পাতালে বছর খানেক – শিবরাম চক্রবর্তী
তখনই বারণ করেছিলাম গোরাকে সঙ্গে নিতে। ছোট ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে কোনো বড় কাজে যাওয়া আমি পছন্দ করিনে।
আর ঐ অপয়া বাইখানা। প্রেমেন মিত্তিরের পাতাল পাঁচ বছর! যখনই ওটা ওর বগলে দেখেছি, তখনই জানি যে, বেশ গলে পড়তে হবে।
বেরিয়েছি সমুদ্র যাত্রায় পাতাল যাত্রায় তো নয়! সুতরাং কী দরকার ছিল ও বই সঙ্গে নেবার? আর যদি নিতেই হয়, তবে আমার বাড়ী থেকে পালিয়ে কী দোষ করলো? যতো সব বিদঘুঁটে কাণ্ড ঐ ছেলেটার! মনে মনে আমি চটেই গেলাম।
শেষে কিন্তু ভড়কাতে হলো জাহাজে উঠেই যখন বইয়ের করামণ ও ব্যক্ত করলে। আমাকে রেলিং-এর একপাশে ডেকে এনে চোখ বড়ো করে চাপাগলায় বললে, মেজ-মামাকে বলবেন না কিন্তু। খবু ভালো হয়, যদি জাহাজটা ডুবে যায়! আমি বললাম, কি ভালোটা হয়?
সটান পাতালে চলে যাওয়া যায় এবং সেখানে–এই বলেই গোরা উৎসাহের সহিত বইখানার পাতা ওলটাতে শুরু করে গোড়ার থেকেই।
আমি ওকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম যে, নিতান্তই অকস্মাৎ প্রচণ্ড সাইক্লোন কিংবা বরফের পাহাড়ের ধাক্কা যদি না লাগে, তাহলে সে রকম সুযোগ পাওয়াই যাবে কিনা সন্দেহ। আর সেই দুরাশা পোষণ করেই যদি ঐ বই এনে থাকে, তবে তা সে খুবই ভুল করেছে, কারণ আজকালকার নিরাপদ সমুদ্রযাত্রার পাতালের ভ্রমণ-কাহিনীকে কাজে লাগানো ভারী কঠিন।
আমার কথায় সে দমে গেল। গম হয়ে থেকে অবশেষে বললে–তাহলে কি কোনই আশা নেই একেবারে?
দেখছি না তো! নিস্পৃহকণ্ঠে আমি জবাব দিই–তাছাড়া, তুমি ব্যতীত জাহাজের এতগুলি প্রাণীর মধ্যে কারো ভুলে পাতালে যাবার শখ আছে বলেও আমার মনে হয় না!
বলেন কি? গোরা যেন আকাশ থেকে পড়ল–তা কখনো হয়? আপনিও কি যেতে চান না পাতালে?
আমি প্রবলবেগে ঘাড় নাড়লাম–পাতাল দূরে থাক,হাসপাতালেও না। মুখ ফাঁক করলাম আমার–কেউ কি মরতে যায় ওসব জায়গায়?
আপনি মিথ্যা বলছেন। গোরা অবিশ্বাসের হাসি হাসল, পাতালে যাবার ইচ্ছা আবার হয় না মানুষের!
আমার হয় না। আমাকে জানো না তুমি। আমি জানালাম, আমার পাতালে যাবার ইচ্ছে হয় না, মোটর চাপা পড়বার ইচ্ছা হয় না, রেলে কাটা যাবারও ইচ্ছা করে না। আমি যেন কিরকম!
আমি সঙ্গে থাকব, ভয় কি আপনার! ও আমাকে উৎসাহ দেয়– মেজমামাকে দেখে আসি, আপনি ততক্ষণ পড়ুন বইখানা।
বইটা হাতে নিয়ে ভাবলাম এটাকে এখনই, আমাদের আগেই পাতালে পাঠিয়ে দিলে কেমন হয়। সিঙ্গাপুরে যাচ্ছি, সিঙ্গা ফুঁকতে তো যাচ্ছিনে, আকাশ-পাতালের বৃত্তান্ত আমার কি কাজে লাগবে? তারপর কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বইটা পড়তে শুরু করি শেষের দিক থেকে। গোড়ার দিক থেকে পড়বে না বলেই শেষের দিকটাই ধরি আগে।
শেষপৃষ্ঠা থেকে আরম্ভ করে একশ চৌত্রিশ পাতা পর্যন্ত এগিয়েছি–কিংবা পিছিয়েছি–এমন সময়ে কর্ণবিদারী এক আওয়াজ এলো। সেই মুহূর্তেই আমার হাত থেকে খসে পড়ল বইটা এবং খসে পড়লাম চেয়ার থেকে। অত বড় জাহাজটা থর থর করে কাঁপতে লাগল মুহূর্মুহূ।
উঠব কিংবা অমনি করে পড়েই থাকব, অর্থাৎ উঠবার আদৌ আবশ্যক হবে কিনা, ইত্যাকার চিন্তা করছি, এমন সময় গোরার মেজমামা হন্দদন্ত হয়ে ছুটে আসেন।
এই যে, বেঁচে আছো? বেঁচেই আছো তাহলে। হার্টফেল কররানি এখনো?
