আটকলা - জসীম উদ্দীন

আটকলা - জসীম উদ্দীন

রহিম শেখ বড়ই রাগী মানুষ। কোনো কাজে একটু এদিক-ওদিক হলেই সে তার বউকে ধরে বেদম মার মারে।

সেদিন বউ সকালে সকালে উঠে ঘর-দোর ঝাড়ু দিতেছে, রহিম ঘুম হতে উঠে বলল, “আমার হুঁকায় পানি ভরেছ?”

বউ বলল, “তুমি তো ঘুমাইতেছিলে, তাই হুঁকায় পানি ভরি নাই। এই এখনই ভরে দিতেছি।”

রহিম চোখ গরম করে বলল, “এত বেলা হয়েছে, তবু হুঁকায় পানির ভর নাই! দাঁড়াও, দেখাচ্ছি তোমায় মজাটা।”

এই বলে সে যখন বউকে মারতে উঠেছে, বউ বলল, “দেখ যখন তখন তুমি আমাকে মার ধর কর, আমি কিছুই বলি না। জানো আমরা মেয়ে জাত? আট কলা হেকমত আমাদের মনে মনে। ফের যদি মার তবে আট কলা দেখেয়ে দিব।”

এই কথা শুনে রহিম শেখের রাগ আরও বেড়ে গেল। সে একটা লাঠি নিয়ে বউকে মারতে মারতে বলল, “ওরে শয়তানী, দেখা দেখি তোর আট কলা কেমন? তুই কি ভেবেছিস আমি তোর আট কলাকে ডরাই?”

বহুক্ষণ বউকে মারিয়া রহিম মাঠের কাজ করতে বাহির হয়ে গেল। অনেকক্ষণ কেঁদে কেঁদে বউ মনে মনে একটি মতলব আঁটল। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া সহজেই মিটে যায়। দুপুরে রহিম ভাত খেতে আসলে বউ রহিমের কাছে জেনে নিল, কাল সে কোন ক্ষেতে হাল বাইবে।

বিকাল হলে বউ বাড়ির কাছের এক জেলেকে ডেকে এনে বলল, “জেলে ভাই! কাল ভোর হওয়ার কিছু আগে তুমি আমাকে একটি তাজা শোলমাছ এনে দিবে। আমি তোমাকে এক টাকা আগাম দিলাম। আরও যদি লাগে তাও দিব। শেষ রাতে আমি জেগে খিড়কির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকব। তখন তুমি গোপনে শোলমাছটি আমাকে দিয়ে যাবে।”

গ্রামদেশে একটি শোলমাছের দাম বড়জোর আট আনা। এক টাকা পেয়ে জেলে মনের খুশীতে বাড়ি ফিরল। সে এ-পুকুরে জাল ফেলে ও-পুকুরে জাল ফেলে। কত টেংরা, পুঁটি, কই, পাবদা মাছ জালে আটকায়; কিন্তু শোল মাছ আর আটকায় না। রাত যখন শেষ হয়ে এসেছে তখন সত্য সত্যই একটি শোলমাছ তার জালে ধরা পড়ল। তাড়াতাড়ি মনের খুশীতে সে মাছটি নিয়ে রহিম শেখের বাড়ির খিড়কি-দরজায় আসল। বউ তো আগেই সেখানে এসে দাঁড়িয়ে আছে। মাছটি নিয়ে বউ তাড়াতাড়ি যে ক্ষেতে রহিম আজ লাঙল বাইবে সেখানে পুঁতে রেখে আসল।

সকাল হলে রহিম ক্ষেতে এসে লাঙল জুড়ল। সে এদিক হতে লাঙলের ফাড়ি দিয়ে ওদিকে যায়, ওদিক হতে এদিকে আসে। হঠাৎ তার লাঙলের তলা হতে একটি শোলমাছ লাফিয়ে উঠল। রহিম আশ্চর্য হয়ে মাছটি ধরে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসল।

তারপর বউকে বলল, “লাঙলের তলায় এই তাজা শোলমাছটি পেলাম। খোদার কি কুদরত! এই মাছের কিছুটা ভাজা করবে, আর কিছুটা তরকারি করবে। অনেকদিন মাছ-ভাত খাই না। আজ পেট ভরে মাছ-ভাত খাব।”

এই বলে রহিম ক্ষেতের কাজে চলে গেল। দুপুর হতে না হতেই বাড়ি ফিরে এসে বউ-এর কাছে সে খেতে চাইল। বউ এক থালা ভাত আর কয়েকটা মরিচ-পোড়া এনে তার সামনে ধরল।

একে তো ক্ষুধায় তার শরীর জ্বলতেছে, তার উপর এই মরিচ-পোড়া আর ভাত দেখে রহিমের মাথায় খুন চেপে গেল।

সে চোখ গরম করে বলল, “সেই শোলমাছ কি করেছিস শীগগীর বল?”

বউ যেন আকাশ হতে পড়ল, এমনি ভাব দেখিয়ে বলল, “কই, মাছ কোথায়? তুমি কি আজ বাজার হতে মাছ কিনেছ?”

