লাখপতি – সত্যজিৎ রায়
ত্রিদিব চৌধুরী আর থাকতে না পেরে বিরক্তভাবে বেয়ারাকে ডাকার বোতামটা টিপলেন। কিছুক্ষণ থেকেই তিনি অনুভব করছেন যে, কামরাটা যত ঠাণ্ডা থাকার কথা মোটেই তত ঠাণ্ডা নয়। অথচ তাঁর তিন সহযাত্রীই দিব্যি নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছেন। এটা যে কী করে সম্ভব হয় তা ত্রিদিববাবু মোটেই বুঝতে পারেন না। আসলে অন্যায়ের প্রতিবাদ না করে করেই হয়েছে এই হাল। সাত চড়ে রা নেই বলেই তো জাতটার কোনওদিন উন্নতি হল না।
দরজায় টোকা পড়ল।
অন্দর আও।
দরজাটা একপাশে সরে গিয়ে বাইরে বেয়ারাকে দেখা গেল।
কামরার টেমপারেচার কত রাখা হয়েছে? ধমকের সুরে জিজ্ঞাসা করলেন ত্রিদিববাবু।
উয়ো তো মালুম নহী হ্যায় বাবু।
কেন? মালুম নেই কেন? এসি-তে ট্রাভেল করে গরম ভোগ করতে হবে এ আবার কীরকম কথা? এ ব্যাপারে তোমাদের কোনও দায়িত্ব নেই?
বেয়ারা আর কী বলবে?–সে বোকার মতো দাঁত বার করে দাঁড়িয়ে রইল। এদিকে আপার বার্থের মাদ্রাজি ভদ্রলোকটির ঘুম ভেঙে গেছে, তাই ত্রিদিব চৌধুরীকে বাধ্য হয়ে তাঁর রাগ হজম করে নিতে হল।
ঠিক হ্যায়। তুম যাও–আর শোনো, কাল সকালে ঠিক সাড়ে ছটার সময় চা দেবে।
বহুত আচ্ছা, হুজুর।
বেয়ারা চলে গেল। ত্রিদিববাবু দরজা বন্ধ করে তাঁর জায়গায় শুয়ে পড়লেন। এসব ল্যাঠা ভোগ করতে হত না যদি তিনি প্লেনে আসতেন। তাঁর মতো অবস্থার লোকেরা কলকাতা থেকে রাঁচি সাধারণত প্লেনেই যায়। মুশকিল হচ্ছে কি, প্লেনে যাত্রা সম্পর্কে ত্রিদিববাবু একটা আতঙ্ক বোধ করেন সেটা কাটিয়ে ওঠা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। বছর বারো আগে তিনি একবার প্লেনে করে বোম্বাই গিয়েছিলেন। সে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। সেদিন আবহাওয়া ছিল প্রতিকূল, ফলে প্লেন আকাশে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যে ঝাঁকুনি শুরু হয় সেটা চলে একেবারে শেষ পর্যন্ত। সেদিনই ত্রিদিববাবু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন যে তিনি আর কখনও প্লেনে চড়বেন না। তাই এবার যখন রাঁচি যাওয়ার দরকার হল তখন তিনি সরাসরি রাঁচি এক্সপ্রেসে বুকিং করলেন। এসি-তে আরামের প্রত্যাশা করেছিলেন, কিন্তু এখন সে আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে অন্ধকার কামরায় শুয়ে নানান চিন্তার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দিলেন।