উঁহু! সংক্ষেপে সারি।
আমার তো পিলে ফাটার উপক্রম। জানান গোরার মামা।
ব্যাপার কি? কি হয়েছে? এঞ্জিন বা করলো নাকি।
উঁহু আরেকখানা জাহাজ। জাহাজে জাহাজে ঠোকাঠুকি।
কী সর্বনাশ।
মনে হচ্ছে কোনো চারা জাহাজ। চোরাই মালের জাহাজ টাহাজ হবে বোধ হয়। ধাক্কা মেরেই ছুটেছে। ঐ দ্যখো না!
ঐ অবস্থাতেই ঘাড় উঁচু করে তাকালাম, আরেকখানা জাহাজের মতই দেখতে, সুদূর দিকচক্রবালের দিকে নক্ষত্ৰবেগে পালাচ্ছে। আমাদের শ্রীমান ততক্ষণে কাঁপুনি থামিয়ে স্তব্ধ হয় দাঁড়িয়েছেন স্তম্ভিত হয়ে।
দুধারেই এনতার ফাঁকা, দুশো জাহাজ যাবার মতন চওড়া পথ, তবু যে এরা কি করে মুখোমুখি আসে, মারামারি করে, আমি তো ভেবে পাই না। আমি বিরক্তি প্রকাশ করি।
উপকূল থেকে আমরা এখন কদ্দুরে? মেজমামার প্রশ্ন।
দেড় শো কি দুশো মাইল হবে বোধ হয়। আমি বলি, ছসাত ঘণ্টা তো চলছে আমাদের জাহাজখানা!
বলতে বলতে ঢং ঢং করে অ্যালার্ম বেল বাজতে শুরু করলো এবং শ্রীমদগৌরাঙ্গদেব লাফাতে লাফাতে আবির্ভূত হলেন।–মেজমামা, দেখবে এসো, কী মজা! আপনিও আসুন শিরামবাবু! জাহাজের খালে হুহু করে জল ঢুকছে। কী চমৎকার! তার হাতাতালি আর থামে না।
অকুস্থলে উপস্থিত হয়ে দেখি, কাপ্তেন সেখানে দাঁড়িয়ে। খালাসীরা পাম্পের সাহায্যে জলনিকাশ করছে। চারিদিকেই দারুণ ত্রাস আর এ্যস্ততা। যাত্রীরা ভীত-বিবর্ণ মুখে খালাসীদের কাজ দেখছে। সমস্ত জনপ্রাণীর মধ্যে আমাদের গেরোই কেবল আনন্দে আত্মহারা। পাতালে যাবার পথ পরিষ্কার হচ্ছে কিনা ওর, কাজেই ওর ফুর্তি!
কেন অনর্থক পাম্প করে মরছে? আমাকেই প্রশ্ন করে গোরা। জাহাজটা ডুবে গেলেই তো ভাল হয়।
ভালটা যাতে সহজে না হয়, তারই চেষ্টা করছে, বুঝতে পারছো না? আমার কণ্ঠস্বরে উম্মা প্রকাশ পায়।কলিযুগে কেউ কি কারো ভাল চায়?
যা বলেছেন! ভারী অন্যায় কিন্তু! এক মুহূর্তের জন্য থামে সে–ডাঙ্গা এখান থেকে কদুর?
তা–দু-তিন মাইল হবে বোধ হয়। আমি ভেবে বলি।
মোট্টে! তাহলে তো সাঁতরেই চলে যেতে পারবো। সে যেন একটু হতাশ হয়। কোন দিকে বলুন তো ডাঙ্গাটা?
সোজা নিচের দিকে।
ওঃ তাই বলুন! ওর মুখে হাসি ফোটে আবার আপনি যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন।
নাঃ, ভয় কিসের! আমি জোর করে হাসি।
পাতালে যেতে হবে এবং পুরো পাঁচবচ্ছর হবে সেখানে। তার আগে চলছে না। কি বলুন? তাই তো? আমার মতের অপেক্ষা করে গোরা। সমুদ্রটা তলিয়ে দেখতে সে অস্থির।
পাতাল যেরকম জায়গা, সেখানে পুরো পাঁচমিনিটও থাকা যাবে কিনা এই রকম একটা সংশয় আমার বহুদিন থেকেই ছিল, পাতাল কাহিনীর একশ চৌত্রিশ পাতা পর্যন্ত পড়েও সে সন্দেহ আমার টলেনি, কিন্তু আমার অবিশ্বাস ব্যক্ত করে ওকে আর ক্ষুণ্ণ করতে চাই না।
হঠাৎ সে সচকিত হয়ে ওঠে–বইটা? সেই বইখানা?
