সেই পায়ের শব্দ শোনা গেল। আর ক্রমশ আবার তা মিলিয়ে গেল ঝড়ের শব্দের সঙ্গে অন্ধকারে। কর্নেলের তরুণী স্ত্রী এবার তার স্বামীর কাধে মাথা রেখে নিজের চেহারার বিবর্ণতাকে গোপন করার প্রয়াস পেল।
: আজ সকালে তারা এসেছে। এবার ছোট্ট অ্যাবি বিস্ফারিত চোখে বলল,
: হ্যাঁ, বাবা, এটা কি সত্যি কাহিনী?
: হ্যা মা।
: আঃ, কী ভালো! বল বাবা, এটা আরো সুন্দর। বল বাবা, তুমি বলে যাও। এ কী মা! তুমি কাঁদছ?
: না বাছা, তুমি কিছু ভেব না। ও কিছু নয়। আমি হতভাগ্য পরিবারগুলোর কথা ভাবছিলাম।
: কিন্তু তুমি কেঁদো না, মা। দেখবে, এখনি সব ঠিক হয়ে যাবে। গল্পের প্রথমে এমনই হয়। তারপর সবাই সুখী হয়। তুমি বলে যাও, বাবা ও মায়ের কান্না থামুক।
: বাড়ি যেতে দেবার আগে ওদেরকে একবার দুর্গের চুড়োয় নিয়ে যাওয়া হল।
: আমাদের বাড়ি থেকে তো সেই দুর্গের চুড়া দেখা যায়, বাবা।
: তারপর সেই দুর্গের চুড়োয় সামরিক আদালতে তাদের ঘণ্টাব্যাপী বিচার হল। তারা বিচারে দোষী প্রমাণিত হল আর পরিণামে তাদের হত্যা করার আদেশ দেয়া হল।
; হত্যা।হ্যাঁ বাবা?
: হ্যা, হত্যা-বাবার কণ্ঠ এবার কেমন গম্ভীর হয়ে এল।
: আঃ, কী অলুক্ষণে! তুমি আবার কাঁদছ মা। না মা, তুমি কেঁদো না। দেখবে, এবার গল্পের ভালো অংশ শুরু হবে। হ্যা বাবা, এবার খুব তাড়াতাড়ি বলতো। দেখছ-না, মা কেমন অধৈর্য হয়ে উঠেছে।
: হা মা, সত্যি। আমি মাঝে মাঝে থেমে যাচ্ছি বলেই হয়তো এমন হয়েছে।
: তাইতো বলছি বাবা, তুমি থেমো না।
: বেশ তাই হোক। সেই তিনজন কর্নেল,
: তুমি কি তাদের চেন, বাবা? : হ্যা, মা।
: আহা, আমিও যদি চিনতাম! আমি কর্নেলদের ভালোবাসি, বাবা। তাঁরা কি আমাকে চুমু খেতে দেবে?
এবার জবাব দেওয়ার সময় কর্নেল মেফেয়ারের কণ্ঠ থরথর করে কেঁপে উঠল। বললেন, তাদের একজন নিশ্চয়ই দেবে, মা! নে মা, ওর কথা ভেবে আমার হাতে চুমু খা।
: ওঁদের তিনজনের জন্যেই আমি চুমু খেলাম, বাবা। ওঁরা নিশ্চয়ই আমাকে চুমু খেতে দিতেন। আমি বলতাম, আমার বাবাও একজন কর্নেল—ওঁদের মতোই সাহসী। আর তাহলে নিশ্চয়ই ওঁরা আমাকে না বলতে পারতেন না। তুমি কী বল, বাবা?
