স্বামী হওয়ার সুখ – শিবরাম চক্রবর্তী
সন্ধ্যেয় যখন চারুর সঙ্গে আমার কফি হাউসে দেখা, তখন তাকে খুব সুচারু বলে মনে হল না। দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে—কিন্তু আগের সে-চারু যেন নয়। কোথায় যেন কী গলদ ঘটেচে। আরামচেয়ারে বসে কফি পান করছে বটে, কিন্তু কফি পেলেও আরাম পাচ্ছে না। বিলক্ষণ বোঝা যায়।
তার ওপরে আরেকটা বৈলক্ষণ্য, বসেছে না বলে বসে আছে বললেই যেন ঠিক হয়। ভূমিকম্পের দ্বারা ধরণি দ্বিধা হয়ে বাড়িঘর যেমন বসে যায়, প্রয়োপবেশনের ফলে কয়েদিরা বসে যায় যেমন অনেকটা সেই রকমের চেহারা আমাদের শ্রীচারুর।
অপরের বিপদে-আপদে অকাতরে উপদেশপ্রবণ আমার মতো লোক এরকম বিধ্বস্ত অবস্থায় কাউকে দেখতে পেলে অযাচিতই এগিয়ে যায়। তা ছাড়া, আরও বড়ো কারণ ছিল। ওই বর্বরটাই আবার আমার মাসতুতো বোন শেফালীর বর।
‘ভারি মুশকিলে পড়েছি ভাই!’ চারু বলল আমায়—‘আর কী করে যে এই মুশকিল থেকে আসান পাব ভেবে পাচ্ছিনে।’
‘শেফালি?’ আন্দাজ করে আমি ঢিল ছুড়ি।—‘শেফালি বুঝি?’
‘শেফালিই।’ মাথা নেড়ে ও সায় দেয়।
‘ও!’ এই বলে ওর আরও বলার আমি অপেক্ষা রাখি।
‘আজকের দুর্ঘটনাটা ঘটেছে।’ বলল চারু—‘রোজ যেমন দুপুরে আপিস থেকে বেরিয়ে টিফিন করতে যাই আজও তেমনি গেছি আর সেই সময়েই এই বিনামেঘে বজ্রাঘাত!’
‘কীরূপ বজ্রাঘাত?’ আমি জিজ্ঞেস করি।
ব্যাকরণের সীমা লঙ্ঘন করে ভাষার সেঅপপ্রয়োগ করছে বলেই আমার মনে হয়। দধীচির অস্থিতেই বজ্র, এই তো আমি জানি। কিন্তু এখানে যখন তা নয়, তার বদলে ঘৃতাচীর অস্তিত্বই টের পাওয়া যাচ্ছে, তখন বিনা আগুনে ঘি পড়ল, এই জাতীয় কোনো উপমা নির্বাচন করলেই কি সুষ্ঠু হত না?
কিন্তু ভাষার কারুকার্যে নজর দেবার মতন মনের অবস্থা চারুর নয় তখন। অলংকার এবং লঙ্কার মধ্যে ঝালের প্রাচুর্য থাকলেও, আর সব বিষয়েই যে বৈষম্য, এতখানি বোঝার মতো সূক্ষ্ম বোধশক্তি তার আছে তখন আশা করা অন্যায়।
‘সেই কথাই তো বলতে যাচ্ছি।’ বিষণ্ণ সুরে ও শুরু করল—‘যখন আমি টিফিন করতে বেরিয়েছি সেই সময়ে শেফালি এসেছিল আমার আপিসে।’
‘ও!’ সমঝদারের মতো আমি মগজ নাড়ি।
‘আমার জন্যে আপিসের বাইরে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ অপেক্ষাও করেছিল নাকি!’ চারু জানাল—‘ওকে নিয়ে কেনাকাটায় বেরোবার কথা ছিল কিনা আমার।’
‘আর তুমি বুঝি তা বেমালুম ভুলে বসেছিলে?’