ডেকেই পড়ে রয়েছে। আমি বলি।
ডেকে ফেলে এসেছেন? কী সর্বনাশ!–কত কাজে লাগবে এখন ঐ বইটা। কেউ যদি নেয়– সরিয়ে ফ্যালে? বলে গোরা বইয়ের খোঁজে দৌড়োয়।
কি রকম বুঝছ গতিকটা? মেজমামা এগিয়ে আসেন।
স্বয়ং জাহাজ তাঁর কথার জবাব দেয়। তার একটা ধার ক্রমশ কাত হতে থাকে, ডেকের সেই ধারটা পাহাড়ের গায়ের মতো চালু হয়ে নেমে যায়। সে ধারটা দিয়ে জলাঞ্জলি যাওয়া খুবই সোজা বলে মনেহয়। বসে বসেই সুড়ুৎ করে নেমে গেলেই হল। অ্যালার্ম বেল আরো জোর জোর বাজাতে থাকে। কাণ্ডেন লাইফবেটিগুলো নামাবার হুকুম দ্যান। জাহাজ পরিত্যাগের জন্য যাত্রীদের প্রস্তুত হতে বলেন।
লাইফবোট নামানোর জন্য তেমন হাঙ্গামা পোহাতে হলো। জাহাজ তো কাত হয়েই ছিল, সেই ধার দিয়ে দড়ায় বেঁধে ওগুলো ছেড়ে দিতেই সটান জলে গিয়ে, দাঁড়াল। আরোহীরাও লাইফবোটের অনুসরণে প্রস্তত হলেন। সাবধানতা এইজন্য যে একটু পা ফসকালেই একেবারে লাইফ আর লাইফবোটের বাইরে–সমুদ্রগর্ভেই সটান!
গোরার মেজমামা এবং আমি-আমাদেরও বিশেষ দেরি ছিল না। যেমন ছিলাম, তেমনি বোটে যাবার জন্যে তৈরি হলাম। এমন দুঃসময়ে লাগেজ, হোন্ড-অল বা সুটকেসের ভাবনা কে ভাবে? সন্দেহের বাক্সের কথাই কি কেউ মনে রাখে? কেই-বা সঙ্গে নিতে চায় সেসব?
কিন্তু গোরা? গোরা? কোথায় গেল সে এই সংকট মুহূর্তে? আমি গলা ফাটাই এবং মেজমামা আকাশ ফাটান–গোরার, কিন্তু কোনো সাড়াই পাওয়া যায় না।
কে জানে হয়তো কেবিন বই পড়ছে! আমার প্রকাশ পায়।
এই কি পড়বার সময়? মেজমামা খাপ্পা হয়ে ওঠেন–পড়াশুনা করার সময় কি এই?
ওর কি সময়-অসময়–জ্ঞান আছে? আমি বলি, যা ওর পড়ার ঝোঁক!
দুজনে আমরা কেবিনের দিকে দৌড়োই, নাঃ, কেবিন তো নেই, তখন এদিকে-ওদিকে, দিগবিদিকে ছোটছুটি শুরু করি কিন্তু গোরা! অবশেষে আমাদের জন্য সবুর না করে শেষে বোটখানাও ছেড়ে দেয়।
সবগুলি বোটকেই দিকচক্রান্তে একে একে অন্তর্হিত হতে দেখে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে মেজমামা বসে পড়ে। আমি পড়ি শুয়ে। সেই পরিত্যক্ত জাহাজের প্রান্তসীমায় তখন কেবলি আমরা দুজন। গোরা অথবা লাইফবোট–কার বিরহ আমাদের বেশি কাতর করে বলা তখন শক্ত।
খট করে হঠাৎ একটা শব্দ হতেই চমকে উঠি। দেখি শ্রীমান গৌরাঙ্গ হাসতে হাসতে অবতীর্ণ হচ্ছেন। সমুন্নত ডেকের চুড়ায় গিয়ে তিনি উঠেছিলেন।
কোথায় ছিলিরে এতক্ষণ? গোরাকে দেখতে পাবামাত্র সেখানে বসেই মেজমামা যেন কামান দাগেন।
কতক্ষণে বোটগুলো ছাড়ে, দেখছিলাম। গোরার উত্তর আসে, সবগুলো চলে যাবার পর তবে আমি নেবেছি।
কৃতার্থ করেছে। মনে মনে আমি কই।
মেজমামার দিক থেকে সহানুভূতির আশা কম দেখে ছেলেটা আমার গা ঘেঁসে দাঁড়ায়। কানে কানে বলে, পাতালে যাবার এমন সুযোগ কি ছাড়তে আছে মশাই? আপনিই বলুন না।
আমি চুপ করে থাকি। কী আর বলবো? আশঙ্কা হয় এমন কথা বলতে গেলেই হয়ত তা কান্নার মত শোনাবে। নিশ্চিত মৃত্যুর সম্মুখে কান্নাকাটি করে লাভ!
ঘাবড়াবেন না, ওর চাপা গলার সান্ত্বনা পাই। ফিরে এসে আপনিও প্রেমেনবাবুর মতো অমনি একখানা বইয়ের মত বই লিখতে পারবেন।
আমি শুধু বলি–হ্যাঁ, ফিরে এসে; ফিরে আসতে পারি যদি! মুখ ফুটে এর বেশি বলতে পারি না, মুখের ফুটো বুজে আসছিল আমার।
ক্রমশ বিকেল হয়ে আসে। অনেকক্ষণ বসে থেকে অবশেষে আমরা উঠি। খাওয়ার এবং শোয়ার ব্যবস্থা করতে হবে তো! যতক্ষণ অথবা যতদিন এই জাহাজের এমনি ভেসে থাকার মতি গতি থাকবে, আর এই পাশ দিয়ে যেতে যেতে অন্য কোনো জাহাজ আমাদের দেখতে পেয়ে তুলে না নেবে, ততক্ষণ বা ততদিন টিকে থাকার একটা বন্দোবস্ত করতে হবে বই কি!
