চতুরঙ্গ – মনোজ সেন
বিকেলের পড়ন্ত আলোয় চ্যাটার্জি পাড়ার বিনানি হাউসের সামনে সুব্রত রায়ের স্টেশন ওয়াগনটা এসে দাঁড়াল। সকলের আগে গাড়ি থেকে নেমে হৈমন্তী বাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। অনেকক্ষণ ধরে চোখ কুঁচকে দেখল বাড়িটা। নীচু পাঁচিল ঘেরা একফালি জমির ওপরে একটা সাদামাটা চাঁছাছোলা হলদে রঙের দোতলা বাড়ি। নিরেট দেওয়ালে পরপর সবুজ রং করা খড়খড়ি পাল্লার জানলা, এক-তলায় মাঝখানে একটা দরজা ভেতরে ঢোকবার। দরজার সামনে একটা টানা ন্যাড়া বারান্দা, রেলিং-টেলিং-এর বালাই নেই। বারান্দা আর বাউন্ডারি ওয়ালের মধ্যে একটু খালি জমি, সেখানে কিছু শুকনো ফুলের গাছ করুণ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাড়ির পেছনের দিকে একটা বাঁধানো উঠোন, একটা কুয়োতলা আর কয়েকটা কাঁঠাল আর নারকোল গাছ দেখা যাচ্ছে। কোথাও কোনোরকম অলংকরণের কোনো চেষ্টাই করেননি পূর্বতন মালিক। মোটকথা, সমস্ত বাড়িটার একটা যেন কেমনধারা কঠিন আর তপঃক্লিষ্ট চেহারা।
সুব্রত প্রফুল্লকণ্ঠে বললেন, ‘কি রে, ভালো না বাড়িটা?’
হৈমন্তী ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কলকাতা শহরে একটা ফ্ল্যাট পেলে না, বাবা? বাংলায় থাকতে হবে বলে কি শেষপর্যন্ত এই ধাপধাড়া কমলপুরে এই মান্ধাতার আমলের বাড়িটা কিনতে হল? এটা কি একটা বসতবাড়ি না আলুর কোল্ডস্টোরেজ?’
স্টেশন ওয়াগন থেকে মাল নামাতে নামাতে সুব্রত বললেন, ‘কমলপুর মোটেই ধাপধাড়া নয়, ম্যাডাম। রীতিমতো, যাকে বলে, সাবডিভিশনাল টাউন। কী নেই এখানে? স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, সিনেমা, কলকাতায় যা যা পাওয়া যায়, তার সবই এখানে পেয়ে যাবি। কেবল তোর কলকাতায় এমন মিষ্টি হাওয়াটা পাবি না। তা ছাড়া, কোল্ডস্টোরেজই বল আর যাই বল, যে দামে বাড়িটা পেয়েছি, তাতে কলকাতায় একটা গোয়ালঘরও জুটত কি না সন্দেহ আছে।’
সুমিত বলল, ‘আমার কিন্তু জায়গাটা বেশ ভালো লাগছে রে দিদি। চারদিকে কত গাছপালা। আমাদের রাইপুরার মতো ন্যাড়া ন্যাড়া নয়। পেছনে পাঁচিলের ওপাশে কী সুন্দর একটা আমবাগান আর রাস্তার ওপারে ফাঁকা মাঠ। আশেপাশে বাড়িও বেশি নেই। সূর্যাস্তটা দেখলি? দারুণ!’
হৈমন্তী চোখ পাকিয়ে বলল, ‘চুপ কর! তোকে আর কাব্যি করতে হবে না। গাছপালা দেখছিস, না? এখানে বাবা-মা একা একা কী করে থাকবে, সেটা ভেবে দেখেছিস?’
সুব্রত বললেন, ‘একা থাকাটা কোনো একটা ব্যাপারই নয়। সারাটা জীবনই তো আমরা একা একাই থাকলুম। বিশেষ করে তোদের মা। তোরা হস্টেলে, আমি ফ্যাক্টরিতে। ও তো একাই থাকত। চয়নের মা ছাড়া বন্ধু বলতে তেমন তো আর কেউ ছিল না। থাকবেই বা কোত্থেকে? কলোনিতে সব মহিলারাই হয় হিন্দিতে নয়তো মারাঠিতে কথা বলতেন আর তোর মা এতবছর ওখানে থেকেও দুটো ভাষার একটাও রপ্ত করে উঠতে পারল না। বাক্যালাপ করতে না পারলে বন্ধু হয়? অনেক চেষ্টা করে তোদের মা স্রেফ দুটো হিন্দি কথা শিখে উঠতে পেরেছিল। একটা হল ”বুঝা হায়?” আর অন্যটা ”বুঝা হায়।” কী কষ্ট! তাই তোদের মা-ই চেয়েছিল যে, রিটায়ারমেন্টের পর পশ্চিমবাংলায় এসে থাকব আমরা। এখানে এলে সে অন্তত দুটো বাংলা কথা বলে বাঁচবে, আর কলোনির মহিলারাও ওর হিন্দির হাত থেকে বাঁচবেন।’
ইভা বললেন, ‘বাজে কথা বোলো না। আমি যথেষ্ট ভালো হিন্দি বলতে পারি। তুমিই তো এই সেদিন কলোনি বাজারে গিয়ে গন্ধ লেবু কিনতে গিয়ে, ”তুমারা পাস গন্ধা লেবু হ্যায়?” বলেছিলে। লেবুওয়ালা শুনে রেগে কাঁই। তেড়ে এসেছিল প্রায়।’
সুব্রত কথাটা কানেই তুললেন না। বললেন, ‘তোদের মা-র কথা তো আর অমান্য করতে পারি না। তবে হ্যাঁ, একটা অসুবিধে আছে। আমি এখন সারাদিন ওর ঘাড়ের ওপর থাকব। দ্যাখ, সেটা কতদিন সহ্য হয়।’
ইভা হাত নেড়ে বললেন, ‘সে কী কথা? এই যে শুনলুম, তুমি নাকি সারাদিন বাগান করবে? তা, ওই তো অতবড়ো বাগান রয়েছে। আমার ঘাড়ের ওপরে তোমার থাকবার কী দরকার?’
ইভার কথা শুনে সুমিত আর অদিতি হি হি করে হাসতে লাগল। অদিতি বলল, ‘বাবা বাগান করবে বলেছে? তা হলেই হয়েছে! বাবা তো বোগেনভেলিয়া আর বাঁধাকপির মধ্যে যে কী তফাত— তা বুঝতেই পারে না।’
ইতিমধ্যে সবাই বাইরের ঘরে এসে ঢুকেছে। সুব্রত একটা আঙুল তুলে ছোটোমেয়েকে কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই ইভা ঘোষণা করলেন, ‘হৈমন্তী, তুই আর অদিতি সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডানদিকের বড়ো ঘরটায় থাকবি। তার পাশের ঘরটায় আমরা থাকব। বাঁ-দিকের ঘরটায় থাকবে সুমিত আর চয়ন। কি চয়ন, সুমিতের সঙ্গে একঘরে থাকতে তোমার কোনো আপত্তি নেই তো?’
চয়ন এতক্ষণ মালপত্র নামিয়ে ফ্যানের নীচে দাঁড়িয়ে হাওয়া খাচ্ছিল। বলল, ‘কী যে বলেন কাকিমা। কোনো মানেই হয় না।’
সুমিত বলল, ‘চয়নদা, এরা আমাদের একঘরে করে দিয়েছে। চলো, আমরা এখান থেকে চলে যাই।’
ইভা বললেন, ‘হ্যাঁ, এখন যে যার ঘরে চলে যাও। স্নান করে নেবে। বাথরুমে কোনো আয়না বা বেসিন নেই। দরজার পাশে কুলুঙ্গি আছে, সেখানে সাবান রাখবে। স্নান করে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়বে সকলে। কলকাতা থেকে অনেকটা পথ আসা হয়েছে। সকলেরই বিশ্রামের দরকার।’
অদিতি বলল, ‘সে হবে অখন। বাবা, আগে বলতো, তুমি এ বাড়িটার নাম বিনানি হাউসই রাখবে না কি, পালটাবে না?’
সুব্রত বললেন, ‘পালটাব বই কী। তোরা একটা নাম ঠিক করে দে।’
এইখানে সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়াটা বোধ হয় যুক্তিযুক্ত হবে।
এই পরিবারের কর্তা হলেন শ্রী সুব্রত রায়। বিরলকেশ, দীর্ঘদেহী, স্বাস্থ্যবান পুরুষ। তাঁর যে ষাট বছর বয়েস হয়েছে, তা দেখলে বোঝা যায় না। আজ থেকে প্রায় সাঁইত্রিশ-আটত্রিশ বছর আগে মুম্বাই (তখন ছিল বম্বে অথবা বোম্বাই) থেকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার দূরে রাইপুরা বলে একটা ছোটো শহরে মহারাষ্ট্র রাবার কেমিক্যাল ওয়ার্কসের ফ্যাক্টরিতে জুনিয়ার কেমিস্ট হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা এমএসসি ডিগ্রি তাঁর সম্বল ছিল। দীর্ঘ এতবছরের কঠিন পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ের পর সেখান থেকেই ‘ভাইস-প্রেসিডেন্ট, টেকনিক্যাল’ পদ থেকে অবসর নিয়েছেন।
পরিবারের কর্ত্রী শ্রীমতী ইভা রায়। ইনি এখন কিঞ্চিৎ মোটা হয়ে পড়েছেন, তবে একসময়ে যে তিনি অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন সেটা বোঝা যায়। তবে এই সৌন্দর্য দর্শকের বুকে জ্বালা ধরানো রূপ নয়; বরং, তা শান্ত, নির্মল আর আনন্দজনক। তাঁর কণ্ঠস্বর আর কথা বলার ধরনটি ভারি মিঠে। যখন কথা বলেন, মনে হয় যেন গান গাইছেন।
হৈমন্তী এঁদের বড়ো মেয়ে। তার প্রায় ছাব্বিশ বছর বয়েস। বম্বে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাশ করে সে এখন পুনায় একটি প্রকাশন সংস্থায় কাজ করছে। তা ছাড়া, সে নানা পত্রপত্রিকায় নানারকম প্রবন্ধও লিখে থাকে। ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমেও বেশ নাম করেছে। সে তার মায়ের মতো সুন্দরী না-হলেও দেখতে বেশ ভালো। দু-টি মৃত সন্তানের পর সে বেঁচে যায়। ফলে, তার বাবা-মার সঙ্গে তার সম্পর্কটা বড়ো অদ্ভুত। ইভা আর সুব্রত তাকে জন্ম থেকে কেমন একটা ভয়মিশ্রিত বিস্ময়ের সঙ্গে দেখে আসছেন। যেন, সে একটা অন্য জগতের মানুষ। তার হাঁটাচলা, কথাবার্তা বা কাজকর্ম— কোনোকিছুই যে সমালোচনার যোগ্য হতে পারে তা তাঁদের কোনোদিনই মনে হয়নি। শাসনের এমন অপর্যাপ্ত অভাব সত্ত্বেও সে কিন্তু বখে যায়নি। হৈমন্তী রাগী বা জেদি হতে পারে কিন্তু অভব্য কখনোই নয়।
সুমিত তেইশ বছরের যুবক। তার বাবার মতোই সে লম্বা-চওড়া আর প্রবল শক্তিশালী। তার একটা বদনাম আছে যে, সে যা ধরে তাই নাকি ভেঙে যায়। তাকে নাকি একবার একটা জানলা বন্ধ করতে বলা হয়েছিল আর তারপরে সমস্ত জানলাটাই দেওয়াল থেকে খুলে বেরিয়ে এসেছিল। বম্বের এমার্সন কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি নিয়ে সে এখন আইআইটি-তে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করছে। শোনা গেছে যে তার না কি একজন গার্লফ্রেন্ড আছে। মেয়েটি গুজরাটি, ছোট্টোখাট্টো গোলগাল শান্তশিষ্ট মেয়ে। সুমিতের দিদি আর ছোটোবোন না কি ওদের কয়েক বার রাস্তায় হেঁটে যেতে দেখেছে। দু-জনেই বলেছে যে তখন তারা এতই ঘনিষ্ঠ ছিল যে, তাদের মাঝখান দিয়ে একটা বড়োসড়ো এরোপ্লেন অনায়াসে উড়ে যেতে পারত। এর কারণ যে দু-জনের শালীনতাবোধ তা অবশ্য দুইবোন মোটেই মানতে রাজি নয়। তাদের বিশ্বাস, কাছাকাছি এলে খুশির চোটে সুমিত যদি হাত ধরে ফেলে, তখন তো হাতটাত ভেঙে একাকার হবে, এমনকী থানা-পুলিশও হয়ে যেতে পারে! সেই ভয়েই না কি এহেন দূরত্ব বজায় রাখা হয়ে থাকে।
অদিতি সকলের ছোটো। তার বয়েস উনিশ। সে বম্বের সেন্ট ক্রিস্টফার কলেজে বিএ পড়ছে। সে এতই চঞ্চল আর ছটফটে যে তার পক্ষে কারোর দৃষ্টিপথে বেশিক্ষণ থাকা সম্ভবই নয়। ফলে, সে যে কীরকম দেখতে তা ভালো করে জানা যায় না। তবে চয়নের মতে, সে হল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরীদের অন্যতম। সেজন্য, চয়ন অদিতির নাম দিয়েছে ‘সুন্দরী উচ্চিংড়ি’। অদিতির প্রতি চয়নের পক্ষপাতিত্ব বাদ দিলেও বলা যায় যে নামটা অসার্থক হয়নি। সে ভালো গান গায় আবার কলেজের হকি আর টেনিস টিমে খেলে থাকে।
চয়ন, যার ভালোনাম অভিরূপ, সুব্রতর কর্মজীবনের শুরু থেকে তাঁর সহকর্মী আর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ড. বিভাস বোসের বড়ো ছেলে। সে হৈমন্তীর বাল্যবন্ধু। ডাক্তারি পাশ করে বিলেত যাবার আগে হৈমন্তীকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়, হৈমন্তী স্বীকার করে। তিন বছর বাদে নামের পেছনে নানা উপাধির একটা লম্বা ল্যাজ জুড়ে সম্প্রতি দেশে ফিরেছে। আশা করা যাচ্ছে যে, আর কিছুদিনের মধ্যেই বিয়েটা হয়ে যাবে। চয়ন যে খুব একটা সুপুরুষ তা বলা যায় না। তবে, তার মধ্যে এমন একটা বুদ্ধিদীপ্ত, মার্জিত, সভ্য ব্যক্তিত্ব আছে যাতে আকৃষ্ট না-হয়ে পারা যায় না।
রাত্রের খাওয়া শেষ করে চয়ন, সুমিত আর অদিতি দোতলায় চলে গেল। অবশ্য, তাদের ঘুমোতে যাবার বিন্দুমাত্র বাসনা আছে, তা মনে হল না। এখন অনেক রাত অবধি তাদের আড্ডা চলবে।
বসবার ঘরে সিগারেট ধরিয়ে সুব্রত একটা সোফায় খবরের কাগজ খুলে বসলেন। অন্য একটা সোফায় ইভা একটি বাংলা পত্রিকায় মনোনিবেশ করলেন।
হৈমন্তী কিন্তু ওপরে গেল না। চিন্তিত মুখে ঘরের ভেতরে ঘুরঘুর করতে লাগল। সুব্রত চশমার ওপর দিয়ে কিছুক্ষণ হৈমন্তীকে লক্ষ করে গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘ম্যাডাম, আপনার কিছু বক্তব্য আছে বলে মনে হচ্ছে।’
হৈমন্তী বলল, ‘আছে। বক্তব্য নয়, কিছু প্রশ্ন করবার আছে।’
‘সেগুলি কি এখনই করা প্রয়োজন?’
‘হ্যাঁ, এখনই। সারাদিন তো তোমাদের একা পাওয়া যায় না। ওপরের ওই আমজনতার ভিড়ে কোনো কথাই ভালো করে বলাও যায় না। প্রশ্ন করা আর উত্তর পাওয়া তো অসম্ভব।’
‘ভালো। তাহলে প্রশ্নটা করেই ফেল।’
হৈমন্তী তার বাবার সামনে এসে জিনসের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বেশ একটা ‘যুদ্ধং দেহি’ ভঙ্গিতে দাঁড়াল। বলল, ‘প্রশ্নটা নয়, অনেকগুলো প্রশ্ন।’
সন্ত্রস্ত মুখে সুব্রত বললেন, ‘সর্বনাশ করেছে! অনেকগুলো প্রশ্ন নাকি? শুরু করে দে।’
হৈমন্তী একটা চেয়ার টেনে এনে বসল। বলল, ‘হ্যাঁ, শোনো বাবা। আমার প্রথম প্রশ্ন, তোমার এই কমলপুরের এই বাড়িটা কেনার সত্যিকারের কারণটা কী?’
‘কারণটা অতি পরিষ্কার। কলকাতার ধুলোধোঁয়ার ভেতরে একটা ফ্ল্যাট বাড়িতে একগাদা লোকের সঙ্গে গুঁতোগুঁতি করে না-থেকে, বেশ মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে বিশুদ্ধ বায়ু সেবন করতে করতে আর নিজের বাগানের ফুলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে জীবনের বাকি ক-টা দিন কাটিয়ে দেব— এই ইচ্ছেটাই সত্যিকারের কারণ। জানিস, কোনো এক বিখ্যাত কবি বলেছিলেন, যদি একটা পয়সা পাস তো খাবার কিনে খাবি আর যদি দুটো পয়সা পেয়ে যাস তো ফুল কিনে শুঁকবি।’
হৈমন্তী সুব্রতর রসিকতায় কিছুমাত্র বিচলিত না-হয়ে বলল, ‘এটা একটা কারণ হতে পারে ঠিকই; তবে এর বাইরেও কিছু আছে যার গুরুত্ব কিছু কম নয়। অথচ, সে কথা তুমি আমাদের বলছ না। কেন?’
‘আমি যা বললুম তার বাইরেও যে কিছু আছে আর আমি তা চেপে যাচ্ছি, তোর এরকম সন্দেহের কারণ?’
‘তার কারণ, আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি যে কমলপুর তোমাদের অচেনা জায়গা নয়। তোমরা এখানে আগে এসেছ এবং এই বাড়িতে থেকেছ। তোমরা সে-কথাটা গোপন করতে চাইছ কেন?’ হৈমন্তীর কথা শুনে ইভা ম্যাগাজিনটা বন্ধ করে বললেন, ‘সে তো ঠিকই। তোর বাবা এ বাড়ি কেনবার আগে এখানে বেশ কয়েক বার এসেছে, এই বাড়িতেও এসেছে। কাজেই এ জায়গাটা ওর কাছে মোটেই অপরিচিত নয়। এতে আশ্চর্য হবার কী আছে?’
‘ঠিক কথা। তবে, তুমি তো আসনি। তাহলে, এ বাড়ির আনাচেকানাচে কী আছে— সেটা তুমি জানলে কী করে? বাবা হয়তো তোমাকে এ বাড়ির প্ল্যান দেখিয়ে কোথায় কী ঘর আছে তা বুঝিয়েছিল। কিন্তু যে বাথরুমে তুমি এর আগে কখনো ঢোকনি, তার দরজার পেছনে যে কুলুঙ্গি নামক একটা ব্যাপার আছে যার ভেতরে সাবান-টাবান রাখা যায়, তা তুমি জানলে কী করে? প্ল্যানে তো সেসব ডিটেল দেখানো থাকে না।’
ইভা ব্যাকুল চোখে সুব্রতর দিকে তাকালেন। সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে ফেলে সুব্রত বললেন, ‘ওটা কোনো একটা ব্যাপারই নয়। বাংলাদেশের মফসসলে সব বাড়িতেই অমন থাকে। তা ছাড়া, তোর মায়ের যে একটা তৃতীয় নেত্র আছে সে তো তোরা নিশ্চয়ই এত দিনে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিস। দেখিসনি, কোনো কিছু ওর কাছ থেকে গোপন করবার উপায় নেই? ঠিক ক্যাঁক করে ধরে ফেলবে।’
‘এটা তৃতীয় নেত্রের ব্যাপার নয় বাবা। আমার কি মনে হচ্ছে জানো? তোমরা যে বলে থাকো যে তোমাদের অতীত বলে কিছু নেই, সেই অতীতটা লুকিয়ে আছে এই কমলপুরে। তুমি বলে থাকো যে সাতবছর বয়েসে, পূর্ববঙ্গের দাঙ্গায় আত্মীয়দের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, ভাসতে ভাসতে তুমি এদেশে এসেছিলে আর বড়ো হয়েছ একটা অনাথ আশ্রমে। সেখান থেকেই লেখাপড়া শিখেছ। আর, মা-ও বড়ো হয়েছে সেই অনাথ আশ্রমেই মেয়েদের বিভাগে। আশ্রম কর্তৃপক্ষ তোমাদের বিয়ে দেন আর তার ঠিক পরেই আশ্রমটা উঠে যায়। আমার কোনোদিন এই ইতিহাসটা সর্বাংশে সত্যি বলে মনে হয়নি। যেকোনো কারণেই হোক, তোমরা তোমাদের বিয়ের আগের জীবনটাকে মুছে ফেলতে চেয়েছিলে বা সকলের কাছ থেকে গোপন রাখতে চেয়েছিলে। কেন?’
সুব্রত হাঁ করে মেয়ের কথা শুনছিলেন। তিনি কিছু বলে ওঠার আগেই হৈমন্তী বলল, ‘দ্যাখো বাবা, তোমরা এমন কোনো অন্যায় বা অপরাধ করতে পারো, যার থেকে তোমাদের লুকিয়ে বেড়াতে হবে, তা আমি মরে গেলেও বিশ্বাস করতে পারব না। কিন্তু, একটা রহস্য কোথাও রয়েছে— সেটাই আমি জানতে চাই। সেটা জানলে, তোমাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা বা ভালোবাসায় কোনো ঘাটতি পড়বে তাও আমি বিশ্বাস করি না। তা ছাড়া আরও কয়েকটা ব্যাপার আছে। আমাদের ভাইবোনদের সাতবছর বয়েস থেকেই হোস্টেলে দিয়েছিলে। আমাদের কলোনি থেকে রোজ সকালে বম্বে যাবার বাস ছাড়ত। আমাদের বন্ধুরা সবাই সেই বাসে স্কুল-কলেজে যেত আর আসত; শুধু আমরা ছাড়া। তুমি বলতে, রোজ অত ভোরে ওঠা আর রাত করে বাড়ি ফেরা আমরা সহ্য করতে পারব না যদিও আমরা কেউই রোগা দুবলা ছিলুম না। তোমার ”হোস্টেলে না থাকলে ডিসিপ্লিন শেখা যায় না” যুক্তিটাও অদ্ভুত কারণ ছুটির সময় আমরা যখন তোমাদের কাছে থাকতুম, তখন আমাদের ডিসিপ্লিন শেখাবার কিছুমাত্র চেষ্টা তোমার বা মায়ের মধ্যে কোনোদিন দেখিনি। আদর দিয়ে মাথা খেতে আমাদের। তা ছাড়া দরজায় বেল বাজলে আমাদের খুলতে দিতে না। নিজেরা দৌড়ে গিয়ে খুলে দিতে। কেন? তোমরা কি তাহলে কারোর কাছ থেকে আমাদের আড়াল করে রাখতে চাইছিলে?’
হৈমন্তী দম নেবার জন্য থামতেই, সুব্রত উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘এইসব প্রশ্নের কোনো মানেই হয় না। রহস্য-টহস্য কোথাও কিচ্ছু নেই! সব তোর উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা। অতিরিক্ত ডিটেকটিভ গল্পের বই আর থ্রিলার পড়ে পড়ে তোর মাথাটা একদম গেছে। তার ওপরে ইদানীং তো আবার ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নিয়ে পড়েছিস। সব ব্যাপারেই অনাবশ্যক কৌতূহল। এই কৌতূহলের জন্য বেড়ালের কী দশা হয়েছিল, তা তো জানিস। কাজেই এইসব হিজিবিজি প্রশ্ন মাথা থেকে একেবারে বের করে দে।’
‘না বাবা। তুমি যাই বলো না কেন— এসব মোটেই হিজিবিজি প্রশ্ন নয়। আমি তোমাকে বলছি, এখান থেকে যাবার আগে এই কমলপুরের রহস্য ভেদ করে তবে আমি যাব।’
‘দশদিনের জন্য এসেছিস। খাবি দাবি, ফূর্তি করবি, ঘুরে বেড়াবি। কেন খামখা সুস্থ শরীরকে ব্যস্ত করবি বলতো? আসলে, ব্যাপারটা আমি বুঝেছি। এই কমলপুর জায়গাটা তোর ভালো লাগছে না, বিরক্তিকর রকমের বোরিং লাগছে। তাই একটা উত্তেজনার খোঁজে লেগে পড়েছিস। এটা নিতান্তই পণ্ডশ্রম হচ্ছে। আমি তো বললুম, এখানে কোনো রহস্য নেই। একটা অন্ধকার ঘরে, কালো চশমা চোখে দিয়ে, একটা অনুপস্থিত কালো বেড়াল খুঁজে বের করবার চেষ্টা করে কেন সময় নষ্ট করবি? তার চেয়ে জায়গাটা ঘুরে দেখ। পুরোনো জায়গা, অনেক ইন্টারেস্টিং জিনিস আবিষ্কার করে ফেলবি। যখন ফিরে যাবি, তখন এই কমলপুরের জন্যেই মন খারাপ করবে, দেখে নিস। এখন যা, গিয়ে শুয়ে পড়।’
হৈমন্তীও উঠে দাঁড়িয়েছিল। বলল, ‘তা যাচ্ছি। এই আলোচনাটা কিন্তু শেষ হল না।’
পরেরদিন সকাল বেলা খাওয়ার পরে হৈমন্তী ঘোষণা করল, ‘আমরা এখন বেরচ্ছি।’
ইভা বললেন, ‘এই সাতসকালে কোথায় চললি তোরা?’
‘বাঃ, শহরটা একটু ঘুরে দেখতে হবে না? স্টেশনের দিকেও একবার যাব।’
‘গাড়িটা নিয়ে যা।’
‘না, গাড়ি নিয়ে গেলে কিছুই দেখা হবে না। আমরা হেঁটে হেঁটে যতটা পারি ঘুরে আসব।’
‘বারোটার মধ্যে ফিরবি কিন্তু। একটা-দেড়টার মধ্যে খাওয়ার পাট চুকিয়ে দিতে হবে। রেখা দুটোর সময় ছুটি চেয়েছে।’
‘সে আবার কী? কাজে ঢুকতে-না-ঢুকতেই ছুটি?’
‘সে ঠিক আছে। ও বাড়ি যাবে, জামাকাপড় আর অন্যান্য দরকারি জিনিসপত্র আনবে।’
এই কথার মধ্যে ধুতিশার্ট পরা মাঝবয়েসি রোগামতন একজন ভদ্রলোক এসে উপস্থিত হলেন। বাগান পেরিয়ে বারান্দায় উঠতে উঠতে বললেন, ‘সুব্রতবাবু আছেন না কি? রেখা এসেছে তো? ঘনশ্যাম কিন্তু আজ দুপুর বেলা আসবে।’
সুব্রত ভদ্রলোকের গলা পেয়ে বললেন, ‘ভেতরে আসুন লক্ষ্মণবাবু। হ্যাঁ, রেখা এসেছে; আমরা আসার আগেই ঘরদোর পরিষ্কার করে রেখেছে।’
লক্ষ্মণ ঘরে ঢুকে সুব্রত আর ইভাকে নমস্কার করলেন। সুব্রত সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ইনি লক্ষ্মণ দাস। ইনিই আমাকে বাড়িটা কিনিয়ে দিয়েছেন।’
লক্ষ্মণ একটা চেয়ার টেনে খাবার টেবিলেই বসে গেলেন। বললেন, ‘কাল শরীরটা গোলমাল করছিল, তাই আসতে পারিনি। তবে, তার জন্যে আশা করি কোনো অসুবিধে হয়নি। রেখা খুব চটপটে আর বুদ্ধিমতী মেয়ে।’
সুব্রত বললেন, ‘না না, কোনো অসুবিধে হয়নি। আপনি তো সব ব্যবস্থাই করে রেখেছিলেন।’
লক্ষ্মণ চশমা খুলে ধুতির খুঁটে কাচ মুছতে মুচতে বললেন, ‘যাক, এবার খুশি তো? যে বাড়ি চেয়েছিলেন, সেটাই পেয়ে গেলেন। জানেন বউদি, দাদাকে কত হালফ্যাশানের ভালো ভালো বাড়ি দেখালুম, কোনোটাই পছন্দ হল না। ওঁর শুধু এটাই পছন্দ— এটাই চাই। বিষ্ণু বিনানি তো প্রথমে কিছুতেই বিক্রি করতে রাজি হচ্ছিল না। কিন্তু এই লক্ষ্মণ দাসের সঙ্গে পারবে কেন? অনেক ভজানোর পর রাজি হল বটে কিন্তু মওকা বুঝে যে দর হাঁকল, সে আর কহতব্য নয়। দাদা কিন্তু তাতেই রাজি হয়ে গেলেন। একটা দরদাম পর্যন্ত করলেন না। তা, দাম যাই হোক-না কেন, বাড়ি পছন্দ হওয়াই হলগে আসল কথা। না কি বলেন, বউদি?’
ইভা বললেন, ‘হ্যাঁ, সে তো খুব সত্যি কথা। নিন, এককাপ চা খান।’
বিনয়ে বিগলিত হয়ে লক্ষ্মণ চায়ের কাপটা টেনে নিলেন। চেয়ারের ওপর একটা পা তুলে, সশব্দে একটা চুমুক দিয়ে ছেলেমেয়েদের সম্বোধন করে বললেন, ‘তোমাদের বাড়িটা পছন্দ হয়েছে তো? একটু পুরোনো স্টাইলের বাড়ি, হ্যালফ্যাশানের তো নয়। কিন্তু খুব শক্তপোক্ত।’
হৈমন্তী এতক্ষণ তীক্ষ্নদৃষ্টিতে লক্ষ্মণকে দেখছিল। বলল, ‘হ্যাঁ, বাড়ি পছন্দ হয়েছে। আচ্ছা লক্ষ্মণবাবু, আমরা এখন শহরটা দেখতে বেরব। কী কী দেখব বলুন তো?’
প্রশ্নটা শুনে লক্ষ্মণ বেশ কিছুক্ষণ হেঁ হেঁ করে হাসলেন। তারপর, আর একটা সশব্দ চুমুকের পর বললেন, ‘কী কী দেখবে? এ জায়গাটা কিন্তু আগ্রাও নয়, পুরীও নয়। এখানে না-আছে তাজমহল, না-আছে সমুদ্র, না-আছে কিছু। লোক ডেকে বলবার মতো কিছুই নেই। তবে হ্যাঁ, এখানে দুটো ইশকুল আছে, বামাপদ সিংহ স্মৃতি বয়েজ হাইস্কুল আর কৃষ্ণভামিনী দাসী স্মৃতি গার্লস হাইস্কুল— সে দুটো দেখে আসতে পারো। দুটোই এক-শো বছরের বেশি পুরোনো আর তাদের বাড়ি দুটো সত্যিই দেখবার মতো। একেবারে ইংলিশ স্টাইল। এ ছাড়া, স্টেশনের কাছে বটতলা পাড়ায় বিশালাক্ষীর মন্দির আছে। সেটা যে কত পুরোনো তা কেউ জানে না। সেটাও দেখে আসতে পারো। বেশ কয়েক-শো বছর ধরে সেখানে দেবীর পুজো হয়ে আসছে।’
‘শহরটা তাহলে বেশ প্রাচীন, বলুন?’
‘তা তো বটেই। এক-শো দেড়-শো বছরের পুরোনো বাড়ি বেশ কয়েকটা আছে। কিন্তু পোড়ো ভিটে আছে যেগুলো; আরও পুরোনো। আমি শুনেছি, চৈতন্যচরিতামৃততে না কি এই কমলপুরের কথা বলা আছে। আমি অবশ্য পড়িনি, তবে ভালো ভালো লোকের মুখে শুনেছি। এই কাছেই একটা নদী আছে। আজ অবিশ্যি তার অবস্থা গেয়ে বেড়াবার মতো নেই আর। কিন্তু, বহুদিন আগে না কি এখান দিয়ে সওদাগরদের পালতোলা জাহাজ যেত সমুদ্রে। তখন থেকেই না কি কমলপুর একটা বড়ো গঞ্জ বা ব্যাবসার জায়গা।’
‘বলেন কী?’
‘হ্যাঁ, সেরকমই তো শুনেছি। তা, এই বাড়িটাই ধরো না। কোন না পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ বছরের হবে। এরকম একটা বাড়ি কি কেউ একেবারে জনবসতিহীন জায়গায় মধ্যে বানাবে? তাওতো এই চ্যাটার্জি পাড়াটা এখনও ফাঁকা ফাঁকা আছে, রেললাইনের ওপারে যাও না, দেখবে কী ঘিঞ্জি বাড়িঘর। সরু সরু গলির মধ্যে দু-মিনিটে রাস্তা হারিয়ে ফেলবে।’
‘আচ্ছা, এই বাড়িটা কি বিনানিদের তৈরি?’
‘না, না। বিনানিরা তো মাত্র দু-বছর হল কিনেছিল।’
‘ওদের আগে কে ছিলেন?’
‘ওদের আগে ছিল শঙ্কর আগরওয়াল। সেও বেশিদিন থাকেনি। তার আগে ছিলেন পরিতোষ ভট্টাচার্য। সেলস ট্যাক্সে চাকরি করতেন। কলকাতায় গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে মারা যান।’
‘তার আগে?’
‘তার আগে আর জানি না।’
‘কে এই বাড়িটা তৈরি করেছিলেন?’
‘তাও জানি না। আমি তো বাড়ি কেনা-বেচার ব্যাবসাটা শুরু করেছি বছর দশেক হল। নাইন্টিন নাইন্টি থেকে। তার আগের খবর আমার জানা নেই।’
‘বেশ। পরিতোষ ভট্টাচার্যের ছেলেমেয়েরা কোথায় থাকেন, আপনি জানেন?’
লক্ষ্মণ মাথা নেড়ে বললেন, ‘না ভাই, জানি না। ওঁর একটাই ছেলে ছিল। কলকাতায় চাকরি করত। বাবা মারা গেলে বাড়ি বেচে কোথায় চলে গেছে, কে জানে। আচ্ছা, এবার তুমি বলোতো, এত প্রশ্ন করছো কেন? তোমার কি ধারণা যে আমি তোমার বাবাকে একটা বেনামি সম্পত্তি কিনিয়ে দিয়েছি?’