বিশেষ করে মনে পড়ছে তাঁর ছেলেবেলার কথা। রাঁচিতেই তাঁর জন্ম। তাঁর বাবা আদিনাথ চৌধুরী ছিলেন রাঁচির নামকরা ডাক্তার। ত্রিদিববাবু ইস্কুলের পড়াশুনা রাঁচিতে শেষ করে কলকাতায় চলে যান কলেজে পড়তে। মামাবাড়িতে থেকে বি.এ. পর্যন্ত পড়ে কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর এক মাড়োয়ারি বন্ধুর পরামর্শে ব্যবসার দিকে ঝোঁকেন। লোহালক্কড়ের ব্যবসা দিয়ে শুরু করে অল্পদিনের মধ্যেই ব্যাঙ্কে তাঁর অনেকগুলো টাকা জমে যায়। তিনি বুঝতে পারেন যে ভাগ্যলক্ষ্মী তাঁর প্রতি সবিশেষ প্রসন্ন। সেই থেকে তিনি কলকাতাতেই থেকে যান, যদিও বাপ-মা রাঁচি ছাড়েননি। প্রথমে সর্দার শঙ্কর রোডে একটা ফ্ল্যাটে। তারপর রোজগার বাড়লে পর হ্যারিংটন স্ট্রিটে একটা দোতলা বাড়ির একতলাটা ভাড়া নেন ত্রিদিববাবু। বাপ-মায়ের সঙ্গে যে একেবারে যোগাযোগ ছিল না তা নয়। প্রতি বছর অন্তত একবার সাতদিনের জন্য এসে পৈতৃক বাড়িতে কাটিয়ে যেতেন ত্রিদিববাবু। বাপ-মায়ের অনুরোধেই তিনি ছাব্বিশ বছর বয়সে বিয়ে করেন। দুবছর পরে তাঁর একটি ছেলে হয়। সেই ছেলে এখন আমেরিকায় পড়াশুনা করছে। আর কোনও সন্তান হয়নি ত্রিদিববাবুর। স্ত্রী মারা গেছেন তিন বছর হল। মা দেহ রেখেছেন সেভেন্টিটুতে, আর বাপ সেভেন্টিফোরে। রাঁচির সেই বাড়ি এখনও রয়েছে একটি চাকর ও একটি মালির জিম্মায়। ত্রিদিববাবু নিয়মিত তাদের মাইনে দিয়ে এসেছেন গত দশ বছর ধরে। বাড়িটা রাখার উদ্দেশ্য হল মাঝে মাঝে দু-চারদিন বিশ্রাম করে যাওয়া। কিন্তু রোজগারের ধান্দায় সেটা আর হয়ে ওঠেনি। তিনদিন বিশ্রাম মানেই তো হাজার পাঁচেক টাকা হাতছাড়া হয়ে যাওয়া। যে মানুষের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হল অর্থোপার্জন, তার আর বিশামের ফুরসত কোথায়? ত্রিদিববাবু আজ লাখপতি। বাঙালিরা ব্যবসায়ে। রোজগার করতে পারে না–এই অপবাদের মুখে তিনি ঝাড় মেরেছেন।
এবার যে দশ বছর বাদে ত্রিদিববাবু রাঁচি যাচ্ছেন, এটা বিশ্রামের জন্য নয়। রাঁচিতে লাক্ষার ব্যবসা একটা বড় ব্যবসা। এই ব্যবসায়ে কোনও সুবিধা হতে পারে কিনা সেইটে যাচাই করে দেখার জন্যই রাঁচি যাওয়া। পৈতৃক বাড়িতেই থাকবেন ত্রিদিববাবু, এবং দুদিনের মধ্যেই কাজ হয়ে যাবার কথা। প্রশান্ত সরকারকে তিনি চিঠি লিখে জানিয়ে দিয়েছেন আসছেন বলে। সে-ই তাঁর বাড়িতে গিয়ে চাকরদের বলে সব ব্যবস্থা করে রাখবে। প্রশান্ত তাঁর বাল্যবন্ধু। রাঁচির এক মিশনারি স্কুলে মাস্টারি করে। ত্রিদিববাবুর সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই বললেই চলে, যদিও পুরনো বন্ধুর জন্য তিনি এতটুকু করতে রাজি হবেন এটা ত্রিদিববাবু বিশ্বাস করেন।
আশ্চর্য! এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যে ত্রিদিববাবুর ঘুম এসে গেল এটা তিনি নিজেই জানেন না। তাঁরও যে অন্য তিনজন যাত্রীর মতো নাক ডাকে সেটাও কি তিনি জানেন?
.