আফশোস করে আর ফল কি এখন?
জাহাজকে ধন্যবাদ দিতে হয়, তিনি সেইরূপ কাত হয়ে রইলেন, বেশি আর তলাবার চেষ্টা করলেন না। আমরা তিনজনে এধারে ওধারে এবং কেবিনে পরিভ্রমণ শুরু করলাম।
নাঃ, খাবার দাবার অপর্যাপ্তই রয়েছে। পাঁচ বছর না হোক, পাঁচ হপ্তা টেকার মতো নিশ্চয়ই! বিস্কুট, রুটি, মাখন, চকোলেট, জ্যাম, ঠাণ্ডা মাংস টিন কে টিন। গোরা পুলক আর ধরে না! তার কলেবর আমাদের একেবারে ক্ষেপিয়ে তুললো প্রায়।
খাওয়া দাওয়া সেরে একটা প্রথম শ্রেণীর কেবিনে শয়নের আয়োজন করা গেল। ডেকের টিকিট কেটে প্রথম শ্রেণীতে যাওয়ার সুযোগ পাওয়া কতখানি সুবিধার, নরম গদির আরামের মধ্যে গদগদ হয়ে গোরা আমাদের তাই বোঝাতে চায়, কিন্তু তার সূত্রপাতেই এক ধমকে মেজমামা থামিয়ে দেন ওকে।
পরের দিন ভোরে ঘুম ভাঙলে সবাই আমরা চমৎকৃত হলাম। এ কি! কেবিনের দরজা কেবিন ছাড়িয়ে এত উঁচুতে গেল কি করে। রাতারাতি জাহাজটা কি আরেক ডিগবাজি খেলো না কি! বাইরে বেরিয়ে যে কারণ বের করব, তারও যোগ নেই। কেন না দরজা গেছে কড়িকাঠের জায়গায়, কিন্তু আমরা দরজার জায়গায় নেই। আমরা যে কোথায় আছি, ঠিক বুঝতে পারছি না।
গোরা কিন্তু আমাদের কাজের ছেলে। কোত্থেকে একটা দড়ি বাগিয়ে এনে হুক লাগিয়ে ফাঁসের মতো করে দরজার দিকে ছুঁড়ে দিল। কয়েকবার ছুঁড়তেই আটকালো ফাসটা। তারপর তাই ধরে সে অবলীলাক্রমে উপরে উঠে গেল। ফাঁসটাকে দরজার সঙ্গে বার করে বেঁধে দড়িটা নামিয়ে দিল সে আমাদের উঠবার জন্য।
যে দড়ি-পথ গোরার পক্ষে মিনিটখানেক পরিশ্রম, তাই বেয়ে উঠতে দুজনেই আমরা নাস্তানাবুদ হয়ে গেলাম। অনেকক্ষণে, অনেক উঠে পড়ে, বিস্তর ধস্তাধস্তি করে, এ ওর ঘাড়ে পড়ে, পরম্পরায়, বহুৎ কায়দা-কসরতে ঘর্মাক্ত কলেবরে অবশেষে আমরা উপরে এলাম। এসে দেখি জাহাজ এবার অন্যধারে কাত হয়েছেন। অন্যদিকে হেলেছেন, তাই আমাদের প্রতি এই অবহেলা। সেইজন্যেই কেবিনের মেজে পরিণত হয়েছে দেয়ালে, আর দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে ছাদ। জাহাজের মেজাজে!
জাহাজের এই রকম দোলায় অতঃপর কি করা যায়, তাই হলো আমাদের ভাবনা। ব্রেকফাস্ট করা যাক। গোরা প্রস্তাব করল।
এই রে! মেজমামা বাজের মতন ফাটবেন এইবার! মুখ না ধুতেই প্রাতরাশের সম্মুখে! এ প্রস্তাবে নাঃ আর রক্ষা নেই! কিন্তু আমার আশঙ্কা ভুল, মেজমামার দিক থেকে কোনই প্রতিবাদ এলো না। কাল থেকে গোরার প্রত্যেক কথাতেই তিনি চটছিলেন, কিন্তু একথায় তাঁর সর্বান্তঃকরণ সায় দেখা গেল।
প্রাতরাশ সেরে সব চেয়ে উঁচু এবং ওরই মধ্যে আরামপ্রদ একটা স্থান বেছে নিয়ে সেখানে আমরা তিনটি প্রাণী গিয়ে বসলাম। বসে বসে সারাদিন জাহাজটার আচার-ব্যবহার লক্ষ্য করি! প্রত্যেক ঘণ্টায়ই একটু একটু করে জলের তলায় তিনি সমাধিস্থ হচ্ছেন। এই ভাবে চললে তার আপাদমস্তক তলানো ক ঘণ্টার বা কদিনের মামলা, মনে মনে হিসাব করি।
হয়েছে হয়েছে। মেজমামা হঠাৎ চিৎকার করে ওঠেন, যখন আমরা জাহাজে উঠলাম, মনে নেই তোমার? জাহাজের খোলে যত রাজ্যের লোহা লক্কর বোঝাই করছিল মনে নেই?
হ্যাঁ আছে। তা কি হয়েছে তার?