চারু কোনো উত্তর না দিয়ে মুখখানা মুমূর্ষুর মতো করে রাখে। আমার মতো ভাবগ্রাহীর পক্ষে রূপবাণীর আধখানাই যথেষ্ট। সমস্ত সিনেমাটা না হলেও চলে; সিনের একটুখানিই ঢের। ওইরূপ দেখেই, মুখ ফুটে ও কিছু আর বললেও, ওর অবস্থা জানার আমার কোনো বাধা হয় না।
আমি বললাম—‘কাজটা ভালো করনি ভায়া।’
সঙ্গে সঙ্গে অপরাধ তত্ত্বের একজন বড়ো অথরিটির কথা আমার স্মরণে আসে। অপরাধীরা জন্মায় না, তাদের তৈরি করা হয়ে থাকে। একবার আসামি হবার ফলেই তাদের অপরাধপ্রবণতা দেখা দেয়।
স্বামীদের সম্বন্ধেও ঠিক সেই কথা। স্বামীরাও কিছু জন্মগত নয়। বিবাহের দ্বারা তাদের বানানো হয় এবং তার পরেই তারা চিরদিনের মতো অপরাধী হয়ে পড়ে।
‘আমার আফিসের পবিত্রর সঙ্গে ওর দেখা হয়েছিল। পবিত্র ওকে বলেছিল, কোথায় আমি টিফিন করতে যাই সেজানে এবং তাকে সঙ্গে করে আমার সন্নিধানে নিয়ে যাবার জন্য তৈরিও হয়েছিল নাকি। কিন্তু শেফালি নাকি বলেছে যে, কোনো দরকার নেই, ও একাই বাজার করতে পারবে।’
‘কথাগুলো কি খুব রূঢ়ভাবে বলেছিল? বেশ রেগেমেগে?…পবিত্র কী বলে?’ রোগজীবাণুর মতো যাবতীয় সভ্য মানুষের অন্তর্গত আমার শার্লক হোমসও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবার। এই অকূলে উত্তীর্ণ হবার দুরাশায় তৃণবৎ ‘ক্লু’-র অনুসন্ধান করে।
‘পবিত্র তো বলে যে—না, তার সঙ্গে শেফালি খুব মধুর ব্যবহার করেছে। মেয়েরা পরপুরুষের সঙ্গে যেমন নাকি করে থাকে—’
‘উঁহু, আবার ভাষার শ্রাদ্ধ করছ—তুমি কিংবা পবিত্র কে করছ জানি না।’ বাধা দিয়ে আমি বলি, ‘কথাটা ঘুরিয়ে বলা দরকার। পরস্ত্রীরা যেমন সুমধুর ব্যবহার করে থাকে—এমনি করে বললে ঠিক হবে।’
‘পবিত্র কী বুঝবে? আমি তো নিজস্ত্রীর মাধুর্য জানি। এবং তোমার বোন যখন, তখন এই মাধুর্যের কী অর্থ তা বোধ হয় তোমারও অজানা নয়।’
‘হুঁ। মেয়েরা যখন ভেতরে ভেতরে পুড়তে থাকে, তখনই তাদের মুখে মিষ্ট হাসির উজ্জ্বল আভা দেখা যায়।’ প্রাজ্ঞের মতো আমি মাথা নাড়ি।—‘এই অদ্ভুত কর্ম মেয়েরাই পারে। মেয়েরাই পারে কেবল।’
‘ঠিক।’ চারু যোগ দেয়, ‘আর হয়তো মোমবাতিরাও কিছুটা।’
ওর মুখে আবার আমি চালচিত্র দেখি।
উভয়ে কিছুক্ষণ কফি পানের পর আবার ওর আরম্ভ—‘পবিত্রর কথা শুনে আমার মনে পড়ল আপিস বেরুবার মুখে কেনাকাটার কী একটা কথা যেন ও বলছিল। কিন্তু তাড়াতাড়িতে আমি তাতে ভালো করে কান দিইনি। কান দিতে পারিনি বলাই উচিত। দশটার সময় আপিস যখন কান ধরে টান লাগায়, তখন একটা কান ক-জনকে দেয়া যায়, বলো-না!’