রাঁচি এক্সপ্রেস আসার টাইম সকাল সোয়া সাতটা। প্রশান্ত সরকার তাঁর ছেলেবেলার বন্ধুকে স্বাগত জানাতে দশ মিনিট আগেই হাজির হয়েছেন স্টেশনে। ইস্কুলে থাকতে ত্রিদিব চৌধুরী ওরফে মণ্টির সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল ঘনিষ্ঠ। ত্রিদিব যখন কলকাতায় কলেজে পড়ত তখনও দুজনের মধ্যে নিয়মিত চিঠি লেখালেখি চলত। কলেজ ছাড়ার পরে এখন দুজনের মধ্যে ব্যবধান এসে পড়ে। এর জন্য দায়ী অবশ্য ত্রিদিববাবুই। বাপ-মা বেঁচে থাকতে তিনি মাঝে মাঝে রাঁচিতে এসেছেন, কিন্তু প্রশান্তকে না জানিয়ে। ফলে অনেকবার এমন হয়েছে দুজনের মধ্যে দেখাই হয়নি। কেন যে এরকম হচ্ছে সেটা প্রশান্ত সরকার বুঝতেই পারেননি। তারপর খবরের কাগজ থেকে জেনেছেন যে, ত্রিদিব চৌধুরী এখন একজন ডাকসাইটে ব্যবসায়ী, অর্থাৎ তিনি এখন প্রশান্তর নাগালের বাইরে। সেটা আরও স্পষ্ট হয় এই সেদিনের। পাওয়া চিঠিটা থেকে। চার লাইনের সংক্ষিপ্ত শুকনো চিঠিতে দুজনের মধ্যে দূরত্বটাই ফুটে ওঠে।
বন্ধুর এই পরিবর্তনে প্রশান্তবাবু খুশি হতে পারেননি। ইস্কুলের সেই সরল হাসিখুশি মন্টুর সঙ্গে এই লাখপতি ত্রিদিব চৌধুরীর যেন কোনও মিল নেই। মানুষ কি বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এতই বদলে যায়? ত্রিদিব চৌধুরীর যে অভাবনীয় আর্থিক উন্নতি হয়েছে সেটা অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু টাকার গরমটাকে কোনওদিনই বিশেষ আমল দেন না প্রশান্ত সরকার। তাঁর চরিত্রের এই বিশেষ দিকটা তাঁর বাবার কাছ থেকে পাওয়া। প্রমথ সরকার ছিলেন গান্ধীভক্ত আদর্শবাদী পুরুষ। প্রশান্তর নিজের জীবনে। তেমন কোনও উত্থান পতন ঘটেনি। একজন ইস্কুল মাস্টারের জীবনে কতই বা রকমফের হবে? তাই আজ তাঁকে দেখলে ছেলেবেলার প্রশান্ত ওরফে পানুকে চিনতে কোনও অসুবিধা হয় না। কিন্তু ত্রিদিব চৌধুরী সম্বন্ধে সেকথা বলা চলে কি? সেটা জানার জন্যই প্রশান্ত সরকার উগ্রীব হয়ে আছেন। ছেলেবেলার বন্ধু আজ লক্ষপতি হয়ে যদি দেমাক দেখাতে আসে তা হলে সেটা বরদাস্ত করা মুশকিল হবে।
ট্রেন এল দশ মিনিট লেটে। মাত্র তিনদিনের জন্য আসা, তাই ত্রিদিববাবু সঙ্গে একটা ছোট সুটকেস আর একটা ফ্লাস্ক ছাড়া আর কিছুই আনেননি। সুটকেসটা প্রশান্তবাবু একরকম জোর করেই নিজের হাতে তুলে নিলেন। তারপর দুজনে রওনা দিলেন স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ট্যাক্সির উদ্দেশে।
অনেকক্ষণ ওয়েট করতে হল নাকি? ত্রিদিব চৌধুরী প্রশ্ন করলেন হাঁটতে হাঁটতে।
এই মিনিট কুড়ি।
তুমি যে আবার স্টেশনে আসবে সেটা ভাবতেই পারিনি। কোনও দরকার ছিল না। আমি তো আর এই প্রথম আসছি না রাঁচিতে।
প্রশান্তবাবু মৃদু হাসলেন, কোনও মন্তব্য করলেন না। চিরকালের অভ্যাস মতো তিনি বন্ধুকে তুই বলার জন্য প্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু বন্ধু তুমি বলাতে সেটা আর হল না।
এখানে সব খবর ভাল তো? জিজ্ঞেস করলেন ত্রিদিববাবু।
হ্যাঁ, সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। অ্যাদ্দিন বাদে বাবু আসছেন জেনে তোমার মালি আর চিন্তামণি খুব একসাইটেড।
চিন্তামণি হল একাধারে রসুয়ে আর চৌকিদার। বাড়িটা বাসযোগ্য আছে তো এখনও? না কি ভূতের বাসায় পরিণত হয়েছে?
প্রশান্তবাবু আবার মৃদু হেসে একটু চুপ থেকে বললেন, ভূতের বাসার কথা জানি না, কিন্তু একটা কথা তোমাকে জানানো দরকার। আমি সেদিন রাত্রে তোমার বাড়ির পাশ দিয়ে যাবার সময় বাগানে একটি বছর দশেকের ছেলেকে খেলতে দেখেছি।
রাত্রে মানে?