: হ্যা মা, প্রভু জানেন, নিশ্চয়ই তারা দিত।
: না মা, তুমি ওভাবে আর কেঁদো না। এইতো বাবা গল্পের ভালোর দিকে এসে পড়লেন! বল, বাবা।
: সবাই দুঃখিত হল ওদের জন্য। সামরিক আদালতেরও সবাই। তারপর তারা সবাই মিলে সেই মহান জেনারেলের কাছে গেল। জানাল, তারা তাদের কর্তব্য পালন করেছে। তুই বুঝতে পারিস মা, এটাই তাদের কর্তব্য ছিল। আরো প্রার্থনা জানাল, ওদের যে-কোনো দুইজনকে মৃত্যু থেকে রেহাই দেয়া হোক। কারণ, সৈন্যবিভাগে দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য একজনের মৃত্যুই যথেষ্ট, কিন্তু জেনারেল অতি কঠোর লোক। তিনি সামরিক আদালতের সদস্যদের তিরস্কার করলেন। কারণ, তারা তাদের কর্তব্য শেষ করার পর এবং নিজেদের বিচার-বুদ্ধি মতে সিদ্ধান্তে পৌঁছার পর তার কর্তব্য সীমিত করার জন্য তাকে প্রভাবিত করতে চাইছে যা তার সৈনিক-সুলভ মর্যাদার ওপর কলঙ্ক লেপন করবে। কিন্তু তারা জেনারেলকে জানাল যে, তারা তাঁর কাছ থেকে এমন বিশেষ কিছুই চাইছে না। কারণ, তারা যদি তার জায়গায় থাকত এবং এই অসীম ক্ষমতা ও ক্ষমা করার অধিকারী হত, তাহলে তারা তাই করত। সব শুনে জেনারেল কী যেন ভাবলেন, স্থির হয়ে দাঁড়ালেন কিছুক্ষণ আর তাঁর চেহারার কাঠিন্য ক্রমশ কমে এল। তাদের অপেক্ষা করতে বলে জেনারেল তার গোপন কক্ষে চলে গেলেন প্রার্থনার জন্য। তারপর ফিরে এসে বললেন,
তাদের ভাগ্য তাদের নিজেদেরই ঠিক করতে হবে। এই ভাগ্য-পরীক্ষাতেই সব স্থির হবে। এবং তাদের মধ্যে দুজনকে মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই দেয়া হবে।
: তারা কী ঠিক করেছে, বাবা? কে, কে তাদের মধ্য থেকে মরবে?
: না, মা তারা অস্বীকার করেছে।
: তারা এটা করবে না, বাবা?
: না।
: কিন্তু কেন বাবা?
: কারণ, তাদের মধ্যে যে মারা যাবে তার মৃত্যু আত্মহত্যার শামিল হবে, মা। সত্যিকার খ্রিস্টানের জন্যে আত্মহত্যা নিষিদ্ধ ও মহাপাপ। তাই তারা ওটা প্রত্যাহার করেছে। সামরিক আদালতের আদেশই পালিত হোক। তারা সবাই মৃত্যুর জন্য তৈরি।
: এর অর্থ কী, বাবা!
: তাদের সবাইকে গুলি করে মারা হবে, মা। বলতে বলতে ভারি শোনাল কর্নেলের কণ্ঠ।
আবার অকস্মাৎ সেই শব্দ। বাতাসের শব্দ নয়। সেই পায়ের শব্দ সৈনিকদের ভারি পদশব্দ। ক্রমশ নিকটতর হল। তারপর এক সময় দরজায় গম্ভীর কন্ঠের আওয়াজ শোনা গেল।
: দরজা খুলুন।
: ওই দ্যাখ, বাবা, সৈন্যরা এসেছেন। আমি সৈন্যদের ভালোবাসি, বাবা, আমাকে ভেতরে নিয়ে যেতে দাও ওঁদের। তারপর ছোট্ট মেয়ে অ্যাবি লাফিয়ে দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলে দিল। আর আনন্দে চিৎকার করে ওদেরকে ভেতরে আসতে বলল। সারি সারি সৈন্য ভেতরে প্রবেশ করে দাঁড়াল। সামরিক অফিসারটি কর্নেলকে কুর্নিশ করল আর হতভাগ্য কর্নেল সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সে অভিবাদন গ্রহণ করল। বেদনাহত কর্নেলের বিষন্ন স্ত্রীও দাঁড়াল কর্নেলের পাশে। শঙ্কায় সাদা হয়ে গেছে ওর মুখমণ্ডল। শুধু ছোট্ট অ্যাবি আনন্দিত চঞ্চল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সমস্ত দৃশ্যটার দিকে। মা, মেয়ে আর পিতার দীর্ঘ আলিঙ্গনের পর ভারি কণ্ঠের আওয়াজ আবার ধ্বনিত হল ; দুর্গের দিকে। আর সমস্ত সৈন্যের সঙ্গে তালে তালে পা ফেলে কর্নেল মেফেয়ার চললেন সেই দুর্গের দিকে। যে দুর্গের চুড়ো দেখা যায় ওদের বাড়ি থেকে।
