লামডিঙের আশ্চর্য লোকেরা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
লামডিঙে খুবই অদ্ভুত–অদ্ভুত ধরনের ঘটনা ঘটত। এই ছোট্ট শহরে কৃপণ, লোভী, রাগি, চোর, সাধু, ম্যাজিসিয়ান, ডাকাত, সাহসী, ভীতু নানারকমেরই লোক ছিল। সকলেই সকলকে চিনত।
মগন ছিল চোর এবং খুব একটা উঁচু দরের চোরও নয়। প্রায়ই চুরি করতে কারও বাড়ি ঢুকে ধরা পড়ে যেত। সত্যসিন্ধুবাবুর বউ একদিন তাকে রান্নাঘরে ধরে ফেললেন। চুরি করার আগে মগন জালের মিটসেফ থেকে মাছের ঝোল আর ভাত বের করে খাচ্ছিল আপন মনে। খেয়েদেয়ে বাসনপত্র নিয়ে সটকাবার মতলব। ধরা পড়ে যাওয়ায় খুব বিগলিত মুখে বলল , চারটি খাচ্ছি মাসিমা। গরিবের তো এই একটাই দোষ, বড্ড খিদে পায়। সত্যসিন্ধুবাবুর বউ তাতে গললেন না, চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করলেন। লোক জড়ো হয়ে মগনকে নাকে খৎ দেওয়ালো। এতে প্রতিবেশী গগনবাবু একটু অসন্তুষ্ট হয়ে রীতিমতো উঁচু গলায় কালীবাবুকে বললেন মশায় মগনটা একেবারে কাঁচা চোর বটে, কিন্তু চোর তো? এ তল্লাটে ওই মোটে একটাই চোর, তা ও যদি চুরি ছেড়েই দেয় তবে গেরস্তকে সজাগ রাখার আর তো উপায়ই রইল না। চোর ছ্যাঁচড় থাকলে মানুষ সাবধান হতে শেখে, নষ্টচন্দ্রার দিন যে চুরির প্রথা আছে তাও হল ওই জিনিসই। আমি বলি কি, মগন যদি চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েই তবে আমাদের উচিত তাকে হাসিমুখে ক্ষমা করা। মগন। আমাদের একটা মৌলিক শিক্ষা তো দেয়। সতর্কতার শিক্ষা।
কালীবাবু কথাটার যুক্তিযুক্ততা মেনেই বোধহয় আমতা-আমতা করে বললেন, মগনের উচিত চুরিটা আরও ভালো করে শেখা। নইলে প্রায়ই ব্যাটা ধরা পড়ে মাঝরাতে আরামের ঘুমটার দফা রফা হয়ে যায়। এ মোটেই ভালো কথা নয়।
গগনবাবু দুঃখ করে বললেন, কে শেখাবে বলুন? সেরকম গুরু কি আর আছে? আমরা ছেলেবেলায় দেখেছি করিম–চোর সামন্ত দারোগার কোমরের বেল্টখানা বাজি রেখে দিনে দুপুরে চুরি করল।
কালীবাবু গম্ভীর গলায় বললেন, দুপুরে দারোগারা খুব ঘুমোয় আর ঘুমোনোর সময় বেল্ট খুলে রাখে। এটা খুব খারাপ অভ্যাস।
গগনবাবু মাথা নেড়ে বললেন, মোটেই নয়। কোমরে পরা অবস্থায় খুলে নিয়ে করিম বাজিকে। বাজি জিতল তার ওপর সামন্ত দারোগা। পাঁচ টাকা দিয়ে আশীর্বাদ করে বললেন, জীবনে এরকম চোর আর দেখিনি। তুই ডাকাত হ।
পরদিনই সকালবেলা মগন বাজারে গিয়ে গোপেশ জাদুকরকে ধরল। গোপেশদা, দু-চারটে হাতসা ফাঁই এবারে শিখিয়ে দিন। নইলে ইজ্জত থাকছে না।
গোপেশ যাদুকর লোকটা মজার মানুষ। সময়ে এবং সর্বত্রই সে হাতসা ফাঁই দেখায়। ম্যাজিক ছাড়া সে একদম থাকতে পারে না। বাজার করার সময়েও সে কত সময়ে মাছ, ফুলকপি, আলু বা দোকানে ঢুকে বিস্কুটের প্যাকেট, ক্রিমের শিশি সকলের চোখের সামনেই হাওয়া করে দেয়। তবে মগনের সঙ্গে তার তফাত হচ্ছে, সে আবার জিনিসগুলো ফিরিয়ে দেয়। সে তো চোর নয়।
