ত্রিশূলে রক্তের দাগ – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

ত্রিশূলে রক্তের দাগ – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

সম্প্রতি চিৎপুর এলাকায় আন্তর্জাতিক চোরাচালানীচক্রের কার্যকলাপ ফাঁস হাওয়ার ঘটনা সব কাগজে বেরিয়েছিল। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার পক্ষ থেকে এর একটা ফলোআপ সংগ্রহের জন্যে বেরিয়ে ট্রাফিক জ্যামে আটকে গেলাম। ঘিঞ্জি রাস্তা। বেলাও পড়ে এসেছিল। তার ওপর ঠিক এই সময়টাতেই লোডশেডিং। বিরক্ত হয়ে গাড়িতে বসে সিগারেট টানতে টানতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখছিলাম, আর এই অব্যবস্থার জন্যে ট্রাফিক পুলিশদেরই দায়ী করছিলাম। লরি বা ট্রাকের প্রতি তাদের মাত্রাতিরিক্ত মনোযোগ যে অনেক সময় জ্যামবিভ্রাট বাধায়, তাতে কোনও ভুল নেই।

বাঁ পাশে বসে থাকার ফলে পরপর কয়েকটা হার্ডওয়্যার স্টোর্স, যাত্রা, থিয়েটারের পোশাকের দোকান, এবং তার মাঝখানে একটা বইয়ের দোকান চোখে পড়ল। আনন্দময়ী পুস্তক ভাণ্ডার। নিশ্চয় সুখ্যাত বটতলা প্রকাশনের ঐতিহ্যসম্পন্ন দোকান। সামনের শোকেসে যাত্রানাটক, কৃত্তিবাসী রামায়ণ, কাশীদাসী মহাভারত, প্রভাস খণ্ড, বৃহৎ তন্ত্রসার ইত্যাদি টাইটেল সাজানো ছিল। আলো কম হলেও, আমার দৃষ্টিশক্তি মোটামুটি ভালই। তাছাড়া পঞ্জিকার পাতায় এমন বইয়ের বিজ্ঞাপন আমাকে আকৃষ্ট করে। এইসব দোকান যেন এক রহস্যময় পৃথিবীর তথ্যে ভরা। বশীকরণতন্ত্র ডাকিনীতন্ত্র, ভোজবিদ্যা কামাখ্যাতন্ত্র…এক আশ্চর্য অন্ধকার মায়ালোকের দিকে অঙ্গুলিসঙ্কেত করে যেন।

হঠাৎ হকচকিয়ে গেলাম। এক সৌম্যকান্তি বৃদ্ধ আনন্দময়ী পুস্তক ভাণ্ডার থেকে বেরোলেন। তার হাতে লাল মলাটের একটা বই। তার মাথায় ধুসর টুপি, মুখের সাদা দাড়ি, এবং বাঁ হাতে একটা বিদঘুটে গড়নের যষ্ঠি। ফুটপাতে নেমেই তিনি কয়েক পা এগিয়ে অন্য একটা দোকানে ঢুকলেন। এ দোকানটার সাইন বোর্ডে লেখা আছে : আর দাশ অ্যাণ্ড কোং। যাত্রা-থিয়েটারের যাবতীয় পোশাক, স্টেজ, সিন সুলভে ভাড়া পাওয়া যায়। পরীক্ষা প্রার্থনীয়।

হ্যাল্লো ওল্ড ডাভ বলে অভ্যাসমতো চেঁচিয়ে ডাকার কথা স্রেফ ভুলে গিয়েছিলাম, কারণ এই ধুরন্ধর বৃদ্ধকে এখানে দেখতে পাওয়ার কথা কল্পনাও করিনি। গতকাল উনি ফোনে জানিয়েছিলেন, এক জার্মান উদ্ভিদবিজ্ঞানীর সঙ্গে নেপাল রওনা হচ্ছেন–আমার সঙ্গদান সম্ভব কি না। বলা নিষ্প্রয়োজন, এ আমন্ত্রণ একটা ছুতোনাতা করে এড়িয়ে গিয়েছিলাম। নেপাল যত সুন্দর দেশ হোক দুষ্প্রাপ্য প্রজাতির অর্কিডের তল্লাসে পাহাড়-জঙ্গলে টো টো করে ঘোরা আমার ধাতে সইবে না।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, যে কোনও কারণে হোক, ওঁর নেপাল যাওয়া হয় নি।

হয়নি কিন্তু এই এবেলায় চিৎপুরে কী করছেন? বটতলার বই কেনারই বা উদ্দেশ্য কী? আর যাত্রা-থিয়েটারের পোশাকের দোকানেই বা কেন ঢুকলেন? রহস্যের গন্ধ পেলাম। ভাবলাম, নেমে গিয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করি। কিন্তু সেই মুহূর্তে ট্রাফিকজট কোনও যাদুবলে খুলে গেল। আমাদের গাড়ির বাঁ দিকে ইতিমধ্যে কয়েকটা রিকশো, ঠেলা, টেম্পো ঢুকে পড়েছিল। জট ছাড়লে স্বভাবত হল্লা আর যানবাহনের গর্জনও প্রচণ্ডভাবে বেড়ে যায়। আমার ডাক উনি শুনতে পেতেন না।

অফিসে গিয়ে ব্যাপরটা ভাবছিলাম। আর দাশ অ্যাণ্ড কোম্পানির দোকানে ঢুকে , কি ছদ্মবেশ ধরার জিনিসপত্র কিনছিলেন কর্নেল নীলাদ্রি সরকার? কিছু কি ঘটেছে, কোথাও? নাকি সম্প্রতি ফঁস-হয়ে-যাওয়া আন্তর্জাতিক চোরাচালানচক্রের সঙ্গে ওঁর এই কাজকর্মের কোনও সংস্রব আছে?

রাত আটটায় অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা ইলিয়ট রোডে সানি লজ নামে বিশাল বাড়িটির তিনতলায় হানা দিলাম। দরজা খুলে ষষ্ঠীচরণ জনান্তিকে জানাল, বাবুমশাই আসনে বসে জপ করছেন। অবাক হয়ে ভেতরের ড্রইংরুমে ঢুকে দেখি, কতকটা তাই বটে। আমার বৃদ্ধ বন্ধু ডিভানে আসন করে বসে সেই বটতলার লাল মলাটের বইটি পড়ছেন। ঠোঁটদুটো কাঁপছে। তার মানে, উচ্চারণ করেই পড়ছেন। আমার সাড়া পেয়ে চোখ কটমটিয়ে হুংকৃত স্বরে বলে উঠলেন, ওঁং হ্রীং ক্রীং জয়ন্তং মারয়ঃ মারয়ঃ তাড়য়ঃ ফট ফট স্বাহা।

একটু ভড়কে গিয়ে বললাম, সর্বনাশ! এ আবার কী?

কর্নেল হো হো করে হেসে ডিভান থেকে নেমে আমার হাতে বইটা খুঁজে দিলেন। লাল মলাটের ওপর সোনালী হরফে লেখা আছে ডাকিনীতন্ত্র। শ্রী হরিশরণ শর্মা তন্ত্ৰার্ণব সিদ্ধাচার্য কতৃক সংগৃহীত। পাতা উল্টে দেখি, ভূমিকায় বলা হয়েছে, এই গুপ্ত তন্ত্র আসামের কামরূপ অঞ্চলের পর্বত-অরণ্যে বহু বৎসর ভ্রমণ করিয়া সিদ্ধাই ডাকিনীগণের নিকট হইতে সংগৃহীত। তন্ত্ৰাৰ্ণব শ্রীহরিশরণ শর্মা মহাশয় বহুবার একচুলের জন্য বাঁচিয়া গিয়াছে। সাধক পাঠকবর্গের জ্ঞাতার্থে উল্লেখ করি যে বাৎসরাধিক কাল তাহাকে ডাকিনীগণ মন্ত্রবলে মেষশাবকে রূপান্তরিত করিয়াছিল। দেবী কামাখ্যার করুণায় তিনি মনুষ্যদেহ পুনঃপ্রাপ্ত হন।…

বললাম, এই গাঁজা কেনার জন্যে আজ বিকেলে চিৎপুরে আনন্দময়ী পুস্তক। ভাণ্ডারে ঢুকেছিলেন।

হুঁ–তুমি তোমাদের প্রেসমার্কা কালো গাড়িতে বসে লোলুপ দৃষ্টে শো-কেসের বইগুলি দেখছিলে বটে!

ঠিক ঠিক। তারপর আপনি আর দাশ অ্যাণ্ড কোংয়ের দোকানে ঢুকলেন ছদ্মবেশ কিনতে। কই, দেখি, কী কিনলেন?

কর্নেল মাথা নেড়ে বললেন, আমি কি বুড়োবয়সে যাত্রাদলে নাম লেখাব ভাবছ?

যাত্রাদলে ঢুকলে পোশাক নিজেকে কিনতে হয় না। নিশ্চয় ছদ্মবেশ ধরার দরকার হয়েছে আপনার। তা এক কাজ করলেই তো পারেন। গোঁফদাড়ি সাফ, করে ফেললেই হল। কেউ আর প্রখ্যাত কর্নেল নীলাদ্রি সরকারকে চিনতে পারবে না। অবশ্য মাথার টাকটি অতি প্রসিদ্ধ। কিন্তু তার জন্য টুপিই যথেষ্ট।

ষষ্ঠীচরণ কফি রেখে গেল। কফি খেতে খেতে কর্নেল বললেন, তুমি তো এ যাবৎ দেখেছ ডার্লিং, আমি কদাচ ছদ্মবেশ ধরি না। ছদ্মবেশ ব্যাপারটা বড় বাজে। ওর ভেতর প্রচুর পোকা থাকে। আসলে মাথার ভেতরকার কোমল সারপদার্থকে ঠিক মত কাজে লাগাতে পারলেই হল। চাই শুধু কিছু তথ্য-সঠিক, অকপট তথ্য। সত্যকে আবিষ্কারের জন্য আমি তাই ডিডাকটিভ পদ্ধতির পক্ষপাতী। আগে সিদ্ধান্ত পরে তথ্য সংগ্রহ নয়, আগে তথ্য সংগ্রহ পরে সিদ্ধান্ত।

বললাম, বেশ। আপনারই ডিডাকটিভ পদ্ধতি অনুসারে গতকাল থেকে এ পর্যন্ত আপনার ক্রিয়াকলাপের যে তথ্য পাচ্ছি, তা থেকে সিদ্ধান্ত করা যায় যে আপনার নেপালযাত্রা বরবাদ করার মতো একটি ঘটনা ঘটেছে এবং সেই ঘটনার সূত্রে আজ বিকেলে আপনাকে চিৎপুরে গিয়ে…।

হাত তুলে বাধা দিয়ে সহাস্যে গোয়েন্দাপ্রবর বললেন, এনাফ জয়ন্ত, এনাফ। কিন্তু আমি অবাক হচ্ছিযে তুমি কাগজের লোক হয়েও কাগজ পড় না।

ময়রার সন্দেশে রুচি থাকে না। কিন্তু কাগজে কী বেরিয়েছে? চিৎপুরের আন্তর্জাতিক চোরাচালানীচক্রের খবর তো? যতদূর জানি, লালবাজারের তরুণ গোয়েন্দাকর্তা আপনাকে এতে নাক গলাতে দেবেন না। কারণ, আপনি এসব ব্যাপারে যুক্ত হলে তার কৃতিত্ব প্রদর্শনের সুযোগ মিলবে না।

কর্নেল কফির পেয়ালা রেখে চুরুট ধরালেন। তারপর মৃদু হেসে চোখ নাচিয়ে বললেন, চলো ডার্লিং, আগামীকাল একবার ভৈরবগড় ঘুরে আসি।

ভৈরবগড়! নড়ে বসলাম। মাই গুডনেস! মনে পড়ে গেছে। আসলে এসব খবর চোখের কোণা দিয়ে ছুঁয়ে দেখার মত। তাছাড়া দেশজুড়ে প্রতিদিন অসংখ্য খুনোখুনি হচ্ছে। কিন্তু ভৈরবগড়..কর্নেল! ভৈরবগড়ে গোটা দুতিন খুন হয়েছে তার জন্য নেপাল-যাত্রা পণ্ড করে আপনার চিৎপুরে যাত্রার তাৎপর্য মাথায় ঢুকছে না? মফস্বলে দলাদলি আজকাল বেড়ে গেছে। দলে দলে সংঘর্ষ আকছার হচ্ছে। কাজেই এ খুনোখুনিতে রহস্য কিসের?

