ছায়া ছায়া ভূত – সায়ন্তনী পূততুন্ড

ছায়া ছায়া ভূত – সায়ন্তনী পূততুন্ড

–ডাক্তারবাবু……আমি কি বেঁচে আছি?

প্রশ্নটা শুনে ডাক্তারবাবুর ভুরুতে সামান্য ভাঁজ পড়ল।

মাথার উপরে একটা টিমটিমে আলো জ্বলছে। তাতে সামনের মানুষটাকে স্পষ্ট দেখতে না পেলেও তার অস্পষ্ট ছায়া ছায়া অবয়ব বোঝা যাচ্ছিল। নাকের উপর ভারি চশমার কাঁচ ঐ আধা আলো আধা অন্ধকারেই চকচক করে উঠছে। মুখের চাপদাড়ির জঙ্গল বুঝতেও অসুবিধা হচ্ছিল না।

মনস্তত্ত্ববিদের ঘর যেমন হয়, এ ঘরটাও তেমনই। আলোর চেয়ে অন্ধকারই বেশি। ডাক্তারবাবু টেবিলের ওপ্রান্তে বসে আছেন, আর রোগী এ প্রান্তে। কাউকেই বিশেষ স্পষ্ট দেখার উপায় নেই। শুধু দেওয়ালে দুটো ক্ষীণ ছায়া মাঝে মাঝে নড়েচড়ে উঠছে।

ডক্টর সিনহা প্রশ্নটায় বেশ কৌতুকবোধ করলেন। আস্ত একটা জলজ্যান্ত লোক জিজ্ঞাসা করছে যে সে বেঁচে আছে কিনা!

–এমন মনে হচ্ছে কেন আপনার?

লোকটা যেন একটু ইতস্তত করল। একটু উশখুশ করে উঠে বলল–একটা সিগ্রেট খেতে পারি?

এখানে ধূমপান মানা হলেও লোকটার অবস্থা দেখে ডাক্তারবাবুর দয়া হয়। অসম্ভব ভয়ে সে জড়োসড়ো! গলার স্বর কাঁপছে! একটু যেন ফাঁসাসেও!

–নিশ্চয়ই।

সে কাঁপা কাঁপা হাতে সিগ্রেট ধরাল। হাত দুটোও থরথর করে কাঁপছে। লাইটার জ্বালাতেই ডাক্তারবাবু তার চোখ দুটো একঝলক দেখতে পেলেন। লাল টকটকে চোখ। যেন রক্ত জমে আছে চোখে! একবারের জন্য যেন মনে হল– লোকটার চোখের মণিটা লাল!

মুহূর্তের জন্য হলেও চমকে উঠেছেন তিনি। পরক্ষণেই সামলে নিলেন। হয়তো বহুদিন লোকটা ঘুমোয়নি। সেই জন্যই চোখ অমন লাল।

কিন্তু চোখের মণি অমন লাল হয় কী করে?……

নাঃ, তিনি নিজেকে বোঝালেন। হয়তো লাইটারের সামান্য আলোয় তার চোখের ভুল হয়েছে। একটা স্বাভাবিক মানুষের চোখের মণি লাল কখনই হয় না।

একেই বলে ইলুশন!

লোকটা সিগ্রেটে উত্তেজিত কয়েকটা টান মেরে যেন একটু শান্ত হয়। বলে– ডাক্তারবাবু, আপনি একটু দেওয়ালের দিকে তাকাবেন প্লিজ?

এমন উদ্ভট আবদারে তিনি অবাক ও বিরক্ত দুই-ই হলেন। কিন্তু মনস্ত ত্ত্ববিদের চটে যাওয়ার উপায় নেই।

–কেন?

সে ফিসফিস করে বলে–দেখুন তো দেওয়ালে কটা ছায়া দেখা যাচ্ছে?–আপনি নিজেই তো দেখে নিতে পারেন…!

— আমার ভয় করছে! অসম্ভব ভীত, সন্ত্রস্ত গলা তার– বলুন না। ক’টা দেখা যাচ্ছে?

তিনি আরও অবাক–সে কি! কটা আবার দেখা যাবে! দুজন আছি, তাই দুটোই দেখা যাচ্ছে!

–তিনটে নয় তো?

–তিনটে! তিনটে কেন থাকবে?

লোকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে–থ্যাঙ্কস। তাহলে তিনটে নেই……

এবার বোধহয় ডক্টর সিনহা ভদ্রলোকের বিষয়ে কৌতূহল বোধ করলেন। লোকটার হাবভাব যেন কেমন উদ্ভট! ত্রিশ বছরের কেরিয়ারে অনেক উদ্ভট রোগীর দেখা তিনি পেয়েছেন। কিন্তু এমন রোগী দেখেননি। ওকে একটু গুছিয়ে নেওয়ার সময় দিলেন তিনি। তারপর আলতো গলা খাকারি দিয়ে বলেন—

–কী হয়েছে আপনার? কী সমস্যা?

–বলবো… সে আস্তে আস্তে বলে–বলবো বলেই তো এসেছি। কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়!

–কোথায়?

লোকটা এবার অদ্ভুত ভাবে তাকায় তার দিকে। ডাক্তারবাবুর মনে হল লোকটার চোখ যেন হঠাৎ জ্বলে উঠল…

–আপনি আমার কথা বিশ্বাস করবেন তো?

–কেন করবো না?

সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে–তবে শুনুন…আমার নাম তপন মিশ্র। আমি রাইটার! থ্রিলার লিখি…

–তপন মিশ্র! ডক্টর সিনহা অবাক হয়ে বলেন–আপনি তপন মিশ্র। রাতের ভয়ঙ্কর গল্পটার লেখক?

–হ্যাঁ। আমিই…।

.

তপন মিশ্রের কথা।

প্রত্যেকবার এইসময়টাই আমার বড্ড চাপ যায়।

পূজাবার্ষিকীতে থ্রিলারের কদর খুব বেশি। বিশেষ করে কিশোর পত্রিকাগুলোতে। তাই প্রায় জানুয়ারি থেকেই আসতে থাকে সম্পাদকদের ফরমায়েশ! জানুয়ারি থেকে জুলাই অবধি দম ফেলার ফুরসতও থাকে না।

এবার এক সম্পাদক এলেন অদ্ভুত এক ফরমায়েশ নিয়ে। বললেন–দাদা, গোয়েন্দা গল্প নয়, এবার একটু অন্যরকম লেখা চাই আপনার।

কীরকম লেখা চান জানতে চাইলে বললেন–একদম টানটান থ্রিলার। একটা বিভৎস চরিত্রকে নিয়ে। ভিলেন চরিত্র। সাইকো আজকাল বাজারে খুব খাচ্ছে! খুনের সিকোয়েন্স থাকবে অনেকগুলো। রক্তারক্তি কাণ্ড! দেখবেন–পুরো হটকেক হয়ে যাবে।

–যখন সব ফর্মুলাই জানেন, তখন নিজেই একটা হটকেক বানিয়ে ফেলুন!।

…না…এ কথাটা বলিনি! ভাবছিলাম বলবো কিনা। কিন্তু চেপে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের লক্ষণ মনে হল। মুখে শুধু বললাম–বেশ।

বলে তো দিলাম–কিন্তু এমন চরিত্র আমদানি করি কোথা থেকে! প্রচুর থ্রিলার পড়তে শুরু করলাম। ইংরাজি, বাংলা, হিন্দি সবরকম থ্রিলার ফিল্ম দেখলাম। অনেক দেখে শুনে একটা চরিত্রের আইডিয়া পাওয়া গেল।

চরিত্রের নাম রাখলাম–অগ্নি। ছ’ফুট হাইটের এক মাঝবয়েসী লোক। হঠাৎ করে তার শখ হল ব্ল্যাকম্যাজিক নিয়ে গবেষণা করবে। সেই মতো কাজও করতে শুরু করল। ব্ল্যাক ম্যাজিকের উপর কাজ করতে করতেই একটা বই পড়ে জানতে পারল যে, মানুষের হৃৎপিণ্ড শয়তানকে উৎসর্গ করে, তারপর সেই প্রসাদ খেলে নাকি অমরতা লাভ করা যায়।

সেই বই পড়েই তার মাথা খারাপ হয়ে যায়। অমরত্বের লোভে সে আর মানুষ থাকলো না। শুরু হলো তার নারকীয় হত্যাকাণ্ড। প্রথমে আশেপাশের লোক, কাজের লোক এমনকি নিজের স্ত্রী-পুত্রকেও সে ছাড়ে নি! সবাইকে খুন করে, তাদের হৃৎপিণ্ড শয়তানকে উৎসর্গ করে খেতে শুরু করেছিল! শেষ পর্যন্ত পুলিশ তাকে ধরে এবং তার ফাঁসি হয়।

