বাঁচার মতো বাঁচা – তারাপদ রায়

বাঁচার মতো বাঁচা – তারাপদ রায়

বড় বড় লেখকেরা বাঁচা মরার গল্প লিখে কিংবা উলটো ভাবে বলা যায় মরা বাঁচার কাহিনি লিখে নাম করেন। বাঁচা মরার গল্প খুব গুছিয়ে লিখতে পারলে, তার মধ্যে আর্থ সামাজিক বীক্ষণ যদি থাকে তবে তো পোয়াবারো, জয়জয়কার।

আমার মতো হালকা গল্প লিখে লেখক সমাজে কলকে পাওয়া অসম্ভব। পুরস্কার-টুরস্কার তো কোনও দিনই পাব না, সভাসমিতিতে বক্তৃতা করতেও কেউ সচরাচর ডাকে না, এমনকী আমার লেখা বই পর্যন্ত সমালোচকেরা আলোচনা করে হাস্যাস্পদ হতে চান না।

সুতরাং অবশেষে আমি একটা জীবনমরণ প্রতিজ্ঞা করেছি, অন্তত একটা, কমপক্ষে একটা বাঁচা। মরার গল্প লিখবই, লিখব।

এই জীবনধর্মী গল্পটি সেই প্রতিজ্ঞারই ফসল।

প্রথমেই কবুল করে রাখি, এই গল্পের নায়কের নাম জীবনচন্দ্র চক্রবর্তী।

সুতরাং গল্পটি, এই ছোট রচনাটি কয়েক মিনিটের মধ্যে পাঠ করার আগে কোনও সমাজ সচেতন, আর্থ-রাজনৈতিক চিন্তায় চিন্তিত পাঠক যদি কোনও কটু প্রশ্ন তোলেন তাই আগে ভাগেই ব্যাখ্যাটা দিয়ে রাখছি, আর কোনও কারণে নয়, শুধু এই ক্ষুদ্র কাহিনির নায়কের নাম জীবন বলেই এটাকে একটা জীবনধর্মী কাহিনি হিসেবে ধরা যেতে পারে।

আমাদের এই খণ্ড কাহিনির সামান্য নায়ক শ্রীযুক্ত জীবনচন্দ্র চক্রবর্তীর জীবন কাহিনি কিন্তু রীতিমতো রোমাঞ্চকর এবং যথেষ্টই শিক্ষাপ্রদ।

জীবনবাবুর পূর্বপুরুষদের বসবাস ছিল সাবেকি বঙ্গ প্রদেশের ঢাকা বিভাগের ঢাকা জেলার মুন্সিগঞ্জ মহকুমার বিক্রমপুর পরগনার অন্তর্গত ডিহি গজানন নগরের নন্দপুকুর গ্রামে।

স্বাধীনতা মানে পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের কাছে যেটা পার্টিশন, দেশ ভাগ, সেই দুঃখজনক, হৃদয়বিদারক ঘটনার পরেও প্রায় বছর তিনেক জীবনবাবু নন্দপুকুর গ্রামে পিতৃপুরুষের ভিটেয় থাকার চেষ্টা করেছিলেন।

উনিশশো সতেরো সালে জীবনচন্দ্রের জন্ম। সেই গোলমেলে সাতচল্লিশ সালে তার বয়েস নিতান্ত তিরিশ। কিন্তু বিরাট সংসারের বোঝা ঘাড়ে।

বাইশ বছর বয়েসে বিয়ে করেছিলেন জীবনচন্দ্র, তেইশ বছর বয়েসে তার স্ত্রী মারা যান, পিত্রালয় থেকে ফেরার পথে ঝড়ে নৌকোডুবি হয়ে ধলেশ্বরী নদীতে।