: মা, কী সুন্দর হল বল তো! আমি তোমাকে আগেই বলেছি না। ওই দেখ ওরা দুর্গের দিকে যাচ্ছে। বাবা সেই কর্নেলদের দেখতে পাবে।।
: আয়, মা। আমার কাছে আয়, আয়। বলে দুহাতে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ভেঙে পড়ল কর্নেলের স্ত্রী অবরুদ্ধ কান্নায়।

পরদিন আর্ত মা আর বিছানা ছেড়ে উঠতে পারল না। ডাক্তার আর নার্সেরা তার বিছানার পাশে বসে তার অসুস্থতা সম্পর্কে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করতে লাগলেন ফিসফিসিয়ে। অ্যাবিকে কিন্তু ঘরের ভেতরে আসতে দেয়া হল না। তাকে জানানো হল, মায়ের খুব অসুখ। কাজেই সে যেন ভেতরে না-এসে বাইরে খেলাধুলো করে। ছোট্ট মেয়ে সেই শীতে গায়ে একটা র‍্যাপার জড়িয়ে বাইরে পথে কিছুক্ষণ খেলে বেড়াল। তারপর এক সময় অতি অদ্ভুতভাবে মনে হল অ্যাবির, মায়ের এই দুঃসহ অসুস্থতার সময় বাবা কেন কিছু না-জেনে পড়ে আছেন সেই দুর্গের চুড়োয়। এটা সত্যি অন্যায়। এটা হতে দেয়া উচিত নয়। যে-করেই হোক বাবাকে খবর দিতে হবে। সে নিজেই দেবে।

প্রায় একঘণ্টা পর জেনারেল মহোদয় সামরিক আদালতে সপারিষদ প্রবেশ করলেন! টেবিলের পাশে তার মুষ্টিবদ্ধ আঙুলগুলো রেখে সমস্ত চেহারায় ভয়ানক গম্ভীরতা এনে দাঁড়ালেন তিনি। জানালেন, এবার তিনি ব্যাপারটা শুনতে রাজি আছেন। মুখপাত্রটি জানাল, আমরা ওদেরকে অনেক বুঝিয়েছি, আমাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্যে, অনেক আবেদন-নিবেদন করেছি ওদের কাছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। আত্মপ্রবঞ্চনার পক্ষপাতী নয় তারা। তারা মরবে, তবু ধর্মকে কলুষিত করবে না। ত্রাণকর্তার মুখমণ্ডল অকস্মাৎ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে এল। কিন্তু তবু কিছু উচ্চারিত হল না তাঁর কণ্ঠ থেকে। কিছুক্ষণ চিন্তায় মগ্ন থাকলেন তিনি। তারপর বললেন, না, ওদের সবাইকে মরতে হবে না। তাদের ভাগ্য পরীক্ষা করে নেয়া হবে। সমস্ত আদালতের মধ্যে একটা কৃতজ্ঞতার আভা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আবার বললেন জেনারেল, ওদেরকে ডেকে পাঠাও। দেয়ালের দিকে মুখ করে ওদেরকে পাশাপাশি দাঁড়াতে আদেশ দাও। আর তাদের হাতগুলো ক্রশ করে পেছন থেকে বেঁধে রাখ। সবশেষে আমাকে খবর দাও যাতে সে অবস্থায় ওদের আমি দেখতে পারি।

সবাই যখন চলে গেল তখন জেনারেল বসে পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে একজন প্রহরীকে ডেকে বললেন, “যাও পথের ওপর যে শিশুকে প্রথম দেখবে তাকেই আমার কাছে নিয়ে এস।’

