ঠাকুরদার সিন্দুক রহস্য – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
সময়টা ছিল নভেম্বরের গোড়ার দিকে এক রবিবারের সকালবেলা। ইলিয়ট রোড এলাকায় কর্নেলের তিনতলার অ্যাপার্টমেন্টে তার জাদুঘরসদৃশ ড্রয়িংরুমে আড্ডা দিচ্ছিলুম। কর্নেল গভীর মনোযোগে টাইপরাইটারে কীসব টাইপ করছিলেন। মাঝে-মাঝে তিনি পোস্টকার্ড সাইজ কীসের রঙিন ছবি তুলে দেখছিলেন এবং আবার টাইপে মন দিচ্ছিলেন। অবশেষে বুঝতে পেরেছিলুম, তিনি বিরল প্রজাতির পাখি-প্রজাপতি-অর্কিড কিংবা ক্যাকটাস সম্পর্কে প্রবন্ধ লিখছেন। দেশে ও বিদেশে প্রকৃতিবিজ্ঞানী হিসেবে খ্যাতি তার কম নয়। এই বৃদ্ধ বয়সেও যে-কোনো শক্তিমান যুবকের মতো তিনি দুর্গম পাহাড়-জঙ্গল-মরুভূমি চষে বেড়াতে পারেন। লক্ষ করছিলুম, দাঁতে-কামড়ানো চুরুটের নীল একফালি ধোঁয়া উঠে তার প্রশস্ত টাকের ওপর ঘুরপাক খেতে-খেতে মিলিয়ে যাচ্ছিল। ঝকঝকে সাদা দাড়িতে চুরুটের একটুকরো ছাই আটকে ছিল। জানতুম টাইপ করা শেষ না হলে ছাইটুকু খসে পড়ার সম্ভাবনা নেই।
সোফার এককোণে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন প্রাইভেট ডিটেকটিভ কৃতান্তকুমার হালদার–আমাদের প্রিয় হালদারমশাই’। তার ডানহাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনীর চিমটিতে একটুখানি নস্যি। কখন সেটা নাকে খুঁজবেন বোঝা যাচ্ছিল না।
হালদারমশাই একজন প্রাক্তন পুলিশ অফিসার। রিটায়ার করার পর একটা প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলেছেন। মাঝে-মাঝে তার এই এজেন্সির বিজ্ঞাপন দেন। কখনও-সখনও দু-একটা কেসও পান। কে জটিল হলে তিনি কর্নেলস্যারের লগে কনসাল্ট করতে আসেন। তবে আজ তাঁর হাবভাব দেখে বুঝতে পেরেছিলুম, কোনো কেসের ব্যাপারে কর্নেলের কাছে আসেননি।
নভেম্বর মাস শুরু হয়ে গেলেও এখনও কলকাতায় শীতের কোনো সাড়া নেই। প্রশস্ত ড্রয়িংরুমে দুটো সিলিংফ্যান পূর্ণ বেগে ঘুরছিল। একসময় নস্যি নাকে খুঁজে প্যান্টের পকেট থেকে নোংরা রুমাল বের করে নাক মুছলেন গোয়েন্দাপ্রবর কে. কে. হালদার। তারপর আপনমনে বললেন,–পড়বার মতন খবর নাই। জয়ন্তবাবু! আপনাগো দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা কী যেসব ল্যাখে, বুঝি না। খালি ন্যাতাগো বক্তৃতা। বক্তৃতা কি খবর? খবর কই গেল?
খবর আছে হালদারমশাই!-কর্নেল বলে উঠলেন। দেখলুম, এতক্ষণে তার টাইপ করা শেষ হয়েছে। কাগজগুলো গুছিয়ে ছবিগুলো তার সঙ্গে ক্লিপে এঁটে তিনি একটা প্রকাণ্ড খামে ঢোকাচ্ছিলেন। তাঁর দাড়ি থেকে চুরুটের ছাইটা এবার খসে পড়ে গেছে। হালদারমশাইয়ের দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে তিনি আবার বললেন, আপনার পড়ার মতো খবর জয়ন্তদের কাগজেই আছে। হালদারমশাই কর্নেলের দিকে গুলিচোখে তাকিয়ে বললেন,–কী খবর আছে কর্নেলস্যার?
–ছয়ের পাতায় মফস্বলের খবর দেখুন! তিন নম্বর কলামে বোল্ড টাইপে ছাপা!
গোয়েন্দাপ্রবর দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার পাতা উল্টে একটু ঝুঁকে বসে বিড়বিড় করে কী একটা খবর পড়তে শুরু করলেন।
একটু পরে তিনি খিখি করে হেসে উঠলেন,–অ্যাঁ? মৎস্যজীবীদের জালে মুণ্ডুকাটা কালো কুকুর! এটা কী হইল? মুকাটা মাইনষের বডি হইলে কথা ছিল। মুণ্ডুকাটা কুত্তার লাশ!
কর্নেল খামটা ড্রয়ারে ভরে সোফার কাছে তাঁর ইজিচেয়ারে এসে বসলেন। মিটিমিটি হেসে বললেন,–মুণ্ডুকাটা কালো কুকুরের লাশ আপনার খবর বলে মনে হচ্ছে না হালদারমশাই?
হালদারমশাই বললেন,–বুঝলাম না কর্নেলস্যার। জয়ন্তবাবু কই, মশায়! আপনাগো সাংবাদিকগো হাতে যখন ল্যাখনের মতো খবর থাকে না, তখন মুণ্ডুকাটা কালো কুত্তারে খবর কইরা ফ্যালেন!
বললুম,–কর্নেল ঠিক ধরেছেন। আপনি ধরতে পারেননি।
–ক্যান?
–চিন্তা করে দেখুন! দেবতার সামনে মুণ্ডু কেটে বলিদান করা হয় পাঁঠা। কোথাও কোথাও মোষের মুণ্ডু কেটেও বলিদানের প্রথা আছে। প্রাচীন যুগে নাকি এইভাবে নরবলির প্রথাও ছিল। কিন্তু কুকুর বলিদান! কোন দেবতা কুকুর-বলি পেলে খুশি হন? এটা একটা রহস্য না?
প্রাইভেট ডিটেকটিভ হাসলেন,–নাঃ। পোলাপানগো কাম। মশায়! চৌতিরিশ বৎসর পুলিশে চাকরি করছি! পাড়াগাঁয়ে দেখছি, পোলাপানরা শেয়ালের ছানার মুণ্ডু কাটত। বড়রা বাধা দিত না। ক্যান কী, শেয়াল অগো ছাগল, হাঁস-মুরগি খাইয়া ফ্যালে! কিন্তু কুত্তা হইল গিয়া উপকারী প্রাণী। রাত্রে পাড়ায় চোর ঢুকলে কুত্তা চাঁচাইয়া মাইনষেরে সাবধান করে।
কর্নেল বললেনে,–হালদারমশাই! আপনি নিজেই কুকুর-বলির রহস্য ফাঁস করে দিলেন কিন্তু!
–ফাঁস করলাম! কন কী কর্নেলস্যার?
–হ্যাঁ। পাড়ায় রাতবিরেতে চোর ঢুকলে কুকুর চ্যাঁচামেচি করে মানুষকে সাবধান করে। এটা আপনারই কথা। কাজেই চোরেরা সেই কুকুরকে রাগের বশে বলি দিতেই পারে। আর একটা কথা। খবরের শেষ লাইনটা আপনি পড়েননি।
হালদারমশাইয়ের গোঁফের দুই ডগা উত্তেজনায় তিরতির করে কঁপছিল। তিনি খবরের কাগজ তুলে আবার বিড়বিড় করে পড়তে থাকলেন। তারপর শেষ লাইনটা আওড়ালেন : খবর পেয়ে। দোমোহানির থানার পুলিশ মৎস্যজীবীদের কাছ থেকে মুণ্ডুকাটা কালো কুকুরের লাশ উদ্ধার করেছে।
কর্নেল বললেন,–কী বুঝলেন এবার?
হালদারমশাই চাপাগলায় বললেন,–পুলিশ! তা হইলে খবরের একখান ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। কিন্তু দোমোহানির নিজস্ব সংবাদদাতা তা ল্যাখে নাই ক্যান, বুঝি না।
আমি বললুম,–নিজস্ব সংবাদদাতাদের পাঠানো খবর জায়গার অভাবে কেটেছেটে ছাপানো হয়।
ঠিক এই সময় ডোরবেল বাজল। কর্নেল যথারীতি হাঁক দিলেন,–ষষ্ঠী!
কর্নেলের এই ড্রয়িংরুমে ঢুকতে হলে ডাক্তারবাবুদের জন্য অপেক্ষারত রোগীদের ঘরের মতো একটা ঘর পেরিয়ে আসতে হয়। কর্নেলের ওই ঘরটা অবশ্য ছোট। ষষ্ঠী আগন্তুককে ভিতরে পাঠিয়ে দিয়ে ওদিকের করিডোর হয়ে নিজের ঘর বা কিচেনে চলে যায়। কর্নেলের কাছে সকলের জন্য দরজা খোলা, তা ষষ্ঠী জানে।
যাই হোক, একটু পরে ড্রয়িংরুমের পর্দার ফাঁকে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোককে দেখা গেল। তিনি পা থেকে জুতো খোলর পর জুতো দুটো হাতে নিয়ে ঢুকছিলেন। কর্নেল বললেন, আপনি ইচ্ছে করলে জুতো পরেই ঢুকতে পারেন। আর যদি জুতো ওঘরে খুলে রেখেই ঘরে ঢোকেন, আপনার জুতো চুরি যাবে না।
ভদ্রলোক কাচুমাচু মুখে হাসবার চেষ্টা করে বললেন,–আজ্ঞে অভ্যেস!
–তার মানে বাইরে জুতো খুলে কোথাও ঢুকলে আপনার জুতো চুরি হয়।
–আজ্ঞে স্যার! ঠিক ধরেছেন।
–এ পর্যন্ত কতজোড়া জুতোচুরি গেছে?
–পাঁচজোড়া স্যার! আমার দুঃখের কথা আর কাকে বলব? অবশেষে আমার মাসতুতো ভাই পরেশ-পুলিশে চাকরি করে স্যার, সে-ই আপনার নাম-ঠিকানা দিল। আপনার চেহারার বর্ণনাও দিল। পরেশ বলল, এর বিহিত পুলিশ করতে পারবে না। তুমি কর্নেলস্যারের কাছে যাও। তাই এলুম! তা-তাহলে জুতো পরেই ঢুকি?
কর্নেল গম্ভীরমুখে বললেন,–হ্যাঁ। দেখছেন না, আমরা জুতো পরেই আছি!
যে ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন, তার পরনে সাদাসিধে প্যান্ট-শার্ট, কাঁধ থেকে একটা কাপড়ের ব্যাগ ঝুলছে এবং ব্যাগের ভিতর থেকে একটা সোয়েটার উঁকি দিচ্ছে। খাড়া নাকের নীচের প্রজাপতি-ছাঁট গোঁফ আর সিঁথে করা কঁচাপাকা চুলে ঈষৎ শৌখিনতার ছাপ। পায়ের পামশুজোড়া নতুন তা বোঝা যাচ্ছিল। এ-ও বোঝা যাচ্ছিল, ইনি যেখান থেকে আসছেন, সেখানে শীত এসে গেছে। কারণ তিনি কলকাতায় এসেই গায়ের সোয়েটার খুলে ব্যাগে ঠেসে ঢুকিয়ে রেখেছেন।
ভদ্রলোক সোফায় বিনীতভাবে বসে প্রথমে কর্নেলকে, পরে হালদারমশাই ও আমাকে করজোড়ে নমস্কার করলেন। তারপর বললেন, আমার নাম জয়গোপাল রায়। রেলে চাকরি করতুম। আজ এখানে, কাল সেখানে বদলির চাকরি। থিতু হয়ে কোথাও বসতে পারিনি যে বাড়ি-ঘর করব। আর করেই বা কী হবে? বাবুগঞ্জে পৈতৃক একতলা একখানা বাড়ি আছে। সেখানে আমার বিধবা বোনকে থাকতে দিয়েছিলুম। চাকরি থেকে গত মাসে রিটায়ার করার পর সেই বাড়িতেই চলে এসেছি, তারপর থেকেই এক উটকো বিপদ!
কর্নেল বললে,–জুতোচুরি?
–আজ্ঞে কর্নেলসায়েব! প্রথমে চুরি গেল পুরোনো পামশুজাড়া। সন্ধ্যাবেলা ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছিল। গোবিন্দ-কোবরেজের ঘরে আড্ডা দিচ্ছিলুম। বাড়ি ফেরার সময় দেখি, সকলের জুতো আছে। আমার জোড়া নেই। সেই শুরু। কিন্তু তখন তলিয়ে কিছু ভাবিনি। আবার বাজার থেকে নতুন একজোড়া জুতো কিনলুম। দিন-তিনেক পরে মুখুজ্যেমশাইয়ের ঠাকুরবাড়িতে কথকতা শুনতে ঢুকেছিলুম। দরজার বাইরে জুতো খুলে রেখেছিলুম। কথকতা শেষ হল রাত দুটোয়। বেরিয়ে এসে আমার জুতোজোড়া আর খুঁজেই পেলুম না।
–তা হলে এইভাবে আপনার মোট পাঁচজোড়া জুতো চুরি হয়েছে?
–হ্যাঁ কর্নেলসায়েব। তারপর থেকে সতর্ক হয়েছিলুম। যেখানে ঢুকি, জুতোজোড়া হাতে নিয়েই ঢুকি কিন্তু এবার শুরু হল আরেক বিপদ! রাতবিরেতে বাড়ির আনাচে-কানাচে কারা ঘুরঘুর করতে আসে।
–সেটা টের পান কী করে?
–আজ্ঞে কালু। আমার বোনের পুষ্যি একটা কালো তাগড়াই কুকুর ছিল। তার নাম কালু। সে চ্যাঁচামেচি জুড়ে দিত। তখন আমি আর আমার বোন হৈমন্তী ঘর থেকে বেরিয়ে হাঁকডাক করে পড়শিদের জাগাই। তারা লাঠিসোটা, টর্চ নিয়ে বাড়ির চারদিকে খোঁজাখুঁজি করে। তবে দেখুন স্যার, দু-একদিন অন্তর এরকম হলে পড়শিরা বিরক্ত হয় না? দোষটা গিয়ে পড়ত কালুর ঘাড়ে।
কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে শুনছিলেন। বললেন,–হুঁ। তারপর?
জয়গোপালবাবু জোরে শ্বাস ছেড়ে বললেন,–বাবুগঞ্জে বিদ্যুৎ আছে। কিন্তু চোর আসে রাতবিরেতে, হঠাৎ যদি লোডশেডিং হয়, তখন। তো গত মঙ্গলবার ভোরবেলা উঠে দেখি সাংঘাতিক কাণ্ড। কাড়ির দরজার সামনে রক্তের ছড়াছড়ি। চাপ-চাপ রক্ত। চমকে উঠেছিলুম। কে কাকে আমার বাড়ির দরজার সামনে খুন করেছে ভেবে। তারপর চোখে পড়ল দরজার পাশে দেওয়াল থেকে–
–কালুর মুণ্ডু ঝুলছে?
জয়গোপালবাবু নড়ে বসলেন,–আপনি খবর পেয়েছেন স্যার? তক্ষুনি থানায় গিয়েছিলুম। পুলিশ এসেছিল। সে এক হইচই ব্যাপার! হৈমন্তী কালুর শোকে কেঁদেকেটে অস্থির। কর্নেলসায়েব! পরেশ বলছিল, আপনার নাকি পিছনেও একটা চোখ আছে। ওরে বাবা! সে এক বীভৎস দৃশ্য! আপনি নিশ্চয়
কর্নেল তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আপনি খবরের কাগজ পড়েন?
জয়গোপালবাবু কিছু বলার আগেই গোয়েন্দাপ্রবর হালদারমশাই বলে উঠলেন,–সেই কুত্তার বডি উঠছে মৎস্যজীবীগো জালে! কর্নেলস্যার ঠিকই কইছিলেন। কুকুর-বলির রহস্য ঠিকই ফাস করছিলাম।
জয়গোপালবাবু অবাক চোখে তাকিয়ে বললেন,–খবরের কাগজ নিয়মিত পড়ি না। কিন্তু উনি বলছেন মৎস্যজীবী–মানে জেলেদের জালে কুকুরের বডি উঠেছে। কিছু বুঝতে পারছি না!
কর্নেল একটু হেসে বললেন,–পুলিশ আপনাকে খবর দেয়নি?
–আজ্ঞে না তো!
–বাড়ি ফিরে হয়তো আপনার বোনের কাছে জানতে পারবেন, পুলিশ আপনাদের হতভাগ্য কালুর লাশ উদ্ধার করেছে। আপনার বাড়ি বাবুগঞ্জে। নদীর ধারেই গঞ্জ গড়ে ওঠে। আপনাদের বাবুগঞ্জের নদীটার নাম কী?
–বেহুলা। একসময় নাকি বড় নদী ছিল। এখন প্রায় মজে এসেছে।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ বললেন, আপনাগো কুত্তাটার মাথা চোরেরা কাটল ক্যান তা কি বুঝছেন?
জয়গোপালবাবু বিব্রতভাবে বললেন,–চ্যাঁচামেচি করত বলে।
রাত্রে জুতোচোরেরা আপনার জুতো চুরি করতে আইলে কুত্তাটা চ্যাঁচামেচি করত–বলে হালদারমশাই কর্নেলের দিকে ঘুরলেন,–কর্নেলস্যার! একটা কথা বুঝি না। চোরেরা ভদ্রলোকের জুতো চুরি করে ক্যান? হেভি মিস্ত্রি।
কর্নেল হাসলেন, ঠিক বলেছেন হালদারমশাই! হেভি মিস্ত্রি। আচ্ছা জয়গোপালবাবু, কেউ. বা কারা আপনার জুতো চুরি করে কেন, একথা কি ভেবে দেখেছেন?
জয়গোপালবাবু করুণমুখে বললেন, অনেক ভেবেছি কর্নেলসায়েব। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারিনি!
–আপনার বোন হৈমন্তীদেবীর কী ধারণা?
–সে-ও কিছু বুঝতে পারছে না। হৈমন্তী কান্নাকাটি করে চুপিচুপি বলছিল, কালুকে চিরকালের জন্য চুপ করাতে চেয়েছে কেউ বা কারা, তা ঠিক। কিন্তু তার মনে একটা আতঙ্ক ঢুকেছে। কালুকে মারল, মারল, কিন্তু তার মাথা কেটে দোরগোড়ায় ঝোলালো কেন? তার আতঙ্কের কারণ, হয়তো এরপর আমার মাথা কেটে ফেলবে, ওটা তারই নোটিস! হৈমন্তীর ধারণা, রেলে চাকরি করার সময় আমি কারওর কোনো ক্ষতি করেছিলুম। আমি ওকে বলেছি, আমি ছিলুম রেলের সামান্য কেরানি। জ্ঞানত কারও কোনো ক্ষতি করিনি।
কর্নেল ইজিচেয়ারে সোজা হয়ে বসে বললেন,–আপনার বাবা কী করতেন?
–বাবাও রেলে চাকরি করতেন। বাবা অবশ্য রেলে গার্ড ছিলেন। কাটিহারে মারা যান।
–আপনাদের বাড়িটা কে তৈরি করেছিলেন?
–আমার ঠাকুরদা বিনয়গোপাল রায়।
–তিনি কী করতেন?
–ঠাকুরদা বাবুগঞ্জে মুখুজ্যেমশাইয়ের জমিদারির সেরেস্তায় খাজাঞ্চি ছিলেন।
হালদারমশাই জিজ্ঞেস করলেন,–খাজাঞ্চি? সেটা কী পোস্ট?
কর্নেল বললেন,–ট্রেজারার বলতে পারেন। পুরোনো আমলে জমিদারদের খাজাঞ্চিখানা থাকত। অর্থাৎ ট্রেজারি। প্রজাদের খাজনা আদায় করে সেখানে রাখা হত। তাছাড়া জমিদারবাড়ির পারিবারিক সম্পদ, ধনরত্ন এসব কিছুই খাজাঞ্চিখানায় জমা থাকত। খাজাঞ্চি ছিলেন একাধার তদারককারী, আর ক্যাশিয়ার। কোষাধ্যক্ষ বলতে পারেন।
গোয়েন্দাপ্রবর গম্ভীরমুখে বললেন,–হঃ! বুঝছি।
কর্নেল বললেন,–জয়গোপালবাবু! আপনার ঠাকুরদাকে আপনি দেখেছেন?