কর্নেল বললেন, আছে। তুমি তৈরি থেক–আগামীকাল সকাল নটায় ট্রেন।

.

০২.

ভৈরবগড় বর্ধমানের সীমান্তে খনি অঞ্চলের একটি বনেদী জনপদ। গ্রাম-শহরের অদ্ভুত সংমিশ্রণ। চারদিকে অসমতল রুক্ষ মাটির বিস্তার। গাছপালা স্বভাবত কম। এদিকে ওদিকে কিছু পোড়ো এবং চালুখনি রয়েছে। বেশির ভাগই কয়লাখনি, কয়েকটা অভ্র খনিও আছে। তবে ভৈরবগড়ের উল্লেখযোগ্য পুরাকীর্তিও কম নয়। বিশেষ করে পাঁচশো বছরের বাবা ভৈরবের বিশাল মন্দিরটা।

ট্রেনে যেতে যেতে গোয়েন্দাপ্রবর আমাকে ভৈরবগড়ের ভূপ্রকৃতির এই সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে বললেন, আজ ১১ মার্চ মঙ্গলবার। গত ৭ মার্চ শুক্রবার সকালে ভৈরবমন্দিরের চত্বরে মহেশ্বর ত্রিপাঠী নামে এক ব্যবসায়ীর লাশ পাওয়া যায়। মহেশ্বরবাবু নির্বিরোধ মানুষ ছিলেন। স্থানীয় অসংখ্য প্রতিষ্ঠানে প্রচুর টাকাকড়ি সাহায্য করতেন। কাজেই তার জনপ্রিয়তাও ছিল। এমন মানুষকে কেউ খুন করবে, ভাবা যায় না। রাত্রিবেলা মন্দিরেই বা কেন তিনি গিয়েছিলেন, পুলিস তদন্ত করে প্রথমে জানতে পারেনি। পরে জেনেছে ৬ মার্চ বৃহস্পতিবার এক তান্ত্রিক সাধুবাবা, নাকি তার বাড়ি গিয়েছিলেন। কিন্তু তন্নতন্ন খুঁজে সেই সাধুবাবার পাত্তা আর মেলেনি।

জিজ্ঞেস করলাম, খুন করা হয়েছিল কীভাবে?

মহেশবাবুর পিঠের দিকে হার্টের পেছনে সমান ব্যবধানে তিনটি গভীর ক্ষতচিহ্ন ছিল। সম্ভবত বসে থাকা অবস্থায় অতর্কিতে তাকে পেছন থেকে আঘাত করা হয়। কর্নেল ট্রেনের জানালার দিকে চোখ রেখে বললেন, পরবর্তী হত্যাকাণ্ড ঘটে ঠিক পরদিনই–শনিবার। একই জায়গায় একই অবস্থায় পাওয়া যায় নবারুণ ভদ্র নামে একজন রিটায়ার্ড খনি-ইঞ্জিনীয়ারের লাশ। এক্ষেত্রেও আগের দিন নবারুণবাবুর কোয়ার্টারে সেই সাধুবাবা এসেছিলেন। কিছুক্ষণ গোপনে দুজনের মধ্যে নাকি কী কথাবার্তা হয়নবারুণবাবুর স্ত্রীর কাছে পুলিশ এটুকু জানতে পেরেছে। সাধুবাবাকে যে মহেশ্বরবাবুর খুনের ব্যাপারে পুলিশ খুঁজছে, নবারুণবাবুর স্ত্রী বা নবারুণবাবুও তা জানতেন না। বাড়িতে ওই সময় আর কেউ ছিল না। এর পর যেটুকু জানা গেছে, তা হল : দুজনেই আসছি বলে বাড়ি থেকে আন্দাজ সন্ধ্যা সাতটায় বেরিয়ে যান। আর ফেরেন নি।

কর্নেল চুপ করলে বললাম, তন্ত্রসাধনায় নরবলির কথা শুনেছি। এ তো দেখছি তাই।

গতকাল বর্ধমানের পুলিসসুপারের ট্রাঙ্ককল পেলাম–তখন সবে নেপাল যাত্রার জন্য তৈরি হচ্ছি। ভৈরবমন্দিরের একই জায়গায় একই ভাবে পাওয়া গেছে। ভবেশ মজুমদার নামে আর একজন ব্যবসায়ীর লাশ। বসে থাকা অবস্থায় খুন। পিঠে তিনটি গভীর ক্ষতচিহ্ন। এবারও জানা গেছে, আগের দিন এক সাধুবাবা এসেছিলেন ভবেশবাবুর কাছে। তিনিও আসছি বলে সন্ধ্যা ছটায় বেরিয়ে যান। এবারও ভবেশবাবু বা কেউ জানতেন না, সাধুবাবাকে পুলিস খুঁজছে। তাই গতকাল সঙ্গে সঙ্গে পুলিস তেঁড়রা পিটিয়ে ঘোষণা করেছে, ঢ্যাঙা, রোগা গড়নের কোনও লাল কৌপিন ও জটাধারী সাধুবাবাকে দেখলেই যেন জনসাধারণ পুলিশে খবর দেন। বলার দরকার নেই, এলাকার সব সাধু গা-ঢাকা দিয়েছেন। কেউ কেউ জনতার হাতে প্রচণ্ড মারধরও খেয়েছেন। কিন্তু পুলিশ যাকে খুঁজছে, তাঁরা কেউই তিনি নন। নিহতদের বাড়ির লোকের সাক্ষ্যে সেটা বোঝা গেছে। তবু ভুল হতেও তো পারে। জনাতিনেক সাধু ভৈরবগড় হাসপাতালে এখন আহত অবস্থায় রয়েছেন। আজ দুপুরে ফের এসপি ট্রাঙ্ককল করে এসব কথা জানিয়েছেন।

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে গম্ভীর মুখে টানতে থাকলেন। বললাম, পুলিস ঢেঁড়রা পিটিয়ে ভুল করেছে।

তুমি ঠিকই বলেছ, জয়ন্ত। কর্নেল একটু হাসলেন। পুলিস অনেক সময় একটু বেশি উৎসাহ দেখিয়ে বসে। তবে এই তিনটি অদ্ভুত হত্যাকাণ্ডের আরও একটি অদ্ভুত ধরনের কমন ব্যাপার আছে। সেটা পরে লোকের চোখে পড়েছে। ভৈরবমন্দিরের, চূড়ায় অন্তত পঁচিশ-তিরিশ ফুট উঁচুতে একটা ত্রিশূল আছে। প্রতিবার হত্যাকাণ্ডের পর সেই ত্রিশুলের গায়ে রক্ত দেখা যাচ্ছে কয়েকপোঁচ। জ্বলজ্বলে টাটকা রক্ত। কাছের একটা খনি থেকে ফায়ারব্রিগেড আনিয়ে পুলিশ ত্রিশূলের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে কলকাতায় বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠিয়েছে। মানুষের রক্ত হলে সত্যি বড় রহস্যময় ঘটনা বলতে হয়। এত উঁচুতে কেউ উঠে রক্ত মাখিয়ে আসবে, এ তো অসম্ভব! মোচার আকৃতি মন্দিরচূড়া পাথরে তৈরি এবং ভীষণ পিছল। অত উঁচু মই কার আছে?

কর্নেল! তাহলে বেশ বোঝা যাচ্ছে, হত্যার অস্ত্র ত্রিশূল ছাড়া কিছু নয়। তিনটে সমান ব্যবধানে ক্ষতচিহ্ন, একমাত্র ত্রিশূলই সৃষ্টি করতে পারে।

ঠিক ঠিক। বলে কর্নেল ঘাড় নাড়লেন। তারপর গলায় ঝুলন্ত বাইনোকুলার চোখে রেখে টেলিগ্রাফের তারে পাখি দেখতে থাকলেন। পাখিটা দ্রুত পিছিয়ে পড়ল। তখন উনি জানালায় ঝুঁকে গেলেন। পাখি দেখলেই আমার এই বাতিকগ্রস্ত বন্ধুটির ঘিলু যেন গলে যায়। জ্ঞানগম্যি আর থাকে না।….

সরকারী বাংলোটা ভৈরবগড়ের শেষপ্রান্তে! দক্ষিণে সামান্য দূরে জি.টিবোড়। পূর্বদিকে বেশ কিছুটা দূরে ভৈরবমন্দিরের চূড়া দেখা যাচ্ছিল। বিকেলে পৌঁছে খাওয়া-দাওয়ার পর লনে বসেছিলাম। আমার বৃদ্ধ বন্ধু হঠাৎ উঠে গেলেন। তারপর বরাবর যা দেখেছি, তাই দেখতে পেলাম। চোখে বাইনোকুলার রেখে উনি পূর্বের অনাবাদী মাঠে হনহন করে হেঁটে চলেছেন। ওঁর লক্ষ্যবস্তু পাখি যদি হয়, তাহলে সে-পাখি কোনও গাছের নয়। কারণ ওদিকে কোনও গাছই নেই। একটু পরে একটা ঢিবির আড়ালে ওঁর ধূসর রঙের টুপিটা অদৃশ্য হলে ঘরে ঢুকে সটান শুয়ে পড়লাম। ট্রেনজার্নির ক্লান্তি ছিল।

সন্ধ্যার পর গোয়েন্দাপ্রবর ফিরে এসে আমাকে ঘুম ভাঙিয়ে অকালনিদ্রার জন্যে মৃদু ভৎর্সনা করলেন। তারপর বললেন, যাই হোক, অনেকখানি ঘোরাঘুরি করা গেল। ভৈরবমন্দির দর্শন করলাম। তারপর গেলাম রাজবাড়ি দর্শনে। রাজত্ব না থাকতে পারে, রাজা এখনও আছেন। গতবার এ তল্লাটে এসে ওঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। কাল সকালে আমাদের দুজনেরই ওখানে নেমন্তন্ন বড় অমায়িক মানুষ। আমার মতো নানারকম খেয়াল আছে ওঁর। বাড়িতে একটা চিড়িয়াখানা গড়ে তুলেছেন। কয়েক রকম জন্তুজানোয়ার আর পাখি আছে। গিয়ে দেখবেখন।

চৌকিদার চা দিয়ে গেল। চা খেতে খেতে বললাম, বাইনোকুলারে কী দেখছিলেন মাঠে?