লক্করগুলো তো ভেগেছে, এখন ওই লোহার ভারেই জাহাজ ডুবছে। খোলের ভেতর থেকে লোহাগুলো তুলে এনে যদি জলে ফেলে দেওয়া যায় তাহলে হয়তো জাহাজটাকে ভাসিয়ে রাখা যায়।
আমি ঘাড় নাড়ি–তা বটে। কিন্তু কে আনবে সেই লোহা? এবং কি করেই বা আনবে?
গোরা উৎসাহিত হয়ে ওঠে আনবো? আনবো আমি? তার কেবল মাত্র আদেশের অপেক্ষা!
থাম! মেজমামা প্রচণ্ড এক ধমক লাগান।
লক্করদের সবাই কি গেছে? আপাতত একে ফেলে দিলেও জাহাজটা কিছু হালকা হতে পারে বোধ হয়? দেব ফেলে? আমি বললাম।
থামো তুমি। মেজমামা গরম হলেন আরো তোমরা দুজনে মিলে আমাকে পাগল করে তুলবে দেখছি।
তার চেয়ে এক কাজ করা যাক। আমি গম্ভীরভাবে বলি, জাহাজের কেবিনগুলো ওয়াটার-টাইট বলে শুনেছি। বড়ো দেখে একটার মধ্যে ঢুকে ভাল করে দরজা এঁটে আজকের রাতটা কাটানো যাক তারপর কালকের কথা। কাল যদি ফের বেঁচে থাকি, তখন।
তাই করা গেল। স্টোর-রুম থেকে প্রচুর খাবার এনে সব চেয়ে বড়ো একটা কেবিনের মধ্যে আমরা আশ্রয় নিলাম। গোরা কতকগুলো টর্চ বাতি নিয়ে এসেছিল, তাদের আর আমাদের একসঙ্গে জ্বালাতে শুরু করলো। টর্চের সাহায্যে টর্চার করার নামই হচ্ছে জ্বালানো মেজমামা বললেন, এর চেয়ে জ্বালাতন আর কি আছে? আর ঠিক এই ঘুমোবার সময়টাতেই! বললেন মেজমামা।
অনেকক্ষণ কেটে গেল, কিন্তু রাত যেন আর কাটে না। যতক্ষণ সম্ভব এবং যতদূর সাধ্য, প্রাণপণে আমরা ঘুমিয়েছি; কিন্তু ঘুমানোর তো একটা সীমা আছে! গোরা সেই সীমানায় এসে পৌঁছেই ঘোষণা করে, এইবার ব্রেকফাস্ট করা যাক।
অ্যাঁ! এই রাত থাকতেই! শুয়েই আমি চমকে উঠি।
কী রাক্ষুসে ছেলে রে বাবা! মেজমামাও গর্জ্জন করেন, তোর কি ভোর হোতেও তর সইছে নারে?
খিদে পেয়েছে যে। গোরা বলে, ভোর না হলে বুঝি খিদে পেতে নেই?
খিদে কি আমারও পায়নি? মেজমামা ফোঁস করেন; কিন্তু–তা বলে কি রাত থাকতেই ব্রেকফাস্ট–এ রকম বে-আক্কেলে কথা কেউ শুনেছে কখনো?
কারো বাপের জন্মে? ভদ্রলোকে শুনলে বলবে কি?
আহা ছেলেমানুষ, খিদে পেয়েছে খাক না! এখানে তো ভদ্রলোক কেউ নেই। কে শুনছে? বিস্কুটের টিনটা গোরার দিকে আগিয়ে দিই।
বা-রে, আমি বুঝি বাদ? মেজমামা আমার দিকে হাত বাড়ান, ছেলেমানুষ বলে কি ও মাথা কিনেছে নাকি? ছেলেমানুষ না হলে খিদে পেতে নেইকো?
মেজমামাকেও একটা টিন দিতে হয় এবং নিজেও আমি একটা টিন শেষ করি। তারপর আবার ঘুম। তারপর আবার অনেকক্ষণ কাটে। আবার ঘুম ভাঙে। আবার খাবার পালা। এইভাবে বারবার তিনবার ব্রেকফাস্টের দাবী মিটিয়েও সকালের মুখ দেখা যায় না। বারোটা বিস্কুটের টিন ফুরোয়, কিন্তু বারো ঘণ্টার রাত আর ফুরোয় না, তখন বিচলিত হতে হয়, সত্যিই!
গোরা, জ্বালাতে টর্চটা একবার। কি ব্যাপার দেখা যাক–
টর্চের আলো ফেলে কেবিনের পোর্টহোলের ভেতর দিয় যা দেখি, তাতে চোখ কপালে উঠে যায়। জল, কেবল সমুদ্রের কালো জল! তা ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না।
সর্বনাশ হয়েছে! মেজমামা কন–খুব সংক্ষেপেই।
হ্যাঁ আমরা জলের তলায়–ডুবে গেছি। আমাদের জাহাজ ডুবে গেছে কখন!
কিন্তু একথা মুখ ফুটে না বললেও চলতো, কেন না তথ্য আর অস্পষ্ট ছিল না যে, আমাদের আর আশেপাশের কেবিনগুলো সব ওয়াটার-টাইট বলেই আমরা বেঁচে আছি এখনো পর্যন্ত। পোর্টহোলের কাঁচের শাসিটা পুরু, এত পুরু যে, তা ভেঙে জল ঢুকতে পারবে না। তাই রক্ষা!