‘আরেকটা তো ছিল!’ আমি বলি। অঙ্গুলিনির্দেশই যথেষ্ট,। নাকি, টেনে দেখাতে হবে, ঠিক করতে পারি না।
‘এ পাড়ায় ও বাজার করতে এলে একটা নির্দিষ্ট স্থানে নির্ধারিত সময়ে আমরা মিলিত হই। বরাবরের মতো এই আমাদের পাকাপাকি ব্যবস্থা। কিন্তু—ও যে আজ কেনাকাটায় আসবে তা আমি একদম খেয়ালই রাখিনি।’
‘যাক, যা হবার হয়ে গেছে। গতস্য শোচনা নাস্তি। ও নিয়ে আর মাথা ঘামিয়ো না।’ ওর মনের বোঝা এক ফুৎকারে উড়িয়ে দেবার আমার আয়াস।
মুখে কিছু বলে না, কিন্তু ওর মাথা আরও ঝুঁকে পড়ে।
‘সেই জন্যেই বুঝি আপিস ফেরতা আর বাড়ি যাওয়া হয়নি? কফি হাউসে রয়েছ এখনও? কিন্তু এমন করে পালিয়ে পালিয়ে ক-দিন থাকবে? এইভাবে কি বঁাচা যায়? আমি তোমায় বাড়ি যেতে বলি।’ খুনের আসামি থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করুক এই আমার সাধু ইচ্ছা।
‘বাড়ি তো যেতেই হবে।’ কাঁদো-কাঁদো সুরে ও বলে, ‘বাড়ি তো যাবই, কিন্তু গিয়ে কী কৈফিয়ত দেব তাই আমার ভাবনা।’
‘কী আবার দেবে? স্রেফ হেসে উড়িয়ে দেবে।’
দ্বিজেন্দ্রলালী কায়দায়—‘এই গোঁফ জোড়াতে দিলে চাড়া তোমার মতন অনেক পাব!’—
ভাবখানা এইরকম করে—বুঝেচ?’
‘কিন্তু আমার যে গোঁফ নেই।’ ও গোঁফে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। যেখানে ওর গোঁফ নেই সেইখানে।
অ-দ্রষ্টব্যটা দেখতে হয় আমায়। দেখে শুনে আরেকটা উপায় বার করতে হয় আমাকে—এই আমাকেই।
‘সেএকটা কথা বটে। আমারও নেই যে তোমায় ধার দেব।’ আমি বাতলাই—‘তবে পরচুলার মতো চেষ্টা করলে কি পরের গোঁফ একটা ভাড়া পাওয়া যায় না? জোগাড় করে দিতে পারে না কেউ?’
এ-প্রস্তাব ওর মনঃপূত নয়। ও ঘাড় নাড়ে আর বলে—‘আমি তোমার মতো, সেকথা কি মিথ্যে কথা বলা হবে না? সেকথা কি এখানে খাটে?’
