মিরখাইয়ের অটোগ্রাফ – হুমায়ূন আহমেদ


নীলগঞ্জ হাইস্কুলের হেডমাস্টার জাহেদুর রহমান সাহেব নীতুর বড়মামা। বড়মামাকে নীতুর খুব পছন্দ। তিনি অন্যসব হেডমাস্টারদের মত না—পড়া ধরেন না, গম্ভীর হয়ে থাকেন না, একটু হাসাহাসি করলেই বিরক্ত হন না। গল্প বলতে বললে—গল্প শুরু করেন। সুন্দর সুন্দর গল্প, তবে নীতুর ধারণা, বানানো গল্প। বানানো গল্প শুনতে নীতুর ভালো লাগে না। তাঁর সত্যি গল্প শুনতে ইচ্ছে করে। সে গল্প শুনতে চায় কিন্তু প্রথমেই বলে নেয়—সত্যি গল্প বলতে হবে।

আজ নীতুর মামা জাহেদুর রহমান সাহেব একটা ভূতের গল্প শুরু করেছেন। তাঁর সামনে এক বাটি মুড়ি। বড় চায়ের কাপে এক কাপ চা। তিনি মুড়ি খাচ্ছেন এবং চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। নীতু তাঁর সামনেই উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। দু’ হাত দিয়ে মাথা তুলে রেখেছে। খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মামাকে দেখছে এবং বোঝার চেষ্টা করছে মামা সত্যি গল্প বলছেন, না মিথ্যা গল্প বলছেন। মিথ্যা গল্প হলে সে শুনবে না।
নীতুর বয়স বেশি না। এবার ক্লাস থ্রীতে উঠেছে। তবে তাঁর খুব বুদ্ধি। গল্পের সত্যি-মিথ্যা সে চট করে ধরে ফেলে। ঐ তো সেদিন কাজের বুয়া তাকে গল্প বলেছে—
এক দেশে ছিল একটা বাঘ। মাঘ মাসের শীতে বাঘ হইছে কাহিল। কাপড়ের দোকানে গিয়া বলছে, মিয়া ভাই, আমারে একখান গরম চাদ্দর দেন। শীতে কষ্ট পাইতাছি….
নীতু বুয়াকে কড়া কর ধমক দিয়েছে। সে কঠিন গলায় বলেছে, মিথ্যা গল্প বলতে নিষেধ করেছি। এটা তো মিথ্যা গল্প।
‘বাঘ কি কথা বলতে পারে? বাঘ কি দোকানে যেতে পারে?
‘কথা তো সত্য বলছেন আফা……..কিন্তু…..’

‘থাক বুয়া, তোমাকে গল্প বলতে হবে না’।
নীতু খুব সাবধানী। কেউ তাকে ঠকাতে পারে না। বড় মামাও পারবেন না, চেষ্টা করলেও না। সে ঠিক ধরে ফেলবে।
নীতি বলল, কই বড় মামা, তারপর কি হল বল।
জাহেদুর রহমান সাহেব বলবেন, মুড়ি খেয়ে নিন।
‘উঁহু, তুমি খেতে খেতে বল।’
জাহেদ সাহেব চায়ের কাপে লম্বা চুমুক দিয়ে বললেন, ইয়খন আমার যুবক বয়স। চাকরির সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছি। খবর পেলাম, চিটাগাং পোর্ট—এর স্কুল একজন
‘মামা, মিথ্যা গল্প না তো?
‘অসম্ভব। আমি মিথ্যা গল্প বলি কি ভাবে? স্কুলের হেড মাস্টার মিথ্যা বলে কখনো শুনেছিস?’
‘আচ্ছে বেশ, বল।’
‘কুতদূর বলেছি?’
‘তোমার তখন যুবক বয়স…….’
‘ও হ্যা, খবর পেলাম, চিটাগাং পোর্টের স্কুলে ইংরেজী একজন শিক্ষক নেবে….’
‘মামা, তুমি কিন্তু একটু আগে বলেছ অংকের শিক্ষক। তুমি মিথ্যা গল্প শুরু করেছ’।
‘আরে না, ওরা একজন শিক্ষক নেবে, তাকে অংক-ইংরেজী দুটো পড়াতে হবে। এখন বুঝলি?’
‘হুঁ।’
‘ইন্টারভিউ দিলাম। চাকরি হয়ে গেল। ভাল বেতন। কর্ণফুলি নদীর উপর বিরাট বাসা ভাড়া করলাম। তখন বাড়ি ভাড়া ছিল সস্তা। দু’শ-তিনশ’ টাকায় আলিশান বাড়ি পাওয়া যেত।’
‘আলিশান বাড়ি মানে কি মামা?’
‘আলিশান বাড়ি মানে রাজপ্রাসাদ।’