এই হলো গল্পের মূল কাঠামো। ভাবনা আসা মাত্রই দাঁড় করিয়ে ফেললাম গল্পটাকে। সম্পাদক পাণ্ডুলিপি পড়ে খুব খুশি!বলেই ফেললেন–দাদা, যত লেখা আপনার পড়েছি, এটা হচ্ছে বেস্ট! দেখবেন, পাব্লিক একেবারে গপগপিয়ে খাবে।

সম্পাদকের প্রশংসা পেয়ে খুব খুশি হলাম। কিন্তু সে সুখ আমার কপালে সইল না।

সেদিন রাত্রে খুব ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল। বাইরে ঝড়ের দাপাদাপি! মাঝে মাঝেই প্রচন্ড শব্দ করে বাজ পড়ছে। এমন সময় হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে গেল।

আমি বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছিলাম! ঘুম আসছিল না। পাশেই আমার স্ত্রী ও একমাত্র ছেলে ঘুমিয়ে কাদা। কিন্তু আমি ঘুমোতে পারছি না। কী যেন অস্বস্তি কাজ করছিল মনের মধ্যে!

আমার বেডরুমের জানলার কাঁচে মাঝেমধ্যেই বিদ্যুতের নীল আলো ঝলসে ঝলসে উঠছে। বাইরে যেন একটা নীল কুয়াশা কখন আস্তে আস্তে এসে জমাট বাঁধছিল! বৃষ্টির জলটাকেও যেন নীল মনে হয়!

ঘরে একটা মোমবাতি জ্বলছিল। তাও সেটার প্রায় ফুরিয়ে আসার সময় হয়েছে। একদম স্তিমিত আলোয় হঠাৎ মনে হল… কেউ যেন আমার ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে।

অসম্ভব! কাউকেই তো দেখতে পাচ্ছি না! চোখের সামনে কেউ নেই! অথচ দেওয়ালে ওটা তবে কার ছায়া!

প্রায় ছ’ফুট লম্বা একটা ছায়া! বেশ বুঝতে পারলাম তার পরনে ওভারকোট! মাথায় টুপি!

অবিকল তেমন…ঠিক তেমন…যেমন বর্ণনা আমি বইয়ে দিয়েছি! অগ্নির পরনেও এই পোষাকই থাকতো…! এই পোষাকই…

–তোমরা লেখকরা নিজেদের কি ভাবো…?

কানের কাছে একটা অদ্ভুত হিসহিসে আওয়াজ। যেন এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া শিস দিয়ে বলে উঠল–যতই অমরত্বের লোভ থাক–নিজের স্ত্রী-সন্তানকে খুন করা অত সহজ! নিজের হাতে নিজের আপনজনকে টুকরো টুকরো করে কাটতে কী প্রচন্ড কষ্ট হয়, তোমার বিন্দুমাত্রও ধারণা আছে?

আমি বুঝে উঠতে পারলাম না ঘটনাটা ঠিক কী ঘটছে! স্বপ্ন দেখছি! না সত্যিই এ সব আমার সাথে ঘটছে!

কিছু বোঝার আগেই সেই কণ্ঠস্বর আবার বলল–তুমিই আমাকে এই ঘৃণ্য অভিশপ্ত জীবন দিয়েছ। আমার হাত দিয়েই আমার সন্তানকে খুন করিয়েছ! আমি কষ্ট পেলেও কিছু করতে পারিনি! কারণ তুমি লেখক! যা করাবে তাই করতে হবে। এটাই নিয়ম! বলতে বলতেই সে নিষ্ঠুরভাবে হিসহিসিয়ে উঠল– এবার তোমাকেও তার দাম দিতে হবে। আমার জীবন এবার তুমিও একবার বেঁচে দেখো। আমি যা যা করেছি, সব এবার করে দেখবে তুমি। আর আমার মতোই তোমারও কিছু করার থাকবে না!

এতক্ষণ যেন আমার জ্ঞান ছিল না! এবার কথাগুলো শুনে প্রায় লাফিয়ে উঠতে গেলাম!

ঠিক তখনই দপ্ করে মোমবাতিটা নিভে গেল! সঙ্গে সঙ্গেই কাছে প্রচন্ড শব্দে বাজ পড়ল! জানলাগুলো তার দাপটে কেঁপে ওঠে!