কিন্তু তাতে সংসারের দায়দায়িত্ব মোটেই কমেনি। নিজের এবং খুড়তুতো, জ্যাঠতুতো এবং সেই সঙ্গে পিসতুতো ভাই বোন (এক বিধবা পিসিমা তাঁদের নন্দপুকুর বাড়িতে থাকতেন)। শুধু তুতো ভাইবোনের সংখ্যাই একুশজন, সেই সঙ্গে নিজের বিধবা মা এবং ঠাকুমা সমেত ওই সব ভাই বোনদের জনকজননীর সংখ্যা এগারো। এর ওপরে ছিল আসোজন বসোজন।

একেক বেলায় চল্লিশ-পঞ্চাশ জনের পাত পড়ত জীবনচন্দ্রদের নন্দপুকুরের বাড়িতে। এক সময়ে প্রচুর ধান জমি ছিল তাদের, পরবর্তীকালে কাঁচা টাকার লোভে এর কিছু কিছু জমিতে পাট চাষ করা হত। কিন্তু দেশ বিভাগের পরে সেসব জমির ফসল সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াল।

তবু জমিজমা বেচে, কষ্ট করে জীবনচন্দ্র উনিশশো পঞ্চাশ সাল পর্যন্ত নন্দপুকুরেই থাকার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু সে বছরের মারাত্মক দাঙ্গার পরে আর থাকতে পারলেন না। আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী স্বজাতি সকলেই ক্রমে ক্রমে দেশ ছেড়েছে। এমনকী এতদিন যারা জীবনচন্দ্রের মুখাপেক্ষী ছিল, তারাও অনেকে একে একে এপারে চলে এল।

অবশেষে জীবনচন্দ্রও একদিন সাত পুরুষের ভিটে ছেড়ে সংসারের বাকি যারা অবশিষ্ট ছিল সবাইকে নিয়ে কলকাতায় চলে এলেন। ভিটে বাড়ি, জমি জমা বেচে সামান্য কিছু টাকা পাওয়া গিয়েছিল, সেই অর্থের ওপর ভরসা করে সেই সঙ্গে মা-ঠাকুমার গায়ের অবশিষ্ট গয়নাটুকু কলকাতায় এসে স্যাকরার কাছে বাঁধা দিয়ে জীবনচন্দ্ৰ নতুন জীবন শুরু করলেন।

তখন জীবনচন্দ্রের বয়েস মাত্র তেত্রিশ। চাকরি করার বা ব্যবসার অভিজ্ঞতা কিছু নেই, কলকাতা মহানগরী সম্পর্কেও তার মনে একটা অজানা, দ্বিধাগ্রস্ত ভাব।

যা হোক সদর কলকাতায় না থেকে শহরতলি দমদমে ষাট টাকায় একটা ছোট একতলা বাড়ি ভাড়া করে বসবাস শুরু করলেন জীবনচন্দ্র।

টাকা ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে। এদিকে ঠাকুমা, মা দুজনেই বিগত হয়েছেন। তবুও সংসারে সাত আটটি পুষ্যি এখনও বর্তমান। তাদের বাঁচা মরা সবই এখনও জীবনবাবুর ওপরেই নির্ভর করছে।

অতঃপর শুরু হল জীবনবাবুর জীবন সংগ্রাম।

সে এক ভয়াবহ, অসম লড়াই।

বেঁচে থাকার জন্যে জীবনবাবুকে কী কী করতে হয়েছে তার তালিকা রচনা করতে গেলে সে খুবই দীর্ঘ হয়ে যাবে। তা ছাড়া যেকোনও বুদ্ধিমান লোকই সেসব অনুমান করতে পারেন।

কথায় আছে, অসফল ব্যবসায়ী আলপিন থেকে হাতি সব কিছুর ব্যবসা করার চেষ্টা করে।

ব্যবসা মানে কেনা বেচা। কোনও জিনিস কিনে সেটা বেচা। কেনার দর আর বেচার দর, এই দুইয়ের মধ্যে যত ব্যবধান হবে ততই লাভ।