বেশ বেশি রাত। সাড়ে এগারোটা। দেখে চমকে গিয়েছিলাম। মনে হল যেন দশ বছরের মন্টু আবার ফিরে এসেছে।
এনিওয়ে–ভূত যে নয় সে তো বোঝাই যাচ্ছে। বাড়ি তো আমার বাবার তৈরি–ওতে কে মরেছে মরেছে সে তো আমার জানা আছে। কথা হল–বাড়িটাকে ঝেড়ে পুঁছে রেখেছে তো?
একেবারে তকতকে। আমি কাল গিয়ে দেখে এসেছি। ভাল কথা–তোমার কাজটা কখন, কোথায়?
আমার নামকাম যেতে হবে আজই দুপুরে, আফটার লাঞ্চ। মহেশ্বর জৈন বলে এক লাক্ষা ব্যবসায়ী থাকেন ওখানে। আড়াইটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট।
বেশ তো, আমরা যে ট্যাক্সিটা এখন নিচ্ছি সেটাই তোমার জন্য ঠিক করা আছে। এখন তোমাকে পৌঁছিয়ে দুপুরে খেয়ে আবার দুটোর মধ্যে তোমার কাছে চলে আসবে। নামকাম যেতে মিনিট দশেকের বেশি লাগবে না।
ট্যাক্সিতে উঠে রওনা হবার পরে প্রশান্ত সরকার জরুরি কথাটা পাড়লেন–তাও সরাসরি নয়, একটু ভণিতা করে।
ইয়ে–তুমি আছ কদ্দিন?
আজ কথা শেষ না হলে কাল আরেকবার যেতে হবে। আমি ফিরছি পরশু।
যা ভারভার্তিক চেহারা হয়েছে তোমার, খোলাখুলি কথা বলতেও সঙ্কোচ হয়।
কী বলতে চাও বলে ফেলো না। ওরকম ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বললেই সন্দেহ হয়।
কিছুই না, সামান্য একটা অনুরোধ। তুমি রাজি হলে তোমার এই বাল্যবন্ধু খুব গ্রেটফুল বোধ করবে।
কী অনুরোধ?
ফাদার উইলিয়ামসকে মনে আছে?
উইলিয়ামস–উইলি, ও সেই লাল দাড়ি?
লাল দাড়ি। সেই উইলিয়ামস বছর পাঁচেক হল একটা ইস্কুল করেছেন গরিব ছেলেদের জন্য। তাতে হিন্দু, মুসলমান, ক্রিশ্চান, কোল সবরকম ছেলেই পড়ে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ব্যাপারটাকে দাঁড় করিয়েছেন ভদ্রলোক। তাঁর খুব ইচ্ছে যে তুমি একবার ইস্কুলটাকে দেখে যাও। কিছুই না, আধঘণ্টার ব্যাপার। ভদ্রলোক খুব উৎসাহিত বোধ করবেন।
গেলেই তো হাত পাতবে।
মানে?