তারপর আর কিছু মনে নেই!

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই টের পেলাম পাশের বাড়িতে ভীষণ শোরগোল। কারা যেন ভীষণ কাঁদছে।

স্ত্রী বেড টি নিয়ে এসেছিলেন। কিছু বলার আগেই উত্তেজিত স্বরে বললেন– জানো, রথীনবাবুকে কাল কে যেন খুন করে গেছে!

রথীনবাবু আমাদের প্রতিবেশী!

–পুরো টুকরো টুকরো করে কেটেছে। আমার স্ত্রীর চোখ দুটো আতঙ্কে বিস্ফারিত–সবচেয়ে আশ্চর্য কি জানো! ওনার হৃৎপিণ্ডটা নেই! কে যেন খুবলে তুলে নিয়েছে!

আমার মুখ দিয়ে কোন শব্দ বেরোল না! গত রাত্রের কথা মনে পড়ে গেল! টের পেলাম ভীষণ আতঙ্ক আমার বুকের ভিতরে চেপে বসছে!

বেড টি খেতে গেলাম। কিন্তু মুখে ভালো লাগল না। মুখ থেকে কেমন যেন বদগন্ধ বেরোচ্ছিল। অল্প অল্প গা গুলোচ্ছিল। কাঁচা মাংস খেলে মুখের স্বাদ যেমন হয়ে যায় টের পেলাম, মুখটা তেমনই হয়ে আছে!

ভাবলাম ব্রাশ করলেই ঠিক হয়ে যাবে। হয়তো হজম টজম ঠিক মতন হয়নি তাই এই…

বাথরুমে গিয়ে ব্রাশ করতে গিয়েই যা দেখলাম তাতে আমার পায়ের তলার মাটি সরে গেল!

আমার দাঁতে কালচে কালচে লাল ছোপ! শুকনো রক্তের দাগ যেমন হয়, ঠিক তেমন! আর জিভ…!

জিভটা পুরো লাল! রক্ত তখনও শুকিয়ে যায়নি!

আমি হতভম্ব! মনে হচ্ছিল এক্ষুনি পড়ে যাবো। আস্তে আস্তে বাথরুমের মেঝেতেই বসে পড়লাম!

বসে পড়তেই আরেকটা অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়ল। আমার বসে থাকা ছায়াটার পাস থেকেই আরেকটা দীর্ঘদেহী ছায়া ভেসে উঠেছে! ওভারকোট, টুপি পরা! ও ছায়া আমার নয়! হতেই পারে না। অথচ ছায়াটা ঠিক আমার পিছনেই…!

এরপরই ছায়াটা গোটা দেওয়ালে হেঁটে বেড়াতে শুরু করলো! ঠিক যেমন সরীসৃপ দেওয়াল বেয়ে বেড়ায়…তেমনিই সারা দেওয়ালে, ছাতে শরীর ঘেঁষটে বেড়াচ্ছে সে!

বুঝলাম ও আমায় নিষ্কৃতি দেবে না! সৃষ্টি এবার সষ্টাকে ধ্বংস করেই ছাড়বে!

কাউকে কিছু বললাম না। কিন্তু সারাদিন, সারারাত সেই ছায়া আমার সাথে। লেগেই থাকলো। কখনও সে আমার পিছন পিছন আসে, কখনও দেওয়ালময় হেঁটে বেড়ায়! কিন্তু পিছু ছাড়ে না! আমার অদ্ভুত আচরণ দেখে স্ত্রী অবাক হলেন। কিন্তু ভাবলেন যে হয়তো রথীনবাবুর মৃত্যু সংবাদে আমি ভয় পেয়ে গেছি। তাই এমন অবস্থা!

এর ঠিক দুদিন পরের কথা!

আমাদের কাজের মেয়েটা সেদিন বিকেলে একটু দেরি করে এলো! সে নতুন একটা কাজ ধরেছে বলে এখন থেকে একটু দেরি হবে বলে জানালো।

আমার স্ত্রী-পুত্র সেদিন একটু বেরিয়েছিল। ঘরে একা আমিই ছিলাম। নতুন একটা লেখা নিয়ে ব্যস্ততার মধ্যেও ওকে ঘাড় নেড়ে জানাই যে খবরটা বৌদির কানে পৌঁছে দেবো!

–চা দেবো বাবু?