‘তুমি রাজপ্রাসাদে থাকতে?’
‘গরীবের রাজপ্রাসাদ বলতে পারিস। দুটো শোবার ঘর। বসার ঘর। টানা বারান্দা। দোতলা বাড়ি। একতলায় টেক্স অফিস। দোতলায় আমি থাকি। আলো-হাওয়া খুব আসে। সমুদ্রের ওপর বাড়ি হলে যা হয়।’
‘মামা, তুমি একটু আগে বলেছ নদীর উপর বাড়ী।’
‘কর্ণফুলি নদী সেখানে সমুদ্রে পড়েছে। কাজেই নদীর উপর বললে যেমন ভুল হয় না, সমুদ্রের উপর বাড়ি বললেও ভুল হয় না। বারান্দার দাঁড়িয়ে দক্ষিণে তাকালে সমুদ্র দেখা যায়, আবার পশ্চিমে তাকালেই নদী। এখন বুঝেছিস?’
‘হুঁ। তারপর কি হয়েছে বল।’
‘বাড়িটা ছিল লোকালয়ের বাইরে। দিনের বেলায় একতলার অফিসে কাজকর্ম হত। লোকজনে গমাগম করত। সন্ধ্যাবেলা সব শুনশান!’
‘শুনশান কি মামা?’
‘শুনশান হল—কোন শব্দ নেই। নীরব। ভয়ংকর নীরব।’
‘তারপর?’
‘তারপর একদিন কি হয়েছে শোন। কাজে আটকা পড়েছিলাম অফিস থেকে ফিরতে অনেক দেরি হল…….’
‘অফিস বলছ কেন মামা—তুমি না স্কুলে মাস্টারি কর–!’
‘বাবারে, স্কুলেও তো অফিস আছে। ছাত্র পড়ানো শেষ করে সেই অফিসে হেডমাস্টারের সঙ্গে মিটিং করতে গিয়ে দেরি। এই জন্যেই অফিস বলছি।’
‘ও আচ্ছা।’
‘আমি দুপুরে বাইরে খেয়ে নেই। রাতে নিজে রেঁধে খাই। চারটা চাল ফুটাই, আলুভর্তা করি, একটা ডিম ভাজি। গাওয়া ঘি গরম ভাতের উপর ছড়িয়ে আলুভর্তা দিয়ে ভাত খাওয়ার মজাই অন্য…..।’
‘আমার আলুভর্তা আর গাওয়া ঘি দিয়ে ভাত খেতে ইচ্ছে করছে মামা।’
‘এখন খাবি?’
‘হুঁ।’