ঘুঘু পাখির একটা ঝাঁক। এই লাল রঙের ঘুঘু পাখিরা ঝাঁক বেঁধে থাকে। এদের…

কথায় বাধা পড়ল। বাইরে কেউ ভরাট গলায় বলল, আসতে পারি কর্নেল?

কর্নেল ঘুরে সহাস্যে বললেন, আরে আসুন, আসুন মিস্টার সিনহা। আপনারই অপেক্ষায় ছিলাম।

একজন প্রকাণ্ড আকৃতির পুলিস অফিসার ঘরে ঢুকলেন। আলাপ-পরিচয় হল। যদুপতি সিনহা। এখানকার থানার অফিসার-ইন-চার্জ। একথা ওকথার পর বললেন, আপনার কথা সত্য কর্নেল! মহেশ্বরবাবু, নবারুণবাবু আর ভবেশবাবু প্রত্যেকের বসার ঘরে এককপি করে ডাকিনীতন্ত্র পাওয়া গেছে। এই দেখুন। তিনটে বই-ই এনেছি।

এই বইটাই কর্নেল চিৎপুর থেকে কিনেছেন। কর্নেল বইগুলোর পাতা উল্টে দেখার পর একটু হেসে বললেন, আনন্দময়ী পুস্তকভাণ্ডার থেকে গত ৫ মার্চ এক ভদ্রলোক একসঙ্গে ৭ কপি ডাকিনীতন্ত্র কিনেছিলেন। পাশের আর দাশ অ্যাণ্ড কোংয়ের দোকান তেকে তিনিই কেনেন একটা জটাচুল, একটা কমণ্ডলু, একটা ত্রিশূল আর কাপালিক সাধুর কাপড়চোপড়। চেহারার বর্ণনা থেকে বুঝতে পেরেছি একই লোক।

যদুপতিবাবু বললেন, চেহারার বর্ণনাটা শোনা যাক একটু।

লম্বাটে গড়ন। মোটা নাক। মাথায় আমার মত টাক।

কিন্তু সাধুবাবার বর্ণনার সঙ্গে তো ঠিক মিলছে না। সাধুবাবাকে যারা দেখেছেন, তারা বলছেন ঢ্যাঙা রোগা গড়ন। লম্বা ধারালো নাক।

নাক লম্বা আর ধারালো হওয়াটাই সুবিধেজনক। কর্নেল হাসলেন। তারপর চৌকিদারকে ডেকে যদুবাবুর জন্যে একটা খালি কাপ আনতে বললেন।

চৌকিদার কাপ দিয়ে গেল! কর্নেল পট থেকে চা ঢেলে সযত্নে যদুপতিবাবুর জন্যে চা তৈরি করে বললেন, ত্রিশুলের রক্তের রিপোর্ট কি এসেছে মিস্টার সিনহা?

যদুপতিবাবু বললেন এসেছে। ফোরেনসিক বিশেজ্ঞরা পরীক্ষা করে বলেছেন, মানুষেরই রক্ত।

আমি চমকে উঠলাম। গায়ে কাঁটা দিল। কর্নেল যদুপতিবাবুর দিকে নিষ্পলক চোখে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকার পর বললেন, বিকেলে ভৈরবমন্দিরে গিয়েছিলাম। মন্দিরের চূড়ার গড়ন মোচার মত। একেবারে খাড়া উঠে গেছে অন্তত কুড়িবাইশ · ফুট উচ্চতা তো বটেই। তার ডগায় ত্রিশূল বসানো আছে। মন্দিরের মূল দেয়ালের উচ্চতাও প্রায় দশ-বারো ফুটের কম নয়। যদি না কেউ মূল দেয়ালের অংশটুকুতে উঠতে পারে মোচার মত চূড়ার অংশে উঠবে কিভাবে? ভীষণ পিচ্ছিল আর খাড়া।

যদুপতিবাবু বললেন, কেন? বাঁশের মই দিয়েও ওঠা যায়।

কর্নেল মাথা নাড়লেন। তাহলে মইয়ের গোড়া নিচের মাটিতে দুটো ছাপ রাখবে। মাটিটা পুত্থানুপুঙ্খ পরীক্ষা করেছি বিশেষ ধরনের আতশ কাচ দিয়ে। কোনও ছাপ নেই। দ্বিতীয়ত, মইয়ের ডগাও চূড়ার ওপর দুটো ছাপ ফেলবে। বাইনোকুলারের সাহায্যে তাও খুঁটিয়ে দেখেছি। দুটো ছাপ চূড়ায় শেষপ্রান্তে ত্রিশূলের ঠিক নিচেই আছে। কিন্তু ওটা নিশ্চয় ফায়ারব্রিগেডের মইয়ের ডগার ছাপ। ত্রিশূলের রক্তের নমুনা নেওয়ার সময় আপনারা ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি এনেছিলেন। ফায়ার ব্রিগেডের মই গাড়ির সঙ্গে ফিট করা থাকে। তাই নিচের মাটিতে মইয়ের দাগ পাইনি।

যদুপতিবাবু হাসলেন। পুলিসোচিত ভঙ্গিতে চোখ নাচিয়ে বললেন, জাস্ট আপনার ওপিনিয়ন নিলাম। আমরাও ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখেছি, কর্নেল! মানুষের রক্ত ত্রিশুলে লেগে থাকার কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। তবে ভৈরবমন্দিরের ট্রাডিশন কিন্তু সাংঘাতিক। শুনেছি, প্রাচীনকালে শিবচতুর্দশীর রাতে শিবলিঙ্গে জলের বদলে মানুষের রক্ত ঢালা হত। আর এই কাপালিক সাধুরাও আসলে হোমিসাইডাল ম্যানিয়াক। তা না হলে নরবলি দিতে পারে, বলুন?

কর্নেল বললেন, এক্ষেত্রে কিন্তু নরবলি দেওয়া হয়নি। মন্দির প্রাঙ্গণে হাড়িকাঠ আছে। তা সত্ত্বেও ভিকটিমদের মুণ্ডু কাটা হয়নি। পিঠে ত্রিশূল বিঁধিয়ে মারা হয়েছে।

তান্ত্রিক ব্যাপার। এ হয়তো কামাখ্যার ডাকিনীতন্ত্রের মতে আলাদা পদ্ধতিতে বলিদান।

যদুপতিবাবু হো হো করে হাসতে লাগলেন। কর্নেল বইগুলোর পাতা ওল্টাচ্ছিলেন। বললেন, আশ্চর্য তো! প্রতিটা বইয়ের মারণতন্ত্র অংশটা আণ্ডার লাইন করা দেখছি।

যদুপতিবাবু মন্তব্য করলেন, ধাঁধার পর ধাঁধা! ত্রিশূলে মানুষের রক্তও ব্যাপারটাকে অলৌকিক করে তুলেছে।

কর্নেল বললেন, সাধুর কথায় মহেশ্বর ত্রিপাঠী না হয় মারণতন্ত্র জপতে রাত্রিবেলা মন্দিরে গেলেন। কিন্তু তার পরিণতি দেখে পরবর্তী ভিকটিম নবারুণবাবু কেন ভয় পেলেন না বা তার মনে সন্দেহ জাগল না এবং তিনিও মন্দিরে গেলেন? তারপর দেখুন তৃতীয় ভিকটিম ভবেশবাবুও ঠিক তাই করলেন। বড় অদ্ভুত!

যদুপতিবাবু দুলতে দুলতে বললেন, মানুষ যত শিক্ষিত হোক, কুসংস্কার বড় কঠিন রোগ কর্নেল!

এই সময় আরেকজন পুলিশ অফিসার এলেন। পরিচয়ে জানলাম, ইনি আই বি দারোগা খগেন্দ্র বিশ্বাস। গম্ভীর মুখে বললেন, জরুরি খবর আছে স্যার। বিকেল চারটে নাগাদ রঞ্জন আঢ্যির বাড়িতে সেই সাধু এসেছিলেন। সাধুকে বসতে বলে, রঞ্জনবাবু ভেতরের ঘরে গিয়ে থানায় ফোন করেন। আমরা ছুটে যাই–আপনি তখন বাইরে ছিলেন। রঞ্জনবাবুর বাড়ি গিয়ে সাধুকে পাইনি। রঞ্জনবাবু ফোন করে গিয়ে দেখেন, সাধু নেই। সম্ভবত ব্যাপারটা আঁচ করে কেটে পড়েছিল।

কর্নেল বললেন, সাধুবাবা রঞ্জনবাবুকে কী বলছিলেন?

খগেন্দ্রবাবু বললেন, এককপি ডাকিনীতন্ত্র কিনতে পীড়াপীড়ি করছিলেন।

আর কিছু?

না স্যার! রঞ্জনবাবু বললেন, এছাড়া আর কিছু বলেননি সাধু। কিন্তু ফোন করে এসে রঞ্জনবাবু দেখেন, এককপি ডাকিনীতন্ত্র বসার ঘরে পড়ে রয়েছে। পাতা উল্টে দেখেছি, মারণমন্ত্রের তলায় ডটপেন দিয়ে আণ্ডার লাইন করা।

রঞ্জনবাবু এখন কোথায়?

বাড়িতেই থাকার কথা। ওঁর বাড়িতে আর্মড গার্ড মোতায়েন করেছি। ওঁকে বেরোতেও নিষেধ করেছি।

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। এখনই রঞ্জনবাবুর কাছে যাওয়া দরকার। ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই। চলুন মিস্টার সিনহা। জয়ন্ত, তুমিও এস।

বাইরে জীপ দাঁড় করানো ছিল। যদুপতিবাবু ড্রাইভ করছিলেন। আলো-আঁধারি আঁকাবাঁকা রাস্তায় এগিয়ে বাজার এলাকায় ঢোকার মুখে হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে গেল। যদুপতিবাবু অস্ফুট স্বরে বিরক্তি প্রকাশ করলেন।

অনেক গলিঘুজি ঘুরে একস্থানে জীপ দাঁড়াল। সামনে একটা দোতলা নতুন বাড়ির বারান্দায় হ্যাঁজাক জ্বলছিল। বেঞ্চে দুজন সশস্ত্র কনস্টেবল বসেছিল। তারা উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট ঠুকল। বাড়িটা নিঃঝুম কেন বুঝতে পারলাম না। যদুপতিবাবু জিজ্ঞেস করলেন, রঞ্জনবাবু বেরোননি তো?

একজন কনস্টেবল মাথা নেড়ে বলল, না স্যার! কিছুক্ষণ আগেও ভেতরে ওঁর। গলা শুনেছি।

দরজার কড়া নাড়লে হেরিকেন হাতে একটি লোক জানালা খুলে প্রথমে আমাদের দেখে নিল, তারপর দরজা খুলল। বুঝলাম, রঞ্জনবাবু খুব সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। যদুপতিবাবু বললেন, তোমার মনিবকে খবর দাও হে! বলল, আমরা এসেছি।

লোকটি বলল আজ্ঞে হুজুর, বাবু তো নেই!