অন্যমনস্ক হয়ে বলি–দাও।

ও চলে গেল রান্নাঘরে। শুনতে পেলাম বাসনপত্রের আওয়াজ! বাসন মাজার শব্দ!

— কচি মেয়ে…কচি হৃৎপিণ্ড! হঠাৎ একরাশ ঠাণ্ডা হাওয়া আবার আমার কান ছুঁয়ে গেল! ফিসফিস করে বলল–

–কেমন লাগবে খেতে?

সেই শেষ কথা…বিশ্বাস করুন তারপর আমার আর কিছু মনে নেই! আমি কি করেছি না করেছি…কিছু বলতে পারবো না!

শুধু যখন জ্ঞান এলো তখন দেখলাম..

মেয়েটা আমার সামনে পড়ে আছে…ভীষণ আতঙ্কে চোখ দুটো খোলা… সারাঘরে রক্ত… আর রক্ত…! আমার গায়ে… মুখে… হাতে… সর্বাঙ্গে…

আর লাশের পাশে পড়ে আছে কিচেনের একটা ছুরি! সেটাও যেন রক্ত মেখে পাশবিক জিঘাংসায় হাসছে!

আমি কী করবো…কী করবো…লাশটা লুকোনো দরকার…রক্তটা মুছে ফেলা দরকার…নিজের হাত পা পরিষ্কার…

কোনটা আগে করবো? ভীষণ কান্না আর ভয় বুকের মধ্যে এসে ধাক্কা মারছে! ভয়ে, অনুতাপে কান্নায় ভেঙে পড়লাম! কী কষ্ট! মৃত্যুযন্ত্রণার মতো…!

আমি একটা জানোয়ার…জানোয়ার…! খুনী…সাইকো…ওঃ ঈশ্বর!

অনেকক্ষণ কান্নাকাটির পর মনের জোর ফিরে পেলাম। লাশটাকে স্টোররুমে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে ফেলি। স্টোররুমে এখন আর কেউ ঢোকে না! চতুর্দিকে শুধু ধুলো আর মাকড়সার জাল! সেখানেই বর্জ্য জিনিসপত্রের স্তূপে লুকিয়ে ফেললাম তাকে।

তখনই ফের নজরে পড়ল– সেই ছায়া! আমার ছোটখাটো চেহারার ছায়ার ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে আছে! হ্যাট-কোট পরা…লম্বা ছায়া…যেন তাকিয়ে দেখছে আমি কী করছি!

নাঃ, ওর কাছে হেরে যেতে পারবো না আমি! এক্ষুনি কিছু করতে হবে।

তাড়াতাড়ি সব দাগ মুছে ফেললাম। টয়লেটে ঢুকে স্নান করছি এমন সময় কলিংবেলের আওয়াজ। আমার স্ত্রী ফিরে এসেছেন। কোনমতে গা মুছে তাকে দরজা খুলে দিই। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে অবাক হলেন–তুমি এই ভর সন্ধ্যায় স্নান করেছ যে!

কী বলবো ভেবে পেলাম না। শুধু বলি–এই…মানে ইচ্ছে করল।

তিনি সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে আমায় একবার মেপে নিলেন।

–ভারতী এসেছিল?

ভারতী আমাদের কাজের মেয়ের নাম।

ভয়ে কুলকুল করে তখনও ঘামছি। মুখ দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না। কোনমতে বলি–ভারতী? কই… ন্‌ন্‌ন্‌নাঃ …আসেনি তো!

স্ত্রী বিরক্ত হয়ে বকবক করতে করতে কিচেনের দিকে গেলেন। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বেরিয়ে এসে বিস্মিত স্বরে বললেন–ভারতী আসেনি? তবে বাসনপত্র কে মাজলো?

কোনও উত্তর দিতে পারলাম না!

সেরাত্রে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর চুপিচুপি উঠে রান্নাঘরে গেলাম। যেখানে যত ছুরি, কাঁচি, ধারালো জিনিস আছে পাগলের মতো খুঁজতে শুরু করি। এক্ষুনি এগুলো সরানো দরকার! আমার নিজের উপর নিজেরই বিশ্বাস আর নেই। আমারই চরিত্র আমায় হারিয়ে দেবে! অসম্ভব! কিছুতেই হারবো না আমি ওর কাছে!

সমস্ত ছুরি, কাঁচি, কাটার জিনিসপত্র আঁতিপাতি করে খুঁজে জড়ো করলাম। তারপর প্যাকেট করে সব ফেলে দিলাম আস্তাকুঁড়েতে। কাল সকালে ময়লা তোলার লোক এসে নিয়ে যাবে প্যাকেটটা!