হাতি কিংবা হাতি জাতীয় দুর্মূল্য, দুর্লভ জিনিস কেনা বেচার অসুবিধে হল যত সহজে কেনা যায় তত সহজে বেচা যায় না। আর ব্যবসার আসল রহস্য হল ওইখানে, কেনার পর যত তাড়াতাড়ি বেচা যায়, লাভ যতই কম হোক, আবার কেনা-বেচা করা যাবে। আবার লাভ, এই ভাবে পৌনঃপুনিক লাভ এক দফায় লাভের থেকে বেশি।

এই অর্থে হাতির ব্যবসা কোনও কাজের কথা নয়। যত ছোট, যত কম দামের জিনিস হবে তত সুবিধে।

জীবন সংগ্রামে জীবনবাবু সফল হয়েছিলেন।

তিনি বুদ্ধিমান লোক ছিলেন এবং সহজেই টের পেয়েছিলেন যে তাঁর পক্ষে বড় কিছুর ব্যবসা ঠিক হবে না। বলা বাহুল্য, তিনি ঠিকই ধরেছিলেন। তিনি হাতির ব্যবসা করেননি। এবং শুধু হাতি কেন, তিমি, জিরাফ, জলহস্তী কোনও কিছুর ব্যবসাতেই তিনি মাথা গলাননি।

এখানে লিখে রাখা উচিত, সে সময়ে জীবনবাবুর সে সামর্থ্যও খুব ছিল না।

তখন দমদমে প্রচুর ব্যাঙ। সে দমদম এ দমদম নয়। পানাপুকুর, ডোবা, দমদম, সিঁথি আর বরানগরের মধ্যে দৈর্ঘ্য-প্রস্থে লম্বা-চওড়া জলাজমি।

আর সেই জলাজমিতে ব্যাঙ আর ব্যাঙ। সে যে কতরকম ব্যাঙ, কোলা ব্যাঙ, চোলা ব্যাঙ, ধেড়ে ব্যাঙ, ধাড়ি ব্যাঙ, টুনি ব্যাঙ, টোনা ব্যাঙ।

দমদমের বাসিন্দাদের তখন খুব রাগ ছিল ব্যাঙের ওপরে। সকাল নেই, সন্ধ্যা নেই, সারাদিন সারারাত শুধু ঘ্যাঙর ঘোঁ, ঘো ঘোঁ এবং ঘোঁ ঘোঁস, ঘ্যাঙর ঘোঁকঁহাতক সহ্য করা যায়।

কিন্তু জীবনচন্দ্রের জীবনবোধ ছিল অন্যরকম। তার প্রজ্ঞাও ছিল অসাধারণ।

ঢাকা, মুন্সীগঞ্জের ছেলে, সরাসরি বলা যায় নন্দপুকুর গ্রামের সুসন্তান জীবনচন্দ্রের জীবনে ব্যাঙের অভিজ্ঞতা এই প্রথম নয়। তিনি জানতেন, ভালই জানতেন ব্যাঙ পোকা মাকড় এমনকী জোনাকি ধরে খায়। জোনাকির আলো জ্বলে আর নেভে, সে শুধু ব্যাঙকে ধরানোর জন্যে।

কিন্তু দমদমে এসে জীবনবাবুর অভিজ্ঞতা হল যে সাধারণ পোকামাকড় নয়, জোনাকি নয় ব্যাঙের সবচেয়ে প্রিয় খাদ্য হল মশা, মানুষের রক্তাপ্লুত মশা।

তখন দমদমে মশাও খুব। রাতে মশারি টাঙিয়ে শুলেও মশারির জাল ভেদ করে মশা ঢুকে যায়, তারপর কামড়িয়ে জর্জরিত করে।

কিন্তু যেদিন থেকে জীবনচন্দ্র টের পেলেন যে ব্যাঙ হল মশাভোজী প্রাণী, মুখের নাগালের মধ্যে পেলে উড়ন্ত মশাকে এক লাফে ধরে সে গিলে ফেলতে পারে। তিনি ব্যাঙকে নিজের কাজে ব্যবহার করতে লাগলেন।

সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় চারটে বড় কোলা ব্যাঙ ধরে তার তক্তাপোশের চার পায়ার সঙ্গে এক পায়ে দড়ি বেঁধে আটকিয়ে দিলেন।

মশারির মধ্যে মশা ঢোকে প্রধানত বিছানার তোষকের নীচে যেখানে মশারি গোঁজা হয় সেই গোঁজার সূক্ষ্ম ফাঁক দিয়ে।

ব্যাঙ বেঁধে রাখার ব্যবস্থা করায় মশাদের অনুপ্রবেশ করার জায়গা ব্যাঙগুলোর নাগালের মধ্যে এসে গেল। তারপর, কী আশ্চর্য, সেই রাত থেকে জীবনচন্দ্রের মশারির মধ্যে আর একটি মশাও ঢুকতে পারল না।

এই ঘটনা এই কাহিনির পক্ষে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, শুধু একটা কথা এখানে জানানো দরকার যে মশার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে ব্যাঙ ধরে ধরে জীবনচন্দ্র এই বিদ্যায় এক্সপার্ট হয়ে। গিয়েছিলেন।

এরপরের ঘটনাবলি খুবই সংক্ষিপ্ত। যখন আলপিন, সেফটিপিন, গুলিসুতো, কান খোঁচানি, জিবছোলা ইত্যাদির ব্যবসায়ে জীবনচন্দ্র প্রায় সর্বস্বান্ত হতে বসেছেন সেই সময়ে খবর পেলেন, খবরের কাগজে দেখতেও পেলেন জাপান, হংকং, সিঙ্গাপুরে খুব ব্যাঙের চাহিদা তাদের দিশি ব্যাঙে আর হচ্ছে না তারা ভারত থেকে ব্যাঙ আমদানি করতে চায়।

সঙ্গে সঙ্গে যথাস্থানে যোগাযোগ করলেন জীবনচন্দ্র এবং সেই যোগাযোগ ফলপ্রসূ হল।

এরপর থেকে তিনি তাঁর আটজন সম্পর্কিত এবং নিজের ভাইবোন, এই বিরাট ম্যান পাওয়ার নিয়ে ব্যাঙ ধরতে নেমে গেলেন। পরে অবশ্য মাইনে করা লোকও তাকে রাখতে হয়েছিল।

সূর্যোদয়ের দু ঘন্টা আগে থেকে সেই সূর্যাস্তের এক ঘণ্টা পরে পর্যন্ত সকাল নেই, দুপুর নেই, বিকেল নেই, সন্ধ্যা নেই সারাদিনমান ব্যাঙ ধরা চলতে লাগল, দমদমের খালে-নালায়, জলায়-ড্রেনে। সেই সময় দমদমকে তিনি প্রায় ব্যাঙ শূন্য করে ফেলেছিলেন, হয়তো সত্যিই ওই অঞ্চল থেকে ব্যাঙ নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত কিন্তু ইতিমধ্যে বানর চালানের হিড়িক পড়ে গেল।

দমদমে আবার বানর নেই। তার জন্যে সেই দক্ষিণেশ্বর, আলমবাজার, কলকাতার হেস্টিংস, ময়দান এইসব জায়গায় ছুটতে হল। আর বানর ধরা সোজা কাজ নয়।

বিস্তারিত বর্ণনায় গিয়ে লাভ নেই।

মোদ্দা কথা, ব্যাঙ চালানের আর বানর চালানের কারবারেও কিন্তু খুবই সফল হলেন জীবনচন্দ্র। এক জীবনে একার চেষ্টায় ও পরিশ্রমে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করলেন। সবচেয়ে বড় কথা টাকা দু হাতে উপার্জন করলেন বটে কিন্তু জীবনচন্দ্রের জীবনধারা একদম পালটাল না।

সেই মালকোঁচা মারা ধুতি, কালো কাবলি জুতো আর ফুলহাতা টুইলের শার্ট যে পোশাকে গ্রাম ছেড়ে তিনি কলকাতায় এসেছিলেন সেই পোশাক আর বদলায়নি।