আমরা চমকে উঠলাম। খগেন্দ্র বিশ্বাস চোখ কটমটিয়ে বললেন, নেই মানে?

ভেতর দিকের দরজার পর্দা তুলে বিবর্ণ মুখে এক প্রৌঢ়া ভদ্রমহিলা বললেন, ঘণ্টাখানেক আগে ফোন বাজল। দাদা ফোন ধরল। কী কথাবার্তা হল। তারপর দাদা ব্যস্ত হয়ে খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। বলল, এক্ষুণি আসছি। জরুরি কাজ আছে। আমি নিষেধ করলাম, শুনল না। আর বৌদি তো শয্যাশায়ী।

কর্নেল শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলে উঠলেন, মিস্টার সিনহা। এখনই ভৈরবমন্দিরে যাওয়া দরকার। শীগগির!

আবার আমরা জীপে উঠলাম। অন্ধকার ঘোরালো সঙ্কীর্ণ রাস্তায় জীপ ছুটে চলল প্রচণ্ড গতিতে। মিনিট পনেরো পরে যখন থামল, জীপের হেডলাইটের আলোয় বিশাল এবং জরাজীর্ণ এক মন্দিরের ফটক দেখতে পেলাম। আবছা আলোয় ডাইনে-বাঁয়ে ধ্বংসস্তূপ আর আগাছার জঙ্গলও চোখে পড়ল।

টর্চ জ্বেলে মন্দিরের ফটক পেরিয়ে আমরা প্রাঙ্গণে ঢুকলাম। তারপর সবাই থমকে দাঁড়ালাম। প্রাঙ্গণে ফুট তিনেক উঁচু একটা চত্বরের ওপর পা মুড়ে আসনে বসা অবস্থায় কেউ মুসলিমদের নমাজ পড়ার ভঙ্গিতে উবু হয়ে রয়েছে। মাথাটা ঝুঁকে মাটিতে ঠেকেছে। সবার আগে চত্বরে উঠলেন কর্নেল। বললেন, হুঁ–যা ভাবছিলাম।

খগেনবাবু ক্ষুব্ধস্বরে বললেন, বোকা! বোকা! অত করে বললাম ভদ্রলোককে।

যদুপতিবাবু চারধারে টর্চের আলো ফেলছিলেন। বললেন, বিশ্বাস? জীপ নিয়ে যাও। অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এস সঙ্গে।

কর্নেল ঝুঁকে টর্চের আলোয় হতভাগ্য লোকটিকে দেখছিলেন। পিঠে তিনটি ক্ষতচিহ্ন। রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। কর্নেল বললেন, মারা গেছেন সঙ্গে সঙ্গে। খুনী শরীরের ভাইটাল পয়েন্টগুলো ভালই জানে।

এদিন আমার বৃদ্ধ বন্ধুকে অস্বাভাবিক গম্ভীর এবং অতিমাত্রায় ব্যস্ত থাকতে দেখছিলাম। আমার কোনও প্রশ্নের জবাব দেননি। যেন আমার কথা ওঁর কানে ঢুকছিল না। গতিক দেখে মুখ বন্ধ করেছিলাম। চুপচাপ দেখে যাচ্ছিলাম ওঁর ক্রিয়াকলাপ।

ওঁর সারাটা দিনের গতিবিধি ও ক্রিয়াকলাপ বর্ণনা করতে গেলে আরব্য উপন্যাস হয়ে যাবে। ডাইরীতে যেভাবে লিখে রেখেছিলাম, সেভাবেই সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরছি।

…সাড়ে সাতটায় কর্নেলের ডাকে নিদ্রাভঙ্গ। রাতের সেই বীভৎস ঘটনার পর মন বিভ্রান্ত। গোয়েন্দাপ্রবর অভ্যাসবশে সম্ভবত প্রাতঃভ্রমণ সেরে এসেছেন। দাড়িতে সাদা কী লেগে আছে। পাখির পালক? বিষণ্ণ হেসে ফেলে দিলেন। ভীষণ গম্ভীর হাবভাব। রাজবাড়িতে ব্রেকফাস্টের অ্যাপয়েন্টমেন্ট। রেডি হতে তাড়া দিলেন। তারপর আপন মনেই বললেন, আশ্চর্য জয়ন্ত! আজও ভৈরবমন্দিরের ত্রিশূলে রক্তের নতুন দাগ ফুটে উঠেছে। চমকে উঠলাম শুনে। এ নিশ্চয় অলৌকিক কাণ্ড।

আটটায় রাজবাড়ির গাড়ি এল। রাজবাড়ি ভৈরবমন্দিরের পেছনে। রাজবাহাদুর সুপ্রতাপ সিংহ অমায়িক মানুষ। খেতে ও খাওয়াতে ভালবাসেন। কর্নেলের মতোই প্রকৃতিবিদ্যার বাতিক আছে। কত রকম দুপ্রাপ্য অর্কিড, ক্যাকটাস, আরও বিচিত্র গাছগাছড়ার সংগ্রহ আছে। ছোট্ট একটি চিড়িয়াখানাও আছে। বেশি নেশা পায়রার। পৃথিবীর নানাদেশের পায়রা পুষেছেন। কথায় কথায় কর্নেল জানতে চাইলেন, মুসিলিটা ক্যালিটা (শব্দ দুটো এরকমই মনে হল) জাতের পায়রা আছে নাকি। রাজাবাহাদুর মুচকি হেসে চোখ নাচিয়ে বললেন, আসুন। দেখে যান। কাঠের খাঁচার সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। গম্ভীর গলায় মেঘে বলে সে কী রাজকীয় হাঁক। বাড়ি কেঁপে উঠল। উঁকি মেরে দেখি, একটা সাদা পায়রা ঝিম ধরে বসে আছে খাঁচায়। ঢ্যাঙা নোগা মত এক ভদ্রলোক এলেন। মাথায় নীল টুপি, গায়ে স্পোর্টিং গেঞ্জি, পরনে আঁটো প্যান্ট, হাতে একটা ছড়ি। এসেই গাল চুলকে বললেন, তোমাকে খবর দিতে যাচ্ছিলাম। কাল বিকেলে ওড়াবার সময় মাদীটা বেশি দুরে চলে গিয়েছিল। ভাবলাম, সন্ধ্যার মুখে ফিরে আসবে। বোমের মাথায় লাল আলোটা জ্বেলে নাড়াচাড়া করলাম। ফিরে এল না।

রাজবাহাদুর খাপ্পা হয়ে বললেন, ব্যস! গেল। টাকাকে টাকা, পরিশ্রমকে পরিশ্রম!

মেঘেন্দ্রবাবু বললেন, বাজপাখির পাল্লায় না পড়ে তো ফিরে আসবে। এতদিন ধরে ট্রেনিং দিচ্ছি। বেঁচে থাকলে ফিরতেই হবে। আর যদি নাই ফেরে, কথা দিচ্ছি–আমি এর একটা জোড়া এনে দেব।

রাজাবাহাদুর পরিচয় করিয়ে দিলেন। মেঘেন্দ্রলাল ঘোষ। ওঁর শ্যালক। একসময় সার্কাসে ছিলেন। নানা ঘাটের জল খেয়েছে জীবনে। চিরকুমার মানুষ। চেহারায় জীবনসংগ্রামের পোড়-খাওয়ার ছাপ স্পষ্ট। রাজাবাহাদুর শ্যালকের হাতে পশু পাখির দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছেন। মনে হল, শ্যালককে খুব স্নেহ করেন।

চিড়িয়াখানা থেকে ফের ড্রইংরুমে। কর্নেলের সঙ্গে রাজাবাহাদুরের পায়রা নিয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনা। তারপর এল খুনোখুনির প্রসঙ্গ। রঞ্জন আঢ্যির কথা উঠতেই রাজাবাহাদুর মুখ বিকৃত করে বললেন, ওই সুদখোরটার এমন পরিণতি স্বাভাবিক। বুঝলেন না? নকশালরা আবার অ্যাকশানে নেমেছে।

কর্নেল বললেন রঞ্জন আঢ্যি সুদখোর নাকি?

হ্যাঁ। তাছাড়া যে কটা লোক মারা পড়েছে, সব কটাই সুদখোর। মহাজনী কারবার ছিল।

কিন্তু নবারুণবাবু? উনি তো রিটায়ার্ড মাইন ইঞ্জিনীয়ার!

হাসলেন রাজাবাহাদুর। নবারুণও তো সুদখোরের বংশ মশাই! রক্তে ওটা আছে। শুনেছি, সেও টাকা ধার দিত খনিশ্রমিকদের। ইণ্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা, বুঝলেন না? খনিশ্রমিকরা নেশাভাঙ করে আর জুয়া খেলে ফতুর হয়। নো প্রপার এডুকেশান, নো হেলদি অ্যাটমসফিয়ার। ওদের দোষ কী?

কিন্তু তাহলে কাপালিক সাধুর ব্যাপারটা কী মনে হয় আপনার?

ছদ্মবেশী নকশাল-স্কোয়াড। রাজাবাহাদুর রায় দিলেন। আমার ডাইরীতে পরবর্তী অংশ ফের সংক্ষিপ্ত।..রাজাবাহাদুরের কাছে বিদায় নিয়ে পুলিস স্টেশন। সেখানে কর্নেল-যদুপতিবাবুর দুর্বোধ্য গোপন মন্ত্রণা। ডাকবাংলোতে প্রত্যাবর্তন। আমার পুনঃপুনঃ প্রশ্ন। কর্নেলের উৎকট নীরবতা। আমি খাপ্পা। কর্নেলের চোখ বুজে কিয়ৎক্ষণ ধ্যান। তারপর হঠাৎ নিষ্ক্রমণ। প্রশ্নের জবাব পেলাম না।

বেলা একটায় কর্নেলের ফোন। লাঞ্চটা যেন আমি একা সাবাড় করি। এবং বিকেল চারটেয় যেন থানায় যাই রহস্যের পর্দা উন্মোচন দেখতে যদি আমার আগ্রহ থাকে।

.

০৩.