–আজ্ঞে না। আমার জন্মের আগে তিনি মারা যান। ওদিকে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পর মুখুজ্যেপরিবারের লোকেরা কে কোথায় চলে যায়।
-এখন বাবুগঞ্জে কোন মুখুজ্যে আছেন?
-আজ্ঞে স্যার, প্রমথ মুখুজ্যেমশাই। সেই সাতমহলা বাড়ি এখন ধ্বংসস্তূপ। প্রমথবাবুর হাতে কিছু জমিজিরেত আছে। নিজেই দেখাশোনা করেন। মেকানাইজড় এগ্রিকালচার। বুঝলেন তো?
কর্নেল একটু হেসে বললেন,–বুদ্ধিমান লোক।
জয়গোপালবাবু আড়ষ্টভাবে হাসলেন,তা আর বলতে? ভাগচাষিদের ভাগিয়ে দিয়ে পাওয়ারটিলার আর সেচের জন্য পাম্পিং মেশিন কিনে রীতিমতো ফার্মহাউস করে ফেলেছেন। দোতলা নতুন বাড়ি করেছেন। তবে ঠাকুরবাড়িটা পুরোনো আমলের।
–আপনার জুতোচুরির কথা তাকে কি আপনি বলেছেন?
–বলিনি। বলে কী হবে? আমার বোন হৈমন্তী ছাড়া আর কেউ জানে না।
–পুলিশকে জানাননি?
জয়গোপালবাবু চাপাস্বরে বললেন,–হৈমন্তী নিষেধ করেছিল। পুলিশ জুতোচুরির কথা শুনলে হাসবে। বরং রাতবিরেতে বাড়িতে চোরের উৎপাতের কথা বলাই ঠিক হবে। তাই আমি পুলিশকে শুধু চোরের কথাই বলেছিলুম। তবে দেখুন কর্নেলসায়েব, দু-একটা মিথ্যা নালিশ না করলে কেস শক্ত হবে না। তাই পুলিশকে বলেছিলেন, চোর রান্নাঘর থেকে থালা-ঘটি-বাটি চুরি করেছে। আরও চুরি করার জন্য প্রায়ই রাতবিরেতে হানা দিচ্ছে।
–কুকুরটার কথা কি বলেছিলেন?
–আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার। পুলিশ ডায়েরি লিখে নিয়ে বলেছিল, কাকে সন্দেহ হয় বলুন। কাকেই বা সন্দেহ করব বলুন? বাবুগঞ্জে চোর নিশ্চয় আছে। তাদের কারও নাম করলে আমাদের ক্ষতি করতে পারে। তাই কারও নাম বলিনি।
–পুলিশকে আপনাদের কুকুরটার মুণ্ডুকাটার খবর নিশ্চয় দিয়েছিলেন?
–হ্যাঁ। পুলিশ এসে মুণ্ডুটা নিয়ে গিয়েছিল। সে-ও স্যার, আমার মাসতুতো ভাই পরেশের অনুরোধে। পরেশ কলকাতার বেনেপুকুর থানার সাব-ইন্সপেক্টর। সে-ই তো আমাকে আপনার কথা বলেছে।
ষষ্ঠীচরণ এতক্ষণে আমাদের জন্য দ্বিতীয় দফা কফি আনল। কর্নেল বললেন,–কফি খান জয়গোপালবাবু। কফি নার্ভ চাঙ্গা করে।
জয়গোপালবাবু কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন,–বাবুগঞ্জে স্যার জাঁকিয়ে শীত নেমেছে। শেয়ালদা স্টেশনে নেমে গরমের চোটে সোয়েটার খুলতে হল। তবে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। কফি খেয়ে সত্যিই চাঙ্গা হচ্ছি!
প্রাইভেট ডিটেকটিভ গুলি-গুলি চোখে তাকিয়েছিলেন। হঠাৎ বললেন,–জয়গোপালবাবুরে একটা কথা জিগাই।
জয়গোপালবাবু বললেন, আপনি কি স্যার ওপার বাংলার লোক?
–জন্ম হইছিল ওপারে। ছোটবেলায় এপারে আইছিলাম। তো কথাটা হইল, আপনার ঠাকুরদা জমিদারবাড়ির খাজাঞ্চি ছিলেন। ওনার একখান বাড়ি ছাড়া আর কোনো প্রপার্টি ছিল না?
জয়গোপালবাবু যেন চমকে উঠে বললেন,–প্রপার্টি?
তারপর ভদ্রলোক কফির কাপ-প্লেট রেখে তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে কী সর্বনাশ!–বলে আমাদের হতবাক করে বেরিয়ে গেলেন।
গোয়ন্দাপ্রবর বললেন,–এটা কী হইল? অরে আমি ফলো করুম…!
কর্নেল হালদারমশাইকে বাধা না দিলে উনি সত্যিই জয়গোপালবাবুকে অনুসরণ করে হয়তো বাবুগঞ্জে গিয়ে হাজির হতেন। কর্নেল বললেন,–হালদারমশাই! শুনলেন তো! বাবুগঞ্জে এখন জাঁকিয়ে শীত পড়েছে। শীতের পোশাক ছাড়া সেখানে গিয়ে শীতে কাঁপতেন, না গোয়েন্দাগিরি করতেন? কাজেই তাড়াহুড়ো করে লাভ নেই।
হালদারমশাই উত্তেজিতভাবে বললেন,–হেভি মিস্ত্রি আরও হেভি হইয়া গেল! ‘প্রপার্টি’ কথাটা যেই কইলাম, অমনই উনি কফি খাওয়া ছাড়ান দিয়া ঘোড়ার মতন ছুট দিলেন।
ঠিক বলেছেন। ঘোড়ার মতোই ব্যাপারটা অদ্ভুতই বটে।-বলে কর্নেল চুরুট ধরালেন। চোখ বুজে তিনি আবার ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন।
আমি বললুম,–ভদ্রলোকের মাথায় ছিট আছে মনে হচ্ছে। ওঁর কথা বলার ভঙ্গিও কেমন এলোমেলো। গুছিয়ে সব কথা বলতে পারছিলেন না। পুলিশ কুকুরের কাটামুণ্ডু নিয়ে গেল কেন, তাও বুঝিয়ে বললেন না।
হালদারমশাই বললেন,–জয়ন্তবাবু! আপনি সাংবাদিক। পুলিশের কামের মেথড বুঝবেন না।
হাসতে-হাসতে বললুম,–মেথডটা কী?
–মশায়! চৌতিরিশ বৎসর পুলিশে চাকরি করছি। মেথডটা আমি জানি। ভদ্রলোক রাত্রিকালে চোরের উৎপাতের কথা কইছিলেন। তারপর ওনার কুত্তাটার মাথা কাইটা ঝুলাইয়া দিছিল অরা। এখন পুলিশের কাম হইল গিয়া কুত্তার মুণ্ডু ডাক্তারেরে দেখাইয়া সার্টিফিকেট লওয়া। পুলিশ যখন ডায়েরি লিখছে, তখন ওই কুত্তার মুণ্ডুকাটার ঘটনাও পুলিশের ডিউটির মধ্যে পড়ে। আপনাগো দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায় লিখছে, মৎস্যজীবীগো জালে পাওয়া মুণ্ডুকাটা বডিটার খোঁজ লইতে গেছে পুলিশ! তা হইলেই বুঝুন!
হালদারমশাই ঢ্যাঙা বলিষ্ঠ গড়নের মানুষ। মাথার চুল খুঁটিয়ে ছাঁটা। তিনি ছদ্মবেশ ধরতে পটু। তবে তিনি বড্ড হঠকারী স্বভাবের মানুষ। পুলিশ ইন্সপেক্টরের পদ থেকে রিটায়ার করলেও মাঝে-মাঝে সেই কথাটা ভুলে গিয়ে বিভ্রাট বাধান। আজ সকালে বুঝতে পারছিলুম, তার নাকের ডগায় একখানা অদ্ভুত কেস এসে ঝুলছিল। কেসটা কর্নেলের হলেও তিনি এতে নাক গলাতে উদগ্রীব। অবশ্য এ-ও সত্যি, অসংখ্য জটিল রহস্যজনক কেসে কর্নেল তাঁর সাহায্য নেন। তাই লক্ষ করছিলুম, পুলিশের কাজের মেথড়’ নিয়ে কথা বলার পর তিনি কর্নেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। উত্তেজনায় চোয়ালে-চোয়ালে ঘর্ষণের জন্যই তার গোঁফের দুই সূক্ষ্ম ডগা যথারীতি তিরতির করে কাঁপছিল।
একটু পরে কর্নেল চোখ খুলে বললেন,–হালদারমশাই। আমার মনে হচ্ছে জয়গোপালবাবুর বোনের আশঙ্কার কারণ আছে। একটা কুকুরকে চিরকালের জন্য চুপ করানোর অনেক উপায় আছে। অথচ কেউ বা কারা কুকুরটার মাথা কেটে দরজার পাশে ঝুলিয়ে রেখছিল কেন? জয়গোপালবাবুকে নিশ্চয় তারা বোঝাতে চেয়েছিল, তোমার মুণ্ডুও এমনি করে কাটা হবে।
–ঠিক কইছেন কর্নেলস্যার! এবার আমার ধারণাটা কইয়া ফেলি?
–হ্যাঁ বলুন!
–কে বা কারা ওনার ঠাকুরদার কোনো প্রপার্টি ফেরত চায়।
আমি অবাক হয়ে বললুম,–ফেরত চায় মানে?
জবাবটা কর্নেল দিলেন,–জয়ন্ত! হালদারমশাই সম্ভবত ঠিক বুঝেছেন! জমিদারের খাজাঞ্চি ছিলেন জয়গোপালবাবুর ঠাকুরদা। এমন হতেই পারে, তিনি কারও কোনো প্রপার্টি–তার মানে কোনো দামি জিনিস হাতিয়ে নিয়েছিলেন। এখন তার বংশধর সেটা ফেরত চাইছে। এছাড়া রাতবিরেতে চোরের উপদ্রবের কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। জিনিসটা খাজাঞ্চি ভদ্রলোকের নিজের হলে চোরেরা এত সব কাণ্ড করতে যাবে কেন? জুতোচুরি, রাতবিরেতে হানা দেওয়া, কুকুরের মুণ্ডুকাটা!
বললুম,–আমার ধারণা, জুতোচুরি মানে জয়গোপালবাবুকে উত্যক্ত করা।
হালদারমশাই বললেন,–হঃ! ঠিক কইছেন জয়ন্তবাবু! বারবার জুতোচুরি করলে মাইনষের মাথা ব্যাবাক খারাপ হওনের কথা! তারপর কুত্তার মুণ্ডুকাটা! জয়গোপালবাবুকে উত্যক্ত কইর্যা মারছে অরা। কর্নেলস্যার! আপনি আমারে পারমিশন দ্যান! বাবুগঞ্জে গিয়া খোঁজখবর লই।
কর্নেল বললেন, আমার মতো ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবেন?
–আপনিও লগে-লগে থাকবেন।
আমি বললুম,–বাবুগঞ্জ কোথায়?
কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন,–বেহুলা নদীর ধারে!
বিরক্ত হয়ে বললুম,–ওঃ কর্নেল! এমন একটা সিরিয়াস ব্যাপারকে আপনি হাল্কাভাবে নিচ্ছেন। ধরুন, যদি সত্যি জয়গোপালবাবুর কোনো বিপদ হয়?
এই সময় টেলিফোন বেজে উঠল। কর্নেল রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন,…হ্যাঁ। বলছি।… আরে কী কাণ্ড! পরেশ। তুমি বেনেপুকুরে কবে এলে?..কী আশ্চর্য! আমার নাকের ডগায় আছো! তোমার মাসতুতো দাদাকে সঙ্গে নিয়ে তুমিই আসতে পারতে!…হ্যাঁ। জয়গোপালবাবু এসেছিলেন। তোমার কথাও বলছিলেন।…হা তুমি যখন বলছ, আমার পক্ষে যতটা সম্ভব সাহায্য নিশ্চয় করব।…আমারও তাই মনে হল। একটু ছিটগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। সেটা এ অবস্থায় স্বাভাবিক। তো শোনো! উনি হঠাৎ উঠে চলে গেলেন।…বুঝতে পেরেছি। তো বাবুগঞ্জ জায়গাটা ঠিক কোথায়?..না। ওই যে বললুম, হঠাৎ চলে গেলেন।…তার মানে শান্তিপুরের আগে!… কাছারিবাড়ির মোড়? তারপর?…নাঃ! বাসে নয়। গাড়িতেই যাব, তত কিছু দূরে নয়!…দোমোহানি ওয়াটারড্যাম?…বাঃ! এখন তাহলে তো সাইবেরিয়ান হাঁসের মেলা বসে গেছে।…বলো কী! গড়ের জঙ্গলেও… ওয়ান্ডারফুল! বুঝলে পরেশ? কদিন থেকে ভাবছিলুম মফস্বলে শীত এসে গেছে। জলাভূমিতে দেশ-বিদেশের পাখি এসে জুটবে। এবার কোথায় যাব, তা ঠিক করতে পারছিলুম না।…ধন্যবাদ পরেশ! এই খবরটার জন্য ধন্যবাদ।…না, না। ওঁর কেসটা আমি নিয়েছি।…আচ্ছা রাখছি।
রিসিভার রেখে কর্নেল একটু হেসে বললেন,–জয়ন্ত, তিতলিপুরের গড়ের জঙ্গলের কথা ভুলে গেছ?
হালদারমশাই নড়ে বসলেন।–হঃ! সেই তিতলিপুর! গড়ের জঙ্গল।
বললুম,–বাজে জায়গা। তিতলিপুরে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। বিশেষ করে নভেম্বর মাসে।
কর্নেল বললেন,–বাবুগঞ্জ তিতলিপুর থেকে সামান্য দূরে। আমরা দোমোহানির যে সেচ-বাংলোতে ছিলুম, সেখানে নয়। আমরা এবার থাকব বাবুগঞ্জের কাছাকাছি অন্য একটা বাংলোতে।
একটু অবাক হয়ে বললুম,–একজন ছিটগ্রস্ত মানুষের আবোল-তাবোল কথা শুনে আপনিও দেখছি হালদারমশাইয়ের মতো উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন! হালদারমশাই একজন প্রাক্তন পুলিশ অফিসার এবং বর্তমানে গোয়েন্দাগিরি ওঁর নেশা ও পেশা। বরং হালদারমশাই আগে গিয়ে ব্যাপারটা বুঝে আসুন।
হালদারমশাই সহাস্যে বললেন, আমি তো যামুই। হেভি একখান মিস্ত্রির লেজটুকু দেখছি। কিন্তু কর্নেলস্যারের লগে-লগে একদিন ঘুইরাও আসল কথাটা আপনি বুঝলেন না জয়ন্তবাবু?
–আসল কথাটা কী?
গোয়েন্দাপ্রবর চোখ নামিয়ে বললেন,–পক্ষী! উনি চোখে বাইনোকুলার দিয়া ওয়াটারড্যামে পক্ষী দেখবেন! বেনেপুকুরের এস. আই. ভদ্রলোক কর্নেলস্যারকে হেভি পক্ষীর খবর দিছেন!
কর্নেল চুরুটের ধোঁয়ার মধ্যে বললেন,–ঠিক বলেছেন হালদারমশাই! সাইবেরিয়ান হাঁস হেভি পক্ষীই বটে। একেকটার ওজন আট-দশ কিলোগ্রামেরও বেশি। সুদূর উত্তরের সাইবেরিয়া থেকে প্রতি শীতে চীন পেরিয়ে হিমালয় ডিঙিয়ে ওরা বাংলার মিঠে জলে সাঁতার কাটতে আসে। আবার শীতের শেষে দেশে ফিরে যায়। প্রকৃতির এ এক বিচিত্র রহস্য! পরিযায়ী পাখিদের রহস্য!
হাসি চেপে বললুম, হ্যাঁ। এ-ও হেভি রহস্য।
কর্নেল গম্ভীরমুখে বললেন, তুমি সাংবাদিক। একালের সাংবাদিকরা সর্ববিদ্যাবিশাবদ। জয়ন্ত! তোমার জানা উচিত ছিল, পাখিদের হাজার-হাজার মাইল উড়ে আসা এবং ঠিক পথ চিনে ঘরে ফেরা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে কত গবেষণা চলেছে। পাখিদের এই পরিযানের রহস্য আজও সঠিকভাবে সমাধান করা যায়নি। শুনলে অবাক হবে, জিনোমবিজ্ঞানীরাও পরিযায়ী পাখিদের ডি. এন. এ.-র মধ্যে …
আবার ডোরবেল বাজল। তাই কর্নেলের বক্তৃতা শোনা থেকে রেহাই পেলুম। কর্নেল যথারীতি হাঁকলেন,ষষ্ঠী!
একটু পরে আমাদের আবার হতবাক করে বাবুগঞ্জের জয়গোপাল রায় এক হাতে জুতোজোড়া নিয়ে ঘরে ঢুকলেন এবং পরক্ষণে জিভ কেটে জুতোদুটো পায়ে পরে সোফায় বসলেন।
কর্নেল বললেন, আপনার ঠাকুরদার প্রপার্টি পেলেন?
জয়গোপালবাবু কাচুমাচু মুখে হাসবার চেষ্টা করে বললেন,–হা স্যার! ভাগ্যিস ওই ভদ্রলোক মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। উনি মনে করিয়ে না দিলে আবার পরের রোববার আসতে হত।
বলে তিনি হালদারমশাইয়ের দিকে তাকালেন। হালদারমশাই বললেন,–কী কন বুঝি না!
জয়গোপালবাবু বললেন,–আজ্ঞে স্যার, এন্টালি মার্কেটের উল্টোদিকে ডাক্তার লেনে আমাদের বাবুগঞ্জের এক ল-ইয়ার পাঁচুবাবু থাকেন। পঞ্চানন বারিক। আমার ঠাকুরদার প্রপার্টির উইল ওঁর সাহায্যেই আমার বাবা কোর্টে প্রবেট করিয়েছিলেন। ঠাকুরদার উইলে বসতবাড়ির লাগোয়া কাঠাদশেক জমির কথা ছিল। জমিদারবংশের প্রমথ মুখুজ্যেমশাইয়ের খুড়তুতো ভাই অবনী জমিটা দখলে রেখেছিল। বাবা মামলা-মোকদ্দমা করবেন, না রেলের গার্ড হয়ে কঁহা-হা মুল্লুক ঘুরে বেড়াবেন। তখন বলেছিলুম, বাবা কাটিহারে মারা যান। তো আমি রেলের চাকরি থেকে রিটায়ার করে বাড়ি ফিরলুম। তখন আমার বোন হৈমন্তী আমাকে ওই জমিটার কথা বলল। হৈমন্তীর আগেই পাঁচুবাবু ল-ইয়ারের সঙ্গে বাবুগঞ্জে ওঁর দেশের বাড়িতে কথা বলেছিল। তারপর সেই উইল পাঁচুবাবু দেখতে চেয়েছিলেন।
কর্নেল বললেন,–বুঝেছি। আপনার ঠাকুরদার উইল পাঁচুবাবুর কাছেই থেকে গিয়েছিল!
–আজ্ঞে হ্যাঁ, গত রোববার পাঁচুবাবু দেশের বাড়িতে গিয়েছিলেন। হৈমন্তী তার কাছে উইল চাইতে গিয়েছিল। উনি বলেছিলেন, পরের রোববার আমি যেন কলকাতা গিয়ে উইলখানা ওঁর কাছে ফেরত নিই। কারণ এদিন উনি বাবুগঞ্জে যাবেন না। ফ্যামিলি নিয়ে সাড়ে দশটার বাসে চেপে তারাপীঠে তীর্থ করতে যাবেন।
–পেলেন উইল?