খাওয়া-দাওয়া, চালচলনেও কোনও ব্যতিক্রম নেই। নিজের কোনও গাড়ি নেই, একটা জাল ঢাকা ভ্যান আছে সেটা বানরদের জন্যে। জীবনচন্দ্র নিজে ট্রামে বাসেই যাতায়াত করেন।

শুধু ওই দমদমের ভাড়াটে বাড়ি কিনে সেটাকে তিনতলা করেছেন। আর সবই খরচ করেছেন তার পুষ্যিদের জন্যে।

জীবনচন্দ্র যখন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ফুটপাথের দোকানে মাটির ঊড়ে চা খেতেন কেউ ভাবতেও পারত না এই লোকটাই খুড়তুতো ভাইকে আমেরিকা পাঠিয়েছে, পাঁচ লক্ষ টাকা খরচ করে বোনের বিয়ে দিয়েছে। এরই পয়সায় ভাই-ভাইপোরা লাল মারুতি, সাদা অ্যামবাসাডর হাঁকাচ্ছে, বারে-রেস্তোরাঁয় টাকা ওড়াচ্ছে, সল্ট লেকে বাড়ি বানাচ্ছে।

তাদের সব বড়লোকি চালচলন, বড়লোকি ব্যবসা। এক ভাইপো সিনেমার প্রডিউসার হয়েছে। আরেক ভাইপো কবিতার কাগজ করেছে। সব ফ্লপ হওয়ার কারবার। নিঃসন্তান, বিগতদার জ্যাঠার পয়সা, বহু কষ্টার্জিত পয়সার তারা সদ্ব্যবহার করতে লাগল।

এবং এসব ক্ষেত্রে সাধারণত যা হয়ে থাকে তারা ধরেই নিয়েছিল যে তাদের জ্যাঠা খুব বোকা, একেবারে মূর্খ, গণ্ডমূর্খ। এত কষ্টের উপার্জনের টাকা একটু ফুর্তি করল না। একটু আহ্লাদ করল না, একটু বিলাসিতা করল না, অন্তত আরও একটা বিয়ে তো করতে পারত।

জ্যাঠা আরেকবার দারগ্রহণ করলে তাদের যে কী অবস্থা হতে পারত, তারা সেসব ভাবেনি। তারা আগাগোড়া জ্যাঠাকে বোকাই ভেবে গেছে।

কিন্তু জীবনচন্দ্র বোকা নন। কোনও বোকা লোক ব্যবসায় উন্নতি করতে পারে না।

তবে জীবনচন্দ্র জীবনসায়াহ্নে পঁচাত্তর বছর বয়েসে পৌঁছে ভেবে দেখলেন জীবনে সাধ আহ্লাদ কিছুই পূরণ করা হল না। এক নাগাড়ে দম না ফেলে খাটতে খাটতেই সারা জীবন চলে গেল।

এত টাকা পয়সা, সব ভাই-ভাইপোরা ধ্বংস করছে। তার নিজের প্রয়োজন খুবই কম। আর এ বয়েসে এসে হঠাৎ বিলাসিতা শুরু করা বেমানান হবে। তা ছাড়া বিলাসিতার পরিশ্রমও কিছু কম নয়, সেটা অভ্যাস করতে হয়।

কিন্তু নিজের জন্যে তো কিছু খরচ করতে হবে। পুরো জীবনটা কৃচ্ছসাধনে ব্যয় করার পর এই চিন্তাটা বার বার ঘুরে ঘুরে জীবনবাবুর মাথায় আসতে লাগল।

অবশেষে নিজেই একটা বুদ্ধি বার করলেন। বুদ্ধির অভাব তার কোনও দিনই হয়নি, এবারেও হল না।

জীবনচন্দ্র তার সহ ব্যবসায়ী প্রাণগোপালের কাছে গেলেন। গিয়ে প্রাণগোপালকে বললেন, দ্যাখো, আমার পঁচাত্তর বৎসর বয়েস হয়েছে। আমার নিজের ধারণা আমি আর খুব বেশিদিন বাঁচব না।