সমস্ত কাজ করার পর যেন অদ্ভুত স্বস্তিবোধ করলাম! এবার আর কিছু হবে! কিচ্ছু হবে না……! সব ঠিকঠাক আছে…সব ঠিক…

ঘুমিয়ে পড়ার আগে চোখে পড়ল সেই লম্বা ছায়াটা তখনও দেওয়ালে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি তৃপ্তির হাসি হাসলাম–এইবার ওকে হারিয়েছি আমি! আর আমাকে ও কষ্ট দিতে পারবে না।

মনে খুব শান্তি নিয়ে ঘুমোতে গেলাম! চমৎকার ঘুম হল। কোন দুঃস্বপ্ন নয়, নিপাট সুখের ঘুম।

পরদিন বেশ দেরিতে ঘুম ভাঙে। তাকিয়ে দেখি বেলা এগারোটা বাজে! অবাক হলাম! সে কি! এত দেরী! আমার স্ত্রী আমায় ডাকেননি কেন! বেড টি ও বিছানার পাশে নেই! কী অদ্ভুত!

অবাক হয়ে উঠে বসতেই চোখে পড়ল দৃশ্যটা!

আমার দুই হাতে, সারা গায়ে রক্ত! সারামুখে……!

বুকের ভিতরটা ধ্বক করে উঠল…আমার আর দিগবিদিক জ্ঞান থাকলো না!…ছুটে গেলাম বাইরের ঘরের দিকে…নেই… কেউ নেই… আমার স্ত্রী…আমার ছেলে…কেউ নেই…ছাতে, বসার ঘরে, বাথরুমে, বাগানে… কোথাও নেই…

…হঠাৎ টেবিলের উপরে চোখ পড়ল! সেখানে একটা পাত্রে দুটো হৃৎপিণ্ড সাজানো! একটা বড়……আরেকটা ছোট……!

.

বলতে বলতেই হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললেন তপন মিশ–বিশ্বাস করুন! আমি…আমি সজ্ঞানে এসব করিনি! আমি কী করে নিজের সন্তানকে মারবো! কী করে আমি…নিজের হাতে নিজের ছেলেকে-স্ত্রীকে……।

বাদবাকি কথাগুলো উচ্ছ্বসিত কান্নায় ঢেকে গেল। ডাক্তারবাবু রুদ্ধশ্বাসে তার কথা শুনছিলেন। অসম্ভব যন্ত্রণায় লোকটা বুকফাটা হাহাকার করে উঠল–

–আমার আর কেউ রইল না ডাক্তারবাবু…আমি…আমি… একটা জানোয়ার… একটা সাইকো…একটা ঘৃণ্যজীব…ও…ওঃ ভগবান… আমি… আমি ভাবলাম এবার কী করবো! এবার কি…বাঁচার আর কোন মানে রইলো না যখন…তখন কি করি! তখন…তখন…বেডকভারটা দিয়ে ফ্যানে ফাঁস এঁটে…ওঃ যন্ত্রণা! যন্ত্রণা!…আর পারছি না!…আমি আর পারছি না ডাক্তারবাবু…আমি…

–আপনি খুনি!

লোকটা অস্পষ্ট মুখ তুলে তাকায়। তার চোখ চকচক করে উঠল।

–আপনাকে এই মুহূর্তে পুলিশে দেওয়া দরকার।

–পুলিশে দেবেন? শান্ত গলায় তপন মিশ বলে–দিন। পুলিশে ফোন করুন। তাই ভালো…তাই ভালো।

টিমটিমে বাতিটার পাশেই একটা বড় আলো থাকে। রোগীরা সবসময় অন্ধকার পছন্দ করে বলেই বড় আলোটা জ্বালান না তিনি। এবার পুলিশে ফোন করার জন্য বড় আলোটার দরকার পড়ল!

কিন্তু আলোটা জ্বালিয়েই…চিৎকার করে উঠলেন ডক্টর সিনহা!

সব যেখানে থাকার–আছে। দেওয়ালে দুটো ছায়া তখনও মুখোমুখি বসে আছে! তপন মিশ্রের ধরানো সিগ্রেটটা তখনও জ্বলছে!

কিন্তু………শূন্যে!

আর কেউ নেই!!!!!!!!!!

No comments