লোকটি কিন্তু বাইরে যেতে-না-যেতেই ফিরে এল। কুচিকুচি বরফের কণায় আচ্ছন্ন পোশাকে আবৃত ছোট্ট অ্যাবিকে এক হাতে ধরে নিয়ে। এবি সোজা চলে এল সেই রাষ্ট্রপতির কাছে যার নাম শুনে দুনিয়ার জাঁদরেল ও ক্ষমতাবান লোকেরা ভয়ে কাঁপে।

অ্যাবি সোজা তার কোলে এসে বসল। বলল,

: আমি আপনাকে জানি। আপনি রাষ্ট্রপতি, জেনারেল আমি কত দেখেছি আপনাকে আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে। সবাই কিন্তু ভয় পায় আপনাকে দেখে। আমার কিন্তু একটুও ভয় করে না। কারণ আপনি আমার দিকে কোনোদিন সোজাসুজি তাকাননি। মনে পড়ে আপনার? আমার সেই লাল ফ্রকটা মনে পড়ে আপনার? ফ্রকটার নিচের দিকে নীল। একটুকরো নরম হাসি এবার রাষ্ট্রপতির মুখের কাঠিন্যকে কিছুটা কমিয়ে দিল। কিন্তু তবু তিনি বিজ্ঞ রাজনীতিকের মতোই তার উত্তর দিতে চেষ্টা করলেন,
: কেন, আমি তো…
: আমাদের বাড়ির পাশে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমাদের বাড়ি, মনে পড়ে না?
: আমার সত্যি লজ্জিত হওয়া উচিত। তুমি বুঝতে পারছ না, মা…
: এবার ছোট্ট অ্যাবি মিষ্টি তিরস্কার করে জেনারেলকে বাধা দিল তার কথায়।
: আচ্ছা, তাহলে আপনার কিছুই মনে পড়ছে না। কিন্তু আমি তো কিছুই ভুলে যাইনি।
: আমি সত্যি লজ্জিত, মা। আমি তোমাকে কথা দিলাম। এবার নিশ্চয়ই তুমি আমাকে ক্ষমা করবে। আমাকে তোমার বন্ধু বলে নেবে আজকের জন্যে, চিরদিনের জন্যে।
: নিশ্চয়ই আমি ক্ষমা করব যদিও আমি বুঝতে পারি না, কী করে আপনি সব ভুলে গেলেন। আপনি নিশ্চয়ই খুব ভুলোমন। আমারও কিন্তু মাঝে মাঝে ভুলোমন হয়ে পড়ে। আমি নিশ্চয়ই আপনাকে ক্ষমা করতে পারব। কারণ, আপনি ভালো। আর দয়ালু। আপনি আমাকে আরো কাছে টেনে নিচ্ছেন না কেন? বাবা যেমনি নেয়। বাইরে এখন কী প্রচণ্ড শীত।
: মা লক্ষ্মী আমার, তোমাকে নিশ্চয়ই আমি আমার হৃদয়ের কাছে টেনে নেব। কিন্তু তুমি আমার ছোট্ট বন্ধু হবে তো, অনেক দিনের জন্য? জেনারেলের কণ্ঠ এবার কেমন ভারি হয়ে এল। অ্যাবিকে কাছে টেনে নিলেন আরো। বললেন, তোকে দেখে আমার নিজের ছোট্ট মেয়ের কথা মনে পড়ছে। অবশ্য এতদিনে সে আর ছোট্টটি থাকত না। কিন্তু সে তোর মতোই মিষ্টি, প্রিয় আর আদরের ছিল। তোর মতোই সুন্দরী ছিল। তোর মতো ছোট্ট পরীর রূপ। শত্রু-মিত্র সবার ওপর প্রভাবশালী বিশ্ববিজয়ী আকর্ষণ ছিল তার। সে আমার দু-হাতের ভেতর শুয়ে থাকত ঠিক তোর মতো নিবিড় হয়ে। আমার হৃদয়কে আনন্দে শান্তিতে আপ্লুত করে দিত যেমন এখন তোকে পেয়ে আমার মন তেমনি এক আনন্দে আপ্লুত হয়ে গেছে। আমরা বন্ধু ছিলাম, খেলার সাথি ছিলাম। কত আগেকার ছিল এসব! কত আগেকার ঘটনা! এখন কোথায়, কোন স্বর্গে সব হারিয়ে গেছে। কিন্তু এতদিন পরে আবার তুই সব ফিরিয়ে এনেছিস, মা। আয় ছোট্ট মা, তুই আমার আশীর্বাদ নে।
: তুমি কি সত্যি তাকে খুব ভালোবাসতে? খুব, খুব বেশি?