রহিম বলল, “কেন, আমি যে আজ ইটা-ক্ষেত হতে শোল মাছটা ধরে আনলাম।”

বউ উত্তর করল, “বল কি? ইটা-ক্ষেতে কেহ কখনো শোলমাছ ধরতে পারে? কখন তুমি আমাকে শোলমাছ এনে দিলে? তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?”

তখন রহিমের মাথায় রাগে আগুন জ্বলছে। সে চিৎকার করে উঠল, “ওরে শয়তানী! এমন মাছটা তুই নিজে রেঁধে খেয়ে আমার জন্য রেখেছিস মরিচ-পোড়া আর ভাত! দেখাই তোর মজাটা!”

এই বলে রহিম বউকে বেদম প্রহার করতে লাগল। বউ চিৎকার করে সমস্ত পাড়ার লোক জড় করে ফেলল, “ওরে তোমরা দেখরে, আমার সোয়ামী পাগল হয়েছে, আমাকে মেরে ফেলল।”

বউ-এর চিৎকার শুনে এ-পাড়া ও-পাড়া হতে বহুলোক এসে জড় হল। তাহারা জিজ্ঞাসা করল, “তোমরা এত চেঁচামেচি করতেছ কেন? তোমাদের কি হয়েছে?”

রহিম বলল, “দেখ ভাই সকল! আজ আমি একটা তাজা শোলমাছ ধরে এনে বউকে দিলাম পাক করতে। এই রাক্ষসী সেটা নিজেই খেয়ে ফেলেছে। আর আমার জন্য রেখেছে এই মরিচ-পোড়া আর ভাত। আপনারাই বিচার করেন। এমন বউ-এর কি শাস্তি হতে পারে?”

বউ তখন হাত জোড় করে বলল, “দোহাই আপনাদের সকলের। আপনারা ভালোমতো পরীক্ষা করে দেখেন, আমার সোয়ামীর মাথা খারাপ হয়েছে, সে যাতা বলতেছে কিনা? ওর কাছে আপনারা জিজ্ঞাসা করেন, ও কোথা হতে মাছ আনল, আর কখন আনল?”

রহিম বলল, “আজ সকালে আমি ঐ ইটা-ক্ষেতে যখন লাঙল দিতেছিলাম তখন একটি এত বড় শোলমাছ আমার লাঙলের তলে লাফিয়ে উঠেছিল। সেইটি ধরে এনে বউকে রান্না করতে দিয়েছিলাম।”

বউ পাড়ার সবাইকে বলল, “আপনারা সবাই বলুন, শুকনা মাঠে শোলমাছ কেমন করে আসবে? আমার সোয়ামী পাগল না হলে এমন কথা বলতে পারে?”

গায়ের লোকেরা সকলেই বলাবলি করল, “রহিম শেখের ইটা ক্ষেতের ধারে-পাশে কোনো ইদারা-পুকুর নাই। সেখানে শোলমাছ আসবে কোথা হতে? রহিম নিশ্চয়ই পাগল হয়েছে।”

তখন তাহারা যুক্তি করে রহিমকে দড়ি দিয়ে বাধতে গেল। সে যখন বাধা দিতেছিল, সকলে তখন তাঁকে কিল-থাপ্পর মারছিল।

একজন বলল, “পানিতে চুবাইলে পাগলের পাগলামী সারে। চল ভাই, একে পুকুরে নিয়ে গিয়া কিছুটা চুবিয়ে আনি।”

যেই কথা সেই কাজ। সকলে ধরে রহিমকে খনিকটা পুকুরে চুবিয়ে আনল। রহিম বাধা দিতে চায়, কিন্তু কার বাধা কে মানে।

রহিম রাগে শোষাইতে লাগল। তখন একজন বলল, “উহাকে আজই পাগলা গারদে নিয়ে যাও। নতুবা রাগের মাথায় কাকে খুন করে ফেলে বলা যায় না।”

রহিমের বউ বলল, “আপনারা আজকের মতো ওকে খামের সঙ্গে বেঁধে রেখে যান। কাল যদি না সারে পাগলা গারদে নিয়ে যাবেন।”

গাঁয়ের লোকেরা তাই করল। রহিমকে ঘরের একটি খামের সাথে কষিয়া বেঁধে যে যার বাড়ি চলে গেল।

সবলোক চলে গেলে বউ রহিমের হাতের-পায়ের বাঁধন খুলে দিয়ে হাঁসতে হাঁসতে মাছ-ভাতের থালা এনে তার সামনে ধরল। সদ্য পাক করা মাছের তরকারির গন্ধ সারাদিনের না খাওয়া রহিমের নাকে এসে লাগল। সে মাথা নীচু করে ভাত খেতে আরম্ভ করল। পাখার বাতাস করতে করতে বউ বলল, “দেখ, আমরা মেয়ে-জাত, আট কলা বিদ্যা জানি; তার-ই এক কলা আজ তোমাকে দেখাইলাম। তাতেই এত কাণ্ড! আর বাকী সাত কলা দেখাইলে কি যে হত বুঝতেই পার।”

রহিম বলল, “দোহাই তোমার, আর সাত কলার ভয় দেখাইও না। এই আমি কছম কাটিলাম। এখন হতে আর যদি তোমার গায়ে হাত তুলি তখন যাহা হয় করিও।”

No comments