এবার কিন্তু মারা গেলাম আমরা। কান্নার উপক্রম হয় মেজমামার।
অনেকটা নিচেই তলিয়েছি মনে হয় এত নিচে যে, সুয্যির রশ্মিও এখানে এসে পৌঁছোয় না। দিন কি রাত, বোঝবার যো নেই।
কতক্ষণ আছি, তাই বা কে জানে! মেজমামার দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ে।
ব্রেকফাসেটর সংখ্যা ধরে হিসেব করলে মনে হয়, এক রাত কেটে গিয়ে গোটা দিনটা কাটিয়ে এখন আমরা আরেক রাতে এসে পৌঁছেছি।
তবে! তবে আর কি হবে। মেজমামার হতাশার স্বর শুনে দুঃখ হলো। তারপরে নিজেই তিনি নিজের প্রশ্নের উত্তর দিলেন–তবে আর কি হবে! দাও আমার রুটি- মাখনের বাক্সটা সাবাড় করা যাক তাহলে!
মুখ থেকে কথা খসতে না খসতেই গোরা মাতুল-আজ্ঞা পালন করে। এসব দিকে ওর খুব তৎপরতা।
এইভাবে এতদিন এখানে কাটাতে হবে, কে জানে! হয়তো বা যাবজ্জীনই, পাউরুটির পেষণে মুখের কথা অস্পষ্ট হয়ে আসে মেজমামার।–না খেয়ে তো আর বাঁচা যায় না। অতএব খাওয়াই যাক কী করা যাবে?
তারপর থেকে উদরকেই আমরা ঘড়ির কাজে লাগাই। আবার খিদে পেলেই বুঝি, আরো ছ ঘণ্টা কাটলো। এই করেই দিনরাত্রির হিসেব রাখা হয়। এসব বিষয়ে গোরার পেট সব চেয়ে নিখুঁত– একেবারে কাঁটায় কাঁটায় চলে। ঘণ্টায় ঘন্টায় সাড়া দেয়!
এইভাবে কয়েকটা ব্রেকফাস্ট কেটে যাবার পর মনে হলো, কেবিনে অন্ধকার যেন অনেকটা ফিকে হয়ে এসেছে। হ্যাঁ, এই যে বেশ আলো আসছে পোর্টহোল দিয়ে।
কী ব্যাপার? ব্যগ্র হয়ে ছোটেন মেজমামা পোর্টহোলের দিকে, কই, আকাশ তো দেখা যাচ্ছে না। চারদিকেই জল যে! তাঁর করুণধ্বনি আমাদের কানে বাজে!
নাঃ, এখনো জলের তলাতেই আছি বটে, তবে কিছুটা উপরে উঠেছি। সূর্যরশ্মি প্রবেশের আওতার মধ্যে এসেছি! আমার মনে হয়, ইতিমধ্যে উপরের মাস্তুল টাস্তুলগুলো বসে গিয়ে ভার কমে যাওয়ায় খানিকটা হালকা হয়ে নিমজ্জিত জাহাজটা কিছু উপরে উঠতে পেরেছে। যাক, একটু আলো তো পাওয়া গেল, এই লাভ!
থাক না জল চারদিকে, আমাদের কেবিনের মধ্যে তো নেই! এই বা কি কম বাঁচোয়া! সান্ত্বনার স্বরে এই বলে মেজমামার কথার আমি জবাব দিই।
প্রত্যুত্তরে মেজমামা শুধু আরেকটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করেন।
আমার কিন্তু এমনি জলের তলায় থাকতেই ভাল লাগে। কিরকম মাথায় উপরে, তলায়, চারধারেই অথৈ জল! কেমন মজা! যদ্দুর চাও–খালি সমুদ্র–আর সমুদ্দুর গোরা এতক্ষণে একটা কথা কয়–বাড়ির চেয়ে এখানে–এখন ঢের ভাল!
হ্যাঁ! বাড়ির চেয়ে ভাল বই কি! মেজমামা নতুন বিস্কুটের টিন খুলতে খুলতে বলেন, জলে ডুবে বসে আছি জলাঞ্জলি হয়ে গেছে আমাদের–ভাল না?
জল ডুবে কি রকম? গোরা প্রতিবাদ করে–ডুবে গেলেও আমরা কতো নিচে আছি শিব্রামবাবু?
বিশ-ত্রিশ-চল্লিশফিট, কি আরো বেশিই হবে–কে জানে! আমি জানাই।
ডুবন্ত লোকের কাছে ত্রিশ ফিট জলের তলাও যা, আর হাজার ফিটও তাই! সবই সমান! কোনোটাই ভাল নয়। আবার মেজমামার দীর্ঘনিঃশ্বাস।
কিন্তু মেজমামা, আমাদের কেবিনের মধ্যে তো এক ফোঁটাও জল ঢুকতে পারছে না! তাহলে ডুবলামই বা কি করে? আবার গোরার জিজ্ঞাস্য হয়।–জলে যদি না পড়ি–না যদি হাবুডুবু খাই–আমরা মরবো কেন? বলেই সে আমার দিকে প্রশ্নবাণ ছাড়ে, হ্যাঁ, শিব্রামবাবু বলুন না! জলে ডুবে গেলে কি বাঁচে মানুষ? আমরা যদি ডুবেছি, তাহলে বেঁচে আছি কি করে?