প্রবলবেগে মাথা নেড়ে হৈমন্তী বলল, ‘না না, ছি ছি! আমি সেরকম কোনো সন্দেহ করছি না। নিছক কৌতূহল বলতে পারেন। আসলে, আমি ভাবছিলুম যে, এ বাড়িতে ভূত-টুত কিছু আছে কি না। তাই পুরোনো বাড়ির ইতিহাসটা জানতে চাইছিলুম। বাবা-মা একা থাকবেন তো। ভয়-টয় না-পান।’
খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে হাসতে লক্ষ্মণ বললেন, ‘দূর পাগল। এ বাড়িতে ভূত থাকলে আমি তা কখনো দাদাকে কিনিয়ে দিতে পারি। উনি আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি।’
‘তা তো বটেই। আচ্ছা, আপনি যে নদীটার কথা বললেন, সেটা এখান থেকে কতদূর?’
‘খুব কাছে। তোমাদের বাড়ির চৌহদ্দির পূর্বদিকে একটা আমবাগান আছে। সেটাও কিন্তু দাদার প্রপার্টি এখন; ঠিক তার পরেই। এখান থেকে পাঁচমিনিটের হাঁটাপথ। আগে বোধ হয় নদীটার নাম ছিল চন্দ্রা। আমরা বলি চাঁদা নদী। একটা চওড়া ঘাট আছে। লোকে বলে চ্যাটার্জি পাড়ার ঘাট। আগে ওখানে আশেপাশের গ্রামগঞ্জ থেকে নৌকো-টৌকো আসত। এখন আর বড়ো আসে না। জায়গাটার বেশ শান্ত সুন্দর পরিবেশ। ওখানে ঘাটে বসে থাকলে মন প্রফুল্ল হয়। তোমরা এখন নদীর ধারে বেড়িয়ে এসো না।’
‘যাব, তবে এখন না। আমরা প্রথমে যাব স্টেশনে।’
বাড়ির সামনে দিয়ে যে রাস্তাটা এঁকেবেঁকে চলে গেছে সেটাই স্টেশনে যাবার পথ। মাঝে মাঝে পাড়ার বাড়িঘর, পুকুর, বাগান, ফাঁকা জমি বা খেলার মাঠ। রাস্তাটা পাকা ঠিকই, কিন্তু ধুলোয় ভরতি।
হাঁটতে হাঁটতে চয়ন জিজ্ঞাসা করল, ‘স্টেশনে কেন? মানে, স্টেশনেই কেন?’
হৈমন্তী বলল, ‘স্টেশনের সঙ্গে লাগোয়া একটা বাজার থাকেই যেখানে সবকিছু পাওয়া যায়। ওখানে দেখতে হবে, সাইকেল ভাড়া পাওয়া যায় কি না বা কোথায় পাওয়া যায়— তার সন্ধান মেলে কি না। তারপর, চারটে সাইকেল ভাড়া করে আমরা হইচই করে ঘুরতে শুরু করব।’
‘বাঃ, তোর ঘটে যে বুদ্ধি আছে, সে কথা স্বীকার না-করে উপায় নেই।’
‘তোকে বিয়ে করতে রাজি হওয়ায় এ ব্যাপারে তোর সন্দেহ হওয়াই স্বাভাবিক।’
অদিতি বলল, ‘কিন্তু দিদি, এই মফসসল শহরে যদি লেডিস সাইকেল পাওয়া না-যায়, তাহলে? তুই তো সালোয়ার কুর্তা পরে আছিস, তুই জেন্টস সাইকেল চালাতে পারবি। আমি তো এই লম্বা স্কার্ট পরে তা পারব না।’
চয়ন বলল, ‘নো প্রবেলেম। তুই আমার সাইকেলের রডে বসে যাবি। তোর উড়ন্ত চুলের গুচ্ছ এসে আমার নাকে-মুখে লাগবে। আমি তার সুগন্ধ শুঁকতে শুঁকতে আর হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ্চো করে হাঁচতে হাঁচতে বন বন করে চালিয়ে যাব।’
‘মোটেই না। তুমি আমার ঘাড়ের ওপর হাঁচতে হাঁচতে সাইকেল চালাবে, সেটা আমার একদম সহ্য হবে না।’
‘কেন? হবে না কেন? তুই তোর যে সব বয়ফ্রেন্ডদের মুণ্ডু চিবোচ্ছিস, তারা হাঁচতে হাঁচতে চালালে তো আপত্তি করতি না, চাঁদু?’
‘করতুম না-ই তো? আমি তো তোমার মুণ্ডু চিবোচ্ছি না। তোমার কেস একেবারে আলাদা।’
স্টেশন পর্যন্ত যেতে হল না। তার আগেই, বাজারের মুখে একটা সাইকেল দোকান পাওয়া গেল। লেডিস সাইকেলও পাওয়া গেল। তবে, একটা।
দোকানদারটি মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক, ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ। সবুজ রঙের ট্রাউজার্স আর হলুদ রঙের টি-শার্ট পরে শোভা পাচ্ছিলেন। দন্তবিকাশ করে বললেন, ‘ছাত্র ধর্মঘটের জন্যে আজ ইশকুল-কলেজ সব বন্ধ, তাই পেলেন। নইলে, এইসময় আমার ভাড়ার সাইকেলগুলো সব বেরিয়ে যায়। ওই চারটে নিয়ে যান, ভাড়ার টাকাটা কিন্তু অগ্রিম দিতে হবে।’
বলে চারটে প্রায় প্রাগৈতিহাসিক ঝড়ঝড়ে সাইকেল দেখিয়ে দিলেন।
চয়ন সন্দিগ্ধ হয়ে প্রশ্ন করল, ‘এদের ব্রেক কাজ করে তো?’
‘করে না মানে? আলবাত করে! হালদার সাইকেল মার্টের কোনো সাইকেলের আজ পর্যন্ত ব্রেক ফেল করেনি, বুঝলেন? তা, আপনারা তো বিনানিবাবুর বাড়িতে এসেছেন, তাই না? ঠিকই ধরেছি। লক্ষ্মণবাবুর কাছে শুনলুম সব কথা।’
হৈমন্তী বলল, ‘কী সব কথা?’
‘না, মানে, বোম্বাই-এর এক বাঙালি ভদ্রলোক প্রায় দেড়া দামে বাড়িটা কিনে নিয়েছেন। দরদাম করলে অনেক কমেই পেয়ে যেতেন। ঠিকই করেছেন। পছন্দটাই হল গে আসল কথা। টাকা তো আজ আছে, কাল নেই। বলে না, নলিনীদলমপি—’
হৈমন্তী বাধা দিয়ে বলল, ‘ওই বাড়িতে পরিতোষ ভট্টাচার্য বলে এক ভদ্রলোক থাকতেন এক সময়। তার আগে কে থাকতেন, আপনি জানেন?’
হালদারবাবু বাধা পাওয়ায় একটু ক্ষুণ্ণ হলেন। বললেন, ‘না, আমি সঠিক জানি না। বছর বারো আগে আমি যখন এই দোকান খুলি, তখন ওখানে বিধানবাবু থাকতেন। বিধান চন্দ্র বিশ্বাস। রেলে চাকরি করতেন। সে সময় এখান থেকে আপনাদের বাড়িটা দেখা যেত। আজ আর যায় না। দেখুন না, মাঝখানে কত বাড়ি উঠে গেছে। এত লোক বেড়ে যাচ্ছে— ঘিঞ্জি হয়ে যাচ্ছে শহরটা।’
হৈমন্তী বলল, ‘এই বিধান চন্দ্র বিশ্বাস এখন কোথায় থাকেন?’
‘জানি না। ওঁর ছেলে মাদ্রাজ না পাঞ্জাব কোথায় চাকরি করত। শুনেছি, তার কাছেই চলে গিয়েছিলেন। এখানে থাকতে থাকতেই ওঁর স্ত্রী মারা যান। তারপরে কেমন একটু উদাসীন মতন হয়ে পড়েছিলেন। তখন ছেলে এসে নিয়ে যায়। এইরকমই তো জীবন। বুঝলেন না, সংসারানলোদগ্ধোমি…’
হালদারবাবুর বক্তৃতার মধ্যেই তাঁকে নমস্কার করে সবাই দোকান থেকে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে এল।
চয়ন বলল, ‘সাইকেল তো হল। এরপর কী? এবার কোথায় যাব আমরা?’
হৈমন্তী বলল, ‘স্টেশনে। স্টেশনমাস্টারের সঙ্গে দেখা করব।’
‘বিধান বিশ্বাসের ঠিকানার জন্যে কি?’
‘হ্যাঁ।’
‘ব্যাপারটা কী বলতো? তুই এরকম হন্যে হয়ে তোদের বাড়িটার ইতিহাস খুঁজছিস কেন? ভূতের কথাটা যে লক্ষ্মণবাবুকে বললি, সেটা অবশ্যই বাজে কথা।’
‘ব্যাপারট্যাপার কিছু নয়। এমনিই। নেই কাজ তো খই ভাজ।’
‘উঁহু, অকারণে খই ভাজার পাত্রী তুই নোস। সে যাই হোক, বাড়িটার ইতিহাস যদি চাস তো কাকাবাবুকে বলে বাড়ির দলিলটা দেখলেই সব পেয়ে যাবি। ওখানে সব লেখা থাকে।’
‘না, বাবাকে বলে লাভ নেই। দেবে না। আসলে আমি জানতে চাই, তৈরি হবার পর থেকে কারা কারা ওই বাড়িতে থেকেছেন। মালিকই হোক বা ভাড়াটেই হোক, থাকাটাই জরুরি।’
‘তাহলে, একটা কাজ করা যাক। স্টেশনে না-গিয়ে, চল কোর্টে যাই। সেখানে গিয়ে একটা উকিল ধরে সার্চ করলে অন্তত মালিকদের সন্ধান পাওয়া যাবে।’
‘ঠিক বলেছিস। তাহলে চল, কোর্টেই যাই।’
কোর্টের বাড়িটা লালরঙের লম্বা একতলা দালান। সামনে টানা বারান্দা। সেখানে কালো কোটপরা দু-জন ছোকরা অ্যাডভোকেট দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলেন। কোর্ট শুরু হতে তখনও দেরি আছে, সেজন্য লোকজনের ভিড় শুরু হয়নি।
চারজন সাইকেল থেকে নেমে দুই উকিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সার্চের কথা শুনে একজন বললেন, ‘চ্যাটার্জি পাড়ার বাড়িটা, যেটাতে বিনানি থাকত? তার তো এই কিছুদিন আগেই সার্চ হল। রমাপদ করেছিল। আবার সার্চ? এর মধ্যেই আবার বিক্রি হবে? কে কিনবে? আপনারা?’
হৈমন্তী বলল, ‘দেখুন, কেনবার জন্য নয়। আমরা জানতে চাই, ওই বাড়িটার মালিক কারা কারা ছিলেন। কিংবা, তার চেয়েও বড়ো কথা, কারা ওই বাড়িটাতে থেকেছেন।’
বক্তা উকিলবাবুটি অত্যন্ত সন্দিগ্ধভাবে জিজ্ঞাস করলেন, ‘ব্যাপারটা কী বলুন তো? আপনারা কারা?’
‘আমরা, এখন যিনি বাড়িটা কিনেছেন, তাঁর ছেলে-মেয়ে। আমরা এটা জানতে চাই। কারণ, কাল রাত্রে আমাদের বাড়িতে কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটে, যার সহজ বুদ্ধিতে কোনো ব্যাখ্যা করা যায় না। কাজেই আমরা জানতে চাই, ও বাড়িতে কোনো অপঘাত মৃত্যু বা ওই ধরনের কিছু ঘটনা আগে ঘটেছে কি না। বাবাকে এসব কথা বলে কোনো লাভ নেই। তিনি অলৌকিক কোনো কিছুতেই বিশ্বাস করেন না।’
হৈমন্তীর কথা শুনে দুই উকিলবাবুরই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। বক্তা বললেন, ‘বলেন কী! ভূত?’
‘জানি না; আর সেটাই তো জানতে চাই।’
‘দেখুন, এসব কথা জানতে হলে, আমার মনে হয়, আপনাদের মনোরঞ্জনবাবুর সঙ্গে কথা বলাটাই সবচেয়ে ভালো হবে। মনোরঞ্জন দত্ত আমাদের এখানে সিনিয়র মোস্ট অ্যাডভোকেট। সত্তরের কাছাকাছি বয়েস। কিন্তু মাথা একেবারে সাফ আর অসম্ভব ভালো স্মৃতিশক্তি। কুড়ি বছর আগেকার মামলার যাবতীয় ডিটেল গড়গড় করে বলে দিতে পারেন। এ শহরের প্রায় সকলকেই চেনেন, জানেন।
‘বাঃ, সে তো খুব ভালো কথা। তাঁর সঙ্গে কোথায় দেখা করা যাবে?’
উকিলবাবু বললেন, ‘অত্যন্ত ব্যস্ত লোক। এমনি গিয়ে তো দেখা করতে পারবেন না। তাঁর কাছেই যেতে পারবেন না। আপনারা ওঁর মুহুরি সুকুমারবাবুর সঙ্গে দেখা করে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে নিন। তিনি প্রথমে ঘটনার গুরুত্ব বুঝে নিয়ে তারপরে একটা ডেট দেবেন।’
‘তাঁকে কোথায় পাব?’
‘ওইদিকে তিননম্বর ঘরটা বার লাইব্রেরি। তার বাইরে মুহুরিরা টেবিল পেতে বসেন। ওখানে সুকুমার নস্করের খোঁজ করবেন, সবাই দেখিয়ে দেবে। একটু অপেক্ষা করুন, উনি এখনই এসে পড়বেন।’
চারজন কোর্ট চত্বরে একটা বিশাল বটগাছের নীচে বাঁধানো বেদির ওপরে গিয়ে বসল। তখন লোকজন আসতে শুরু করেছে। ভিড় বাড়ছে।
একটি বাচ্চাছেলে কেটলি করে ভাঁড়ের চা বিক্রি করছিল। তার কাছ থেকেই চারটে চা কিনল চয়ন।
চা খেতে খেতে অদিতি বলল, ‘কাল রাত্রে কী হয়েছিল রে দিদি? আমি তো কিছুই টের পায়নি।’
হৈমন্তী বলল, ‘কিচ্ছু হয়নি। আমাকে একটা গল্প বানিয়ে বলতে হল।’
‘কেন? কী করবি তুই আমাদের বাড়িতে কারা থেকেছে, সে খবর নিয়ে?’
‘কারণ আছে। বেশ, তোদের বলি শোন। আমার কি মনে হয় জানিস? বাবা যে এখানে বাড়িটা কিনেছে, তার কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। সেটা যে কী আমি তা জানতে চাই।’
সুমিত বলল, ‘বাবাকে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করলেই হয়। এমন লুকিয়ে চুরিয়ে মিথ্যে গল্প বলে কোনো কাজ করা কি ঠিক হচ্ছে? বিশেষ করে বাবার ব্যাপারে? বাবা জানতে পারলে কী ভাববে বলতো? দুঃখ পাবে না?’
‘আমি যা করছি, সেটা বাবাকে না জানিয়ে করছি না। কাল রাত্রে তোরা ওপরে গেলে আমি বাবাকে খোলাখুলি প্রশ্ন করেছিলুম। বাবা এড়িয়ে গেল— জবাব দিল না। আমি তখন চ্যালেঞ্জ রেখেছি যে, যে ক-দিন এখানে আছি, তার মধ্যেই এই রহস্যের সমাধান আমি করবই।’
‘কী রহস্য যে তুই দেখছিস, তা তুইই জানিস! আমি তো কোনো রহস্যের কোনো গন্ধই পাচ্ছি না।’
হৈমন্তী সুমিতের নাকটা মুলে দিয়ে বলল, ‘তোর যা বোঁচা নাক, গন্ধ পাবি কোত্থেকে?’
চয়ন বলল, ‘ঠাট্টা নয়, হৈমন্তী। কাকাবাবুর মতো একজন খোলামেলা মানুষের কোনো রহস্য থাকতে পারে, তা তো আমি ভাবতেই পারি না। ব্যাপারটা কী আমাদের খুলে বলবি?’
হৈমন্তী মাথা নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ, বলব। যদিও বুঝতে পারছি না যে তোকে এসব কথা বলা ঠিক হচ্ছে কি না। হয়তো এটা আমাদের পরিবারের কোনো গোপন কথা, যা বাইরের লোকের জানা উচিত নয়। তবে, এটাও ঠিক যে পরে যদি এটা প্রকাশ পায় আর অন্য কারোর কাছ থেকে তুই এটা জানতে পারিস, তাহলে আমাদের মধ্যে একটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে।’
‘ভনিতা ছেড়ে আসল কথাটা বল।’
‘আমার কি মনে হয় জানিস? বাবা যে এখানে এসেছে সেটা আমাদের বিয়ের আগেই একটা কিছু ফয়সালা করে ফেলবার জন্য, যাতে পরে এ নিয়ে কেউ বলতে না-পারে যে কথাটা চেপে গিয়ে আপনি মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন।’
‘তুই কী ভাবছিস তা নিশ্চিন্তে আমাকে বলতে পারিস। যদি সত্যিই এটা তোদের পরিবারের কোনো গোপন তথ্য হয়, তাহলে অন্তত আমার মুখ থেকে কোনো শব্দই কখনো বেরোবে না।’
‘আমি তা বিশ্বাস করি বলেই তোকে সব কথা বলব।’
সুমন বলল, ‘আর আমাদের বলবি না?’
‘হ্যাঁ, তোদেরও বলব। মানে, যতটা বলা দরকার, ততটাই বলব।’
এই কথার মধ্যে পূর্বপরিচিত উকিলবাবু সামনে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘সুকুমারবাবু এসে গেছেন। ওই যে পাঁচনম্বর টেবিলে হলুদ রঙের পাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোক। শিগগির যান। নইলে হয়তো সারাদিন অপেক্ষা করতে হবে।’
হৈমন্তী বলল, ‘এক্ষুনি যাচ্ছি।’
চারজনে পাঁচনম্বর টেবিলের দিকে দৌড়ল।
সুকুমার নস্কর বয়স্ক লোক। রোগা, দড়ির মতো পাকানো শরীর, কাঁচা-পাকা চুল, গালভাঙা মুখে স্টিল ফ্রেমের গোল চশমা। একেবারে অসার্থকনামা ব্যক্তি, দেখলে মনে হয় রামগড়ুরের মাসতুতো ভাই। জীবনে কোনোদিন হেসেছেন বলে মনে হয় না।
অত্যন্ত বিরক্ত মুখে হৈমন্তীর কথা শুনলেন সুকুমারবাবু। বললেন, ‘আপনারা ভূতের খোঁজ করবার জন্য স্যারের সঙ্গে দেখা করতে চান? একী ফাজলামো নাকি? জানেন, আপনাদের পেছনে যাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁদের কারোর খুনের মামলা, কারোর ডাকাতির, কারোর বধূনির্যাতন বা ডিভোর্স? আর আপনারা এসেছেন কিনা ভূত নিয়ে কথা বলবার জন্য। আর কথা বাড়াবেন না তো। যান, যান। যতো সব!’
মুখটা যথাসাধ্য করুণ করে হৈমন্তী আপিল পেশ করতে যাচ্ছিল, তার আগেই হঠাৎ সুকুমার তড়াক করে উঠে অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘গুড মর্নিং স্যার।’
হৈমন্তী পেছন ফিরে দেখল সাদা শার্টপ্যান্ট পরা একজন দীর্ঘদেহী অ্যাডভোকেট একহাতে কালো কোট আর অন্য হাতে ব্রিফকেস নিয়ে গটগট করে বার লাইব্রেরির মধ্যে ঢুকে গেলেন। পেছন থেকে তাঁর মুখটা দেখা গেল না, কেবল মাথায় ধবধবে সাদা কাঁধ পর্যন্ত লম্বা বাবরি চুলটাই দেখা গেল।
চারজন বিমর্ষ মুখে ফিরে যাচ্ছিল, উকিলবাবুটি এসে ধরলেন। বললেন, ‘কি হল? দেখা করতে দিল না তো? জানতুম, দেবে না। এক কাজ করুন। আপনারা কাল আসুন। ইতিমধ্যে আমি মনোরঞ্জনবাবুর সঙ্গে কথা বলে রাখব। দেখি, কোনো ব্যবস্থা করা যায় কি না। ভূত বলে কথা।’
হৈমন্তী উকিলবাবুকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে সাইকেলে উঠে পড়ল।
হালদার সাইকেল মার্টে সাইকেলগুলো জমা দিয়ে সবাই বাড়ির পথ ধরল। ঠিক হল, বিকেল বেলা নদীর ধারেই যাওয়া হবে।
রাস্তার ওপরে একটা কালভার্ট ছিল। তার ইটের তৈরি চওড়া রেলিং-এর ওপর বসে হৈমন্তী বলল, ‘এবার আমার কথাটা সবাই শোন।’ তারপর, রাত্রে তার বাবার সঙ্গে যা যা আলোচনা হয়েছে বলল। সবাই চুপ করে শুনে গেল।
ওর কথা শেষ হলে চয়ন বলল, ‘তুই যা বললি, সেটা ঠিকই আছে। তবুও আমার মনে হচ্ছে, তুই ঘটনাগুলোর ভুল ব্যাখ্যা করছিস। আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না, যে কাকাবাবু মিথ্যে কথা বলছেন বা কোনো অপরাধ করে অথবা কারোর কাছ থেকে পালিয়ে রাইপুরায় গা ঢাকা দিয়ে বসেছিলেন। আর, এতদিন বাদে এখানে ফিরে এসেছেন তার ফয়সলা করবার জন্য। তাহলে তো বলতে হয় এটা কোনো খুনের কেস। একমাত্র খুনের মামলাই কখনো তামাদি হয় না বলে জানি। আমি ওঁকে ছোটোবেলা থেকে দেখে আসছি। কোনো খুনখারাবির মধ্যে উনি জড়িয়ে পরতে পারেন— এটা আমি কল্পনাই করতে পারি না।’
হৈমন্তী বলল, ‘এটা যে খুনেরই কেস তা আমারও মনে হয় না। তবে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে অন্য কোনো কারণে, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, বাবা এক বা একাধিক লোকের কাছ থেকে রাইপুরায় লুকিয়ে ছিল। আমি চিরকাল দেখে আসছি যে আমরা যখন বাড়িতে থাকতুম, তখন বাবা বা মা আমাদের দরজা খুলতে দিত না। কেউ বেল বাজালে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলত। বার বার আমাদের বলত, আমরা যেন কোনো অপরিচিত লোকের সঙ্গে কথা না-বলি। মাঝেমাঝেই আমাদের প্রশ্ন করত, কেউ আমাদের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছে কি না বা আমাদের ফলো করছে কি না। আমাদের সবাইকে নাচ-গান না শিখিয়ে ক্যারাটে শেখার স্কুলে ভরতি করে দিয়েছিল লেখাপড়ায় ফাঁকি দেওয়া চলত কিন্তু সেখানে ফাঁকি দেওয়া চলত না। এইরকম আতঙ্কের কারণ অবশ্যই তাঁদের ছেলেমেয়েদের প্রতি অতিরিক্ত স্নেহ হতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে আমাদের হোস্টেলে দেবার কোনো যুক্তি থাকে না। যাই হোক, সবই তো তোরা শুনলি। এবার বল, তোরা আমার সঙ্গে আছিস কি না।’
সবাই সমস্বরে বলল, ‘আমরা ছিলুম, আছি এবং থাকব।’
বলতে বলতেই ওদের সামনে একটা কালোরঙের অস্টিন এ-ফর্টি প্রচুর ধুলো উড়িয়ে এসে দাঁড়াল। পেছনের দরজা খুলে যিনি নেমে এলেন, তাঁর মাথায় সাদা বাবরি চুল, নাকের নীচে মস্ত পাকানো পাকাগোঁফ। তাঁর পরনে কালো কোট যদি না থাকত, তাহলে তাঁকে নির্দ্বিধায় পিতামহ ভীষ্ম বলা যেতে পারত। ভদ্রলোকের বয়েস যাই হোক না কেন, তাঁর শরীর বেশ শক্তপোক্তই আছে।
চারজন তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল। ভদ্রলোক বললেন, ‘আজ তোমাদের কোর্টে দেখলুম। তোমাদের খুবই উদবিগ্ন দেখাচ্ছিল। তোমরা না কি আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছিলে কোনো ভূতের ব্যাপারে খোঁজখবর নেবার জন্য আর সুকুমার তোমাদের ভাগিয়ে দিয়েছে? ব্যাপারটা কী বলোতো?’
হৈমন্তী সহাস্যে বলল, ‘না না, মি. দত্ত, সুকুমারবাবুর কোনো দোষ নেই। তিনি ঠিক কাজই করেছেন। আপনি অত্যন্ত ব্যস্ত লোক। আমাদের সমস্যাটার গুরুত্ব উনি বুঝতে পারেননি, ভেবেছেন আমরা আপনার সময় নষ্ট করব।’
‘আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে। কী জানো, অন্য কেউ এ ধরনের কথা বললে হয়তো আমি সুকুমারকেই সমর্থন করতুম, কিন্তু তোমাদের বেলায় একটু ব্যতিক্রম করলুম। কারণ, তোমাদের দেখে আমার মনে হচ্ছে, তোমরা বোধ হয় স্রেফ ছেলেমানুষি করছো না। যেকোনো কারণেই হোক, তোমরা সত্যিই উদবিগ্ন। বলো, কী তোমাদের সমস্যা। কিন্তু খুব সংক্ষেপে বলবে। আমি এখন খেতে যাচ্ছি। দেরি করিয়ে দিও না।’
‘এখানেই বলব, স্যার?’
‘হ্যাঁ, এখানেই বলো।’
‘চ্যাটার্জি পাড়ার বাড়িটা, যেটাতে বিনানি বলে একজন থাকতেন, সেটা আমার বাবা কিনেছেন। তিনি বম্বেতে চাকরি করতেন, রিটায়ার করেছেন সম্প্রতি। আমরা সকলে গতকাল একসঙ্গে এসেছি। আমরা এই ক-জন ন-দশ দিন বাদে ফিরে যাব, বাবা আর মা এখন থেকে এখানেই থাকবেন। কতগুলো কারণে আমাদের মনে হচ্ছে যে বাড়িটাতে কোনো গণ্ডগোল আছে। বাবা অবশ্য পাত্তা দিচ্ছেন না; কিন্তু আমরা খুব একটা নিশ্চিন্ত হতে পারছি না। আপনি তো এই শহরে বহুদিন আছেন, চেনেনও সবাইকে, সেজন্য আপনার কাছে জানতে চাইছিলুম যে ওই বাড়িতে কখনো কোনো অপঘাত মৃত্যু বা অস্বাভাবিক ঘটনা কিছু ঘটেছে কি না।’
‘তোমাদের বাবা বম্বে থেকে এখানে এসে সেটল হতে চান কেন? এই জায়গাটার সন্ধান পেলেন কী করে?’
‘বাবা-মা পশ্চিমবাংলাতেই থাকতে চান কিন্তু কলকাতা শহরটা একেবারেই পছন্দ করেন না। তাই, অনেক খুঁজে শেষপর্যন্ত এই জায়গাটাই পছন্দ করেছেন। আমার ধারণা, বাবা তাঁর কোনো বন্ধুর কাছে এই কমলপুরের সন্ধান পেয়েছিলেন।’
‘ভালোই করেছেন, তাঁর পছন্দের প্রশংসাই করতে হয়। আর, তোমাদের বলতে পারি যে ও বাড়িতে ভূত থাকার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। ওখানে কোনো অপঘাত মৃত্যু বা ওই ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে তো কখনো শুনিনি। ও বাড়ির বাসিন্দাদের মধ্যে পরিতোষ ভটচায অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায় ঠিকই কিন্তু সে তো কলকাতায়। আর বিধানের স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন দীর্ঘ অসুখের পর, অপঘাতে নয়। এ ছাড়া আর কোনো ঘটনার কথা তো আমার জানা নেই। আর, মাস্টারমশায়ের ছোটোছেলে যে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল, সে খুব সম্ভবত মারা যায়নি। হয়তো এখনও সে বেঁচেই আছে। আমার ধারণা, সে তার বাবার সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সাধু-টাধু হয়ে গেছে।’
হৈমন্তীর গলাটা কেঁপে গেল। বলল, ‘এই মাস্টারমশায়ের নিরুদ্দেশ ছেলের ব্যাপারটা কী স্যার?’
‘আরে তুমি যে ভাবছ, কেউ সেই ছেলেকে গুমখুন করে তোমাদের বাড়ির পেছনের জমিতে মাটিচাপা দিয়ে দিয়েছে আর সে সার হয়ে ঢ্যাঁড়স ফলাচ্ছে, সে রকম কিছু নয়। সদ্য এমএসসি না এমএ পাশ করেছিল। হয়তো সে বিদেশ-টিদেশে যেতে চেয়েছিল। মাস্টারমশায় রাজি হননি। তাই হঠাৎ একদিন কাউকে কিছু না-বলে, নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। হয়তো সে বিদেশেই গেছে, নয়তো দেশেই আছে কোনো আশ্রমে-টাশ্রমে। আমার এখনও মনে আছে, ছেলে নিরুদ্দেশ হওয়াতে মাস্টারমশাই উদবিগ্ন যত না হয়েছিলেন, রেগে গিয়েছিলেন তার চেয়ে অনেক বেশি। এমনকী, বারো বছর পার হয়ে গেলে শ্রাদ্ধও করেননি। কেউ কোনো প্রশ্ন করলে বলতেন, ”ও ছেলের নাম উচ্চারণ করাও উচিত নয়”।’
‘ব্যাপারটা কী হয়েছিল, একটু যদি বলেন।’
‘এটাই ব্যাপার। এর বাইরে যদি কিছু হয়ে থাকে তবে সেটা আমার জানা নেই।’
‘আপনার দেরি হয়ে না-গেলে, এই মাস্টারমশায়ের কথা যদি একটু বলেন, স্যার।’
‘মাস্টারমশায় ছিলেন বামাপদ স্কুলের অঙ্কের টিচার। আমিও ওঁর কাছে পড়েছি। খুব পণ্ডিত মানুষ ছিলেন। ওঁর লেখা পাটিগণিত আর বীজগণিতের বই সেযুগে ছাত্রমহলে খুব জনপ্রিয় ছিল। নিষ্ঠাবান বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ, কাঠবাঙাল, প্রচণ্ড বদরাগী আর অত্যন্ত পরিশ্রমী ছিলেন। খুব খাটতেন ছাত্রদের জন্য। বিশাল চেহারা, গালভরা লম্বা দাড়ি, আর বাঘের মতো গলা ছিল তাঁর। নামজাদা দুষ্টু ছেলেরাও তাঁর সামনে কেঁচো হয়ে থাকত।’
‘উনি কি এখানকার লোক ছিলেন?’
‘না, না। বললুম যে, বাঙাল। ইস্ট পাকিস্তান থেকে উদবাস্তু হয়ে এদেশে এসে প্রথমে অন্য কোথাও পড়াতেন। পরে সেখান থেকে কমলপুরে আসেন। তখন তাঁর স্ত্রী মারা গেছেন। তিন ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে স্টেশনের কাছে বটতলা পাড়ায় একটা ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। তাঁর বড়োছেলে কানু বা শ্রীকান্ত আমার বন্ধু ছিল। আমরা এক ক্লাসে পড়তুম। সে খেলাধুলোয় যতটা ভালো ছিল, লেখাপড়ায় ততটা ছিল না। কোনোরকমে ম্যাট্রিকটা পাশ করে সে একটা ছোটোখাটো চাকরি নিয়ে কলকাতায় চলে যায়। সেখানে সে একটা সেকেন্ড ডিভিশন টিমে ফুটবলও খেলত। বে থা করেনি। অনেকদিন পর্যন্ত তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। বছর দুয়েক আগে মারা গেছে। মেজোছেলের নাম ছিল বোধ হয় সমীরণ, আমরা ডাকতুম রনু বলে। সে কলকাতায় হোস্টেলে থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ত। পাশ করে গুজরাট না কোথায় চলে যায়। তার আর কোনো খোঁজ রাখিনি। ছোটোছেলেটা আমার থেকে অনেকটাই ছোটো। তার ভালোনাম মনে নেই, সবাই ডাকত বীরু বলে। তার বেশ হিরোমার্কা চেহারা ছিল। একমাথা কোঁকড়া চুল ছিল, বড়ো হয়ে আবার একজোড়া মোটা গোঁফ গজিয়েছিল। তার কথা তো আগেই বলেছি। মেয়ে স্বাতী ছিল সবচেয়ে ছোটো। তার বিয়ে হয়েছিল পাটনায় এক উকিলের সঙ্গে। আমি নেমন্তন্ন খেয়েছিলুম। এখনও বোধ হয় পাটনাতেই আছে। রিটায়ার করে মাস্টারমশায় বাড়ি বিক্রি করে কলকাতায় শ্রীকান্তর কাছে চলে গিয়েছিলেন। সেখানে গত হন, তা বছর কুড়ি হবে।’
‘মাস্টারমশায়ের নামটা কি আপনার মনে পড়ে?’
গোঁফের ফাঁকে একটা ছেলেমানুষী হাসি হাসলেন মনোরঞ্জন। বললেন, ‘যতদূর মনে পড়ে, তাঁর আসল নাম ছিল অনাথবন্ধু রায়। কিন্তু বংশানুক্রমে ছাত্ররা আড়ালে তাঁকে বলত বকাসুর। খুব বকা দিতেন তো, তাই। আচ্ছা, এবার বলোতো তোমাদের পরিচয় আর কে কী করো।’
‘আমি হৈমন্তী রায়, আমি পুনায় নিম্বলকর পাবলিকেশনে চাকরি করি আর ফ্রি লান্স জার্নালিজম করি। ইনি ডাক্তার অভিরূপ বোস, সম্প্রতি বিলেত থেকে এমআরসিপি পাশ করে ফিরে বম্বের সেন্ট মাইকেল হসপিটালে জয়েন করেছেন। ইনি আমাদের পারিবারিক বন্ধু। এ সুমিত, আমার ছোটো ভাই। বম্বে আইআইটি-তে এম টেক করছে। আর এ অদিতি, আমার বোন, বম্বেতে কলেজে পড়ে। আগামী বছর বিএ পরীক্ষা দেবে।’
‘তার মানে, তোমরা প্রায় বম্বের লোকই বলা যায়। অথচ, ভারি সুন্দর বাংলা বলো তোমরা। এটা নিশ্চয়ই তোমাদের বাবা আর মায়ের ইনফ্লুয়েন্স। তাই না?’
হৈমন্তী হেসে বলল, ‘ঠিকই ধরেছেন। বাংলায় কথা বলা আর বাংলা বই পড়া আমাদের ছোটোবেলা থেকেই অবশ্যকর্তব্য ছিল।’
মনোরঞ্জন চলে যাবার পর চয়ন বলল, ‘একটা কথা হৈমন্তী। ভদ্রলোক যতক্ষণ কথা বলছিলেন, তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে তোর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তোর ভূতের গল্পটা বোধ হয় বিশ্বাস করেননি। তোর মুখের ভাব থেকে তোর মনের আসল কথাটা বোঝবার চেষ্টা করছিলেন। এটা কি লক্ষ করেছিস?’