জয়গোপালবাবু একটু হেসে বললেন,–আর একটু দেরি করলেই ওঁকে পেতুম না। তীর্থ করতে বেরুনোর মুখে বাগড়া দিলুম। একটু বিরক্ত হয়েই বাড়ি ঢুকে প্যাকেটটা এনে দিলেন। বললেন, দশকাঠা দখলি জমি এতদিন পরে ফেরত পাওয়ার হ্যাপা অনেক। ফিরে এসে বলবেন।
–আপনার ঠাকুরদা সম্পত্তির উইল করেছিলেন কেন? আপনার বাবা ছাড়া কি আর কোনো ছেলে-মেয়ে ছিল তার?
জয়গোপালবাবু কী বলতে ঠোঁট ফাঁক করেছিলেন। বললেন না।
কর্নেল বললেন, সম্পত্তির আইনত কোনো নির্দিষ্ট প্রাপক না থাকলে এবং সম্পত্তির পরিমাণ বেশি হলে তবেই লোক উইল করে। তাই জিজ্ঞেস করছি আপনার ঠাকুরদা উইল করেছিলেন কেন?
জয়গোপালবাবু একটু ইতস্তত করে বললেন,–ঠাকুরদার শেষ বয়সে দেখাশোনা করতেন আমার পিসিমা। বাবা তো রেলের গার্ড।
–তার মানে, আপনার ঠাকুরদার একটি মেয়ে ছিল?
–ঠিক ধরেছেন স্যার। তো তারও দুর্ভাগ্য আমার বোনের মতো। পিসিমাও বিধবা ছিলেন। তাঁর একটি মাত্র ছেলে। তার নাম প্রবোর। সে এখন বাবুগঞ্জে আছে। ঠাকুরদার শুধু বসতবাটি আর তার লাগোয়া দশকাঠা পোড়ো জমি বাবাকে দিয়ে গেছেন। উইলে সম্পত্তির বেশি অংশই ছিল পিসিমা কুমুদিনীর নামে। পিসিমা মারা গেলে সেই সম্পত্তি প্রবোধ পেয়েছিল। ধানি জমি, পুকুর, একটা আমবাগান। উড়নচণ্ডী প্রবোধ সব বেচে খেয়ে এখন অবনী মুখুজ্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। নির্লজ্জ বজ্জাত! হৈমন্তীর কাছে কম টাকা ধার করেছে। আমাকে দেখলে এখন ছায়া মাড়ায় না!
–আপনার বোন হৈমন্তী টাকা পান কোথায়?
জয়গোপালবাবু চাপাস্বরে বললেন,–প্রাইমারি স্কুলের টিচার যে! অনেক টাকা মাইনে পায়। আপনার দিব্যি স্যার! রেলে আমি হৈমন্তীর মাইনের আদ্ধেক টাকা মাইনে পেতুম। অবশ্য পেনশন পাচ্ছি! হৈমন্তীও পাবে! বদমাশ প্রবোধের মুখ থেকে লালা ঝরবে না? বলুন! অবনী মুখুজ্যে ওকে আশ্রয় দিয়ে দু-দশটাকায় সব সম্পত্তি গ্রাস করেছে। প্রবোধের সায় না থাকলে অবনী আমার বাবার ন্যায্য দশকাঠা জমি দখল করতে পারত? হৈমন্তী তো মেয়ে। সে একা কী করতে পারত?
হালদারমশাই কথা বলার জন্য উসখুস করছিলেন। এবার বলে উঠলেন,–তাহলে জুতোচুরি, রাত্রে আপনারে জ্বালাতন, তারপর কুত্তার মাথা কাইট্যা ঝোলানো সেই প্রবোধেরই কাম!
জয়গোপালবাবু হাত নেড়ে বললেন,–না। না। প্রবোধের সে সাহসও নেই। আর ক্ষমতাও নেই। নেশাভাঙ করে বুড়ো বয়সে তার শোচনীয় অবস্থা। লাঠিতে ভর করে লেংচে হাঁটে। একটু হেঁটেই হাঁপায়। একদিন সে–
জয়গোপালবাবু হঠাৎ থেমে গেলেন। কর্নেল বললেন,–বলুন জয়গোপালবাবু।
–কালীপুজোর কদিন আগের কথা। বাজারে গেছি। হঠাৎ দেখি প্রবোধ আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। একটু চমকে উঠেছিলুম বইকী! কিন্তু সে হাউমাউ করে কেঁদে বলল, ও ভাই গোপাল! আমাকে গোটাদশেক টাকা দে, তোর পায়ে পড়ি। আমার বড় কষ্ট রে! অবনী আমাকে এখন তাড়িয়ে দেওয়ার ছল খুঁজছে! কান্নার চোটে ভিড় জমে গেল।
–আপনি টাকা দিলেন?
–দিলুম স্যার! মনটা ভিজে গেল। পিসতুতো দাদা! বুদ্ধির দোষে এই অবস্থায় পড়েছে। গোয়েন্দাপ্রবর বললেন,–তা হইলে সে আপনারে উত্যক্ত করতাছে না?
–আজ্ঞে না। কেউ বললেও ও কথা বিশ্বাস করব না।
–তা হইলে সেই অবনীবাবু করতাছে।
জয়গোপালবাবু বললেন,–অবনী মুখুজ্যে জমিটা দখল করেছে, তা ঠিক। তবে ওই জমিতে সে গার্লস হাইস্কুল করবে শুনেছি। হৈমন্তীর মতে, ওটা নাকি ওর চালাকি। আর আমাদের ন্যায্য জমি ফিরে পাওয়ার চান্স থাকবে না। তাই গালর্স স্কুল করে নাম কিনতে চাইছে। কিন্তু আমার জুতো চুরি করবে কেন সে?
কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন,–আপনার ঠাকুরদার উইলটা একটু দেখতে পারি?
জয়গোপালবাবু বললেন,–নিশ্চয়ই দেখতে পারেন। হৈমন্তী মাঝে-মাঝে আমাকে বলে, ঠাকুরদার উইলেই এমন কিছু গণ্ডগোল আছে, যা কোনো ল-ইয়ারও বুঝতে পারছে না। দলিল-দস্তাবেজের ভাষা স্যার, বোঝা বড়ই কঠিন।
বলে তিনি ব্যাগের ভিতর থেকে বড় আকারের একটা খাম কর্নেলকে দিলেন। কর্নেল খাম থেকে আরেকটা জীর্ণ নোংরা খাম বের করলেন। তারপর দু-পাতার একটা কাগজ বের করে চোখ বুলিয়ে বললেন,–যদি আমার প্রতি আপনার বিশ্বাস থাকে, আমি এটা দু-একটা দিনের জন্য রাখতে চাই।
জয়গোপালবাবু করজোড়ে বললেন,–কর্নেলসায়েব, বিপদে পড়ে আপনার শরণাপন্ন হয়েছি, আপনাকে অবিশ্বাস করতে পারি?
-–ঠিক আছে। আপনাকে আসতে হবে না। আপনি বাবুগঞ্জে বসেই শিগগির এটা ফেরত পাবেন। আর একটা কথা। আপনি যে আমার কাছে এসেছিলেন, তা আপনার বোন ছাড়া আর কাকেও ঘুণাক্ষরে যেন জানাবেন না। তবে আপনার মাসতুতো ভাই পরেশ চৌধুরী পুলিশের লোক। পরেশ আমার বিশেষ স্নেহভাজন। সে আমাকে কিছুক্ষণ আগে টেলিফোন করেছিল। সে আমাকে আপনার কথা বলেছে। কাজেই বাইরের লোক বলতে শুধু পরেশই জানল।
জয়গোপালবাবু খুশি হয়ে বললেন,পরেশ টেলিফোন করেছিল আপনাকে? তাহলে আর আমি ওর কাছে যাচ্ছিনে। বারোটা পাঁচের লালগোলা প্যাসেঞ্জার ট্রেন ধরব। রানাঘাট জংশনে নেমেই বাস পাব।
বলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তারপর কর্নেলকে নমস্কার করে পা বাড়িয়ে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালেন, –ওঁদের সঙ্গে তো আলাপ হল না! দেখছ কাণ্ড? ছ্যা-ছ্যা! আমার ভদ্রতাবোধটুকুও হারিয়ে ফেলেছি।
কর্নেল আগে হালদারমশাইয়ের পরিচয় দিতেই জয়গোপালবাবু বিস্ফারিত চোখে নমস্কার করে বললেন,–ওরে বাবা! প্রাইভেট ডিটেকটিভ? জানেন স্যার, হৈমন্তী আমাকে একবার বলেছিল–
তার কথা থামিয়ে কর্নেল আমার পরিচয় দিলেন। জয়গোপালবাবু আমাকে নমস্কার করে বললেন,–আমার কী সৌভাগ্য! ওরে বাবা! আপনারা সব কত নামজাদা মানুষ। আমি সামান্য এক চুনোপুঁটি!…
জয়গোপালবাবু বেরিয়ে যাওয়ার পর আমি একটু হেসে বললুম,–হালদারমশাই কি এখন ওঁকে ফলো করতে চান?
গোয়েন্দাপ্রবর একটিপ নস্যি নিচ্ছিলেন। রুমালে নাক মুছে বললেন,–কর্নেলস্যার যা করতে বলেন, তা করব।
কর্নেল হাসলেন না। নিভে যাওয়া চুরুটটা জ্বেলে বললেন,–বাবুগঞ্জে হালদারমশাই যদি যেতে চান, আপত্তি করব না। বরং খুশি হব। তবে ছদ্মবেশে গেলেই ভালো হয়।
হালদারমশাই উত্তেজিতভাবে বললেন,–যামু!
–আপনি তো সবচেয়ে ভালো পারেন সাধু-সন্ন্যাসী সাজতে।
–সাধুর বেশেই যামু!
–কিন্তু ঝুলির ভিতরে আপনার লাইসেন্সড রিভলভার থাকবে। আপনার সরকারি আইডেন্টিটি কার্ডও সঙ্গে থাকা দরকার।
আমি বললুম,–কিন্তু সেখানে প্রচণ্ড শীত!
প্রাইভেট ডিটেকটিভ হাসলেন,–সাধুরা কম্বল গায়ে জড়ায় না? ধুনি জ্বালে না?
–আপনার সেই সিন্থেটিক কাপড়ে তৈরি বাঘছাল, ত্রিশূল আর প্লাস্টিকে তৈরি মড়ার খুলি নিতে ভুলবেন না যেন!
হালদারমশাই উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,–বাড়ি গিয়া খাওয়াদাওয়া কইরাই বারাইয়া পড়ুম। বাবুগঞ্জে গিয়া সন্ধ্যার পর সাধুর ছদ্মবেশ ধরুম। জয়গোপালবাবুর বাড়ির কাছাকাছি জায়গা হইলে ভালো হয়। চলি কর্নেলস্যার। চলি জয়ন্তবাবু!
কর্নেল বললেন,–যথাসময়ে আমাদের দেখা পাবেন। কিন্তু সাবধান হালদারমশাই! কুকুরের মুণ্ডু যে বা যারা কেটেছে, সে বা তারা শুধু ধূর্ত নয়, নৃশংসও বটে।
কর্নেলস্যার! পঁয়তিরিশ বৎসর পুলিশ ছিলাম। ভাববেন না।–বলে গোয়েন্দাপ্রবর সবেগে বেরিয়ে গেলেন।…
আমার ফিয়াট গাড়িটা কিছুদিন থেকে বেগড়বাঁই করছিল। গত সপ্তাহে মেকানিকের পাল্লায় পড়ে জব্দ হয়েছে। পরদিন সোমবার সকাল আটটায় বেরিয়ে চৌত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়কে গাড়িটা যেন পক্ষীরাজের মতো উড়ে যাচ্ছিল। কর্নেল আমার বাঁদিকে বসেছিলেন। তার গলা থেকে ঝোলানো ক্যামেরা আর বাইনোকুলার। পিঠে যথারীতি আঁটা তাঁর প্রসিদ্ধ কিটব্যাগ, যার ভিতর একজন মানুষের জন্য দরকারি অসংখ্য জিনিস ঠাসা। কোণা দিয়ে উঁকি মারছিল প্রজাপতি ধরার জন্য অদ্ভুত একরকম জালের লম্বা হাতল। মাঝে-মাঝে তিনি বাইনোকুলারে পাখি দেখছিলেন, নাকি অন্য কিছু তা বলা কঠিন। এটা ওঁর এক বাতিক। মাঝে-মাঝে তিনি আমাকে সাবধান করে দিচ্ছিলেন, যেন গতি কমাই।
এই রাস্তায় কর্নেলের সঙ্গে কতবার কত জায়গায় গেছি। কিন্তু আমার কিছু মনে থাকে না। ঘণ্টা আড়াই চলার পর তিনি বললেন,–সামনে ডাইনে একটা পিচরাস্তায় ঘুরতে হবে জয়ন্ত।
রাস্তাটা সঙ্কীর্ণ। কখনও যাত্রী-বোঝাই বাস, কখনও ট্রাক-লরি-টেম্পো, কখনও বা সাইকেলভ্যানের আনাগোনা। তাই এবার সাবধানে যেতে হচ্ছিল। রাস্তাটা বাঁক নিতে-নিতে চলেছে। দুধারে কখনও গ্রাম, কখনও পাকাধানে ভরা আদিগন্ত মাঠ, দূরে নীলাভ কুয়াশা আর মাঝে-মাঝে জলাভূমি, জঙ্গল, তারপর হঠাৎ ছোট্ট বাজার, বাসস্ট্যান্ড। আধঘণ্টা পরে বাঁ-দিক থেকে আরেকটা পিচরাস্তা এসে এই রাস্তার সঙ্গে মিশে একটু চওড়া হল। কর্নেল বাইনোকুলারে সামনেটা দেখে নিয়ে বললেন,–বাবুগঞ্জ এসে গেছি বলতে পারো। ওই দেখো, বাঁদিকে একটা ছোট্ট নদী। বেহুলা নদীই হবে।
বলে তিনি মাথার টুপি খুলে টাকে হাত বুলিয়ে নিলেন। বললুম,–সামনে যা ভিড়ভাট্টা দেখছি, ওর ভিতরে ঢুকলে কি সহজে বেরুতে পারব?
কর্নেল বললেন, আমরা বাবুগঞ্জের ভিতরে ঢুকব না।
–তাহলে আমরা যাচ্ছি কোথায়?
–বাবুগঞ্জের পূর্বপ্রান্তে একটুখানি এগোলেই নদীর ধারে সেচদফতরের বাংলো।
একটু অবাক হয়ে বললুম,–আপনি কি আগে কখনও এসেছেন?
–নাঃ!
–তাহলে কেমন করে জানলেন…
কর্নেল আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,–জানা খুবই সোজা। কলকাতার সেচদফতরের এক বড়কর্তাকে ফোন করে রাস্তার হালহদিশ সব জেনে নিয়েছি। তুমি যখন কাল দুপুরে খাওয়ার পর । ডিভানে চিত হয়ে ভাতঘুমে ডুব দিয়েছিলে, তখন এইসব জরুরি কাজ সেরে নিয়েছিলুম। হ্যাঁ–এবার বাঁ-দিকে মোরামবিছানো পথে চলো।
বাঁদিকে গাছপালার ভিতরে একতলা-দোতলা বাড়ি আর ডানদিকে শাল-সেগুনের জঙ্গল। জিজ্ঞেস করলুম,–এই জঙ্গলটা কি সরকারি বনসৃজন প্রকল্পের রূপায়ণ?
কর্নেল হাসলেন,–বাঃ! বেশ বলেছ। এটা তা-ই। শাল-সেগুন এই মাটির স্বাভাবিক উদ্ভিদ নয়।
–তাহলে এ জঙ্গলে বাঘ-ভালুক নেই।
–নাঃ! নিরামিষ জঙ্গল বলতে পারো! তবে শীতের প্রকোপে জঙ্গলের তাজা ভাবটা নেই। শরৎকালে এলে ভালো লাগত।
কিছুক্ষণ পরে সামনে উত্তরে একটা উঁচু জমির ওপর মনোরম বাংলোটা দেখা গেল। নিচু পাঁচিলের ওপর কাঁটাতারের বেড়া। ভিতরে রঙবেরঙের ফুলের উজ্জ্বলতা। আমাদের গাড়ি দেখতে পেয়েই উর্দিপরা একটা লোক গেট খুলে দিল। নুড়িবিছানোলন পেরিয়ে ডাইনের চত্বরে গাড়ি দাঁড় করালুম। একজন প্যান্ট-শার্ট পরা লোক নমস্কার করে বলল,–কর্নেলসায়েব কি আমাকে চিনতে পারছেন?
কর্নেল গাড়ি থেকে নেমে বললেন,–কী আশ্চর্য! সুবিমল, তুমি এখানে এসে জুটলে কবে?
–আজ্ঞে গত মার্চ মাসে। মালঞ্চতলার ক্লাইমেট সহ্য হচ্ছিল না। তাই বড়সায়েবকে ধরাধরি করে বাড়ির কাছে বদলি হয়ে এসেছি।
–তোমার বাড়ি কি বাবুগঞ্জে?
–না স্যার! নদীর ওপারে ওই যে দেখছেন, ঝাঁপুইহাটিতে। তো গত রাত্তিরে ইঞ্জিনিয়ারসায়েব ফোন করে জানালেন, আপনি আসছেন। শুনেই মনটা নেচে উঠল। চলুন স্যার! এদিকটা বেজায় ঠান্ডা!
কর্নেল বললেন,–আলাপ করিয়ে দিই! জয়ন্ত! সুবিমল হাজরা এই বাংলোর কেয়ারটেকার। জলচর। জলচর পাখির খবর ওর নখদর্পণে। সুবিমল! জয়ন্ত চৌধুরীর নাম তুমি শুনে থাকবে। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার বিখ্যাত সাংবাদিক।
সুবিমল হাজরা আমাকে নমস্কার করে বলল,–কী সৌভাগ্য! আপনার ক্রাইমস্টোরির আমি ফ্যান!
একটু অবাক হয়ে বললুম,–এখানে দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা আসে?
–কোন পত্রিকা আসে না তাই বলুন স্যার! কর্নেলসায়েব আমাকে আপনার কথা বলেছিলেন যেন! অনুগ্রহ করে এদিকে আসুন আপনারা। গাড়ির চাবি নিশ্চিন্তে চণ্ডীকে দিন। চণ্ডী! সায়েবদের গাড়ি গ্যারেজে ঢুকিয়ে জিনিসপত্র পৌঁছে দাও।
একজন গাঁট্টাগোট্টা চেহারার লোক কখন এসে পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল লক্ষ করিনি। সে আমাদের সেলাম দিয়ে গাড়ির ডিকি খুলতে যাচ্ছিল। বললুম,–ডিকিতে কিছু নেই। আমাদের ব্যাগেজ ব্যাকসিটে আছে।
বাংলোর দক্ষিণের বারান্দায় রোদ পড়েছে। বেতের কয়েকটা চেয়ার আর টেবিল আছে। কর্নেল সেখানে বসে বললেন,–আচ্ছা সুবিমল! কাগজে পড়েছি, বাবুগঞ্জে কারা নাকি কুকুর-বলি দিয়েছে?
সুবিমল হাসতে-হাসতে বলল,–এক ভদ্রলোক রেলে চাকরি করতেন। রিটায়ার করে বাড়ি ফিরে কীসব কাণ্ড করে বেড়াচ্ছেন। খামোকা যাকে-তাকে ধরে তম্বি করেন, তুমি আমার জুতো চুরি করেছ! পাগল স্যার! পাগল আর কাকে বলে? তার বোন প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারি করেন। একটা পেল্লায় গড়নের কুকুর পুষেছিলেন। গোপালবাবু–মানে সেই টিচারের দাদা, যিনি রেলে চাকরি করতেন, এসে অবধি যার-তার দিকে কুকুর লেলিয়ে দিতেন। আর কুকুরটাও ছিল বজ্জাত। বাড়ির সামনে দিয়ে কেউ গেলেই তাকে কামড়াতে আসত।
–কাউকে কি কামড়েছিল?
–কামড়ায়নি। তবে চ্যাঁচামেচি করত। দাঁত বের করে তেড়ে আসত! তাই হয়তো দুষ্টু ছেলেরা রাত্তিরে কুকুরকে কোনো কৌশলে বেঁধে বলি দিয়েছিল। আর তাই নিয়ে গোপালবাবু থানাপুলিশ করে হইচই বাধিয়ে ছাড়লেন। মাথায় ছিট আছে স্যার!