‘একটুব আগেই তো খেলি। খাওয়ার কথা শুনে খিদে পাওয়া, ভূতের কথা শুনে ভয় পাওয়া—এসব তো ভালো লক্ষণ না। এসব হল জটিল এক রোগের লক্ষণ। রোগটার নাম হচ্ছে—শোনা রোগ’। এই রোগ হলে শোনা কথায় আক্কেল গুডুম হয়……..।’
‘তুমি গল্প বাদ দিয়ে অন্য কথা বলছ—’
‘আমি অন্য কথা বলতে চাইনি, তুইই তো অন্য কথা নিয়ে এলি। যাই হোক, গল্প শুরু করি—কি যেন বলছিলাম, ও হ্যাঁ, আমার বাসা যে এলাকায়, সে এলাকাটা সন্ধ্যার পর শুনশান নীরব হয়ে যায়। সেইদিন বাসাটা অন্যদিনের চেয়েও নীরব। হোটেলে চারটা ভাত খেয়ে যখন ফিরছি—’
‘মামা, তুমি এক্ষুণি বললে আলুভর্তা দিয়ে গাওয়া ঘি দিয়ে ভাত খেলে?’
‘তোকে গল্প বলাই এক যন্ত্রণা। সবটা না শুনেই জেরা শুরু করিস। পুরোটা শুনে তাঁর পরে জেরা করবি। ঠিক করেছিলাম, বাসাতেই রেঁধে খাব। রাঁধতে গিয়ে দেখি চুলা ধরানো যাচ্ছে না। এক ফোটা কেরোসিন নেই। বাধ্য হয়ে হোটেলে খেতে গেলাম’।
‘ও আচ্ছা।’
‘হোটেলটা আবার অনেকখানি দূরে। তিন কিলোমিটার হবে। যেতে লাগে এক ঘন্টা। খাওয়া—দাওয়া শেষ করে ফিরছি। রাত ন’টার মতো বাজে। নির্জন রাস্তা। খুব হাওয়া দিচ্ছে—শীত শীত লাগছে। চাদর গায়ে ছিল। চাদর দিয়ে নিজেকে মুড়িয়ে নিয়ে এগুচ্ছি—হঠাৎ মনে হল, কে যেন চাদরের খুট ধরে আমার সঙ্গে সঙ্গে এগুচ্ছে। তাকিয়ে দেখি, কেউ না। নিশ্চয় মনের ভুল। কিন্তু আমি স্পষ্ট অনুভব করলাম, যখন আমি খাঁটি কে যেন চাদরের খুট ধরে সঙ্গে সঙ্গে হাঁটে। দাঁড়ালেই চাদরের খুট ছেড়ে দেয়। আমি হতভম্ব। ব্যাপারটা কি? চাদরে কোন সমস্যা আছে নাকি? আমি গা থেকে চাদর খুলে ভাজ করে ছোট করলাম। ফেলে দিলাম কাঁধে। শীত লাল্গলে লাগুক। চাদরের খুঁট ধরে তো আর কেউ এখন টানাটানি করবে না। আবার হাঁটা ধরতেই ভয়ংকর এক চমক খেলাম। কে যেন এখন আমার বাঁ হাতের কড়ে আঙ্গুল ধরে হাঁটছে। অথচ কাউকে দেখা যাচ্ছে না।’
নীতু ভীতু গলায় বল, মামা, কে তোমার কড়ে আঙ্গুল ধর হাঁটছে?
‘কিছুই বুঝতে পারিনি। তযে হাঁটছে সে শক্ত হাতেআমার আঙুল চেপেধরে আছে। মনে হ্ছে, অল্প বয়স্ক কোন বাচ্ছা। তুলুলে হাত। নরম আর ঠান্ডা। আমি ঝাঁকি দিয়ে হাত সরিয়ে নিলাম। দু’পা এগুতেই আবার আঙ্গুল চেপে ধরল।
নীতু কাঁদে। কাঁদো গলায় বলল, মামা, আমার ভয় লাগছে। জাহেদুর রহমান সাহেব বললেন—তোর আর কি ভয় লাগছে? আমার ভয় যা লাগছিল তাঁর সীমা-পরিসীমা ছিল না। শরীর ঘেমে গেল। বুক ধ্বক ধ্বক করতে লাগল। একবার ইচ্ছা করল, ওঠে দৌড় দেই।
‘তুমি কি করলে? দৌড় দিলে?’