আহা, জল ঢুকছে না যেমন, হাওয়াও ঢুকতে পারছে না যে তেমনি। আমি ওকে বোঝাবার প্রয়াস পাই। আর আমার মনে হয়, মানুষে জলে ডুবে যে মারা যায়, সে জলের প্রভাবে নয় হাওয়ার অভাবেই! এই কারণেই গায়ে জলের আঁচড়টিও না লাগিয়ে আমরা শোনপাপড়ির মত শুকনো থেকেও সমুদ্রগর্ভে ডুবে মারা যেতে পারি। আজই হোক কিংবা কালই হোক-সঞ্চিত হওয়ার অক্সিজেন নিঃশেষ হয়ে গেলেই—অক্সিজেন–বঞ্চিত হলেই আমরা…
গুরুতর বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাঝখানেই গোরা সশব্দে লাফিয়ে ওঠে–একি? কে ওখানে? ও কে?
আমাদের সবার দৃষ্টি পোর্টহোমের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ওর শার্সির ওধারে বদন ব্যাদান করে এ আমার কোন প্রাণী বাবা? অজানা কোন জানোয়ার? সমুদ্রের তলায় এমন বিচ্ছিরি বিটকেল বিদঘুঁটে চেহারা–ভয় দেখাচ্ছে এসে আমাদের!
শার্ক! মেজমামা পর্যবেক্ষণ করে কন। এরই নাম শাক।
হ্যাঁ বইয়ে পড়েছি বটে। এই সেই শার্ক? গোরার উৎসাহের সীমা থাকে না। পোর্টহোলের। উপর সে ঝুঁকে পড়ে একেবারে।
উঁহু, অতো না! অতো কাছে নয়, কামড়ে দিতে পারে। আমি সতর্ক করে দিই, এমন কি, না কামড়ে একেবারে গিলে ফেলাও অসম্ভব নয়।
বাঃ শার্সি রয়েছে না মাঝখানে? গোরা মোটেই ভয় খাবার ছেলে নয়।
তোকে দেখলেই সুখাদ্য মনে করবে! মেজমামও সাবধান করতে চান–তখন শার্সি ফার্সি ভাঙতে ওর কতক্ষণ! মাঝখানে আমরাও মারা পড়বো তোর জন্যেই!
গোরা কিন্তু ততক্ষণে অতিথির সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান শুরু করেছে।
সেদিন বিকেল থেকেই কেবিনের বাতাস দুর্গন্ধ হয়ে উঠল–এইবার কমে আসছে অক্সিজেন, বিষাক্ত হয়ে উঠছে বাতাস। আমি বললাম, এর পর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নিতেও কষ্ট হবে আমাদের।
তাহলে উপায়? মুখখানা সমস্যার মত করে তোলেন মেজমামা। তাহলে এক কাজ করা যাক তিনি নিজেই সাবধান করে দেন, যতো টিন আর বিস্কুট আছে, সব খেয়ে শেষ করা যাক এসো। খেয়ে দেয়ে তারপর গলায় দড়ি দিলেই হবে। খাবি খেয়ে অল্পে অল্পে মরার চেয়ে আত্মহত্যা করা ঢের ভালো!
ঠিক অতো উপাদেয় না হলেও আরেকটা উপায় আছে এখনো? মেজমামাকে আশ্বস্ত করি, আমাদের দুধারেই কেবিন, উপরে আর নিচের তলাতেও। আপাতত দেয়ালে এবং মেঝের ছ্যাদা করে ঐ সব ঘরের বিশুদ্ধ বাতাস আমদানি করা যাক। এ ঘরের দূষিত বায়ু সব দূর করে দিই। তারপর শেষে ছাদ ফুটো করলেই হবে। আপাতত এতেই চলে যাবে দিনকতক।
মেজমামা স্তস্তির সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়েন। গোরা বলে, তার চেয়ে আমরা জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলি না কেন। তাতেও তো কি বাতাস বাড়াতে পারে! কি বলেন?
মেজমামা কটমট করে তাকান ওর দিকে, আমি কোনো উত্তর দিই না।
এর পরের কদিনের ইতিহাস সংক্ষেপে এই : ঘরের বাতাস ফুরিয়ে এলেই এক একধারে একটা করে গর্ত বাড়ে। বাতাসের কমতি গর্তের বাড়তির দ্বারা পুষিয়ে যায়। গোটা জাহাজটা আমাদের ভাগ্যক্রমে এয়ার-ওয়াটার-টাইট ছিল বলেই এই বাঁচোয়ো!
