রম্য গল্প: অপেক্ষা
ঝড়বৃষ্টির আগাম পুর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে,যেকোনো সময় মুষলধারে বৃষ্টি নামতে পারে,জোরালো ভাবে বাতাস বইছে, ঠান্ডা-শীতল বাতাস যেন প্রাণ জুড়িয়ে দিচ্ছে! এমন সময় ইচ্ছে করছে ছুটে ছাদে চলে যেতে, বৃষ্টির প্রতিটি ফোটায় যেন বুদ হয়ে থাকতে পারি,কিন্তু হঠাৎ বজ্রপাত চোখ ধাঁধিয়ে দিলো,আর ছাদে যাওয়া হবেনা বেশ বুঝতে পারলাম! কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে বৃষ্টি নামলো আর কারেন্টও চলে গেল যেন বৃষ্টির সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলতে!
আমি জানালাগুলো বন্ধ করে বেলকুনির দরজা খুলে রাখলাম, আর চার্জার লাইট খুজতে গেলাম, কিন্তু বিধিবাম! কোনোকিছুই খুজে পেলাম না, মোবাইলের চার্জও ১৫% এর নিচে থাকায় আলো জ্বালানো সম্ভব হলোনা! চেয়ার টেনে বেলকুনিতে বসলাম, প্রচন্ড বৃষ্টির তান্ডবে পানির ছিটেফোটায় আমি মোটামুটি ভিজে যাচ্ছি, তবে উঠতে ইচ্ছে করছে না। একটু পরপরই অন্ধকার আকাশ আলোকিত করে বজ্রপাত হচ্ছে,বজ্রপাতের সৌন্দর্য সব আলোকে হার মানায়, আমার ভীষণ পছন্দের এই ঝুম বৃষ্টি সাথে বজ্রপাত, কিন্তু এতে কারো ক্ষতি না হোক!
টানা ১ ঘন্টার মতো এভাবেই বসে থাকলাম, ততক্ষনে বৃষ্টি প্রায় থেমে এসেছে,কিন্তু কারেন্ট আজকে আসবে কিনা সন্দেহ আছ সে পরিমান বাতাস বৃষ্টি হলো, তাতে কারেন্টের তার ছিড়ে যাওয়া অসম্ভব নয়! একটু পরে বৃষ্টি থেমে গিয়ে অদ্ভুত সুন্দর সুবাস বের আসলো, আমি ছাদে চলে আসলাম, বৃষ্টি শেষে জমে থাকা পানির ওপর দিয়ে হেটে চলার মজাটাই আলাদা, মিনিট তিরিশেক সেই স্বাদ আস্বাদন করে রুমে আসলাম! মানুষের বেশিরভাগ সময় কাটে আশায় আশায়, মানুষ পেয়ে যতোটা খুশি হয়, তার চেয়ে বেশি আশা করে খুশি হয়,কিছু জিনিস হয়তো একেবারেই অসম্ভব তবুও কল্পনার জগতে সেই অসম্ভবেই বিচরণ করে যায় সবাই, এতে তৃপ্তি আছে,মনোজগতের এক পূর্ণতা আছে, ধরাছোঁয়ার বাইরেও কিছু পূর্নতা মানুষকে আন্দোলিত করে যার রেশ কাটেনা!