এই সময়ে একটা রোগা চেহারার লোক ট্রেতে কফি আর পটাটোচিপস এনে টেবিলে রাখল। সুবিমল বলল,–ঠাকমশাই!
ঠাকমশাই নমস্কার করে বললেন,–সুবিমল! আমি তো ইংরিজি জানি না। তুমি সায়েবকে জিজ্ঞেস করা উনি কী খাবেন।
কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন,–আমি ঠাকমশাইয়ের মুণ্ডু খাব!
ঠাকমশাই সবিনয়ে বললেন,–সায়েব তো ভালো বাংলা জানেন। আর সুবিমল, তুমি গত রাত্তির থেকে আমাকে ভয় দেখাচ্ছ, এক সায়েব আসবেন। তার সঙ্গে ইংরিজিতে কথা বলতে হবে। তা স্যার! আমার মুণ্ডু খেতে তেতো লাগবে। তেতো বোঝেন তো স্যার?
কর্নেল তার বিখ্যাত অট্টহাসি হেসে বললেন,–ঠাকমশাই! আমি কলকাতার এক ভেতো-বাঙালি। আমার চেহারা পোশাক-আশাক দেখে লোকে সায়েব বলে ভুল করে।
ঠাকমশাই ভাঙা দাঁত বের করে হাসলেন,–কী কাণ্ড! এখন চেহারা দেখে বুঝতে পারছি। তবে হঠাৎ করে দেখলে বোঝবার উপায় নেই কিছু! বাঁচা গেল। সুবিমল! আজ তোমার পাতে কী পড়বে বুঝলে? কচু।
বলে বুড়োআঙুল দেখিয়ে তিনি চলে গেলেন। সুবিমল বলল,–ঠাকমশাইয়ের নাম নরহরি মুখুজ্যে। বাড়ি বাবুগঞ্জে। মানুষটি বড় সরল স্যার!
কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন,–শুনেছি বাবুগঞ্জের জমিদার ছিলেন মুখুজ্যেরা। ঠাকমশাই তাদের বংশের কেউ নাকি?
–সঠিক জানি না স্যার! তবে মুখে তো বড়াই করে বলেন! সম্পর্ক থাকতেও পারে, না-ও পারে। বাবুগঞ্জে অনেক মুখুজ্যে-চাটুজ্যে-বাঁড়ুজ্যে আছেন। কফি ঠিক হয়েছে তো স্যার?
–হ্যাঁ। শীতের সময় গরম কিছু দিয়ে গলা ভেজানোই যথেষ্ট। তো তুমি কি বাংলোয় সারাক্ষণ থাকো, নাকি বাড়ি-টাড়ি যাও?
সুবিমল একটু হেসে বলল,–বাংলোয় কেউ এলে বাড়ি যাওয়া হয় না। অন্যদিন সন্ধ্যার সময় কেটে পড়ি। সকালে আসি। সাইকেল আছে।
–কিন্তু নদী পার হও কী করে? নৌকায়?
–না স্যার! আর সে-বাবুগঞ্জ নেই। নদীতে ব্রিজ হয়েছে। বাবুগঞ্জ এখনও ছোটবাবু, মেজবাবু বড়বাবুদের টাউন। এই বাংলোয় বিদ্যুৎ এসে গেছে। টেলিফোনও।
বাঃ! আচ্ছা সুবিমল, মুখুজ্যেবংশের জমিদারদের কে নাকি কৃষিফার্ম করেছে এখানে? তোমাদের কলকাতার বড়সাহেব বলছিলেন।
–প্রমথ মুখুজ্যে স্যার! ওঁর ফার্মহাউস ওই জঙ্গলের ওধারে। ওখানে নদী বাঁক নিয়ে দক্ষিণে গেছে। সেই বাঁকের ওপরদিকে প্রমথবাবুর ফার্ম। দোমোহানির ওয়াটারড্যাম ওখান থেকে প্রায় পাঁচ কি.মি. পূর্বে।
কর্নেল কফি শেষ করে চুরুট ধরিয়ে বললেন, তুমি দোমোহানির ড্যামের পাখির খবর বলো সুবিমল। আর জয়ন্ত! ততক্ষণ তুমি ঘরে গিয়ে পোশাক বদলে জিরিয়ে নিতে পারো! তিনঘণ্টা টানা ড্রাইভ করেছ।
সত্যিই আমি ক্লান্ত। ঘরে ঢুকে দেখলুম মেঝেয় কার্পেট। দুধারে দুটো নিচু খাট। একটা সোফাসেট। সেন্টার টেবিলে ফুলদানিতে তাজা ফুল, একদিকে ওয়াড্রোব। ঘরটা প্রশস্ত। লাগোয়া বাথরুম উঁকি মেরে দেখে নিলুম গিজার আছে। গরম জলে স্নান করা যাবে।
পোশাক বদলে বিছানায় লম্বা হলুম। টের পাচ্ছিলুম, রোদ কমে এলে শীত কী সাঙ্ঘাতিক হয়ে উঠবে। আর শীতের কথা ভাবতে গিয়ে হঠাৎ মনে পড়ে গেল প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদারমশাইয়ের কথা। ভদ্রলোক গতকাল এখানে এসেছেন। সাধু-সন্ন্যাসীর বেশে কোথায় ধুনি জ্বেলে রাত কাটিয়েছেন কে জানে! তবে ওঁর পক্ষে অসাধ্য কিছু নেই। পুলিশজীবনের কত রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনি তিনি শুনিয়েছেন। অবশ্য কর্নেলের সঙ্গে তাকে এযাবৎ অনেক অ্যাডভেঞ্চারে বেপরোয়া পা বাড়াতে দেখেছি।
এবারকারটা কেমন হবে, এখনও বুঝতে পারছি না। জয়গোপালবাবু যে ছিটগ্রস্ত লোক, তা ঠিক। সুবিমলবাবুর কথায় মনে হল, জুতোচুরি নিয়ে ওঁর একটা পাগলামি আছে। অথচ কর্নেল এত গুরুত্ব দিয়ে ব্যাপারটা ভেবেছেন কেন কে জানে! কী আছে জয়গোপালবাবুর ঠাকুরদার দলিলে?
দেড়টার মধ্যে স্নানাহার সেরে নিয়ে কর্নেল বলেছিলেন,–আজ দোমোহানি জলাধারে পাখি দেখার মতো সময় পাব না। বরং বাবুগঞ্জের ভিতরটা দেখে নেওয়া যাক! সুবিমলকে সঙ্গে নিয়ে বেরুব।
আমি বলেছিলুম,–মফস্বলের শহরের যা অবস্থা! ওর ভিতরে আপনার দর্শনযোগ্য কিছু আছে। বলে মনে হয় না। তার চেয়ে গোয়েন্দামশাই কী অবস্থায় কোথায় আছেন, দেখা উচিত।
কর্নেল একটু হেসে বলেছিলেন,–পাশে একটা নদী, তখন শ্মশানঘাট সেই নদীর ধারে কোথাও নিশ্চয়ই আছে। সাধুবাবার বেশে হালদারমশাই শ্মশানঘাট বেছে নিতেও পারেন!
সেই সময় সুবিমল এসে গেল,–এবেলা কী প্রোগ্রাম করেছেন স্যার?
–জয়ন্ত এখানকার শ্মশানঘাট দেখতে চাইছে!
সুবিমল গম্ভীর হয়ে বলল,–বাবুগঞ্জের শ্মশানঘাট খুব প্রাচীন। জমিদারবাবুদের পূর্বপুরুষরা জায়গাটা নদীর তলা থেকে পাথরে বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন, যাতে নদীর স্রোতে ধসে না যায়। বুঝুন স্যার! মালগাড়িতে চাপিয়ে বিহার থেকে সেই পাথর আনা হয়েছিল। তারপর গরু-মোষের গাড়িতে চাপিয়ে বাবুগঞ্জ। বুঝুন কী এলাহি কাণ্ড! তারপর ওই শ্মশানকালীর মন্দির! জয়ন্তবাবু দেখার মতো জায়গাই দেখতে চেয়েছেন। স্যার!
কর্নেল চুরুটের ধোঁয়ার মধ্যে বললেন,–দেখার মতো জায়গা মানে?
সুবিমল চাপা গলায় বলল,–শ্মশানকালীর মন্দিরে নরবলি দিত জমিদারের পূর্বপুরুষেরা। শুনেছি, কাকে বলি দেওয়া হবে, তার খোঁজ দিত জমিদারের নায়েব। যে প্রজার খাজনা সবচেয়ে বেশি বাকি পড়েছে, সেই হতভাগাকে রাত্তিরে পাইকরা বেঁধে আনত, স্যার! সে মন্দির ভেঙে গেছে। বটগাছটা গিলে খেয়েছে মন্দির। প্রতিমা তুলে নিয়ে বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেছে ওরা। আর বটগাছের গোড়ায় মন্দিরের ধ্বংসস্তূপে কত যে মড়ার খুলি আছে-না দেখলে বিশ্বাস করবেন না। কখনও-সখনও কোনো সাধুবাবা এসে খুলিগুলি জড়ো করে বসে থাকে। ধুনি জ্বেলে চোখ বুজে মন্ত্র পড়ে।
কথাটা শুনতে পেয়ে চণ্ডী বলল,–কাল সন্ধ্যাবেলায় দেখেছিলুম এক সাধুবাবা এসে জুটেছেন।
কর্নেল আমার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললেন,–তাহলে জয়ন্তের ইচ্ছে পূর্ণ হোক। সুবিমল! কোথায় সেই শ্মশানঘাট? শর্টকাটে যেতে চাই কিন্তু!
সুবিমল বলল,–তাহলে নদীর ধারে বাঁধের পথে চলুন। ব্রিজ পেরিয়ে গিয়ে একটুখানি এগোতে হবে।
পূর্ববাহিনী বেহুলার দক্ষিণ তীরে বাঁধের দুধারে ঘন গাছপালা আর ঝোঁপঝাড়, একটা জেলেবসতি বাঁদিকে চোখে পড়ল। একটা একতলা ঘরের মাথায় টাঙানো আছে ‘বাবুগঞ্জ-ঝাঁপুইহাটি মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি, লেখা সাইনবোর্ড। কিছুদূর হেঁটে যাওয়ার পর নদীর ব্রিজের এদিকটায় দুধারে দোকানপাট আর ভিড়। ব্রিজ পেরিয়ে গিয়ে আবার বাঁধ এবং গাছের সারি। তারপর নদী যেখানে উত্তরে বাঁক নিয়েছে, সেখানে উঁচু জমির ওপর একটা বিশাল বটগাছ। কর্নেল মাঝে-মাঝে বাইনোকুলারে হয়তো পাখি দেখছিলেন। সুবিমল বলল,–এসে গেছি স্যার!
চওড়া উঁচু জায়গাটা ছাইভর্তি। ঘাসে ঢাকা বটতলার ওদিকটায় ইতস্তত চিতার ছাই। সেই ছাই উত্তরের বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে। বাঁধ থেকে সেখানে কয়েক পা এগিয়ে তারপর ‘সাধুবাবা’ কে চোখে পড়ল। সামনে ধুনি জ্বেলে গায়ে কম্বল জড়িয়ে তিনি বসে আছেন। হা-গোয়েন্দাপ্রবরই বটে! আমাদের দেখামাত্র তিনি চোখ বন্ধ করে ফেললেন।
সুবিমল একটু দূরে হাঁটু মুড়ে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করছে দেখে হাসি পাচ্ছিল। কিন্তু · কর্নেল চোখের ইঙ্গিতে আমাকে দূরে থাকতে বললেন। আমি আস্তে বললুম,–সুবিমলবাবু! সাধুবাবা খুব রাগী মানুষ মনে হচ্ছে। পাশেই ত্রিশূল পোঁতা। কিছু বলা যায় না, হঠাৎ ত্রিশূল ছুঁড়ে মারতে পারেন। চলুন, ওপাশে ওই নিমগাছটার কাছে গিয়ে দাঁড়াই। কর্নেলের ব্যাপার তো জানেন! উনি সাধুদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে তুলতে পারেন।
নিমতলায় দাঁড়িয়ে লক্ষ করলুম। কর্নেল অবিকল সুবিমলের মতো হাঁটু মুড়ে নমো করলেন। তবে টুপিপরা মাথা মাটিতে ঠেকানোর অসুবিধে আছে। তারপর দেখলুম, দুজনে কী সব কথা হচ্ছে।
সুবিমল সতর্কভাবে একটু হেসে ফিসফিস করে বলল,–বুঝলেন জয়ন্তবাবু! সাধুবাবা কর্নেলসায়েবকে বিদেশি সায়েব ভেবেছেন। আমি সাধুবাবাদের এই ব্যাপারটা দেখেছি। সায়েব-মেমদের খাতির করে।
একটু পরে কর্নেল এসে বললেন,–সাধুবাবার আশীর্বাদ নিয়ে এলুম।
আমি বললুম,–তাহলে আমিও আশীর্বাদ নিয়ে আসি?
কর্নেল গম্ভীরমুখে বললেন,–সাধুবাবা প্রতিদিন মাত্র একজনকে আশীর্বাদ করেন। তারপর যারা যায়, তাদের অভিশাপ দেন। ভাগ্যিস আজ সারাদিন ওঁর কাছে কেউ যায়নি। নইলে আমাকে অভিশাপ দিতেন। এ এক সাঙ্ঘাতিক সাধু। চলোলা সুবিমল। এখান থেকে কেটে পড়ি।
সুবিমল বাঁধে উঠে বলল,–জয়ন্তবাবু নিশ্চয় মড়ার খুলিগুলো দেখতে পেয়েছেন?
বললুম,–হ্যাঁ! দেখলুম, কত খুলি গাছের শেকড়ে আটকে আছে।
সুবিমল হঠাৎ ফুঁসে উঠল। ওই হতভাগা প্রজাদের অভিশাপেই তো মুখুজ্যেদের জমিদারি ধ্বংস হয়ে গেছে।
কর্নেল একটু হেসে বললেন,–জমিদারিপ্রথা উচ্ছেদ করা হয়েছিল স্বাধীনতার পরে, হতভাগ্যদের অভিশাপ দেরি করে লেগেছিল।
–দেরি কী বলছেন স্যার! প্রথম মুখুজ্যের ঠাকুরদার আমলেই নাকি সাংঘাতিক কাণ্ড হয়েছিল। তখন আমার জন্মই হয়নি। ১৯৪২ সালের আগস্ট আন্দোলনের কথা বইয়ে পড়েছি। আপনারা তো আমার চেয়ে বেশি জানেন। বাবার মুখে শুনেছিলুম, আগস্ট মাসে তখন প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি হয়েছিল ক’দিন ধরে। একরাত্রে স্বদেশিবাবুরা জমিদারের খাজাঞ্চিখানা লুঠ করেছিলেন। অনেক ধনরত্নও নাকি লুঠ হয়েছিল। শোনা কথা, জয়গোপালবাবুর ঠাকুরদা ছিলেন খাজাঞ্চিবাবু। ঝড়জলের জন্য তিনি বাড়ি যেতে পারেননি। তাঁকে বেঁধে রেখে লুঠ চলেছিল। শেষরাত্তিরে বিনয়বাবু-খাজাঞ্চি, কোনোভাবে বাঁধন খুলে পালিয়ে আসেন। তবে শোনা কথা স্যার। খাজাঞ্চিবাবু নাকি বিপ্লবীবাবুদের লুঠ-করা জুয়েলসের কিছুটা কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। তাই নিয়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড বেধেছিল। পুলিশ বিনয়বাবুকে জেল খাটাতে চেয়েছিল। প্রমাণের অভাবে তিনি খালাস পান। তবে জমিদারবাবুদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলেন।
কর্নেল বললেন,–তারপর?
–বছর আট-দশ পরে বিনয়বাবু বাবুগঞ্জে ফিরে আসেন। জমিদারবাবুদের অবস্থা ততদিনে পড়ে গেছে। দালানকোঠা মেরামতের অভাবে ধ্বসে পড়েছে। ওই যে বলছিলুম, অভিশাপ!
–তাহলে জয়গোপালবাবুর ঠাকুরদা নিরাপদে বাড়ি-ঘর তৈরি করে বসবাস করতে পেরেছিলেন?
–হ্যাঁ স্যার। এখনও সেই তিনকামরা একতলা বাড়ি আছে।
–চলো সুবিমল! সেই বাড়িটা বাইরে থেকে দেখে বাবুগঞ্জের ভিতর দিয়ে বাংলোয় ফিরব। ব্রিজের কাছে আসতেই দেখলুম, একটা লোক লাঠি হাতে ল্যাংচাতে-ল্যাংচাতে এদিকে আসছে। গায়ে সোয়েটার। মাথায় মাফলার জড়ানো। আর পরনে যেমন-তেমন প্যান্ট, পায়ে চপ্পল, লোকটা যে নেশা করেছে, তা বোঝা যাচ্ছিল। সুবিমলকে দেখেই সে বলে উঠল,–এই যে বাবা হারাধন।
সুবিমল ধমকের সুরে বলল,–মাতলামি করবে না প্রবোধদা! দেখছ না আমার সঙ্গে কারা আছেন?
জয়গোপালবাবুর মুখে তার পিসতুতো ভাই প্রবোধের কথা শুনেছিলুম। এই সেই প্রবোধ। সে জড়ানো গলায় হেসে বলল,–মাইরি সুবিমল! আমার খালি ভুল হয়! ছেলেকে দেখলেই বাপের নাম বলে ফেলি। হ্যাঁ! তুমি ঝাঁপুইহাটির হারাধনের ছেলে সুবিমল। বাবা সুবিমল! সাবধান! জুতো হারিয়ো না যেন! জুতো হারাতে-হারাতে শেষে নিজেই হারিয়ে যাবে! মাইরি বলছি! আমাদের গোপাল! জয়গোপালের জুতা হারাত না? শেষে আজ শুনি সে নিজেই হারিয়ে গেছে। হিমি কেঁদেকেটে থানাপুলিশ করে বেড়াচ্ছে। এই বাবা সায়েব! গিভ মি টেন রুপি! ওনলি টেন।
কর্নেল বললেন,–জয়গোপালবাবু হারিয়ে গেছেন। আপনি তাকে খুঁজে বের করুন।
মাতাল প্রবোধ হিহি করে হেসে উঠল।–ওরে বাবা! এ তো দিশি সায়েব দেখছি! ধুস!
কর্নেল আমাকে অবাক করে তাকে একটা দশটাকার নোট দিয়ে বললেন,–জয়গোপালবাবু। আপনার মামার ছেলে। তাকে খুঁজে বের করে সুবিমলকে গোপনে জানালে একশো টাকা বকশিশ পাবেন। কেউ যেন জানতে না পারে।
টাকা পেয়ে প্রবোধ যেন হকচকিয়ে গিয়েছিল। তারপর সে সেলাম ঠুকে চাপাস্বরে বলল,–মাইরি, একশো টাকা দেবেন?
কর্নেল একটু হেসে বললেন,–দেব।
–মা কালীর দিব্যি?
–মা কালীর দিব্যি।
মাতাল প্রবোধ ল্যাংচাতে-ল্যাংচাতে ভিড়ের মধ্যে গিয়ে মিশল। শেষ-বিকেলে তখন ব্রিজের মুখে যানবাহন আর তুমুল ভিড়। কারণ বাবুগঞ্জের উত্তরপ্রান্তে ব্রিজের কাছাকাছি দুধারে দোকানপাট। নদীর ওপারের গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে লোকেরা এসে শেষবেলায় কেনাকাটা করে বাড়ি ফেরার জন্য ব্যস্ত। গরু-মোষের গাড়ি, সাইকেলভ্যান, টেম্পো, লরি-বাস ব্রিজের মুখে এসে জট পাকিয়েছে।
ভিড় পেরিয়ে কিছুটা যাওয়ার পর সুবিমল কর্নেলকে বলল,–ওই মাতালটাকে টাকা দিলেন স্যার! ও আবার মদের দোকানে গিয়ে মদ গিলবে।
কর্নেল বললেন,–সুবিমল! এবার জয়গোপালবাবুর বাড়ি চলে!