‘না, দৌড় দিলাম না। কারণ স্যান্ডেল পুরানো, স্যান্ডেলের ফিতা নরম হয়ে আছে। দৌড় দিলেই ফিতা ছিঁড়ে যাবে। আমি সিগারেট ধরালাম।’
‘সিগারেট ধরালে কেন মামা?’
‘সিগারেটে আগুন আছে। আগুন থাকলে ভূত-পেত কাছে ভিড়ে না।’
‘ওটা কি ভূত ছিল মামা?’
‘না, ভূত ছিল না। ওটা ছিল টুতের বাচ্চা।’
নীতু অবাক হয়ে বলল, টুতের বাচ্চা আবার কি?’
জাহেদুর রহমান সাহেব বললেন, আমরা সব সময় বলি না বাঘ-টাগ, ভূত—টুত? বাঘের যেমন বাচ্ছা আছে, সেরকম আছে টাগের বাচ্চা। আবার ভূতের বাচ্চার মত আছে টুতের বাচ্চা।
‘ওরা কেমন মামা?’
‘ভয়ংকর। ভূতরাই ওদের ভয়ে অস্থির, মানুষের কথা ছেড়ে দে। একটা টুতের বাচ্চা থাকলে তাঁর ত্রিসীমানার কোন ভূতের দেখা পাবি না।’
‘ওরা দেখতে কেমন?’
‘দেখতে কেমন কি করে বলব? ওদের তো আর চোখে দেখা যায় না’।
‘হাত দিলে বুঝা যায়?’
‘অবশ্যই যায়’।
‘তারপর কি হল মামা বল।’
‘আমিতো ভয়ে আঁৎকে উঠলাম। তবে চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে প্রচন্ড ধমক দিয়ে বললাম, কে? কে।?’
‘ধমক দিলে কেন মামা?’
‘ভয় কাটানোর জন্যে দিলাম। খুব বেশি ভয় পেলে ধমক দিতে হয়। ধমকের জোর যত বেশি হয় ভয়ও তত কমে।’
‘তোমার ধমকের জোর খুব বেশি ছিল?’
‘ভয়ংকর ছিল। নিজের ধমকে নিজেই ভয় পেয়ে গেলাম। আর তখন শুনলাম, মিন মিন করে কে যেন কথা বলল। কথা পরিস্কার না, একটু জড়ানো।
আমি বললাম, কথা কে বলছে?’

‘আমি?’
‘আমিটা কে? নাম কি?’
‘আমার নাম মিরখাই।’
‘তুই কে? ভূত নাকি?’
‘জ্বী না, আমি ভূত না, আমি টুত।’
‘তু আমার আঙ্গুল ধরে আছিস কেন? ভয় দেখাবার চেষ্টা করছিস?’
‘হুঁ।’
‘কেন?’
ভূতের বাচ্ছা হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল। আমি বললাম, ব্যাপারটা কি?
কাঁদছিস কেন? কোন জবাব নেই—কান্না আরো বেড়ে গেল। আমার মায়াই লাগল। ব্যাপার কিছু বুঝছি না। কেন কাঁদছে জানা দরকার।
‘মামা, ওর কি পেটে ব্যথা?’
‘তখনো জানি না—তবে পেটে ব্যথা হতে পারে। পেটে ব্যথার কারণে কাঁদাটা অস্বাভাবিক না। আবার অন্য কারণও থাকতে পারে—হয়ত পথ হারিয়ে ফেলেছে। খুব অল্প বয়স যাদের, ওরা মাঝে মাঝে পথ হারিয়ে ফেলে—তখন কান্নাকাটি শুরু করে—আমি বললাম, কি রে, তুই পথ হারিয়ে ফেলেছিস?’
‘না।’
‘পেটে ব্যথা?’
‘না’।
‘কেউ মারধর করেছে?’
‘না।’
‘তাহলে ব্যাপারটা কি খুলে বল। কান্না বন্ধ করে বল হয়েছে কি। টুতের বাচ্চা ফোঁফাতে ফোঁফাতে বলল, পরীক্ষায় ফেল করেছি।’
‘বলিস কি?’
‘নীতু বলল, মামা, টুতের বাচ্চাদের স্কুল আছে?
‘অবশ্যই আছে। প্রাইমারী এডুকেশন এদের জন্যে কম্পলসারি’।