রোজকার মতোই সে মগনকে বোঝাতে লাগল, চোর যদি জাদুকর হয় বা যাদুকর যদি হয় চোর তাহলে সমাজের ঘোর বিপদ। চুরি করা যদি ছেড়ে দিস তবে শেখাতে পারি।
মগন মাথা চুলকে বলে, আচ্ছা ভেবে দেখি।
আসলে মগনের বিপদ হয়েছে পায়রাকে নিয়ে। পায়রা নামে একটি মেয়ের সঙ্গে তার খুব ভাব। কিন্তু পায়রার বাপ পাঁচশো টাকা পণ চেয়ে বসেছে। সেটা জোগাড় না হলে বিয়ে হওয়ার নয়। পায়রা রোজ খোঁটা দিচ্ছে, হিঃ খুব জানা আছে, কেমন মুরোদের চোর।
মগনকে বিদায় করে গোপেশ নানা মজার কাণ্ড করতে-করতে বাজার সারে। শৈবালবাবু অতি সতর্ক লোক। তার জামার ভিতরে গুপ্ত পকেট, তাতে টাকা রেখে সেফটিফিন দিয়ে আটকে তবে বাজারে আসেন এবং সারাক্ষণ পকেটে হাত চেপে থাকেন। সেই শৈবালবাবু আজ শীতের প্রথম ফুলকপি কিনে দাম দিতে গিয়ে থ’। পকেটে টাকা নেই।
গোপেশ পাশেই দাঁড়িয়ে পালং শাক কিনছিল। একটু হেসে বলল , আরে তাতে কী! আমি কিছু ধার দিচ্ছি কপিটা কিনেই বাড়ি যান।
শৈবালবাবু হেঁ-হেঁ করে কিছুক্ষণ জামার পকেটটা চুলকোলেন। তারপর গোপেশকে বললেন, ইয়ে বুঝলে কথাটা পাঁচ কান কোরো না। ষষ্ঠীপদর সঙ্গে একটা বাজি ধরেছিলুম, যদি কেউ আমার পকেট কখনও মারতে পারে তাহলে পাঁচশো টাকা হারব। যা টাকা গেছে যাক, বাজিটা না হারি।
গোপেশ গম্ভীর হয়ে বলল , তাই বা কেন, টাকাটা তো মনে হয় বেশি দূর যায়ওনি। ওই তো ব্রিজলাল বেগুনওলার কাঁধের গামছাটায় কী যেন একটা বাঁধা আছে, দেখুন তো।
বলাই বাহুল্য ব্রিজলালের গামছায় বাঁধা অবস্থায় শৈবালবাবুর টাকা পাওয়া গেল এবং ব্রিজলাল খুবই অপ্রতিভ হাসি হেসে বলল , গোপেশবাবু, আপনি তো আমাকে জেল খাঁটিয়ে মারবেন।
বাজার টাজার সেরে গোপেশ যখন ফেরে তখন মোড়ের মাথায় গোলবাড়ির বারান্দায় বসে থাকা অহীনবাবু তাঁকে ধরবেনই, ও গোপেশ, আরে এসো–এসো এদিকে একটু, মাছটা কী কিনলে একটু দেখিয়ে যাও।
বুড়ো মানুষ বলে গোপেশ বা আর কেউই তাঁকে এড়াতে পারে না। অহীনবাবু বেশ ভোরে উঠে একটু মর্নিংওয়াক সেরে এসেই বারান্দায় দক্ষিণ কোণটায় মোড়া পেতে বসে থাকেন। অহীনবাবুর এই কোণটায় বসবার একটা কারণ হল, ওদিকটায় বড়লোক আশুতোষ ঘোষের বাড়ির রান্নাঘর। সকাল থেকেই রান্নাঘরের নানারকম ভালো ভালো গন্ধ আসতে শুরু করে। রুটি সেঁকার গন্ধ, ডিম ভাজার গন্ধ, মাংসের গন্ধ, মাছের কালিয়া বা পোলাওয়ের গন্ধ। অহীনবাবু নিজের পয়সায় ভালো জিনিস কখনওই খান না। কিন্তু গন্ধের নেশায় তাঁর অর্ধেক খাওয়া হয়ে যায়। তাঁর আর এক নেশা হল, কে কী কিনে আনছে বাজার থেকে তা দেখা।