–সামনে ডানদিকের গলিরাস্তায় ঢুকতে হবে। কিন্তু আপনি কি প্রবোধদার কথা বিশ্বাস করেছেন?
-কিছু বলা যায় না। প্রবোধের কথা সত্য হতেও পারে।
বিকেলের আলো দ্রুত কমে আসছিল। গলির দুপাশে মাটি বা ইটের একতলা বাড়ি। কিন্তু গলিপথটা নির্জন। একটু পরে দুধারে পোড়ো জমি চোখে পড়ল। ঝোঁপ-জঙ্গল গজিয়ে আছে। তারপর একটা পুরোনো একতলা ইটের বাড়ি দেখতে পেলুম। সামনে খানিকটা জায়গায় মাটি নগ্ন।
সেখানে দাঁড়িয়ে সুবিমল বাঁদিকে নিচু পাঁচিলে ঘেরা জমিটা দেখিয়ে বলল,–ওখানে স্যার মুখুজ্যেমশাইয়ের এক শরিক অবনীবাবু গার্লস স্কুল তৈরি করবেন। কিন্তু জমিটা জবরদখল। জয়গোপালবাবু যখন রেলে চাকরি করতেন, তখন হিমিদি–মানে হৈমন্তীদি, উনি স্যার প্রাইমারি স্কুলের টিচার–তো উনি অবনীবাবুর সঙ্গে এঁটে উঠতে পারেননি। মামলা করার সাহস হয়নি। পঞ্চায়েতে নালিশ করেছিলেন। শেষে পঞ্চায়েত বলেছিল, জমিটা খালি পড়ে আছে। ওটা গার্লস স্কুলের জন্য দান করে দাও।
এই সময় বাড়ির দরজা খুলে একজন প্রৌঢ়া বেরিয়ে বলল,–ওখানে কারা গো?
সুবিমল এগিয়ে গিয়ে বলল,–সরলামাসি! আমি সুবিমল! হিমিদি বাড়ি নেই বুঝি?
–অ! সুবিমল? এই দ্যাখো না বাবা কী বিপদ! আমাকে পাহারায় রেখে বাবুদিদি গেছেন থানায়। সেই দুপুরে গেছেন। এখনও ফিরছেন না। আমি শুধু ঘর-বার করছি।
–কী বিপদ সরলামাসি?
–তুমি শোনোনি? সারা বাবুগঞ্জ, শুনেছে। বিপদ বলে বিপদ! অমন এক জলজ্যান্ত লোক গোপালবাবু কলকাতা গেলেন। গিয়ে ফেরার পথে হারিয়ে গেলেন!
–হারিয়ে গেলেন মানে?
–হ্যারিয়ে গেলেন বইকী। রানাঘাট ইস্টিশনে বাবুদাদাকে ট্রেন থেকে কাল বিকেলে নামতে দেখেছিল হরেন-গয়লা। শুধু সে একা দেখেনি। আরও দেখেছিল মুসলমান পাড়ার মকবুল। বাবুদিদির কান্নাকাটি আর থানা-পুলিশ করার খবর পেয়ে তারা এসে বলে গিয়েছে। পুলিশকেও বলেছে। এদিকে সারাটা রাত্তির গেল। সকাল গেল। বাবুদাদার খবর নেই। বাবুদিদির মাসতুতো দাদা কলকাতার পুলিশ। তাকে বাবুদিদি টেলিফোনে খবর দিয়েছিলেন। তিনি দুপুরবেলা এসে বাবুদিদিকে নিয়ে আবার থানায় গেছেন।-বলে প্রৌঢ়া আমাদের দিকে তাকাল।
সুবিমল বলল,–এনারা কলকাতার সায়েব। এখানে বেড়াতে এসেছেন। আমি যেখানে কাজ করি, সেই বাংলোতে উঠেছেন। স্যার! সরলামাসির জেলেপাড়ায় বাড়ি। দেখলে বুঝবেন না মাসির কী ক্ষমতা! ওদের মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির অফিসে দিনের বেলা ডাকাত পড়েছিল। মাছ বিক্রির টাকা সেদিন বিলি হওয়ার কথা। খবর পেয়ে নৌকায় চেপে ডাকাত এসেছিল। আর এই মাসি এক ডাকাতকে ধরে উপুড় করে ফেলেছিল। বেগতিক দেখে অন্য ডাকাতরা পালিয়ে যায়।
সরলা বলল,–ওসব কথা থাক বাবা সুবিমল। এই বিপদ নিয়ে আমার মাথার ঠিক নেই। অ্যাদ্দিন বাবুদাদা যেখানে যেতেন জুতো হারিয়ে আসতেন। ছেলেছোকরারা ঠাট্টা-তামাশা করত। এখন বাবুদাদা নিজেই কোথায় হারিয়ে গেলেন! রানাঘাট হাসপাতাল থেকে বাবুগঞ্জ পর্যন্ত যত ছোট-বড় হাসপাতাল আছে খোঁজ নিয়েছে পুলিশ। পাত্তা নেই।
কর্নেল বললেন,–জয়গোপালবাবুর কি কোনো শত্রু আছে এখানে?
–অমন ভোলাভালা মানুষের কে শত্রু থাকবে সায়েবকবা? বাবুদাদা রেলের চাকরি শেষ করে নিজের বাবার বাড়িতে এসে ঠাই নিয়েছিলেন। ওনার বোন অ্যাদ্দিন বাড়িখানা যত্ন করে আগলে রেখেছেন। ধরুন, বাবুদিদিরও তো বয়েস হয়েছে। ছেলেপুলে নেই। আর কদ্দিন চাকরি করবেন? আপদে-বিপদে পড়লে আমাকে খবর পাঠান, আসি। পাশে এসে দাঁড়ালে উনিও মনে জোর পান। কিন্তু এ কী হল বুঝতে পারছি না।
কর্নেল বললেন,–সুবিমল! এই বাড়ির দরজায় কারা নাকি কুকুরের মুন্ডু কেটে ঝুলিয়ে ছিল–তুমিই বলছিলে!
সুবিমল কিছু বলার আগেই সরলা বলল,–আজ্ঞে হ্যাঁ সায়েববাবা। বাবুদিদির পোষা কুকুর। কালো রঙের জন্য কালু নামে তাকে ডাকতেন। রাতবিরেতে বাড়ি পাহারা দিত, পেল্লায় কুকুর গোয় বাঘের মতো গজরাত।
কর্নেল বললেন,–সুবিমল বলছিল দুষ্টু ছেলে-ছোকরাদের কীর্তি।
সরলা চোখ বড় করে ক্রুদ্ধস্বরে বলল,–ছেলে-ছোকরাদের সাধ্য কী রাত্তিরে তার কাছে যায়? সায়েববাবা! এ কাজ বজ্জাত লোকেদের। পাশেই দশকাঠা জায়গা গিলে খেয়ে আশ মেটেনি। এখন বাড়িখানা গিলে খাওয়ার মতলব করেছে।
সুবিমল বলল,–কালুকে মেরে বাড়ি দখল করবে কী করে? সরলামাসি! তুমি কী বলছ?
সরলা চাপাস্বরে বলল,–বাবুদিদি বলছিল, কালুকে মারার পর রোজ রাত্তিরে জানালার পিছনে কারা এসে ভূতপেরেতের গলায় কীসব বলে। তখন বাবুদিদি বাড়িতে ইলেকটিরি আলো জ্বেলে দিয়ে বাবুদাদাকে ডাকাডাকি করেন। বুঝলে বাবারা? কাল সন্ধে হয়ে গেল, বাবুদাদা কলকাতা থেকে ফিরলেন না। তখন ওই গলির মুখে মন্ডলবাবুর ছেলে বিট্টুকে বাবুদিদি পাঠিয়েছিলেন। ওঁর ছাত্তর বিট্টু। সে আমায় ডেকে এনেছিল। তারপর রাত্তিরে ওই ভূতপেরেতের উৎপাত। জানলা খুলেই টর্চবাতি জ্বালালুম। কাকেও দেখতে পেলুম না, দৌড়ে পালানোর শব্দ শুনলুম। তখন চেঁচিয়ে বললুম, ওরে বদমাশের দল! আমি সেই ডাকাত-ধরা মেয়ে সল্লা-মেছুনি! এবার চেপে ধরব না, মাছবেঁধা করে বিধব।
কর্নেল বললেন, ভূতপেরেতের গলায় কী বলছিল তারা, বুঝতে পেরেছ?
সরলা বলল,–সবকথা বুঝতে পারিনি। একটা কথা কানে আসছিল। জুতো।
–জুতো?
–আজ্ঞে হ্যাঁ সায়েববাবা! জুতো!
সুবিমল হাসল,–তাহলে দুষ্টু ছেলেদের কাজ!
–ছেলেদের অমন গলার স্বর হয় না। আর পায়ের শব্দও অত জোরালো হয় না। পিছনের দিকে গলির মুখে ততক্ষণে আলো জ্বলে উঠেছে। কাছে ও দূরে শাঁখ বাজছিল।
কর্নেল বললেন,–সরলা! বাড়ির আলো জ্বালবে না?
সরলা এতক্ষণে কাপড়ের আড়াল থেকে টর্চ আর একটা ধারাল হেঁসো বের করে বলল, ঘরের ভেতর আলোর সুইচ। বাবুদিদি সব ঘরে তালা এঁটে গিয়েছেন।
বলেই সে আঙুল তুলল,–ওই বাবুদিদিরা আসছেন!
ঘুরে দেখলুম, সরলার বয়সি এক মহিলা আর একজন প্যান্ট-শার্ট-সোয়েটার পরা ভদ্রলোক গলিপথে এগিয়ে আসছেন। কাছে এসে সেই ভদ্রলোক কর্নেলকে নমস্কার করে বললেন, স্যার আপনি?
কর্নেল বললেন,–হ্যাঁ পরেশ! জয়গোপালবাবুর নিখোঁজ হওয়ার খবর শুনে সেচবাংলো থেকে চলে এসেছি!
বুঝলুম, ইনিই কলকাতা পুলিশের সেই সাব-ইন্সপেক্টর পরেশবাবু। তিনি বললেন,–হিমিদি! ইনিই সেই কর্নেলসাহেব। আর ইনি কর্নেলসাহেবের সঙ্গী সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরী।
হৈমন্তী আমাদের নমস্কার করে দ্রুত এগিয়ে গেলেন। সরলা তাকে অনুসরণ করল। কর্নেল বললেন,–তোমরা থানায় গিয়েছিলে শুনলুম।
–সব বলছি স্যার! এখানে এত মশার মধ্যে আপনারা দাঁড়িয়ে আছেন। ভিতরে চলুন।
এই সময় সামনের একটা ঘরের দরজা খুলে গেল। ভিতরে উজ্জ্বল আলো। হৈমন্তী ডাকলেন, –পরেশ! কর্নেলসায়েবদের এই ঘরে নিয়ে এসো।
ঘরের সামনে একটুকরো বারান্দা আছে। বাইরের এই বারান্দায় উঠে কর্নেল থমকে দাঁড়ালেন। পরেশবাবু বললেন,–কী হল স্যার?
কর্নেল পকেট থেকে তার খুদে কিন্তু জোরালো টর্চের আলো পায়ের কাছে ফেললেন। দেখলুম ছোট্ট একটুকরো ইটের সঙ্গে বাঁধা ভাজকরা একটা হলদে কাগজ। কর্নেল সেটা কুড়িয়ে নিয়ে বললেন,–এটা সরলা বা তোমাদের চোখের পড়ার মতো জায়গায় কখন কেউ রেখে গেছে। দেখা যাক, এতে কী আছে।
ঘরে ঢুকে দেখলুম একপাশে একটা তক্তাপোশ। তাতে সতরঞ্চি বিছানো আছে। আর একটা পুরোনো নড়বড়ে টেবিল, চারটে তেমনই নড়বড়ে চেয়ার। দেওয়ালে পুরোনো একটা ক্যালেন্ডার ঝুলছে। দেওয়ালের তাকে ঠাসাঠাসি কী সব বই। পরেশেরই কথায় আমরা তক্তাপোশে বসলুম। কর্নেলের তাগড়াই শরীরের চাপে চেয়ার যে ভেঙে যেত, তা পরেশবাবু বিলক্ষণ জানেন মনে হল।
হৈমন্তী ও সরলা দুজনে ততক্ষণে সম্ভবত রান্নাঘরে আমাদের জন্য চা করতে গেছেন। বাবুগঞ্জের শীতটা এতক্ষণে আমাকে বাগে পেয়েছে। জ্যাকেটের জিপ টেনে দিলুম।
কর্নেল ইটের টুকরো থেকে সাবধানে ভাঁজ করা কাগজটা খুলে ফেলেছেন। চোখ বুলিয়ে তিনি পরেশবাবুকে দিলেন। পরেশবাবু পড়ার পর বললেন,–কাদের এত স্পর্ধা? এভাবে চিঠি লিখে হিমিদিকে হুমকি দিয়েছে!
সুবিমল ব্যস্তভাবে চাপাস্বরে জিজ্ঞেস করল,–কী লিখেছে? কী লিখেছে?
আমিও না বলে পারলুম না,–চিঠিটা একবার দেখতে পারি?
পরেশবাবু চিঠিটা আমাকে দিলেন। দেখলুম, হলদে কাগজটার উল্টোপিঠে কীটনাশক ওষুধের বিজ্ঞাপন। খালি পিঠে লাল কালিতে লেখা আছে। ইংরাজিতে একটা লাইন।
HE ME BONETK
এই লাইনটা পড়ে বললুম,–কর্নেল! নোকটা রসিক। ইংরাজিতে যা লিখেছে, তা পড়লে হবে ‘হিমি বোনটিকে’। অদ্ভুত রসিকতা তো!
পরেশবাবু বললেন,–এবার বাকিটা পড়ুন। রসিকতা না স্পর্ধা বুঝতে পারবেন।
কর্নেল একটু হেসে বললেন,–জয়গোপালবাবুর মতোই ছিটগ্রস্ত।
সুবিমল আগের মতো ব্যস্তভাবে বলল,–পড়ুন না জয়ন্তবাবু, কী লিখেছে?
বললুম,–পদ্য বলে মনে হচ্ছে।
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। তুমি পদ্যের মতো পড়ো। এই যে হৈমন্তীদেবীও এসে পড়েছেন। আমরা চা খাই। আপনি পদ্য শুনুন। সরলা কোথায়? তাকেও ডাকা উচিত।
হৈমন্তী বললেন,–শ্মশানঘাটের সাধুবাবাকে চা পাঠাতে দেরি হয়েছে। সরলা তাকে চা দিতে গেল।
–শ্মশানঘাটের সাধুবাবা?
–আজ্ঞে হ্যাঁ। উনি রাত্তিরে এখানে দু-মুঠো খেয়ে এই ঘরে শুয়ে থাকেন। আবার ভোরবেলা চলে যান। সারাদিন তপ-জপ করেন। ওঁর সেবাযত্ন আমিই করছি। তা কর্নেলসায়েব পদ্যের কথা বলছেন। কী পদ্য?
পরেশবাবু বললেন,–কোনো বজ্জাত তোমাকে হুমকি দিয়ে পদ্য লিখেছে। ওই কাগজটা সুতোয় জড়িয়ে ইটের টুকরোতে বেঁধে বারান্দায় কখন সে রেখে গিয়েছিল।
কর্নেল বললেন, আপনাকে লেখা চিঠি আপনি পাবেন। আগে কানে শুনে নিন। পড়ো জয়ন্ত!
চিঠিটাতে লেখা পদ্য ছন্দ মিলিয়ে পড়তে শুরু করলুম।
কর্নেল নীলাদ্রি সরকার
তাঁহাকে ডাকার কী দরকার
প্রাণ যদি চাও গোপালদার
সিন্দুক খুলবে ঠাকুরদার
দর্শন পাবে দুই পাদুকার
জঙ্গলে পোডড়া-ভিটে সাধুখাঁর
নিশিরাতে ঠিকঠাই রাখবার
হুঁশিয়ার পুলিশকে ডাকবার
চেষ্টাটি করলে গোপালদার
মুন্ডুটি ধড় ছেড়ে যাবে তার
হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার
কর্নেল বললেন,–চিঠিটা ওঁকে দাও জয়ন্ত!
হৈমন্তীদেবীর হাতে চিঠিটা দিয়ে চায়ে চুমুক দিলুম। তারপর লক্ষ করলুম, হৈমন্তী চিঠিটাতে দ্রুত চোখ বুলিয়ে বললেন,–কর্নেলসায়েব! এ তো ভারি অদ্ভুত ব্যাপার! গোলমেলে ঠেকছে।
কর্নেল বললেন, আগে বলুন কোথায় জঙ্গলে কোনো সাধুখাঁর পোড়ো-ভিটে আছে নিশ্চয় আপনি জানেন?
-হ্যাঁ। পুরোনো জমিদারবাড়ির ওধারে হরনাথ সাধুখাঁ নামে এক ব্যবসায়ীর বাড়ি ছিল। এখন তো সেই জমিদারবাড়ি ধ্বংসস্তূপ। হরনাথবাবু এখন বাজারে এসে বাড়ি করেছেন। চাল-ডাল এসবের আড়তদারি ব্যবসা করেন তিনি।
–আপনার ঠাকুরদার সিন্দুক কোথায় আছে?
হৈমন্তীদেবী কর্নেলের দিকে একবার তাকিয়ে মুখ নামালেন। তারপর মাথা নেড়ে আস্তে বললেন,–জানি না।
–আপনার ঠাকুরদার উইল আমি আপনার দাদার কাছ থেকে নিয়ে দেখেছি। তাতে একটা প্রাচীন সিন্দুকের কথা আছে। কিন্তু অদ্ভুত একটা ব্যাপার লক্ষ করলুম। আপনাদের তিনকামরা বাড়িটা একতলা। অথচ উইলে লেখা আছে, বাড়ির একটা অংশ দোতলা। সেই অংশের একতলায় সিন্দুকটা আছে।
পরেশবাবু বললেন, আমি তো এ বাড়িতে ছোটবেলায় কতবার এসেছি। দোতলায় কোনো ঘর দেখিনি। যদি আমার জন্মের আগে কোনো অংশ দোতলা থাকত, সে কথা নিশ্চয় জানতে পারতুম।
হৈমন্তীদেবী গম্ভীরমুখে বললেন,–দোতলা ঘর থাকলে তা ভেঙে যাওয়ার কোনো চিহ্ন থাকত। আমি উইল দেখেছি। ওটা যে মুহুরিবাবু লিখেছিলেন, তারই ভুল বলে আমার ধারণা।
কর্নেল বললেন, আপনার দাদার কী ধারণা, জানেন?
–দাদার বিশ্বাস, সিন্দুকটা কোনো ঘরে পোঁতা আছে।
–আপনার ঠাকুরদার পাদুকা অর্থাৎ জুতোর ব্যাপারটা কী, আপনি জানেন?
–নাঃ! দাদা আসবার পর তার অনেকগুলো জুতো হারিয়েছিল। তারপর দাদা নিজেই হারিয়ে গেল। শেষে এই চিঠি। কে বা কারা দাদাকে কোথায় বন্দি করে রেখে ঠাকুরদার জুতো দাবি করছে–কিছু বুঝছি না।
–পরেশ! পুলিশ কি জয়গোপালবাবুর অন্তর্ধানের কোনো হদিস পেয়েছে?
পরেশবাবু বললেন,–বাবুগঞ্জে হরেন নামে একজন গোয়ালা আছে। সে দুধের কারবার করে। রোজ কলকাতা যাতায়াত করে সে। সে পুলিশকে বলেছে, প্ল্যাটফর্মে ভিড়ের মধ্যে গোপালদাকে সে দেখেছিল। আর মকবুল নামে একটা লোক ডিমের কারবারি। সে স্টেশনের পিছনে বাসে চাপবার সময় গোপালদাকে দেখতে পেয়েছিল। গোপালদা হন্তদন্ত হেঁটে একটা প্রাইভেট কারের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। তখন বাস ছেড়ে দেয়। কাজেই মকবুল আর কিছু দেখতে পায়নি। কাজেই পুলিশ ঠিকই সন্দেহ করেছে, গোপালদা কারও প্রাইভেট কারে চেপেছিলেন। সে-ই তাকে সুযোগ পেয়ে অপহরণ করেছে।
–গাড়ির রং কী গাড়ি, তা কি মকবুল লক্ষ করেছিল?