হৈমন্তী চিন্তিত মুখে বলল, ‘করেছি। অত্যন্ত ঘড়েল লোক। এত বছর মনুষ্যচরিত্র নিয়ে কারবার করছেন। মুখ দেখে মনের কথা টেনে বের করাই ওঁর কাজ। সেইজন্য তাড়া থাকা সত্ত্বেও এতক্ষণ ধরে কথা বললেন। উনি এটুকু বুঝেছেন যে আমরা ছেলেমানুষী করছি না, কোথাও একটা খুব সিরিয়াস কোনো প্রবলেম আছে। তা ছাড়া, সবাইকে ছেড়ে অনাথবন্ধু রায়ের কথা এত সবিস্তারে বলাটাও কিন্তু বেশ চিন্তার ব্যাপার। আমি যা সন্দেহ করছি, উনিও কি তাই করছেন? বুঝতে পারছি না।’
বিকেল বেলা ইভার প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও আবার বেরোল চারজন।
চয়ন বলল, ‘এবার কোথায়? নদীর ধারে?’
হৈমন্তী বলল, ‘না, বামাপদ হাইস্কুলে।’
‘আজ তো স্কুল বন্ধ থাকার কথা।’
‘তা ঠিক। তবে, একটা বুড়ো মালী বা দরওয়ান নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।’
অদিতি বলল, ‘ব্যাপারটা কী হচ্ছে রে দাদা? তুই কিছু বুঝতে পারছিস?’
সুমিত হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘সবটা নয়। কিছু কিছু। আমরা এখন বোধ হয় যাচ্ছি বকাসুরের সন্ধানে। তাই না, দিদি?’
হৈমন্তী বলল, ‘ঠিক তাই। এখন লোকজনকে জিজ্ঞেস করে আমাদের বামাপদ হাইস্কুল খুঁজে বার করতে হবে।’
১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠিত বামাপদ সিংহ স্মৃতি বয়েজ হাইস্কুলের বাড়িটা প্রকাণ্ড। মোটা মোটা থামওলা তিনতলা ইমারত, মাঝখানে একটা মাঝারি ধরনের মাঠের তিনদিক ঘিরে তৈরি করা। বাড়িটার পেছনে একটা ফুটবল খেলার মাঠের কিছুটা রাস্তা থেকেই দেখা যায়। খেলার মাঠ আর স্কুলবাড়ি ঘিরে চারদিকে প্রায় পাঁচফুট উঁচু ইটের পাঁচিল। মেন গেটটাও খুব বড়ো, লোহার গরাদ দেওয়া। গেটের ওপর অর্ধচন্দ্রাকৃতি লোহার ফ্রেমের ওপর স্কুলের নাম আর প্রতিষ্ঠার সময়কাল দেওয়া আছে।
তবে বাড়িটার অবস্থা বিশেষ ভালো নয়। দেখলে বোঝা যায়, অনেকদিন বাড়িটার দেওয়ালে রং পড়েনি। লোহার গেটে মরচে পড়েছে, সেটা বোধ হয় সবসময় খোলাই থাকে কারণ তার কবজাগুলো কাজ করে না। পাঁচিলের দেওয়ালে ভোটের স্লোগান, অসংখ্য হাতে লেখা পোস্টার, ছাপানো হ্যান্ডবিল। এক ইঞ্চি জায়গাও খালি নেই। মহিষছাপ খৈনি আর মাও-এর বাণীর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।
স্কুলের দরজা জানলা সব বন্ধ। সামনের মাঠে জনাচারেক হাফপ্যান্ট পরা কমবয়সি ছেলে পা ছড়িয়ে বসে আড্ডা মারছিল। এ ছাড়া আর কোথাও কোনো লোকজন নেই।
গেট দিয়ে চারজনকে ঢুকতে দেখে ছেলেগুলি উঠে এল। তাদের একজন বলল, ‘কাকে খুঁজছেন? আজ তো ইশকুল বন্ধ।’
হৈমন্তী হেসে বলল, ‘ইশকুল বন্ধ তো তোমরা এখানে কী করছো?’
‘আমরা এসেছি নিমাইবাবুর কাছে। আমাদের ইশকুলে ড্রামা হবে তো। নিমাইবাবু আজ আমাদের পার্ট দেবেন।’
‘নিমাইবাবু কোথায়?’
‘ভেতরে আছেন। পার্ট লিখছেন। কাল সকালে সেই পার্ট মুখস্থ করে ওঁকে শোনাতে হবে।’
‘কোন ড্রামা হবে?’
‘বিমল কাঞ্জিলালের লেখা ”রাজা কেন গজা খায়”।’
ভয়ংকর গম্ভীর হয়ে চয়ন বলল, ‘বলো কী? সে তো খুব শক্ত ড্রামা।’
‘হ্যাঁ, তাই তো। নিমাইবাবু বলেন, হাসির ড্রামা করা হল গে সবচেয়ে কঠিন কাজ। ভালো হলে হাসি, না-হলে ফাঁসি।’
এই কথার মধ্যে একজন ধুতি পাঞ্জাবি পরা পক্ককেশ শ্যামবর্ণ ভদ্রলোক একটা ক্লাসরুমের দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। তাঁর হাতে অনেকগুলো ফুলস্ক্যাপ কাগজ। চারজনকে দেখে বারান্দা থেকে নেমে এগিয়ে এলেন। বললেন, ‘কাউকে খুঁজছেন?’
হৈমন্তী বলল, ‘হ্যাঁ, এই স্কুলের মালী বা দরোয়ান। যেকোনো একজন হলেই হবে।’
‘কেন বলুন তো?’
‘আমরা গতকাল চ্যাটার্জি পাড়ার একটা বাড়িতে উঠে এসেছি। আমাদের বাড়ির সামনে কিছুটা জমি আছে। তার ঘাস কাটা আর বাগান করার জন্য বাবা একজন মালী খুঁজছেন। আমরা তো কাউকে চিনি না। ভাবছিলুম, এই স্কুলের মালী বা দরোয়ান হয়তো কোনো খোঁজ দিতে পারবে।’
‘তা পারবে। একটু দাঁড়ান, ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’
বলে নিমাইবাবু ছেলেদের কাছে ডাকলেন। একটি ছেলের হাতে কাগজগুলো দিয়ে বললেন, ‘ওপরে প্রত্যেকের নাম লেখা আছে। ঠিকমতো দিবি। একটাও যেন না হারায়। আর কেষ্ট, তুই যা তো, পীতাম্বরকে ডেকে নিয়ে আয়।’
বলামাত্র কেষ্ট আর তার বন্ধুরা লাফ দিয়ে বারান্দায় উঠে দৌড়ে একটা করিডর দিয়ে খেলার মাঠের দিকে চলে গেল। বোধ হয় ও মাঠের আশেপাশেই কোথাও পীতাম্বরের ঘর।
এবার অতিথিদের দিকে ফিরে নিমাইবাবু বললেন, ‘কোন বাড়িতে এসেছেন আপনারা? সামনে জমি বললেন না? বিনানিদের বাড়িতে না কি?’
হৈমন্তী বলল, ‘হ্যাঁ, ওই বাড়িতেই।’
নিমাইবাবু মৃদু হেসে বললেন, ‘জানেন, ওই বাড়িটা তৈরি করেছিলেন এই ইশকুলেরই একজন মাস্টারমশাই। তা ধরুন, আজ থেকে কোনো-না বাহান্ন-তিপ্পান্ন বছর আগে।’
‘হ্যাঁ, শুনেছি। অঙ্ক পড়াতেন। অনাথবন্ধু রায়। আমরাও রায়।’
‘তাই না কি? আমি তো ভেবেছিলুম আপনারা অবাঙালি। মাস্টারমশায়ের নাম ছিল অনাথনাথ রায়, অনাথবন্ধু নয়। বেজায় রাশভারী লোক ছিলেন। শুনেছি, প্রথম যখন এখানে এসেছিলেন, তখন খুব গরিব ছিলেন। ইস্ট পাকিস্তানের উদবাস্তু, সেখানে দাঙ্গায় সর্বস্ব খুইয়ে ছিলেন। পরে বই লিখে অবশ্য অনেক টাকা করেছিলেন। আবার, দুঃখও পেয়েছেন অনেক। স্ত্রী মারা গেলেন। তিন ছেলে ছিল। বড়োটার লেখাপড়া হল না, ছোটোটা বিবাগি হয়ে কোথায় চলে গেল। কেবল মেজোটাই ঠিক ছিল। ভালো চাকরি করত, কিন্তু পরে সে আর বাবার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখত না। উফ, সে কত বছর আগেকার কথা!’
‘আপনি অনাথনাথ রায়কে দেখেছেন?’
‘অবশ্যই। আমি তো তাঁর ছাত্র ছিলুম। উনি বোধ হয় একাত্তরে রিটায়ার করেন। আমি ইশকুলে জয়েন করি আটাত্তরে। কাজেই, তাঁর সহকর্মী হবার সুযোগ হয়নি। প্রকাণ্ড ষণ্ডা চেহারা ছিল তাঁর। যে ছাত্রকে মারতেন, সে তিনদিন ইশকুলে আসত না।’
‘এই অনাথনাথ রায়ের কোনো ছবি আছে এই স্কুলে?’
‘আছে। লাইব্রেরিতে। সেটা তো বন্ধ। আপনাদের জানলা দিয়ে দেখতে হবে। এখন সন্ধ্যে হয়ে আসছে। এত কম আলোয় কিছু দেখতে পাবেন কি না সন্দেহ আছে। আপনারা বরং কাল আসুন। কালকেও ইশকুল বন্ধ। তবে দিনের বেলায় ভালো দেখতে পাবেন।’
‘আপনি তখন থাকবেন তো?’
‘থাকব। দশটার পরে আসবেন। আমি দুটো পর্যন্ত থাকব। ওই যে পীতাম্বর এসে গেছে। আপনারা কথা বলে নিন।’
কথা বলার বিশেষ কিছু তো ছিল না। কাজেই, পীতাম্বরের সঙ্গে কিছুক্ষণ আমড়াগাছি করে চারজন বাড়ির দিকে রওনা হল।
সেদিন রাত্রে গতরাতের মতো হৈমন্তী তিনজনকে দোতলায় পাঠিয়ে দিয়ে তার বাবা আর মার মুখোমুখি হল। সুব্রত সিগারেট ধরাতে ধরাতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী মিস মার্পল, আপনার অনুসন্ধান কতদূর এগোল? কিছু পেলেন?’
হৈমন্তীর আজকে সেই রণং দেহি ভাবটা আর নেই। স্মিতমুখে বলল, ‘পেয়েছি। অনেক কিছুই পেয়েছি। একেবারে আশাতীত বলা যায়।’
‘বলিস কী? যথা?’
‘এই বাড়িটা বানিয়েছিলেন জনৈক অনাথনাথ রায়, যেমন আমরা রায়। তিনি বামাপদ হাইস্কুলে অঙ্ক পড়াতেন। অত্যন্ত একরোখা, শক্তিশালী পুরুষ ছিলেন। তাঁর তিন ছেলে, এক মেয়ে। ছেলেরা হল কানু, রনু আর বীরু। কানু আর রনু খুব সম্ভবত পরলোকগত, বীরু জীবিত। বীরু ছিল খুবই সুদর্শন। তার মাথাভরা কোঁকড়া চুল ছিল, যেমন তোমার ছিল আমাদের ছেলেবেলায়। আর তার ট্রেডমার্ক ছিল নাকের নীচে মোটা গোঁফ, যা তোমার নেই। সেটা না থাকলে তাকে চেনা কঠিন হত। সেই গোঁফে না কি তাকে খুব হ্যান্ডসাম দেখাত।’
বলে হৈমন্তী চট করে ইভার দিকে তাকাল। দেখল, তাঁর মুখে একটি আশ্চর্য মিষ্টি চাপা হাসি, অর্ধনিমীলিত চোখে তিনি সুব্রতর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। যেন তিনি কোনো সুদূর অতীতের অত্যন্ত প্রিয় একটা ছবি মনে করবার চেষ্টা করছেন। মনে হচ্ছিল যেন তাঁর বয়েসটা হঠাৎ অনেকটা কমে গেছে।
ইভা চাপা গলায় বললেন, ‘কার ছেলের মাথায় কোঁকড়া চুল আর মুখে মোটা গোঁফ, তা নিয়ে তোর মাথাব্যথা কীসের রে?’
সুব্রতকে কিন্তু উদবিগ্ন দেখাচ্ছিল। কাঁপা কাঁপা হাতে সিগারেটে টান দিয়ে কাষ্ঠহেসে বললেন, ‘তুই এই অনাথনাথ রায়ের বংশপত্রিকা নিয়ে গবেষণা শুরু করলি কেন? গবেষণা মানে কি জানিস? ”গো এষণা” বা সাদা বাংলায় যাকে বলে, ”গোরু খোঁজা”। এই গোরু খুঁজে যে তুই কী আনন্দ পাচ্ছিস তা তুই-ই জানিস। গোরুটা সত্যি আছে কি না সেই খোঁজটা কি নিয়েছিস?’
‘আছে, বাবা। ভীষণভাবে আছে।’
‘আচ্ছা, কানু আর রনু যে পরলোকগত— এই সংবাদটি তোকে কে দিল?’
‘কেউ না। এটা আমার অনুমান। কানু জ্যাঠা আর রনু জ্যাঠা বেঁচে থাকলে তুমি একাই এখানে আসতে কি না, সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। তবে, পাটনার পিসিমার কথা আমি জানি না। কেন তুমি নিরুদ্দেশ হয়েছিলে বাবা? কীসের জন্য?’
মুখের ওপর হাত বুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুব্রত বললেন, ‘তুই যে কী বলছিস, আমি তো তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। তোর কি আর খেয়ে-দেয়ে কোনো কাজ নেই? রোদে রোদে ঘুরে কোত্থেকে একগাদা জ্যাঠা আর পিসি ধরে নিয়ে আসছিস। এসেছিস নতুন জায়গায়, ঘুরে বেড়া, ফুর্তি কর। তা না, যতসব বাজে কাজ করে বেড়াচ্ছিস!’
‘বাজে কাজ নয় বাবা। তোমাকে কয়েকটা কথা খোলাখুলি বলতে চাই। তোমরা আমাদের এত স্নেহ ভালোবাসা দিয়েছ, অথচ তোমরা তা কোনোদিনও পাওনি— এটা আমি মেনে নিতে পারছি না। কিছু না-পেলে কি কিছু দেওয়া যায়? তুমি যে বলো তোমাদের রেফারেন্স বলে কিছু নেই, সেটা ঠিক নয়, হতে পারে না। তোমাদের অতীত অবশ্যই আছে, তবে তার স্মৃতিটা হয়তো আনন্দজনক নয়। আমার ধারণা যদি ঠিক হয়, তোমাদের এত হাসি-গান আর আনন্দের পেছনে কোনো গভীর, হয়তো-বা ভয়ংকর একটা দুঃখের ইতিহাস লুকিয়ে আছে। আমরা তোমাদের কাছ থেকে অনেক পেয়েছি তা ঠিক। আজ রোদে রোদে ঘুরে আমরা যদি সেই দুঃখের ইতিহাসটা মুছে ফেলতে পারি, তাহলে তার চেয়ে বড়ো পাওয়া তো আর কিছু হতে পারে না।’
সুব্রত সোফার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। মেয়ের মাথায় সস্নেহে হাত রেখে বললেন, ‘যদি সেরকম কিছু থাকেই, সেটা তোরা মুছতে যাবি কেন? সেটা আমাদের ব্যাপার। আমরাই সেই কাজটা করব।’
‘আমাদের ব্যাপার? তার মানে মা-ও এর মধ্যে আছে। কীভাবে বা কেন আছে, সে প্রশ্ন করে লাভ নেই, কারণ তুমি জবাব দেবে না। আমি বুঝতেই পারছি, সেই কাজটা করতেই আজ প্রায় চল্লিশ বছর বাদে তুমি এখানে ফিরে এসেছ। দ্যাখো বাবা, যে কাজ সম্পন্ন করতে এত বছর লাগে, সেটা তুমি একা করতে পারবে কি? আমাদের তো সঙ্গে থাকতেই হবে।’
‘সঙ্গে থাকতে হবে? দূর পাগল! কোথাও কিছু নেই যা খুশি তাই বলে যাচ্ছে। কী জানিস? কেঁচো খুঁড়তে গেলে সাপ বেরিয়ে পড়তে পারে। তখন সামলাতে পারবি?’
‘পারব বাবা। সাপটাকে মেরে ফেলব।’
‘জীবনটা অত সোজা নয় রে। কথায় বলে, বাঘের দেখা আর সাপের লেখা। অনেক রাত হল। যা, এবার শুতে যা।’
পরদিন সকালে চারজনে প্রথমেই বামাপদ হাইস্কুলে গিয়ে হাজির হল। তখন মাঠে কেউ নেই। দরজা-জানলাও বন্ধ, কেবল একটি ক্লাসরুমের দরজা খোলা ছিল। ওরা গুটি গুটি তার সামনে গিয়ে দেখল ভেতরে ফাঁকা ঘরে নিমাইবাবু বসে বসে একমনে বোধ হয় নাটকের ডায়ালোগ লিখছেন।
চারজনের পায়ের শব্দ পেয়ে মুখ তুললেন নিমাইবাবু। বললেন, ‘এই যে, আপনারা এসে গেছেন। মাস্টারমশায়ের ছবি দেখবেন তো? চলুন।’
বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নিমাইবাবু বললেন, ‘আচ্ছা, মাস্টারমশায়ের ছবি দেখতে আপনাদের ইচ্ছে হল কেন?’
হৈমন্তী বলল, ‘কারণ, আপনি কাল মাস্টারমশায়ের যে জীবনকাহিনি বললেন, সেটা আমাদের বড়ো অদ্ভুত লেগেছে। মানুষের কীরকম কপাল দেখুন। স্ত্রীর মৃত্যুতে, দাঙ্গায়, দেশভাগে নিশ্চয়ই অনেক আঘাত পেয়েছিলেন। পরে শিক্ষকতার মধ্যে অবশ্যই বেঁচে থাকার মানে খুঁজে পেয়েছিলেন। যখন টাকাপয়সা হল, নিজের বাড়ি হল, সবে সুখের মুখ দেখতে শুরু করেছেন, তখনই আবার একের পর এক আঘাত। সন্তানদের মধ্যে একজন হারিয়ে গেল, একজন উপযুক্ত হতে পারল না। এগুলোও তাঁকে কিছু কম যন্ত্রণা দেয়নি। তবু কাজের মধ্যে ডুবে থেকেছেন। পতনঅভ্যুদয়বন্ধুর-পন্থা বোধ হয় একেই বলে, তাই না? আশ্চর্য গল্প। একেবারে উপন্যাসের উপাদান।’
নিমাইবাবু হাঁ করে হৈমন্তীর কথা শুনছিলেন। বললেন, ‘আপনি কি লেখেন-টেখেন না কি?’
পেছন থেকে চয়ন বলল, ‘হ্যাঁ উনি তো একজন নামজাদা লেখিকা। আপনি হৈমন্তী রায়ের লেখা কোনো উপন্যাস পড়েননি?’
‘না তো?’
‘বলেন কী? ওঁর কয়েকটা উপন্যাস, যেমন ”আলোয় ঢাকা অন্ধকার” বা ”রাতকানা চাঁদ” বা ”রাঙিয়ে আকাশ রাঙিয়ে মন” তো খুব জনপ্রিয় আজকাল।’
অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে নিমাইবাবু বললেন, ‘আর বলবেন না মশাই। এই মফসসলে ভালো বই আর আসে কোথায়? এই লাইব্রেরিতেই দেখুন না, নারায়ণ গাঙ্গুলির পরের কোনো লেখকের বই-ই পাবেন না। এইদিকে আসুন। এই জানলা দিয়ে দেখুন। ওই যে কালো চাপদাড়ি ভদ্রলোকের ছবি দেখছেন, উনিই মাস্টারমশাই।’
স্কুল থেকে বেরিয়েই অদিতি লাফ দিয়ে এসে গুম গুম করে দুটো কিল বসিয়ে দিল চয়নের পিঠে। বলল, ‘দ্যাখো চয়নদা, তুমি ইয়ার্কি মারার আগে আমাদের ইশারা করে দেবে, বুঝেছ? তোমার তো মুখের রেখার কোনো পরিবর্তন হয় না। আর আমি কিছুতেই হাসি চেপে রাখতে পারি না। ইস, কী কষ্টে যে হাসি চেপে রেখেছি, তা শুধু আমিই জানি।’
হৈমন্তী গভীরভাবে কী যেন চিন্তা করছিল। মুখ তুলে বলল, ‘দাঁড়া, দাঁড়া। আচ্ছা সুমিত, মুখে মুখে একটা অঙ্ক কষে দে তো। একাত্তরের থেকে তিন বিয়োগ করলে কত থাকে?’
সুমিত বলল, ‘আটষট্টি।’
‘বেশ। একজন পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট পাশ করে কত বছর বয়েসে? সাধারণত বাইশ কী তেইশে। তাহলে, আটষট্টি থেকে তেইশ বাদ দিলে রইল কত?’
‘পঁয়তাল্লিশ।’
‘পঁয়তাল্লিশের সঙ্গে ষাট যোগ করলে কত হয়?’
‘এক-শো পাঁচ।’
‘পাঁচ, না? বাঃ, চমৎকার মিলে যাচ্ছে!’
‘এটা আবার একটা অঙ্ক হল? না মেলবার কী আছে? অঙ্কটা কীসের, সেটা একটু বলবি?’
‘সে তুই বুঝতে পারবি না। তাহলে, আমাদের এমন একটা লোককে খুঁজে বের করতে হবে যে ছেচল্লিশ-সাতচল্লিশ বছর আগে এখানে থাকত আর তখন তার বয়েস ছিল অন্তত কুড়ি বছর। তার মানে এখন তার বয়েস হতে হবে ছেষট্টি থেকে সাতষট্টি—’
সুমিতের আঁতে ঘা লেগেছিল। বাধা দিয়ে বলল, ‘আমি অঙ্ক বুঝতে পারব না, মানেটা কী? শুনেছ চয়নদা, আমি অঙ্ক বুঝতে পারব না, পারবে না কি দিদি?’
চয়ন ভুরু কুঁচকে হৈমন্তীর দিকে তাকিয়েছিল। বলল, ‘অঙ্কটা বোধ হয় আমি একটু একটু বুঝতে পেরেছি। কাজটা কি ভালো করছিস, হৈমন্তী? যে নিরুদ্দেশ, সে যদি স্বেচ্ছায় বাইরে আসতে না-চায়, তাকে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনা কি ঠিক হবে?’
হৈমন্তী মাথা নেড়ে বলল, ‘জানি না, সত্যিই জানি না। তবে, জানলার বাইরে পা বাড়িয়ে ঝাঁপটা যে দিয়ে ফেলেছি, চয়ন। এখন আর শত চেষ্টা করলেও ফিরে আসতে পারব না। আর, আরও একটা কারণ আছে। যা ঘটে গেছে, তার মধ্যে মা-ও জড়িত। আমি কিছুতেই ভাবতে পারি না যে আমাদের শান্ত, নরম প্রকৃতির মা কোনো মারাত্মক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে।’
‘কাকিমা? অসম্ভব! হতে পারে না।’
‘তোর জায়গায় আমি হলে, আমিও তাই ভাবতুম। কিন্তু আজ ভাবতে পারছি না। তুই ভেবে দ্যাখ, ঘটনাটা এমনই যে সাঁইত্রিশ-আটত্রিশ বছর ধরে সেটা বাবা-মাকে প্রবল যন্ত্রণা দিয়েছে। আজও তার জের মেটেনি। সেই যন্ত্রণা থেকেই মুক্তি পাবার জন্য ওদের এখানে আসতে হয়েছে। ওরা চাক বা না-চাক, আমি যদি ব্যাপারটা খানিকটা বুঝেও ওদের সাহায্য না-করি আর ভবিষ্যতে যদি কিছু ঘটে যায়, তাহলে ওদের সন্তান বলে নিজের পরিচয় দেবার মুখ থাকবে আমার? এখন, এই সাহায্য আমি তখনই করতে পারব, যখন ঠিক কী ঘটেছিল সেটা আমি জানতে পারব। ব্যাপারটা যদি রহস্যের আড়ালেই থেকে যায়, তাহলে তো আমি কিছুই করতে পারব না। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আজ আমি তোদের একটা কথা বলতে চাই—’
‘কী কথা?’
‘কাল রাত্রে বাবার কথায় বুঝেছি যে, যে ঘটনা ঘটেছিল সেটা আমি যতটা বিপজ্জনক ভাবছিলুম, তার চেয়ে অনেক বেশি মারাত্মক। তাই আমি বলি কী, এখন থেকে আমি একাই যা-কিছু করার করব। তোদের এর মধ্যে জড়াতে চাই না। আমার বিবেক বলছে, কোনোরকম বিপদের মধ্যে তোদের টেনে আনা ঠিক হবে না। কাজেই তোরা ফিরে যা। ভালো-মন্দ যাই হোক না কেন, আমি ঠিক সামলে নেব।’
‘তা কখনো হয়? এক যাত্রায় পৃথক ফল? আমাদের বেলা তো ফলও নয়, স্রেফ আঁটি। ও সব হবে না। জানলার বাইরে এই আমিও ঝাঁপ মারলুম। তোরা বাচ্চা দুটো ফিরে যা। ঘুরে টুরে বাড়ি ফিরবি। বলবি, আমাদের ফিরতে দেরি হতে পারে।’
সুমিত বলল, ‘ফিরে যা বললেই হল? ব্যাপারটা যখন বিপজ্জনক, তখন আমাকে তো তোমাদের সঙ্গে থাকতেই হবে। এর তো কোনো অলটারনেটিভ হতেই পারে না। কাজেই, তোমাদের সঙ্গে জানলার বাইরে আমিও ঝাঁপ মেরে ফেলেছি।’
অদিতি বলল, ‘আমিও। তোমাদের পেছনেই আছি।’
স্কুলের পাশে রাস্তার ধারে ‘নিউ গ্র্যান্ড হোটেল’ নামক একটি চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে কথা হচ্ছিল। হৈমন্তী বলল, ‘আমি তোদের যা জানি বা বুঝেছি সেটা খুলে বলছি। আমরা তো জানি যে বাবা-মা দু-জনেই অনাথ আশ্রমে বড়ো হয়েছে, তারাই ওদের বিয়ে দিয়েছে এবং সেই আশ্রম এখন উঠে গিয়েছে। অর্থাৎ, বাবা বা মা-র অতীতের কোনো চিহ্নই আজ আর নেই। বলা যেতে পারে যে, রাইপুরার ফ্যাক্টরিতে যোগ দেবার পর থেকেই ওদের জীবনের শুরু। কথাটা সত্যি হোক বা না-হোক, তাতে আমার আপত্তি করার কিছু ছিল না। কিন্তু বাবার এই শহরে বাড়ি কিনে উঠে আসায় আমি উদবিগ্ন হয়ে পড়েছি।’
চয়ন বলল, ‘কেন? ছেলেবেলা যেখানে কেটেছে সেখানে অনেকেই ফিরে আসতে চায়। সেটা তো অস্বাভাবিক নয়।’
‘না, তা অবশ্যই নয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, রাইপুরায় ওদের সারাজীবনের গোপনীয়তার আর উদবেগের কারণটা কী? ওরা নিশ্চয়ই কোনো একটা ভয়ানক বিপদের আশঙ্কায় ছিল। কী সেই বিপদ? সেই বিপদ কি এখনও জিন্দা আছে আর ওরা আবার সেটার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে? এটাই আমার উৎকণ্ঠার প্রধানতম কারণ।’
‘বোঝা গেল। তোর মনে নিশ্চয়ই তাহলে এই বিপদের একটা থিয়োরি তৈরি হয়েছে। সেটা কী?’
‘আমার কি মনে হচ্ছে জানিস? কোনো কারণে দু-জনকে এই শহর থেকে পালাতে হয়েছিল, একসঙ্গে বা আলাদা আলাদা। ওরা এই শহরে কোনো অনাথ আশ্রমে ছিল, তাও আমার অসম্ভব বলে মনে হয়। ওদের দু-জনের মধ্যেই যে আভিজাত্য আছে— শিক্ষা, রুচি আর সৌজন্যের ছাপ আছে, সেটা কোনো মার্জিত শিক্ষিত ভদ্রপরিবারে বড়ো না-হলে থাকত না।’
‘ঠিক কথা।’
‘তা হলে প্রশ্ন হল, ওরা আবার এই শহরে ফিরে এল কেন? আমার ধারণা ওদের কোনো ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হয়েছিল। সম্ভবত, কোনো মারাত্মক অপরাধের বোঝা ওদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যার থেকে না পালালে বাঁচার কোনো রাস্তা ছিল না তখন। সেই অপরাধ এতই গুরুতর ছিল যে, অন্তরালে থেকে অন্যের মাধ্যমে তার মোকাবিলা করা সম্ভব ছিল না। আজ, চল্লিশ বছর বাদে, টাকাপয়সা জমিয়ে সেই অন্যায়ের মুখোমুখি হয়ে নিজেদের কোনো অনিচ্ছাকৃত গ্লানি থেকে মুক্ত করবার জন্যই ওরা ফিরে এসেছে। এবং, সেই কথাটা ওরা আমাদের বলতে পারছে না, কারণ ওরা নিজেরাই নিঃসন্দেহ নয় যে এই লড়াইতে ওরা জিততে পারবে কি না।’
‘দ্যাখ, গুরুতর অপরাধের পেছনে থাকে টাকাপয়সা, সুন্দরী মেয়ে, নয়তো খুন। এগুলোর কোনোটাই কাকাবাবু বা কাকিমার প্রতি কখনোই প্রযোজ্য হতে পারে না।’
‘ঠিক কথা। দ্যাখ, আমি নিশ্চিত যে সুব্রত রায় অনাথনাথ রায়ের ছোটোছেলে; যে আজ থেকে সাঁইত্রিশ বা আটত্রিশ বছর আগে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল। সে যদি বাইশ-তেইশ বছর বয়েসে এমএসসি পাশ করে থাকে, তাহলে আজ তার বয়েস হয় ষাট যেটা বাবার বয়েসের সঙ্গে মিলে যাছে। এও আমরা জেনেছি যে ছেলে নিরুদ্দেশ হবার ফলে অনাথনাথ রেগে গিয়েছিলেন, দুঃখিত হননি। তবে কি সেই ছেলে একগুঁয়ে বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে চলে গিয়েছিল? এর মধ্যে মাকে আনতে হলে বলতে হয়, বাবা মাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল, গোঁড়া ব্রাহ্মণ অনাথনাথ রাজি হননি, তাই পলায়ন। আর খুন? এর মধ্যে তো মাকে আনাই যাচ্ছে না। এই দুটো ঘটনার একটাও ঘটেছে বলে আমার মনে হয় না। ঘটে থাকলে গুজব ছড়াতোই আর মনোরঞ্জন দত্ত সেকথা আমাদের অবশ্যই বলতেন। কিন্তু, তিনি বললেন যে বীরু সন্ন্যাসী হয়ে চলে গিয়েছিল। তার মানে, বীরুর স্বভাবচরিত্র নিয়ে কোনো খারাপ কথা তিনি শোনেননি। সম্ভবত, মায়ের অস্তিত্বের কথাই তাঁর অজানা। আমার মনে হয়, বীরুর নিরুদ্দেশ হবার কারণটাই তিনি জানতে পারেননি। তাহলে, কী ঘটে থাকতে পারে আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে?’
চয়ন গভীর মনোযোগ দিয়ে হৈমন্তীর কথা শুনছিল। বলল, ‘আমার কিন্তু খুন বা টাকাপয়সা নয়— অন্য ব্যাপারটার সম্ভাবনাই বেশি বলে মনে হচ্ছে। এই সুন্দরী চিংড়িটাকে দেখলে আন্দাজ করা যায় যে, বয়েসকালে কাকিমা কতটা সুন্দরী ছিলেন। তাঁর জন্য কাকাবাবুর যৌবনকালে যদি চিত্তচাঞ্চল্য হয়েই থাকে, তার জন্য তাকে দোষী বলা তো যায় না।’
‘প্রথম দিকে আমারও তাই মনে হয়েছিল। ভেবে দ্যাখ, এটাতো একটা রগরগে গল্প, এই শহরের লোক সেটা না-চটকে ছেড়ে দিত? সবাই কিন্তু বলেছে, অনাথনাথবাবুর ছেলে বিবাগি হয়ে চলে গিয়েছিল। এখানে প্রশ্ন ওঠে যে মা কে, কোথায় থাকত, বাবার সঙ্গে ভালোবাসাই বা হল কী করে? হতে পারে যে মা-র বাপের বাড়ি অন্য কোনো শহরে ছিল এবং সেই তরফেও প্রবল বাধা ছিল। সেক্ষেত্রে, এই বাড়িটা মা এত ভালো করে চিনল কী করে আর ওরা এই শহরেই বা ফিরে এল কেন? ঘটনাটা যখন ঘটে, তখন বাবা বাইশ আর মা আঠেরো। স্কুল থেকে পাশ করে বেরিয়ে সবে কলেজে ঢুকছে। তখন তার এই বাড়িতে যাতায়াত ছিল। কেন? অদ্ভুত ব্যাপার, বাবা আর মা একইসঙ্গে পালিয়েছিল যদি, এখানকার লোকেরা সেটা টের পেল না? আলাদা আলাদা পালিয়ে থাকলে সেই ঘটনা দুটো কেউ কানেক্টই বা করছে না কেন? উঁহু, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে।’
‘আজ কি সেটা আর বের করা সম্ভব হবে?’
‘হবে, যদি সেই সময়কার কোনো লোককে খুঁজে বের করতে পারি। মনোরঞ্জন দত্তকে বলে লাভ নেই। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে বাবার কাছে চলে যাবেন। তিনি অলরেডি বোধ হয় সন্দেহ করতে আরম্ভ করেছেন যে— সুব্রত রায়ই বীরু।’
‘তাহলে, তোর পছন্দমতো লোক পাবি কোথায়?’
হৈমন্তী বলল, ‘দাঁড়া, মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।’
বলে, পাশেই দরজার ধারে একটা টেবিলে বসে থাকা ধুতি আর ফতুয়া পরিহিত দোকানের স্থূলকায় মালিকের কাছে উঠে চলে গেল। প্রৌঢ় ভদ্রলোক তখন গভীর মনোযোগের সঙ্গে বাংলা খবরের কাগজ পড়ছিলেন। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে হৈমন্তী বলল, ‘আমি কি আপনার সঙ্গে কিছু কথা বলতে পারি?’
কাগজ থেকে মুখ তুলে ভদ্রলোক ভাবলেশহীন গলায় বললেন, ‘বলুন। কোন খাবারটা আপনাদের পছন্দ হয়নি?’
‘না না, আমি কোনো কমপ্লেন করতে আসিনি। আমি আপনার কাছ থেকে কয়েকটা খবর নিতে এসেছি।’
‘খবর নিতে এসেছেন? আপনি কে?’