বসে বসেই হাঁক মারেন, ওহে ও শিকদার, বলি সব ভালো তো? তা মাছটা মনে হয় আজ জব্বর কিনেছ! মুখখানা তোমার বেশ হাসিহাসি দেখছি যেন। দেখি–দেখি, আমরাও একটু হাসি।…বাঃ বাঃ এ যে সরল পুঁটি গো, ভারী তেলালো মাছ, একটু সর্ষেবাটা আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে রাঁধতে বোলো বউমাকে। এক্কেবারে চাকুম চাকুম লেগে যাবে’খন।…আরে মুখুজ্জেমশাই নাকি? প্রাতঃপেন্নাম। আজও কি কাটাপোনা নাকি? থলেটা একটু ফাঁক করুন দাদা, আপনার কাটাপোনাকে একটা গুডমর্নিং জানিয়ে দিই। ব্রাহ্মণের ভোগে লাগবে, ব্যাটার কপালটা ভালোই।…আরে আরে কে ও? কালী না? বলি পালাচ্ছ কোথায়, তোমার মাছ না দেখে কি ছাড়ব? …ও বা–বা এ যে দেখছি ফুলকপি আর কই মাছ। আজ তো একেবারে খুনখারাপি করে ফেলেছ হে…সবাই চলেটলে গেলে অহীন ধীরে সুস্থে বাজারে বেরোন। বেশি বেলায় বাজারে তেমন কিছু থাকে না। ঝড়তি পড়তি যা পান সস্তায় কেনেন। কপি পাতাটাতা অনেক সময় দোকানিরা ফেলে দেয়। অহীনবাবু সকলের অলক্ষ্যে তাও কয়েকটি কুড়িয়ে নেন।
এই সময়ে বাজারে অহীনবাবুর সঙ্গে প্রায় দিনই বিধুবাবুর দেখা হয়ে যায়। বিধুবাবু লোকটার ভারী ভুলো মন। সকালবেলায় বাজারে তিনি প্রায়দিনই কিছু না কিছু হারিয়ে যান। হয় পয়সা, না হয় চশমা, কিংবা ঘড়ি, অথবা পকেটের পেন, কখনও পায়ের এক পাটি চটি, কোনওদিন রুমাল, কিংবা মাছের থলে। সেটা আবার খুঁজে দেখতে তাকে বাজারে ফিরতে হয়।
বিধুকে দেখেই অহীনবাবু হাঁক দেন, বলি ও বিধু, বাজারে আবার দেখছি যে! কিছু ফেলে গেছ নাকি? আচ্ছা তুমি সবসময়ে এত কী ভাব বলো তো!
বিধু মাথা চুলকে বলেন, ভাবছি দুনিয়াটার হচ্ছেটা কী।
কেন দুনিয়াটার কী এমন হচ্ছে। এই তো আজও পূর্বদিকে সূর্য উঠেছে। মাছের দাম বেড়েছে। শীতকালে শীত বেড়েছে।
বিধুবাবু তবু মুখটা গোমড়া করে বলেন, তবু দুনিয়াটার একটা কিছু হচ্ছে।
অহীনবাবুর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, তা হবে।
গল্পগুজব করতে-করতে অহীনবাবু আর বিধুবাবু যখন ফেরেন তখন প্রায়ই রসো পাগলা। এসে অহীনবাবুর পথ আটকায়, এই যে বাবু, কিছু ভিক্ষে দিবেন?
রসো পাগলাকে দেখলে অহীনবাবু ভারী বিব্রত বোধ করতে থাকেন। বলেন, আঃ, যাও যাও, অন্যদিকে দ্যাখো।
রসো ছাড়ে না। পিছু–পিছু আসতে থাকে আর খিকখিক করে হাসে আর বলে, জীবনে একটা দিন দিয়ে দেখুন, মনটা কেমন ফুরফুরে লাগবে, গান গাইতে ইচ্ছে করবে, গিন্নিমা মুখ করবেন না।
আঃ যাও না হে, বলছি তো নেই।
রসো বিড় বিড় করতে থাকে, না দিলে আজ আপনার ডাল সেদ্ধ হবে না, মাছে নুন বেশি পড়ে যাবে, গলায় কাঁটা ফুটবে…
গোটা লামডিঙে রসো পাগলাই একমাত্র লোক যে চাঁদ দেখলেও খুশি হয়, অমাবস্যাঁতেও আনন্দে গান গেয়ে ঘুরে বেড়ায়। সে রোদেও খুশি বৃষ্টিতেও তার আহ্লাদ। শীত, গ্রীষ্ম সব। ঋতুতেই তার মন নাচে। সর্বদাই রসো খুশি বটে, কিন্তু খিদে পেলে ভারী রেগে যায়।
রসোর খিদে পায় সকালেই। ঘুম থেকে উঠেই সে যে-কোনও বাড়ির সামনের রাস্তায় পায়খানা করে সেই বাড়ির উদ্দেশ্যে তর্জন গর্জন করতে থাকে, সব তো বেরিয়ে গেল, এখন ভিতরটা ফাঁকা হয়ে গেছে না? নিজেরা তো দিব্যি সাঁটছ, রসোর কথা একটু ভাবতে হবে না?