শার্কটা গোরার রূপে-গুণে মুগ্ধ হয়েছিল নিশ্চয়। সে কেবলি ঘুরে ঘুরে আসে। গোরা তার শার্ক বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করে সময় কাটায়। ইতিমধ্যেই দুজনের ভাব বেশ জমে উঠেছে। সামুদ্রিক সব বিষয়কৰ্ম ফেলে ঘুলঘুলির কাছেই ঘোরা-ফেরা করছে শার্কটা। আর গোরার তরফেও আগ্রহের অভাব নেই, সুযোগ পেলেই সে সমুদ্রচর বন্ধুর আদর-আপ্যায়নের কসুর করে না। বেশির ভাগ সময়ই ওদের মুখোমুখি দেখা যায়–মাঝে শার্সির ব্যবধান মাত্র। কোন দুর্বোধ্য ভাষায় যে ওরা আলোচনা করে, তা ওরাই জানে কেবল।
মেজমামা একটার পর একটা বিস্কুটের বাক্স উজাড় করে চলেন। আর কারো হস্তক্ষেপ করার যো নেই ওদিকে। মেজমামার প্রসাদ পায় গোরা। আর কখনো-সখনো নিজের প্রসাদের দু-এক টুকরো আমাকে দ্যায়। আমি হাঁ করেই থাকি, উঠে কি হাত বাড়িয়ে খাবার কষ্ট স্বীকার করার ক্ষমতাও যেন নেই আমার। গোরার ভুলবশত ক্বচিৎ কখনো এক-আধখানা যা গোঁফের তলায় এসে পড়ে, তাতেই আমার জীবিকা-নিৰ্বাহ হয়ে যায়।
শুয়ে শুয়ে প্রেমেনের বইখানা পড়ি। দুবার পড়ে ফেলেছি এর মধ্যেই একবার শেষ থেকে গোড়ার দিকে, আরেকবার গোড়া থেকে শেষের দিকে। এবার মাঝখান থেকে দুদিকে পড়তে শুরু করেছি যুগপৎ।
কদিন এইভাবে কাটে, জানি না! খাওয়া আর শোওয়া ছাড়া তো কাজ নেই শুয়ে পড়া, শুয়ে শুয়ে পড়া। এমনি করে একদিন যখন বইটার দিগ্বিদিকে পড়ছি, এমন সময়ে অকস্মাৎ সমুদ্রতল যেন তোলপাড় হয়ে উঠল। আমাদের কেবিন কাঁপতে লাগল, একটা গমগমে আওয়াজ শুনতে পেলাম। সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে বসলাম আমরা কী ব্যাপার? প্রশ্নের পরমুহূর্তেই পোর্টহোলের ফাঁক দিয়ে সূর্যের উজ্জ্বল আলো আমাদের কেবিনের মধ্যে ঢুকলো। এ কী! এই আকস্মিক দুর্ঘটনায় সবাই আমরা চমকে গেলাম।
আকাশ, আকাশ! মেজমামা চিৎকার করে আকাশ ফাটান।
তাইতো! আকাশই তো বটে! ঘুলঘুলির ফাঁক দিয়ে দেখি–রৌদ্রকরোজ্জ্বল সুনীল আকাশ! নীলাভ শূন্যের তলায় দিগন্ত বিস্তার সমুদ্রের কাঁচলে নীল জল! আবার যে এইসব নীলিমার সাক্ষাৎ পাবো, এমন আশঙ্কা করিনি।
ভেসে উঠেছি আমরা। ভাসছি আবার। কিন্তু ভেসে উঠলাম কি করে? মেজমামা হঠাৎ কঠোরভাবে চিন্তা করেন–অনেক ভেবে চিন্তে বলেন, হয়েছে, ঠিক হয়েছে। জাহাজের খোলটা গেছে খসে সঙ্গে যত লোহালক্কর ছিল, সব গেছে জলের তলায়। তার জন্যই ওই বিচ্ছিরি আওয়াজটা হলো তখন, বুঝেছিস গোরা!
গোরা ততক্ষণে কেবিনের দরজা খুলে বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে! তারও আর্তনাদ শোনা যায় সঙ্গে সঙ্গেই–জাহাজ! মেজমামা, জাহাজ! এদিক দিয়েই যাচ্ছে দ্যখোসে–
এতদিনে ও একটা বুদ্ধিমানের মতো কাজ করে। হাফ-প্যান্টের পকেট থেকে লাল সিল্কের রুমালটা বার করে নাড়তে শুরু করে দ্যায়। আমিই ওটা ওকে একদা উপহার দিয়েছিলাম! ওর জন্মদিনে।
আমাদের নব জন্মদিনে সেটা এখন কাজে লাগে।
রেঙ্গুন থেকে চাল–বোঝাই হয়ে জাহাজটা কলকাতা ফিরছিল। জাহাজে উঠে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি অচেনা মানুষের মুখ দেখে আনন্দ হয়! ক্যালেন্ডারের তারিখ মিলিয়ে জানা যায়, পুরো পাঁচ পাঁচটা দিন আমরা জলে তলায় ছিলাম।
যাহোক পাতাল–বাস হলো মামা। মেজমামা ঘাড় নাড়লেন–পাঁচদিন না তো–পাঁচ বচ্ছর।
পাতালে তো অ্যাদ্দিন কাটলো, এখন হাসপাতালে কদিন কাটে কে জানে! আমি বলি, যা বিস্কুক পেটে গেছে এই কদিনে। শুকনো বিস্কুট চিবুতে হয়েছে দিনরাত!–
গোরা বলে, বারে বিস্কুট বুঝি খারাপ। ও তো খুউব ভাল জিনিস। বিস্কুট খেতে পেলে ভাত আবার খায় নাকি মানুষ!
গোরার মামা গুম হয়ে থাকেন। তাঁর ভোট যে বিস্কুট আর গোরার পক্ষেই সেটা বোঝা যায় বেশ ।
Post a Comment