‘আমি একজন সাংবাদিক, পুনায় একটা খবরের কাগজে আছি। পশ্চিমবাংলার পুরোনো শহরগুলোর ওপরে একটা ফিচার লিখছি। আপনি যদি সে ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করেন তো খুব উপকৃত হই। আপনার দোকানে চা খেতে ঢুকেছিলুম। আপনাকে দেখে মনে হল, আপনি হয়তো এই শহরের পুরোনো কথা জানেন।’
‘না না আমি কিছু জানি না।’
‘কাউকে জানেন যিনি আমাদের কিছু বলতে পারবেন? বিশেষ করে বটতলা পাড়ার কোনো লোক? আপনার দোকানে তো অনেকেই আসেন।’
‘বটতলা পাড়াই কেন?’
‘কারণ, ওখানকার বিশালাক্ষীর মন্দির না কি খুব প্রাচীন। সেই মন্দির দিয়েই আমার লেখাটা শুরু করব ভাবছি।’
‘বটে দাঁড়ান, ভেবে দেখি। ওখানে কিং জর্জ কলেজের অধ্যাপক বনমালীবাবু হয়তো আপনাকে সাহায্য করতে পারবেন।’
‘তাঁর বয়েস কত?’
‘বয়েস বেশি নয়। ইয়ংম্যান। তবে শুনেছি, খুব জ্ঞানী লোক।’
‘ওঁর চেয়ে বয়স্ক আর কেউ নেই?’
‘ওঁর চেয়ে বয়স্ক? ও হ্যাঁ, শরৎ কুণ্ডু মশাই আছেন। আশির কাছাকাছি বয়েস। মন্দিরের কাছেই থাকেন। মাথা এখনও পরিষ্কার, স্মৃতিশক্তি খুব প্রখর আর খুব গল্প করতে ভালোবাসেন। বিশেষত যত কেচ্ছার গল্প। তবে, তাঁর কাছে না-গেলেই ভালো করবেন।’
‘কেন? অশ্লীল গল্প করেন বুঝি।’
‘না, তা নয়। বড্ড বেশি কথা বলেন। একবার শুরু করলে থামতে পারেন না। সে মহাযন্ত্রণা!’
‘ও বাবা। তাহলে, আমরা বরং বনমালীবাবুর কাছেই যাই।’
বটতলা পাড়া শহরের কেন্দ্র বলা চলে। বেশ ঘিঞ্জি এলাকা, গায়ে গায়ে লাগা দোতলা-তিনতলা বাড়ি, রাস্তার দু-ধারে ছোটো-বড়ো অসংখ্য দোকান, ‘বিশ্রাম’ বলে একটা আবাসিক হোটেলও দেখা গেল। মূল রাস্তাটা চ্যাটার্জি পাড়ার দিক থেকে এসে স্টেশনের পাশ দিয়ে রেললাইন পেরিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে পাড়ার ভেতর দিয়ে, তার থেকে বেরিয়েছে শাখানদীর মতো মাঝেমাঝেই সরু সরু গলি। রাস্তার নাম প্রাণতোষ বিশ্বাস রোড।
লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল যে, শরৎ কুণ্ডু মশাই থাকেন আটত্রিশ নম্বরে। পঁয়ত্রিশ নম্বরের কাছাকাছি এলে উলটোদিকে আটত্রিশ নম্বরের বাড়িটা দেখা গেল। বেশ পুরোনো বাড়ি, খিলেন করা দরজা-জানলা, বাইরের দেওয়ালে শ্যাওলার ছোপ। বাড়ির মাঝখানে সদর দরজা, তার দু-পাশে লাল মেঝের দুটো বড়ো বড়ো রোয়াক। একটা রোয়াকের ওপর একজন টাকমাথা, সবুজ লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরিহিত, বৃদ্ধ ভদ্রলোক বসে ছিলেন।
একটা অদ্ভুত দৃশ্য লক্ষ করা গেল। রাস্তা দিয়ে যাঁরা যাচ্ছেন, তাঁরা আটত্রিশ নম্বরের কাছাকাছি এসেই হঠাৎ হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিচ্ছেন। শরৎবাবু তাঁদের কাউকে কাউকে ডাকছেন বটে কিন্তু তাঁরা হাত নেড়ে হনহন করে চলে যাচ্ছেন যেন তাঁদের ভয়ানক তাড়া। বাড়িটা পার হয়ে গিয়েই আবার কিন্তু তাঁরা দুলকি চালে হেঁটে যাচ্ছেন।
ব্যাপার দেখে চয়ন বলল, ‘খুব সাবধান। কুণ্ডুমশায়ের কাছে না-ঘেঁষে সবাই যেভাবে পালাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে ওঁর খপ্পরে পড়লে ছাড়া পাওয়া মুশকিল হবে। এর চেয়ে বনমালীবাবুই বোধ হয় ছিলেন ভালো।’
হৈমন্তী বলল, ‘পাগল নাকি? এখন জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা শোনার সময় কোথায়? আমাদের দরকার কেচ্ছা, বক্তৃতা নয়। শোন অদিতি, আমি তোকে চোখ টিপলে তুই পেটে হাত দিয়ে শুয়ে পড়বি। বলবি, ভয়ানক পেট ব্যথা করছে। তখন আমরা তোকে নিয়ে কেটে পড়ব।’
কুণ্ডুমশাই খুবই সন্দিগ্ধভাবে বললেন, ‘তোমরা আমার সঙ্গে কথা বলতে চাও? আমার সঙ্গে? না, মানে, আমার সঙ্গে তো কেউ কথা বলতে চায় না, তাই জিজ্ঞেস করছিলুম। আমি বুড়ো হয়ে গেছি, একজন ওল্ড হ্যাগ। কে আমার কথা শুনবে, বলো?’
হৈমন্তী বলল, ‘আমি এই জায়গাটার ওপরে একটা লেখা লিখছি। এখানকার কিছু লোকের সম্পর্কে জানতে চাই। তাই, আমরা আপনার কাছেই এসেছি। শুনলুম, আপনি এই শহরের সব খবরই রাখেন।’
‘নিশ্চয়ই রাখি। আমার জন্ম এখানে। আশি বছর ধরে এই শহরের হাওয়া খাচ্ছি। খবর রাখব না মানে? এখানকার সব কথা আমার মনে আছে। নাইন্টিন ফর্টি ওয়ানে এখানকার ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন হারওয়েল সাহেব। মি. টিমথি হারওয়েল। খুব ভালোবাসতেন আমাকে। আমাকে শারাট বলে ডাকতেন। তাঁর কথা বলি, শোনো।’
‘হারওয়েল নয়, অনাথনাথ রায় বলে কাউকে মনে পড়ে আপনার?’
‘অনাথনাথ? অঙ্কের মাস্টার? খুব মনে পড়ে। ছেলেরা তাঁকে ডাকত বকাসুর বলে। বিরাট লম্বা-চওড়া কুস্তিগিরের মতো চেহারা, প্রচণ্ড গায়ে জোর, মুখ ভরতি দাড়িগোঁফ আর বেজায় রগচটা। অনেকে ভাবত, অনাথবাবু ব্রাহ্ম, আসলে তা নয়। তিনি ছিলেন ইস্টবেঙ্গলের গোঁড়া বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ।’
‘উনি কোথায় থাকতেন?’
‘ওই যে দূরে সবুজ রঙের টিনের চালের বাড়িটা দেখছো, ওইখানে। ওবাড়িটা এখন চালের গোডাউন হয়েছে। তাঁর তিন ছেলে, এক মেয়ে ছিল। ছেলেদের মধ্যে বড়োটা ছিল ভালো, বাকি দুটো মহাবিচ্ছু, একেবারে নামকাটা সেপাই! মেয়েটা ছিল খুবই ছোটো। এখানে আসেন নাইন্টিন ফর্টি নাইনে। ফিফটি টুতে চ্যাটার্জি পাড়ায় বাড়ি করে উঠে যান। তারপর থেকে আর যোগাযোগ ছিল না। এখন বেঁচে আছেন কি না, জানি না।’
‘আপনি ওঁকে চিনতেন?
‘চিনবো না? এ বাড়ির সামনে দিয়েই তো যাতায়াত করতেন। আমার দোকান থেকেই বাসন-কোসন কিনতেন।’
‘আপনার সঙ্গে কথাবার্তা হত।’
‘অবশ্যই। তখন আমি দোকানে বসতুম। যখনই আসতেন, গল্পটল্প করতেন। বাঙাল ভাষায় কথা বলতেন। শুনতে খুব মজা লাগত।’
‘আচ্ছা, শুনেছি উনি সাতচল্লিশে উদবাস্তু হয়ে এখানে আসেন। আপনি বলছেন, কমলপুরে আসেন উনপঞ্চাশে। এই দু-বছর উনি কোথায় ছিলেন? সেটা কখনো বলেছেন?’
‘বলেছেন বই কী! এখান থেকে চাঁদার উজানে মাইল পাঁচেক গেলে হরিজীবনপুর গ্রাম। সেই গ্রামের জমিদার রামানন্দ সিংগির কাছারিতে অ্যাকাউন্ট্যান্ট ছিলেন। রামানন্দবাবু ওঁকে শিয়ালদা স্টেশন থেকে তুলে এনেছিলেন। অসম্ভব কম মাইনে ছিল তো। সংসার চলত না। পরে অবশ্য ওঁর জ্ঞান দেখে রামানন্দবাবু ওঁকে এখানকার বামাপদ হাইস্কুলে নিয়ে আসেন। স্কুলটাতো সিংগিদের দানেই তৈরি হয়েছিল। ওঁদের টাকাতেই চলত। এখন সেই সিংগি পরিবারও নেই, টাকাও বন্ধ। আজ দেখো গিয়ে, সেই স্কুলের কী হাঁড়ির হাল হয়েছে। তখন অবশ্য খুব রমরমা ছিল।’
‘সিংহ পরিবার নেই কেন? কোথায় গেল তারা?’
‘কোথায় আর যাবে? ফৌত হয়ে গেছে।’
‘মানে, সবাই মারা গেছেন? সে কত বছর আগেকার ঘটনা?’
‘কত বছর? দাঁড়াও, বলছি। সে বছরই চাঁদার ওপরে কাঠের পুল হল। তা হলে নাইন্টিন সিক্সটি সেভেন কী সিক্সটি এইট হবে। মানে ধরো প্রায় চল্লিশ বছর আগে। সে কী ভয়ংকর কাণ্ড! আজ হলে কাগজ আর টেলিভিশনে হুলুস্থুল পড়ে যেত। অথচ, তখন আমরা কেউ কিছু জানতেই পারিনি। জেনেছি অনেক পরে।’
‘কী জেনেছেন? কোনো গণ্ডগোল হয়েছিল? সবাই মারা গেলেন কী করে?’
‘সবাই মানে— রামানন্দ আর তাঁর মেয়ে। সে এক ভয়ানক গল্প। তখন আমরা নানা রকমের গুজব শুনেছি। রামানন্দ নাকি ডাকাতের হাতে খুন হয়েছিলেন। তাঁর একটাই মেয়ে ছিল। তার নাম ছিল খুব সম্ভবত রানি। অল্পবয়েসে তার মা মারা যান। সে সেই খুনের দৃশ্য সহ্য করতে না-পেরে পাগল হয়ে যায়। তখন রামানন্দবাবুর প্রাইভেট সেক্রেটারি বৃন্দাবন বা বিনু চৌধুরি তাকে রাঁচিতে রেখে আসে। সেখানেই সে মারা যায়। বিনু চৌধুরি অন্তত এই কথাই বলে থাকে। লোকে কিন্তু অন্য কথা বলে। কেউ বলে, ডাকাতির ঘটনাটা বিনু চৌধুরিরই সাজানো। তারই ভাড়াটে লোকেরা রামানন্দবাবুকে মেরে তাঁর মেয়েকে তুলে নিয়ে যায়। কেউ বলে, রামানন্দবাবুকে তাঁর মেয়েই কোনো কারণে পাগল হয়ে গিয়ে গুলি করে মারে। বিনুকেও মারতে গিয়েছিল। সে কোনোরকমে নিজের প্রাণ বাঁচায়। তখন মেয়েটা চাঁদার জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। আবার কেউ বলে, বিনু চৌধুরি নিজেই রামানন্দবাবুকে খুন করে তাঁর মেয়েটাকে হাপিস করে দেয়। বুঝলে না, ওসব জমিদারদের ব্যাপার। সত্যি-মিথ্যে বোঝা কঠিন। ওদের বাড়ির ভেতরে যা হয়, বাইরের কাকপক্ষীও জানতে পারে না। মোটকথা, সেই ঘটনার পর মেয়েটাকে আর দেখা যায়নি।’
একটা গভীর শ্বাস নিয়ে যথাসাধ্য স্বাভাবিক গলায় হৈমন্তী বলল, ‘পুলিশ কোনোরকম তদন্ত করেনি? তার ফল কী হয়েছিল?’
‘পুলিশ? তুমিও যেমন! পুলিশ তো তখন বিনু চৌধুরির হাতের মুঠোয়। সব এক গেলাসের ইয়ার। তদন্ত একটা নাম কা ওয়াস্তে হয়তো হয়েছিল। আমি জানি না।’
‘বিনু চৌধুরি এখন কোথায়?’
‘ওই হরিজীবনপুরেই। বে-থা করল না। রামানন্দবাবুর টাকা দিয়েই তাঁর জমিদারিটা কিনে নিল। চালাতে পারল না। পারবে কোত্থেকে? অত ফুর্তি আর শিকার পার্টি করলে কি আর চলে? রামানন্দবাবু ভালো লোক ছিলেন, এটা একেবারে নরকের কীট! হেন খারাপ কাজ নেই যা ওটা করতে পারে না। বিনু চৌধুরির স্বভাব চরিত্রের কথা তাহলে শোনো।’
হৈমন্তী বলল, ‘তার আগে বলুন, কমলপুরে আসার পরেও কি অনাথনাথের সঙ্গে হরিজীবনপুরের কোনো যোগাযোগ ছিল?’
‘ছিল। অনাথবাবু সিংগি পরিবারের প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ ছিলেন। এখানে থাকার সময় আর শুনেছি তার পরেও দুর্গাপুজো, কালীপুজো বা অন্যান্য ছুটিছাটায় সপরিবারে হরিজীবনপুরে যেতেন। জমিদার বাড়িতে তো তাঁদের অবারিতদ্বার ছিল। এবার শোনো বিনু চৌধুরির গল্প।’
হৈমন্তী অদিতির দিকে তাকিয়ে প্রবলবেগে চোখ টিপল।
দোকানে যথারীতি সাইকেল জমা দিয়ে চারজন বাড়ির দিকে হাঁটছিল।
চয়ন বলল, ‘ছবিটা বেশ পরিষ্কার হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তাই না?’
হৈমন্তী চিন্তিতভাবে বলল, ‘খুব একটা নয়। এটা অবশ্যই বোঝা গেল যে বিনু চৌধুরি সম্পত্তির লোভে তার অন্নদাতাকে খুন করে তার মেয়েকে হাপিস করে দেয়। কিন্তু, সেই মেয়েই যে মা, সেটা প্রমাণ হল না। এরকম ঘটনা সারা ভারতবর্ষের জমিদারিগুলোতে আকছার ঘটেছে। আর বিনু চৌধুরি যদি সেই মেয়েকে রাঁচি বা অন্য কোথাও নিয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে তার মধ্যে বাবাকে ফিট করা যাচ্ছে না। যদি ধরে নিই যে, যে বছর বাবা নিরুদ্দেশ হয়, সে বছরেই খুনের ঘটনাটা ঘটে, তাহলেও একটা প্রশ্ন থেকেই যায়।’
‘কী প্রশ্ন?’
‘উনিশ-শো আটষট্টিতে বাবা কলকাতায় এমএসসি পড়ছে বা সবে পাশ করেছে, অনাথনাথ রয়েছেন কমলপুরে আর রামানন্দ খুন হচ্ছেন হরিজীবনপুরে। এর মধ্যে যোগসূত্রটা কোথায়?’
‘আমি কিন্তু একটা যোগসূত্র দেখতে পাচ্ছি।’
‘কী দেখতে পাচ্ছ?’
‘অনাথনাথ প্রায়ই সপরিবারে হরিজীবনপুরে যেতেন। সেখানে তাঁর কনিষ্ঠপুত্রের সঙ্গে জমিদারনন্দিনীর মোলাকাত এবং প্রেম। বিনু চৌধুরি রামানন্দকে খুন করে তাঁর মেয়েকে যেখানে রেখে এলেন, কনিষ্ঠপুত্র তাঁদের অনুসরণ করে গিয়ে সেখান থেকে নায়িকাকে উদ্ধার করে ভাগলবা।’
‘তোমার মুণ্ডু! মনে রেখো, অনাথনাথ জমিদারবাড়ির একজন কর্মচারী মাত্র। কনিষ্ঠপুত্রের মধ্যে জমিদারনন্দিনীর প্রতি কিছুমাত্র আকর্ষণ আছে জানতে পারলে মেরে তার হাড় গুঁড়ো করে দিতেন। তা ছাড়া, বাবা যখন কলকাতায় পড়তে যায় তখন এখান থেকে ডেলি প্যাসেঞ্জারি তো করত না, নিশ্চয়ই হোস্টেলে বা মেসে থাকত। তার মানে পনেরো বছর বয়েস থেকে তার হরিজীবনপুরের সঙ্গে যোগাযোগ কমে যাওয়ার কথা। জমিদারনন্দিনীর বয়েস তখন দশ বা এগারো। সেই বয়েসে, আর যাই হোক, প্রেম হয় না।’
‘সে যুগে শুনেছি ওইরকম বয়েসেই প্রেম-ট্রেম হত। ন-বছরে বিয়ে হত, বারো পেরোলেই মেয়েরা বুড়ি হয়ে যেত। কাজেই, তার আগেই এসব রোমান্স-টোমান্স যা করবার করে ফেলতে হত।’
‘ছাই হত! সে যুগটা পৌরাণিক যুগ নয়, আধুনিক যুগ। নায়িকার যখন আঠেরো বছর বয়েস, তখনও যে নায়ক কলকাতা থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে সকলের অজান্তে, তার কোনো প্রমাণ নেই। বিনু চৌধুরি সমেত কেউই কিন্তু একসঙ্গে দু-জনকে কখনোই সন্দেহ করেনি। হতে পারে, নায়ক তখন কমলপুরেই ছিল। সে খুনের কথা জানল কী করে? কুণ্ডুবাবুর কথায় জানা যাচ্ছে যে, এখানকার লোক খবরটা পেয়েছে ঘটনার অনেক পরে। যদি ধরে নিই যে নায়ক, যেভাবেই হোক, খুব তাড়াতাড়ি খবরটা পেয়েছিল তাহলে কি সে জলপথে তিন মাইল বা স্থলপথে পাঁচ-ছ-মাইল গিয়ে নায়িকাকে উদ্ধার করেছিল? বিনু চৌধুরি কী তাহলে খুনের সঙ্গে সঙ্গে নায়িকাকে পাচার না-করে নায়কের হরিজীবনপুরে এসে তাকে অনুসরণ করবার অপেক্ষায় বসে ছিল?’
‘হয়তো তখন নায়ক হরিজীবনপুরেই ছিল।’
‘তাহলে সেই প্রশ্নটাই থাকে যে, বিনু চৌধুরি তাকে সন্দেহ করল না কেন? তা যদি করত তাহলে তার ভাড়াটে লোকেরা এখানে এসে নায়ক বা তার বাবা অনাথনাথের ওপর চড়াও হত। দু-জনের কেউ-ই ভীরুপ্রকৃতির লোক ছিলেন না। তাঁরা ছেড়ে কথা বলতেন না, তার ফলে একটা গোলমাল বাঁধতই। থানা-পুলিশ আর মামলামোকদ্দমাও হতে পারত। আর সেটা আমরা ঠিক জানতে পারতুম।’
সুমিত বলল, ‘ও বাবা! এ যে একেবারে, যাকে বলে— কুয়াশাবৃত ঘনীভূত রহস্য।’
‘ঠিক বলেছিস। আসল রহস্যগুলো কুয়াশাবৃতই রয়ে গেল। এক, মা যদি রামানন্দ সিংহের মেয়েই হয়, তাহলে বাবা তাকে নিয়ে অজ্ঞাতবাসে গেল কেন? বিনু চৌধুরির হরিজীবনপুরের লোকাল থানার ওপরে ইনফ্লুয়েন্স থাকতে পারে, কমলপুরেও কি ছিল? এখানকার জুডিসয়ারিও কি তার পকেটে ছিল? নিজের অতীতটা মুছে ফেলার চেষ্টা তাহলে কীসের জন্য? আর দুই, মা আমাদের বাড়িটার খুঁটিনাটি জানল কী করে? সন্দেহ নেই যে মা এই বাড়িতে আসত। কেন?’
একটু চুপ করে থেকে আবার হৈমন্তী বলল, ‘আমার কি মনে হচ্ছে জানিস? এই দু-নম্বর প্রশ্নটার উত্তর আমি জানি, কিন্তু সেটা কিছুতেই ধরতে পারছি না। কী একটা পয়েন্ট মিস করে যাচ্ছি। কী সেটা?’
অদিতি বলল, ‘আজ রাত্তিরে ভালো করে ঘুমিয়ে নে। দেখবি, কাল ঠিক উত্তরটা পেয়ে যাবি।’
‘আর একটা প্রবলেম। বোঝাই যাচ্ছে যে, যে কারণে বাবার অজ্ঞাতবাস সেটা এখনও মেটেনি, জিন্দা আছে। তাহলে, বাবা এই শহরে আবার ফিরে এল কেন? এখানে এমন অনেকেই আছেন যাঁরা গোঁফহীন টাকমাথা সত্ত্বেও তাকে চিনে ফেলতে পারেন। সেই রিস্কটা নেওয়া কি খুব জরুরি ছিল? ভাবছি, আর একবার কোর্টে যেতে হবে।’
চয়ন বলল, ‘হরিজীবনপুরকে কি বাদই দিলি?’
‘না, বাদ একেবারেই দিচ্ছি না। সম্ভাবনাটা যে খুবই প্রবল। আবার মেলাতেও পারছি না। নাঃ, আমার মাথাটা দেখছি একেবারেই গেছে!’
বলতে বলতেই মনোরঞ্জন দত্তের গাড়ি এসে পাশে দাঁড়াল। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে মনোরঞ্জন বললেন, ‘এই যে চারমূর্তি, কেমন আছো তোমরা? আর ভূতের ভয়-টয় পাওনি তো?’
হৈমন্তী হাত-পা ছুড়ে বলল, ‘আরে, কী আশ্চর্য! আপনি? এক্ষুনি আপনার কথাই ভাবছিলুম। আপনি লক্ষ বছর বাঁচবেন।’
‘সেটা সুসংবাদ নয়। তা, আমার কথা হচ্ছিল কেন?’
‘সেদিন আপনার কাছে অনাথ রায়মশায়ের কথা শুনে তাঁর প্রতি আমার কৌতূহল খুব বেড়ে গেছে। ভাবছি, তাঁকে নিয়ে একটা কিছু লিখব। ছিন্নমূল একটা মানুষের জীবনের উত্থান-পতন, একেবারে গল্পের মতো। ওঁর সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য জানবার জন্যে আপনাকে বিরক্ত করতে যাব ভাবছিলুম।’
‘বিরক্ত আবার কী? তুমি যে সাহিত্যও করো তা ভাবতেই পারিনি। এতটুকু মেয়ে, কত কিছু করে যাচ্ছ। কী জানতে চাও, বলো।’
‘এখানে নয়, মানে এরকম রাস্তায় দাঁড়িয়ে নয়। একটু সময় নেব আপনার। কোথায় গিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করব, বলুন।’
‘এক কাজ করো। কাল বিকেলে বামাপদ হাইস্কুলে এসো। পাঁচটা নাগাদ। আমি ওখানে যাব একটা স্কুল-কমিটির মিটিং অ্যাটেন্ড করতে। পাঁচটার মধ্যে মিটিং শেষ হয়ে যাবে। তারপরে ওখানে বসেই তোমাদের সঙ্গে কথা বলব। যদি অসুবিধে থাকে, আমার বাড়িতে সন্ধ্যে বেলা চলে আসতে পারো। আমার ঠিকানা আর ফোন নম্বর লিখে নাও।’
ঠিকানা আর ফোন নম্বর ডায়েরিতে লিখে নিয়ে হৈমন্তী বলল, ‘না, না। আমাদের কোনো অসুবিধে নেই। বাড়িতে বিশ্রামের সময় বিরক্ত করব না, স্কুলেই যাব।’
বিকেল বেলা অদিতি জিজ্ঞাসা করল, ‘এবার আমরা কোথায় যাব রে দিদি?’
হৈমন্তী বলল, ‘চল, আজ নদীর ধারে ঘুরে আসি।’
শুনে সকলেই খুশি হল।
নদীটি সত্যিই খুব কাছে। আমবাগানের ভেতর দিয়ে পায়ে চলা পথ। আশেপাশে বাড়িঘর নেই। যথার্থই খুব শান্ত নির্জন পরিবেশ। নদীটা চওড়ায় পঁচিশ-তিরিশ ফুটের বেশি হবে না। তিরতির করে বয়ে চলেছে। দু-একটা ডিঙিনৌকো বেয়ে গ্রামের লোকেরা যাতায়াত করছে। আমবাগানের রাস্তাটা শেষ হয়েছে একটা জরাজীর্ণ ঘাটে। নদীর অন্য পাড়ে দিগন্তবিস্তৃত ধান খেত, আর বহুদূরে একটি গ্রাম। পাখির ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।
একটি মাঝবয়সি লোক ঘাটের হাড়জিরজিরে সিঁড়ির ওপর বসে নদীতে ছিপ ফেলে একাগ্রচিত্তে বসে ছিল। হৈমন্তী এগিয়ে গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, এখান থেকে হরিজীবনপুর কত দূর?’
লোকটি ছিপ থেকে চোখ না-তুলে বলল, ‘অনেক দূর।’
‘নৌকোয় যেতে কতক্ষণ লাগে?’
‘অনেকক্ষণ।’
‘সকালে রওনা হলে দুপুরের মধ্যে পৌঁছোনো যাবে?’
‘যেতে পারে।’
‘সন্ধ্যেও হয়ে যেতে পারে?’
‘পারে।’
হতাশমুখে হৈমন্তী সঙ্গীদের কাছে ফিরে এল। বলল, ‘চমৎকার! এরকম ইনফর্মেশন পেতে থাকলে রহস্যভেদ একেবারে জলের মতো সহজ হয়ে যাবে।’
চয়ন বলল, ‘তুইও যেমন। দেখছিস না, লোকটা ছিপ ফেলে বসে আছে? মাছ ধরার সময় কথা বলতে হয় না, জানিস না?’
‘না তো। কথা বলতে হয় না কেন?’
‘কারণ, গলার আওয়াজ পেলে মাছ পালিয়ে যেতে পারে।’
অদিতি বলল, ‘জলের ভেতরে মাছ গলার আওয়াজ শুনতে পাবে?’
‘পেতেই পারে। মাছ কি কালা না কি? ওরা সব শুনতে পায়। তুই ঘাটে বসে একটা ইংরেজি গান ধর, দেখবি নদীসুদ্ধু মাছ লাফাতে লাফাতে হরিজীবনপুরের দিকে পালাচ্ছে।’
‘বাজে কথা বোলো না। আমার গান শুনে কত লোক প্রশংসা করেছে, তুমি জানো?’
‘তারা আমাদের বঙ্গবাসী রুই কাতলা নয়, নিশ্চয়ই স্যামন বা হেরিং মাছ। সেগুলো আবার পাতে দেওয়া যায় না।’
হৈমন্তী বলল, ‘তোরা থামবি? দেখছিস একটা কথা চিন্তা করছি। তার মধ্যে যত ভ্যাজরাং ভ্যাজরাং।’
অদিতি বলল, ‘কী ভাবছিস রে দিদি?’
‘একটা সমস্যা, তার উত্তরটা আমার সামনে আছে অথচ সেটা ধরতে পারছি না। নাঃ, আমাদের একবার হরিজীবনপুরে যেতেই হবে। লোকাল লোকেদের কাছে খবর নিতে হবে যে সেই সময়ের কোনো লোক এখনও ওখানে থাকে কি না। তখন যারা জমিদারবাড়িতে কাজ করত, তারা এখন নিশ্চয়ই খুব বুড়ো হয়ে পড়েছে। সেইরকম একটা লোককে ধরতে হবে।’
চয়ন বলল, ‘একজন বাইরের লোকের কাছে তারা জমিদারবাড়ির অন্দরমহলের ব্যাপারে মুখ খুলবে কেন? ওই ছিপওয়ালা লোকটার মতোই উত্তর পাবি। ধরি মাছ না ছুঁই পানি।’
‘ঠিক কথা। তবু চেষ্টা করতে হবে। চেষ্টায় কি না হয়, কি না হয় শেষটায়।’
রাত্রে সবাই শুতে গেলে যথারীতি বাবা, মা আর মেয়ের কনফারেন্স বসল।
সুব্রত বললেন, ‘তোর ইনভেস্টিগেশনের ঝুলিতে আর কী কী যোগ হল?’
হৈমন্তী বলল, ‘বলব, তার আগে বলোতো, মা-র নাম কি কখনো রানি ছিল?’
চমকে উঠলেন সুব্রত। বললেন, ‘কস্মিনকালেও না। তোর মায়ের নাম ইভা। অনাথ আশ্রমের ক্রিশ্চান মিশনারিরা ওই নাম রেখেছিল।’
‘আচ্ছা, প্রতিভা থেকে ইভা হয়নি তো?’
সুব্রতর গলাটা অধৈর্য শোনাল। খানিকটা যেন বিরক্তভাবে বললেন, ‘না। বললুম তো, তোর মায়ের নাম ইভা। আর কিছু নয়।’
‘বেশ, এবার শোনো আমাদের ঝুলিতে আর কী কী খবর এল। সবচেয়ে ইমপর্টেন্ট খবর হল, আজ থেকে সাঁইত্রিশ-আটত্রিশ বছর আগে, হরিজীবনপুর গ্রামে এক ভদ্রলোক খুন হয়েছিলেন। তাঁর একটি মেয়ে ছিল। ঘটনার পর থেকে সে নিরুদ্দেশ। এই ঘটনার নানারকম ভার্সান এখনও এখানকার কিছু কিছু লোক মনে রেখেছে।’
বলেই হৈমন্তী ইভার দিকে তাকাল। ইভা চোখ বুজে বসেছিলেন। তাঁর মুখে একটা তীব্র যন্ত্রণার অভিব্যক্তি।
সুব্রত বললেন, ‘তাতে তোরই বা কী, আমারই বা কী?’
‘কিছু না, কিছু না। দ্বিতীয় খবরটি হল, এখানকার সিনিয়রমোস্ট অ্যাডভোকেট, মি. মনোরঞ্জন দত্তের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়েছে। তাঁর ঠিকানা আর ফোন নম্বর আমার কাছে আছে। যদি চাও তো দিতে পারি।’
সুব্রত কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ক্ষীণকণ্ঠে বললেন, ‘ঠিক আছে, দিস। উকিল মোক্তারের সঙ্গে পরিচয় করে রাখা ভালো। কাজে লেগে যেতে পারে।’
হৈমন্তী ডায়েরির একটা পাতা ছিঁড়ে তাতে ঠিকানা আর ফোন নম্বর টুকে সুব্রতর হাতে দিল। বলল, ‘ভালো কথা। কাল বিকেলে আমরা যাচ্ছি মি. মনোরঞ্জন দত্তের সঙ্গে কথাবার্তা বলবার জন্য।’
‘একজন উকিলের সঙ্গে তোদের কী কথা? মামলামোকদ্দমা করবি না কি? বাড়াবাড়ি করছিস কিন্তু।’
‘কিছুমাত্র না। আমরা যাচ্ছি অনাথনাথ রায়ের জীবন সংক্রান্ত তথ্য জোগাড় করতে। আমি ওঁকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখব কিনা, তাই জন্য।’
বেশ বিচলিত অবস্থায় উঠে দাঁড়ালেন সুব্রত। রাগতভাবে বললেন, ‘যা খুশি কর! যখন বিপদে পড়বি, তখন বুঝবি।’
বলে, দুমদুম করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে চলে গেলেন। উদবিগ্ন বিপর্যস্ত ইভা তাড়াতাড়ি তাঁর পেছনে পেছনে গেলেন।
সকাল বেলা সাড়ে ন-টার সময় হৈমন্তী বলল, ‘আমি একবার গার্লস স্কুলে যাচ্ছি। তোরা যদি যেতে চাস তো আসতে পারিস।’
সুমিত বলল, ‘গার্লস স্কুলে কেন? দত্তসাহেব তো পাঁচটার সময় বয়েস স্কুলে যেতে বললেন।’
‘এখন দত্তসাহেবের কাছে যাচ্ছি না।’
‘তবে?’
‘চল না। গেলেই দেখতে পাবি।’
ওরা যখন গার্লস স্কুলের গেটে পৌঁছোল, তখন ছাত্রীদের দল হো হো করতে করতে ভেতরে ঢুকছে। দেখা গেল এই স্কুলের প্রতিষ্ঠা ১৯০০ সালে। এর অবস্থাও প্রায় বয়েস স্কুলেরই মতো।
ছাত্রীদের মধ্যে একজন এগিয়ে এল। জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনারা কি কাউকে খুঁজছেন?’
হৈমন্তী বলল, ‘হ্যাঁ। আমরা একবার হেডমিস্ট্রেসের সঙ্গে দেখা করতে চাই। এখন কি দেখা করা যাবে?’
মেয়েটি বলল, ‘কেন যাবে না? আপনারা ভেতরে আসুন। ডান দিকে প্রথম যে পর্দা ঝোলানো ঘরটা, ওটাই হেডমিস্ট্রেসের।’
‘উনি কি এসেছেন?’
‘হ্যাঁ, এসে গেছেন। দেখছেন না, দরজা খোলা।’
‘ঢুকব কী করে?’
‘দরজায় নক করবেন, উনি ডেকে নেবেন।’
চয়ন জিজ্ঞাসা করল, ‘উনি কি খুব বদরাগী? বকবেন না তো?’
মেয়েটি হেসে ফেলল। বলল, ‘বকবেন কেন? একটু গম্ভীর আছেন, তবে রাগী নন।’
হেডমিস্ট্রেস একজন প্রৌঢ় অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মহিলা। নাম মিস ভেরোনিকা গোমস, কথা বললেন ইংরেজিতে। চারজনকে বসতে বলে, তাদের আসবার কারণ জানতে চাইলেন।
হৈমন্তী বিনয়ের সঙ্গে বলল, ‘আমরা আপনার কাছে একটা ইনফর্মেশন জানতে এসেছি। আপনি আমাদের সাহায্য করলে অত্যন্ত বাধিত হব।’
মিস গোমস হৈমন্তীর কথা শুনে খুশি হলেন। বললেন, ‘কী ইনফর্মেশন?’
‘আমরা জানতে চাইছিলুম, উনিশ-শো সাতষট্টি বা আটষট্টি সাল নাগাদ আপনাদের স্কুলে রানি বা প্রতিভা সিনহা নামে কোনো মেয়ে পড়ত কি না। সেই ইনফর্মেশনটা কি আজ আর পাওয়া সম্ভব?’