: হ্যাঁ, মা তুই বুঝতে পাচ্ছিস না? সে আমাকে হুকুম দিত আর আমি মাথা পেতে নিতাম। পালন করতাম তার আদেশ।
; আশ্চর্য, তুমি কী সুন্দর! তুমি আমাকে চুমু খাবে না?
: নিশ্চয়ই। আনন্দের সঙ্গে, কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তোকে চুমু খাব, মা। এই নে, এটা তোর জন্যে। আর এটা ওর জন্যে। তুই আমাকে অনুরোধ করেছিস, মা। কেন তুই আমাকে হুকুম দিলি নে, আমার সেই মায়ের মতো। তাহলে আমি নিশ্চয়ই সে হুকুম পালন করতাম।
ছোট্ট মেয়ে অ্যাবি শুনে আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল। একটু পরেই তার কানে ভেসে এল সৈন্যদের সমবেত পায়ের শব্দ।
: সৈন্য! সৈন্য, সৈন্যরা সব আসছে। আমি ওদেরকে দেখব।
: অবশ্যই দেখবি মা। কিন্তু এক মুহূর্ত অপেক্ষা কর। আমি তোর জন্য একটা জিনিস এনেছি, এটা তুই নে।
সহসা একজন অফিসার ঘরে প্রবেশ করল। ঈষৎ মাথা নত করে বলল, ধর্মাবতার, ওরা এসেছে। তারপর আবার মাথা একটু নত করে চলে গেল।
রাষ্ট্রপতি অ্যাবিকে ছোট্ট তিনটি সিল-করা বাক্স দিলেন। এর মধ্যে দুটো সাদা আর একটি টকটকে লাল। আর এ লালটি কর্নেলদের মধ্যে যে পাবে তাকেই মৃত্যুবরণ করতে হবে।
: আহা, কী সুন্দর টকটকে লাল! এগুলো কি আমার জন্যে?