‘ওদের কি কি পড়ানো হয়?’
‘সবই পড়ানো হয়—অংক, ভূগোল, ইতিহাস, ধর্ম….’
‘ও কিসে ফেল করেছে?’
‘ও ফেল করেছে—ভয় দেখানো বিষয়ে।’
‘সেটা কি?’
‘সব ভূত-টুতের বাচ্চাদের ১০০ নম্বরের একটা পরীক্ষা দিতে হয়—ভয় দেখানো পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় এরা মানুষকে ভয় দেখায়। যে ভয় দেখাতে পারে না সে ফেল করে। ভয় দেখানো পরীক্ষায় ফেল মানে ভয়াবহ ব্যাপার। এই বিষয়ের ফেলে অর্থ হল সব বিষয়ে ফেল। মিরখাই কাউকে ভয় দেখাতে পারে না। পর পর দু’বার ফেল করেছে।’
নীতু বলল, আহা বেচারা!
‘আজ তাঁর পরীক্ষা। সে আমাকে ভয় দেখাবে। আমি যদি ভয় পাই তাহলে পাশ করবে। ভয় না পেলে আবার ফেল। আজ ফেল করলে পরপর তিনবার ফেল হবে—তাকে স্কুল থেকে বের করে দেবে।’
‘তুমি ভয় পাচ্ছ না কেন মামা? একটু ভয় পেলে কি হয়?’
‘আমি নিজেও তাই ঠিক করলাম—ভাবলাম, এমন ভয় পাব যে টুত সমাজে হৈ-চৈ পোড়ে যাবে। মিরখাই শুধু যে পরীক্ষায় পাশ করবে তাই না, মুন-মার্ক পেয়ে পাশ করবে।
‘মুন—মার্কটা কি!’
‘একশ’তে আশি নম্বরের উপর পেলে হয় স্টার মার্ক। একশ’তে ৯০ নম্বরের উপর পেলে হয় মুন—মার্ক। যাই হোক, আমি বললাম, মিরখাই, তোর পরীক্ষা শুরু হবে কখন?’
মিরখাই বলল, রাত বারোটার পর। হেড স্যার আসবেন—অন্য স্যাররাও আসবেন। তখন আমি আপনাকে ভয় দেখাব। যদি ভয় পান তাহলে আমি পাশ করব। আর যদি না পান তাহলে….’
মিরখাই ডাক ছেড়ে কাঁদতে লাগল। আমি বললাম, কান্না বন্ধ কর মিরখাই। কোন কান্না না। আজ তোকে আমি পরীক্ষায় পাশ করিয়ে দেব—এমন ভয় পাব যে তোদেরই আক্কেল গুডুম হয়ে যাবে।
‘সত্যি?’
‘হ্যাঁ সত্যি। তুই আসিস সবাইকে নিয়ে। চোখন মোছ। এত কাঁদবি না। যা, বাসায় যা।’
‘তারপর কি হল মামা?’
‘আজ থাক বাকিটা কাল বললে কেওমন হয় রে নীতু!’
‘খুব খারাপ হয়। তোমাকে আজই বলতে হবে। এক্ষুণি বলতে হবে। ওরা কি করল—এল তোমার কাছে?’
‘হুঁ।’