–গাড়িটার যা বর্ণনা মকবুল দিয়েছে, তাতে অ্যামবাসাডার বলে মনে হয়েছে। গাড়িটার রং তত সাদা নয়। মেটে রঙের। এখন সমস্যা হল, বাবুগঞ্জে আজকাল অসংখ্য গাড়ি আছে। হিমিদির সন্দেহ অবনী মুখুজ্যের গাড়ি। কিন্তু তার অ্যামবাসাড়ার গাড়ি নেই। সাদা রঙের মারুতি আছে।
বলে পরেশবাবু ঘড়ি দেখলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,–হিমিদি! আমাকে সাড়ে সাতটার বাসে কলকাতা ফিরতে হবে। কর্নেলসায়েব! আমি একদিনের ছুটি নিয়ে এসেছিলুম। আপনি যখন এসে গেছেন, আমি নিশ্চিন্ত! বাবুগঞ্জ থানার ও.সি. বাসুদেব ঘোষ এখানে আপনার আসবার কথা জানেন। পুলিশ সুপার তাঁকে খবর দিয়েছেন। বাসুদেববাবু সেচ-বাংলোেয় আপনার সঙ্গে আজ রাত্রেই দেখা করতে যাবেন।
পরেশবাবু হৈমন্তীদেবীর সঙ্গে বাড়ির ভিতরে গেলেন। সেই সময় সুবিমল চাপাস্বরে বলল, –স্যার! আমার একটা সন্দেহ হচ্ছে। কর্নেল বললেন,–কী সন্দেহ?
–হিমিদির ঠাকুরদার সিন্দুক কোথায় লুকোনো আছে তা হিমিদি হয়তো জানেন।
–কী করে বুঝলে?
–হিমিদির চোখ-মুখ দেখে। সিন্দুকের কথা শুনেই উনি কেমন যেন চমকে উঠেছিলেন।
কর্নেল কিছু বলার আগেই একটা ব্রিফকেস হাতে নিয়ে পরেশবাবু এলেন। তারপর আমাদের কাছে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। হৈমন্তীদেবী বাইরের বারান্দায় গিয়ে তাকে বললেন,–তোমাকে টেলিফোন করে সব জানাব পরেশ। তিনি ভিতরে এলে কর্নেল বললেন, –হৈমন্তীদেবী! ওই পদ্যে লেখা চিঠিটা আমার দরকার। আপনার দাদাকে উদ্ধার করার জন্য ওটা একটা মূল্যবান সূত্র। তবে একটা কথা। পুলিশকে এই চিঠির কথা যেন জানাবেন না।
চিঠিটা হৈমন্তীদেবীর হাতের মুঠোয় ছিল। তিনি কর্নেলকে সেটা দিলেন। এই সময় সরলার, সাড়া পাওয়া গেল। সে বাইরের বারান্দায় উঠে ঘরে ঢুকল! তার হাতে ছোট একটা কেটলি আর কাঁচের গেলাস। সে বলল,–গিয়ে দেখি শ্মশানঘাটে ধুনির আগুন আছে। কিন্তু সাধুবাবু নেই। ডাকাডাকি করে সাড়া পেলুম না।
কর্নেল একটু হেসে বললেন,–সাধু-সন্ন্যাসীদের স্বভাবই এরকম। কোথায় কখন থাকেন। আবার উধাও হয়ে যান। আচ্ছা চলি। চিন্তা করবেন না। আপনার দাদাকে আশা করি শিগগির উদ্ধার করে দেব।
যে পথে গিয়েছিলুম, সেচ-বাংলোয় সেই পথেই এসেছিলুম। ঠান্ডায় আমার হাত-পা প্রায় নিঃসাড়। সুবিমল ঠাকমশাইকে কফির তাগিদ দিয়ে রুমহিটারের সুইচ অন করে দিল। তারপর সে বেরিয়ে গেল। তখন কর্নেলকে চাপাস্বরে জিজ্ঞেস করলুম,হালদারমশাইয়ের কানে কী ফুসমন্তর দিলেন যে উনি শ্মশানঘাট থেকে উধাও হয়ে গেলেন?
কর্নেল একটু হেসে বললেন,–কাল বাবুগঞ্জে এসেই হালদারমশাই শ্মশানঘাটের ওদিকে ঝোঁপের আড়ালে সাধু সেজে গিয়েছিলেন। তারপর শ্মশানঘাটের বটতলায় ধুনি জ্বেলে বসে ছিলেন। তাঁর বরাত ভালো। হৈমন্তীর সাধু-সন্ন্যাসীদের প্রতি খুব ভক্তি আছে। সেটা অবশ্য তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক। তরে তার দেখাদেখি সরলারও একইরকম ভক্তি আছে। সরলা কাল বিকেলে শ্মশানঘাটে এক সাধুবাবাকে দেখে হৈমন্তীকে খবর দিয়েছিল। ব্যস্! শীতের রাতে শ্মশানঘাটে কাটানো সম্ভব ছিল না বলব না। কারণ হালদারমশাইয়ের পক্ষে পুলিশজীবনে অমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। কিন্তু ওখানে বসে থেকে কষ্ট করে রাত কাটিয়ে তার লাভটা কী? তার উদ্দেশ্য ছিল জয়গোপালবাবুর বাড়ির আনাচেকানাচে ওত পেতে দুবৃত্তদের পাকড়াও করা। কাজেই হৈমন্তী তার সেবাযত্ন করতে চাইলে প্রত্যাখ্যান করবেন কেন?
–তাহলে গতরাতে গোয়েন্দামশাই দুবৃত্তদের সঙ্গে লড়াইয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন?
–নাঃ! তারা আড়াল থেকে সম্ভবত দেখেছিল ত্রিশূলধারী এক সাধুবাবা হৈমন্তীর অতিথি!
–তা উনি আজ হঠাৎ বেপাত্তা হলেন কেন? আপনার পরামর্শে?
–হ্যাঁ। হালদারমশাই আমাকে খবর দিলেন, জয়গোপালবাবু বাড়ি ফেরার পথে নিখোঁজ। তাঁর বোন থানা-পুলিশ করে বেড়াচ্ছেন। কথাটা শুনেই আমি ওঁকে পরামর্শ দিলুম, প্রাক্তন জমিদারপরিবারের ঠাকুরবাড়িতে চলে যান। খুব হুঙ্কার ছাড়বেন। তন্ত্রমন্ত্র আওড়াবেন।
–তাতে কী লাভ!
–মুখুজ্যেবাড়ির লোকজনের গতিবিধির খবর দৈবাৎ মিলতেও পারে।
–জয়গোপালবাবুর নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে মুখুজ্যেদের কোনো যোগাযোগ আছে বলে মনে করছেন?
–জানি না। তবে চান্স নিলে ক্ষতি কী?
এই সময় ঠাকমশাই ট্রেতে কফি আর পাঁপড়ভাজা এনে টেবিলে রাখলেন। তারপর বললেন,–সাহেবকে থানা থেকে ফোন করেছিল কেউ। চণ্ডী ফোন ধরেছিল।
–চণ্ডী কোথায়?
-আজ্ঞে সে বাড়ি চলে গেছে। কাল সকালে ইঞ্জিনিয়ারসাহেবকে জিপগাড়িতে চাপিয়ে সে কোথায় নিয়ে যাবে। গ্যারেজ থেকে জিপগাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেছে চণ্ডী। বুঝলেন স্যার? জিপগাড়িটা ইঞ্জিনিয়ারসায়েব আপনাদের জন্যই পাঠিয়েছিলেন। আপনারা গাড়ি এনেছেন শুনে ইঞ্জিনিয়ারসায়েব জিপগাড়িটা চণ্ডীকে নিয়ে যেতে বলেছিলেন।
ঠাকমশাই মাথায় মাফলার জড়িয়েছেন এবং গায়ে আস্ত একখানা কম্বল। তিনি বেরিয়ে যাওয়ার পর বললুম,–একটা ব্যাপার ভারি অদ্ভুত লাগছে।
কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন,–বলো!
–কিডন্যাপার হুমকি দিয়ে পদ্য লিখল কেন? সে এও জানে স্বয়ং কর্নেল নীলাদ্রি সরকার জয়গোপালবাবুর কেস নিয়েছেন এবং এখানে এসেছেন। লোকটাকে রসিক মনে হচ্ছে।
কর্নেল হাসলেন,–পল্লীকবিও বলতে পারো। ছন্দ আর মিল দেখে মনে হচ্ছে, সে অনেকদিন ধরে পদ্য লেখে। অবশ্য আমার তো মনে হয়, বাঙালিরা জাতকবি।
-–আচ্ছা কর্নেল, আপনি কখনও কবিতা লিখেছেন?
বাইরে সুবিমলের কণ্ঠস্বর শোনা গেল,–কার সঙ্গে কথা বলছ জগাই।
–এক ভদ্রলোক সায়েবদের সঙ্গে দেখা করতে চান।
কর্নেল বারান্দায় বেরিয়ে গিয়ে বললেন, কী আশ্চর্য! হালদারমশাই যে! আসুন! আসুন! সুবিমল! গেট খুলে দিতে বলো!
আমি চমকে উঠেছিলাম। কিন্তু বাইরে গেলাম না। কর্নেলকে বলতে শুনলাম,–সুবিমল! পটে প্রচুর কফি আছে। একটা কাপ নিয়ে এসো!
কর্নেলের পিছনে হালদারমশাই ঢুকলেন। সাধুবাবার বেশে নয়, প্যান্ট-শার্ট-সোয়েটার কোট-হনুমানের টুপি পরে এবং কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে। বললুম,–কর্নেল বলছিলেন আপনি মুখুজ্যেদের ঠাকুরবাড়িতে ।
আমাকে থামিয়ে দিয়ে হালদারমশাই বললেন,–পরে কইতাছি। আগে রেস্ট লই।
কর্নেল চুপচাপ বসে কফিপানে মন দিলেন। একটু পরে সুবিমল একটা কাপ-প্লেট আনল। কর্নেল বললেন,–সুবিমল! ইনি আমার বন্ধু-ওঃ হো তুমি তো দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায় জয়ন্তর ক্রাইম-রিপোর্টাজ পড়ো। তাহলে অনুমান করো নি কে?
হালদারমশাই কাপে কফি ঢালতে-ঢালতে বললেন,–আইজ রাতে হেভি শীত পড়ছে।
সুবিমল মুচকি হেসে বলল,–মনে পড়েছে। আপনি হালদারমশাই বলে ডাকলেন, তখন আমার অত খেয়াল ছিল না। নমস্কার স্যার। আমি বাংলোর কেয়ারটেকার সুবিমল হাজরা।
গোয়েন্দা এবার হাসবার চেষ্টা করে বললেন,–বয়সে পোলাপান! আপনি কমু ক্যান? তুমিই কমু!
–নিশ্চয় স্যার! আপনাদের তিনজনকে একত্রে চর্মচক্ষে দেখতে পাব তা কল্পনাও করিনি।
কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন,–সুবিমল! বিকেলে শ্মশানঘাটে এঁকেই তুমি নমো করেছিল!
সুবিমল চমকে উঠে বলল,–কী অদ্ভুত! ইনিই সাধুবাধা সেজে শ্মশানঘাটে বসেছিলেন!
–হ্যাঁ, ওই প্রকাণ্ড ব্যাগে ওঁর জটাজুট দাড়ি-টাড়ি আছে। কিন্তু ত্রিশূল? হালদারমশাই! ত্রিশূল কোথায় ফেলে এলেন?
–সব কমু। কফি খাইয়া লই। হেভি ফাইট দিছি। টায়ার্ড।
কর্নেল বললেন,–সুবিমল! হালদারমশাইয়ের থাকার ব্যবস্থা করতে হবে।
সুবিমল বলল,–কোনো অসুবিধে নেই স্যার। ইঞ্জিনিয়ার সেনসায়েব এসে যে ঘরে থাকেন, সেই ঘরে ওঁর থাকার ব্যবস্থা করছি। আর ঠাকমশাইকে বলে আসি, একজন গেস্ট এসেছেন।
সে বেরিয়ে যাওয়ার পর হালদারমশাই ফুঁ দিয়ে দ্রুত কফি শেষ করলেন। তারপর যা বললেন, তা সংক্ষেপে এই :
কর্নেলের কথামতো সন্ধ্যায় হালদারমশাই শ্মশানঘাট থেকে উঠে বাবুগঞ্জের ভিতর দিয়ে হেঁটে যান। তার নিজস্ব হিন্দিতে জমিদারদের ঠাকুরবাড়ির পথ জিজ্ঞেস করে চলতে থাকেন। তারপর নিজের খেয়ালে সোজা ঠাকুরবাড়িতে না ঢুকে পিছনে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ঢুকে পড়েন। ততক্ষণে সন্ধ্যারতি শেষ হয়েছে। হালদারমশাই পাঁচিল ডিঙিয়ে ঢুকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ঠাকুরবাড়ির ভিতরের চত্বরে উজ্জ্বল আলো। তিনি কী করবেন ভাবছেন, হঠাৎ পিছন থেকে টর্চের আলো এসে তার ওপর পড়ে। বেগতিক দেখে তিনি ত্রিশূল তুলে হুঙ্কার দিয়ে তেড়ে যান। কিন্তু তার পিছন থেকে কেউ তাকে জাপটে ধরে। জোর ধস্তাধস্তি চলতে থাকে। মরিয়া হয়ে হালদারমশাই তার লাইসেন্সড রিভলভার বের করে টর্চের দিকে গুলি ছোড়েন। টর্চের কাঁচ গুঁড়ো হয়ে টর্চ ছিটকে পড়ে। সামনের লোকটা আর্তনাদ করে ওঠে। এদিকে যে পিছন থেকে তাকে জাপটে ধরে মাটিতে ফেলেছিল, সে হালদারমশাইয়ের হাতে রিভলভার দেখে এবং গুলির শব্দ শুনে বাপরে! বাপরে! ডাকাত! ডাকাত! বলে চাচাতে-চাঁচাতে রাস্তার দিকে ছুটে যায়। লোকেরা লাঠিসোটা-বল্লম নিয়ে ছুটে আসতে পারে ভেবে হালদারমশাই ত্রিশূলের কথা ভুলে গিয়ে তার ওই ঝোলাটি চেপে ধরে দৌড়তে থাকেন। নাক বরাবর দৌড়ে নির্জন পিচরাস্তা পেয়ে যান। তারপর টর্চের আলো জ্বেলে সামনে শালের জঙ্গল দেখে ঢুকে পড়েন। জঙ্গলের ভিতরে সাধুবাবার বেশ বদলে প্যান্টশার্ট-সোয়েটার-কোট আর হনুমান টুপি পরে জঙ্গল থেকে বেরুচ্ছেন, সেই সময় দেখতে পান, পাশের একটা মারামরাস্তা দিয়ে একটা গাড়ি আসছে। তিনি লক্ষ করেন ওটা জিপগাড়ি। হাত তুলে গাড়ি দাঁড় করিয়ে তিনি সেচ-বাংলোর কথা জিজ্ঞেস করেন। জিপের চালক বলে, এই মোরামরাস্তা ধরে চলে যান।
কর্নেল বললেন,–ইঞ্জিনিয়ার মিঃ সেনের জিপগাড়ি। চণ্ডী গাড়িটা নিয়ে যাচ্ছিল। যাই হোক, বোঝা যাচ্ছে, আমাকে তো বটেই, আপনাকেও শত্রুপক্ষ চেনে। এটা একটা ভাববার কথা। তো ওসব পরে ভাবা যাবে। আপনি বাথরুমে ঢুকে অন্তত মুখহাত ধুয়ে ফেলুন। গরমজলের ব্যবস্থা আছে। আপনার মুখে এখনও ছাইয়ের ময়লা লেগে আছে। রুমালে চিতার ছাই মোছা যায় না। আর কপালের লাল রংগুলোও ধুয়ে ফেলবেন।
বললুম,–ছ্যা-ছ্যা! মড়াপোড়া ছাই মুখে ঘষেছিলেন হালদারমশাই?
গোয়েন্দাপ্রবর কোট এবং সোয়েটার খোলার পর খিখি করে হেসে বললেন,–সে-ছাই না। . কাঠ কুড়াইয়া ধুনি জ্বালছিলাম, সেই ছাই।
সুবিমল এসে বলল,থানা থেকে ও.সি. বাসুদেববাবু কর্নেলসায়েবকে ফোন করেছেন!
কর্নেল বললেন,–ফোন কি তোমার অফিসঘরে?
–হ্যাঁ স্যার!
কিছুক্ষণ পরে হালদারমশাই মুখ-হাত ধুয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলেন। বললেন, –শার্ট-গেঞ্জি-প্যান্ট খুললে অনেক ময়লা বাইরাইব। রাত্রে আর স্নান করুম না। কাইল সকালে স্নান কইর্যা সব সাফ করুম।
তিনি চেয়ারে বসে হঠাৎ লাফিয়ে উঠলেন,–ওই যাঃ।
–কী হল হালদারমশাই?
–বাঘছালখান জঙ্গলে ফ্যালাইয়া আইছি।
–কাল দিনে গিয়ে খুঁজে পাবেন।
এইসময় কর্নেল ফিরে এলেন। জিজ্ঞেস করলুম,–ও.সি. ভদ্রলোককে কেমন বুঝলেন?
কর্নেল একটু হেসে বললেন,–মজার কথা শোনো। হালদারমশাইও শুনুন। ও.সি. বাসুদেব ঘোষ কথাপ্রসঙ্গে বললেন, একটু আগে অবনী মুখার্জি নামে এক ভদ্রলোক তার একজন কাজের লোককে সঙ্গে নিয়ে থানায় গিয়েছিলেন। হৈমন্তীদেবী নাকি কলকাতা থেকে প্রাইভেট ডিটেকটিভ এনেছেন। সেই ডিটেকটিভ সাধুবাবার ছদ্মবেশে মুখার্জিবাবুদের ঠাকুরবাড়িতে ঢোকার জন্য উঁকি দিচ্ছিলেন। অবনীবাবুর দুজন লোক তা দেখতে পেয়ে তাকে তাড়া করে। ঠাকুরবাড়িতে ডিটেকটিভ ঢুকবে কোন সাহসে? তো ডিটেকটিভ তাঁর এই লোকটাকে লক্ষ করে গুলি ছোড়েন। ভাগ্যিস গুলি এর টর্চের মাথায় লেগে কাঁচ গুঁড়িয়ে গেছে। কাজেই সেই সাধুবেশী ডিটেকটিভ আর হৈমন্তীদেবীর নামে এফ, আই. আর. করতে চান অবনীবাবু। ও.সি. তাকে সান্ত্বনা দিয়ে ব্যাপারটা তদন্ত করবেন বলে বিদায় করেছেন।
হালদারমশাই গুলি-গুলি চোখে তাকিয়ে শুনছিলেন। বললেন,–খাইসে!
–নাঃ! খায়নি। বাসুদেববাবু আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন, আমি এ বিষয়ে কিছু জানি কি না? বললুম, জানি। প্রাইভেট ডিটেকটিভ মিঃ কে. কে. হালদার একজন প্রাক্তন পুলিশ ইন্সপেক্টর। তার আত্মরক্ষার জন্য লাইসেন্সড় ফায়ার আর্মস আছে। তবে চরম অবস্থায় পড়লে অর্থাৎ আততায়ী তাকে মেরে ফেলতে চেষ্টা করলে তিনি শুন্যে গুলি ছুঁড়ে ভয় দেখান। মিঃ হালদার দায়িত্বজ্ঞানহীন নন। অবনীবাবুর দুজন লোক তার মুণ্ডু কাটতে চেষ্টা করছিল–যেভাবে হৈমন্তীর কালুর মুন্ডু কাটা হয়েছিল।
হালদারমশাই উত্তেজিতভাবে বললেন,–ঠিক কইছেন কর্নেলস্যার! একজন আমারে জাপটাইয়া মাটিতে ফেলছিল। অন্যজনের এক হাতে টর্চ ছিল। অন্য হাতে লম্বামতো কী একটা ছিল। দাও হইতে পারে। কুত্তাটার মতন আমার মুণ্ডু কাইট্যা ফেলত।
বললুম,–তাহলে অবনী মুখুজ্যেই হৈমন্তীদেবীর পিছনে লেগেছেন! জয়গোপালবাবুকে তিনিই কিডন্যাপ করে লুকিয়ে রেখেছেন।
কর্নেল এতক্ষণে চুরুট ধরিয়ে বললেন,–আগে খোঁজ নিয়ে দেখা যাক অবনীবাবু পদ্য লিখতে পারেন কি না।
হালদারমশাই নড়ে বসলেন,–পইদ্য? পইদ্যের কথা ক্যান কর্নেলস্যার?