কাঁটায় কাঁটায় চারটেতে থানায় হাজির হলাম। ভেতরকার বড় ঘরে রীতিমত কনফারেন্সের আয়োজন হয়েছে। পুলিসসুপারও এসেছেন। বড়-ছোটো একঝাঁক গোমড়ামুখো পুলিস অফিসার বসে আছেন। মধ্যমণি হয়ে মিটিমিটি হাসছেন আমার বৃদ্ধ বন্ধু। তারপর চা এল।

চা খেতে খেতে গোয়েন্দাপ্রবর বললেন, মিস্টার বিশ্বাস আসামীকে নিয়ে আসার আগেই এই হত্যারহস্যের পর্দা তোলা যাক। দুটি সূত্র থেকে আমি উপকৃত। প্রথমটি হল : রাজাবাহাদুরের সংগৃহীত একটি বিশেষ জাতের ট্রেণ্ড পায়রার অন্তর্ধান। দ্বিতীয়টি হল : রাজাবাহাদুরের উক্তি–ভিকটিমরা প্রত্যেকে চড়া সুদে টাকা ধার দেওয়ার মহাজনী কারবারে লিপ্ত ছিলেন। থানায় এসে মিস্টার সিনহাকে নিহত ব্যক্তিদের বাড়ি তল্লাস করে কারবারের খাতাপত্র তদন্ত করার নির্দেশ দিলাম। আশাতীত ফল পাওয়া গেল। মিস্টার সিনহা, আপনার তদন্ত রিপোর্টটি পড়ুন একবার।

যদুপতি সিনহা একটা ফাইল খুললেন। মহেশ্বর ত্রিপাঠীর খাতায় আসামীর নামে কর্জখাতে খরচ লেখা আছে দুহাজার টাকা। সুদের হার মাসিক শতকরা তিরিশ টাকা। নবারুণবাবুর মহাজনী খাতা পাইনি। নোটবইয়ে আসামীর নামে লেখা আছে, আড়াই হাজার টাকা। সুদের হার মাসিক শতকরা কুড়ি টাকা। ভবেশবাবুর খাতায় একই লোকের নামে কর্জখাতে খরচ লেখা আছে পাঁচ হাজার পাঁচশো টাকা। সুদের হার মাসিক শতকরা চল্লিশ টাকা। রঞ্জন আঢ্যির খাতায় আসামীর নামে কজখাতে লেখা রয়েছে সাত হাজার টাকা। মাসিক সুদ শতকরা তিরিশ টাকা।

পুলিশ সুপার বললেন, এত চড়া সুদে টাকা ধার নিয়ে কী করতেন ভদ্রলোক?

যদুপতিবাবু বললেন, এই ইণ্ডাস্ট্রিয়াল এলাকায় একটা জুয়াচক্রের রিং লিডার হতে গেলে প্রচুর টাকা ইনভেস্ট করতে হয় স্যার। গুণ্ডাদল এবং মেয়েমানুষও পুষতে হয়। কিন্তু আমাদের চাপ সৃষ্টিতে এই চক্র বিশেষ সুবিধা করতে পারছিল না।

কর্নেল বললেন, এবার হত্যাপদ্ধতির কথায় নামা যাক। ভিকটিমরা সন্ধ্যার দিকে ফোন পাবার পরই ব্যস্তভাবে ছুটে যেতেন। বোঝা যায়, ফোনের অপরপ্রান্তে লোক অর্থাৎ আমাদের আসামীটিকে ওঁরা খুবই গুরুত্ব দিতেন। রঞ্জনবাবুর কথাই ধরুন। কাপালিক সাধুর আগমন এবং এককপি ডাকিনীতন্ত্র রেখে যাওয়ার সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের সম্পর্ক থাকছে জেনেও রঞ্জনবাবু ছুটে গিয়েছিলেন ফোন পেয়ে। কেন? এর ব্যাখ্যা করা যায় এভাবে : প্রথমত, কাপালিক সাধু ও ডাকিনীতন্ত্র ব্যাপারটার সঙ্গে ওই জরুরি ফোন পাবার কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে, তিনি মোটেও জানতেন না। দ্বিতীয়ত, এমন ঝুঁকি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ছুটে যাবার কারণ টাকাকড়ি ছাড়া আর কিছু হতেই পারে না। আশা করি, আপনারা সুদখোর মহাজনদের মানসিকতার সঙ্গে পরিচিত। যখন সুদ কেন, আসল টাকাও ফেরত পাবার আশা ছেড়ে দিয়েছেন, তখন হঠাৎ যদি দেনাদার খাতক ফোনে ডেকে বলেন, এক্ষুণি চলে আসুন টাকা যোগাড় হয়েছে এবং সুদে আসলে সব মিটিয়ে দিচ্ছি, এবং সেই খাতক যদি হন এক গণ্যমান্য বিশিষ্ট ব্যক্তি–তাহলে অর্থগৃধু মহাজন পাগল হয়ে দৌড়ে যাবেন বৈকি। টাকার সঙ্গে এঁদের রক্ত নেচে ওঠারই কথা।

পুলিশসুপার বললেন, ঠিক, ঠিক। কিন্তু মহেশ্বরবাবুর খুন হওয়া দেখেও কেন নবারুণবাবু কিংবা নবারুণবাবুর খুন হওয়া দেখেও ভবেশবাবু, এবং ভবেশবাবুর খুন হওয়া দেখেও রঞ্জনবাবু একই ফাঁদে পা দিতে গেলেন?

কর্নেল বললেন, নবারুণবাবু কেমন করে জানবেন, আমাদের আসামী ওরফে। ঘাতক লোকটি মহেশ্বরবাবুর কাছেও টাকা ধার করেছিলেন? তেমনি ভবেশবাবুও জানতেন না, তিনি ছাড়া আরও অনেকের কাছে এই লোকটি টাকা ধার করেছেন এবং ফেরত পাওয়ার আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন। এই ভিকটিম মহাজনরা প্রত্যেকে স্বাভাবিক কারণেই ভাবলেন, একমাত্র তার কাছেই ওই লোকটি দেনাদার। বিশেষ করে লোকটি যদি বিশিষ্ট কোনও ব্যক্তি বা সম্ভ্রান্ত পরিবারের কেউ হন, তিনি যে রাজ্যজুড়ে সকলের কাছে দেনা করে বেড়াবেন–কে ভাবতে পারে?

যদুপতিবাবু মুচকি হেসে বললেন, অথচ ইনি তাই করেছে।

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ–অন্তত সাতজন মহাজনের কাছে তো বটেই। কারণ আমরা সাতকপি ডাকিনীতন্ত্র চিৎপুরে এক ক্রেতার কেনার খবর জানি। শিল্পাঞ্চলে মহাজনদের ছড়াছড়ি। আপাতত আমরা চারজনকে জেনেছি। কারণ তারা খুন হয়েছেন, বাকি তিনজনকে জানি না। তবে বলা যায়, এই তিনজন জোর বেঁচে গেলেন। বাই দা বাই, মিস্টার সিনহা, এই চারজন মহাজনের কাতোর বাড়িতে কোনও হ্যাণ্ডনোট পেয়েছে কি–আসামীর স্বাক্ষরিত কোনও হ্যাণ্ডনোট?

না, কর্নেল।

তাহলেই বুঝুন, ভিকটিমদের বলা হয়েছে হ্যাণ্ডনোটসহ যেতে। ওঁরা ছুটে। গেছেন। ঘরে বসিয়ে রেখে আসামী টাকা আনার ছলে ভেতরে গেছেন। তারপর অতর্কিতে পিঠে ত্রিশূল বিঁধিয়ে মেরেছে। বডি বয়ে নিয়ে গেছে ভৈরবমন্দিরে। আসামীর বাসস্থানের অতি সন্নিকটে মন্দির। বেশি কষ্ট করতে হয়নি।

পুলিশসুপার বললেন, সন্নিকটে? মন্দিরের কাছে তো আর কোনও বাড়ি নেই!

কর্নেল দ্রুত বললেন, মিস্টার সিনহা, এবার টেলিফোন এক্সচেঞ্জের তদন্তরিপোর্ট, প্লিজ!

যদুপতিবাবু ফাইলের দিকে ঝুঁকে বললেন, রঞ্জনবাবুর বাড়ির লাইন চাওয়া হয়েছিল রাজবাড়ি থেকে।

মাইগুডনেস! নড়ে বসলেন পুলিসসুপার। অসম্ভব। রাজাবাহাদুর অত্যন্ত সৎ মানুষ!!

যদুপতিবাবু বললেন, এক্সচেঞ্জের অপারেটার রাজাবাহাদুর বা রাজবাড়ির অনেকের কণ্ঠস্বরের সঙ্গে পরিচিত। সে বলেছে, অচেনা কণ্ঠস্বরে লাইন চাওয়া হয়েছিল। ছয়ুই মার্চ সন্ধ্যা সাতটায় মহেশ্বরবাবুর, সাতুই মার্চ সন্ধ্যা ছটায় নবারুণবাবুর এবং নয়ুই। মার্চ সন্ধ্যা সাতটায় ভবেশবাবুর বাড়ির লাইন চাওয়া হয়েছিল রাজবাড়ি থেকেই। কণ্ঠস্বর অচেনা।

কণ্ঠস্বর বদলানো খুব সহজ। কর্নেল বললেন, যাই হোক মিস্টার সিনহা, এবার আমাদের মূল সাক্ষীকে উপস্থিত করুন।

হতবাক হয়ে দেখি, যদুপতিবাবু টেবিলের তলা থেকে একটা পাখির খাঁচা বের। করে টেবিলে রাখলেন। খাঁচার ভেতর একটা সাদা পায়রা। তার গলায় খয়েরি রঙের খানিকটা তুলো বাঁধা রয়েছে। বললাম, কর্নেল! আজ সকালে আপনার দাড়িতে কি এই পায়ারাটিরই পালক দেখছিলাম?

কর্নেল হাসলেন। অত উঁচুতে ত্রিশূল। কিভাবে রক্ত মাখানো সম্ভব, ভাবতে গিয়ে হঠাৎ মনে হয়েছিল–ট্রেণ্ড পাখির সাহায্য নেওয়া হয়েছে কি? এ-ক্ষেত্রে পায়রার কথাই সবার আগে মনে আসে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এবং পরে নানা ক্ষেত্রে ট্রেণ্ড পায়রা দিয়ে চিঠি পাঠানো হত। অন্যান্য কাজও করা হয়েছে পায়রা দিয়ে। তাই রাজাবাহাদুরের পায়রাগুলোর কথা মনে পড়েছিল। মিস্টার সিনহাকে নির্দেশ দিয়েছিলাম গতরাতে রঞ্জনবাবুর হত্যাকাণ্ডের পর। ফায়ার বিগ্রেডের সাহায্যে ত্রিশূলে ফাঁদ পেতে রাখতে বলেছিলাম।

যদুপতিবাবু বললেন, রাত তিনটের মুকহরবস্তীতে গিয়ে পাখি ধরা একটা লোককে ওঠালাম। ফায়ার ব্রিগেডের একটা গাড়িও চুপচাপ আনা হল। মুকহর লোকটি কিছুতেই ফায়ার ব্রিগেডের মইয়ে উঠবে না। ভয়টয় দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত কাজ হল। ভোর পাঁচটায় দেখি, পক্ষিবরের আবির্ভাব এবং গলায় তুলোতে রক্ত। ত্রিশূলে এসে গলা ঘষতে গিয়েই বাছাধন ফাঁদে পড়ল। তারপর দেখি, কর্নেল হন্তদন্ত হয়ে মাঠ দিয়ে আসছেন।

কর্নেল বললেন, তখনও বুঝিনি, কে এর পেছনে। সকাল আটটার পর রাজবাড়িতে ব্রেকফাস্টের নিমন্ত্রণে গিয়ে দেখলাম, রাজাবাহাদুরের পায়রার খাঁচায় জোড়াপায়রার একটা নিখোঁজ। অমনি সব জল হয়ে গেল। হা-ওই যে আসামী হাজির। ওঁর টুপিটা খুললেই দেখবেন, মাথায় আমার মত টাক আছে। চিৎপুরের দোকানে যে চেহারার বর্ণনা পেয়েছিলুম, আজ সকালে ওঁকে দেখামাত্র তা মিলে গিয়েছিল।

সবাই দরজার দিকে ঘুরে দেখলাম, খগেন্দ্র বিশ্বাস এবং আরও সব অফিসারের সঙ্গে হাতকড়া ও কোমরে দড়ি পরে আসামী সত্যি হাজির। কিন্তু কী আশ্চর্য! এ যে দেখছি, রাজাবাহাদুরের শ্যালক সেই মেঘেন্দ্রবাবু?