হ্যাঁ, কিংবা না কিছু না বলে প্রাণগোপাল মন দিয়ে জীবনচন্দ্রের কথা শুনতে লাগলেন।

জীবনচন্দ্র তার কাঁধের ঝোলা থেকে একশো টাকার নোটের দশটা বান্ডিল মোট এক লক্ষ টাকা বার করে প্রাণগোপালকে দিলেন এবং সেই সঙ্গে একটি তালিকা। প্রাণগোপাল সেই তালিকাটি খুঁটিয়ে দেখলেন এবং টাকার বান্ডিল ও তালিকাটি যত্ন করে দেয়াল সিন্দুকে ভরে রাখলেন।

এর অল্প কিছুদিন পরে জীবনচন্দ্র মারা গেলেন।

খবর পেয়ে নবাগতা নায়িকার ফ্ল্যাট থেকে ছুটে এলেন প্রডিউসার ভাইপো। বার থেকে টলতে টলতে এসে গেলেন আরেক ভাইপো। অন্য একজন গাঁজা পার্কে উঠতি কবিদের সঙ্গে গঞ্জিকা সেবন করতে করতে পরবর্তী সংখ্যার পরিকল্পনা করছিলেন। তিনিও ছুটে এলেন।

দেখা গেল, কোনও রকমে জ্যেষ্ঠতাতের শেষকৃত্য নমোনমো করে শেষ করে যে যার ভাগ তাড়াতাড়ি বুঝে নেওয়াই তাদের সকলের উদ্দেশ্য।

জীবনচন্দ্রের এক ভাই তখনও জীবিত। কিন্তু পক্ষাঘাতে তিনি শয্যাশায়ী। বাকরুদ্ধ। তাঁর মতামত কিছু জানা গেল না। তবে তার মত আর কী আলাদা হত?

সবাই বলাবলি করছে কাশী মিত্রের ঘাটে নিয়ে যাবে না নিমতলায়। কোথায় তাড়াতাড়ি হবে।

এমন সময় খবর পেয়ে প্রাণগোপাল এলেন। এসে বললেন, আপনাদের কিছু ভাবতে হবে। আমি সব ব্যবস্থা করছি।

সত্যিই সুব্যবস্থা। একজন মৃতের জন্যে এর চেয়ে ভাল ব্যবস্থা আর হতে পারে না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ফুলে ঢাকা বিশাল ট্রাক এল। এক হাজার আটটি শ্বেতপদ্ম দিয়ে সাজানো। এল অগুরু, চন্দন। সিল্কের পাঞ্জাবি, তাতের কোরা ধুতি পরানো হল জীবনচন্দ্রকে, যেসব জিনিস তিনি জীবনে পরিধান করতে পারেননি।

সাদা ফুলে সাজানো মাইক লাগানো আরও বহু গাড়ি এল। বিখ্যাত সানাইবাদক রহমতুল্লা করুণ, করুণতর সুরে সানাই বাজালেন। তার পিছনের গাড়িতেই ততোধিক বিখ্যাত কীর্তন গায়িকা আশারানী। তিনি মধুর কণ্ঠে হরিনাম গাইতে লাগলেন।

শ্মশানে আর এক এলাহি কাণ্ড। কয়েক মণ চন্দন কাঠ, দুই কলসি ঘি। শ্মশান বন্ধুদের জন্যে দই, রাবড়ি, সন্দেশ।

মহাসমারোহে জীবনচন্দ্রের সকার হল। ভাইপোরা স্তম্ভিত হয়ে গেল।

শুধু যারা জীবনচন্দ্রকে জানত না, যারা শবযাত্রা ও সৎকারের প্রত্যক্ষদর্শী তারা সবাই একবাক্যে স্বীকার করল, একেই বলে বেঁচে থাকা। একেই বলে বাঁচার মতো বাঁচা।

No comments