‘রাত বারটায়?’
‘আমি ঘুমের ভান করে পড়ে আছি। নাক ডাকার মত আওয়াজও করছি যাতে কেউ বুঝতে না পারে এটা আমার নকল ঘুম। কিন্তু আমার কান খুব সজাগ—কি হচ্ছে না হচ্ছে সব বুঝতে পারছি। জানালা দিয়ে টুত ঢুকল, সেটা বুঝলাম। টুতের স্যাররা যে জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছেন সেটাও টের পেলাম….। টুত এসে আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, মামা, আমি এসেছি।’
‘ও তোমাকে মামা ডাকে?’
‘আগে কিছু ডাকত না। হঠাৎ ডাকা শুরু করল।’
‘আমার মনে হয় ও তোমাকে পছন্দ করেছে বলেই মামা ডাকছে।’
‘হতে পারে। তারপর বললাম, ভেরি গুড। ভয় দেখানো শুরু কর। টুত বলল, কি ভাবে ভয় দেখাব মামা?
আমি বললাম, প্রথমে টান দিয়ে গা থেকে লেপটা সরিয়ে দে। তারপর আমার পায়ের পাতায় সুড়সুড়ি দে। সুড়সুড়ি দিতেই আমি চিৎকার করে উঠব। আমার চিৎকার শুনে তুই খিক খিক করে হাসবি। তারপর জানালাটা বন্ধ করবি। খুলবি। বন্ধ করবি। খুলবি। আমি তখন বাতি জ্বালাব। বাতি নিভিয়ে খিক খিক করে হাসবি। টুত বলল, আচ্ছা। বলেই সে করল কি—টান দিয়ে আমার গা থেকে লেপ সরিয়ে দিল।
আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম। সে আমার পায়ে সুড়সুড়ি দিতে শুরু করল। আমি চেঁচিয়ে বললাম, কে কে! কে আমার পায়ে সুড়সুড়ি দেয়? কে কে?
আর তখন থিক থিক হাসির শব্দ শোনা যেতে লাগল। আমি ভয়ে আঁ আঁ করতে লাগলাম।
নীতু বলল, মামা, এটা তো সত্যি ভয় না, মিথ্যা ভয়। তাই না?
‘হ্যাঁ মিথ্যা ভয়। কিন্তু কার সাধ্য সেটা বুঝে। আমি আঁ আঁ চিৎকার করছি আর তখন জানালা বন্ধ হচ্ছে আর খুলছে। আমি চিকন স্বরে চেঁচাতে লাগলাম—ভূত ভূত ভূত। আমাকে বাঁচাও! আমাকে বাঁচাও! কে কোথায় আছ? আমাকে বাঁচাও। ভূত আমাকে মেরে ফেলল! ভুত আমাকে মেরে ফেলল!

আমার চিৎকার হৈ চৈ শুনে টুত নিজেই ভয় পেয়ে গেল। সে আমার কানের কাছে এসে ফিস ফিস করে বলল, মামা, আপনি কি সত্যি সত্যি ভয় পাচ্ছে?
আমি বললাম—কথা বলে সময় নষ্ট করিস না—তুই এখন টেবিল থেকে জিনিস[প্ত্র মাটিতে ফেলতে থাক। কাচের জিনিস ফেলবি না। ভাঙ্গা কাচে পা কাটতে পারে। বই-খাতা শব্দ করে মাটিতে ফেল।
ধুম ধুম শব্দে বই-খাতা মাটিতে পড়তে লাগল। আমি তখন চড়কির মত সারা ঘরে ঘুরপাক খাচ্ছি আর বলছি—এসব কি হচ্ছে! এসব কি হচ্ছে! ভূত আমাকে মেরে ফেলল! আমাকে বাঁচাও। কে কোথায় আছ আমাকে বাঁচাও!
সুইস টিপে বাতি জ্বালালাম। মিরখাই সঙ্গে সঙ্গে বাতি নিভিয়ে ফেলল। আমি চিৎকার করে বললাম, এ সব কি হচ্ছে। বাতি নিভে যাচ্ছে কেন? বলে আবার বাতি জ্বালালাম। মিরখাই আবার বাতি নিভিয়ে ফেলল। আমি একটা বিকট চিৎকার করে গোঁ গোঁ শব্দ করতে করতে মেঝেতে পড়ে গেলাম।
মিরখাই—এর স্কুলের হেডমাস্টার সাহেব বললেন, থাক থাক, আর লাগবে না, আর লাগবে না। বাদ দাও, শেষে মরে-টরে যাবে। দেখে মনে হচ্ছে হার্ট এ্যাটাক হয়ে গেছে। মিরখাই, ত উমি পাশ করেছ। শুধু পাশ না, মুন-মার্ক পেয়ে পাশ করেছ। ভেরী গুড। চল যাওয়া যাক।
মিরখাই আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, মামা যাই।
আমি বললাম, আচ্ছা যা, আর শোন, ভালমত পড়াশোনা করিস।
নীতু বলল, মামা, গল্প কি শেষ হয়ে গেল?
‘হ্যাঁ।
‘এটা কি সত্যি গল্প মামা?’
‘অবশ্যই সত্য গল্প।’
‘মিরখাইয়ের সঙ্গে কি এখনো দেখা হয়?’
‘হয়। আসে মাঝে-মধ্যে।’
‘এখন মিরখাই কি করে?’