‘সম্ভব। দু-হাজার সালে আমাদের স্কুলে যে শতবার্ষিকী উৎসব হয়েছিল, তখন স্কুলের শুরু থেকে এক-শো বছরের সব ছাত্রীর নামসহ একটা স্যুভেনির বেরিয়েছিল। তাতেই পাওয়া যাবে।’
‘সেই স্যুভেনির কোথায় পাওয়া যাবে?’
‘এখানেই পাবেন। একটু বসুন। বইটা আনছি।’
বলে উঠে গিয়ে আলমারি থেকে একটা মস্ত মোটা বই নিয়ে এলেন। নাকের ওপর চশমা লাগিয়ে পাতা ওলটাতে ওলটাতে বললেন, ‘এই মেয়েটি কি আপনার আত্মীয়?’
হৈমন্তী বলল, ‘না, আত্মীয় নন। আমার এক প্রতিবেশী বন্ধুর মা। তাঁর ছেলেবেলা না কি এই শহরে কেটেছে। আমরা বোম্বেতে থাকি, সেখানেই বড়ো হয়েছি। আমার বন্ধুটি এদিকে বড়ো একটা আসে না। সেই এটা জানতে চায়। আমার বাবা এখানে বাড়ি কিনেছেন শুনে আমাকে এই খবরটা সংগ্রহ করতে বলেছে।’
‘আপনারা বোম্বেতে থাকেন? ওখান থেকে এসে এখানে থাকতে পারবেন?’
‘কেন পারব না? এই জায়গাটা তো খুব সুন্দর। শান্ত পরিবেশ।’
‘হ্যাঁ, তা বটে। কোন সাল বললেন? সাতষট্টি। না, এখানে সিনহা কেউ নেই। আটষট্টি দেখি। এখানে আছে। দু-জন সিনহা। একজন শান্তা সিনহা, বটতলাপাড়া, কমলপুর।’
‘আর অন্যজন’
‘সে এখানে থাকত না। তার নাম মহারানি সিনহা। সে থাকত হরিজীবনপুরে।’
হৈমন্তীর গলাটা কেঁপে গেল। কোনোরকমে বলল, ‘না, মিলল না। আচ্ছা, হরিজীবনপুর তো এখান থেকে অনেক দূর। সেখান থেকে ছাত্রীরা আসে?’
‘আসে বই কী। কাছেপিঠে এত বড়ো স্কুল তো আর নেই। যারা ভালো এডুকেশন পেতে চায়, তারা আসে। আমিই জনাতিনেক ছাত্রীকে দেখেছি। আসাটা তো খুব কঠিন নয়। হরিজীবনপুর থেকে বাসে আসতে লাগে আধঘণ্টা থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। বাস যখন চালু হয়নি, তখন আসত নৌকোয়। আটটার সময় হরিজীবনপুরের ঘাট থেকে নৌকোয় উঠলে এখানে চ্যাটার্জি পাড়ার ঘাটে ন-টা থেকে সাড়ে ন-টার মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যেত। সেখান থেকে হেঁটে বা সাইকেলরিকশায়। এখন অবশ্য নৌকোয় আর কেউ আসে না।’
‘বাস কতদিন চালু হয়েছে।’
‘তা, অনেক দিন। কুড়ি বা পঁচিশ বছর তো হবেই।’
‘আর একটা প্রশ্ন। আটষট্টিতে কি রায় কেউ ছিল?’
‘রায়? হ্যাঁ, তিনজন ছিল। রমলা রায়, থাকত ওই বটতলা পাড়ায়। স্বাতী রায়, থাকত চ্যাটার্জি পাড়ায়। আর শ্রীলেখা রায়, থাকত মার্কেট রোডে। আর কিছু?’
হৈমন্তী বলল, ‘না, আর আপনাকে বিরক্ত করব না।’
বলে প্রচুর ধন্যবাদ জানিয়ে উঠে পড়ল।
হৈমন্তী মাথা নীচু করে হাঁটছিল। সুমিত জিজ্ঞাসা করল, ‘কিছু বুঝলি?’
হৈমন্তী মুখ তুলে ম্লান হেসে বলল, ‘বুঝেছি। প্রায় চল্লিশ বছর আগেকার নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কের ব্যাপারটা, সবটা না হলেও, অনেকটাই পরিষ্কার হল।’
‘তুই যে কী ধরতে পারছিলি না, সেটার কিছু হল?’
‘হ্যাঁ, হল।’
‘কী ধরতে পারছিলি না?’
‘ধরতে পারছিলুম না যে মা কেন বা কীভাবে এ বাড়িতে আসত।’
চয়ন বলল, ‘এই ব্যাপার? সে তো সোজা। হরিজীবনপুরের চেনা লোকের বাড়িতে আসতেই পারে। স্কুল থেকে বেরিয়ে চ্যাটার্জি পাড়ার ঘাটে যাওয়ার পথে, কিছু না হোক জল খেতে আসতে বাধা কোথায়?’
‘বাধা ছিল। জমিদারের মেয়ে তার বাবার একজন কর্মচারীর বাড়িতে জল খেতে আসতে যে পারে না তা নয়, কিন্তু তার পক্ষে সে বাড়ির খুঁটিনাটি জানাটা কি অস্বাভাবিক নয়?’
‘তা সে প্রবলেমটার সমাধান হল কী করে?’
‘আরে, আমি তো স্টুপিডের মতো সেটাই মিস করে যাচ্ছিলুম। মা তার বাবার একজন প্রাক্তন কর্মচারীর বাড়িতে আসত না, আসত তার ক্লাসফ্রেন্ডের বাড়িতে। সম্ভবত, সে তার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল। একমাত্র সে ক্ষেত্রেই বাড়িটার খুঁটিনাটি তার পক্ষে জানা সম্ভব। আমাদের পিসি স্বাতী রায়কে আগাগোড়াই বাদ দিয়ে যাচ্ছিলুম। মিস গোমসের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ আইডিয়াটা মাথায় এল। অন্ধকারে ছোড়া ঢিল একেবারে ঠিক জায়গায় গিয়ে লেগেছে।’
‘তোর পিসিই যে স্বাতী রায়, সেটা কি তুই নিঃসন্দেহে জানিস?’
‘একেবারে যে নিঃসন্দেহ তা বলতে পারছি না। আজকের মধ্যেই ক্লিয়ার করে নেব।’
দুপুর বেলা খাওয়ার পরে টেবিলে বসেই গল্প হচ্ছিল। এ কথা-সে কথার পর হৈমন্তী বলল, ‘আচ্ছা মা, তুমি যে স্কুলে পড়তে, সেখানে তোমার অনেক বন্ধু ছিল?’
ইভা বললেন, ‘ছিল বই কী।’
‘তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড কে ছিল মা? স্বাতী?’
সুব্রত আর ইভা ভয়ানক চমকে উঠে স্তম্ভিত হয়ে হৈমন্তীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। একটু সামলে নিয়ে ইভা বললেন, ‘না, তার নাম ছিল খুকি।’
ভীষণ গম্ভীর হয়ে সুব্রত বললেন, ‘তুই কার কাছ থেকে এইসব অদ্ভুত অদ্ভুত খবর জোগাড় করছিস? যত সব বাজে লোক। কী কুক্ষণে যে তোদের সঙ্গে এনেছিলুম! এখন তোরা গেলে বাঁচি।’
‘আমি কিন্তু বাঁচি না, বাবা। আমরা শূন্য হাতে ফিরে যাব না। যা শুরু করেছি, সেটা শেষ করেই যাব।’
‘কী যে তুই শুরু করেছিস তা তুইই জানিস। আবার বলছি, ক্ষ্যামা দে মা! তোর ইনভেস্টিগেটেড জার্নালিজম বন্ধ কর। তাতে তোদেরই মঙ্গল।’
বলে সুব্রত উষ্মার সঙ্গে প্লেট সরিয়ে উঠে পড়লেন। ইভাও উঠে টেবিল পরিষ্কার করতে করতে বললেন, ‘তোদের বাবা ঠিকই বলেছে। এই রোদে ঘুরে অকারণে নিজেদের শরীর খারাপ করছিস আর চয়নকে খাটিয়ে মারছিস। বেচারির এখানে না-এলেই ভালো হত। শান্তিতে ছুটিটা কাটাতে কীসের অসুবিধে তোদের? এসব বাদ দে না। আজ বিকেলেও বেরোবি না কি?’
‘হ্যাঁ মা, বেরুব। একবার স্কুলে যাব। সেখানে কিছু কাজ আছে।’
‘কী এমন কাজ তোর স্কুলে? না গেলে হয় না?’
‘না মা, যেতেই হবে। কী কাজ, পরে তোমাকে সব বলব।’
পাঁচটার সময় ওরা স্কুলে পৌঁছোল। গেটের বাইরে পরিচিত অস্টিন গাড়িটা ছাড়া আরও দু-তিনটে গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। তার মধ্যে একটা পুরোনো মডেলের বিরাট আট সিলিন্ডারের হাডসন। ভেতরে কাউকে দেখা গেল না। তবে, লাইব্রেরি থেকে উত্তেজিত কথাবার্তার আওয়াজ পাওয়া গেল।
চয়ন বলল, ‘মিটিং এখনও ভাঙেনি মনে হচ্ছে। এখানেই অপেক্ষা করবি, না ঘুরে আসবি?’
হৈমন্তী বলল, ‘কোথায় আর ঘুরব? এসে হয়তো দেখব মিটিং শেষ আর দত্তসাহেব চলে গেছেন।’
সুমিত বলল, ‘এই ভিনটেজ হাডসনটি কার, কে জানে!’
চয়ন বলল, ‘মনে হচ্ছে, সেই বিনু চৌধুরির।’
হৈমন্তী বলল, ‘আমারও তাই মনে হচ্ছে।’
এই কথার মধ্যে লাইব্রেরির দরজা খুলে ছ-সাতজন বয়স্ক ভদ্রলোক বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। তাঁদের সকলেরই মুখ গম্ভীর, হয়তো কিছুটা ক্রুদ্ধ। বোঝা গেল, ওঁদের আলোচনা মোটেই বন্ধুত্বপূর্ণ হয়নি।
দত্তসাহেব চারজনকে দেখে তাড়াতাড়ি বারান্দা থেকে নেমে এগিয়ে এলেন। বললেন, ‘এই যে, তোমরা এসে গেছ। একটু দাঁড়াও, এঁরা চলে গেলেই আমরা কথা বলব।’
চয়ন বলল, ‘কথা বলবার মতো মুড কি আছে, দত্তসাহেব?’
দত্তসাহেব সহাস্যে বললেন, ‘আছে, আছে। আমরা হলুম উকিল, বুঝেছ ডাক্তার? কোনো কিছুতেই বিচলিত হলে আমাদের চলে না।’
আরও একজন এগিয়ে এলেন। ইনি রোগা, একটু কুঁজো হয়ে হাঁটেন, গালভাঙা, গর্তে বসা চোখের নীচে গভীর কালি, ভেজা ভেজা ঠোঁট, মাথায় টেরিকাটা প্রচুর কলপ লাগানো চকচকে কালো চুল। পরনে গিলে করা আদ্দির পাঞ্জাবি আর জরিপাড় ধুতি। এঁকে দেখলে পিচ্ছিল বিষাক্ত গেছো ব্যাঙের কথা মনে পড়ে।
গেছো ব্যাঙ বললেন, ‘এরা কারা, মনোরঞ্জনবাবু? এদের তো আগে কখনো দেখিনি।’
এঁর গলার আওয়াজও ব্যাঙের মতো— ঘ্যাঙঘেঙে।
মনোরঞ্জন বিরাগপূর্ণ গলায় বললেন, ‘না দেখারই কথা। এখানে সম্প্রতি এসেছে। চলুন, চৌধুরিবাবু, আপনাকে গাড়িতে তুলে দিই।’
গেছো ব্যাঙ হাত নেড়ে বললেন, ‘দাঁড়ান মশাই, এদের সঙ্গে একটু আলাপ করে নিই।’
বলে অদিতির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কোথায় উঠেছ তোমরা?’
অদিতি কিছু বলবার আগেই মনোরঞ্জন বললেন, ‘ওরা চ্যাটার্জি পাড়ায় উঠেছে। ভূতের ভয় পাচ্ছিল। তাই আমার কাছে এসেছে বাড়িটার ইতিহাস জানবার জন্য।’
অদিতির থেকে চোখ না-ফিরিয়ে ব্যাঙ বললেন, ‘ভূতের ভয় পাচ্ছ না কি? পুরোনো বাড়ি নিশ্চয়ই। ওরকম বাড়িতে ভয় পাওয়া অসম্ভব নয়। আমিও একটা খুব পুরোনো বাড়িতে থাকি। তবে আমি কিন্তু ভয়-টয় পাই না।’
হৈমন্তী বলল, ‘আপনিও পুরোনো বাড়িতে থাকেন? কোন বাড়িটা?’
উত্তরটা ব্যাঙ অদিতিকে দিলেন। বললেন, ‘সেটা এখানে নয়। আমার বাড়ি একটু দূরে হরিজীবনপুরে। একদিন এসো না সেখানে। গল্প-টল্প করা যাবে।’
হৈমন্তী বলল, ‘নিশ্চয়ই যাব।’
এইবার হৈমন্তী ব্যাঙের দৃষ্টিপথে এল। তিনি বললেন, ‘খুব ভালো কথা। তোমরা কালকেই চলে এসো। বিকেল বেলা। চা খাবে আর আমরা গল্প করব।’
মনোরঞ্জনের মুখে তখন আষাঢ়ের মেঘ। বললেন, ‘সে হবে অখন। এখন চলুন। এইবার রওনা না-হলে আপনার পৌঁছুতে দেরি হয়ে যাবে।’
‘যাচ্ছি মশাই, যাচ্ছি। কার বাড়িতে উঠেছ তোমরা?’
‘ওরা সুব্রত রায়ের বাড়িতে উঠেছে। নিন, চলুন।’
‘অন্যান্য ভদ্রলোকেরাও বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, চলুন চৌধুরিমশাই। আর দেরি করবেন না।’
‘ঠিক আছে, যাচ্ছি। কাল এসো কিন্তু তোমরা। আমি অপেক্ষা করে থাকব।’
হৈমন্তী সহাস্যে বলল, ‘অবশ্যই যাব। আপনি কিচ্ছু চিন্তা করবেন না।’
বিনু চৌধুরিকে গাড়িতে তুলে দিয়ে মনোরঞ্জন ফিরে এলেন। হৈমন্তীকে বললেন, ‘কার সঙ্গে কথা বলছিলে জানো?’
‘জানি। হরিজীবনপুরের বর্তমান জমিদার শ্রীল শ্রীযুক্ত বাবু বিনু চৌধুরির সঙ্গে।’
‘এই লোকটার সম্বন্ধে আর কী জানো?’
‘জানি, উনি একজন নমস্য ব্যক্তি। হেন অন্যায় কাজ নেই যা ইনি করতে পারেন না। অন্নদাতা রামানন্দ সিংহকে খুন করিয়ে বা করে, জমিদারিটি নিজের কুক্ষিগত করেন আর রামানন্দের মেয়েকে লোপাট করে দেন।’
হতভম্ব মনোরঞ্জন খাবি খেতে খেতে বললেন, ‘তুমি দেখছি অসাধারণ মেয়ে! এরমধ্যে এত সব জেনে ফেলেছ? তা এতই যদি জানো, তো ওর বাড়িতে যেতে রাজি হলে কেন? জেনে শুনে বাঘের গুহায় ঢুকতে চাও?’
‘বাঃ, বাঘের মুখোমুখি না-হলে, তাকে শেষ করব কী করে? বিনু চৌধুরির দুর্বলতা সুন্দরী অল্পবয়সি মেয়েদের প্রতি। সেই ছিদ্রপথেই যখন গুহায় ঢোকার নেমন্তন্ন পেয়েছি, তখন সেই সুযোগটা ছেড়ে দেব?’
মনোরঞ্জন চারজনকে নিয়ে একটা খালি ক্লাসরুমে ঢুকলেন। সবাই বেঞ্চগুলোর ওপরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসল। মনোরঞ্জন হৈমন্তীর সামনে বসে বললেন, ‘সত্যিকথা বলোতো মা, তোমরা কারা? এখানে এসেছ কেন? বিনু চৌধুরিকে শেষ করতেই বা চাও কেন?’
হৈমন্তী পালটা প্রশ্ন করল, ‘আপনার কী মনে হয়?’
মনোরঞ্জন একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘আমার ধারণা, তোমরা অনাথবাবুর হারিয়ে যাওয়া ছেলে বীরুর ছেলে-মেয়ে। কিন্তু বিনু চৌধুরির সঙ্গে তোমাদের কী সম্পর্ক? রামানন্দ সিংহ কি তোমাদের কোনোরকম আত্মীয়?’
‘সেটা বের করতেই তো হরিজীবনপুরে যেতে হবে আমাদের।’
‘তোমাদের বাবা তোমাদের হরিজীবনপুরে যাবার অনুমতি দেবেন?’
‘না। যথাসাধ্য সেটা আটকানোর চেষ্টা করবেন।’
‘তবুও তোমরা যাবে? ব্যাপারটা আমাকে খুলে বলবে?’
‘বলব। তবে, একটা শর্ত আছে। যদি আপনি সেটা মানতে রাজি থাকেন, তাহলেই বলব— নইলে নয়।’
‘কী শর্ত?’
‘শর্তটা হল, আমি আপনাকে যা বলব, তা আপনি ঘুণাক্ষরেও বাবা বা মাকে জানাবেন না; যতক্ষণ না আমরা হরিজীবনপুর থেকে ফিরে আসি কাল। একটা হেস্তনেস্ত কালকেই হয়ে যাবে।’
‘খুবই কঠিন শর্ত। তোমরা যদি বীরুর ছেলে-মেয়েই হও, তাহলে তোমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব আমার ওপরেও বর্তায়।’
‘আমাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা আমরা করতে পারব না— এটাই কী আপনার বিশ্বাস?’
‘না, আমার বিশ্বাস তোমরা পারবে। ঠিক আছে, তোমার শর্ত আমি মেনে নিলুম।’
হৈমন্তী কমলপুরে আসবার পর থেকে যা যা ঘটেছে, ওর বাবা আর মা-র সঙ্গে যা যা কথা হয়েছে, তার সবকিছু এক নিশ্বাসে বলে গেল।
তারপর বলল, ‘আমি এখনও নিঃসন্দেহ নই যে মা সত্যি সত্যিই রামানন্দ সিংহের মেয়ে কি না। আর বুঝতে পারছি না, বাবা নিরুদ্দেশ হয়েছিল কেন আর এতবছর বাদে ফিরেই বা এল কেন। এই রহস্যগুলো এখনও খুব পরিষ্কার নয়; আর হরিজীবনপুরে গিয়ে ওই বিনু চৌধুরির সঙ্গে কথা না বলতে পারলে পরিষ্কার হবেও না।’
মনোরঞ্জন এতক্ষণ গভীর মনোযোগের সঙ্গে হৈমন্তীর কথা শুনছিলেন। এইবার বললেন, ‘আমি বোধ হয় কিছুটা বুঝতে পারছি। বিনু চৌধুরি লোককে যাই বলে থাকুক না কেন, আমি জানি যে সে পুলিশের কাছে যে ডায়েরি করেছিল তাতে সে রামানন্দ সিংহের মেয়ের ওপরে খুনের বোঝা চাপিয়েছিল। যে বন্দুক দিয়ে খুনটা করা হয়, তার ওপরে না কি সেই মেয়ের আঙুলের ছাপ ছিল। কিন্তু বিনু চৌধুরির ছিল না। পুলিশ এই অভিযোগেই একটা ওয়াটার-টাইট কেস তৈরিও করেছিল কিন্তু যেহেতু সেই মেয়েটির কোনো হদিশ পাওয়া যায়নি, তাই কোর্টে কেসটা আর চালায়নি। তবে মনে রেখো, কেসটা এখনও জিন্দা আছে। জানোতো, খুনের মামলা তামাদি হয় না? আজও যদি জানা যায় যে রামানন্দ সিংহের মেয়ে কোথায় আছে, তাহলে পুলিশ তাকে সঙ্গেসঙ্গে গ্রেপ্তার করতে পারে। অ্যান্টিসিপেটারি বেলের দরখাস্ত করলে সেটা নাকচ হয়ে যাবার সম্ভাবনাই বেশি। বিশেষত যখন ক্রাইম ঘটে যাওয়ার পরে সে পালিয়ে যায়। আর মামলায় যদি প্রমাণও হয় যে আন্ডার এক্সট্রিম প্রোভোকেশন সে খুন করেছিল, তাহলেও তার জেল হওয়া ঠেকানো যাবে না। আর, সেটা প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব, কারণ সেই খুনের ঘটনার একমাত্র সাক্ষী বিনু চৌধুরি। এইসব কারণেই বীরু তোমাদের মাকে নিয়ে অজ্ঞাতবাসে চলে গিয়েছিল। যে প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে, তা হল তোমার বাবার সঙ্গে তোমার মায়ের যোগাযোগ হয়েছিল কী করে?’
হৈমন্তী বলল, ‘ঠিক বলেছেন। আরও একটা প্রশ্ন, এখনই বা ওরা ফিরে এল কেন? আজ কি অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়েছে?’
‘হ্যাঁ, কিছুটা হয়েছে তো বটেই। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে বিনু চৌধুরি ছিল তখনকার একজন প্রথম সারির নেতা। খুঁটির জোরে সে হাতে মাথা কাটত। তার কথাই ছিল হরিজীবনপুরের আইন। পুলিশ ছিল তার তাঁবেদার। তখন তার সঙ্গে লড়াই করা মানে ছিল নিজের মৃত্যুকে ডেকে আনা। আজ কিন্তু সেই অবস্থা আর নেই। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সে এখন রীতিমতো ব্যাকফুটে। স্থানীয় লোকেদের ওপরে যত অত্যাচার সে করেছে, তার প্রতিশোধ নেবার অপেক্ষায় বসে আছে তারা। সুযোগ খুঁজছে। বিনু সে কথা খুব ভালো করেই জানে। পুলিশের মদতও সে আর তেমন পায় না, জমিদারিও চলে গেছে। কাজেই, সে এখন আগেকার থেকে অনেক বেশি দুর্বল। তবে, ভেবো না যে সে একেবারে নখদন্তহীন সিংহ। এখনও সে যথেষ্ট ক্ষমতা ধরে। তার সশস্ত্র দেহরক্ষীদের তার প্রাক্তন প্রজারা যমের মতো ভয় পায়। আর যেকোনো কারণেই হোক, পুলিশ এখনও তার গায়ে হাত দিতে ভরসা পায় না।’
‘ক-জন দেহরক্ষী পোষেন ইনি?’
‘শুনেছি পাঁচজন।’
‘বেশ, তারপরে বলুন।’
‘হ্যাঁ, শোনো। এটা স্পষ্ট যে, বিনু চৌধুরির সঙ্গে মোকাবিলা করবার এটা উপযুক্ত সময়। কিন্তু পুলিশ যে জমিদারবাবুর খুনের কেসটা খাড়া করেছিল, তার কিন্তু কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাহলে কি বীরু কোনো নতুন সাক্ষ্য প্রমাণ পেয়েছে? না কি তার সন্ধানেই এসেছে? সেটা ঠিক ধরতে পারছি না।’
‘আমার মনে হয়, আপনার দ্বিতীয় অনুমানটাই ঠিক। আমরা সেই কাজটাই করবার জন্য হরিজীবনপুরে যেতে চাই।’
‘কি করবে সেখানে সেটা ঠিক করেছ?’
‘হ্যাঁ। সেই সময়কার জমিদারবাড়ির কোনো পুরোনো লোক হয়তো এখনও জীবিত আছেন। তাঁদের খুঁজে বের করবার চেষ্টা করব আর তাঁদের কথা থেকে কোনো ক্লু পাওয়া যায় কি না, সেটা দেখব। বাবার থেকে এই কাজটা আমরা অনেক ভালো করতে পারব। কারণ, আমরা সকলের অচেনা। বাবাকে কেউ কেউ চিনে ফেলতে পারে। সেক্ষেত্রে, ব্যাপারটা বিপদজনক হয়ে পড়তে পারে। তা ছাড়া, জমিদারবাড়ির ভেতরটা দেখব। মা ওখান থেকে বেরিয়ে এসেছিল কী করে, সেটা হয়তো তখন বোঝা যাবে। বিনু চৌধুরি নিশ্চয়ই আটঘাট বেঁধেই কাজে নেমেছিল আর রামানন্দ সিংহের মেয়ের পালানোর রাস্তা বন্ধ করে রেখেছিল।’
‘ঠিক বলেছ। কিন্তু সেই প্রশ্ন, তোমার বাবার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়েছিল কী করে? তবে কি তিনি আগে থেকেই জানতেন যে, তাঁর বাবাকে ওই রাত্রেই খুন করা হবে? তাই, আগেভাগে বীরুকে খবর দিয়ে রেখেছিলেন? সেটা একটা জোরদার সম্ভাবনা বলে মনে হয় না। তাহলে কেউ-না-কেউ ঠিক জানতে পারত। তা ছাড়া, ওঁরা পালালেন কী করে? ট্রেনেই হোক বা বাসেই হোক, ওঁদের যেতে হত এই শহর দিয়েই। আর, এই শহরের অসংখ্য চোখ আর কান। তাদের ফাঁকি দেওয়া অসম্ভব হত। পুলিশ খবর পেয়ে যেত।’
চয়ন বলল, ‘ছদ্মবেশে গিয়ে থাকতে পারেন।’
‘সেটা খুবই কষ্টকল্পনা ডাক্তার। ভেবে দেখ, বাবা খুন হচ্ছেন বা হবেন আর মেয়ে তখন ছদ্মবেশ ধরে পালানোর কাজে ব্যাপৃতা রয়েছেন— এটা প্রায় অসম্ভব। তা ছাড়া বীরুকেও নিশ্চয়ই ছদ্মবেশ ধরতে হয়েছিল। ওর যা চেহারা ছিল তখন, তাতে কেউ-না-কেউ ওকে ঠিক চিনে ফেলত। বীরুকে যারা শেষ দেখেছিল তারা যে তাকে ট্রেনে বা বাসে উঠতে দেখেছে সেরকম কোনো কথা আমরা কখনোই শুনিনি। সে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল।’
‘আমরা শুনেছি, উধাও হওয়ার পর অনাথবাবু ছোটোছেলের ওপর খুব খাপ্পা হয়েছিলেন। তাঁকে বিচলিত বা উদবিগ্ন মনে হয়নি। সেটাই বা কেন?’
‘ঠিকই শুনেছ। সত্যি কথা বলতে কী, আমিও সেটা বুঝতে পারছি না। এক, হতে পারে যে তিনি ছিলেন গোঁড়া ব্রাহ্মণ, কায়েতের মেয়েকে নিয়ে ছেলের পলায়নের ব্যাপারটা তিনি শান্তভাবে নিতে পারেননি।’
হৈমন্তী ম্লান হাসল। বলল, ‘বাবা যে বলে তার ছেলেবেলাটা কেটেছে অনাথ আশ্রমে— সেটা বোধ হয় মিথ্যে নয়; শুধু কথাটার মধ্যে একটা শ্লেষ লুকিয়ে আছে।’
মনোরঞ্জনও হাসলেন। বললেন, ‘বীরু একটা এক নম্বরের ফাজিল ছেলে ছিল। ওর পক্ষে এরকম রসিকতা করা মোটেই অসম্ভব নয়। সে যাই হোক, তোমাদের কয়েকটা উপদেশ দিই কাজে লাগবে।’
‘বলুন।’
‘বিনু চৌধুরি তো তোমাদের বিকেলের চা খেতে ডেকেছে। সকালে বোধ হয় তোমাদের কী করে প্যাঁচে ফেলবে সে ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করবে। তোমরা একটু তাড়াতাড়ি হরিজীবনপুরে যেও। ওখানে গিয়েই কালীকৃষ্ণ চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা করবে। কালী হরিজীবনপুর পঞ্চায়েতের একজন হোমরাচোমরা, এখন বোধ হয় উপপ্রধান। তাকে আমার রেফারেন্স দেবে। তাকে তোমাদের সমস্যার কথা বলবার দরকার নেই। শুধু বলবে যে তোমরা সাংবাদিক, পশ্চিমবাংলার পুরোনো জমিদারবাড়ি নিয়ে লিখতে চাও। সেই কথা শুনে, বিনু চৌধুরি তোমাদের ওখানে যেতে আমন্ত্রণ করেছেন বলেই ওখানে তোমরা গিয়েছ। আর, আমি তোমাদের কালীর কাছে পাঠাচ্ছি যাতে কোনো বিপদ-আপদ হলে সে যেন তৎক্ষণাৎ একটা ব্যবস্থা নেয়। কালী আমার মস্ত ভক্ত, আমি পাঠিয়েছি শুনলে সে তোমাদের জন্য জান লড়িয়ে দেবে। তার টেলিফোন আছে। তাকে বলবে যে কোনোরকম গোলমাল দেখলে সে যেন পত্রপাঠ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। বাকি ব্যবস্থা আমি তখন এখান থেকে করব।’
‘কীরকম গোলমাল হবে বলে আপনার মনে হয়?’
‘সেটা তো বুঝতে পারছি না। তোমাদেরই অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে, দিনের আলো থাকতে থাকতে ওই বাড়ি থেকে অবশ্যই বেড়িয়ে আসবে। বেরিয়েই কালীর কাছে রিপোর্ট করবে আর আমাকে টেলিফোন করবে। আর একটা প্রশ্ন। তুমি কি কখনো তোমার মা-র মুখে কার্শিয়াঙের কোনো উল্লেখ শুনেছ?’
‘কার্শিয়াং? কেন বলুন তো?’
‘না, এমনিই জিজ্ঞাসা করলুম।’
‘এখানে আমি একটা প্রশ্ন করতে পারি?’
‘অবশ্যই। কী প্রশ্ন?’
‘একটা কথা বুঝতেই পারছি যে আপনি বিনু চৌধুরিকে পছন্দ করেন না। কেন? শুধু তার চরিত্রের জন্য না অন্য কোনো কারণ আছে?’
‘আছে। লোকটা যে শুধু এই স্কুলে ডোনেশন বন্ধ করে দিয়েছে তাই নয়, আগে সিংহ পরিবার থেকে যে টাকা স্কুল পেয়েছে, সে সেটা সুদে-আসলে ফেরত চায়। তা করলে, এতদিনের ঐতিহ্যবাহী স্কুলটা উঠে যাবে। তাতে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। ওই শয়তান লোকটাকে খুন করার একটা গোপন বাসনা যে আমার নেই— সে কথা জোর করে বলতে পারব না।’
‘বুঝেছি। সেই জন্যেই আপনি আমাদের বাধা দিচ্ছেন না।’
মনোরঞ্জন সহাস্যে বললেন, ‘এ ব্যাপারে আমি কিছু বলতে চাই না। সে যাকগে। তোমরা কিন্তু আমি যা বললুম, ঠিক সেইভাবে কাজ করবে। আর, বীরুকে বলবে, কাল দুপুর বেলা সে যেন তোমার মাকে নিয়ে আমার বাড়িতে আসে। তোমরা ওখানে অ্যাকশন চালাবে আর আমি কোর্টে বসে থাকব, তাতো হয় না। আমরা টেলিফোনের পাশে বসে থাকব তোমাদের খবরের আশায়। কাজেই, বীরুর এখানে আসা খুবই দরকার।’
হৈমন্তী মনোরঞ্জনকে প্রণাম করে বলল, ‘তাই হবে, জ্যাঠামশাই।’
বাকি সকলে ওকে অনুসরণ করল।
ফিরতে রাত হল। সুব্রত অত্যন্ত চিন্তিত মুখে বারান্দায় পায়চারি করছিলেন। ওদের দেখে নেমে এলেন। বললেন, ‘কী ব্যাপার? এত দেরি হল কেন?’
হৈমন্তী বসবার ঘরে ঢুকে একটা সোফার ওপর ধপাস করে বসে পড়ে বলল, ‘কাজ করছিলুম, কাজ।’
ইভা খাবার টেবিলে প্লেট সাজাচ্ছিলেন। বললেন, ‘তোর এই কাজের ঠেলায় আমরা তো অস্থির হয়ে পড়ছি। তোদের বাবা ভীষণ চিন্তা করছিল। যা তো, হাত-মুখ ধুয়ে আয়। আমি খাবার দিয়ে দিচ্ছি।’
খেতে খেতে সুব্রত বললেন, ‘আজ কোন রাজকার্য করলেন ম্যাডাম? খুব খুশি খুশি দেখাচ্ছে যেন?’
হৈমন্তী হাসতে হাসতে বলল, ‘রাজকার্যই বটে। জমিদার তো একরকম রাজাই।’
‘তুই জমিদারের কাজ করছিলি? কোন জমিদার?’
‘হরিজীবনপুরের বর্তমান জমিদার শ্রীযুক্ত বাবু বৃন্দাবন চৌধুরির সঙ্গে আজ পরিচয় হল। তাঁর জমিদারিটা অবশ্য গেছে, কিন্তু ঠাট বজায় রেখেছেন। তিনি আমাদের হরিজীবনপুরে নেমন্তন্ন করেছেন। কাল আমরা সেখানে যাচ্ছি।’
‘কী সর্বনাশ! তুই জানিস এই বৃন্দাবন চৌধুরি কে আর কীরকম লোক?’
‘খুব ভালো করে জানি। সে আমার একজন অত্যন্ত নিকট আত্মীয়কে খুন করেছে, আর একজনকে গৃহত্যাগী করেছে। আমার আর একজন শ্রদ্ধেয় প্রিয়জনকে অজ্ঞাতবাসে পাঠিয়েছে। সে একটা আদ্যন্ত শয়তান। পৃথিবীতে হেন নোংরা কাজ নেই যা সে করে না বা করতে পারে না।’
‘এতই যদি জানিস, তাহলে যাচ্ছিস কেন?’
‘তার কারণটা তো খুব স্পষ্ট, বাবা। সাপের মুখোমুখি না-হলে কি সাপ মারা যায়?’
উত্তেজিত সুব্রত বললেন, ‘কেউ তোকে সাপ মারতে বলেছে?’
‘হ্যাঁ, আমার নিষ্ঠুরভাবে খুন হওয়া দাদামশায় বলেছেন! তাঁর দৌহিত্রী হয়ে আমি এটা মেনে নিতে পারি না!’
‘কী গোঁয়ার্তুমি হচ্ছে এসব?’