ওর সত্যাগ্রহ আমাকে বিস্মিত করে। আমি বললাম—‘সত্যবাদীদের তাহলে বিয়ে করাই উচিত নয়। যুধিষ্ঠিরও একলা বিয়ে করতে হলে অতবড়ো দুঃসাহস করতেন কি না সন্দেহ।
‘ভয়ানক মিথ্যে বলা হবে। শেফালির মতো মেয়ে অনেক পাওয়া যায় না। খুঁজে বার করো দেখি একটা। অমন দুর্ধর্ষ মেয়ে ওই একটিই আছে।’
স্বামীগত সর্বজনীন সমস্যাকে ও ব্যক্তিগত করে দেখে সকাতর হচ্ছে এই দৃশ্যে আমার হাসি পায়। ওই ধরনের কলত্রাণি কেবল দেশে দেশে বা প্রদেশে প্রদেশে নয়, গৃহে গৃহে বিরাজমান—একপ্রকার আশ্বাসে ওর দুঃখভার লাঘব করার চেষ্টা করি—কিন্তু বৃথা! ওর দীর্ঘনিশ্বাসের তোড়ে আমার সমস্ত যুক্তি আর পটাটো চিপস উড়ে যায়।
‘তুমি বুঝতে পারছ না বন্ধু?’—আমার সমস্ত কথার পরেও ভদ্রলোকের সেই এক কথা—‘মেয়েদের বিষয়ে একটুও যদি তোমার জ্ঞানগম্যি থাকে তাহলে বুঝতে পারবে যে, যে কাজ আমি করেচি তাদের চোখে তা অমার্জনীয়। মেয়েলি অভিধানে তার কোনো ক্ষমা হয় না। শেফালি এই ভাববে, ভাববে কী, ভেবে বসে আছে যে তার সম্বন্ধে আমার আর কোনো আগ্রহই নেই। তাকে আমি ঘরসাজানো একটা আসবাবের বেশি গণ্য করি না। সেইজন্যই তার কথা আমি এত সহজে ভুলতে পেরেচি।…’
‘এই বিপদে রবীন্দ্রনাথের সাহায্য নিলে হয় না?’ আমি জিজ্ঞেস করি—‘ভুলে থাকা নয় ভুলে যাওয়া—কবিতা জোরালো করে আউড়ে দিলে কেমন হয়?…না, না, এখানে নয়, শেফালির কাছেই—তাই বলছি।’
চারু সেকথায় কান দেয় না, নিজের কথায় গড়িয়ে চলে—‘তার সঙ্গে একসাথে বাজার করার মতো এত বড়ো সৌভাগ্য যে কী করে আমি হেলায় হারাতে পারি, কেন যে আমি আপিসে এসে অবধি তার প্রতীক্ষায় হাপিত্যেশে ঘড়ির কাঁটার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে প্রত্যেক মিনিট অধীর হয়ে থাকিনি, এই ভেবেই সেআরও মর্মাহত হবে। মেয়েরা ওইরকমই! তাদের মিলনের অপেক্ষায় ছটফট করা ছাড়া আমাদের যে আর কোনো কাজ নেই, থাকতে পারে না এবং থাকা উচিত নয়, শেফালির এই নারীসুলভ ধারণায় অজান্তে আমি কত বড়ো আঘাত যে হেনেছি তা তুমি ভাবতে পারো না।’
আমি ভেবে দেখি। দেখে বলি—‘হুম।’
‘শেফালি একথা কিছুতেই বুঝতে পারবে না,’ চারু বলতে থাকে—‘আপিস বেরোবার মুখে কী করে ট্রামে চাপব শুধু এই এক সমস্যা ছাড়া আর কোনো চিন্তা আমাদের মনে স্থান পায় না। এমনকী সেই ভাবনায় ভালো করে আমরা দুটি খেতেও পারিনে। আর তারপর আমরা যন্ত্রচালিতের মতো ট্রামের নির্দিষ্ট স্টপেজে গিয়ে অপেক্ষা করে, পর পর কয়েকটা কেরানি-ভরতি ট্রামে-বাসে পাত্তা না পেয়ে অবশেষে মরিয়া হয়ে আঙুলের ডগা দিয়ে একটাকে