‘ও এখন ভূত এবং টুত সমাজে বিরাট ব্যক্তিত্ব। টুত ইউনিভার্সিটিতে মাস্টারি করে। এসোসিয়েট প্রফেসর। চারটা বই লিখেছে। বিরাট নাম করেছে বই লিখে।’
‘কি বই লিখেছে?’
‘মানুষকে কি করে ভয় দেখাতে হয় সেই বিষয়ে বই। মানুষকে ভয় দেখানোতে সে খুব নাম করেছে তো, সে জন্যে ঐ বিষয়ে শেষ পড়াশোনা করেছে, গবেষণা করেছে। পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছে। টুত সমাজে মানুষকে ভয় দেখানোর কৌশল এখন তারচে’ বেশী কেউ জানে না। সে খুবই জ্ঞানী ব্যক্তি।’
‘সত্যি মামা?’
হ্যাঁ সত্যি। তাঁর একটা বই আছে, টুত ইউনিভার্সিটিতে পাঠ্য—“মানুষকে ভয় দেখানোর সহজ, জটিল ও মিশ্র পদ্ধতি।” আরেকটা বই আছে যেটা নানা ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। খুবই কঠিন বই, নাম হল—“ভয়ের রূপরেখা”।
“উনি বাচ্চাদের জন্যে বই লিখেননি?’
‘নিচু ক্লাসের ছাত্রদের জন্যেও তাঁর বই আছে, খেলতে খেলতে ভয় দেখানো”। মিরখাইয়ের সঙ্গে আলাপ করতে চাস? চাইলে একদিন আসতে বলি—
‘না মামা, আসতে বলার দরকার নেই।’
‘তোর অটোগ্রাফ লাগবে, অটোগ্রাস লাগলে অটোগ্রাফের খাতাটা দিয়ে দিস।
অটোগ্রাফ এনে দেব।
জাহেদুর রহমান সাহেব নীতুর অটোগ্রাফের খাতায় মিরখাইয়ের অটোগ্রাফ এনে দিয়েছেন। নীতু খাতা দেখে বলল, কোন তো লেখা দেখছি না মামা।
জাহেদ সাহেব হাই তুলতে তুলতে বললেন, দেখবি কি করে! মিরখাই নিজে যেমন অদৃশ্য, তাঁর হাতের লেখাও অদৃশ্য।
‘এখানে কি লেখা আছে মামা?’

এখানে লেখা—স্নেহের নীতুকে। নীতু, ভয়কে জয় কর, মিরখাই। খাতাটা যত্ন করে রাখিস মা। টুতের অটোগ্রাফ পাওয়া সহজ ব্যাপার না।’
নীতু তাঁর অটোগ্রাস খাতা খুব যত্ন করে তুলে রেখেছে। কেউ এলেই সে মিরখাইয়ের অটোগ্রাফ খুব আগ্রহ করে দেখায়।

No comments