আছে কিন্তু নেই – কমলকুমার মজুমদার

আছে কিন্তু নেই – কমলকুমার মজুমদার

ধপাস করে মাথায় কি একটা এসে পড়ল। গড়িয়ে গায়ের কাছে। একটা কাপড় আর তুলোয় তৈরি নরম ভালুক। এটা একটা হাউসিং কমপ্লেক্স। সারসার রঙচটা ঢাঙা বাড়ি। খুপরি খুপরি ফ্ল্যাট। কোনটায় একটা বেডরুম, কানটায় দুটো। একটা সঙ্কীর্ণ রান্নাঘর। সিন্দুকের মতো বাথরুম। সামান্য একটু নড়বার চড়বার জায়গা। একটা বুলি বারান্দা। এইরকম সারি সারি। খাপে খোপে বিভিন্ন আয়ের, বিভিন্ন স্বভাবের, মেজাজের, চেহারার মানুষ। এই খাঁচায় দেহখাঁচাকে বন্দী করার জন্যে বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। লটারি, মুরুব্বি, দালাল।

পুতুলটা হাতে নিয়ে ওপর দিকে তাকালুম। রোদোপোড়া তামাটে আকাশ। আকাশে হেলান দেওয়া ছোট্ট সুন্দর একটা মুখ। বালাপরা কচি একটা হাত বারান্দার রেলিং-এর ফাঁকে গলে ঝুলছে। ছোট্ট পায়ের অংশ। কচি কচি আঙুল নেড়ে পুতুলটাকে ডাকছে। তিনতলার বারান্দায় এক দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি। বুমকো ঝুমকো চুল। একটা চোখ দেখতে পাচ্ছি। খরগোশের মতো। পুতুলটার বদলে মেয়েটির পড়ে যাওয়াও আশ্চর্যের ছিল

সিঁড়ি দেখতে পাচ্ছি। পুতুলটাকে বুকে নিয়ে ওপরে উঠছি। প্রতি তলায় এপাশে একটা ফ্ল্যাট, ওপাশে একটা। সিঁড়ির ধাপ জায়গায় জায়গায় ভাঙা। কখনোই ঝাঁট পড়ে না। সিঁড়ির চওড়া হাতলে চাপ চাপ ময়লা।।ল ঝল করে বুলছে ইলেকট্রিক লাইন। হোন্ডারে বাল্ব নেই। রাত্তিরবেলা এই সিঁড়ি অন্ধকারে তলিয়ে থাকে। দরজায় রঙ নেই। কোথাও কোথাও নম প্লেট। আনজের খোসা, ডিমের খোলা, ছেড়া চটি, কি নেই আবর্জনার ঐশ্বর্যে!

তিনতলায় উঠে আন্দাজ করে নিলুম কোন ফ্ল্যাটটা হতে পারে। কলিংবেল আছে। দুচারবার টেপাটেপি করতেই ভেতর থেকে প্রশ্ন এল, কি?

মনে হল বলি, ভালুক। তা না বলে বললুম, দরজাটা খুলুন, আপনাদের বাচ্চার ভালুকটা নিচে পড়ে গিয়েছিল দিয়ে যাই।

দরজা খোলা যাবে না। বাড়িতে কেউ নেই। প্রশ্ন না বাড়িয়ে ভালুকটাকে দরজায় ঠেস দিয়ে রেখে নিচে নেমে। এলুম। ওপর দিকে তাকিয়ে দেখলুম, বাচ্চাটা বারান্দায় আর নেই।

এই হল স্যান্ডউইচ ফ্যামিলি! স্যান্ডউইচ কেন? ওই যে চলেছে। গুড়গুড়ে দুচাকায়, একটি কত্তা একটি গিন্নি। কত্তার মাথায় প্রতিরক্ষা কড়া, গিন্নির মাথায় গামলা। কত্তার নেয়াপাতি ভূড়িটি দুহাতে আঁকড়ে ধরে আছেন। কত্তার পিঠ আর গিন্নির পেটের মাঝখানে চেপ্টে আছে মাখনের মতো একটি বাচ্চা। হিউম্যান স্যান্ডউইচ। পথের চড়াই উতরাই, হোলিস অ্যান্ড পটহোলসের তোয়াক্কা না করে সোদপুরের ফ্যামিলি চলেছে। সল্টলেকে। দাদার কাছে মা থাকেন, গর্ভধারিনী, সুগার, গ্রকোমা,। আরথারাইটিস, অ্যামনিসিয়ার সমন্বয়ে এক গলগ্ৰহ। সাপের ছুঁচো গেলা। ফেলাও যায় না গেলাও যায় না। ডাক্তার দুঃসংবাদ দিয়ে গেছেন, মিস্টার বাগচী আনইউজুয়ালি স্ট্রং হার্ট, এইভাবে নাইনটি অবদি টেনে দিতে পারেন।

সে কি মশাই, যা হয় একটা কিছু ব্যবস্থা করুন, একটা রিলিফ।

ব্যবস্থা একটাই আছে, সেটা হল বড় রকমের একটা শক।

ফোর ফর্টি ভোল্ট?