পাকড়াতে পারি। তারপর ঝুলতে ঝুলতে কী করে যে সশরীরে আপিসঘরে পৌঁছে নিজের টেবিলটিতে গিয়ে বসি সেএকটা মন্ত্রমুগ্ধ ব্যাপার! এমনকী, চোখ বুজে থাকলেও, এই দিনের পর দিন একটানা ঘটে মধ্যে অন্য কিছু ভাববার এতটুকু ফাঁক কোথাও থাকে না। যেখানে রঙিন স্বপ্নদের কিংবা স্বপ্নের রঙ্গিণীদের একটুখা¡নি স্থান দেয়া চলে। কিন্তু এসব কথা শেফালি বুঝবে না। এ জন্মে নয়।’
‘রানির জীবনে তো না।’ আমি ওর সঙ্গে একেবারে একমত—‘বুঝতে হলে তার জন্যে ওকে কেরানি-জন্ম লাভ করতে হবে।’
‘বলো তো ভাই, আমি কী করি এখন?’ চারু ভেঙে পড়ে—ওর কন্ঠস্বরের মতোই ভগ্নদশা দেখা যায় ওর।
‘এক কাজ করো।’ আমি উপদেশ দিই; ‘মেয়েরা ভারি ফুল ভালোবাসে। কথায় যখন কুলিয়ে ওঠা যায় না, তখন সৌরভে ওদের কূল মেলে। সামান্য কিছু ফুলের তোড়াটোড়া কিনে নিয়ে যাও—সেই সঙ্গে দু-একটা মুখরোচক গল্প বানিয়ে রাখো—দরকার হলে তাকমাফিক তখন ছাড়বে।’
‘উঁহু! কিচ্ছু হবে না তাতে। শেফালিকে তুমি জান না।’ চারুর সেই এক সুর।
শুনে শুনে আমার রাগ হয়। আমার মাসতুতো বোন—জন্ম থেকে দেখচি—আমি জানিনে! আর দু-দিনের পরিচয়ে উনি জানেন। রেগেমেগে বলি—‘তাহলে যাও, সটান গিয়ে লেকে ডুবে মরো গে। তাহলেই সেএই অবহেলার দুঃখ ভুলবে। ভুলতে পারবে আমি আশা করি। পা কাটা গেলে আর কাঁটার ব্যথা থাকে না।’—এই বলে আমার কফির দামটাও ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে চটেমটে আমি উঠে আসি। শোকের বোঝা যে বইছে, বোঝার ওপর এই শাকের আঁটিও তার সইবে।
কিন্তু যথার্থই বলেছিল চারু, শেফালিকে সত্যিই আমি চিনিনে। তার একফালিই আমি দেখছিলাম, শেফালি আর সেনেই। মাসতুতো বোনরূপে যার বন্যরূপ একদা দেখেছি, কিছুদিনের সংসারযাত্রায় তার এখন অন্যরূপ—শেফালির দাম্পত্যচেহারা একেবারে আলাদা। অচিরেই তা জানা গেল।
শেফালি বেড়াতে এসেছিল আমাদের বাড়ি। তার দিকে তাকিয়ে চোখ আর ফেরানো যায় না।
‘বা:। দিব্যি যে তোকে মানিয়েছে!’ আমি বলি। লেটেস্ট ডিজাইনের বাজারের সেরা শাড়িটা তার সর্বাঙ্গ জুড়ে যেকথা বলছিল তার উচ্চস্বরের সঙ্গে আমার তুচ্ছ স্বর পাল্লা দিতে পারে না, বলাই বাহুল্য।
‘ভালো লাগছে তোমার?’ শেফালি শাড়ি এবং আমার দিকে তাকায়।
‘ভয়ংকর রকম।’
‘তাহলে যেয়ো আমাদের বাড়ি। আরগুলোও দেখাব। এর চেয়েও সেগুলো আরও চমৎকার। ছ-রকমের ছ-খানা শাড়ি কিনেচি, শাড়ি আর ব্লাউজে জড়িয়ে।’
ভালো করে ওকে তাকিয়ে দেখি।—‘চারু কিছু বলল না?’ আমি জানতে চাই।
‘উনি?’ বলতে গিয়ে চলকে উঠল শেফালি। ‘উনি বললেন বই কী! উনিই তো বললেন!’