: না মা, এগুলো অন্যের জন্যে। ওই পর্দার কোণটা সরিয়ে ফেল, মা। পর্দার ওপারে একটা ছোট্ট দরজা আছে। দরজার ভেতরে চলে যা—দেখতে পাবি, তিনটি লোক দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। হাত তাদের পিছন দিকে বাঁধা। কিন্তু তাদের প্রত্যেকেরই একটি হাতের মুঠো খোলা—ঠিক ছোট্ট পেয়ালার মতো। এগুলোর একটি করে এক এক হাতে ফেলে দিয়ে তুই আমার কাছে ফিরে চলে আয়, মা।।
রাষ্ট্রপতিকে একা ফেলে মুহুর্তে অ্যাবি সেই পর্দার অন্তরালে অদৃশ্য হয়ে গেল। ভক্তিআনত স্বগূতোক্তির মতো জেনারেল নিজে নিজেই এবার বলতে লাগলেন,
: চরম অনিশ্চয়তা আর কিংকর্তব্যবিমূঢ়তার মধ্যে তার গোপন চির-শুভ-ইচ্ছের মতো এই চিন্তা আমার মাথার মধ্যে এল তাদের জন্যে, যারা তার ওপর আস্থাবান নয় কিন্তু তার সাহায্য চায়। তিনি জানেন, কার মৃত্যু হবে এবং এজন্যেই তার ছোট্ট প্রতিনিধি, নিস্পাপ দূতকে তিনি পাঠিয়ে দিয়েছেন তার ইচ্ছে পূরণের জন্যে। অন্যের ভুল হতে পারে কিন্তু তার ভুল হবে না। তার ভুল হয় না। আশ্চর্য, অচিন্ত্যনীয় তার পথ। সে-পথ জ্ঞানের। ধন্য হোক, তার পবিত্র নাম।
ছোট্ট নিস্পাপ পরীর মতো অ্যাবি পর্দা সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে মুহুর্তের জন্যে দাঁড়াল। খুব সতর্ক হয়ে, অদম্য কৌতূহল নিয়ে সে বন্দি সৈনিকদের স্থাণুর মতো শরীরগুলোর দিকে তাকাল। আর সহসা সমস্ত মুখমণ্ডল এক অপূর্ব আভায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আনন্দে অধীর হয়ে সে নিজের মনেই বলে উঠল, কী আশ্চর্য, এই তো ওদের মধ্যে বাবা রয়েছে। ওই তো ওঁর পিঠ। সবচে সুন্দর সেই পিঠ। আনন্দে সে এগিয়ে গেল বাবার দিকে। সিল-করা বাক্সগুলো খোলা হাতগুলোতে দিয়ে বাবার মুখের দিকে তাকাল আর হাস্যোজ্জ্বল আনন্দে চিৎকার করে উঠল,
: বাবা, বাবা, দেখ তোমাকে কী দিয়েছি! এটা আমি তোমার জন্যে এনেছি।
কর্নেল এবার নিজের হাতের সেই ভয়াবহ ছোট্ট উপহারটির দিকে তাকালেন। তারপর তার ছোট্ট নিস্পাপ হত্যাকারীকে টেনে আনলেন নিজের বুকের মধ্যে। ভালোবাসায়, শঙ্কায় আর সহানুভূতিতে তিনি কেঁপে উঠলেন। সমস্ত সৈনিক, অফিসার, মুক্ত কয়েদি—সবাই অবশ হয়ে দাড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ এই করুণ মর্মান্তিক দৃশ্যের পরিব্যাপ্তি দেখে। তাদের হৃদয় এই সকরুণ পরিস্থিতিতে সহানুভূতিতে ভরে এল। অশ্রুভারাক্রান্ত হল তাদের চোখ। কাঁদল সবাই। কিছুক্ষণের জন্যে একটা গভীর অবিস্মরণীয় ভক্তিপুত স্তব্ধতা নেমে এল সেখানে। তারপর প্রহরারত অফিসারটি অনিচ্ছাসত্ত্বেও এগিয়ে গেল বন্দি কর্নেলের দিকে। তার কাধে হাত রেখে বলল,
: শোক আমাকে আচ্ছন্ন করেছে সত্যি কিন্তু আমার কর্তব্য আমাকে করতেই হবে। আমাকে যে আদেশ…
: আদেশ? কিসের আদেশ! বলল ছোট্ট এ্যাবি।
: ওঁকে সরিয়ে নিতে হবে আমাকে। সত্যি আমি দুঃখিত।
: ওঁকে সরিয়ে নিতে হবে? কোথায়?