লোকে রসোর নোংরামি দেখে চটে যায় বটে, কিন্তু তাদের অভ্যাসও হয়ে গেছে। খেতে দিলে অবশ্য রসো নিজেই নোংরাটা সাফ করে দেয়।
দুপুরে রসো খায় জৈনদের লঙ্গরখানায়। রাতে এঁটো–কাঁটা জুটে যায়। খাওয়ার সময়টুকু বাদ দিলে রসো ভারী আনন্দে আছে। রাত্রিবেলা সে গিয়ে নয়নসাধুর আখড়ায় পড়ে থাকে। আর ভূতেরা নাকি তার গা–হাত-পা টিপে দেয়।
বলাই বাহুল্য লামডিঙের মতো জায়গায় ভূত না থাকলে যেন মানায় না। বাস্তবিক লামডিঙে ভূতের এতই বাড়বাড়ন্ত এবং খ্যাতি ছিল যে, নানা জায়গা থেকে অনেক সাধু তান্ত্রিক আর ফকির ভূত ধরতে লামডিঙে চলে আসত। বিশেষ করে শীতে আর বর্ষায় নাকি ভুতেরা চারদিক গিজগিজ করে। করবেই। কারণ, বর্ষায় আর শীতেই বুড়ো আর থুথুড়েরা খুব মরে। তাই তো ভূত হয়ে চারদিকে ঘোরে।
বেশি নয়, নয়নসাধু মোট পাঁচটা ভূত ধরেছিল। তার মধ্যে একটা হল খাঁটি মেম সাহেব। নয়নসাধু কথাটা খুব বড়াই করে বলেও বেড়ায়, আমার পাঁচজনের মধ্যে একটা মেম বুঝলি? মাটির তলা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এসে আর একটা কবরের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে কাকে যেন খুব আদর করছিল। আমি গিয়ে খপ করে চুলের কুঁটি চেপে ধরে বললাম, কী রে মেম, এখানে কী হচ্ছে? অমনি হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল , সাধুবাবা, আমি আমার ছেলেকে আদর করছি। মাত্র তিন বছর বয়সে মরে গিয়েছিল কলেরায়–তা মেমটার জন্য দুঃখ হল। ছেলের আত্মা তো স্বর্গে চলে গেছে। নিষ্পাপ শিশু, তার আত্মা তো আর পাপের দুনিয়ায় পড়ে থাকবে না। সেই থেকে মেমটাকে বুঝিয়েসুঝিয়ে রেখেছি পুষে।
মেমভূতটাকে নয়নসাধু ধরলেও মল্লিকবাবুদের বাড়ির ঘড়িরামকে সে ধরতে পারেনি। ঘড়িরামকে ধরা অত সহজও ছিল না। ঘড়িরাম যখন জীবিত ছিল তখন একটাই নেশা ছিল তার। ঘড়ির নেশা। খুবই গরিব ছিল বলে ঘড়িরামের পক্ষে ঘড়ি কেনা ছিল দুঃসাধ্য। সে কুলির কাজ করত রেল স্টেশনে। কী করে এবং কেনই বা যে তার ঘড়ির শখ হল বলা মুশকিল তবে ছোট্ট একটা কাঁচে ঢাকা বাক্সর মধ্যে তিনটে কাঁটা ঘুরছে এ দৃশ্য দেখলে সে মুগ্ধ হয়ে যেত। শোনা যায়, ঘড়িরাম বিস্তর মেহনত করে না খেয়ে পয়সা জমিয়ে বহুদিনের চেষ্টায় সস্তায় একটা ঘড়ি। কিনেছিল এক জুয়াড়ির কাছ থেকে। কিন্তু যেদিন ঘড়িটা সে কেনে তার পরদিনই পুলিশ এসে তাকে চুরির দায়ে ধরে নিয়ে যায়। ঘড়িরামকে জেল খাটতে হয়েছিল ক’মাস। জেল থেকে বেরিয়ে এসেই ঘড়িরাম অন্য মূর্তি ধরল। বিনা দোষে জেল খাটার শোধ তুলতে সে এমন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল যে, লামডিংকে প্রায় ঘড়িশূন্য করে দিয়েছিল সে। ছোরা নিয়ে সন্ধের পর সে বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে অপেক্ষা করত এবং যে যেত তারই হাতের ঘড়ি কেড়ে নিত। মোট তিন হাজার সাতশো