কর্নেল জ্যাকেটের ভিতর হাত ভরে সেই হলুদ কাগজটা বের করলেন। তারপর বললেন, –আজ বিকেলে জয়গোপালবাবুদের বাড়ির বারান্দায় এটা রাখা ছিল। জয়ন্ত! পড়ে শোনাও। হালদারমশাই কী বলেন শোনা যাক।
আমি পদ্যটা পড়তে থাকলুম :
কর্নেল ডাকার কী দরকার
প্রাণ যদি চাও গোপালদার
সিন্দুক খুলবে ঠাকুরদার
দর্শন পাবে দুই পাদুকার
জঙ্গলে পোডভিটে সাধুখাঁর
নিশিরাতে ঠিকঠাই রাখবার
হুঁশিয়ার পুলিশকে ডাকবার
চেষ্টাটি করলে গোপালদার
মুন্ডুটি ধড় ছেড়ে যাবে তার
হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার
হালদারমশাইয়ের গোঁফের দুই ডগা তিরতির করে যথারীতি কাঁপছিল। ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে তিনি বললেন,–ঠাকুরদার সিন্দুক! দুই পাদুকা! মানে দুইখান জুতা! জয়গোপালবাবুর পাঁচজোড়া জুতা চুরি গেছে। জুতা! ঠাকুরদার জুতা! জুতা চায় ক্যান? জুতায় কী আছে?
কর্নেল চুরুটের ধোঁয়ার মধ্যে বললেন,–১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট বিপ্লব!
গোয়েন্দাপ্রবর বললেন,–কী কইলেন? কী কইলেন?
–বাবুগঞ্জের জমিদারের খাজাঞ্চিখানা লুঠ হয়েছিল।
–অ্যাঁ?
–প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি চলছিল কয়েকদিন ধরে। সেই সময় খাজাঞ্চিখানা লুঠ।
হালদারমশাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,–কর্নেলস্যার কী কইতাছেন জয়ন্তবাবু?
বললুম,–জয়গোপালবাবু কী বলেছিলেন আপনি ভুলে গেছেন হালদারমশাই! উনি বলছিলেন না, ওঁর ঠাকুরদা জমিদারবাড়ির খাজাঞ্চি ছিলেন।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ হাসলেন,–হঃ! মনে পড়ছে। কর্নেলস্যার কইছিলেন খাজাঞ্চি মানে ট্রেজারার। তা ট্রেজারার ভদ্রলোকের জুতা অ্যাদ্দিন পরে চায় কারা? ক্যান চায়?
বললুম,–আমার ধারণা…
কথায় বাধা পড়ল। পর্দা তুলে সুবিমল ঢুকে বলল,আপনারা নটায় ডিনার খেয়ে নিলে ভালো হয় স্যার। ঠাকমশাই বড় শীতকাতুরে মানুষ। বয়সও হয়েছে।
কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, ঠিক আছে। নটায় আমরা খেয়ে নেব।
সুবিমল বেরিয়ে গেলে হালদারমশাই বললেন,–জয়ন্তবাবু কী কইতাছিলেন য্যান?
কর্নেল চোখ কটমটিয়ে আমার দিকে তাকালেন,–রাতবিরেতে জুতোর কথা বললেই ভূতপ্রেতের দল জানালার কাছে এসে জুতো চাইবে। সাবধান জয়ন্ত।
হালদারমশাই খিখি করে হেসে উঠলেন।…
পরদিন সকালে ঘুম ভেঙেছিল ঠাকমশাইয়ের ডাকে। তার হাতে চায়ের কাপ-প্লেট। ঠাকমশাই, কাঁচুমাচু হেসে বললেন,–স্যারের ঘুম ভাঙালুম। কিন্তু বুড়োসায়েব ভোরবেলা আমাকে বলে গেছেন, আপনার বিছানায় বসে বাসিমুখে চা খাওয়ার অভ্যেস।
কর্নেল সর্বত্র এই ব্যবস্থাটা করে প্রাতঃভ্রমণে বের হন। আমার বেড-টি না খেলে বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করে না। চা নিয়ে জিজ্ঞেস করলুম,–ঠাকমশাই! কাল রাত্রে যিনি এসেছেন, সেই হালদারসায়েব কি ওঠেননি?
–উঠেছেন। বুড়োসায়েব বেরিয়ে যাওয়ার পর উনি উঠে আমার কাছে চা চাইলেন। ওঁকে চা দিয়ে আপনাকে দিতে এলুম।
ঠাকমশাই বেরিয়ে যাওয়ার পর চা খেয়ে বাথরুমে গেলুম। প্রাতঃকৃত্যের পর দাড়ি কেটে প্যান্ট-শার্ট-জ্যাকেট পরে বারান্দায় গিয়ে বসলুম। সেই সময় সুবিমলবাবু সাইকেলে থলে ঝুলিয়ে বাজারে যাচ্ছিলেন। তাকে জিজ্ঞেস করলুম,–হালদারমশাই কী করছেন?
সুবিমল বলল,উনি কিছুক্ষণ আগে বেরুলেন। আমি বাজার করে শিগগির ফিরে আসছি।
তখনও রোদ আর কুয়াশায় চারদিক রহস্যময় দেখাচ্ছিল। সাড়ে সাতটা বাজে। কিছুটা দূরে পূর্ব-দক্ষিণে সেই সরকারি অরণ্য কুয়াশায় ঢাকা। কিন্তু পুবের ফাঁকা মাঠের ওপর দিয়ে নদী পেরিয়ে ম্লান রোদ এসে বাংলোর ফুলবাগানকে ঈষৎ উজ্জ্বল করেছে। হালদারমশাই তো কর্নেলের সঙ্গে বেরোননি। পরে বেরিয়েছেন। কোথায় গেলেন তিনি?
একটু পরে মনে পড়ল, সরকারি শালের বনে বাঘছাল ফেলে এসেছিলেন। সম্ভবত তিনি সেই বাঘছাল খুঁজে আনতে গেছেন। গোয়েন্দাপ্রবর আমাকে বলেছিলেন, ছদ্মবেশের জিনিসপত্র তিনি চিৎপুর এলাকায় যাত্রা-থিয়েটারের সাজপোশাকের দোকান থেকে কেনেন। বাঘছালটা চিৎপুরে কেনা নকল জিনিস হলেও ওটা তো তাকে পয়সা দিয়ে কিনতে হয়েছে। কাজেই ওটা জঙ্গলে ফেলে রাখবেন কেন?
প্রায় নটায় কর্নেল ফিরলেন। সেই ট্যুরিস্টের বেশ! মাথায় টুপি, পিঠে কিটব্যাগ আঁটা। কোমর থেকে ফ্লাক্স ঝুলছে। গলা থেকে বাইনোকুলার আর ক্যামেরা। তিনি যথারীতি সম্ভাষণ করলেন, –মর্নিং জয়ন্ত! আশা করি সুনিদ্রা হয়েছে!
–মর্নিং কর্নেল! বেঘোরে ঘুমিয়েছি। কতদূর ঘুরলেন?
–প্রমথ মুখুজ্যের ফার্মের পাশ দিয়ে হেঁটে দোমোহানি জলাধার পর্যন্ত। কিন্তু কুয়াশা কাটতে দেরি হচ্ছিল। বাইনোকুলার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল। তাই ফিরে এলুম। পরে দেখা যাবে। হালদারমশাই কোথায়?
–উনি সম্ভবত সরকারি জঙ্গলে ওঁর বাঘছাল খুঁজতে গেছেন। আমার সঙ্গে দেখা হয়নি। ততক্ষণে সুবিমল বাজার করে ফিরে এসেছিল। ঠাকমশাই ট্রেতে কফি আর স্ন্যাক্স আনছিলেন। তার সঙ্গে সুবিমলও এল। সে বলল,–আপনি কি পায়ে হেঁটে ড্যাম অব্দি গিয়েছিলেন স্যার?
কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, হ্যাঁ। কিন্তু বড্ড কুয়াশা। ওবেলায় গাড়িতে যাব বরং।
–বড় মুখুজ্যের ফার্ম দেখলেন?
–দেখলুম। নিচু পাঁচিলের ওপর কাঁটাতারের বেড়া। বাইনোকুলারে যতটা দেখা যায়, দেখলুম।
ঠাকমশাই চলে গিয়েছিলেন। সুবিমল এবার চাপাস্বরে বলল,–দোমোহানির এক মেছুনির নাম রানি। তাকে রানিদি বলে ডাকি। পথে তার সঙ্গে দেখা হল। তার কাছে হাফকিলো পাবদা মাছ ছিল। মাছগুলো দিয়ে রানিদি বলল, প্রায় দেড় কিলো পাবদা ছিল। আসবার পথে বড় মুখুজ্যের ডাকে ফার্মে ঢুকেছিল সে। মাছ ওজন করার সময় রানিদি একপলকের জন্য নাকি জয়গোপালকে দেখেছে। ঘর থেকে বেরিয়েই ঘরে ঢুকে গেল। রানিদি জানে, জয়গোপালবাবুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
সুবিমলের কথা শুনে হতবাক হয়ে গিয়েছিলুম। কিন্তু কর্নেল একটু হেসে বললেন, তোমার রানিদি জয়গোপালবাবুকে একপলক দেখেছে। আমি বাইনোকুলারে মিনিটতিনেক দেখেছি। ফার্মের পশ্চিমে গেট। গেটের ভিতর ঢুকলে বাঁদিকে প্রমথবাবুর বাংলো। একেবারে মডার্ন ফার্ম। প্রমথবাবুও পোশাকে আমার চেয়ে বেশি সায়েব। ড্রেসিং গাউন পরে বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে গায়ে রোদ নিচ্ছিলেন। আমি দক্ষিণ-পূর্ব কোণে পাঁচিলের মাথায় বাইনোকুলার রেখে তাকে দেখছিলুম। আর তার পাশে একটা চেয়ারে বসে আদি অকৃত্রিম জয়গোপালবাবু চা-পান করছিলেন। কিন্তু বেশিক্ষণ দেখা হল না। একটা তাগড়াই অ্যালসেশিয়ান কুকুর টের পেয়ে দৌড়ে আসছিল। আমি রাস্তার অন্যপাশে একটা আখের জমিতে ঢুকে পড়লুম। অ্যালসেশিয়ানের মুখের পাশে একটা ষণ্ডামার্কা লোকের মুখ দেখলুম। পিচরাস্তায় কাকেও না দেখতে পেয়ে সে কুকুরটাকে নিয়ে অদৃশ্য হল।
সুবিমল বলল,–অদ্ভুত ব্যাপার স্যার! জয়গোপালদা নিজেকে নিজেই লুকিয়ে রেখেছেন তাহলে!
–চেপে যাও। আর ঠাকমশাইকে বলো, আমরা সাড়ে নটায় ব্রেকফাস্ট করে গাড়িতে বেরুব।
সুবিমল চলে গেলে বললুম,–কর্নেল! এমন তো হতেই পারে, রানাঘাট স্টেশনে জয়গোপালবাবুকে গাড়িতে লিফ্ট দেওয়ার ছলে প্রমথবাবু বা তার লোকেরা তাকে কিডন্যাপ করে ফার্মহাউসে রেখেছে। প্রাণের ভয়ে বেচারা চুপচাপ আছেন!
–এবং চেয়ারে বসে চা-ও খাচ্ছেন! রানি মেছুনিকে দেখেই লুকিয়ে পড়েছেন।
কর্নেল মিটিমিটি হাসছিলেন। আমি বললুম,–আহা! ভিতু গোবেচারা লোক। প্রাণের দায়ে মানুষ অনেক কিছু করে।
–এবং পদ্য লিখে ঠাকুরদার সিন্দুকে রাখা জুতো দুটো সাধুখাঁর পোড়ো-ভিটেয় রেখে আসতে বলে!
অবাক হয়ে বললুম,–কর্নেল! আপনি কি সিরিয়াসলি বলছেন?
কর্নেল তার প্রসিদ্ধ অট্টহাসি হাসলেন। তারপর বললেন,–নাঃ! তোমার কথায় যুক্তি আছে। জয়গোপালবাবু সম্ভবত পদ্যচর্চা করতেন। তার ওপর তিনি একটু ছিটগ্রস্ত। প্রমথবাবুর কথায় তিনি পদ্যটা লিখতেও পারেন।
–কিন্তু হৈমন্তীদেবী তো তার ঠাকুরদার সিন্দুক কোথায় আছে জানেন না! তাহলে?
কর্নেল স ম গ্র কর্নেল আমার কথার জবাব দিলেন না। কফি শেষ করে চুরুট ধরিয়ে বারান্দা দিয়ে এগিয়ে গেলেন। সুবিমলকে অফিস থেকে বেরুতে দেখলুম। তারপর কর্নেল তার সঙ্গে অফিসে ঢুকলেন।
সাড়ে নটায় আমরা ব্রেকফাস্ট করলুম। তখনও হালদারমশাইয়ের পাত্তা নেই। কর্নেল বললেন, বলা যায় না। জঙ্গলে বাঘছাল খুঁজতে গিয়ে হালদারমশাই গোয়েন্দাগিরি করতে প্রমথবাবুর ফার্মের আনাচে-কানাচে হয়তো ওত পেতে বসে আছেন। কিন্তু সমস্যা হল, অ্যালসেশিয়ানের পাল্লায় পড়ে ফায়ার আর্মস থেকে গুলি ছুড়লে কী হবে?
ব্রেকফাস্টের পর সুবিমলও আমাদের সঙ্গে আসতে চাইল। কর্নেল একটু হেসে বললেন, –আমরা কিন্তু হালদারমশাইয়ের মতো গোয়েন্দাগিরি করতে যাচ্ছি না। কাজেই তুমি আসতে পারো। তাছাড়া তোমার আসবার অধিকার আছে। কারণ তুমি আপাতদৃষ্টে জটিল রহস্যে ভরা একটা ঘটনার এমন মূল্যবান সূত্র দিয়েছ, যা দিয়ে এই ঘটনার সব জট খুলে যাবে।
মনে-মনে অবাক হলেও কিছু বললুম না। রহস্যের জট খোলার কী মূল্যবান সূত্র দিয়েছে সুবিমল, কে জানে!
মোরামরাস্তা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে বাঁদিকে সেই শাল-সেগুনের সরকারি জঙ্গল পেরিয়ে যেতে-যেতে হঠাৎ কর্নেল বললেন,–জয়ন্ত! গাড়ি থামাও।
গাড়ি দাঁড় করিয়ে বললুম, কী ব্যাপার?
কর্নেল গাড়ি থেকে নেমে বললেন,–যা ভেবেছিলুম, তাই ঘটেছে সম্ভবত। জঙ্গলের মধ্যে কুকুরের হাঁকডাক কানে আসছে। সুবিমল গাড়িতে বসে থাকো। জয়ন্ত! আমার সঙ্গে এসো তো!
আমারও কানে এল জঙ্গলের মধ্যে কুকুরের প্রচণ্ড চাঁচামেচি। কর্নেলকে অনুসরণ করে জঙ্গলে ঢুকলাম। শুকনো পাতার ওপর নিঃশব্দে চলা কঠিন। কুকুরের গজরানি লক্ষ করে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে চোখে পড়ল এক অদ্ভুত দৃশ্য! একটা ষণ্ডামার্কা গুঁফো লোকের হাতের চেনে আটকানো প্রকাণ্ড একটা অ্যালসেশিয়ান কুকুর। লোকটা ওপরদিকে তাকিয়ে আছে। আর কুকুরটাও ওপরদিকে মুখ তুলে বিকট হাঁকডাক করছে।
তারপরই দেখতে পেলুম একটা শালগাছের উঁচু ডালে বসে আছেন প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদারমশাই। তার হাতে কোনো ফায়ার আর্মস নেই।
গুঁড়ি মেরে দুজনে এগিয়ে গেলুম। ষণ্ডামার্কা গুঁফো লোকটা দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসছে। আর হালদারমশাই ধমক দিচ্ছেন,–হালার কুত্তারে গুলি কইর্যা মারুম! অরে লইয়া যাও কইতাছি! সত্যই গুলি করুম!
কর্নেল এবং তার পিছনে আমি একসঙ্গে উঠে দাঁড়ালুম। তারপর কর্নেল ধমক দিয়ে বললেন, –এ কী হচ্ছে? এক্ষুনি অ্যারেস্ট করব বলে দিচ্ছি। কুকুর নিয়ে ফার্মে চলে যাও। গিয়ে দেখো, এতক্ষণ সেখানে পুলিশ বড় মুখুজ্যেবাবু আর জয়গোপালবাবুকে পাকড়াও করেছে।
লোকটা দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বলল,–কে আপনি? ওই বাবুর মতো আপনাকেও টমকে দিয়ে গাছে চড়িয়ে ছাড়ব। ওসব পুলিশ-টুলিশ আমি পরোয়া করি না!
এবার কুকুরটা আমাদের দিকে ঘুরে গজরাতে থাকল। কর্নেল এক পা এগিয়ে গিয়ে বললেন,–তাহলে আগে কুকুরটা তারপর তোমার মুণ্ডুটা গুলি করে উড়িয়ে দিই।
বলে তিনি সত্যিই জ্যাকেটের ভিতর থেকে রিভলভার বের করলেন। গাছের ওপর থেকে গোয়েন্দাপ্রবর চেঁচিয়ে উঠলেন,–আমার রিভলভারটা সঙ্গে আনি নাই। হালার কুত্তার মাথা ফুটা কইর্যা দ্যান কর্নেলস্যার!
লোকটা রিভলভার দেখে আঁতকে উঠে কুকুরের চেন ছেড়ে দিয়ে গুলতির মতো উধাও হয়ে গেল। কুকুরটাও কী বুঝল কে জানে, তখনই তার পিছনে দৌড়ে অদৃশ্য হল। কর্নেল বললেন,–হালদারমশাই! আপনি শালগাছে চড়লেন কী করে?
হালদারমশাই সোজা গুঁড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে এসে সামনে দাঁড়ালেন। জিজ্ঞেস করলুম, –আপনার পেট অত মোটা কেন?
হালদারমশাই সোয়েটারের ভিতর থেকে তাঁর বাঘছালটা বের করে সহাস্যে বললেন,–কুত্তার তাড়া খাইয়াও বাঘছাল ফেলি নাই। শুধু একখান ভুল, ফায়ার আর্মস আনি নাই।
কর্নেল বললেন, আপনি বাঘছাল খুঁজতে কি প্রমথবাবুর ফার্মে গিয়েছিলেন?
–না! বাঘছাল ঠিক জায়গায় ছিল। কুড়াইয়া লইয়া ভাবছিলাম, এই জঙ্গলের ওধারে বড় মুখার্জির ফার্ম। তাই সেখানে গিয়া আড়াল থেইক্যা লক্ষ রাখছিলাম। অমনই কুত্তাটা ট্যার পাইছিল।
বুঝেছি।–বলে কর্নেল ঘুরে মোরামরাস্তার দিকে পা বাড়ালেন।
হালদারমশাই আমাদের অনুসরণ করলেন। আমি বললুম,–ভাগ্যিস গাছে চড়েছিলেন। নইলে কুকুরটা আপনার অবস্থা শোচনীয় করে ফেলত।
হালদারমশাই হাসিমুখে বললেন,–কইছিলাম না? পঁয়তিরিশ বৎসর পুলিশের চাকরি করছি। তো কর্নেলস্যার পুলিশের কথা কইছিলেন ক্যান?