ইলেকট্রিক শক নয়, মেন্টাল শক।

মেন্টাল শকের আর বাকি কি আছে। তিন ছেলে তিন দিকে। একজন আমেরিকায়, একজন কসবায়’। একজন সোদপুরে, আর এই সল্টলেক। প্রত্যাশা যাতে না বেড়ে যায়, তাই মিনিমাম ভোগ। মা বলে ডাকলেও পাকে প্রকারে বুঝিয়ে দিতে ছাড়ি না, তোমার স্ট্যাটাস কাজের মাসির চেয়ে বড় নয়। উঠতে বসতে দাঁত খিচুনি। সংসারের ব্যাপারে কিছু বলতে এলেই, হয় আমরা চুপ, না হয় দািবড়নি। আঁবার ইংরিজিও বলে দি, দ্যাটস নান অফ ইওর বিজনেস। পেশায় চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হলেও ব্যবহারে চণ্ডাল। এর পরেও শক! আরো শক।

এর কোনোটাই শক্য নয়। এটা হ’ল কষ্ট। মাপেৰ চেয়ে ছোট জুতো পায়ে গলিয়ে হাঁটার মতো; কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু চলা বন্ধ হচ্ছে না। শক কীরকম জানেন, এই ধরুন, আপনি বড় ছেলে, হঠাৎ আজই মারা গেলেন, চেষ্টা করে। দেখতে পারেন, সেই আচমকা আঘাতে আপনার মা মরলে ও মরতে পারেন। এই একটা পথে আশfর আলো দেখা যাচ্ছে।

ধুর মশাই, নিজেই যদি মরে গেলুম, তাহলে আর হল কী!

কেন আপনার পরিবার সুখে থাকবেন। বুড়ি শাশুড়ীর উৎপাতে তিনিই তো সবচেয়ে বেশি বিব্রত!

কিন্তু, আমি মরে গেলে তার জীবনে আর রইলটা কী!

কেন ব্যাঙ্ক ব্যালেনস! বড়লোকের স্ত্রীদের তো স্বামী থাকে না।

কী থাকে?

প্ৰপাটি। বিষয় সম্পত্তি, কম্পানির কাগজ, ব্যাঙ্ক ব্যালেনস। গরিবদের স্ত্রী থাকে। দুজনে মিলে কষ্ট করে সুখ করে, টাকা জমিয়ে তীর্থে যায়, ঝগড়া করে, প্রেম করে, না খেয়ে ছেলেমেয়েদের খাওয়ায়। অন্যের দুঃখে চোখের জল ফেলে, শ্মশানে যায়। দুজনেই বুড়ো হতে হতে একদিন জুটি ভেঙে যায়। তখন যে থাকে, সে থেকেও থাকে না।

সেই গানের অর্থ এরাই বোঝে,

দো হনস কা জোড়া বিছাড় গিয়ো রে
গজব ভয়ো রামো জুলুম ভয়ো রে।

আপনাদের তো মশাই শেয়ানে শেয়ানে কোলাকুলি। আপনাদের যে হৃদয়, যেখানে অ্যাটাক হয়, বাইপাস হয়, ওটা বাংলা হৃদয় নয়, ইংরিজি হার্ট, একটা টুলুপাম্প, রক্ত তোলে, রক্ত নামায়। প্রেম প্রীতি, ভালবাসা, সহধর্মিতা, মর্মিতা; এইসব নিয়ে যে হৃদয়, সেটা আপনাদের নেই। চোখ আছে জল নেই, মন আছে মনন নেই, প্ৰাণ আছে চৈতন্য নেই, কান আছে শ্রবণ নেই, নাক আছে সুগন্ধ নেই, ত্বক আছে অনুভূতি নেই, ইন্দ্ৰিয় আছে সংযম নেই, হাত আছে সৎকর্ম নেই, পা আছে তীর্থভ্ৰমণ নেই, জিভা আছে মিষ্টি কথা নেই, শিক্ষা আছে জ্ঞান নেই, আত্মা আছে আত্মসমালোচনা নেই। জীবন আছে দর্শন নেই।

বড় বড় কথা! আপনি নিজে কী? তাহলে শুনুন। এলিয়ট সায়েবের দুচরণ কবিতা:

We are the hollow men
We are the stuffed men
Leaning together
Headpiece filled with straw. Alas!

No comments