বর্ষাকাল বিধায় প্রায় প্রতিদিনই এমন বৃষ্টি নামে, আজকে বৃষ্টি বাঁধার মধ্যও বাইরে যেতে হচ্ছে, আনমনে হাঁটছিলাম পিচঢালা রাস্তায়, হঠাৎই পেছন থেকে কেউ বলে উঠলো,””এই …..আসছে”’ ! যে কথাটা বললো তার কন্ঠটা আমার অপরিচিত, তবে যার নাম বললো, সেই নামটা আমার চিরপরিচিত, এক মূহুর্তের জন্য মনে হলো, আমি যা শুনলাম তা যেন সত্যি, আমার বহুকাঙ্ক্ষিত মানুষটি বুঝি সত্যিই এসেছে,আমি পিছন ফিরেই দেখি….. চারপাশে কেউ নেই। বৃষ্টির মধ্য ছাতা মাথায় কিছু পথচারীর আসা যাওয়া ছাড়া আর বিশেষ কিছু নেই,যে কন্ঠে আমি নামটা শুনে পিছনে ফিরলাম। সেইরকম কেউই নেই,আর সেই মানুষটা তো বহুদুরের ব্যাপার! আমারই হয়তো ভুল হচ্ছে, সে এখানে কিকরে আসবে, হয়তো আমারই কোনো পরিচিত কেউ সূক্ষভাবে মজা নিলো আমাকে বিব্রত করে! আমি বোধহয় একটা ঘোরের মধ্য আছি, আমার মস্তিষ্ক সবসময় একজনেরই নাম জপে যাচ্ছে, যার ফলেই এই অবস্থা আমার!
বর্ষা পেরিয়ে ৠতুচক্রের নিয়মে শীতকাল চলে এলো,ঘন কুয়াশায় চারপাশ আবৃত, ভোরবেলা উঠে বাইরে হাটছিলাম, হঠাৎ কারো আবছায়া দেখতে পেলাম,মনের ভিতর এক আফোসোসের ঢেউ নদী হয়ে গেল, না আমার কল্পনা সত্যি হয়নি আজো, কল্পনায় সাজানো মানুষটিকে আজো দেখতেই পেলাম না, সবাই আছে, কিন্তু কোথাও কেউ নেই, এমন অবস্থায় কাটছে আমার বারোমাস!
অনেকদিন পরে আজ বাড়ি যাব,,মনের ভিতর সুপ্ত ইচ্ছে যেন ডানা মেলতে চাইছে, আমার কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে হয়তো দেখতে পাব যাওয়ার পথে, বাসের ভিতরে বসে একনজর চোখের দেখা বাইরে দাঁড়ানো মানুষটিকে! রাত ১০টায় বাসে উঠলাম,সকাল ৭টাল দিকে খুব আগ্রহ নিয়ে চলন্ত বাসে বসে ডায়াল করলাম একটি নাম্বার… যান্ত্রিক কন্ঠে উত্তর এলো,'””sorry the number you have dialed is currently switched off”” প্রথমবার যান্ত্রিক কন্ঠ শুনে মনে মনে নেটওয়ার্কের সমস্যাকেই ফাঁসিকাষ্ঠে তুললাম! এরপর ধীরেসুস্থে আবার ডায়াল করলাম, এরপর আবার টানা ২০/২৫ বার একই নাম্বারে কল দিতে থাকলাম, কিন্তু প্রতিবারই সেই যান্ত্রিক কন্ঠ ভেসে আসতে লাগলো,বাসের গতি থেমে থাকলো না, একসময় আমার আশা ভঙ্গ করে বাস চলে আসলো সেই জায়গা ছাড়িয়ে যেখানে তাকে দেখার সম্ভবনা ছিলো। এখনো ডায়ালকৃত নাম্বারটি বন্ধই আছে, অপেক্ষা কতটো দীর্ঘ আর আক্ষেপ দিতে পারে, এই সময়টা না আসলে বুঝতামই না, নানুবাড়ি এসে হাতমুখ ধুয়ে অনুর সাথে বসলাম, সব কথার এক কথা,”মুড ঠিক নাই, এতোবার কল দিলাম, বন্ধ দেখালো, ইচ্ছে করেই কি বন্ধ করে রাখছে নাকি!””” বেলা ৩টার দিকে সেই নাম্বারটিতে কল ঢুকলো, রিসিভও হলো, আমি কোনোরকম ভণিতা না করে সরাসরি জিগ্যেস করলাম,””কি ব্যাপার ফোন কেন বন্ধ রাখছিলেন?”’