‘গোঁয়ার্তুমি নয় বাবা। আমরা ঝোঁকের মাথায় কিছু করছি না। সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়েই যাচ্ছি।’
হঠাৎ সুব্রত হুংকার দিয়ে উঠলেন, ‘না, তোমরা কোথাও যাচ্ছ না! ঢের হয়েছে, আর কোনোরকম বাড়াবাড়ি আমি সহ্য করব না! কালই তোমাদের কলকাতার ট্রেনে তুলে দেব। সেখান থেকে তোমরা বম্বে ফিরে যাবে।’
সুব্রতর স্বভাববিরুদ্ধ গর্জন শুনে হৈমন্তী ছাড়া বাকি সবাই চমকে উঠল।
হৈমন্তী অবিচলিত গলায় বলল, ‘তুমি তো জানো, যে কাজ আমি কর্তব্য বলে মনে করি, সেটার শেষ না-দেখে ছাড়ি না। তুমি যদি আমাদের ট্রেনে তুলে দাও, আমরা পরের স্টেশনে নেমে গিয়ে আবার ফিরে আসব। সেক্ষেত্রে, তোমার চিন্তা বাড়বে বই কমবে না। তখন আমরা কোথায় আছি, কী করছি, তা তুমি কিছুই জানতে পারবে না। তার চেয়ে আমরা এই বাড়িকেই যদি বেস করি, তাহলে তোমার পক্ষে আমাদের ট্র্যাক করা সহজ হবে।’
‘তুমি তাহলে যাবেই?’
‘হ্যাঁ, আমরা সবাই যাব।’
‘তাহলে আমিও তোমাদের সঙ্গে যাব।’
‘না বাবা। তুমি গেলে সব ভেস্তে যাবে। তোমাকে ওখানে অনেকেই, বিশেষত বৃন্দাবন চৌধুরি চিনে ফেলতে পারে। সেক্ষেত্রে সমস্ত ব্যাপারটা গোলমাল হয়ে যাবে। তুমি তো জানোই যে যুদ্ধে জেতার প্রথম এবং প্রধান পদক্ষেপ হল সারপ্রাইজ। শত্রু যেন জানতে না-পারে যে সে কোনদিক থেকে আক্রান্ত হতে যাচ্ছে। আমরা কিন্তু সর্বরকমভাবে প্রস্তুত হয়ে যাচ্ছি। সে আমাদের কোনোমতেই চমকে দিতে পারবে না। বৃন্দাবন চৌধুরি এখনও জানে না যে তার সম্পর্কে প্রায় সমস্ত খবরই আমাদের জানা। সে কোন দিক দিয়ে আক্রমণ করবে সেটা আঁচ করতে আমাদের অসুবিধে হবে না।’
হঠাৎ সংহত গলায় ইভা বলে উঠলেন, ‘তুমি ওদের যেতে দাও। ওরা তো ওদের অধিকারের বাইরে কিছু করছে না।’
সবাই অবাক হয়ে ইভার দিকে তাকাল। ইভা বলে চললেন, ‘এরকম বিপদজনক কাজ করার অভিজ্ঞতা হৈমন্তীর আছে। এটা অবশ্যই সেসব কাজের থেকে অনেক বেশি বিপদজনক। কিন্তু আমার স্থির বিশ্বাস যে, ওদের দাদামশায়ের আশীর্বাদে ওরা এই বিপদ থেকেও ঠিক বেরিয়ে আসবে।’
সুব্রত কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ‘তুমি এই কথা বলছ? ঠিক আছে। আমি আর বাধা দেব না। ওরা যা খুশি করুক, যেখানে খুশি যাক। তবে চয়ন যেতে পারবে না। ওর যদি কিছু হয়, আমি বিভাসকে মুখ দেখাব কী করে?’
চয়ন বলল, ‘এটা আপনি কী বললেন কাকাবাবু? বাবা যদি জানতে পারে যে আমি হৈমন্তীকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে পালিয়ে গেছি, তখন ব্যাপারটা যে কী দাঁড়াবে, আপনি তো জানেন! বাবা আর জীবনে কোনোদিন আমার মুখদর্শন করবে না। হৈমন্তী যে আজ আমাদের পরিবারেরও একজন।’
সুব্রত মাথা নেড়ে বললেন, ‘সেটা ঠিক। আমি বিভাসকে যতদূর জানি, সে সোজা মেরুদণ্ডের সাহসী মানুষ।’
ইভা বললেন, ‘শোন হৈমন্তী, তোকে কয়েকটা কথা বলি। আমার বাবার জীবনের শেষ ক-টা দিনের কথা। মা মারা যাবার পর থেকেই বাবা খুব চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলেন। কম কথা বলতেন, কাজকর্ম দেখা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সব দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছিলেন ওই বৃন্দাবনের হাতে। মনের জোর চলে যাওয়ায় ওঁর শরীরও ভেঙে যাচ্ছিল। অস্টিও আর্থারাইটিসে ধরেছিল, পঙ্গু হয়ে যাচ্ছিলেন। কিছুদিন এরকম চলার পর, উনি বুঝতে পারলেন যে বৃন্দাবন তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। টাকাপয়সা সরাচ্ছে, জমিজমা বেনামে কিনে নিচ্ছে।’
হৈমন্তী বলল, ‘উনি বৃন্দাবনকে চিনতে পারেননি।’
‘একেবারেই না। ওকে গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন। সেই সময় বাইরে থেকে দেখলে লোকটাকে বশংবদ কর্মচারী ছাড়া আর কিছু মনে হত না। সবসময় সে বিনয়ে একেবারে নুয়ে থাকত। তা ছাড়া সকলকে বিশ্বাস করাই বাবার স্বভাব ছিল। যখন তার আসল রূপটা বুঝতে শুরু করলেন, তখন যতটা রেগে গিয়েছিলেন, দুঃখ পেয়েছিলেন তার চেয়ে অনেক বেশি।’
‘তারপর?’
‘একদিন আমাকে ডেকে বললেন সব কথা। সব শেষে বললেন, ‘আমি একটা ডায়েরি রাখতে শুরু করেছি। তাতে সব কিছু লিখে রেখে যাচ্ছি। সেটা আমি দেওয়াল আলমারির ভেতরের চোরকুঠুরিতে রেখে দিচ্ছি। আগামীকাল বিকেলে আমি বিনুকে সব কাগজপত্র নিয়ে আসতে বলেছি। যদি গোলমাল দেখি, ওকে তৎক্ষণাৎ বিদেয় করে দেব। তখন যদি সে আমার কোনো শারীরিক ক্ষতি করার চেষ্টা করে, তাহলে তুমি সেটা বের করে নিয়ে সোজা রমারঞ্জনের কাছে চলে যাবে। রমা আমাদের পুরোনো লোক, সে ঠিক কোনো ব্যবস্থা নেবে।’
হৈমন্তী বলল, ‘কাগজপত্র নিয়ে আসতে বলেছিলেন কেন? অফিসঘরে গিয়ে দেখা যেত না? সেখানে অন্তত লোকজনের সামনেই যা-কিছু হত।’
‘তাতে কোনো লাভ হত না, কারণ বৃন্দাবন ততদিনে আমাদের সব পুরোনো কর্মচারীদের নানারকম বদনাম দিয়ে বের করে দিয়েছিল। দরোয়ানদের তাড়িয়ে দিয়েছিল। তাদের জায়গায় নিজের লোকেদের বসিয়েছিল। ওর একা আসাটাই বাবার কম বিপদজনক বলে মনে হয়েছিল।’
‘তোমার মামাবাড়ি কোথায় ছিল? তাঁদের সাহায্য চাইলে পাওয়া যেত না?’
‘আমার মামাবাড়ি কলকাতায়। হাটখোলার বিখ্যাত রায়চৌধুরি পরিবার। ওঁরাই বৃন্দাবনকে পাঠিয়েছিলেন। সে তাঁদের দূরসম্পর্কের আত্মীয়। সেইজন্য বাবা তাঁদের কোনোরকম সাহায্যের ওপর ভরসা করতে পারেননি। তা ছাড়া আমার দুই মামা ভালো লোক ছিলেন না। তাঁদের নানা কুকর্মের কথা আমি ছোটোবেলায় কানাঘুসোয় শুনেছি। এইসব কারণে, আমার দাদামশাই মারা যাওয়ার পর থেকে ওঁদের সঙ্গে আর আমাদের কোনো যোগাযোগও ছিল না।’
‘তোমার বাবা কি বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি খুন হতে পারেন?’
‘না। বৃন্দাবনের অতটা দুঃসাহস হবে— সেটা বোধ হয় তাঁর কল্পনার বাইরে ছিল।’
‘সেই ডায়েরিটা এখন কোথায়?’
‘বোধ হয় সেই দেওয়াল আলমারিতেই আছে। আমি যতদূর জানি, বৃন্দাবন সেই ডায়েরি বা চোরকুঠুরির অস্তিত্বের কথা জানত না।’
‘চোরকুঠুরিটা বের করব কী করে?’
‘শোন, দোতলায় সিঁড়ি দিয়ে উঠে সামনের করিডরের শেষ ঘরটা ছিল বাবার শোবার ঘর। তার উত্তরের দেওয়ালে আলমারি। তার সবচেয়ে ওপরের তাকের ডান দিকের কাঠটা কবজা লাগানো, বাইরে থেকে বোঝা যায় না। সেটার একেবারে নীচে একটা গর্ত আছে। তার ভেতরে আঙুল ঢুকিয়ে সামনের দিকে টানলে পাল্লাটা খুলে আসবে। সেটাই চোরকুঠুরি। ঠাকুরদার আমলে ওখানেই সব দরকারি দলিলপত্র আর জমিদারির টাকাপয়সা থাকত বলে শুনেছি। পরে অফিসে লোহার সিন্দুক এলে সেগুলো সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়।’
‘তোমাদের কি কার্শিয়াঙে কোনো জমিজমা ছিল।’
ইভা একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘আশ্চর্য! তুই এখানে বসে কার্শিয়াঙের খবর পেলি কী করে? সে খবর তো বাবা, আমি আর বৃন্দাবন ছাড়া আর কেউ জানে না।’
‘খবরটা কী?’
‘বাবা যখন অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, তখন উনি কার্শিয়াঙে একটা ছোটো বাংলো কিনেছিলেন। আমাকে দু-একবার ওখানে নিয়ে গিয়েছিলেন। ওঁর ইচ্ছে ছিল ওখানে মাঝে মাঝে গিয়ে থাকবেন। সেটা আর সম্ভব হল না।’
‘সেদিন কী ঘটেছিল, মা?’
প্রশ্ন শুনে ইভার মুখটা হঠাৎ গভীর যন্ত্রণায় কেমন যেন উদভ্রান্ত হয়ে গেল। মাথা নীচু করে উদগত অশ্রু কোনোরকমে চেপে বললেন, ‘আমার মনে নেই। কিচ্ছু মনে নেই।’
সুব্রত তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে ইভার কাঁধদুটো ধরে দাঁড় করিয়ে দিলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, ওর কিছুই মনে নেই। আর কথা নয়। এবার চলো, ওপরে চলো।’
বলে স্ত্রীর পিঠ জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে তাঁকে নিয়ে দোতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে হঠাৎ পেছন ফিরে সুব্রত বললেন, ‘তোরা পারবি। ঠিক পারবি।’
হৈমন্তী বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ বাবা। তোমাদের আশীর্বাদ পেয়ে গেছি। আর আমাদের কোনো চিন্তা নেই। ভালো কথা, তুমি এই বাড়িটার একটা নাম চেয়েছিলে না? আমি বলি কী, সবচেয়ে উপযুক্ত নাম হল ”অনাথ-আশ্রম”।’
প্রবল উদবেগ সত্ত্বেও সুব্রত না-হেসে পারলেন না।
হৈমন্তী ফিস ফিস করে বলল, ‘তোরা সকলেই শুনলি। বুঝতেই পারছিস যে কালকে আমাদের দিনটা কীরকম হবে! এখন যদি কেউ যেতে না-চাস, তাহলে নিঃসংকোচে বলতে পারিস।’
তিনজন প্রায় বিরক্ত হয়ে বলল, ‘বলেছি তো, আমরা একসঙ্গে আছি— একসঙ্গে থাকব।’
‘ওখানে গিয়ে কিন্তু ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলে চলবে না।’
অদিতি বলল, ‘তোর কোনো চিন্তা নেই। কেউ ভয় পাবে না। বাবা আমাদের সেলফ ডিফেন্সের জন্য যা-কিছু শিখিয়েছে, সেটা যদি কাজে লাগে তো বুঝব আমাদের শেখাটা সার্থক হয়েছে। আমরা তিনজনেই ব্ল্যাক বেল্ট, কেউ আমাদের কিসসু করতে পারবে না।’
‘পাঁচটা বন্দুকধারী বডিগার্ডের কথা ভুলে যাস না।’
সুমিত বলল, ‘ভুলিনি। আমাদের কপাল ভালো যে, আমাদের সঙ্গে মেডিক্যাল ইউনিটও মজুত রয়েছে।’
চয়ন উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট করে বলল, ‘হুজুর, হাজির।’
হৈমন্তী বলল, ‘ঠিক আছে। তোরা ছেলেরা জিনস আর টি-শার্ট পরে যাবি। আমি সালোয়ার কুর্তা পরে যাব আর অদিতি যাবি স্কার্ট ব্লাউজ পরে। র্যাপ অ্যারাউন্ড স্কার্ট হলেই ভালো হয়। নীচে অবশ্যই তোর টেনিস শর্টস পরে নিবি।’
অদিতি জিজ্ঞাসা করল, ‘আমাকে স্কার্ট পরতে বলছিস কেন?’
‘প্রথম কারণ, যাতে তুই হাত-পা স্বচ্ছন্দে চালাতে পারিস। দ্বিতীয় কারণ, যে পোশাকে বিনু চৌধুরি তোকে দেখেছে, সেটাই যেন বজায় থাকে। তোকে চিনতে যেন কোনোরকম ভুল না-হয়।’
এইসময় সুব্রত দোতলা থেকে নেমে এলেন। তাঁর মুখ গম্ভীর, চিন্তিত। বললেন, ‘তোদের মাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়ে এলুম। তবে তার কোনো এফেক্ট হবে কি না সন্দেহ আছে। সে যাক, কাল কখন রওনা হবি তোরা?’
হৈমন্তী বলল, ‘আমরা এখান থেকে আটটা নাগাদ রওনা হলে আশা করি সাড়ে ন-টার মধ্যে ওখানে পৌঁছোব। প্রথমে যাব কালীকৃষ্ণ চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা করতে। কালীবাবু হরিজীবনপুর পঞ্চায়েতের একজন হোমরাচোমরা ব্যক্তি। আমাদের পরিচয় হবে খবরের কাগজের রিপোর্টার। কালীবাবু বিনু চৌধুরির শত্রুপক্ষ। আমাদের কোনো বিপদ-আপদ হলে কী করতে হবে তার একটা প্ল্যান ছকে ফেলতে হবে। তিনি খুব সম্ভবত আমাদের সবরকমে সাহায্য করবেন।’
‘ব্যাপারটা কী? এই কালীবাবুকে আবার কোত্থেকে পেলি?’
‘সবই হৃদিস্থিত হৃষিকেশের ব্যাপার বাবা। তাঁর সঙ্গে কথা বলে যাব রমারঞ্জনের খোঁজে। তাঁকে না-পেলে জমিদারির অন্য কোনো বরখাস্ত কর্মী বা তাঁদের জীবিত কোনো নিকট আত্মীয়ের সন্ধানে। এইসব করতে করতে বিকেল হয়ে যাবে। তখন যাব রাজেন্দ্রসন্দর্শনে।’
‘মনোরঞ্জনদার টেলিফোন নম্বরটা কাছে রাখবি। কোনো বিপদ বুঝলে ওঁকে ফোন করে দিবি।’
‘হ্যাঁ বাবা। সেরকম কথাই আছে। আর জ্যাঠামশাই তোমাকে কাল দুপুরে মাকে নিয়ে ওঁর বাড়িতে যেতে বলেছেন। তোমরা সেখানে আমাদের খবরের জন্য অপেক্ষা করবে।’
সুব্রত ধপ করে একটা চেয়ারের ওপরে বসে পড়লেন। বললেন, ‘সব ব্যবস্থাই তো করে ফেলেছিস দেখছি। আমার জন্যে করবার আর কিছুই রাখিসনি?’
হৈমন্তী তার বাবার চুলে আঙুল বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘তোমার করবার আছে, বাবা। ধৈর্য ধরে আর আমাদের ওপর বিশ্বাস রেখে, আমরা ফিরে না-আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা— এটাই তোমার কাজ। এবার এসো, সিংহবাড়ির কোথায় কী আছে তার ডিটেলস আমাদের বুঝিয়ে দাও।’
সুব্রত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘যথা আজ্ঞা।’
চারদিকে ধান খেতের মাঝখানে বাসের কন্ডাক্টর ওদের নামিয়ে দিল। সামনে একটা বট গাছের নীচে ছোট্ট একটি চায়ের দোকান। তার পাশে সাত-আটটা সাইকেলরিকশা দাঁড়িয়েছিল। প্রথম রিকশার চালক সবুজ রঙের লুঙ্গি আর লাল রঙের টি-শার্ট পরে সিটের ওপর বসে বিড়ি ফুঁকছিল। বলল, ‘কোথায় যাবেন?’
চয়ন বলল, ‘হরিজীবনপুর।’
‘এটাই হরিজীবনপুর।’
‘এটাই হরিজীবনপুর? কোনো বাড়িঘর দেখছি না তো?’
‘এখান থেকে ওইদিকে একটু দূরে গ্রাম। কার বাড়ি যাবেন?’
‘প্রথমে এদিক-ওদিক ঘুরব, তারপরে জমিদারবাড়িতে যাব।’
রিকশাওয়ালার মুখে আষাঢ়ের মেঘ ঘনিয়ে এল। বলল, ‘জমিদারবাড়ি যাবেন? অ! কোত্থেকে আসা হচ্ছে?’
‘কলকাতা থেকে আসছি। আমরা খবরের কাগজের লোক।’
‘খবরের কাগজের লোক? জমিদারবাড়িতে কী দরকার?’
লোকটির অকারণ অনুসন্ধিৎসায় চয়ন বিরক্ত হচ্ছিল। ও কিছু বলবার আগেই হৈমন্তী বলল, ‘জমিদারি চলে যাবার পর জমিদাররা কে কীভাবে আছেন, সে ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে কাগজে লিখব, এই আর কী!’
‘তবে অন্য কোথাও যান। এখেনে যে জমিদার, সেটা আবার জমিদার না কি? আগের জমিদারবাবুকে খুন করিয়ে, চোরাপথে জমিদারি কিনে নিয়ে সিংহাসনে বসেছে। তখনকার রানিমার দূরসম্পর্কের আত্মীয়। খেতে পেত না, ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াত। পেটে একফোঁটা বিদ্যে নেই। জমিদারবাবু দয়া করে নিজের সেরেস্তায় চাকরি দিয়েছিলেন। তার ভালো প্রতিদানই দিয়েছে! ওই ভুঁইফোড় শালা যদি জমিদার হয় তো আমিও ডেরাইভার।’
পেছনের রিকশাওয়ালা ধমকে উঠে বলল, ‘অ্যাই শালা পঞ্চানন, তোর অত কথা বলার দরকার কী রে? বড়ো ঘরের বড়ো কথায় ফোড়ন কাটতে যাস কেন? চুপচাপ রিকশা চালাবি, সন্ধ্যে বেলা বাড়ি ফিরে যাবি, ব্যাস। ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করিস, চালে আগুন লাগলে সামলাতে পারবি?’
পঞ্চানন মুখ বেঁকিয়ে বলল, ‘আরে, যা যা! এখন আগুন লাগানো অত সহজ নয়, বুঝলি? সেদিন ইটভাটার মাঠে কালীদা কী বলল, শুনিসনি? এবার আমরা আগুন লাগাব। ওর মুখে নুড়ো জেলে দেব!’
‘ওসব কথা বলিসনে রে, পঞ্চা। ওই শালা এখনও যা ক্ষ্যামতা ধরে, তাতে ওর গায়ে আঁচড় লাগাতে গেলে গোটা কয়েক লাশ পড়ে যাবে।’
‘পড়লে পড়বে। তবু, ওই শুয়োরের বাচ্চাটাকে শেষ করে তবে ছাড়ব।’
বলে রিকশাওয়ালা চয়নকে বলল, ‘আমি আপনাদের নিয়ে যেতে পারব না বাবু। গেলে ওই ওরা নিয়ে যাবে। লাইন ভাঙলে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি পেছনে চলে যাচ্ছি।’
সে রকমই হল। পেছনের দুটো রিকশায় চারজন উঠল। প্রথমটায় হৈমন্তী আর অদিতি, অন্যটায় সুমিত আর চয়ন।
চালাতে চালাতে প্রথম রিকশাওয়ালা বলল, ‘এই পঞ্চাননটা একেবারে পাগল। এত মাথা গরম করলে হয়?’
হৈমন্তী বলল, ‘জমিদারবাবুর ওপরে এত রাগ কেন ওর?’
‘শুধু ওর কেন দিদিমণি, রাগ আমাদের সবার। কিন্তু তাই বলে জমিদারবাড়িতে সওয়ারি নেব না— এটা কি কোনো কথা হল? সওয়ারির কী দোষ?’
‘জমিদারবাবু লোক ভালো না, না?’
‘বড্ড খারাপ গো, বড্ড খারাপ! আগে যখন রমরমা ছিল, একদল রাক্ষুসে লেঠেল নিয়ে সবার ওপরে জানোয়ারের মতো অত্যাচার করত। এখন লেঠেলরা কমতে কমতে সাতজনে এসে ঠেকেছে। আর, তাতেই অন্ধকার। হবে না-ই বা কেন? আগে লেঠেলদের হাতে থাকত লাঠি আর তরোয়াল। এখন থাকে বন্দুক। ঠাঁ ঠাঁ ঠাঁ ঠাঁ করে গুলি চলে।’
‘সাতজন না কি? আমি যে শুনে এলুম পাঁচজন?’
‘ঠিকই শুনেছ, দিদিমণি! দু-জন দরোয়ানও আছে। ওরা সবাই বন্দুক হাতে ঘোরে।’
‘উনি তোমাদের ওপর অত্যাচার করলে পুলিশ কিছু করে না?’
‘ওই তো কথা। জমিদারি উঠে যাবার আগে গরমেন্ট আর পুলিশ ছিল ওর হাতের মুঠোয়। তারা তখন ওর কথাতেই উঠত-বসত। আজ দিন পালটে গেছে তবু ওর দাপট কমেনি। হরিজীবনপুরের পুলিশ এখনও ওকে সমীহ করে চলে। জমিদার থানায় ঢুকলে সবাই উঠে দাঁড়ায়, চা-শিঙাড়া এগিয়ে দেয়। তা, উঠবে না-ই বা কেন? জমিদার বাড়ি থেকে সিধে আসে যে। আমাদের পার্টি অনেক চেষ্টা করেও এই চক্কর ভাঙতে পারছে না।’
‘পার্টি অফিসেও সিধে আসে হয়তো।’
‘এলেও কোনো লাভ হবে না। এখানকার সকলের ওর ওপরে এত রাগ যে লাখ টাকা দিলেও সুবিধে করতে পারবে না। টাকাই দাও আর যাই দাও, সুযোগ পেলে আমরা ওর ঘাড়ে কোপ বসাবই!’
‘পঞ্চাননের এত রাগ কীসের?’
‘রাগ হবে না? ওই শালা ওর দিদিকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। পরদিন তার লাশ পাওয়া গেল ধান খেতের মধ্যে। পুলিশ হাত গুটিয়ে বসে রইল, কিচ্ছুটি করল না। তবে কি জানো? আমাদের সকলের পরিবারেই এমন কিছু-না-কিছু ঘটেছে। আমরা সেসব আড়াল করে রাখি। এ ছাড়া তো গরিব মানুষের আর উপায় নেই। তবে, যন্তোন্না কি যায়? আমাদের ভেতরটা পুড়ে যায় গো দিদিমণি!’
‘তোমাদের আগের জমিদার ভালো লোক ছিলেন?’
‘দেবতার মতো মানুষ ছিলেন গো। আজও সবাই তাঁর কথা বলে চোখের জল ফেলে। অমন মানুষের কী ভয়ানক পরিণতি! জানো, তাঁর একটা ফুটফুটে মেয়েও ছিল। একমাত্র সন্তান। ওই জানোয়ারটা তাকেও মেরে গলায় পাথর বেঁধে নদীর জলে ফেলে দিয়েছিল। সকলকে বলেছিল, তাকে না কি সে পাগলাগারদে রেখে এসেছে। লোকটা দিনকে রাত করতে পারে, দিদিমণি।’
‘আচ্ছা, পঞ্চানন যে কালীবাবুর কথা বলছিল, তিনি কে?’
‘তিনি এখানকার একজন নেতা। পঞ্চায়েতের উপপ্রধান। তবে উনিই সবকিছু করেন।’
‘তাহলে চলো, আগে তাঁর কাছে যাই।’
‘সেটা ভালো কথা। ওঁকে এখন পার্টি অফিসেই পাবেন। আর একটা কথা বলব, দিদিমণি?’
‘বলো।’
‘আপনারা জমিদারবাড়িতে যাবেন না। দাদাদের পাঠাবেন। আপনাদের, বিশেষ করে আপনার ছোটো বোনটিকে দেখলে ওই জানোয়ারটা যে কী মূর্তি ধরবে কে জানে! ক্ষেপে গেলে ও সব কিছু করতে পারে।’
‘তা বললে কি হয়? আমি ওদের সবচেয়ে বড়ো। আমাকে তো যেতেই হবে। পিছিয়ে গেলে তো চলবে না। আর, আমি যদি যাই, তাহলে ওরা সবাই যাবেই।’
‘দ্যাখো, যা ভালো বোঝো করো। তবে, খুব সাবধানে থাকবে। একটু এদিক-ওদিক দেখলেই পালিয়ে আসবে।’
হরিজীবনপুর গ্রাম বটে; তবে ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো গ্রাম বলতে যা বোঝায় সেরকম নয়। এখানেও শহরের ছায়া এসে পড়েছে। পুকুর, বাগান, বাঁশঝাড়, কাঁচা রাস্তা, খড়ের চালের মাটির বাড়ি যে নেই তো নয়, তবে একতলা বা দোতলা পাকা বাড়ির সংখ্যা কম নয়। পাকা বা ইট বাঁধানো রাস্তারও অভাব নেই। কালীকৃষ্ণ চক্রবর্তীর পার্টি অফিস যেখানে, সেটা একটা রীতিমতো পাড়া বলা চলে। পিচের রাস্তার দু-ধারে নানা ধরনের বাড়ি।
একটি লাল টালির ছাদওলা ছোট্ট বাড়ির সামনে রিকশাদুটো দাঁড়াল। তার দরজার ওপরে লেখা রয়েছে ‘হরিজীবনপুর গ্রাম পঞ্চায়েত অফিস’। বাড়ির সামনে গোটা চারেক সাইকেল দণ্ডায়মান। দরজার সামনে রোয়াকের ওপর একটি অল্পবয়সি ছেলে ধর্মমহাসভায় স্বামী বিবেকানন্দের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল। এগিয়ে এসে বলল, ‘আপনারা কমলপুর থেকে আসছেন?’
চয়ন বলল, ‘হ্যাঁ, কালীকৃষ্ণবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।’
‘ভেতরে আসুন। উনি আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন।’
ভেতরে একটাই ঘর। একটা বড়ো টেবিল, গোটা পাঁচ-ছয় চেয়ার, একটা বইয়ের আলমারি, রংচটা দেওয়ালে নেতাদের বাঁধানো ফোটোগ্রাফ। টেবিলের পেছনে একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক বসে ছিলেন। অভ্যর্থনাকারী ছেলেটি ছাড়া আরও দু-জন কমবয়সি ছেলে দাঁড়িয়েছিল।
কালীকৃষ্ণবাবু একজন লম্বা-চওড়া শক্তিশালী মানুষ, নাকের নীচে মোটা গোঁফ, টাকমাথা, পরনে কালো ট্রাউজার্স আর সাদা শার্ট। চারজনকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আসুন, আসুন। মনোরঞ্জনকাকা ফোন করেছিলেন। আপনাদের কথা বলেছেন। বসুন। আগে চা খান, তারপরে কথা হবে।’
চা খেতে খেতে কথা শুরু হল। কালীকৃষ্ণ বললেন, ‘আপনারা এত জায়গা থাকতে এই হরিজীবনপুরকেই বেছে নিলেন? কেন? কাজটা কিন্তু খুব বিপদজনক হয়ে গেছে।’
হৈমন্তী বলল, ‘সেইজন্যেই তো বেছে নিয়েছি। জানেন তো, বিপদের মুখোমুখি হতে না পারলে আর সাংবাদিকতা করা কেন?’
‘তা জানি না। তবে, উত্তেজনা খুঁজতে গিয়ে একেবারে বাঘের গুহায় গিয়ে ঢোকা কি ঠিক? সে যাকগে। আপনারা যা ভালো বুঝেছেন, তাই করবেন। তবে, আপনাদের সবরকমে আমরা সাহায্য করব। আপনাদের যাতে কোনোরকম বিপদ না-হয়, আমরা তার জন্য যথাসাধ্য যা করবার তা করব। আমি চারজন ছেলেকে রেডি থাকতে বলেছি, তারা আপনাদের সঙ্গে যাবে।’
‘অনেক ধন্যবাদ আপনাদের। তবে, আমাদের সঙ্গে আপনার দলবল গেলে, বিনু চৌধুরি ভড়কে যাবে, হয়তো মুখই খুলবে না। তার চেয়ে অনেক ভালো হবে, যদি সে জানতে না-পারে যে, আমরা আগে আপনাদের কাছে এসেছি।’
কালীকৃষ্ণ চিন্তিত মুখে বললেন, ‘কথাটা ঠিক। তাহলে কী করতে বলেন?’
‘আমার প্রস্তাব হচ্ছে, আমরা নিজেরাই, আপনার কথায় ”বাঘের গুহায় গিয়ে” ঢুকব। চারটের সময় আমাদের চা খেতে ডেকেছে ওই লোকটা। আমাদের আলাপ আলোচনা ছ-টার মধ্যে শেষ হয়ে যাবার কথা। যদি ছ-টার পরে আমাদের কাছ থেকে কোনো খবর না-পান, তাহলে আপনি আপনার ছেলেদের নিয়ে ওখানে যাবেন এবং জানতে চাইবেন যে আমরা এখনও বেরোচ্ছি না কেন। আপনাদের উদবেগের কারণ হিসেবে বলবেন যে আমরা আপনার আত্মীয়। তখন হয় ওকে আমাদের বের করে দিতে হবে নয়তো আপনাদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। আমার মনে হয়, ও এখন আপনাদের সঙ্গে কোনো ঝগড়া কাজিয়ার মধ্যে যেতে চাইবে না।’
কালীকৃষ্ণ একটু চিন্তা করে বললেন, ‘প্রস্তাবটা মন্দ নয়। আমি একটু ছেলেদের সঙ্গে পরামর্শ করে দেখি। ততক্ষণ আপনারা আমার বাড়িতে চলুন। বিশ্রাম করে নিন। আর, দুপুরের খাওয়াটা আমার ওখানেই সারবেন। এই, সামান্য মাছভাত।’
হৈমন্তী সহাস্যে বলল, ‘সে তো খুব ভালো কথা। তবে, তার আগে একটা কাজ সেরে নিতে চাই। সে জন্যে আপনার একটু সাহায্য দরকার।’
‘কী কাজ?’
‘রমারঞ্জন বলে কাউকে আপনি জানেন? তিনি বহুবছর আগে জমিদারবাড়িতে চাকরি করতেন। আগের জমিদারবাবুর খুব বিশ্বস্ত লোক ছিলেন। তিনি বা তাঁর কোনো নিকট আত্মীয়ের সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই আমরা— এই কাজ।’
‘রমারঞ্জন দেবনাথের কথা বলছেন? আপনারা দেখছি সবরকম খোঁজখবর নিয়েই এসেছেন। হ্যাঁ, ওঁর সঙ্গে দেখা করতে পারেন। ভদ্রলোকের বয়স হয়েছে, তবে সুস্থই আছেন। অবশ্য, বাড়ি থেকে বড়ো বেরোন না। এই সুশীল আপনাদের ওঁর কাছে নিয়ে যাবে। কথাবার্তা শেষ করে কিন্তু সোজা আমার বাড়িতে চলে আসবেন। আমার স্ত্রী রান্নাবান্না করে আপনাদের জন্য বসে আছেন।’
হৈমন্তী হেসে বলল, ‘নিশ্চয়ই আসব।’
সুশীল আগে আগে সাইকেল চালিয়ে রিকশাদুটোকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এল। যেখানে দাঁড়াল, সেটা গ্রামের দরিদ্র এলাকা। বাড়িটা একটা একতলা অতিজীর্ণ ইটের বাড়ি। সামনে বাঁশের বেড়া দেওয়া ছোটো তরিতরকারির বাগান।
ডুরে শাড়িপরা একটি অল্পবয়সি মেয়ে বাগানে কাজ করছিল। সুশীল তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোর ঠাকুরদা ঘরে আছে না কি রে, লক্ষ্মী?’
লক্ষ্মী ঘাড় কাত করে বলল, ‘হ্যাঁ, আছে। শরীরটা খারাপ। শুয়ে আছে। ডেকে দেব?’
হৈমন্তী বলল, ‘না না, ডেকে দিতে হবে না। তুমি গিয়ে ওঁকে বলো যে কমলপুর থেকে চারজন এসেছে ওঁর সঙ্গে দেখা করবার জন্য। কিছু কথা বলবার ছিল। উনি যদি রাজি থাকেন তো আমরা গিয়ে দেখা করব।’
লক্ষ্মী বলল, ‘ঠিক আছে।’
বলে একদৌড়ে ভেতরে চলে গেল। একটু পরেই বেরিয়ে এসে বলল, ‘আপনারা ভেতরে আসুন।’
সুশীল বলল, ‘আপনারা যান। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।’
ওর আর লক্ষ্মীর চোখাচোখিতে বোঝা গেল যে ওদের নিজেদের মধ্যে কিছু আলাপ আলোচনা করা বিশেষ জরুরি।
একটা ছোটো আধো-অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে ঘরে একটি অতিপ্রাচীন তক্তপোশের ওপরে তালিমারা কাঁথা মুড়ি দিয়ে বৃদ্ধ রমারঞ্জন দেবনাথ হাঁটু মুড়ে বসেছিলেন। তাঁর শীর্ণ মুখে খোঁচা খোঁচা পাকা দাড়ি, চোখে গোল স্টিলফ্রেমের চশমা, সামনে একটা খবরের কাগজ পাতা। দরজায় ছেঁড়া শাড়ি কেটে তৈরি করা পর্দা সরিয়ে প্রথমে ঘরে ঢুকল হৈমন্তী। তার পেছনে চয়ন। রমারঞ্জন কাগজটা সরিয়ে বললেন, ‘বসুন। আপনারা কমলপুর থেকে আসছেন? আমার সঙ্গে আপনাদের কী দরকার?’
হৈমন্তী নমস্কার করে বলল, ‘আমরা সাংবাদিক। পশ্চিমবাংলার পুরোনো জমিদারবাড়িগুলোর ওপরে একটা গবেষণামূলক প্রবন্ধ লেখার ভার পেয়েছি। সেইজন্যে এই হরিজীবনপুরে এসেছি। শুনলুম আপনি ওই বাড়ির একজন পুরোনো কর্মচারী। আপনার কাছ থেকে কিছু জানতে চাই। আপনি যদি দয়া করে আমাদের কিছু প্রশ্নের উত্তর দেন তো খুব ভালো হয়।’
রমারঞ্জন এতক্ষণ গম্ভীর হয়েছিলেন। এবার তাঁর মুখে যেন আতঙ্কের ছায়া পড়ল। বললেন, ‘কে আপনাকে আমার কাছে পাঠিয়েছে?’