এইসব আমন্ত্রণের পিছনে আসল কথাটা কী সেটা তুমি জানো না? নতুন ইনস্টিটিউশন, টানাটানির ব্যাপার, একজন পয়সাওয়ালা মক্কেলকে ডেকে খানিকটা আপ্যায়ন করে মাথায় হাত বুলিয়ে শেষে ভিক্ষের ঝুলিটা তার সামনে খুলে ধরো। দ্যাখো হে, এ জিনিস আমার কাছে নতুন নয়। এককালে বহুবার এই প্যাঁচে পড়তে হয়েছে। আমি ভুক্তভোগী। চ্যারিটি যদি করতেই হয় তো সে যখন পরকালের চিন্তা করব, তখন। এখন নয়। এখন সঞ্চয়ের সময়। পরোপকারী হিসেবে একবারটি নাম হয়ে গেলে আর নিস্তার নেই। কাজেই আমাকে এ ধরনের রিকোয়েস্ট করতে এসো না, আমি শুনব না। বুঝিয়ে বললে ফাদার নিশ্চয়ই বুঝবেন; আর সে ভার তোমার উপর। এখানে এসে কাজের বাইরে আমি যেটা চাই সেটা হল রেস্ট। কলকাতায় একটা মিনিট ফাঁক নেই।
ঠিক আছে।
এমন একটা প্রস্তাবের যে এই প্রতিক্রিয়া হতে পারে সেটা প্রশান্তবাবু ভাবতে পারেননি। এখন মনে হচ্ছে এটাই স্বাভাবিক। এ মন্টু সেকালের সে মন্টু নয়। এই মানুষটাকে প্রশান্তবাবু চেনেন না।
জন্মস্থানে এসে ত্রিদিববাবুর ভারিকি ভাবটা খানিকটা দূর হয়ে তার জায়গায় একটা প্রসন্নতার আমেজ দেখা দিল। এই সুযোগে প্রশান্তবাবু তাঁর দ্বিতীয় প্রস্তাবটা করলেন।
আমার একটা অনুরোধ তো নাকচ হয়ে গেল, কিন্তু দ্বিতীয়টি ভাই রাখতে হবে। আমার গিন্নি বারবার করে বলে দিয়েছেন তোমায় বলতে যে, আজ রাত্তিরে যেন এই গরিবের বাড়িতে তোমার পায়ের ধুলো পড়ে। খাওয়াটাও ওখানেই সারতে হবে, বলা বাহুল্য। অভাবের সংসার হলেও এটা জোর দিয়ে বলতে পারি যে, সেখানে ত্রিদিব চৌধুরীর সামনে কেউ ভিক্ষের ঝুলি খুলে ধরবে না।
.
ত্রিদিববাবু এ ব্যাপারে আপত্তি করলেন না। করুণাবশত কিনা তাই নিয়ে মাথা ঘামালেন না প্রশান্ত সরকার। তাঁর তাড়া আছে, বাজার সেরে, নাওয়া-খাওয়া সেরে, তারপর ইস্কুল যেতে হবে। বিদায় নেবার সময় তিনি বলে গেলেন যে, আটটা নাগাদ নিজে এসে তিনি ত্রিদিববাবুকে নিয়ে যাবেন।–আর দশটার মধ্যে খাইয়ে-দাইয়ে তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেব, এ গ্যারান্টি দিচ্ছি।
ত্রিদিব চৌধুরীর ব্যক্তিত্ব আর তাঁর তীক্ষ্ণ বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তা–এই দুটোই যে তাঁর সাফল্যের অন্যতম প্রধান কারণ সেটা আজ আরেকবার প্রমাণ হয়ে গেল। রাঁচিতে আসা বৃথা হয়নি। তাঁর নানান ব্যবসার সঙ্গে লাক্ষা যুক্ত হয়ে তাঁর জীবনটাকে আরেকটু জটিল করে তুলল সেটা ঠিক, কিন্তু সেইসঙ্গে অতিরিক্ত আয়ের কথাটা ভাবলে আর আক্ষেপ করার কোনও কারণ থাকে না। ৪২৪
পাঁচটা নাগাত বাড়ি ফিরে চা খেয়ে ত্রিদিববাবু একবার তাঁর জন্মস্থানটা ঘুরে দেখলেন। দোতলা বাড়ি; একতলায় বৈঠকখানা, খাবার ঘর, গেস্টরুম আর রান্নাঘর, দোতলায় দুটো বেডরুম, বাথরুম, আর একটা বেশ বড় পশ্চিমমুখী ঢাকা বারান্দা। দুটোর মধ্যে ছোট বেডরুমটা ছিল ত্রিদিববাবুর ঘর।
ছেলেবেলার তুলনায় এখন সেটাকে অনেক ছোট বলে মনে হয়, কারণ তিনি নিজেই শুধু বড় হয়েছেন, ঘর যেমন ছিল তেমনই আছে। ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে খাটটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ত্রিদিববাবু স্থির করলেন আজ রাত্রে সেখানেই শশাবেন। চিন্তামণি সকালেই জিজ্ঞেস করেছিল, কিন্তু তিনি তখনও মনস্থির করে উঠতে পারেননি। রাত্রে বেরোবার মুখে চাকরকে ডেকে ছোট ঘরে বিছানা করার কথা বলে দিলেন।
