নীতি গল্প: ভালো থাকুন, ভালো রাখুন সবাইকে

নীতি গল্প: ভালো থাকুন, ভালো রাখুন সবাইকে

একটি শিক্ষামূলক গল্প। এই গল্পটা হয়তো আমার বিজ্ঞ, বিচক্ষণ বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই জানেন। তবুও আমি নিশ্চিত , নতুন করে জানতে তাদের সবার ভালো লাগবে। আসলে এটা কোনো গল্প নয় , একটা খেলা। খুব ছোট্ট , সাধারণ একটা খেলা যার সারমর্ম জুড়ে লুকিয়ে আছে এক গভীর নীতিজ্ঞান আর আমাদের মূল্যবোধের অবনমনের প্রতি নির্মম কষাঘাত ।

এই খেলার সাথে আমার পরিচয় ঘটে স্থানীয় এক বি এড কলেজের কোনো বার্ষিক অনুষ্ঠানে। সেই অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে আমরা কয়েকজন আমন্ত্রিত ছিলাম। যারা বিএড কলেজে পড়েছেন বা কখনও সেখানে গেছেন, তারা হয়তো জানেন ছোট বিএড কলেজের সব সদস্যরা মিলে কার্যত একটি বড়সড় পরিবারের আকার নেয়। তো সেই অনুষ্ঠানেই কলেজের অধ্যক্ষ মহোদয়কে অনুরোধ করা হলো কিছু বলার জন্য। তিনি যেন খুব অভিনব ভঙ্গিতে কিছু একটা শেখাতে যেন উৎসুক ছিলেন আমাদের সকলকে। আর তাঁর সেই শিক্ষাপদ্ধতি দেখে আমরাও কার্যত তাজ্জব বনে গেলাম। কি করলেন তিনি?

তিনি এক এক করে কলেজের তিনজন ছাত্র আর তিনজন ছাত্রীকে এনে দাঁড় করালেন এক সারিতে। তারপর ছয়জনের হাতেই ধরিয়ে দিলেন একটা করে বেলুন। এর পর নির্দেশ দিলেন বেলুনগুলিকে মাঝারি আকারে ফোলাতে। যেন কোনোভাবেই ফোলাতে গিয়ে বেলুনগুলো ফেটে না যায়।

সবাই নির্দেশ মতো কাজ করলো। কারোরই বেলুন ফাটলো না। এরপর তিনি প্রত্যেকের হাতে একটা করে আলপিন ধরিয়ে দিলেন। আলপিন ধরিয়েই তিনি বললেন –

তিন মিনিট সময় এই খেলার। এই তিন মিনিট পর যার বেলুন অক্ষত থাকবে, সেই হবে এই খেলার বিজয়ী। স্টার্ট !!!

স্টার্ট বলার সাথে সাথে সবাই একে অপরের ওপর হুড়মুড়িয়ে পড়লো। যে করেই হোক নিজের বেলুনটা রক্ষা করতে হবে আর অন্যের বেলুনটা ফাটাতে হবে। আলপিন তো আছেই হাতে। আমরা সবাই দর্শকের আসনে বসে ভবিষ্যত শিক্ষকদের এই কীর্তিকলাপ দেখছি, আর মনে মনে হাসছি। কি বাচ্চাদের মতোই না আচরণ করছে তারা! নিজের বেলুন রক্ষার থেকেও বেশি মনোনিবেশ এখন অন্যের বেলুন ফাটানোতে। মাত্র এক মিনিট যেতে না যেতেই দেখা যাচ্ছে সবার বেলুন ফেটে গেছে, শুধু একজনেরটা অবশিষ্ট আছে। সবাই মিলে সেটাও ফাটিয়ে দিল!

তাহলে, খেলার ফল কি হল? তিন মিনিট তো দূর অস্ত! মায় একমিনিটও আয়ু প্রাপ্ত হলো না কারুর বেলুন। অতএব, খেলায় কেউ জিতলো না! এবার অধ্যক্ষ মহোদয় এসে বললেন –

এর ঠিক উল্টোটা কি হতে পারতো? আমরা সবাই জিততে পারতাম। পারতাম না কি? তোমরাই বল। তোমাদের কাউকে বলা হয়নি যে অন্যের বেলুন ফাটাতে হবে। বলা হয়েছিল তিনমিনিট পর যার বেলুন অক্ষত থাকবে সেই বিজয়ী। তোমাদের সবার বেলুন অক্ষত থাকতে পারতো আর তোমরা সবাই বিজয়ী হতে পারতে!