আমার ভুরু কড়িকাঠে গিয়ে ঠেকে—আমি ঠিক বুঝতে পারি না।
‘উনিই তো বললেন কিনতে।’ শেফালী আরও খোলসা করে দেয়, ‘না কিনিয়ে ছাড়লেন না তাই বরং বলা উচিত।’
‘না না। এ হতেই পারে না।’ আমার প্রতিবাদ।
শেফালি হেসে কুটিকুটি হয়ে যায়। ‘সত্যি, ভারি মজার ব্যাপার। বলি তাহলে। ক-দিন আগে এক-আধটা টুকিটাকি কেনার জন্য ধর্মতলায় যাবার আমার দরকার পড়ে। আমার ধারণা ছিল আপিসে বেরুবার মুখে কথাটা ওঁকে বলেছিলাম—তাই ভেবে বাজার করতে হলে যেখানটা যেসময়ে আমরা গিয়ে মিলে থাকি সেইখানে গিয়ে আমি উপস্থিত হলাম। বিশ মিনিট ওঁর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকার পর আমার মনে পড়ল, ওই যা:! ওঁকে তো বলাই হয়নি। বলতে ভুলেই গেছি একদম। তখন ওঁর আপিসে গিয়ে হাজির হলাম; গিয়ে জানলাম, জানব আর কী, একটু আগেই উনি টিফিন করতে বেরিয়েছেন।’
‘ও!’ আমি বলি। একই গল্পের অপরার্ধ আত্মপ্রকাশ করে আমার ওকারের মতো গোলাকার হয়ে দেখা দেয়।
‘তারপর উনি যখন বাড়ি ফিরলেন’—বলতে বলতে শেফালি হেসে গড়িয়ে পড়ল—‘দেখলাম উনি ফুলের বাজার সবটা উজাড় করে নিয়ে এসেছেন—’
‘ফুলস প্যারাডাইস—!’ আমি বলি।
‘এবং যথাসময়ে যথাস্থানে অপেক্ষা না করার জন্যে সেকী মার্জনাভিক্ষা! ভদ্রলোক এমন কাতরাতে লাগলেন যে, তাঁকে সান্ত্বনাদানের জন্যেই বাধ্য হয়ে আমায়—’
‘বুঝেচি। মানে, মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা বসিয়েছিস। বেচারাকে সেই কাহিল অবস্থায় পেয়ে ওর পকেট ফাঁক করে ঝেড়ে-ঝুড়ে বেবাক বের করে নিয়েছিস। পরিষ্কার করে—এই তো?’ তীক্ষ্ণকন্ঠে আমি বলি, ‘আমার মতো উচ্চমনা লোকের বোন হয়ে যে একাজ করতে পারলি এই ভেবে আমার ঘাড় হেঁট হচ্ছে। মাসতুতো ভাইরা চোর হয় বলে শুনেচি কিন্তু তাই বলে কি মাসতুতো বোনদের ডাকাত হতে হবে? ছি:! ছলনা ছাড়া কী এ?’
‘ছলনা কি প্রতারণা তা আমি জানিনে।’ শেফালি ঝংকার দিয়ে ওঠে—‘আমার ধারণায় আমি ঠিকই করেছি। উচিত দন্ডই ওঁর হয়েছে। যদি দেখা যায় ঠিকঠাক করে যথাস্থানে দেখা করতে ভুলে যেতেন সেই তো এক খারাপ হত—ভীষণ খারাপ হত বলতে গেলে। কিন্তু যখন দেখা করবার কোনো কথাই নেই, এই কথাটাও উনি ভুলতে পেরেছেন তখন—বুঝতেই পারা যাচ্ছে ওঁর হৃদয়ে আমার কতটুকু স্থান! উঃ, এমন লাঞ্ছনা—এতখানি দুঃখ জীবনে আমি কখনো পাইনি।’
শেফালির কলকল কন্ঠ, ওর দুই চোখ ছাপিয়ে ছলছল করে ওঠে। বলতে না বলতে।
Post a Comment