প্রশান্ত সরকারের স্ত্রী বেলা সুগৃহিণী এবং রন্ধনে সুনিপুণা, তাই খাওয়াটা হল পরিপাটি। ভোজের ব্যাপারে প্রশান্তবাবু কোনও কার্পণ্য করেননি। বন্ধুকে মাংস, দুরকম মাছ, পোলাও, লিচু, তিনরকম মিষ্টি ও মালাই খাইয়েছেন। ত্রিদিববাবু তৃপ্তির সঙ্গেই খেয়েছেন। কিন্তু খাবার পরে দশ মিনিটের বেশি বসেননি। তাঁর বর্তমান অবস্থা, এবং তিনি কীভাবে সেই অবস্থায় পৌঁছলেন, সে সম্পর্কে প্রশান্তবাবুর কৌতূহল আর মিটল না। পৌনে দশটার মধ্যে ত্রিদিবাবু নিজের বাড়িতে ফিরে এলেন।
বাড়িটা শহরের একটা অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি অংশে। পাড়া এর মধ্যেই নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। ত্রিদিববাবু সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ওঠার সময় তাঁর নিজের পায়ের আওয়াজ নিজের কাছেই দুরমুশের মতো মনে হল।
দোতলায় এসে ত্রিদিববাবু দেখলেন যে, তাঁর ছেলেবেলার খাটে তাঁর জন্য বিছানা পাতা হয়ে গেছে। সবেমাত্র খাওয়া হয়েছে, তাই তিনি স্থির করলেন যে কিছুক্ষণ বারান্দায় আরাম কেদারায় বসে বিশ্রাম করে তারপর শুতে যাবেন।
হেলানো চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে আধঘণ্টার মধ্যেই তিনি অনুভব করলেন যে, সারাদিনের সমস্ত অবসাদ চলে গিয়ে তিনি আশ্চর্য হালকা ও শান্ত বোধ করছেন। বাইরে ফিরে চাঁদের আলো, বাগানের একটা নেড়া শিরীষ গাছের ছড়ানো কালো ডালগুলোর দিকে তাঁর দৃষ্টি। ত্রিদিববাবু বুঝতে পারলেন যে তিনি নিজের নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছেন। সমস্ত বিশ্বচরাচরে যেন সেটাই একমাত্র শব্দ।
তাই কি?
না, তার সঙ্গে আরেকটা শব্দ যোগ হল। একটা ক্ষীণ কণ্ঠস্বর। সেটা কোত্থেকে আসছে বলা কঠিন।
মনোযোগ দিয়ে শুনে ত্রিদিববাবু বুঝলেন যে, সেটা কোনও অল্পবয়স্ক ছেলের গলায় আবৃত্তির শব্দ। কবিতাটা তাঁর ভীষণ চেনা।
ক্ষীণ হলেও কণ্ঠস্বর স্পষ্ট, প্রত্যেকটি কথা পরিষ্কার।
–রথের দিনে খুব যদি ভিড় হয়
একলা যাব, করব না ত ভয়–
মামা যদি বলেন ছুটে এসে
হারিয়ে যাবে, আমার কোলে চড়ো
বলব আমি, দেখছ না কি মামা
হয়েছি যে বাবার মতো বড়ো–
আমায় দেখে মামা বলবে, তাই-তো,
খোকা আমার সে খোকা আর নাই তো।–
এতদিন যেন ত্রিদিব চৌধুরীর স্মৃতির কোণে লুকিয়ে ছিল কবিতাটা; আজ শুনে আবার নতুন করে মনে পড়ছে।
আবৃত্তি ক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসছে। ত্রিদিববাবু উঠে পড়লেন চেয়ার থেকে। মনটাকে পিছনের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া কোনও কাজের কথা নয়। আসল হল ভবিষ্যৎ; অতীত নয়। তিনি জানেন ভবিষ্যতে তাঁকে আরও অনেক উপরে উঠতে হবে, লাখপতি থেকে কোটিপতি হতে হবে। অতীত মানে তো যা ফুরিয়ে গেছে, শুকিয়ে গেছে, শেষ হয়ে গেছে। অতীতের চিন্তা মানুষকে দুর্বল করে, আর ভবিষ্যতের আশা তাকে সবল করে, সক্রিয় করে।