: হায় খোদা! ওকে সরাতে হবে… সরাতে হবে দুর্গের ওপাশে।
: না না, সে তুমি পারবে না! এবার চিৎকার করে উঠল অ্যাবি। আমার মা অত্যন্ত পীড়িত-বাবাকে আমি বাড়ি নিয়ে যাব।
অ্যাবি তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে বাবার পিঠের ওপর চড়ে বসে দুহাত দিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরল। বাবাকে নিবিড়ভাবে নিজের দিকে টেনে বলল, আমি তৈরি, বাবা, চল এবার আমরা যাই।
: না মা, আমাকে যেতে দেবে না। আমাকে ওদের সঙ্গে যেতে হবে।
ছোট্ট অ্যাবি এবার বাবার পিঠ থেকে লাফিয়ে নিচে নামল। নিজের চারদিকে তাকাল। তারপর দৌড়ে এসে অফিসারের সামনে গিয়ে ক্রোধে উত্তেজিত হয়ে তার ছোট তুলতুলে পা দুটো মেঝেতে বারবার আঘাত করে চিৎকার করে বলে উঠল,
: তোমাকে আমি বলেছি, আমার মায়ের অসুখ। তোমার সে কথা শোনা উচিত। বাবাকে তোমার যেতে দিতেই হবে।
: আহা, ছোট্ট শিশু! হায় খোদা, যদি পারতাম! কিন্তু ওঁকে যে আমায় নিয়ে যেতেই হবে।
তারপর অফিসার পাহারারত সৈন্যদের আদেশ দিলেন, ‘এটেনশন’। বিদ্যুতের মতো এবি সেখান থেকে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল। আবার ফিরে এল মুহূর্তে। নিজের ছোট হাত দিয়ে রাষ্ট্রপতি জেনারেলকে জোর করে টেনে নিয়ে এল সেখানে। আর এই অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখে উপস্থিত সবাই সোজা হয়ে দাড়াল। অফিসাররা জেনারেলকে অভিবাদন জানালেন আর সৈন্যেরা রাইফেল নামিয়ে কুর্নিশ করল। অ্যাবি এবার জোরেলের দিকে তাকিয়ে বলল,
: তুমি এদেরকে থামাও! আমার মা অত্যন্ত পীড়িত। বাবাকে ছাড়া সে এক মুহূর্তও থাকতে পারে না। আমি সে কথা ওদেরকে বলেছি, কিন্তু ওরা আমার কথা শুনছে না। ওরা বাবাকে নিয়ে যেতে চায়। জেনারেল হঠাৎ হতবুদ্ধি হয়ে দাড়িয়ে রইলেন। তারপর বললেন, তোমার বাবা! ওই কি তোমার বাবা?
; কেন? নিশ্চয়ই! দেখছ না, বাবা বলেই-না সবচে সুন্দর লাল বাক্সটি আমি ওকে দিয়েছি।
একটা বেদনার্ত অনুভূতি জেনারেলের সমস্ত মুখমণ্ডলে রেখায়িত হয়ে উঠল। তিনি বললেন,
: হা প্রভু! এ কী আমি করেছি। মানুষের দ্বারা ঘটতে পারে, এমন নিষ্ঠুরতম কাজ আমি করেছি। নিশ্চয়ই শয়তান আমাকে পরিচালিত করেছে। প্রভু, আমার কী হবে! আমি কী করব?

অ্যাবি এবার অধৈর্য হয়ে আর্তস্বরে চিৎকার করে উঠল : কেন, তুমি ওদেরকে বল বাবাকে ছেড়ে দিতে।
তারপরই সে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল— : বাবাকে ছেড়ে দিতে বল! তুমি-না একটু আগে বলেছিলে, তোমাকে হুকুম দিতে? আর আমি এখন যা করতে বলছি, তা তুমি করছ না!

একটা নরম প্রীতির আলো সহসা সেই বৃদ্ধ বিক্ষত চেহারায় প্রথম উষার স্বর্ণাভার মতো উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। জেনারেল এবার ছোট অ্যাবির মাথার উপর হাত রেখে বললেন, প্রভুকে ধন্যবাদ, এই আসন্ন দুর্ঘটনা থেকে—অচিন্তনীয় প্রতিজ্ঞা থেকে আমাকে বাঁচানোর জন্যে। আয় মা, তার ইচ্ছায় তুই আমাকে সব বলে দিয়েছিস। তুই অনন্যা, মা।

তারপর অফিসারদের বললেন, তোমরা এর আদেশ পালন কর। বন্দির অপরাধ ক্ষমা করা হয়েছে। একে মুক্ত করে দাও!

No comments