এই বেলুন আমাদের জীবনেরই প্রতীকী যেন। আর এর ভেতরে থাকা হাওয়া হলো আমাদের সাফল্য, যাকে ধরে রাখতে আমরা বদ্ধপরিকর। হাতে থাকা আলপিন হল ঈশ্বরপ্রদত্ত এমন একটা ক্ষমতা যার মাধ্যমে আমরা অন্যের সাফল্য কে বিনষ্ট করতে সচেষ্ট হতে পারি। আর এরা সবাই নিজের প্রকৃত কাজ ফেলে সেই কাজটাতেই বেশি মনোনিবেশ করেছিল।

ঠিক এটাই ঘটছে আমাদের সমাজে। আমরা সবাই নিজেদের সাফল্যের পথকে মসৃন করার তাগিদে অন্য সবার ব্যর্থতা কামনা করি। আমরা ধরেই নিই, যে আমাদের সফলতার স্বর্গের সিঁড়ি নির্মিত হবে অন্য কারো না কারো ব্যর্থতার মরদেহের ওপর। আমাদের প্রত্যেক কার্যকলাপে প্রমাণিত হয়, কিভাবে নিজের চেষ্টার চেয়ে অন্যের ব্যর্থতার প্রতি আমাদের মনোনিবেশ বেশি, কিভাবে নিজের সাফল্যের চেয়ে অন্যের ব্যর্থতার আনন্দ আমরা বেশি উপভোগ করি। যেন জীবনটা কোনো ক্রিকেট ম্যাচ, নিজেকে জিততে হলে অন্যকে হারাতে হবে।

কিন্তু আমাদের মানবসমাজের অগ্রগতি তো এভাবে হয় না । যদি সহস্র প্রতিদ্বন্দ্বী কে হারিয়ে একজনই মাত্র সফল হতো যুগ যুগ ধরে, তাহলে কিছু ব্যক্তিবিশেষেরই হয়তো উন্নতি হতো, সামগ্রিক পৃথিবী চলে যেত পশ্চাদগতির অতল অন্ধকারে। সেই অন্ধকার কিন্তু কাউকে ছেড়ে দিত না, সফল থেকে সফলতম ব্যক্তিকেও গ্রাস করে নিতে দ্বিধাবোধ করতো না সেই অন্ধকার । কাজেই, যা প্রকৃত সাফল্য তা নির্ধারিত হয় সকলের মিলিত প্রচেষ্টায়, সকলের হিতার্থে, সকলের মঙ্গলকামনায় ।

ঠিক এখানেই আমাদের মনের পটভূমিতে রচিত হয় ঐক্যবদ্ধতার সংজ্ঞা , TEAM এর সংজ্ঞা । যেই TEAM এর অর্থ গিয়ে দাঁড়ায় –

T— Together

E–Everyone

A–Achieves

M–More

আর জীবনে যারা দলবদ্ধ না থেকে একলা চলায় বিশ্বাসী, তাদের মতবাদকেও স্বাগত জানাই। কিন্তু এও ঠিক, একলা চলার অর্থ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া নয়, আর সমাজের কারো অনিষ্টসাধন তো নয়ই। আমার জয় মানেই কিন্তু অন্য কারো হেরে যাওয়া নয়। বরং, হ্যাঁ, কারো বিফলতা, কারো পশ্চাদপদতা মানবসমাজের অংশ হিসেবে আমাদেরও সামগ্রিক ব্যর্থতার কারণ হতে পারে। শেষ করবো গুরুদেবের কিছু কথা দিয়ে —

যারে তুমি নীচে ফেল, সে তোমারে বাঁধিছে যে নীচে,

পশ্চাতে রাখিছ যারে, সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।

ভালো থাকুন, ভালো রাখুন সবাইকে ।।

No comments