ওপাশ থেকে উত্তর আসলো,”’চার্জ ছিলোনা তাই বন্ধ হয়ে গেছিলো রাতে””।
এই উত্তরটা ঠিক মন মতো হলোনা আমার. ,কিছুটা ক্ষোভের সাথেই কল কাটতে উদ্যত হলাম, কিন্তু ওপাশ থেকে কিছুটা আশ্বাস পেলাম পরে দেখা পাওয়ার, নানুবাড়িতে তখন বুড়োমেলার ধুম, কি মনে করে যেন তাকে বললাম মেলায় ঘুরতে আসতে, যদিও জানতাম সে আসবেনা, হলোও তাই,সে আসলোনা! ১৫ দিন নানুবাড়িতে থাকার পর আবার ফেরার সময় হয়ে এলো আবারো একটি সুপ্ত ইচ্ছা মনে জেকে বসলো, ফেরার সময় গোলাপি রংয়ের সালোয়ার-কামিজ পরলাম, বাসে উঠলাম সকাল ১১টার দিকে, দুপুর ১টার দিকে বাস থামলো রেস্টুরেন্টে, কি যেন মনে হলো,আমার চোখ কি যেন খুজে যাচ্ছিলো,আমি পুরো রেস্টুরেন্টে উভ্রান্তের মতো ঘুরলাম, জানিনা কিসের আশায়, তবে মনের কোথাও একটা একটি সম্ভবনা উঁকি দিচ্ছিলো, মনে হচ্ছিলো এখানেই কোথাও একটা সে আছে! কিন্তু আমার খুঁজে ফেরাটা সফল হলোনা, আমি পেলাম না যাকে খুজলাম তাকে,এটা হয়তো পাগলামিই বলা যায়,কারণ কারো অবস্থান না জেনে কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর!আমি একটা আইসক্রিম আর বার্গার কিনে রেস্টুরেন্টের বাইরে এসে কল দিলাম, প্রথম ২বার বন্ধ পেলাম,এরপর রিং হলো, এবং রিসিভও হলো,আমি তাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বললাম ,”””তুমি কি ……..রেস্টুরেন্টে ছিলে? আর তোমার তো বাসা এখান থেকে দূরে না অনেক, একবার এখানে আসো,””
আমাকে অবাক করে দিয়ে সে বললো,””””আগে বলতে হয় না!আমি ১ ঘন্টা আগেই ওখানে ছিলাম, একটা কাজে গিয়েছিলাম, আমাকে রওনা দেয়ার সময় বললেই আজকে দেখা হয়ে যেত!”””
আমি বিস্মিত হলাম! আমার ষষ্ঠইন্দ্রিয় তাহলে ভুল আভাস দেয়নি সে এখানেই ছিলো! একটুর জন্য অপেক্ষাটা শেষ হলেও হলো না!
এরপর আরো দুএকবার বাড়ি যাওয়া হয়েছে .তবে প্রতিবারই কোনো না কোনো কারণে আর দেখাটা হয়ে ওঠেনি, এক আক্ষেপ থেকেই গেলো, কে জানে বাস্তবে দেখাটা হয়ে উঠবে কবে!
এরপর কেটে গেছে বছর পাঁচেক, সেই মানুষকে কাগজো কলমে নিজের করে পাওয়ার মুহুর্তটা ফ্রেমে বন্দি করে রাখার মতো!এখন ঝুম বৃষ্টি নামলে কিংবা শীতকালের কুয়াশাতে কারো জন্য মন খারাপ করে বসে থাকতে হয়না,সামনে তাকালেই পেয়ে যাই তাকে,অনূভুতির রাজ্যটা কল্পনা থেকে বাস্তবে আসার পরে সবকিছু যেন এক নিমেষে পাল্টে যায়, কোনো আফসোস থাকেনা আর. ..শুরুতে যদি সেই অপেক্ষা না থাকতো, আক্ষেপ না থাকতো, হয়তো আজকের এই সুন্দর সময়ের মূল্য বুঝতাম না,
অপেক্ষা সুন্দর, ভালোবাসার মতোই সুন্দর, অপেক্ষা আক্ষেপ ভালোবাসা একই সাথে চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে।
Post a Comment