নিজের শোয়ার ঘরে গিয়ে ত্রিদিববাবু ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন। শহরে এখন লোডশেডিং, খাটের পাশে টেবিলের উপর একটা মোমবাতি টিমটিম করে জ্বলছে, তার মৃদু আলোতেই তিনি স্পষ্ট দেখলেন যে, বিছানাটা ভাল করে পাতা হয়নি, চাদর বালিশ দুটোই কুঁচকে আছে। হাত দিয়ে চাপড় মেরে সেগুলোকে টান করে দিয়ে, পাঞ্জাবি খুলে আলনায় রেখে ত্রিদিববাবু খাটে শুয়ে পড়লেন। মোমবাতিটা জ্বলবে কি? কোনও দরকার নেই। একফুঁয়ে সেটাকে নিভিয়ে দিলেন ত্রিদিববাবু। পোড়া মোমের উগ্র গন্ধ কিছুক্ষণ বাতাসে ঘোরাফেরা করে মিলিয়ে গেল। পশ্চিমের জানলা দিয়ে আকাশ দেখা যাচ্ছে। রাতের আকাশ চাঁদের আলোয় ফিকে। পায়ের দিকে ঘরের দরজা। দরজা দিয়ে বাইরে বারান্দা ও বাঁয়ে সিঁড়ির মুখটা দেখা যাচ্ছে। সিঁড়ির দিকে দৃষ্টি যাবার কথা নয়, কিন্তু ত্রিদিববাবুর মনে হল তিনি যেন একটা পায়ের আওয়াজ পাচ্ছেন। খালি পায়ে থপথপ করে সিঁড়ি দিয়ে ওঠার শব্দ।
কিন্তু কেউ এল না। শব্দটা যেন মাঝর্সিড়িতে থেমে গেল।
হঠাৎ ত্রিদিববাবুর মনে হল তিনি অনর্থক ছেলেমানুষি কল্পনাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। সব ভৌতিক চিন্তা এক ঝটকায় মন থেকে দূর করে দিয়ে তিনি শক্ত করে চোখ বন্ধ করে ঘুমোবার চেষ্টায় প্রবৃত্ত হলেন। একতলায় খাবার ঘরের জাপানি ঘড়িতে ঢং ঢং করে এগারোটা বাজল। ঘড়িটা এতদিন বন্ধ ছিল। আজই সকালে ত্রিদিববাবু আবার সেটাকে চালু করে দিয়েছেন।
ঘড়ির শেষ ঢং মিলিয়ে যাওয়ায় নৈঃশব্দ্য যেন আরও বেড়ে গেল।
ত্রিদিববাবুর চোখ বন্ধ, এবং সেই বন্ধ চোখেই যেন তিনি টুকরো টুকরো ঝাঁপসা ছবি দেখতে শুরু করেছেন। তিনি জানেন যে এটা ঘুমের পূর্বাভাস। ওই টুকরো ছবিগুলো আসলে স্বপ্নের টুকরো। মানুষ গান করার আগে যেমন গুনগুন করে সুর ঠিক করে নেয়, এই টুকরো ছবিগুলো হল আসলে স্বপ্ন শুরু হবার আগে স্বপ্নের গুনগুনানি।
কিন্তু স্বপ্নের সময় এখনও আসেনি। চোখ বন্ধ অথচ সম্পূর্ণ সজাগ অবস্থাতেই ত্রিদিববাবু তাঁর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করলেন যে ঘরে যেন কে ঢুকেছে। না, শুধু ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় নয়, শ্রবণেন্দ্রিয়ও বটে। ত্রিদিববাবু নিশ্বাসের শব্দ পাচ্ছেন। কেউ যেন দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে ঢুকে দাঁড়িয়ে পড়ে দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে।
লোক দেখতে পাবেন এই দৃঢ় বিশ্বাসে চোখ খুলে ত্রিদিববাবু বুঝলেন যে, তিনি ভুল করেননি।
দরজার মুখে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে, বছর দশেক বয়স, আর ডান হাতটা আলতো করে দরজার উপর রাখা, বাঁ পা-টা একটু সামনের দিকে এগোনো। ছেলেটি যেন ঘরে ঢুকতে গিয়ে তোক দেখে থেমে গেছে।
ত্রিদিববাবু অনুভব করলেন একটা ঠাণ্ডা ভাব তাঁর পা থেকে শুরু করে মাথার দিকে উঠে আসছে শিরদাঁড়া বেয়ে। প্রশান্ত বলেছিল একটি ছেলেকে দেখেছে, বাগানে…খেলছিল…ছেলেবেলার মন্টু…
ছেলেটি নিঃশব্দে আরও তিন পা এগিয়ে এল। এখন সে খাট থেকে চার হাত দূরে। ছেলেবেলার মন্টু…
ত্রিদিববাবুর হাত পা বরফ, মাথা ঝিমঝিম করছে। তিনি বুঝতে পারছেন এবার তিনি চোখে অন্ধকার দেখবেন, তাঁর আতঙ্ক চরমে পৌঁছেছে।
ছেলেটি আরেক পা এগোল। বেগুনি শার্ট…এই শার্ট তো…
সংজ্ঞা হারাবার ঠিক আগের মুহূর্তে ত্রিদিববাবু রিনরিনে গলায় প্রশ্ন শুনলেন।
আমার বিছানায় কে শুয়ে?