সুবিমল বলল,–হিমিদি স্কুলে চলে গেলে ওঁকে ডেকে আনতে হবে।
কর্নেল বললেন,–না। উনি ক’দিনের জন্য ছুটি নিয়েছেন।
মোরামরাস্তা যেখানে পিচরাস্তার সঙ্গে মিশেছে, তার আগে শালের জঙ্গলটা শুরু হয়েছে। তাই আমাদের সামনে জঙ্গলের কিছুটা আড়াল ছিল। কিন্তু গাছের ফাঁক দিয়ে দেখলুম, পিচরাস্তায় একটা পুলিশের জিপ আর পিছনে কালো রঙের পুলিশভ্যান দ্রুত বাবুগঞ্জের দিকে চলে গেল। বললুম,–কর্নেল! পুলিশের গাড়ি গেল।
কর্নেল একটা চুরুট ধরিয়ে বললেন, এখন পুলিশ নয়, ঠাকুরদার সিন্দুক। আর সিন্দুকের মধ্যে জুতো।
পিছন থেকে হালদারমশাই বললেন,–কী কইলেন? কী কইলেন?
-–আগস্ট বিপ্লব। সুবিমলকে জিজ্ঞেস করুন! সে জানে।
হালদারমশাই সুবিমলকে নিয়ে পড়লেন। সুবিমল তাকে বাবুগঞ্জের বাড়িতে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে আগস্ট মাসে ঝড়বৃষ্টির কাহিনি শোনাতে থাকল।
বাজারে এখনই ভিড়। হালদারমশাইকে একটা খাবারের দোকানের কাছে নামিয়ে দিলুম। সুবিমল বলল,মিঃ হালদার! হিমিদির বাড়ি চিনতে পারবেন তো?
হালদারমশাই বললেন,–হঃ। চিন্তা করবেন না। কুত্তার তাড়া খাইয়া ক্ষুধা পাইছে। কিছু খাইয়া লই।
কর্নেল সুবিমলকে শর্টকাটে পৌঁছনোর পথ দেখাতে বলেছিলেন। গলিপথে ঘুরপাক খেতে-খেতে নদীর ব্রিজের কাছে সেই বাজারে গিয়ে সেখান থেকে ডাইনে ঘুরে আবার একটা গলিতে ঢুকেই জয়গোপালবাবুদের বাড়িটা চিনতে পারলুম। গাড়ির শব্দ শুনে কাচ্চাবাচ্চারা ভিড় করেছিল। সুবিমল ধমক দিয়ে তাদের হটিয়ে দিল।
হৈমন্তী বেরিয়ে নমস্কার করে বললেন,–ভিতরে আসুন আপনারা। আমি গেনুদাকে ডেকে বলে আসি, গাড়ি পাহারা দেবে। সুবিমল! ভিতরে গিয়ে বসার ঘরে দরজা খুলে দাও।
কাল রাতে যে ঘরে বসেছিলুম, সেই ঘরে আমি ও কর্নেল বসলুম। একটু পরে হৈমন্তী ফিরে এলেন। কর্নেল বললেন,–গতরাতে কোনো উৎপাত হয়নি তো?
হৈমন্তী বললেন,–না। তবে প্রবোধদাতাকে চেনেন কি না জানি না
–চিনি। বলুন!
–আপনারা চলে যাওয়ার পর প্রবোদা মাতলামি করছিল।
–কিছু বলছিলেন কি উনি?
–মাতলামি করে গান গাইছিল। গোপাল আছে শিবের কোলে! সরলামাসি ওকে ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দিল। তবে গানটা শুনে খটকা লেগেছিল।
কর্নেল হাসলেন,–প্রবোধবাবু ঠিকই বলেছিলেন।
–তার মানে?
–পরে বলছি। আপনি বাইরের দরজা বন্ধ করে একবার বাড়ির ভিতরে চলুন।
ভিতরে ঢুকে দেখলুম, বাড়িটার গড়ন ইংরেজি এল অক্ষরের মতো। যে ঘরে বসেছিলুম, সেটার ভিতরের দরজা পশ্চিমমুখী। এটার সংলগ্ন দুটো ঘর দক্ষিণমুখী। উঠোনের দুটো দিকে পাঁচিল। পাঁচিলের উত্তর অংশে শেষ ঘরটার সংলগ্ন টালির চালের রান্নাঘর।
কর্নেল বললেন, আপনার দাদা সম্ভবত এই ঘরটায় থাকতেন। আর আপনি থাকেন রান্নাঘরের পাশে শেষ প্রান্তের ঘরে। তাই না।
হৈমন্তী একটু চমকে উঠে বললেন, হ্যাঁ। আপনাকে কি দাদা এসব কথা বলেছিল?
কর্নেল তার কথার জবাব না দিয়ে বললেন, আপনার দাদার ঘরে তালা আঁটা দেখছি। ওটার ডুপ্লিকেট চাবি নেই?
হৈমন্তী গম্ভীরমুখে বললেন,–না। দাদা নিজের ঘরের চাবি নিজের কাছেই রাখে।
কর্নেল জ্যাকেটের ভিতর থেকে একটা সাদা খাম বের করে বললেন,–এর মধ্যে আপনার ঠাকুরদার উইল আছে। উইলের একটা অংশ পড়ে আমার খটকা লেগেছে। পড়ে শোনাচ্ছি।
বলে তিনি সাদা খামের ভিতর থেকে আরেকটা জীর্ণ খাম বের করলেন। তার ভিতর থেকে সাবধানে এক পাতার একটা পুরু কাগজ বের করলেন। ওপরের দিকটায় স্ট্যাম্প আছে। কত টাকার স্ট্যাম্প দেখতে পেলুম না। হলুদ হয়ে যাওয়া এবং ভাঁজ ছিঁড়ে যাওয়া কাগজটা যে উইল, তা বোঝা গেল। রেজেস্ট্রি করা উইল। কর্নেল প্যান্টের পকেট থেকে আতশ কাঁচ বের করে একটা অংশ পড়লেন।
‘…এতদ্ব্যতীত দালানবাটীর পশ্চিমে শেষাংশে দ্বিতলের নিম্নতলে সুরক্ষিত সিন্দুক এবং তন্মধ্যে সংরক্ষিত যাবতীয় দ্রব্য আমার পুত্র শ্রীমান হরগোপাল রায় পাইবে।‘
কর্নেল বললেন,–হরগোপাল রায় আপনার বাবা। আপনার ঠাকুরদা ‘দ্বিতলের’ লিখে ‘নিম্নতল’ লিখেছেন। কিন্তু শেষাংশ দ্বিতল নয়। দোতলা নয়। একতলা। তাহলে নিম্নতল’ কথাটার একটাই মানে হয়। তাই না হৈমন্তীদেবী?
হৈমন্তী মুখ নামিয়ে বললেন,–কিছু বুঝতে পারছি না।
–পশ্চিমে শেষাংশে আপনার ঘর। প্লিজ! আপনার ঘরে চলুন।
হৈমন্তী একটু ইতস্তত করে নিজের ঘরে গিয়ে তালা খুলে দিলেন। তারপর ভিতরে ঢুকে পশ্চিম, উত্তর এবং দক্ষিণের জানালা খুললেন। আমরা বারান্দায় জুতো খুলে ঘরে ঢুকলুম। দেখলুম, দেওয়ালের পশ্চিমে সেকেলে একটা উঁচু পালঙ্ক। অন্যদিকে আলমারি। র্যাকে সাজানো বই। এককোণে ছোট্ট বেঞ্চিতে কভারে ঢাকা বাক্স-প্যাঁটরা।
কর্নেল একটু হেসে বললেন,–”দ্বিতলের নিম্নতল’ কথাটা আমি বুঝতে পেরেছি হৈমন্তীদেবী! এই ঘরের তলায় একটা ঘর আছে। ইংরাজিতে যাকে বলে বেসমেন্ট। আগের দিনে বলা হত তিয়খানা। সেখানে দামি জিনিস রাখা হত। আপনার খাটের মাথার দিকে ছোট্ট বেঞ্চে বাক্স-প্যাটরা রাখা আছে।
বলে কর্নেল প্যান্টের পকেট থেকে তাঁর খুদে কিন্তু জোরালো আলোর টর্চ বের করে জ্বাললেন। তারপর একটু ঝুঁকে দেখে নিয়ে বললেন,–বেঞ্চের তলায় পেতলের বালতিটা সরাচ্ছি। আমাকে বাধা দেবেন না প্লিজ!!
কর্নেল পেতলের বালতি সরাতেই দেখা গেল একটা মোটা লোহার আংটা। কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,–হৈমন্তীদেবী! লোহার ওই আংটা ধরে জোরে টান দিলে লোহার চৌকো একটা পাত উঠে আসবে। নীচে সিঁড়ি আছে। নেমে গেলেই সিন্দুকটা পাওয়া যাবে।
হৈমন্তী কান্নাজড়ানো গলায় বললেন,–কিন্তু গোপালদাকে সিন্দুকের খোঁজ দিলে সে ঠাকুরদার জুতো দুটো বের করবে। জুতো দুটোর হিলে কী আছে তা কি আপনি জানেন?
কর্নেল বললেন,–জানি! তার মানে, এই সুবিমলের মুখে একটা ঘটনা শোনার পর তা আমি যুক্তিসঙ্গতভাবেই অনুমান করেছি। ১৯৪২ সালের আগস্ট মাসে ঝড়বৃষ্টির রাতে স্বদেশি বিপ্লবীরা জমিদারের খাজাঞ্চিখানা লুঠ করেছিলেন। আপনার ঠাকুরদা ছিলেন খাজাঞ্চি। তাকে বেঁধে রেখে ধনরত্ন লুঠ করা হয়েছিল। যেভাবে হোক, বাঁধন খুলে আপনার ঠাকুরদা পালিয়ে আসার সময়–হ্যাঁ, আমার অনুমান ঠিক, দৈবাৎ দুটি দামি রত্ন দেখতে পান। আমার দৃঢ় বিশ্বাস রত্নদুটি হিরে। তাই বিদ্যুতের আলোয় তার চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার জন্য হিরের দুটি খণ্ড আপনার ঠাকুরদা কুড়িয়ে পান। এর পরের কাহিনি আপনার জানা। সুবিমল আমাকে বলেছে, আপনার ঠাকুরদাকে জেল খাটানোর চেষ্টা করেছিলেন জমিদারবাবু। আট বছর তিনি লুকিয়ে থাকার পর ফিরে আসেন।
হৈমন্তী বললেন, আমি সব জানি। বাবার কাছে শুনেছি। কিন্তু দাদা এতদিনে রেলের চাকরি থেকে রিটায়ার করে আসার পর মুখুজ্যেদের পাল্লায় পড়েছে, তা বুঝতে পেরেছিলুম। দাদাকে টাকার লোভ দেখিয়ে মুখুজ্যেরা হিরে দুটো হাতাতে চায়। তাই মিথ্যা করে জুতোচুরির গল্প শোনায়।
কর্নেল হাসলেন,–আপনি জানেন তাহলে?
হৈমন্তী চোখ আঁচলে মুছে বললেন,–আগে একটু সন্দেহ হয়েছিল। গতরাতে ওই পদ্য পড়েই বুঝেছিলুম, এটা দাদার পদ্য। হাতের লেখা অন্যের। দাদার পদ্য লেখার অভ্যাস আছে।
হালদারমশাই ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বললেন,–খাইসে!
এই সময় বাইরে গাড়ির হর্ন শোনা গেল। কর্নেল বললেন,–আপনার দাদা নিখোঁজ হয়েছিলেন। ওঁকে প্রমথ মুখুজ্যের ফার্ম থেকে পুলিশ উদ্ধার করে এনেছে। শিগগির এ ঘরের জানালা-দরজা বন্ধ করে তালা এঁটে দিন। আমি বাইরে যাচ্ছি।
পুলিশের জিপ থেকে একজন অফিসার নেমে এসে করজোড়ে কর্নেলকে নমস্কার করে বললেন,–আমার সৌভাগ্য, কিংবদন্তি পুরুষ কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। আমি ও. সি. বাসুদেব ঘোষ।
কর্নেল বললেন,–জয়গোপালবাবুকে এনেছেন তো?
–হ্যাঁ। প্রমথবাবুর ফার্মে দিব্যি বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন। আমাদের দেখে অবাক হয়ে, পরে বললেন, আমি নিখোঁজ হব কোন দুঃখে? বড় মুখুজ্যেবাবু জামাই-আদরে রানাঘাট স্টেশন থেকে গাড়ি চাপিয়ে ফার্মে নিয়ে এসেছেন। খাচ্ছি-দাচ্ছি! দিব্যি আছি!
জয়গোপালবাবু জিপের পিছনদিক থেকে একলাফে নেমে এলেন। হাসিমুখে কর্নেলকে নমস্কার করে বললেন, আপনি এসে পড়েছেন তাহলে?
কর্নেল গম্ভীরমুখে বললেন,–পাঁচজোড়া জুতোর মধ্যে প্রথমজোড়া ছিল আপনার। বাকি চারজোড়া জুতো কি বড় মুখুজ্যে কিনে দিয়েছিলেন?
জয়গোপালবাবু জিভ কেটে বললেন,–ছ্যা-ছ্যা! আমার কি জুতো কেনার পয়সা নেই? আপনার দিব্যি! মা কালীর দিব্যি! পুলিশস্যারের দিব্যি! আমার পাঁচজোড়া জুতো সত্যি চুরি গিয়েছিল। সেই জুতোগুলো আজ সক্কালে বড় মুখুজ্যের ফার্মের পাঁচিলের গোড়ায় ঘাসের মধ্যে দেখেছি। সবগুলোর হিল ওপড়ানো। খাপ্পা হয়ে বললুম, বড় মুখুজ্যেদা! এ কী করেছ? বড় মুখুজ্যের এক কথা। ঠাকুরদার জুতোজোড়া এনে দাও। তবে ছাড়া পাবে! তারপর কাল দুপুরবেলা আমাকে দিয়ে পদ্য লিখিয়ে ছাড়ল। না লিখলে অ্যালসেশিয়ান দিয়ে আমাকে খাওয়াবে বলল। শেষে বলল, কালুর মতো মুণ্ডু কেটে এই বাড়ির দরজায় ঝুলিয়ে রাখব। করি কী বলুন?
–প্রবোধবাবু আপনাকে দেখতে পেয়েছিলেন?
–হ্যাঁ বড় মুখুজ্যে তাকে পেট ভরে মদ খাইয়ে ছেড়ে দিলেন!
–তাই তিনি আপনার বোনকে বলে গেছেন, ‘গোপাল আছে শিবের কোলে। প্রমথ শিবের একটি নাম।
ও.সি. বাসুদেব ঘোষ বললেন,–প্রমথ মুখুজ্যের বিরুদ্ধে ‘রংফুল কনসাইনমেন্ট’-এর বেআইনি আটকের চার্জে এফ. আই. আর. করেছি। জয়গোপালবাবুর কথা শুনেই বুঝেছিলাম, ভদ্রলোক ওঁর সরলতার সুযোগ নিয়েছিলেন।
জয়গোপালবাবু করজোড়ে বললেন,–মামলা করে কী হবে? ঠাকুরদার জুতো তো কেউ হিমির কাছ থেকে হাতাতে পারবে না। হিমি! বিশ্বাস কর আমাকে। আমি কখনও তোকে ঠাকুরদার সিন্দুকের কথা জিজ্ঞেস করব না।
ও.সি. বললেন,–ঠাকুরদার সিন্দুক। সেটা কী?
কর্নেল বললেন,–পরে সব বলব। আমি সেচ-বাংলোয় আরও একটা দিন থাকছি। দোয়োহানি ড্যামে সাইবেরিয়ান হাঁসের ছবি না তুলে যাচ্ছি না। যাই হোক, আপাতত ভাই-বোনকে আশা করি একটু প্রোটেকশন দেবেন। অবনী মুখুজ্যে কেমন লোক আমি জানি না।
হালদারমশাই কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। বুঝলুম, গতরাতে অবনী মুখুজ্যের দুটো লোকের পাল্লায় পড়ে হেনস্থা হওয়ার কথা বলার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তাকে থামতে হল ও. সি. বাসুদেববাবুর কথায়,সম্ভবত ইনিই সেই প্রাইভেট ডিটেকটিভ? আপনার বিরুদ্ধে অবনীবাবু নালিশ করতে গিয়েছিলেন।
হালদারমশাই স্মার্ট হয়ে পকেট থেকে তার ডিটেকটিভ এজেন্সির পরিচয়পত্র দেখিয়ে বললেন, –আমারে দাও দিয়ে অ্যাটাক করছিল অবনীবাবুর দুইজন লোক। লোক না গুণ্ডা! আমি প্রোফেশনের কাজে যেখানে ঘুরি, অগো কী?
ও.সি. হাসতে-হাসতে জিপে উঠে বললেন,–দিনে সময় হবে না। সন্ধ্যা সাতটায় কর্নেলসাহেবের সঙ্গে সেচ-বাংলোয় গিয়ে ঠাকুরদার সিন্দুকের গল্প শুনব! নমস্কার!
.
ও.সি. চলে গেলে হৈমন্তী বললেন,–কর্নেলসায়েব! দাদাকে বলে দিন, কখনও যেন আর ঠাকুরদার সিন্দুকের নাম না করে।
জয়গোপালবাবু করুণমুখে বললেন, কিন্তু ঠাকুরদার দু-পাটি জুতোর একপাটি আমার প্রাপ্য কি না বল হিমি।
হৈমন্তী বললেন,–জুতো নিয়ে কী করবে তুমি? তার চেয়ে অবনী মুখুজ্যের জবরদখল জমিটা তুমি আর আমি আইনত মালিক হিসেবে গার্লস স্কুলে . •মে দান করে দেন!
–দিলুম! তারপর?
–দু’পাটি জুতো বিক্রি করে সেই টাকায় গার্লস স্কুলের বাড়ি তৈরি করে দেব।
–জুতো বিক্রি করে? হ্যাঁ? বলিস কী হিমি? কর্নেলসায়েব! এ কী অদ্ভুত কথা!
সুবিমল মুখ ফসকে বলতে যাচ্ছিল জুতোর হিলের মধ্যে কী আছে, কর্নেল তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,–জয়গোপালবাবু। অদ্ভুত কথার মানে যথাসময়ে জানতে পারবেন। কিন্তু আপনি নিজের জুতো নিজে চুরি না করলেও প্রমথবাবুর প্ররোচনায় একটা খারাপ কাজ করেছেন।
জয়গোপালবাবু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললেন,–আজ্ঞে?
–কালু নামে কুকুরটা আপনাকে দেখলে বা আপনি তার কাছে গেলে চাঁচাত না। কারণ আপনাদের বাড়িরই পোষা কুকুর। এবার বলুন কালুকে আপনি কি কোলে তুলে বা কোনোভাবে প্রমথবাবুর লোক দিয়েছিলেন? জয়গোপালবাবু! আপনার সাহায্য ছাড়া কারও সাধ্য ছিল না যে কালুর মুণ্ডু কাটবে।
জয়গোপালবাবু ভেউ-ভেউ করে কেঁদে উঠলেন। তারপর বললেন, আমি কেমন করে জানব গণশা আমার কোল থেকে তাকে আচমকা কেড়ে নেবে আর কেষ্টা তার মুণ্ডু কাটবে? অন্ধকার রাত্তির। আমাকে গণশা আর কেষ্টা ক্লাব থেকে এগিয়ে দেওয়ার ছলে সঙ্গে এসেছিল। তারপর বলল, কালুকে নিয়ে একটা মজার খেলা খেলবে! আমি কি জানতুম কী মজা?
হৈমন্তী বললেন, তুমি কেন একথা লুকিয়ে রেখেছিলে?
–ভয়ে। তোর দিব্যি। কর্নেলস্যারের দিব্যি। গণশা-কেষ্টা শাসিয়ে গিয়েছিল, তাদের নাম বলে দিলে আমার মুণ্ডু কাটবে।
কর্নেল বললেন,–হৈমন্তীদেবী! দাদাকে বাড়ি নিয়ে যান। যথাসময়ে এসে আপনার ঠাকুরদার সিন্দুক আর জুতো দেখব। চিন্তা করবেন না। আপনার প্ল্যানটা ভালো। বাবুগঞ্জে সৎ-ভদ্রমানুষও তো কম নেই। তারা আপনাকে সাহায্য করবেন। গার্লস হাইস্কুল হবে আপনার ঠাকুরদার নামে। আচ্ছা চলি।
Post a Comment