বন্দুক-মানব – হুমায়ূন আহমেদ
গানম্যানের বাংলা করলাম ‘বন্দুক-মানব’। ঘন বাংলা হয় নি, পাতলা বাংলা হয়েছে। ‘গানম্যানে’ যে কঠিন ভাব আছে, ‘বন্দুক-মানবে’ তা নেই। এখানে মানব শব্দটাই প্রাধান্য পেয়েছে। বন্দুক হয়েছে গৌণ। বাংলা ভাষার এ এক মজার খেলা।
অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যেমন, মন্ত্রী-মিনিস্টার, দেশের প্রধান, রাজনৈতিক নেতাদের সরকার গানম্যান দেয়। গানম্যানরা শাদা পোশাকে থাকে। তাদের পকেটে থাকে আধুনিক মারণাস্ত্র।
বিজ্ঞাপনে দেখি লাইফবয় সাবান জীবাণু থেকে সুরক্ষা দেয়। গানম্যানরাও গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের সুরক্ষা দেন।
এক সকালের কথা। থাকি ‘দখিন হাওয়া’র ফ্ল্যাটে। সম্পূর্ণ ‘একা’। একজন বাবুর্চি ছিল, সে রাত একটা-দুটায় আমি ডিনার খাই দেখে কাউকে কিছু না-বলে (এবং তার পাওনা বেতন না নিয়ে চলে গেছে। আমি হাতমুখ ধুয়ে এককাপ চা বানিয়ে পত্রিকা নিয়ে বসেছি, তখন ঘরে সুশ্রী চেহারার এক যুবক ঢুকল। তার গায়ের শার্ট দামি, প্যান্ট দামি, জুতাজোড়াও চকচক করছে। তার গা থেকে সেন্টের গন্ধ আসছে।
আমি বললাম, কী ব্যাপার?
যুবক বলল, স্যার আমি গানম্যান।
গানম্যান খুব ভালো কথা। আমার কাছে কী?
স্যার, আমি আপনার গানম্যান।
পানি খেতে গিয়ে লোকে বিষম খায়, আমি চায়ে চুমুক দিয়ে বিষম খেলাম। চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বললাম, কোথাও কোনো ভুল হয়েছে। আমার কোনো গানম্যান নেই। থাকার কথাও না।
কোনো ভুল হয় নাই স্যার। এই যে আমার পরিচয়পত্র। পুলিশ। হেডকোয়ার্টার থেকে আপনাকে একটা চিঠিও দেওয়া হয়েছে। এই যে চিঠি।
চিঠি পড়ে দেখি ঘটনা সত্যি। সরকার আমার জন্যে গানম্যানের ব্যবস্থা করেছে। গানম্যান সার্বক্ষণিকভাবে আমার সঙ্গে থাকবে। আমাকে সুরক্ষা দেবে।
আমি বললাম, হলি কাউ!
গানম্যান বলল, কী বললেন বুঝতে পারলাম না।
আমি বললাম, বুঝতে হবে না। ঘরে সিগারেট নেই বলে সিগারেট খেতে পারছি না। তুমি এক প্যাকেট সিগারেট কিনে আনতে পারবে?
অবশ্যই পারব স্যার।
গানম্যান সিগারেট কিনতে গেল, আমি পরিস্থিতি নিয়ে ভাবতে বসলাম।
গানম্যান নিয়ে ঘোরার মধ্যে আত্মশ্লাঘার বিষয় আছে। নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবা এবং অন্যের কাছে গুরুত্বপূর্ণ করা। এই পরিস্থিতিতে আমি কী করব বুঝতে পারছি না। গানম্যানের আনা সিগারেট টেনেও মাথা পরিষ্কার হলো না। আমি পুলিশ হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিনয়ের সঙ্গে বললাম, আমি একজন লেখক মানুষ। লেখক ঘুরবে ঝোলা নিয়ে, ঝোলাতে থাকবে কাগজ-কলম। লেখক কখনো গানম্যান নিয়ে ঘুরবে না। আপনি গানম্যান উঠিয়ে নিন।
কয়েকদিন থাকক। তারপর আপনার কথামতো উঠিয়ে নিব।
কয়েকদিন শুনে রাজি হলাম, সেই কয়েকদিন তিন বছর পর্যন্ত গড়াল। যাই হোক, প্রথম দিনের কথা বলি। দুপুর তিনটার দিকে গানম্যান বলল, স্যার দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা কী?
খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নাই। পাশের ফ্ল্যাট থেকে খাবার আসে। আজ মনে হয় ভুলে গেছে। মাঝে মাঝে তারা খাবার পাঠাতে ভুলে যায়।
আমরা দুপুরে খাব না?
তেহারির দোকান থেকে দু’প্যাকেট তেহারি নিয়ে আসো।
আপনার কি গাড়ি আছে?
গাড়ি আছে। ড্রাইভার নাই। রিকশা করে চলে যাও।
গানম্যান চিন্তিত ভঙ্গিতে তেহারি আনতে বের হলো।
সন্ধ্যার কথা। বন্ধুবান্ধব আসবে। ওল্ড ফুলস ক্লাবের আড্ডা বসবে। আমার বসার ঘরের দরজা সবসময় খোলা থাকে। হিমু তার ঘরের দরজা খোলা রাখে, আমি হিমুর বাবা। আমারও ঘরের দরজা খোলা রাখা উচিত।
আজ দরজা বন্ধ। দরজার পাশে চেয়ার নিয়ে গানম্যান বসে আছে। তার চোখমুখ কঠিন।
দরজার বেল বাজল। গানম্যান দরজা খুলে বলল, হাত উপরে তুলুন, বডি চেক। ভয় পাবেন না। রুটিন চেক। হুমায়ূন স্যারের সিকিউরিটির বিষয়।
আমার কাছে এসেছে ছেলেবেলার বন্ধু ডাক্তার করিম (অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান)। সে হাত তুলল। বডি চেক করা হলো। গানম্যান বলল, আপনার ব্যাগে কী? ব্যাগ খুলুন, ব্যাগে কী আছে দেখব।
করিম ভয়ে ভয়ে বলল, আপনি কে?
আমি হুমায়ূন স্যারের গানম্যান। এখন বলুন, আপনি কে, কোত্থেকে এসেছেন, কেন এসেছেন?
করিম বলল, আমি পাঁচতলায় এসেছিলাম আলমগীর রহমানের কাছে। ভুলে ছয়তলায় চলে এসেছি। হমায়ূন আহমেদকে আমি সেভাবে চিনি না।
একটা চৈনিক প্রবাদ আছে–”হাঁচি, কাশি এবং প্রেম কারও কাছ থেকে লুকানো যায় না।“ আমি এই তিনটির সঙ্গে আরেকটি যুক্ত করেছি- “হাঁচি, কাশি, প্রেম এবং গানম্যান কারও কাছ থেকে লুকানো যায় না।“ কিছুদিনের মধ্যে সবাই জেনে গেল আমার সঙ্গে একজন দুর্ধর্ষ গানম্যান আছে। বন্ধুবান্ধবদের বাসায় আসা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেল।
দশ দিনের মাথায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এল। আমি গানম্যানকে বললাম, আমার দরজা সবসময় খোলা থাকবে, কাউকে চেক করা যাবে না। অতিথিদের নাম-ঠিকানা লেখা যাবে না। আমি যখন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেব তখন সামনে দিয়ে হাঁটাহাঁটি করা যাবে না।
গানম্যান নতুন রুটিনে দ্রুত অভ্যস্ত হয়ে গেল। সে আমার পাশে একটা ঘরে ঘুমায়, সকালে ঘুম থেকে উঠে নাশতা খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে উঠে গোসল সেরে দুপুরের খাবার খেয়ে আবার ঘুম। ঘুম ভাঙার পর সে আমার লেখা গল্প-উপন্যাসের বই হাতে নিয়ে চোখমুখ শক্ত করে বই পড়ে। যেন পরীক্ষার পড়া মুখস্থ করছে। সাহিত্য নিয়ে মাঝে মধ্যে কিছু আলোচনাও হয়। যেমন, স্যারের এই বইটা তেমন ভালো হয় নাই। এন্ডিং-এ ঝামেলা আছে।
আমাদের দুজনের জীবনচর্যায় মিল পাওয়া গেল। সে তার ঘরে একা থাকে, আমিও আমার ঘরে একা থাকি। সে সারা দিন ঘুমায়, আমি সারা দিন লিখি। সন্ধ্যার পর থেকে সে বই পড়ে, আমিও বই পড়ি। গভীর রাত পর্যন্ত সে হিন্দি সিরিয়াল দেখে। গভীর রাত পর্যন্ত আমিও ভিসিআরে সিনেমা দেখি।