সাতষট্টিটা ঘড়ি সে সংগ্রহ করে মল্লিকবাবুদের পরিত্যক্ত বাড়ির মাটির নিচে জমিয়ে রেখেছিল। অবশেষে পুলিশ তার সন্ধান পেল এবং বাড়ি ঘিরে ফেলল। ঘড়িরাম পালানোর চেষ্টা করল না, আত্মসমর্পণও করেনি। সে ছোরা হাতে পুলিশকে তেড়ে এল মারতে। ফলে পুলিশের গুলিতে সে মরে গেল। কিন্তু আশ্চর্য এই যে মরে পড়ে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই ঘড়িরামের শরীর থেকে একটা বায়ুভূত ঘড়িরাম বেরিয়ে এসে পুলিশকে তাড়া করল। দ্বিতীয় ঘড়িরামের তাড়া খেয়ে পুলিশ পালাতে পথ পেল না। সেই থেকে মল্লিকবাবুদের বাড়ির ধারেকাছে কেউ ঘেঁষে না। কিন্তু আশপাশ দিয়ে দিনের বেলা যারা যায় তারা তিন হাজার সাতশো সাতষট্টিটা ঘড়ির সমবেত টিকটিক আওয়াজ শুনতে পায়।
টিকটিক শব্দটা অবশ্য লামডিঙে নতুন কিছু নয়। বরং এ শব্দ লামডিঙের একটি অতি পরিচিত শব্দই বলা যায়। ছোট্ট একধরনের টিনের খেলনা আছে যা হাতের তলায় লুকিয়ে নিয়ে চলা যায়, টিনের একটু পাত আছে সেটাতে আঙুলের চাপে টিকটিক করে শব্দ করে।
ফুলু নামে একটা মেয়ে রোজ তার বাড়ির জানালা দিয়ে নন্টু নামে একটা ছেলেকে দেখতে পেত। নন্টু বেশ ভালো ছেলে, কোনওদিকে তাকায় না, ক্লাসে ফার্স্ট হয়, প্রাইজ পায়। দেখতেও সুন্দর। কিন্তু ফুলুর খুব ইচ্ছে নন্টু একটু তার দিকে তাকাক। ফুলুও দেখতে খুব সুন্দর, কিন্তু পোলিও রোগে তার দুটো পা এমনভাবে কুঁকড়ে গিয়েছিল যে, দোতলা থেকে সে নামতেই পারত না। ফুলুই একদিন ফেরিওয়ালার হাতে ওই খেলনার শব্দ শুনে একটা কিনে নেয়। নন্টু যেই যেত অমনি বাজাত। নন্টুও দোতলার দিকে তাকাত। চোখাচোখি হত দুজনে। ফুলুও হাসত, নন্টুও হাসত। ফুলু হাসত আনন্দে উত্তেজনায়, নন্টু হাসত করুণায়।
কিছুদিন পরেই নন্টু পাশ করে বড় শহরে পড়তে চলে গেল এবং ফুলু খেলনাটা অবহেলায় ফেলে রাখল বিছানার পাশে টেবিলে। সেখান থেকে সেটা একদিন নিয়ে নিল তার ছোট ভাই টুলু।
টুলু খেলনাটা বাজিয়ে তার ঘুমন্ত মাকে চমকে দিত। কুকুর বেড়ালকে ভয় দেখাত। তারপর সে একদিন সেটার প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলল। টুলু ও ফুলুর বাবা ও মার মধ্যে একদিন বেশ ঝগড়া হল। কথা বন্ধ হয়ে গেল কিন্তু টুলুর বাবার চা চাই, জল চাই, সময় মতো ভাত চাই। অথচ কথা বন্ধ। ওদিকে টুলুর মার হয়তো দোকান থেকে কিছু আনাতে হবে বা অসময়ে টাকার দরকার পড়েছে। টুলুর বাবা হঠাৎ হাতের কাছে টিকটিক খেলনাটা পেয়ে সেটা বাজালেন এবং তাঁর বউও সংকেত বুঝে চা বা জল দিয়ে গেলেন। খেলনাওলা আবার আসায় টুলুর মাও ওরকম একটা খেলনা কিনে কাছে রাখলেন। দুজনের মধ্যে প্রায়ই ভাব ঝগড়া এবং আবার ভাব হয়। কিন্তু ঝগড়া হলেই দুজনে ওই যন্ত্রের সাহায্যে পরস্পরকে সংকেতবাক্য পাঠাতে থাকেন।
দেখাদেখি আরও স্বামী স্ত্রীরাও অনুরূপ খেলনা কিনে ফেললেন। খেলনাটার নাম দেওয়া হলো কটকটি।