‘কেউ পাঠায়নি। আমরা নিজেরাই এসেছি। আমরা এখানে এসে রিকশাওলার মুখে আপনার নাম শুনলুম।’
রমারঞ্জন একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘আমি ওখানে অনেক বছর আগে চাকরি করতুম। আমার এখন কিছুই মনে নেই। কাজেই আমি আপনাদের কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারব না।’
‘আমরা আপনাকে সাধারণ কয়েকটা প্রশ্ন করব। তার উত্তর দিলে আপনার কোনো অসুবিধে বা বিপদের সম্ভাবনা নেই, রমারঞ্জনবাবু। আমরা অনেক দূর থেকে আসছি। আপনি আমাদের ফিরিয়ে দেবেন না।’
‘কত দূর থেকে আসছেন?’
‘আমি আসছি পুনা থেকে আর বাকি তিনজন আসছে বম্বে থেকে। আমাদের লেখাটা বেরোবে পুনার একটা কাগজে। কাজেই বুঝতেই পারছেন, সেটা এখানকার কারোর নজরেই পড়বে না। আপনি চাইলে আমার আইডেনটিটি কার্ড দেখতে পারেন। তাহলে আমি সত্যি কথা বলছি কিনা বুঝতে পারবেন।’
‘তার দরকার নেই। তবে আমি কিছু বলতে পারব না।’
এই কথার মধ্যে সুমিত আর অদিতি ঘরে ঢুকল। রমারঞ্জন কিছুক্ষণ স্তম্ভিত দৃষ্টিতে অদিতির মুখের দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘এ কে? এ কে? কে তুমি?’
হৈমন্তী ফিসফিস করে বলল, ‘আপনার রানিকে মনে পড়ে, রমারঞ্জনবাবু?’
রমারঞ্জন প্রায় কেঁদে উঠলেন, ‘এ হতে পারে না। কক্ষনো হতে পারে না। কে তুমি? কে তোমরা?’
হৈমন্তী পূর্ববৎ বলল, ‘আমরা রানির ছেলে-মেয়ে, দাদামশায়। সে তো আপনার মেয়ের মতো ছিল, তাই না?’
রমারঞ্জনের দু-চোখ বেয়ে জল পড়তে লাগল। ভাঙা গলায় বললেন, ‘তোরা রানির ছেলে-মেয়ে? তা কী করে হবে? সে তো মরে গেছে। বৃন্দাবন তাকে মেরে ফেলেছে—’
‘না, দাদামশায়, রানি মরেনি। সে বেঁচে আছে আর ফিরে এসেছে। আমরা এখানে এসেছি রামানন্দ সিংহের খুনের প্রতিশোধ নেবার জন্যে আর আমাদের সম্পূর্ণ নির্দোষ মায়ের ওপরে জঘন্য অপরাধের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে তাকে গৃহত্যাগিনী করবার অপরাধের শাস্তি দেবার জন্যে।’
‘পালিয়ে যা! তোরা এক্ষুনি পালিয়ে যা! বৃন্দাবনকে তোরা চিনিস না। সে করতে পারে না এমন কাজ নেই। আর কাউকে বলিস না যে তোরা রানির ছেলে-মেয়ে।’
‘পালিয়ে যদি যাই, তাহলে ওই লোকটাকে সিংহবাড়ি থেকে টেনে রাস্তায় বের করে আনব কী করে? আমরা সব খবর নিয়েছি। পুলিশ ওর গায়ে হাত দেবে না। এখানকার লোকেদের ওর ওপরে যতই রাগ থাক, পুলিশের মদত না-পেলে, তাদের পক্ষেও কিছু করা সম্ভব নয়। তারা বোমার মতো অগ্নিগর্ভ হয়ে রয়েছে, কিন্তু সেই বোমার পলতেতে আগুন তো কাউকে লাগাতে হবে। আমরা সেই কাজটাই করতে এসেছি। আমরা ছাড়া আর কে তা করতে পারে বলুন?’
‘সেজন্যে তোরা সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখে এগিয়ে যাবি?’
‘হ্যাঁ, দাদামশায়। তাই যেতে হবে। এতদিন আমরা কিছুই জানতুম না। এখন যখন জেনেছি, এবার যদি পিছিয়ে যাই, তাহলে রামানন্দ সিংহের স্মৃতিকে যে অপমান করা হবে।’
‘শোন, মাথা গরম করিসনি। একটা কথা জেনে রাখ, অদিতিকে দেখলে বৃন্দাবন যে কী মূর্তি ধরবে তা তোরা কল্পনাও করতে পারবি না। তার ওপরে ও যদি অদিতি যে রানির মেয়ে সেটা বুঝে যায়, তাহলে তো শোনায় সোহাগা! তখন ওকে সামলানো যাবে না।’
‘যাবে, দাদামশায়। অদিতিকে বাইরে থেকে দেখলে যাই মনে হোক না কেন, নিজেকে রক্ষা করার যথেষ্ট দক্ষতা ওর আছে। সে ব্যাপারে আমরা ভয় পাই না। আসলে, এখন তো আমার মনে হচ্ছে যে বৃন্দাবন যদি ক্ষেপে যায়, তাহলে সে বেসামাল হয়ে পড়বে। তখন তাকে আঘাত করা সহজ হবে। আমরা যে তৈরি আছি সেটা তো সে জানে না। সেখানেই তার দুর্বলতা।’
‘তোরা কী করতে চাস?’
‘আমরা বৃন্দাবনের নেমন্তন্নে চা খেতে যাব। সেখানে তার লক্ষ্য অদিতি। সে যদি ওকে চিনে থাকে তাহলে রানির ওপর প্রতিহিংসা মেটাতে ওর ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। যদি চিনে না-থাকে তো হয় ওকে লোভ দেখিয়ে কবজা করবার চেষ্টা করবে নয়তো জোর করে অত্যাচার করবে। যাই সে করুক না কেন, ওকে আমাদের বাকি তিনজনকে সামনে থেকে সরিয়ে দিতে হবে। তার জন্যে সে আমাদের কোথাও আটকে রাখবে নয়তো জোর করে বাড়ি থেকে বের করে দেবে। আমার ধারণা, সে প্রথমটাই করবে যাতে আমরা বাইরে গিয়ে পুলিশের কাছে না-যাই বা আমার সংবাদপত্রে খবর না-দিতে পারি। আর এক হতে পারে যে আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে। সেটা করবার সে সাহস পাবে না কারণ আমি তাকে প্রথমেই জানিয়ে দেব যে আমার কাগজ আমাকে এখানে পাঠিয়েছে। আটকে রাখার ব্যাপারে আমরা একটু আগে কালীকৃষ্ণবাবুর সঙ্গে কথা বলেছি। ছ-টা বাজলে, উনি দলবল নিয়ে জমিদারবাড়িতে গিয়ে আমাদের খোঁজ করবেন। তখন ওকে আমাদের বের করে দিতে হবে।’
রমারঞ্জন এতক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে হৈমন্তীর দিকে চেয়ে ওর কথা শুনছিলেন। বললেন, ‘তোরা তো সবকিছুই ভেবে রেখেছিস দেখছি। এবার বল, আমি তোদের কীভাবে সাহায্য করতে পারি।’
হৈমন্তী একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘আপনি আমাদের বলুন, কোথায় সে আমাদের আটকে রাখতে পারে আর সেখান থেকে পালানোর কোনো উপায় আছে কি না।’
‘তোদের আটকে রাখার প্রকৃষ্ট জায়গা হল গুমঘর। সেটা এক-তলায়, মাটির কিছুটা নীচে। পাঁচ-ছ-টা সিঁড়ি বেয়ে নামতে হয়। ঘরটা এত নীচু যে তোর ভাইটা সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারবে না। ঢোকার দরজাটা ছাড়া আর কোনো দরজা নেই। বাগানের দিকে দুটো জানলা আছে বটে তবে সেগুলোতে মোটা গরাদ লাগানো। সেগুলো ভাঙা বা বেঁকিয়ে ফেলা অসম্ভব। এই ঘরের পূর্বকোণে একটা কুয়ো আছে। তার তলায় একটা সুড়ঙ্গ আছে সেটা আগে চাঁদার সঙ্গে যুক্ত ছিল। বছর কুড়ি আগেও জোয়ারের সময় ওখান দিয়ে চাঁদার জল আসত। এখন চাঁদা সরে গেছে, তাই জল আর আসে না। রামানন্দবাবুর বাবার আমল থেকে ঘরটা গুদোমঘর হিসেবে ব্যবহার হয়, তবে শুনেছি তাঁর আগে ঢ্যাঁটা প্রজাদের ধরে এনে ওখানে আটকে রাখা হত। কেউ বাড়াবাড়ি করলে তাকে মেরে কুয়োয় ফেলে দেওয়া হত। চাঁদার জল এসে মড়াটা ভাসিয়ে নিয়ে যেত।’
‘এখন কি সুড়ঙ্গটা শুকনো?’
‘হ্যাঁ, শুকনো তবে ওখান দিয়ে পালাতে পারবি না।’
‘কেন?’
‘বছর দশেক আগে কয়েকটা চোর ওই পথে ঢুকে গুদোমঘর সাফ করে দিয়েছিল। তারপর, বৃন্দাবন তার চাঁদার দিকের মুখটা গাঁথনি করে বন্ধ করে দিয়েছে। সে কথাটা আমি এরসাদ মিস্ত্রীর মুখে শুনেছি। এখন সুড়ঙ্গটা সাপখোপ আর কাঁকড়াবিছের বাসা।’
‘গুমঘরে জানলা বসানো হয়েছিল কেন?’
‘আগে কোনো জানলা টানলা ছিল না। পরে যখন ঘরটা গুদোমঘর হল তখনও ছিল না। পরে দেখা গেল একেবারে আলোবাতাস না থাকলে ভেতরটা স্যাঁতসেঁতে হয়ে যাচ্ছে, গ্যাস হচ্ছে আর তার ফলে জিনিসপত্তর নষ্ট হচ্ছে। তখন ওই জানলা দুটো বসানো হয়। ছোটো জানলা, দু-ফুট বাই আড়াই ফুট হবে। বিনু চৌধুরি ও-দুটো বসিয়েছিল।’
‘জমিদারবাড়ি থেকে ঢোকা আর বেরোনোর রাস্তা ক-টা?’
‘তিনটে। বড়ো ফটক বাড়ির দক্ষিণ দিকে মন্দিরের রাস্তায়। তার ঠিক উলটো দিকে বাড়ির পেছনে একটা গেট আছে, তার সামনে চাঁদা। আর পশ্চিম দিকে বাগানের পাশে একটা ছোটো দরজা আছে মালীর আসার জন্যে। সেটা গাছপালায় ঢাকা বলে চট করে নজরে পড়ে না। তার পাশের রাস্তাটা মন্দিরের রাস্তা থেকে বেরিয়ে চাঁদার ঘাটে গিয়ে শেষ হয়েছে।’
হৈমন্তীর আর কোনো প্রশ্ন ছিল না। রমারঞ্জন বললেন, ‘এবার তাহলে বল, রানি বৃন্দাবনের খপ্পর থেকে পালাল কী করে? তোদের বাবাই বা কে?’
হৈমন্তী বলল, ‘সে অনেক কথা, দাদামশায়। সংক্ষেপে বললেও একদিন লেগে যাবে। তা ছাড়া, সব কথা তো আমরাও জানি না। পরে আপনাকে সব বলব। মাকে নিয়ে আসব। তার মুখেই সব শুনবেন।’
‘ঠিক আছে। বৃন্দাবন আমাকে চোর অপবাদ দিয়ে তাড়িয়েছিল। রামানন্দবাবু ওর একটা কথাও বিশ্বাস করেননি, কিন্তু সে তাঁকে এমন অসহায় করে ফেলেছিল যে ইচ্ছে থাকলেও কিছু করতে পারেননি। তোরা আজ সেই অন্যায়ের প্রতিকার করতে এসেছিস। অথচ, আমার এমন অবস্থা যে আমি তোদের জন্য কিছুই করতে পারলুম না।’
‘করতে পারলেন না মানে? আপনি আমাদের যে সাহায্য করলেন, তার কোনো তুলনাই হয় না। যদি বেঁচে ফিরে আসি, তার জন্যে সমস্ত কৃতিত্ব হবে আপনার।’
একটু চুপ করে থেকে হৈমন্তী বলল, ‘আপনাকে একটা কথা বলি, দাদামশায়। রামানন্দ সিংহ বুঝতে পেরেছিলেন যে বৃন্দাবন তাঁর ক্ষতি করতে যাচ্ছে। সেই ক্ষতিটা যে কতদূর ভয়ংকর তা অবশ্য তিনি কল্পনা করতে পারেননি। সেই সময় তিনি মাকে বলেছিলেন যে যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যায়, তবে যেন মা সঙ্গেসঙ্গে তাঁর সব থেকে বেশি বিশ্বাসভাজন রমারঞ্জনের কাছে চলে যায়। মা তার সুযোগ পায়নি। আজ প্রায় চল্লিশ বছর বাদে রামানন্দ সিংহের সেই উপদেশ অনুসারে আমরা এসেছি আপনার কাছে অতীতের হারানো সুযোগের সদব্যবহার করতে। বুঝতে পারছি, রামানন্দ সিংহ ভুল উপদেশ দেননি।’
আবার রমারঞ্জনের দু-চোখ বেয়ে জল পড়তে লাগল। কোনোরকমে বললেন, ‘বেশি ঝুঁকি নিসনি রে দিদি। মনে রাখিস, তোর ভাইবোনেদের দায়িত্ব কিন্তু তোর ওপরে। আর কী বলব, আমার আশীর্বাদ রইল তোদের সঙ্গে।’
দুপুরের খাওয়া মিটলে, সবাই এসে কালীকৃষ্ণবাবুর বাড়ির বারান্দায় বসল।
কালীকৃষ্ণ বললেন, ‘সব ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে। জনাবারো ছেলেকে নিয়ে আমি ছ-টা নাগাদ জমিদারবাড়িতে যাব। আমরা তিনজন সামনে থাকব। বিনু চৌধুরির সঙ্গে কথা বলব। বাকিরা পেছনে আড়ালে থাকবে, তাদের সঙ্গে হাতিয়ার থাকবে। গণ্ডগোল হলে তারা এগিয়ে আসবে। অন্য একদল তার একটু আগে যাবে থানায়। যেকোনো একটা ছুতোয় থানা ঘেরাও করবে, ধর্না দেবে। যতক্ষণ পারে, দারোগাকে ঠেকিয়ে রাখবে যাতে সে এদিকে আসতে না-পারে। ভাবছি, জমিদারবাড়ির টেলিফোনের লাইনটা কেটে দেব।’
হৈমন্তী বলল, ‘না, সেটা করবেন না। প্রয়োজন পড়লে, আমরা মনোরঞ্জন জ্যাঠামশায়ের সঙ্গে ওখান থেকেই যোগাযোগ করব। আর একটা কথা। নিতান্ত দরকার না-হলে, হাতিয়ার বের করবেন না। তা করলে, ওরা এলোপাথাড়ি গুলি চালাবার একটা যুক্তিসংগত কারণ পেয়ে যাবে।’
‘ঠিক বলেছেন। আচ্ছা, আপনি কি ডিটেকটিভ? এতসব তো একজন সাধারণ সাংবাদিকের পক্ষে ভেবে ওঠা সম্ভব নয়।’
হৈমন্তী হেসে উঠল। বলল, ‘না, আমি ডিটেকটিভ নই, সাংবাদিকই। বলতে পারেন, অনুসন্ধানী সাংবাদিক। খবরের কাগজের হয়ে ক্রাইম বা ক্রিমিনাল ঘটনার তদন্ত করা আমার কাজ। সেটা করতে গেলে শুধু সাধারণ ক্রিমিনালই নয়, অনেক মারাত্মক রাঘববোয়ালেরও মোকাবিলা করতে হয়। কাজেই, নিজেকে অক্ষত রাখতে, সবদিক ভেবেই কাজে নামা দরকার। নইলে বিপদে পড়ার সম্ভাবনাই বেশি।’
‘সেসব ক্ষেত্রেও কি ভাইবোনকে সঙ্গে করে নিয়ে যান?’
‘না। তখন আমার সহকর্মীরা সঙ্গে থাকে। এখানে ঘটনাটা হল যে, আমার বাবা রিটায়ার করে কমলপুরে বাড়ি কিনে থাকতে এসেছেন। সেই খবর জানতে পেরে, আমার কাগজ আমাকে এই কাজটা দেয়। আমি একাই আসব ভেবেছিলুম, কিন্তু এরা কিছুতেই তা হতে দিল না। জোর করে আমার সঙ্গে চলে এল। এখন দেখছি, সেটা ভালোই হয়েছে। এই বিনু চৌধুরিকে আমি একা সামলাতে পারতুম কি না তাতে সন্দেহ আছে।’
‘জানি না। আপনারা সবাই মিলেও সামলাতে পারবেন কি না বলা শক্ত। অবশ্য আমরা রয়েছি। দেখি শেষপর্যন্ত কী হয়! এই কাজটা না-নিলেই পারতেন।’
হৈমন্তী হাসল, কোনো মন্তব্য করল না।
কালীকৃষ্ণের গৃহিণী অলকা বললেন, ‘আচ্ছা, তোমরা ধরেই নিচ্ছ কেন যে বিনু চৌধুরি গোলমাল করবেই? হয়তো সে কিছুই করবে না। হৈমন্তীর প্রশ্নমালার উত্তর দেবে আর চা খাইয়ে ছেড়ে দেবে।’
কালীকৃষ্ণ বললেন, ‘সেরকম হবে বলে আমার মনে হয় না। তার ইচ্ছে না থাকলেও, তাকে দিয়ে গোলমাল করাবেন মিস রায়। সেটাই ওঁর মূল উদ্দেশ্য। আমি কি ভুল বলছি, মিস রায়?’
হৈমন্তী বলল, ‘না, আপনি ঠিকই বলছেন। আপনার এই ধারণাটা হল কী করে?’
‘দেখুন, সেরকম কিছু না-হলে, এত খোঁজখবর নিয়ে, এমন আটঘাট বেঁধে আপনি এখানে আসতেন না। আর, খোঁজখবর যখন নিয়েছেন, তখন বিনু চৌধুরির স্বভাবচরিত্রের খোঁজও নিশ্চয়ই পেয়েছেন। সেক্ষেত্রে, সাধারণ সাংবাদিকতার কাজ হলে ভাইবোনদের, বিশেষত বোনকে সঙ্গে করে আনবার রিস্ক নিতেন না। স্পষ্টতই, আপনি একটা পরিস্থিতি তৈরি করে গণ্ডগোল পাকিয়ে তুলতে চাইছেন। কেন চাইছেন, তা আমি জানি না। এখন তা জানতেও চাইছি না। সব মিটে যাক, তখন হয়তো জানতে চাইব। তবে, আপনি যা করছেন তাতে যদি আমাদের কার্যসিদ্ধি হয়, তাহলে সকলেরই মঙ্গল।’
‘আপনি একজন অত্যন্ত বুদ্ধিমান মানুষ। আমরা যে আপনার সাহায্য পেয়েছি সেটা আমাদের সৌভাগ্য।’
কালীকৃষ্ণ বললেন, ‘এখনিই নিজের ভাগ্যকে ভালো-মন্দ কিছু বলবেন না। আগে আপনার কাজটা শেষ হোক, তারপরে না-হয় সেটা বিবেচনা করা যাবে।’
সাড়ে তিনটের সময় দুই পরিচিত রিকশাওয়ালা এসে উপস্থিত হল।
রিকশায় উঠে হৈমন্তী তার রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার নাম কী?’
রিকশাওয়ালা বলল, ‘আজ্ঞে আমার নাম কামালুদ্দিন মণ্ডল, সবাই কামাল বলে ডাকে।’
‘আর ওর নাম?’
‘ও কানাই সাঁতরা, কানু।’
‘বেশ নাম। তোমরা দু-জনে আমাদের জমিদারবাড়িতে নামিয়ে দিয়ে ওখানেই অপেক্ষা করতে পারবে? আমি তোমাদের সারা দিনের ভাড়া দিয়ে দেব।’
‘অপেক্ষা করতে পারব দিদিমণি। তবে ভাড়াটা অগ্রিম দিয়ে দিলে ভালো হয়।’
‘অগ্রিম ভাড়া চাইছ কেন?’
‘সত্যি কথা বলি দিদিমণি? কোনো সুন্দরী মেয়ে একবার ও বাড়িতে ঢুকলে আর বেরোবে কি না সেটা তো জোর করে বলা যায় না। বিশেষ করে আপনাদের মতো এত ভালো দেখতে মেয়েছেলের ওখান থেকে বেরোনো কঠিন। দেখলুম তো কত। অবশ্য আপনারা কলকাতা থেকে আসছেন, বড়ো বড়ো লোকেদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে। হয়তো আপনাদের গায়ে হাত দিতে ওরা সাহস পাবে না। তবে, চিন্তা করবেন না। বিপদ বুঝলে যত জোরে পারেন, চিৎকার করবেন। আমরা কাছেপিঠেই থাকব। আওয়াজ পেলেই, লোকজন জোগাড় করে ঢুকে পড়ব। একটা এসপার নয় ওসপার হয়ে যাবে।’
‘বলো কী? আমাদের জন্যে বিপদে পড়তে যাবে কেন তোমরা?’
‘আর সহ্য হচ্ছে না, দিদিমণি। ওই সাপটাকে মারবার একটা সুযোগ পেলে, জান লড়িয়ে দেব— যা হয় হবে।’
‘পঞ্চাননের মতো তোমার ওপরেও ওই লোকটা অত্যাচার করেছে না কি?’
‘হ্যাঁ দিদিমণি। এই গ্রামের কোনো গরিব লোকের পরিবারই ওর হাত থেকে নিস্তার পায়নি। তবে সেসব কথা তো আর বলা যায় না। তবে, ইনশাল্লা, প্রতিশোধ আমরা নেবই!’
হৈমন্তী অদিতিকে বলল, ‘তোর ভয় করছে না কি রে?’
অদিতি মাথা নেড়ে বলল, ‘না দিদি, ভয় করছে না। যা শুনলুম, তার পরে সে প্রশ্নই ওঠে না। মনে হচ্ছে, জীবনে এই প্রথম একটা ভালো কাজ করতে যাচ্ছি।’
একজন ইউনিফর্ম পরিহিত বন্দুকধারী দরোয়ান চারজনকে দেখে গেটের তালা খুলে দিল। ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলল, ‘আপনারা জমিদারবাবুর সঙ্গে দেখা করবেন তো? ভেতরে আসুন। সামনেই সিঁড়ি আছে। দোতলায় চলে যান, বাবু সেখানে ইন্তেজার করছেন।’
বলে লোকটা হৈমন্তী আর অদিতির আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে হলদে দাঁত বের করে একটা অত্যন্ত অভব্য অশ্লীল হাসি হাসল। বোঝা গেল, ইনি বাবুর যোগ্য দেহরক্ষী বটে। রাজেন্দ্রসঙ্গমে ইনিও যে তীর্থ দর্শনে বঞ্চিত হন না, তাতে সন্দেহ থাকে না।
চারজন বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে চারদিক ভালো করে দেখে নিল। বাড়িটা লম্বাটে, সামনে সবুজ রং করা কাঠের ঝিলমিল লাগানো একসার মোটা থাম আর তাদের পেছনে চওড়া বারান্দা। দোতলার বারান্দায় ঢালাই লোহার ব্রিটিশ আমলের কারুকার্য করা রেলিং। সেই কারুকার্যের মধ্যে জায়গায় জায়গায় ব্রিটিশ ক্রাউন এখনও শোভা পাচ্ছে। বারান্দার পেছনে খড়খড়ি পাল্লার দশ-বারোটা দরজা, তাদের মাথায় রঙিন কাচ বসানো অর্ধচন্দ্রাকৃতি ফ্যানলাইট। ডানদিকে চওড়া শ্বেতপাথরের সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে। বাড়িটার সামনে বাঁধানো চত্বর, বাঁ-দিকে একটা আম-কাঁঠালের বাগান, ডানদিকে বাড়ির পেছনে যাবার রাস্তা, তার পাশে ফুলের বাগান আর কতগুলো লম্বা ঝাউ গাছ। আমবাগানের ভেতর দিয়ে একটা টিনের চালের একতলা বাড়ি দেখা গেল। সেটা বোধ হয় বডিগার্ডদের আস্তানা।
বাড়িটা যতই রাজসিক হোক না কেন, তার অতীত গৌরবের দিন আর নেই, বরং সর্বাঙ্গে অবহেলার চিহ্ন। রং তো বহুদিনই করা হয়নি, ঝিলমিল আর খড়খড়ি লাগানো পাল্লাগুলোর বেশ কয়েকটা ভাঙা। ফুলের বাগান বনবাসের সজ্জা পরে নিয়েছে বহুকাল আগেই, চত্বরের ওপরে ছড়িয়ে রয়েছে শুকনো পাতা আর নোংরা ছেঁড়া কাগজ। একতলার বারান্দার মেঝেতে বড়ো বড়ো ফাটল ধরেছে, ধুলো জমে আছে চারদিকে। আর, ঘরগুলোর মরচে ধরা প্রাচীন তালাগুলো দেখলে বোঝা যায় যে আজ আর এক-তলায় কেউ থাকে না। তাদের ঘিরে কাঁটালতা ওঠার আর বেশি দেরি নেই।
হৈমন্তী নীচু গলায় বলল, ‘বারান্দার বাঁ-দিক ঘেঁষে ওই বিশাল লম্বা নিমগাছটা দেখেছিস, সুমিত? ওটা কিন্তু খুব ইন্টারেস্টিং।’
সুমিত বলল, ‘ঠিক। তুই কি বলতে চাইছিস যে মা ওই গাছ দিয়ে নেমে পালিয়েছিল?’
‘না, সেটা অসম্ভব।’
বলে হৈমন্তী বাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল।
হৈমন্তীর পেছনে পেছনে সবাই দোতলায় উঠল। দোতলার বারান্দাটা তাও কিছুটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। সাদা-কালো মার্বেলের চৌখুপি করা মেঝে। তার একপ্রান্তে একটা আরামকেদারার ওপরে বৃন্দাবন চৌধুরি বসে ছিলেন। তাঁর পরনে নীল আর সাদায় স্ট্রাইপ পাজামা, ঊর্ধ্বাঙ্গে পুরোনো বাংলা সিনেমার নায়িকার বড়োলোক বাবার ইউনিফর্ম লাল ড্রেসিং গাউন। মুখে একটি অত্যন্ত বেমানান চুরুট।
অতিথিদের আসতে দেখে তাঁর হাস্যকর পোশাক সামলাতে সামলাতে উঠে দাঁড়ালেন বৃন্দাবন। দন্তবিকাশ করে বললেন, ‘আরে এসো, এসো। ওরে, কে আছিস, চারটে চেয়ার দিয়ে যা।’
বলামাত্র পূর্বদৃষ্ট দরোয়ানটার মতো গুন্ডামার্কা দুটো লোক দু-হাতে দুটো করে কাঠের চেয়ার এনে আরামকেদারার পেছনে রাখল। বোঝা গেল, তারা তৈরি হয়েই ছিল, ‘ওরে, কে আছিস’ বলাটা অতিথিদের ইমপ্রেস করার একটা অপ্রয়োজনীয় প্রচেষ্টা মাত্র। এইজন্য অপ্রয়োজনীয় যে লোকদুটির পিঠের ওপর আড়াআড়িভাবে স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধা ছিল দু-টি আগ্নেয়াস্ত্র। ইমপ্রেস করার জন্য সেটাই যথেষ্ট ছিল।
সবাই বসলে পরে, আলাপচারি শুরু হল। গৃহকর্তা বললেন, ‘প্রথমেই তোমাদের পরিচয় বলো।’
পরিচয়পর্ব শেষ হলে, হৈমন্তী দু-টি জিনিস লক্ষ করল। প্রথমত, হৈমন্তী পুনার সাংবাদিক এবং সে তার বাংলার পুরোনো জমিদারবাড়ি নিয়ে প্রবন্ধ লেখার জন্য তার ম্যানেজমেন্টের অনুমতি নিয়ে এসেছে শুনে বৃন্দাবন কিঞ্চিৎ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। আর দ্বিতীয়ত, চয়ন বম্বের এক বিখ্যাত হাসপাতালে কর্মরত বিলেতফেরত ডাক্তার শুনে যেন পুলকিত হলেন।
বৃন্দাবন বললেন, ‘বেশ, এবার বলো তোমার বাবার নাম কী, তিনি কী করেন?’
হৈমন্তী বলল, ‘আমার বাবার নাম সুব্রত রায়। বম্বের কাছে একটা কেমিক্যাল ফ্যাক্টরির ডিরেক্টর ছিলেন। এখন রিটায়ার করে কমলপুরে বাড়ি কিনে থাকতে এসেছেন।’
‘বটে? তা, কমলপুরে কেন?’
‘উনি কলকাতা শহর পছন্দ করেন না, অথচ পশ্চিমবাংলায় থাকতে চান। তাঁর একজন বন্ধু এই জায়গার খবর দিয়েছিলেন। এই জায়গাটা ওঁর খুব পছন্দ হয়েছে।’
‘তা বেশ। কোথায় তোমাদের বাড়ি?’
‘চ্যাটার্জি পাড়ায়। সবাই বাড়িটাকে বিনানির বাড়ি বলে।’
‘আচ্ছা, তোমাদের মা-র নাম কী?’
‘আমাদের মা-র নাম ইভা রায়।’
বলামাত্র বৃন্দাবনের মুখে আষাঢ়ের মেঘ ঘনিয়ে এল। প্রবল ভ্রূকুটি করে বললেন, ‘ইভা রায়? তাঁর কি অন্য কোনো নাম আছে? ডাকনাম গোছের?’
‘না, নেই।’
‘ঠিক জানো? তোমাদের মামাবাড়ি কোথায়?’
‘কলকাতায়। তবে, সে বাড়ির সঙ্গে আজ আর কোনো সম্পর্ক নেই। আমার জন্মের আগে আমার দাদামশায় মারা যান। তাঁর একমাত্র ছেলে বিলেতে থাকেন, আর ফিরে আসেননি। কারোর খোঁজখবরও রাখেন না। বাড়িটাও শুনেছি বিক্রি হয়ে গিয়েছে। আমার মাসিরা কেউ থাকেন বরোদায়, কেউ আসামে, একজন পণ্ডিচেরিতে থাকেন বলে শুনেছি।’
হঠাৎ বৃন্দাবন গর্জন করে উঠলেন, ‘ওসব বাজে কথা রাখো! তোমাদের মায়ের নাম রানি। ঠিক কি না, বলো?’
অবিচলিত হৈমন্তী বলল, ‘একেবারেই ঠিক নয়। আমি আমাদের মায়ের নাম ভাঁড়াচ্ছি, আপনার এহেন সন্দেহ হল কেন?’
নিজেকে সামলে নিলেন বৃন্দাবন। বললেন, ‘আমি অনেক দিন আগে রানি নামের একটি মেয়েকে চিনতুম। তোমার বোন অবিকল তার মতো দেখতে। সে যাক গে। তোমরা একটু বসো, আমি তোমাদের চায়ের ব্যবস্থাটা করে আসছি।’
বলেই উঠে দাঁড়িয়ে হনহন করে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেলেন।
চয়ন ফিসফিস করে বলল, ‘এটা কীরকম হল? ওরে কে আছিস বলে ডাক দিলেই তো হত।’
হৈমন্তী গম্ভীর মুখে বলল, ‘কী হল, বুঝতে পারলি না? ঠিকানাটা পেয়ে গেছে। এখন কমলপুরে লোক পাঠাচ্ছে রানিকে ধরে আনবার জন্য। আশা করি, বাবা আর মা বাড়িতে নেই। এতক্ষণে মনোরঞ্জন জ্যাঠামশায়ের চেম্বারে পৌঁছে গেছে।’
‘যদি না-গিয়ে থাকেন?’
‘তখন অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে হবে। এই সম্ভাবনাটার কথা ভেবে দেখিনি। দেখি কী হয়!’
বারান্দা থেকে দেখা গেল বিনু চৌধুরির গাড়িটা বাড়ির পেছন থেকে এসে গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল। একটু বাদেই হাসি হাসি মুখে শ্রী চৌধুরি দোতলায় উঠে এলেন।
হৈমন্তী বলল, ‘কি, কমলপুরে গাড়ি পাঠালেন মাকে ধরে আনবার জন্য? লাভ হবে না; কারণ আমরা বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে বাবা-মা কলকাতায় চলে গেছে। কী সব কেনাকাটা করবার আছে।’
বৃন্দাবনের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। বললেন, ‘তাই না কি? আমি যে তোমাদের মাকে ধরে আনবার জন্যে গাড়ি পাঠালুম— সেটা বুঝলে কী করে?’
‘সেটা বোঝা তো খুব কঠিন নয়, বৃন্দাবনবাবু।’
‘সে যাকগে। একসময় না একসময় তো ফিরবে। তখনই না-হয় ওদের নিয়ে আসবে। আমি আমার লোককে অপেক্ষা করতে বলে দিয়েছি। ওরা যতক্ষণ না আসছে, ততক্ষণ তোমাদের এখানেই থাকতে হবে।’
‘সেটা বোধ হয় সম্ভব হবে না। ওরা রাত করে ফিরবে। ততক্ষণ তো আমরা এখানে বসে থাকতে পারব না।’
শেয়ালের মতো দাঁত বের করে হাসলেন বৃন্দাবন। বললেন, ‘এটা আমার জমিদারি, সাংবাদিক মহোদয়া। এখানে আমার ইচ্ছেয় চলে, আর কারোর নয়।’
‘বলেন কী? আমি তো জানতুম জমিদারিপ্রথা বহুদিন হল উঠে গেছে।’
‘আরে, উঠিয়ে দিলেই কি আর হাজার বছরের প্রথা উঠে যায়? চেষ্টা করে দেখতে পারো, ইচ্ছে থাকলেই তোমরা যেতে পারো কি না। আমার দরোয়ানদের হাতে যে অস্ত্রগুলো দেখছ, ওগুলো কী, জানো?’
সুমিত বলল, ‘কালাসনিকভ।’
‘বাঃ, এইতো জানো দেখছি! ওগুলো কি করতে পারে, তাও নিশ্চয়ই জানো?’