কর্নেল বললেন, মিস্টার বিশ্বাস, আশা করি, চিৎপুরের আর দাশ অ্যাণ্ড কোম্পানির জটাজুট গোঁফ-দাড়ি পোশাক-আশাক পাওয়া গেছে?

হ্যাঁ স্যার। খাটের তলায় পিচবোর্ডের বাক্সে প্যাক করা ছিল।

ত্রিশূলটা?

পেয়েছি। এই দেখুন। এতে কিন্তু রক্তক্ত নেই। ধুয়ে ফেলা হয়েছে।

ত্রিশূলটা দেখে আঁতকে উঠলাম। যাত্রাদলে ব্যবহারের জন্য নিছক টিনের তৈরি ত্রিশূল। সূচনো তিনটে ফলা। একটু বেঁকে আছে শুধু।

কর্নেল বললেন, তিন কপি ডাকিনীতন্ত্র উদ্ধার করতে পেরেছেন তো?

খগেন্দ্রবাবু সহাস্যে বললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ। পিচবোর্ডের বাক্সেই ছিল।

লালমলাটের তিনকপি বই টেবিলে রাখলেন খগেন্দ্র। বইগুলো হাতে হাতে ঘুরল কিছুক্ষণ। দেখলাম, প্রত্যেকটি বইয়ের ভেতর মারণতন্ত্রের তলায় আণ্ডারলাইন করা। শিউরে উঠলাম এই ভেবে যে আরও তিনটি মানুষের বরাতে কী নিষ্ঠুর মৃত্যু অপেক্ষা করছিল!

মেঘেকে হাজতঘরে নিয়ে যাওয়ার সময় কর্নেল তার উদ্দেশ্যে বললেন, আপনার প্ল্যানিং অনবদ্য মেঘেন্দ্রবাবু। কাঁপালিকের আবির্ভাব, ডাকিনীতন্ত্র বই এবং মারণমন্ত্রে আণ্ডারলাইন করা, ত্রিশূলের আঘাতে হত্যা করে ভৈরবমন্দিরের চত্বরে আসনে জপরত অবস্থায় রেখে আসা-সবই চমৎকার পরিকল্পনা। বস্তুত একজন নন একজিস্টেন্ট কাপালিক সাধুর পেছনেই হন্যে হত পুলিশ। বিভ্রান্ত করার কী অপুর্ব কৌশল আপনার! খামোকা নিরীহ সাধুরা মার খেলেন–আরও। অনেকে মার খেতেন জনসাধারণের হাতে। শেষ পর্যন্ত কোনও বদ্ধ পাগল সাধুর ঘাড়ে দোষটা পড়ত এবং পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যে তার সাজা হতো। কিন্তু একটা উইক পয়েন্ট আপনাকে ধরিয়ে দিল। বাড়তি একটু অলৌকিকতার টাচ দিতে গেলেন মন্দিরের দুর্গম ত্রিশূলে রক্তের দাগ মাখিয়ে। এর ফলে ঘটনার অলৌকিক রহস্য নিশ্চয় দানা বেঁধেছিল। কিন্তু এটাই আসলে আবার একটা ভীষণ দুর্বল পয়েন্ট। অতিচালাকি করতে গিয়ে আপনি ধরা পড়ে গেলেন।

মেঘেন্দ্র পেছন ফিরে হাজতঘরে ঢুকলেন। তার মুখ দেখতে পেলাম না। কর্নেল ফের বললেন, আপনি সার্কাসে ছিলেন। নিশ্চয় ক্লাউন সাজার অভিজ্ঞতা আছে। কণ্ঠস্বর বদলাতেও পারেন, খাড়া ধারালো নাককে মোটা নাকে পরিণত করতেও পটু। কাপালিক সাজা কী এমন কঠিন কর্ম! শুধু ত্রিশূলে রক্ত মাখাতে গিয়েই বিপত্তি ঘটল। আপনাকে ধরিয়ে দিলে নিছক একটা পায়রা।

সবাই খাঁচার ভেতর পায়রাটা দেখতে থাকলাম। বেচারা চুপচাপ বসে পিটির পিটির তাকাচ্ছে।…

.

টয় পিস্তল

হঠাৎ আজব দৃশ্য দেখে ঘরসুদ্ধ লোক প্রথমে হতভম্ব হলো, পরে প্রচণ্ড অট্টহাসির ধুম পড়ে গেল। আমি তো হাসতে হাসতে দুহাঁটুর ফাঁকে মাথা গুঁজে প্রায় মরার দাখিল–ফুসফুস ফেটে যাবে মনে হচ্ছিল। তারপর কর্নেলের করুণ ও অস্ফুট স্বগতোক্তি শুনলুম-ওটা কেড়ে নিন ওর হাত থেকে। কেড়ে নিন!

মুখ তুলে টেবিলের ওপর দুহাত ভোলা, অর্থাৎ হ্যাঁণ্ডস আপ ভঙ্গিতে কর্নেল নীলাদ্রি সরকারকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলুম এবং ফের দমফাটানো হাসির চাপ এল। মেঝেয় ছোট্ট মেয়ে নিন তখনও খেলনার পিস্তলটা তাক করে আছে।

কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের বোধ থেকে জানলুম-কর্নেলের মুখে এবং ওই ভঙ্গিতে দেখেছি তা যেন একটি ছোট মেয়ের সঙ্গে কৌতুক নয়। তা যেন ভান নয় মোটেও। যেন কোনও হিংস্র আততায়ী সত্যি সত্যি একটা প্রকৃত মারাত্মক আগ্নেয়াস্ত্র তার দিকে তাক করেছে।

একি আমার নিছক দেখার ভুল? কর্নেল নীলাদ্রি সরকার স্বভাবত সিরিয়াস টাইপের মানুষ। তার মানমর্যাদাও সামান্য নয়। বিশেষত প্রতাপপুর অখনির মালিকের এই বাড়িতে তিনি এখন একজন বরেণ্য অতিথি।

বিজয়েন্দু রায়ের সাত বছরের মেয়ে নিনা টয় পিস্তল হাতে ঘরে ঢুকেই তাকে তাক করে যেই বলেছে–হ্যাণ্ডস আপ, অমনি কি না ওই রাশভারী বৃদ্ধ কর্নেল আচমকা একলাফে কোণায় উঁচু টেবিলে উঠে দাঁড়ালেন–শুধু তাই নয়, দুহাত তুলে চেঁচিয়ে উঠলেন–নো নো নো! মিসেস রায়! মিসেস রায়! ওটা কেড়ে নিন।

পরক্ষণে চন্দ্রকণা মেয়ের হাতের টয় পিস্তলটা কেড়ে নিয়েছেন বাবাঃ! খুব ভয় পেয়েছেন কর্নেলদাদু। দেখছ না–হ্যাণ্ডস আপ করেছেন? ব্যস! এবার তুমি অন্য খেলা খেল গে কেমন?

ঘরে তখনও হাসির আবহাওয়া। কর্নেলকে নামতে দেখলুম! কিন্তু আশ্চর্য, মুখটা গম্ভীর। সোফার আগের জায়গায় বসে কঁচুমাচু হয়ে বললেন–আপনারা ক্ষমা করবেন আমায়। জাস্ট এ ফান। কিন্তু রিয়েলি–এত হঠাৎ ও অমনভাবে ঢুকল যে…মাই গড! হোয়াট এ ফান!

ফের সবাই হাসল। নিনা ওর মায়ের হাত থেকে পিস্তলটা নেবার চেষ্টা করছে। আমি বললুম–দিয়ে দিন না! তখন চন্দ্রকণা সেটা ওকে ফেরত দিলেন। মুখে প্রচুর হাসি।

নিনা পিস্তলটা নিয়ে ফের কর্নেলের দিকে তাক করতেই কর্নেল এবার সব গাম্ভীর্য এবং কঁচুমাচু ভাব ভেঙে হো হো করে হেসে ফেললেন এবং ডাকলেন– নিনি! চলে এস। দেখি তোমার পিস্তল! হুঁ–দেখি দেখি!

খুব ভয় পেয়েছিলুম। দারুণ ভয়! বসে কর্নেল ওর পিস্তলটা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন।বাঃ! চমৎকার পিস্তল কিন্তু! আজকাল আমাদের খেলনা তৈরিতে খুব উন্নতি করেছে। ইয়ে মিসেস রায়, এটা–এটা বুঝি সম্প্রতি কেনা হয়েছে?

চন্দ্রকণা জবাব দিলেন—হ্যাঁ। পরশু উনি কলকাতা থেকে এনে দিয়েছেন। নিনা কদিন থেকে টয় পিস্তলের বায়না ধরেছিল, আজকাল বাচ্চা ছেলেমেয়েরা ওয়েস্টার্ন ফিল্মের কায়দায় গানডুয়েল খেলতে ভালবাসে। নিশ্চয় লক্ষ্য করে থাকবেন কর্নেল?

কর্নেল বললেন–তাই বটে! তবে আর একটা ব্যাপার নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন মিঃ রায়? আজকালকার খেলনা কিন্তু মোটেও খেলনার মতো দেখায় না। অবিকল আসলের ক্ষুদে সংস্করণ। তাই না? যেমন এই টয় পিস্তলটাই দেখুন। পরীক্ষা করার আগে কার সাধ্য এটা খেলনা ভাবতে পারে? তাছাড়া ওজনও দেখছি প্রকৃত পিস্তলের মতো।

এবার সকৌতুকে বললুম–তাই বুঝি আপনি প্রাণভয়ে টেবিলে চড়েছিলেন? কিন্তু আপনার কিলার নিনাও যে একটা বাচ্চা মেয়ে সে কথাটা নিশ্চয় মাথায় ঢোকেনি?