তারপর থেকে লামডিঙে টিকটিক শব্দের আর কোনও অভাব রইল না। সর্বত্র এবং প্রায় সর্বদাই টিকটিক শোনা যেতে লাগল।
এই শব্দই একদিন ব্রজেশ্বরকে তাঁর ঘরের বাইরে টেনে আনল।
ব্রজেশ্বর বসু যে লামডিঙে থাকেন এটা অনেকের জানা ছিল বটে, কিন্তু মানুষটা গত বিশ বছর তাঁর ঘর থেকে বেরোননি। বাজার–হাট দোকানপাট কোথাও তাঁকে কখনও দেখা যায় না। তাঁর বাজার হাট করেন প্রৌঢ়া স্ত্রী। ব্রজেশ্বর তাঁর ঘরে বসে গত বিশ বছর যাবৎ একটানা সৃষ্টিতত্ব বিষয়ে একটা গুরুতর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে কেউ কেউ শুনেছে। তবে মানুষটাকে কেউ চোখে না দেখতে পাওয়ায় মোটামুটি তাঁর কথা সবাই ভুলে গিয়েছিল।
সেদিন রাতে চোর মগন এসে পায়রার জানলার কাছে দাঁড়িয়ে কটকটি বাজিয়ে তাকে সংকেতে ডাকছিল। চুরি করতে বেরোনোর আগে পায়রার সঙ্গে রোজই সে দেখা করে যায়। গগনবাবুর সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর ঝগড়া চলছে কিছুদিন। গগনবাবু কটকটি বাজিয়ে তাঁর স্ত্রীর কাছে ভাত চাইছিলেন। কালীবাবুর বাড়িতে বেড়ালে দুধে মুখ দিয়েছে বলে তাঁর ছেলে বাবু আনন্দে কটকটি বাজাচ্ছিল। আজ রাতে তাকে আর দুধ খেতে হবে না।
কাছাকাছি এতগুলো কটকটি একসঙ্গে বেজে ওঠায় ব্রজেশ্বর দীর্ঘ বিশ বছরের মধ্যে এই প্রথম সচকিত হলেন। তাঁর মনে হল, একটা কোনও বিপর্যয় আসন্ন। তিনি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলেন। বেরিয়ে এসে তিনি দেখলেন, পৃথিবীটা বিশ বছরে অনেক পালটে গেছে। যেখানে গাছ। ছিল সেখানে বাড়ি উঠেছে, যেখানে মাঠ ছিল সেখানে রাস্তা হয়েছে। সেদিন খুব ফুটফুটে জ্যোৎস্না ছিল। ব্রজেশ্বর মুগ্ধ হয়ে চারিদিকটার দৃশ্য দেখতে লাগলেন এবং ঘুরে বেড়াতে লাগলেন।
তাঁদে দেখে পায়রা ‘ভূত-ভূত’ বলে চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেল এবং মগন ‘রাম-রাম’ বলতে বলতে প্রাণভয়ে ছুটে পালাল। মগনের কটকটি যন্ত্রটা পড়ে গিয়েছিল, ব্রজেশ্বর সেটা কুড়িয়ে পেলেন এবং বাজিয়ে দেখলেন। গত বিশ বছর তিনি ঘরের বাইরে আসেননি। তাই তিনি জানেন না, মানুষ এই ক’বছরে কী কী আবিষ্কার করেছে। তিনি দেখে খুবই বিরক্ত হলেন যে, মানুষ এই বিশ্রী যন্ত্রটা আবিষ্কার করেছে। কটকটিটা হাতে নিয়ে তিনি আনমনে হাঁটতে লাগলেন।
সামনেই একটা ভাঙা বাড়ি এবং পরিত্যক্ত বাগান। বাগানের ধারে তিনি এক যুবক এবং একটি যুব তাঁকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখলেন। যুবক এবং যুবতীরা জ্যোৎস্না রাতের নির্জনতায় দাঁড়িয়ে কী করতে পারে তা ব্রজেশ্বর চিন্তা করলেন না। তিনি সোজা গিয়ে তাদের সামনে হাজির হয়ে কটকটিটা বাজিয়ে ক্রুদ্ধস্বরে বলতে লাগলেন, মানুষ গত বিশ বছরে এইসব আবিষ্কার করে দুনিয়াটাকে উচ্ছন্নে দিচ্ছে আর তোমরা এখানে নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে ফিসফাস করছ?