গানম্যানের নিঃসঙ্গতা কাটল, আমার একজন বাবুর্চি জোগাড় হলো। গানম্যান বাজার করে আনে, দু’জনে মিলে কোটাবাছা করে। রান্না চাপায়। একদিন মজার এক দৃশ্য দেখলাম, রান্নাঘরে গানম্যান লেপটা দিয়ে বসে কচুর লতি বাছছে। পাশেই লোডেড পিস্তল।
কোরবানির ঈদে সে ছুটি নিয়ে দেশে গেল না। আমাকে একা ফেলে যাবে না। ঈদের দিন আমাকে কে দেখবে? আমি.কোরবানি দেব না শুনে সে মুষড়ে পড়ল। আমি বললাম, মাংস কাটা, রান্না করা, এইসব কে করবে? ঘরে কেউ নাই। বাবুর্চি ছুটি নিয়ে চলে গেছে।
স্যার আমি তো আছি। টাকা দিন, খাসি কিনে নিয়ে আসি। আরেকটা কথা, আপনার অনুমতি ছাড়াই পাশের বাসার মাজহার স্যারের গরুতে একটা নাম দিয়ে দিয়েছি।
তাকে নিয়ে ঈদের নামাজ পড়তে গিয়ে আরেক যন্ত্রণা। সিজদায় গিয়েছি, টুপ করে শব্দ হলো। তাকিয়ে দেখি পকেট থেকে গানম্যানের পিস্তল জায়নামাজে পড়ে গেছে। মুসুল্লীরা তাকিয়ে আছেন আতংকিত চোখে।
গানম্যানদের প্রতিমাসেই গাজীপুরে পিস্তল শুটিং-এর পরীক্ষা হয়। একবার পরীক্ষা দিয়ে আমার গানম্যান খুব মন খারাপ করে ফিরল।
আমি বললাম, কী হয়েছে?
সে বলল, পরীক্ষা খারাপ হয়েছে। হাতের টিপ নষ্ট হয়ে গেছে।
কচুর লতি বাছলে হাতের টিপ তো নষ্ট হবেই।
তারপরেও স্যার অসুবিধা নাই। আপনার উপর কোনো হামলা হলে পঁচিশ গজের ভিতর যে আসবে তারেই শুট করে ফেলে দিব। একটা হামলা হোক, দেখেন স্যার কী করি?
গানম্যান হামলার আশায় দিন কাটাতে লাগল। সন্ত্রাসী হামলা হলো না, তবে অন্য ধরনের হামলায় জীবনসংশয় হলো। এই হামলার নাম হার্টঅ্যাটাক। ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি হলাম। আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে, গানম্যান সঙ্গে যাবে। ডাক্তার বললেন, অসম্ভব! আপনি যেতে পারবেন না।
গানম্যান বলল, অবশ্যই আমাকে যেতে হবে। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে যদি স্যারের উপর হামলা হয় কে সামলাবে? আপনারা সামলাবেন? জবাবদিহি তো আপনাদের করতে হবে না। আমাকে করতে হবে।
আমাকে সিডেটিভ দেওয়া হয়েছিল। গানম্যান এবং ডাক্তারদের তর্কবিতর্ক শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল অনেক রাতে। চোখ মেলে দেখি, আমি পর্দাঘেরা ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে আছি। আমার পাশে গানম্যান দাঁড়িয়ে। তার চোখ মমতায় আর্দ্র। সে বলল, স্যার আমি আছি। কোনোরকম দুশ্চিন্তা করবেন না। কেউ এসে হামলা করুক দেখেন কী করি?
তার মমতাভেজা কণ্ঠ বলে দিল সে গানম্যান না, বন্দুক-মানব।
.
পাদটিকা
জমিকে লালাউ গুল জিনহে খেয়াল নেহি।
ও লোগ চান্দসিতারো কি বাৎ করতে হ্যাঁয়।
খয়াল কানপুরী
পৃথিবীর বুকের ফুলফল লতাগুল্মে যার চোখ নেই, সে-ই শুধু আকাশের চন্দ্র এবং নক্ষত্রের গল্প করে।
Post a Comment