কর্নেল একটু হেসে রহস্যময় ভঙ্গিতে মাথা দোলালেন। বিজয়েন্দু হাসতে হাসতে বললেন–যদি সিরিয়াসলি ধরেন তাহলে বলব কর্নেলের গোয়েন্দা। মানসিকতারই এটা একটা প্রকাশ। অনবরত হত্যাকারীর মুখোশ ফাস করা যার নেশা ও পেশা, তার মনে এমন আতঙ্ক থাকা স্বাভাবিক।

একটু পরে সুদৃশ্য ট্রে এবং পট-পেয়ালায় কফি তার সঙ্গে কিছু স্ন্যাকস এল। এখন সকাল সাতটা। যে ঘরে আমরা বসে আছি তা পাহাড়ের গায়ে একটা বাংলোবাড়ি। দক্ষিণ-পশ্চিমে বিস্তৃত সুন্দর উপত্যকা, পূর্বে ছোটোখাটো পাহাড় এবং উপত্যকা পেরিয়ে একটা নদী, পূর্বের পাহাড় ঘেঁসে দক্ষিণে চলে গেছে। সময়টা সেপ্টেম্বর। তাই প্রাকৃতিক দৃশ্য তুলনাহীন।

খনি রয়েছে এই পাহাড়ের উত্তর দিকের অন্য একটা উপত্যকায়। এখান থেকে দুমাইল দূরে একটা সুন্দর পীচের রাস্তা বাংলোর পশ্চিম গেট থেকে শুরু হয়ে উত্তর ঘুরে উতরায়ে নেমেছে এবং বড় সরকারী সড়কে মিশেছে। ওই সড়ক ধরে এগোলে খনিতে পৌঁছানো যায়।

আমরা, দৈনিক সত্যসেবকের রিপোর্টার শ্রীমান জয়ন্ত চোধুরী এবং তার বৃদ্ধ বন্ধু গোয়েন্দা ও প্রকৃতিবিদ কর্নেল নীলাদ্রি সরকার দৈবাৎ এসে পড়েছি এখানে। দক্ষিণ-পশ্চিমের উপত্যকার জঙ্গলে কর্নেল কিছু বিরল প্রজাতির প্রজাপতি সংগ্রহ করবেন এবং আমি তাকে নিছক সঙ্গ দেব। ফরেস্ট বাংলোয় ওঠার কথা ছিল। কিন্তু পথে হঠাৎ বিজয়েন্দুর সঙ্গে দেখা এবং কর্নেল তার পরিচিত–অতএব কিছুতেই জঙ্গলে কাটাতে দেবেন না। তার অতিথি হয়ে গতকাল সন্ধ্যায় এখানে আসতে হলো। এখন এ ঘরে রায়দম্পতি ও তাদের মেয়ে নীনা ছাড়া আরও তিনজন ভদ্রলোক আছেন। আলাপ হয়েছে পরস্পর। সতীনাথ চাকলাদার কলকাতা থেকে এসেছে নিছক শিকারে। তিনি নামকরা শিকারী। আমাদের যে ফরেস্ট বাংলোয় থাকার কথা তিনি সেখানেই একটা ঘরে আছেন। এসেছেন গত পরশু। বিজয়েন্দু ওঁর বন্ধু। নরেন্দ্র সিংহরায় পাঁচ মাইল দূরের প্রতাপগড় বাজারের একজন ব্যবসায়ী। আর আছেন শ্যামল মুখার্জি বিজয়েন্দুর খনির ম্যানেজার।

বিজয়ের বয়স চল্লিশ-বেয়াল্লিশ। শক্ত সমর্থ বলিষ্ঠ গড়নের মানুষ, কেমন যেন বন্য চেহারা। গোঁরগোবিন্দ বলে মনে হয়েছে। শিকারী সতীনাথ কিন্তু উল্টো চেহারার ও স্বভাবের। ওঁর হাসিটি এত চমৎকার যে, ভাবাই যায় না এই মানুষ হিংস্র বন্য জন্তুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তেও ওস্তাদ। রোগা, ঢ্যাঙা, বয়সে বিজয়ের কাছাকাছি। নরেন্দ্রবাবু হোঁদলকুতকুতে গড়নের সুখীসুখী চেহারার মানুষ বয়স অনুমান পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ। সবসময় পান খান। কথা খুব কম বলেন। বেশি হাসেন। শ্যামলবাবু আমার বয়সী, অর্থাৎ বত্রিশ। সফিস্টিকেটেড বলা যায়, একটু গম্ভীর। তীক্ষ্ণ চোখজোড়ায় সর্বজ্ঞের হাবভাব। চন্দ্রকণা কিন্তু স্ত্রী হিসেবে বিজয়েন্দুর। বেমানানই বলব। অসাধারণ সুন্দরী তো বটেই বয়সেও মনে হলো অন্তত দশ বারো বছরের ছোট, স্বামীর চেয়ে।

কফি খেতে খেতে এবার শিকারের গল্প শুরু হলো। আমারও শিকারে এক আধটু নেশা ও অভিজ্ঞতা আছে। সঙ্গে রাইফেলও এনেছি একথা শুনে সতীনাথ আমার দিকে ঝুঁকলেন। বেগতিক দেখে কর্নেল বলে উঠলেন–তবে সাবধান মিঃ চাকলাদার, জয়ন্ত মাঝেমাঝে ভুলে যায় যে ওর হাতে রাইফেল আছে। ও খাঁটি রিপোর্টারের মতো বধ্য জন্তুর দিকে তাকায় যেন সত্যসেবকে কীভাবে ফাস্ট লাইনটা শুরু করবে। সুতরাং সাবধান!

সবাই হাসলেন। ওঁকে আশ্বস্ত করে বললুম–আমি এবার শিকার-টিকারে বেরুচ্ছিনে। এখানে বসে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখেই সময় কাটাব।

সতীনাথ বললেন কর্নেলও তো শুনেছি পাকা শিকারী! সুতরাং বেরুতে হলে তিন জনেই বেরুব। কী বলেন কর্নেল?

এইসব গপ্পসপ্প হতে হতে আটটা বেজে গেল। চন্দ্রকণা ততক্ষণে মেয়েকে নিয়ে অন্য ঘরে গেলেন। নিনা খুব চঞ্চল মেয়ে।

তারপর সতীনাথ আমাদের দুজনকে ফরেস্ট বাংলোয় আমন্ত্রণ জানিয়ে চলে গেলেন। একটু পরে নরেন্দ্র বেরিয়ে গেলেন। তার কিছু পরে শ্যামলবাবু ও বিজয়েন্দু কাজকর্ম নিয়ে পাশের ঘরে কথা বলতে চলে গেলেন। ঘরে রইলুম কর্নেল ও আমি।

কর্নেলের মুখটা আবার গম্ভীর দেখাচ্ছিল। বললুম–হ্যালো ওল্ড ম্যান! ব্যাপারটা কী, বলুন তো!

কর্নেল তাকালেন–কিছু কি বলছ, ডার্লিং?

উনি কি যেন ভাবছিলেন। বললুম–এনিথিং সিরিয়াস?

কর্নেল ঘাড় নাড়লেন। তারপর ঠোঁট ফাঁক করলেন–কিন্তু কিছু বললেন না।

মনে হচ্ছে একটা কিছু চক্রান্ত করছেন?

কর্নেল হঠাৎ আমার হাতে হাত রেখে চাপা গলায় বললেন-জয়ন্ত! ওই টয় পিস্তলটা–

উনি থামতেই চমকে উঠে বললুম–কেন? আপনার কি মনে হলো ওটা টয় পিস্তল না।

-হ্যাঁ, ডার্লিং। ওটা একটা খেলনার পিস্তলই বটে!

–তাহলে?

–কিন্তু আশ্চর্য, জয়ন্ত, আশ্চর্য!

এবার বিরক্ত হলুম। সব তাতেই ওঁর যেমন নাক গলানো অভ্যাস তেমনি যেন আজকাল সব কিছুতেই রহস্য টের পাবার বাতিক দাঁড়িয়েছে। বললুম–একটা টয় পিস্তলে কী আশ্চর্য থাকতে পারে বুঝলুম না! ছেড়ে দিন।

কর্নেল আমার বিরক্তি অগ্রাহ্য করে ফের বললেন–ওটা অবিকল আসল পিস্তলের মতো দেখতে। এমন কি ওজনও একই। কেন জয়ন্ত, কেন?

নির্ঘাৎ ওঁর এবার ভীমরতি ধরেছে। অগত্যা উঠে দাঁড়িয়ে বললুম–আপনার কিঞ্চিৎ ভোলা বাতাস সেবন করা দরকার। টুপি খুলে টাক বিকশিত করে, হে প্রাজ্ঞ ঘুঘুমশায়, নদীর ধারে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন। ঘিলুর ধুলোময়লা সাফ হয়ে। যাবে। আসুন।

কর্নেলও উঠে দাঁড়ালেন, তখুনি সায় দিয়ে বললেন–ঠিকই বলেছ ডার্লিং। এর চেয়ে আপাতত আরামদায়ক কিছু নেই। ওঃ, এই ঘরে যেন আমার দম আটকে আসছে।

.

সেই যে বেরুলুম দুজনে, পুরো দুপুর কেটে গেল জঙ্গলে-জঙ্গলে। কর্নেলকে স্বাভাবিক দেখে আশ্বস্ত হয়েছিলুম। কাঁধে কিটব্যাগ নিয়েছিলেন। তার মধ্যেese প্রজাপতি ধরা জাল আর ভাজকরা খাঁচাও ছিল। আড়াইটে অব্দি সাতটা প্রজাপতি ধরলেন উনি। পাখির পিছনেও বাইনোকুলার চোখে নিয়ে ছোটাছুটি করলেন। আমার অবস্থা তখন শোচনীয়। অবশেষে কর্নেলের দৃষ্টি ঘড়ির কাঁটার দিকে আনা গেল এবং দুজনে গলদঘর্ম হয়ে ফেরার পথে পা বাড়ালুম। ..

কিন্তু নদীর ধারে এসে হঠাৎ কর্নেল বললেন–জয়ন্ত, মনে হচ্ছে আমরা ফরেস্ট বাংলোর কাছে এসে পড়েছি। একবার অন্তত মিঃ চাকলাদারের সঙ্গে দেখা করা উচিত। কী বলে?

বিরক্ত হয়ে বললুম–লাঞ্চের সময় চলে গেল যে। তাছাড়া উনি এখানে, আছেন, না জঙ্গলে ঘুরছেন–ঠিক নেই!

কর্নেল আমার হাত ধরে সস্নেহে টানলেন। –ডার্লিং, এটা ভদ্রতা। জঙ্গলে আছি কিন্তু আমরা মানুষ।

বলে উনি যেন বীরবিক্রমে হাঁটা শুরু করলেন। একটু পরেই টের পেলুম, এ যাওয়া স্বাভাবিক গতিতে নয়। তাড়া খাওয়া জন্তুর মতো ঝোপঝাড় ভেঙে আগাছা মাড়িয়ে যেন আশ্রয়ের খোঁজে ছুটে যাওয়া। কয়েকবার ওঁর টুপি কাঁটায় আটকে গেল। দ্রুত ছড়িয়ে নিলেন। আমিও প্রায় ক্ষতবিক্ষত হলুম। তারপর হঠাৎ কর্নেল আমাকে টেনে ধরে বসিয়ে দিলেন এবং নিজেও বসলেন। ঝোপের আড়াল ছিল। তার ওধারে ফরেস্ট বাংলোটা দেখা যাচ্ছিল। নদীর এপারেই একটা টিলার গায়ে রয়েছে সেটা। তারপর দেখলুম, কর্নেল বাইনোকুলার দিয়ে বাংলোটা দেখছেন। আমি অবাক এবং অস্থির।

একটু পরে ঘুরে কর্নেল চাপা গলায় বললেন–এক মিনিট, জয়ন্ত। তুমি এখানে অপেক্ষা করো, আমি এখুনি আসছি। সাবধানে, যেভাবে বসে আছ, তাই থাকবে। নড়ো না।

কোনও প্রশ্নের সুযোগ না দিয়ে উনি গুঁড়ি মেরে এগোলেন। ওঁর ভঙ্গি দেখে, মনে হলো, একটা ক্ষুধার্ত সিংহ যেন চুপিসারে তার শিকারের দিকে এগিয়ে চলেছে। একটু পরেই ওঁকে গাছপালা ও ঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হতে দেখলুম। এই অদ্ভুত কাণ্ডের মাথামুণ্ডু না খুঁজে পেয়ে অগত্যা হাল ছেড়ে দিতে হলো। ঝোপের ফাঁকে দুরের ওই বাংলোর দিকে চোখ রইল আমার।

কিন্তু বাংলো যেমন নির্জন ছিল তেমনিই আছে। জনপ্রাণীটি নেই। পনের মিনিট কেটে গেল। তারপর সামনের দিকে শুকনো পাতা মচমচ করে উঠল। শব্দটা এগিয়ে আসতে থাকল। রাইফেলটা সঙ্গে নিয়ে বেরোয়নি। তাই অসহায় হয়ে আশা করতে থাকলুম যে, ওই শব্দ যেন কর্নেলেরই হয়। শেষ অব্দি আশা মিটল। আন্দাজ দশ গজ দূর থেকে কর্নেলের টুপি চোখে পড়ল। ওঁর মুখে অমায়িক হাসি। কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন–যে পথে এসেছি সেই পথে এই ভাবেই ফিরতে হবে, জয়ন্ত। সাবধান।

অতএব ফের সেইসব কাঁটায় খোঁচা খেতে খেতে আগের জায়গায় পৌঁছানো গেল এবং এবার উনি চড়া গলায় জঙ্গলের সৌন্দর্যের প্রশংসা করতে করতে সুপথে পা বাড়ালেন।

বিজয়ের বাংলোর কাছে পৌঁছে এতক্ষণে বললুম–এসবের মানে কী?