যুবতীটি জলভরা চোখে যখন ব্রজেশ্বরের দিকে ফিরে চাইল তখন ব্রজেশ্বর অবাক হয়ে দেখলেন মেয়েটি মেমসাহেব। মেয়েটি কুঁপিয়ে–ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। ছেলেটা ব্রজেশ্বরের দিকে কটমট করে চেয়ে বলল , আমরা দুঃখের কথা বলছিলাম আর আপনি এসে সব ভণ্ডুল করে দিলেন। মানুষ কী করেছে তা আমরা জানি না। জানতে হলে মানুষদের কাছে যান। আমরা মানুষ নই।
ব্রজেশ্বর অবাক হয়ে বললেন, তবে তোমরা কী?
আমি ঘড়িরাম আর এ হচ্ছে মেরি, আমরা দুজনে দুজনকে ভালোবাসি। ব্রজেশ্বর ভালোবাসা কথাটার তেমন মানেই জানেন না, মাথা চুলকে বললেন, ও তা সে বেশ তো।
কিন্তু মনে-মনে ব্রজেশ্বর খুব ভাবতে লাগলেন, ভালোবাসা জিনিসটা গোল না চৌকো, লাল না সবুজ। ঘড়িরাম আর মেরি সেই জ্যোৎস্নারাত্রে ব্রজেশ্বরকে পেয়ে তাদের দুঃখের কথা বলতে লাগল। ঘড়িরাম মেরিকে বিয়ে করতে চায়, কিন্তু নয়নসাধু বলেছে ঘড়িরাম তিন হাজার ঘড়ি পণ দিলে সে কিছুতেই মেরিকে ছাড়বে না। অথচ ঘড়ি ঘড়িরামের প্রাণ।
অনেকক্ষণ ধরে শোনার পর ব্রজেশ্বরের মাথা হঠাৎ পরিষ্কার হয়ে গেল, ভালোবাসা জিনিসটা তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন, বহুকাল পর স্মৃতিপটে আবার সেসব ভেসে উঠল। ঠিকই তো, তিনিও তাঁর বউকে একসময় ভালোবাসতেন। তারপর সৃষ্টিতত্বের পাল্লায় পড়ে জিনিসটা একদম উবে। গিয়েছিল মন থেকে।
ব্রজেশ্বর আর দাঁড়ালেন না। প্রায় দৌড়ে বাড়ি ফিরে এসে দেখলেন তাঁর প্রৌঢ়া স্ত্রী ঘুমোচ্ছেন। মুখখানায় দুঃখ–দুর্দশার ছাপ পড়েছে বটে, কিন্তু এখনও লক্ষ্মীশ্রী লেগে আছে। বউকে ঘুম থেকে জাগিয়ে একটু আদর করতে ইচ্ছে করছিল তাঁর। কিন্তু বহুকাল বউকে ডাকেননি বলে নামটিও মনে আসছিল না।
হঠাৎ হাতের কটকটির দিকে নজর পড়ায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন ব্রজেশ্বর। বউয়ের কানের কাছে কটকটিটা নিয়ে বাজাতে লাগলেন।
বহুদিন বাদে সেই রাতে দুজনের খুব ভালোবাসা হল। তাঁরা দুজনেই খুব হাসলেন, একটু কাঁদলেনও, অনেক জমা কথা ছিল, সেগুলোও বলতে লাগলেন। কথার ফাঁকে কৌশলে বউয়ের নামটাও জেনে নিলেন ব্রজেশ্বর। উমা। নামটা তাঁর বেশ পছন্দই হল। আর সবচেয়ে বড় কথা, কটকটি জিনিসটাকে তাঁর আর অপছন্দ হল না। খুবই উপকারী জিনিস। মানুষের অনেক কাজে লাগে।
পরদিন থেকেই ব্রজেশ্বরকে পথে ঘাটে হাটে বাজারে সর্বত্র দেখা যেতে লাগল। হাতে কটকটি। যখন তখন বাজাচ্ছেন। লোকে জ্বালাতন হয়ে গেল।
লামডিঙের লোকের অবশ্য জ্বালাতনের অভাব ছিল না। কোজাগরী পূর্ণিমায় লামডিঙের আশেপাশে বনের মধ্যে যেসব সাদা সুন্দর ডল পুতুলের মতো পরিরা নেমে আসত, তাদের কথা সকলেই জানে। লামডিঙের পরিদের মতো সুন্দর পরি অন্য কোথাও দেখা যায় না। তারা বুনো ফুলের মধু খেত ঘুরে-ঘুরে উড়ে–উড়ে। বাতাসে ভেসে তারা কতরকমের নাচের মুদ্রা তৈরি করত। চারদিকটা ভরে উঠত তাদের গায়ের আশ্চর্য সুগন্ধে।