.
তাঁর কখন জ্ঞান হয়েছিল, বা আদৌ হয়েছিল কিনা, আর তারপর কখন তিনি আবার ঘুমিয়ে পড়েছেন, এসব কিছুই জানেন না ত্রিদিববাবু। সকালে যথারীতি সাড়ে ছটায় ঘুম ভেঙে গেল। প্রশান্ত বলেছে সাড়ে সাতটায় এসে তাঁর সঙ্গে ব্রেকফাস্ট করবে। রাত্রে যা ঘটল, তারপর তিনি মামুলি দৈনন্দিন কাজের কথা ভাবতেই পারছেন না। জীবনে তিনি প্রথম এমন ধাক্কা খেলেন। কাল চাঁদনি রাতে যে আবৃত্তি শুনেছিলেন সেই আবৃত্তি করে তিনি ইস্কুলে প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলেন। আর দ্বিতীয়? দ্বিতীয় হয়েছিল প্রশান্ত সরকার। তাতে মন্টু খুশি হয়নি। দুজনেই ফার্স্ট প্রাইজ পেলে দারুণ হত, না রে? মন্টু বলেছিল তার প্রাণের বন্ধু পানুকে।
আর ঘরে যে ছেলেটি এল তার মুখ বোঝা যায়নি, কিন্তু শার্টের রঙ যে বেগুনি সেটা দেখেছিলেন ত্রিদিববাবু। এই বেগুনি শার্ট–তাঁর সবচেয়ে প্রিয় শার্ট–যেটা তাঁকেই জন্মদিনে দিয়েছিলেন তাঁর ছোটমাসি, সেটা কি তিনি ভুলতে পারেন? ওই শার্ট পরে যেদিন প্রথম স্কুলে গেলেন সেদিন পানু বলেছিল, তোকে ঠিক সাহেবের মতো দেখাচ্ছে রে মন্টু।
এই অদ্ভুত ভৌতিক অভিজ্ঞতার মানেও তাঁর কাছে স্পষ্ট। আজকের ত্রিদিবের সঙ্গে ছেলেবেলার ত্রিদিবের কোনও মিল নেই। ছেলেবেলার সেই মন্টু ছেলেবেলাতেই মরে গেছে। আর তার ভূত এসে কাল জানিয়ে গেছে যে, লাখপতি ত্রিদিব চৌধুরীকে সে মোটেই বরদাস্ত করতে পারছে না।
.
প্রশান্তবাবুকে রাত্রের ঘটনা কিছুই বললেন না ত্রিদিববাবু। তবে এটা তিনি বুঝতে পারছিলেন যে, শত চেষ্টা করেও তিনি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হতে পারছেন না। তাই বোধহয় প্রশান্তবাবু এক সময় প্রশ্ন করলেন, তোমার কী হয়েছে বলো তো? রাত্রে ভাল ঘুম হয়নি নাকি?
ত্রিদিববাবু গলা খারিয়ে বললেন, না,–ইয়ে, আমি ভাবছিলাম, মানে, দুদিনের কাজ যখন একদিনেই হয়ে গেল, তখন আজ একবার ফাদার উইলিয়ামসের স্কুলটা দেখে এলে হত না?
উত্তম প্রস্তাব। উৎফুল্ল হয়ে বললেন প্রশান্ত সরকার। মুখের হাসি ছাড়া অন্তরের একটা গোপন হাসিও হাসলেন তিনি, কারণ তাঁর ফন্দি আশ্চর্য ভাবে কাজ দিয়েছে। ফেরার পথে তাঁর প্রতিবেশী নন্দ চক্রবর্তীর ছেলে বাবলুকে বলে যেতে হবে যে, তার কাল রাত্তিরের আবৃত্তি আর অভিনয় চমৎকার হয়েছে। আর সেইসঙ্গে অবিশ্যি চিন্তামণিকে একটা ভালরকম বকশিশ দিতে হবে।
সন্দেশ, মাঘ ১৩৯১
Post a Comment