কর্নেল আমার হাত টেনে নিয়ে বললেন-অধৈর্য হয়ো না। ঠিক মতো সব কিছু চললে তুমি এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারবে। জয়ন্ত, এটা আমার দূরদৃষ্টি বলতে পারো। যেখানে যাই, এক মারাত্মক আততায়ী আমার সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে এগিয়ে আসে। না, না, ডার্লিং। তুমি ভয় পেয়ো না। আশা করি, খুব বেশি কিছু ঘটবে না।

অস্থিরতা চেপে রাখতে হলো। আর তখন খিদেয় নাড়িভুঁড়ি জ্বলছে।

.

সেদিন সন্ধ্যায় বিজয়ের সেই ঘরে আবার আজ্ঞা চলেছে। তবে এ-বেলা সেই ব্যবসায়ী ভদ্রলোক, অর্থাৎ নরেন্দ্র সিংহরায় আসেননি। শিকারী বা ম্যানেজারও না। আমি, কর্নেল ও রায়দম্পতি গল্প করছি। গল্প করার সময় কর্নেলের অন্যমনস্কতা লক্ষ করছিলুম। মাঝেমাঝে ঘড়ি দেখছেন আড়চোখে। কে যেন আসবে, প্রতীক্ষা করছেন। কে সে?

পাশের ঘরে নিনা ইংরেজি ছড়া মুখস্থ করছে, শোনা যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে আবার কথাও বলছিল। বাইরে তখন ফুটফুটে শরঙ্কালীন জ্যোৎস্না।

কর্নেলের চঞ্চলতা এবার বিজয়ের চোখে পড়ল। বললেন কর্নেলের কি। শরীর খারাপ করছে?

কর্নেল ব্যস্তভাবে বললেন–ও নো নো! আমি–ইয়ে মিঃ রায়, ভাবছি যে আজ রাতটা বরং ফরেস্ট বাংলোয় গিয়ে কাটাব। ভারি চমৎকার জ্যোৎস্না ফুটেছে। তাছাড়া আজ দুপুরে জায়গাটা দেখে এসেছি–অপূর্ব। আপনি যদি কিছু না মনে করেন

বিজয়েন্দু বললেন, না। মনে করার কি আছে?

চন্দ্রকণা বললেন কিন্তু এক শর্তে। এখানে ডিনারে না খেয়ে নয়।

কর্নেল বেজার মুখে বললেন–প্লিজ মিসেস রায়। আপনার রাঁধুনীকে কিন্তু আগেভাগেই জানিয়ে দিয়েছি। সে আপনাকে কিছু বলে নি?

চন্দ্রকণা ক্ষুব্ধমুখে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন-কই না তো। তারপর ভেতরে চলে গেলেন। হয়তো রাঁধুনীকে ধমক দিতেই গেলেন।

বিজয়েন্দু একটু হেসে বললেন–তাহলে যা ভেবেছি। শরীর খারাপ। মুশকিল– কী জানেন, এ জায়গাটা একটা বিউটি স্পষ্ট। কিন্তু জলবায়ুটা তেমন ভাল নয়। আমারও মাঝে মাঝে পেটের অসুখ হয়।

কর্নেল এ সময় আমাকে গোপনে একটু খুঁচিয়ে দিলেন। তারপর বললেন-হ্যাঁ। জয়রেও সেই অবস্থা। তাই ওকেও বলেছি, রাত্তিরটা আমার সঙ্গে উপোস করতে।

আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলুম। পাশের ঘরে চন্দ্রকণা শুনলুম মেয়েকে বকাবকি করছেন–এখন খেলে না। এখন কি খেলার সময়? নিনা অনুযোগ করছে, শোনা গেল।

বাইরে কার সাড়া পাওয়া গেল রায়, আসতে পারি? বিজয়েন্দু উঠে গেলেন। তারপর দেখি, সতীনাথ ঢুকছেন ওঁর সঙ্গে। কর্নেলের মুখে উজ্জ্বল হাসি ফুটল। বললেন–আসুন, আসুন মিঃ চাকলাদার। আপনি না থাকায় মোটেও আচ্ছা জমছিল না। তারপর বলুন, আজ কী শিকার-টিকার করলেন।

সতীনাথ হাসিমুখে বসে বললেন–একটা সাপ মেরেছি। হ্যামাড্রায়াড। অর্থাৎ শঙ্খচুড়।

এরপর ফের গল্পের আবহাওয়া জমজমাট হয়ে উঠল। চন্দ্রকণা ফিরলে সতীনাথ। ফের গোড়া থেকে সাপ মারার ঘটনা শুরু করলেন। তারপর এক ফাঁকে হঠাৎ নিনা। সকালের মতো সেই টয় পিস্তল হাতে ঢুকে পড়ল। বিজয়েন্দু হেসে বললেন নিনি, এবার আর কর্নেলদাদুকে নয়–তোমার শিকারীকাকুকে অ্যাটাক করো! জোরে ট্রিগার টিপবে কেমন? তাহলেই কাকু ব্যস!

অমনি নিনা পিস্তল তাক করল সতীনাথের দিকে। কিন্তু আশ্চর্য, সতীনাথ, ঠিক সকালে কর্নেল যা করেছিলেন, তার চেয়েও হাস্যকর কাণ্ড করে বসলেন। এক লাফে তিনি প্রায় চোখের পলকে ঘর তেকে বেরিয়ে গেলেন। তারপর বাইরে ওঁর। প্রচণ্ড গর্জন শোনা গেল–বিশ্বাসঘাতক। ব্রুট। এর শধ একদিন নেবই নেব।

কর্নেল চেঁচিয়ে উঠলেন–মিঃ চাকলাদার। ফিরে আসুন। কোনও ভয় নেই।

কিন্তু চেঁচিয়ে ওঠার মধ্যেই উনি একলাফে নিনার পিস্তলটাও ধরে ফেলেছেন। নিনা কেঁদে উঠেছে। চন্দ্রকণা স্তম্ভিত। বিজয়েন্দু হাঁ করে আছেন। সতীনাথের কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। ভদ্রলোক কি সত্যি চলে গেলেন?

নিনার হাত থেকে পিস্তলটা কেড়ে নিয়ে কর্নেল হাসতে হাসতে জানালা দিয়ে তাক করলেন এবং আমাদের আরও হতবুদ্ধি ও আতঙ্কিত করে ট্রিগার টিপতেই সত্যিকার পিস্তলের আওয়াজ রাতের স্তব্ধতা খানখান করে দিল। আমার বুক চিব ঢিব করতে থাকল।

বিজয়েন্দু লাফিয়ে উঠে বললেন–সর্বনাশ! নিনা করেছে কী!

কর্নেল ভৎর্সনার ভঙ্গিতে বললেন–আপনার পিস্তলের সঙ্গে নিনার খেলনা পিস্তল বদল হয়ে গেছে, মিঃ রায়। আপনি এবার থেকে অস্ত্রের ব্যাপারে সতর্ক হবেন।

বিজয়েন্দু বললেন–আমি খুব দুঃখিত, কর্নেল। আমার পিস্তলটা ড্রয়ারে থাকে। কিন্তু মনে হচ্ছে, চাবি দিতে ভুলে গিয়েছিলুম। কী সর্বনাশ ঘটে যেত এক্ষুণি! কর্নেল পিস্তলটা ওঁকে দিয়ে বললেন–এবার চলি। জয়ন্ত তুমি গুছিয়ে নাও আর মিঃ রায়, মানুষকে ক্ষমা করতে শিখুন।

বিজয়েন্দু কোনও কথাও বললেন না। পিস্তলটা হাতে নিয়ে গম্ভীর মুখে বসে থাকলেন। নিজেদের ঘরে গিয়ে গোছগাছ করছি, সেই সময় চন্দ্রকণার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না শুনলুম। কর্নেল ফিসফিস করে বললেন-জয়ন্ত, ওই জটিল দাম্পত্য • • সমস্যা মেটাবার ক্ষমতা আমাদের নেই। অতএব দ্রুত বেরিয়ে পড়া যাক।

রাস্তায় গিয়ে বললুম–কিন্তু ব্যাপারটা কী?

কর্নেল বললেন–এখনও টের পাচ্ছ না? সতীনাথ চন্দ্রকণার পুরনো প্রেমিক। বিজয়েন্দু এবার ঠিক করেছিলেন সতীনাথ এলেই মেয়ের হাত দিয়ে ওঁকে খুন করাবেন। খুব সরল পন্থা। দৈবাৎ বাচ্চা মেয়ে তাঁর অটোমেটিক পিস্তলের সঙ্গে নিজের টয় পিস্তল বদল করে নিয়েছে। অতএব হত্যাকাণ্ডের দায়টা আইনের ফাঁকে উড়ে যাবে। আজ সকালে আমি যে আচরণ করেছিলুম, তা বিজয়েন্দুকেই সতর্ক করে দিতে। নির্বোধ বিজয়েন্দু তা আঁচ করেননি। আর, আজ দুপুরে আমার অত সতর্কতার কারণ আর কিছু নয়–বিজয়েন্দু খনিতে যাওয়ার পর চন্দ্রকণা প্রেমিকের কাছে আসবেন, এই ধারণা ছিল। তাই পাছে প্রেমিকদ্বয়ের চোখে পড়ি, একটু সতর্ক হয়েছিলুম।

বললুম–এবং গোপনে গিয়ে সবটা প্রত্যক্ষও করে এসেছিলেন।

কর্নেল বললেন–হ্যাঁ। কারণ আজ সকালেই চন্দ্রকণা ও সতীনাথের হাবভাবে আমার সন্দেহ জেগেছিল। যাকগে, এখন চলো বেচারা সতীনাথকে সান্ত্বনা ও উপদেশ দেওয়া যাক।…

No comments