কিন্তু জ্বালাতন এল অন্য দিক থেকে। ভিন্ন গ্রহের যেসব প্রাণী মহাকাশ থেকে প্রায়ই লামডিঙের বনে বাদাড়ে তাদের বেলুনের মতো বা চুরুটের মতো বা পিরিচের মতো মহাকাশযানে করে নামত তাদের সঙ্গে কারও কখনও ঝগড়া বিবাদ বা যুদ্ধ হয়নি। তারা নেমে এসে লামডিঙের সরস সতেজ ঘাস কেটে নিয়ে যেত, ছিঁড়ে নিয়ে যেত লেবু বা করমচার পাতা। তাদের চেহারা খুবই অদ্ভুত, পোশাকও অন্যরকম। লামডিঙের লোকেরা তাদের দূর থেকে দেখত। কাছে যেত না। শুধু রসো পাগলা গিয়ে তাদের কছে বিড়ি চাইত। ভিন্ন গ্রহের প্রাণীরা যে বিড়ি খায় না এ তো সকলেই জানে। তবে তারা ঘাস ও গাছের পাতা খেতে খুবই ভালোবাসে। ভিন্ন গ্রহের একজন প্রাণী একবার সত্যসিন্ধুবাবুর নাতনির হাত থেকে রসগোল্লা কেড়ে নিয়ে খেয়েছিল বলে শোনা যায়। এবং রসগোল্লা খাওয়ার পরই সে সম্পূর্ণ মাতাল হয়ে টলতে-টলতে কোনওরকমে তার মহাকাশযানে ফিরে গিয়েছিল। একবার তাদের নজর পড়ল ওই পরিদের দিকে। সেবার কোজাগরী পূর্ণিমার দিনে যখন পরিরা এসে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে আনন্দ করছে তখন অনেকগুলো মহাকাশযান চারদিকে নেমে এল এবং ভিন্ন জগতের প্রাণীরা দলে–দলে জালদড়ি আর আঠাকাঠি নিয়ে এল পরিদের ধরতে। তারপর বনের মধ্যে সে কী হুর যুদ্ধ!
রসো পাগলাই প্রথম খবরটা দিল সবাইকে ছুটে এসে। লামডিঙের লোকেরা খুব বীর নয়, কিন্তু পরিরা হল তাদের নিজেদের ছেলেমেয়ের মতো। লাঠিসোঁঠা নিয়ে তারাও ছুটল পরিদের বাঁচাতে।
কিন্তু ভিন্ন গ্রহের প্রাণীরা অনেক বেশি শক্তিশালী ও বুদ্ধিমান। তারা নানারকম অস্ত্রশস্ত্র বের করে ভয় দেখাতে লাগল। অন্যদিকে পরিরা তখন প্রাণপণে ছুটোছুটি করছে। আর একদল ভিন্নগ্রহের প্রাণী তাদের নানা কলাকৌশলে ঝপাঝপ ধরে ফেলছে।
এই যখন অবস্থা তখন হঠাৎ ঘড়িরাম কোথা থেকে এসে হজির হল। তার হাতে ছোরা। সঙ্গে মেরি, মেরির হাতে একগাছা ঝাঁটা। তারপর সে এক লণ্ডভণ্ড কাণ্ড। ভিন্ন গ্রহের প্রাণীরা যতই গুলি করুক আর রশ্মি ছুঁড়ুক ঘড়িরামের কিছুই হয় না। কিন্তু ঘড়িরামের পরাক্রমে তাদের নাজেহাল অবস্থা। মেরির ঝাঁটাও কম গেল না। নয়নসাধুর পাঁচটা ভূতও এসে হাত লাগাল। তাদের চেহারা রোগা এবং ধোঁয়াটে হলেও ভিন্ন গ্রহের প্রাণীরা তাদের কাছে গো–হারান হেরে পালাল।
পরিরা আবার খেলতে লাগল বনের মধ্যে। লামডিঙের গল্প সহজে শেষ হওয়ার নয়। এক গল্প থেকে আর একটা গল্পে এবং তা থেকে আর এক গল্পে চলে যেতে কোনও বাধা নেই। চোর সাধু ম্যাজিসিয়ান লোভী কৃপণ সবরকমের মানুষ এবং অমানুষ নিয়ে লামডিং। নিত্যই সেখানে নতুন-নতুন সব ঘটনা শুরু হচ্ছে। কিন্তু সব ঘটনাই যে শেষ হচ্ছে এমন নয়। আসলে পৃথিবীর কোনও গল্পই বোধেহয় পুরোপুরি শেষ হয় না। নানা শাখাপ্রশাখায় তা ছড়িয়ে যেতে থাকে। কিন্তু আমাদের তো এক জায়গায় থামতেই হবে।
Post a Comment