‘জানি। আর, এও জানি যে ওগুলো বেআইনি অস্ত্র। এখানকার পুলিশ হয়তো আপনার ঘুস খেয়ে চোখ বন্ধ করে বসে থাকে, কিন্তু আমাদের কিছু হলে দিদির কাগজের লোকেরা এখানে এসে উপস্থিত হবে আর আপনার হাঁড়ির হাল করে ছাড়বে।’
‘আমার কিসসু হবে না হে ছোকরা! উলটে সরকারের তরফ থেকে আমাকে মেডেল দেবার জন্য অনুরোধ জানাবে তোমার দিদির কাগজ। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে তোমাদের মা তার বাবাকে গুলি করে খুন করে পালিয়েছিল। আমাকেও মারতে গিয়েছিল, আমি কোনোরকমে প্রাণ বাঁচিয়েছিলুম। জমিদারিটা উঠে যাচ্ছিল, আমি কোনোরকমে সেটা কিনে নিয়ে বাঁচাই। আজ তোমাদের মা আবার ফিরে এসেছে জমিদারির দখল নিতে আর তোমাদের পাঠিয়েছে সরেজমিনে অবস্থাটা দেখে নিতে। সে ভুলে গেছে যে খুনের মামলা তামাদি হয় না। সে এখানে এলেই সব ফয়সলা হবে। ততক্ষণ যদি তোমরা না-থাকো আর পালানোর চেষ্টা করো, তাহলে আত্মরক্ষার্থে তোমাদের আমাকে মেরে ফেলতে হবে। আর, এরকম একটি যুগান্তকারী খবরের সন্ধান পেয়ে তোমার দিদির কাগজ সেটাই তুলবে। তোমাদের মারা যাওয়াটা হবে নিতান্তই সেকেন্ডারি। তবে, তোমার ছোটো বোনটিকে অবশ্য মারব না। অমন ফুলের মতো একটা মেয়েকে তো গুলি করে মারা যায় না। তার জন্যে অন্য ব্যবস্থা হবে। ভয় নেই, সে সুখে থাকবে। আর, আমার বহুদিন আগেকার একটা ইচ্ছে পূর্ণ হবে।’
সুমিতের মুখ দেখে ওকে ইশারায় শান্ত থাকতে বলে হৈমন্তী বলল, ‘মা আসার পর যদি দেখা যায় যে আপনার অনুমান ভুল, তখন কী হবে ভেবে দেখেছেন?’
‘কী আবার হবে? মানুষমাত্রই ভুল করে। বলব, সরি স্যার, দুঃখজনক ঘটনা।’
‘কালাসনিকভগুলো সামলাতে পারবেন?’
‘সেটা তোমার চিন্তা না করলেও চলবে। সময়মতো ওগুলো অদৃশ্য হবে, কারোর বাবারও ক্ষমতা হবে না তাদের খুঁজে বের করা।’
ঠিক এইসময়ে পাশের ঘরে টেলিফোন বেজে উঠল। ইভার বর্ণনা অনুযায়ী ওটাই ছিল তাঁর বাবার শোবার ঘর।
টেলিফোনের ঘণ্টি শুনে চেয়ার বয়ে আনা দুটো লোকের একজন ছুটে ঘরের মধ্যে চলে গেল। একটু বাদে বেরিয়ে এসে বিনুকে বলল, ‘দারোগাবাবু ডাকছেন।’
বিরক্তমুখে উঠে দাঁড়ালেন বৃন্দাবন। বললেন, ‘একটা অপদার্থ লোক। তার আবার কী হল? অ্যাই গণেশ, তুই আর পল্টু সিঁড়ির মুখে দাঁড়া। এরা পালাতে চেষ্টা করলে গুলি চালাবি।’
বলতে বলতে বৃন্দাবন ঘরের ভেতরে চলে গেলেন। একটু বাদেই তাঁর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘কী হয়েছে? গাঁয়ের লোক থানা ঘেরাও করেছে? কেন? হাসান শেখের বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে বলে? আরে, ওই হাসানটা একনম্বরের হারামি, অ্যান্টিসোশ্যাল এলিমেন্ট। ওটা মরেছে বলে সকলকে মিষ্টি খাওয়ানো উচিত। ঠিক আছে। তোমার একটু দেরি করে এলেও চলবে। তবে বেশি দেরি যেন না-হয়। দরকার হলে লাঠি মেরে তাড়াও লোকগুলোকে। না-হলে গুলি চালাও। একটা পড়লেই সবাই পালাবে। আরে, ভেড়ার জাত তো সব। দুত্তোর, অনেক লোক! তোমার কি গুলির অভাব হয়েছে?’
বৃন্দাবন ব্যাজার মুখে বেরিয়ে এলেন। বললেন, ‘যতসব ঝামেলা আজকেই হতে হল। কোনো কাজ যদি সুষ্ঠুভাবে করা যায়! যাকগে, এবার তোমরা চলো। নীচে তোমাদের জন্য ওয়েটিংরুম তৈরি করে রেখেছি। তোমাদের বাবা-মা না-আসা পর্যন্ত, ওখানেই তোমাদের অপেক্ষা করতে হবে।’
হৈমন্তী সুমিতকে হাতের মুঠো শক্ত করতে দেখে বলল, ‘কোনিহি ডোকঁ তাপঊন ঘেঊ নাকা (কেউ মাথা গরম করবি না)। মি সাঙ্গে পরিয়ন্ত কোনিহি কাহি অ্যাকশন ঘ্যয়চি নাহি (আমি না বলা পর্যন্ত কেউ অ্যাকশন নিবি না)।
বৃন্দাবন ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললেন, ‘কী সাংকেতিক ভাষায় বলছো তুমি? আমার সঙ্গে চালাকি করার চেষ্টা কোরো না। সাবধান!’
হৈমন্তী সহাস্যে বলল, ‘সরি, সরি। সাংকেতিক ভাষা নয়, মারাঠিতে কথাগুলো বেরিয়ে গেল। মহারাষ্ট্রে বড়ো হয়েছি তো, আমরা নিজেদের মধ্যে ওই ভাষাতেই কথা বলি।’
‘কী বললে তুমি?’
‘বললুম, কোনো ভয় নেই। দেখবি, মা-বাবা এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘বটে? এবার তাহলে তোমরা ওঠো। অতিথিশালায় যেতে হবে। একটু রাত হলে আমার লোকেরা গিয়ে তোমার বোনকে নিয়ে আসবে। ততক্ষণ আমি দেখছি পুলিশের ব্যাপারটা কী হল! তোমাদের মাকে তাদের হাতে তুলে দিয়ে আমি তোমাদের ছেড়ে দেব। অকারণ রক্তপাত আমার ভালো লাগে না।’
আগে আগে বৃন্দাবন, তাঁর পেছনে তাঁর চারজন অতিথি আর তাদের পেছনে দু-জন বন্দুকধারী বরকন্দাজ শোভাযাত্রা করে এক-তলায় নেমে এল। সিঁড়ির পাশে একটা মোটা শালকাঠের দরজার সামনে দাঁড়াল সবাই। এই দরজাটা অন্য দরজাগুলোর মতো প্যানেল করা নয়, চাঁচাছোলা, তক্তাগুলো জায়গায় জায়গায় ফাঁক হয়ে গিয়েছে, কোনো একসময়ে রং করা হয়েছিল, এখন তার সামান্য চিহ্ন লেগে আছে, মাথায়ও কোনো ফ্যানলাইট নেই। দরজার মাঝামাঝি একটা হুড়কো লাগানো।
বৃন্দাবন দরজাটা খুলতে খুলতে বললেন, ‘এই আমাদের অতিথিশালা। এসো তোমরা।’
দরজাটা খোলা হলে দেখা গেল, চৌকাঠ থেকে একটা সিঁড়ি নীচে নেমে গেছে। সেটা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে একটা প্রায়ান্ধকার ঘর। কোনো একটা জায়গা থেকে ম্লান আলো আসছে। কোথা থেকে আসছে সেটা সিঁড়ির মাথা থেকে দেখা যাচ্ছে না।
চারজন সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামা শুরু করতেই দরজাটা বন্ধ করে দেওয়া হল আর হুড়কো টেনে দেবার শব্দ পাওয়া গেল।
ঘরটা বেশ বড়ো, আঠারো ফুট বাই ষোলো ফুট হবে। উচ্চতা কম, আট ফুটের বেশি হবে না। সিমেন্টের মেঝে, একপাশে দেওয়ালে দুটো দু-ফুট আড়াই ফুট মোটা লোহার গরাদ লাগানো জানলা। ঘরের অন্যপাশে একটা চার ফুট ব্যাসের কুয়ো, ফুট দেড়েক উঁচু একটা দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। কুয়োর তলাটা ঘন অন্ধকার। কতটা গভীর বা তলায় কী আছে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
হৈমন্তী চারদিক দেখে নিয়ে বলল, ‘সুমিত, জানলা দিয়ে দেখতো বাইরে কিছু দেখা যাচ্ছে?’
সুমিত গলা বাড়িয়ে দেখে বলল, ‘সামনে একটা পোড়ো বাগান। ঝোপঝাড়ের পেছনে একটা মরচেধরা লোহার শিটের গেট দেখা যাচ্ছে। গেটের গায়ে একটা হুড়কো লাগানো, সেটা বন্ধ আছে তবে তালা দেওয়া আছে কি না বুঝতে পারছি না।’
‘লোকজন কেউ আছে?’
‘না, কাউকে দেখছি না।’
‘জানলার শিকগুলো ভাঙা যাবে?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, কোনো ব্যাপারই নয়।’
‘ঠিক আছে। তুই অদিতিকে উঁচু করে তুলে জায়গাটা দেখিয়ে দে। অদিতি, সব ভালো করে দেখেনে যাতে কম আলোতেও গেটটা খুঁজে পেতে অসুবিধে না-হয়। তারপর আমাদের পরবর্তী অ্যাকশনের প্ল্যানটা বানাতে হবে। সন্ধ্যে হয়ে আসছে, তাড়াতাড়ি যা করবার করতে হবে।’
অদিতিকে কোমর ধরে তুলে ধরল সুমিত। সব দেখেশুনে অদিতি বলল, ‘গেটটা ছোটো আছে রে দিদি। তালা দেওয়া থাকলেও ফট করে টপকে বেরিয়ে যাব। বাইরে কোনো লোকজনও দেখলুম না।’
আস্তে আস্তে বাইরে আলো কমে এল। হৈমন্তী বলল, ‘শোন, আমি যে প্ল্যানটা করেছি, সেটা বলছি। সুমিত প্রথমে জানলার শিকগুলো খুলে নিয়ে অদিতিকে তার ভেতর দিয়ে বাইরে বের করে দিবি। অদিতি বাগানের গেট টপকে বাইরে গিয়ে রিকশা নিয়ে সোজা কালীকৃষ্ণবাবুর বাড়ি চলে যাবি। তারপর তিনি যা করবার করবেন। তুই কিন্তু কোনো পাকামি করতে যাস না। আর মনোরঞ্জন জ্যাঠামশায়কে একটা ফোন করে বাবা বা মাকে বলে দিবি যে সব ঠিক আছে, চিন্তার কোনো কারণ নেই, আমরা চা খাচ্ছি আর চা খেয়ে বাড়িটা ঘুরে দেখব। আমি তোকে বাইরে পাঠিয়েছি ফোন করবার জন্য। ফোন নম্বরটা কালীকৃষ্ণবাবুর কাছে জেনে নিবি।’
অদিতি দৃঢ়ভাবে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘ঠিক আছে।’
চয়ন বলল, ‘মেন গেটের গার্ডটা কিন্তু ডেঞ্জারাস। গুলি চালাতে দ্বিধা করবে না। সে ব্যাপারে কালীকৃষ্ণবাবুকে সাবধান করে দিবি, অদিতি।’
হৈমন্তী বলল, ‘ঠিক কথা। আমাদের জন্য ওদের কারোর কিছু হয়ে গেলে সেটা খুব খারাপ হবে। এইবার শোন, অদিতি বেরিয়ে যাবার মিনিট দশেক বাদে আমরা খুব চেঁচামেচি জুড়ে দেব এই বলে যে ও কুয়োয় ঝাঁপ দিয়েছে। একথা শুনলে বৃন্দাবন নির্ঘাৎ এখানে লোক পাঠাবে। কামাল মণ্ডলের কথা যদি ঠিক হয় তাহলে বৃন্দাবনের সৈন্যসংখ্যা সাতজন। দু-জন গেছে কমলপুরে, একজন আছে গেটে, দু-জন আছে বাবুর বডিগার্ড। আরও দু-জন নিশ্চয়ই ধারেকাছেই আছে। বৃন্দাবন যদি দু-জন বা তিনজনকে পাঠায়, তাদের আমাদের কবজা করতে হবে। সেটা কীভাবে হবে, তা অবস্থা বুঝে স্থির করতে হবে।’
সুমিত বলল, ‘অসুবিধে হবার কথা নয়। ওরা তো জানে না যে আমরা সকলেই ব্ল্যাকবেল্ট। সেই সারপ্রাইজ এলেমেন্টটা কাজে লাগাতে হবে।’
‘ঠিক বলেছিস। আমরা ওদের ঘরে আটকে রেখে বেরিয়ে যাব। তারপরে কী হবে সেটাও আবার অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। এইবার অদিতির অ্যাকশন। সুমিত ওকে তুলে বের করে দে। অদিতি, বেরোবার আগে গলা বাড়িয়ে দেখে নিবি যে আশেপাশে কেউ আছে কি না। যতটা পারবি নিঃশব্দে যাবি।’
অদিতি বলল, ‘চিন্তা করিস না। ঠিক কালীকৃষ্ণবাবুর বাড়ি পৌঁছে যাব। তোরা সাবধানে থাকিস।’
বলতে বলতেই সুমিত এক হ্যাঁচকা টানে একটা জানলার দুটো শিক খুলে ফেলল। তারপর অদিতিকে কাঁধের ওপর তুলে নিল।
অদিতি গেট টপকে বাইরে বেরিয়ে দেখল কিছু দূরে কামাল আর কানাই রাস্তার ধারে একটা কালভার্টের ওপর বসে বিড়ি খাচ্ছে আর গল্প করছে। সন্ধ্যের আবছা আলোতে অদিতিকে আসতে দেখে দু-জনেই দৌড়ে এল।
উত্তেজিত কামাল বলল, ‘কী হল দিদিমণি? বাকি সবাই কোথায়?’
অদিতি বলল, ‘সব বলব কামাল, আগে যত তাড়াতাড়ি পারো কালীকৃষ্ণবাবুর বাড়িতে চলো। আর কানাই, তুমি এখানে থাকো।’
ঝড়ের বেগে রিকশা চালাতে চালাতে কামাল বলল, ‘মনে হচ্ছে, আজ একটা-কিছু হবে। ইনশাল্লা, ওই শয়তানটার খেলা শেষ হবে এবার!’
কালীকৃষ্ণবাবু সব শুনে বলল, ‘এই ব্যাপার? ঠিক আছে। চলুন। ছেলেরা তৈরি আছে। আমরা সাইকেলে রওনা হয়ে যাচ্ছি। আপনি আমার বাড়িতে চলে যান। সেখান থেকেই ফোন করবেন। আর বাইরে বেরোবার চেষ্টা করবেন না।’
অদিতি বলল, ‘বাইরে বেরোবার চেষ্টা করব না মানে? আপনারা ওখানে লড়াই করবেন, আর আমি লুকিয়ে বসে থাকব? সে হবে না। আমিও আসছি। আপনাদের এই ফোনটা কাজ করে না?’
‘করে বই কী!’
‘আমি তবে এখান থেকেই ফোন করে আপনাদের পেছনে পেছনে আসছি। নম্বরটা দিন।’
কালীকৃষ্ণ প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলেন। অদিতি বাধা দিয়ে বলল, ‘দেরি করবেন না। সময় কিন্তু বেশি নেই। যান, শীগগির রওনা হয়ে পড়ুন।’
বৃন্দাবন চিৎকার করে বললেন, ‘গোপেশ্বর, অ্যাই গোপেশ্বর! দ্যাখতো, ওরা গুমঘরে এমন চেল্লাচ্ছে কেন? ব্যাপারটা কী দ্যাখ আর চেল্লাতে বারণ কর।’
একটু বাদেই গোপেশ্বর ছুটতে ছুটতে ওপরে এল। বলল, ‘বাবু, ওরা বলছে ছোটো বোনটা কুয়োয় ঝাঁপ দিয়েছে।’
‘বলিস কী রে? কী সর্বনাশ! শিগগির যা, ইন্দারকেও নিয়ে যাবি। যদি দেখিস বাকিগুলো চালাকি করার চেষ্টা করছে, গুলি চালাবি। নীচের দিকে মারিস, দেখিস যেন গায়ে না-লাগে। এক্ষুনি ওদের মেরে ফেলবার দরকার নেই। সেটা পরে দেখা যাবে। আর দুটো বড়ো দড়ি নিয়ে যা। যদি দেখিস ওরা সত্যি কথা বলছে, তখন একটা দড়ি দিয়ে তিনটেকে বেঁধে রেখে অন্যটা দিয়ে কুয়োর ভেতর নেমে গিয়ে মেয়েটাকে তুলে আনবি। শিগগির যা, মেয়েটা যেন ড্যামেজ হয়ে না-যায়। অনেকদিন বাদে একটু ফুর্তি করব ভাবলুম। তা নয়, যত ঝামেলা।’
জনাতিনেক ছেলেকে নিয়ে কালীকৃষ্ণ গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন। অদিতি আর বাকিরা রইল আড়ালে, অনেকটা দূরে একটা বড়ো গাছের পেছনে।
দূর থেকে দেখা গেল, কালীকৃষ্ণ দরোয়ানটার সঙ্গে কথা বলছেন, তাকে কিছু বোঝাবার চেষ্টা করছেন। সে কিন্তু নির্বিকার। সোজা বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। গেটের তালা খোলার তার যে বিন্দুমাত্র বাসনা নেই— সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পণ্ডশ্রমের পর কালীকৃষ্ণ ফিরে এলেন। বললেন, ‘সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না। তোরা চেম্বার বের কর। বুকে হেঁটে এগিয়ে গিয়ে গুলি চালাবি।’
অদিতি বলল, ‘দাঁড়ান। এখনই খুনখারাবি করতে যাবেন না। অ্যাসল্ট রাইফেল চললে রক্তারক্তি হবে, অকারণে কিছু প্রাণ যাবে। আমার সঙ্গে চারজন আসুন, আগে আমি চেষ্টা করে দেখি। ফুট চারেক উঁচু গেট পেরুতে হবে, কিন্তু নিঃশব্দে।’
‘আপনি আবার কী চেষ্টা করবেন? ওই রাক্ষসটার সঙ্গে আপনি টক্কর দেবেন? তাহলেই হয়েছে! সেটা আমরা দিতে পারি, আপনি পারেন না। ওরা যে কী মাথামোটা শয়তান, আপনি তা জানেন না।’
অদিতি হেসে বলল, ‘খুব ভালো করেই জানি। সেই বুদ্ধিহীন শয়তানিটাই তো কাজে লাগাতে চাই। চিন্তা করবেন না। শান্ত হয়ে থাকুন। আগে আমাকে যেতে দিন। আমি না পারলে, তখন আপনি যা করবার করবেন।’
কালীকৃষ্ণ অদিতির অবিচলিত দৃঢ়তা দেখে বেশ আশ্চর্যই হলেন। বললেন, ‘ঠিক আছে। আপনি যান। জানি না আপনাকে যেতে দেওয়াটা ঠিক কাজ হচ্ছে কি না। তবে আমার মনে হচ্ছে, আপনি পারবেন। এই চারটে ছেলে আপনার সঙ্গে যাবে। যদি একটুও গণ্ডগোল দেখেন, পত্রপাঠ ফিরে আসবেন। আর তোদেরও বলি, সামান্যতম বিপদ দেখলেই বেরিয়ে এসে আমাকে খবর দিবি। তারপর আমি যা করবার করব।’
ক্যাঁচ কোঁচ করে গুমঘরের দরজাটা খুলে গেল। দুটো ষণ্ডামার্কা লোক বন্দুক হাতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল। তিন বন্দি তখন যথাসাধ্য চিন্তিত মুখে কুয়োর পাশে দাঁড়িয়েছিল আর অদিতির নাম ধরে ডাকাডাকি করছিল।
গুন্ডাদুটো নেমে আসতেই হৈমন্তী কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘আমার বোন এর ভেতরে লাফিয়ে পড়েছে। আর দেখুন, কোনো সাড়াশব্দও করছে না। আপনারা ওকে বাঁচান। আমি আর কিচ্ছু চাই না, শুধু ওকে বাঁচাতে চাই।’
গোপেশ্বর নামক লোকটি বলল, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমরা দেখছি। তোমরা একপাশে দাঁড়াও। কোনোরকম নড়াচড়া করবে না। তাহলে কিন্তু সঙ্গেসঙ্গে গুলি চালাব।’
হৈমন্তী বলল, ‘আমরা কেউ কিচ্ছু করব না। আপনারা আগে ওকে তোলার ব্যবস্থা করুন।’
বলতে বলতে গোপেশ্বর কুয়োর কাছে এগিয়ে গেল। তলার নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্যে কিছু দেখা যায় কি না সেই চেষ্টায় ব্যাপৃত হয়ে বলল, ‘ইন্দার, আগে তুই ওদের বাঁধ, তারপরে বাবুর কাছ থেকে একটা টর্চ নিয়ে আয়। তলায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না যে।’
ইন্দার দড়ি নিয়ে ওদের দিকে এগিয়ে এল আর গোপেশ্বর কুয়োর ওপর ঝুঁকে পড়ল।
হৈমন্তী নীচু গলায় বলল, ‘আত্তা (এইবার)।’
বলামাত্র সুমিত তার লম্বা পায়ে গোপেশ্বরের পশ্চাদদেশে একটা প্রচণ্ড লাথি কশাল। লোকটা হুড়মুড় করে কুয়োর ভেতরে পড়ে গেল। ব্যাপারটা এতই অপ্রত্যাশিতভাবে এবং আচমকা ঘটে গেল যে ইন্দার তার বিস্ময় কাটিয়ে দড়ি ফেলে বন্দুক তুলতে যে সময়টা নিল, তার মধ্যেই হৈমন্তীর ডানহাতের চেটো তরোয়ালের মতো প্রচণ্ডবেগে তার গলায় এসে লাগল। লোকটা নিঃশব্দে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
সুমিত বলল, ‘ওই যাঃ, মরে গেল না কি?’
চয়ন ইন্দারের গলায় হাত দিয়ে তার ক্যারোটিড আর্টারিটা দেখে নিয়ে বলল, ‘নাঃ, মরেনি। তবে যা একখানা লাগিয়েছিস, জ্ঞান ফিরতে সময় লাগবে।’
হৈমন্তী বলল, ‘তা হোক। তোরা দু-জনে এটাকে ভালো করে একটা দড়ি দিয়ে বাঁধ আর মুখটা রুমাল দিয়ে বেঁধে দে যাতে জ্ঞান ফিরে চ্যাঁচাতে না পারে।’
বলে, বন্দুকটা আর অন্য দড়ির লাচিটা তুলে নিল। বন্দুকটা সুমিতের হাতে দিয়ে বলল, ‘কাঁধে নে। চল, এইবার সেই গাছের কাছে।’
দড়ির লাচিটা হৈমন্তী নিজের কাঁধে ঝুলিয়ে নিল।
অদিতি আর তার চার সঙ্গী গেট টপকে বাগানে ঢুকল। বাগানের ভেতরটা তখন বেশ অন্ধকার। জমিদারবাড়ির দোতলার বারান্দায় আলো জ্বলে উঠেছে। সেই আলোয় সামান্য আলোকিত হয়ে রয়েছে।
পাঁচিল ঘেঁষে সকলে প্রায় নিঃশব্দে মেন গেটের দিকে এগিয়ে চলল। একতলা অ্যাসবেস্টস চালের গেটহাউসের বারান্দায় একটা টিউবলাইট জ্বলছিল। তার আলোয় উঠোনের অনেকটাই দেখা যাচ্ছিল।
কিছুটা এগিয়ে অদিতি বলল, ‘আপনারা এখানে দাঁড়ান। একদম কথা বলবেন না। দরোয়ানটা গেটের সামনে আমাদের দিকে পেছন করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি যাচ্ছি। ওকে এখানে টেনে আনতে হবে। আমি শিস দিলে আপনারা পেছন থেকে ওর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়বেন আর মাটিতে চেপে ধরে রাখবেন। ঠিক আছে?’
উত্তেজিত চাপা গলায় সকলে বলল, ‘ঠিক আছে।’
অদিতি অকম্পিত পায়ে গেটের দিকে এগিয়ে গেল। বাগানটা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে গেটহাউসের আলো এসে পড়েছে। অদিতি সেই আলোর মধ্যে দু-হাত মাথার পেছনে দিয়ে কোমর বেঁকিয়ে যথাসাধ্য সেক্সি পোজ মেরে দাঁড়াল। মধুরকণ্ঠে দরোয়ানটাকে ডেকে বলল, ‘অ্যাই, শোনো, শোনো-না।’
দরোয়ানটা ঘুরে দাঁড়িয়ে ওই দৃশ্য দেখে স্তম্ভিত। হাঁ করে তাকিয়ে রইল। অদিতি যখন ওকে আঙুল নেড়ে ডাকল, তখনও সে নড়ল না। তার অতিক্ষুদ্র বুদ্ধিতে ঘটনাটা কী ঘটছে সেটা বোঝবার চেষ্টা করতে লাগল। বন্দুকটা পর্যন্ত তুলতে পারল না।
অদিতি তখন খুব আস্তে আস্তে তার পেছনের চারজন দর্শকের উদবিগ্ন চোখের সামনে ওর র্যাপ-অ্যারাউন্ড স্কার্টটা খুলতে শুরু করল। এইবার দরোয়ানটার মুখ একটা অশ্লীল হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ঘটনাটা কেন ঘটছে সেটা না বুঝলেও, এহেন সুযোগ যে হাতছাড়া করা উচিত নয়— এটা সে পরিষ্কার বুঝতে পারল। অদিতি যখন স্কার্টটা পুরো খুলে ফেলল, তখন তার নীচে সাদা হাফপ্যান্টটা দেখে অন্য দর্শকেরা কিছুটা নিশ্চিন্ত হল বটে কিন্তু দরোয়ানটা ক্ষেপে গেল। বন্দুকটা পাঁচিলের গায়ে ঠেকিয়ে রেখে ছুটে গেল অদিতির দিকে।
অদিতি লোকটাকে হাত নেড়ে ডাকতে ডাকতে অন্ধকার বাগানের ভেতরে ঢুকে গেল। সে কাছাকাছি আসতেই, হঠাৎ একটা চক্কর মেরে ঘুরে অদিতি একটা লাথি চালাল তার পেট লক্ষ করে। ওর স্নিকারটা একটা এক্সপ্রেস ট্রেনের গতিতে গিয়ে লাগল দরোয়ানটার সোলার প্লেক্সাসে, সে গাঁক করে একটা শব্দ করে নিঃশ্বাস নেবার আপ্রাণ চেষ্টায় মাটিতে পড়ে গেল।
শিস দেবার আর দরকার হল না। তার আগেই ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে কালীকৃষ্ণবাবুর চারজন ছেলে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপরে। একজন তার দু-পায়ের ওপরে বসল, দু-জন বসল তার দুইহাতের ওপর, একজন তার মুখ চেপে ধরল। ওদের মধ্যে একজন বলল, ‘দড়ি কোথায় পাব, দিদি? এটাকে তো বাঁধা দরকার।’
অদিতি বলল, ‘দড়ি দিচ্ছি। আর মুখটা বেঁধে দেবেন যাতে চ্যাঁচাতে না-পারে।’
বলে ওর পরিত্যক্ত স্কার্টটা তুলে এনে সেটা ফালা ফালা করে ছিঁড়ে ফেলল। ফালিগুলো দিয়ে বলল, ‘এতে হবে?’
সবাই সমস্বরে বলল, ‘অবশ্যই!’
অদিতি দরোয়ানটার কোমর থেকে চাবির রিং বের করে দৌড়ে চলে গেল গেটের দিকে।
ইতিমধ্যে হৈমন্তী, চয়ন আর সুমিত বারান্দার গা ঘেঁষে ওঠা নিম গাছটার নীচে এসে দাঁড়িয়েছে। হৈমন্তী সুমিতকে ইশারায় গাছে উঠে বারান্দায় চলে যেতে বলল।
কালীকৃষ্ণবাবু সাদা হাফপ্যান্ট আর নীল টি-শার্ট পরিহিত অদিতিকে গেট খুলতে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। কিন্তু তখন চিন্তা করবার সময় নেই। সদলবলে এগিয়ে এসে গেট পেরিয়ে চত্বরের মধ্যে ঢুকে পড়লেন।
নীচে গোলমাল শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন বৃন্দাবন। উঠোনে তখন একদল গ্রামের লোক আর তাদের আগে আগে অ্যাসল্ট রাইফেল হাতে অদিতি আর কালীকৃষ্ণকে আসতে দেখে বোধ হয় নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না জমিদারবাবু। কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করলেন, তারপর চিৎকার করে বললেন, ‘অ্যাই অ্যাই, তোমরা ভেতরে ঢুকেছ কেন? বেরোও, এক্ষুনি বেরোও! নইলে কাউকে আস্তে রাখব না।’
ইতিমধ্যে তাঁর দুই দেহরক্ষী অন্য একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। তারা বেরিয়েই তাঁর দিকেই বন্দুক তুলল।
আতঙ্কিত বৃন্দাবন চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘আরে, এই নেমকহারাম শুয়োরের বাচ্চারা, মারবি নাকি আমাকে?’
বলতে বলতেই তিনি টের পেলেন যে তাদের লক্ষ তিনি নন, তাঁর পেছনে অন্য কেউ। তার কারণ, তাঁর ঘাড়ে একটা বন্দুকের নল এসে ঠেকেছে। পেছন থেকে সুমিত বলল, ‘ওই লোকগুলোকে বলুন এই মুহূর্তে বন্দুক ফেলে দিতে নইলে আপনার মাথাটা গুলি করে ঝাঁঝরা করে দেব!’
কাঁপতে কাঁপতে বৃন্দাবন বললেন, ‘ওরে বাবা, ফেলে দে, এক্ষুনি বন্দুক ফেলে দে!’
লোকদুটো বিনা বাক্যব্যয়ে বন্দুক ফেলে দিল। ততক্ষণে হৈমন্তী আর চয়ন সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসেছে। ওরা বন্দুক দুটো তুলে নিয়ে গুন্ডাদুটোকে বলল, ‘মাটিতে শুয়ে পড়ো, নইলে কেউ প্রাণে বাঁচবে না।’
পত্রপাঠ লোকদুটো উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। হৈমন্তী দড়িটা চয়নের হাতে দিয়ে বলল, ‘এ-দুটোকে ভালো করে বাঁধ।’
ততক্ষণে অত্যন্ত উত্তেজিত অদিতি লাফাতে লাফাতে ওপরে উঠে এসেছে। তার পেছনে কালীকৃষ্ণ আর ক্রুদ্ধ গ্রামবাসীদের জনতা। রিকশাওয়ালাদের কাছে সবাই খবর পেয়ে গেছে।
এই গোলমালের মধ্যে বৃন্দাবন হঠাৎ ঘুরে এক দৌড়ে ঘরের ভেতর ঢুকে গিয়ে সশব্দে দরজা বন্ধ করে দিলেন। বোধ হয় তাঁর উদ্দেশ্য ছিল গা ঢাকা দেওয়া আর পুলিশকে টেলিফোন করা। কিন্তু তা করা গেল না।
হৈমন্তী চেঁচিয়ে বলল, ‘সুমিত, দরজা ভেঙে ফ্যাল।’
কালীকৃষ্ণ বললেন, ‘আপনি একা অত বড়ো দরজা ভাঙতে পারবেন না। আমরাও আসছি।’
তার দরকার হল না। হৈমন্তীর কথা শোনামাত্র সুমিত বিদ্যুৎবেগে ঘুরে দরজার ওপরে একটি প্রচণ্ড লাথি মারল। ছিটকিনি ভেঙে দরজাটা দড়াম করে খুলে গেল।
তৎক্ষণাৎ অত্যন্ত অপ্রত্যাশিতভাবে বৃন্দাবন দৌড়ে বেরিয়ে এসে সুমিতের পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন, ‘ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। তুমি আমাকে বাঁচাও। তুমি যত টাকা চাইবে, তাই দেব তোমাকে।’
সুমিত একহাতে ঘাড় ধরে লোকটাকে অনায়াসে শূন্যে তুলে ধরল। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ক্রুদ্ধ জনতাকে সম্বোধন করে বলল, ‘কেউ একে মারবেন না। গায়ে হাত দেবেন না। এ আমাদের অসহায় দাদামশায়কে টাকার লোভে গুলি করে মেরেছিল, আমাদের মাকে একবস্ত্রে রাস্তায় বের করে দিয়েছিল। আপনাদের ওপরে অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছিল। একে এখন পিটিয়ে মারলে, এর তো কোনো শাস্তিই হবে না।’
একজন গ্রামবাসী বললেন, ‘ওটাকে কি পুলিশের হাতে দেবেন না কি? তাহলেই হয়েছে! দু-দিন পরেই ফিরে এসে আবার স্বমূর্তি ধরবে। আমরা শালাকে যখন একবার হাতে পেয়েছি, তখন ওকে জ্যান্ত এ বাড়ি থেকে বেরুতে দেব না। আজকেই ওর ধড় মুণ্ডু আলাদা করে দেব— এই কথা বলে দিলুম।’
লোকটির কথা শুনে বৃন্দাবন শূন্যে পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন।
এবার কালীকৃষ্ণ এগিয়ে এলেন। হৈমন্তীকে বললেন, ‘এটাকে নিয়ে কী করবেন, কিছু ভেবেছেন?’
হৈমন্তী বলল, ‘একেবারে যে কিছু ভাবিনি, তা নয়। এবার, একটা জিনিস যদি খুঁজে পাই তাহলে কী করব সেটা স্থির করব।’
‘কী জিনিস?’
‘চলুন, দেখাচ্ছি। আপনারা সকলে শুনুন, সবাই এখানে এই লোকটাকে ঘিরে দাঁড়ান। একে পাহারা দিন। দেখবেন, কেউ যেন এর গায়ে হাত না-দেয়। আমাদের একটু সময় দিন তারপরে কী করা হবে তা ঠিক করা যাবে।’
ওরা চারজন আর কালীকৃষ্ণ জমিদারের শোবার ঘরে ঢুকল। দেওয়ালে আলমারির চোরকুঠুরিটা খুঁজে পেতে অসুবিধা হল না। ভেতর থেকে বেরল একটা ধূলিধূসরিত মোটা হলদে কাগজের বড়োসড়ো খাম। চল্লিশ বছর বাদেও খামটি প্রায় অক্ষত আছে। পোকায় কাটতে পারেনি। তার ভেতর থেকে বের হল একটি এক্সারসাইজ খাতা।
খাতাটার পাতায় পাতায় ঝকঝকে কালিতে পরিষ্কার অক্ষরে রামানন্দ সিংহ তাঁর জীবনের শেষ ক-টি দিনের রোজনামচা লিখে রেখে গেছেন। সেই লেখা পড়তে পড়তে স্পষ্ট বোঝা যায় যে সেই অশক্ত বৃদ্ধ বেশ বুঝতে পারছিলেন যে তাঁর অন্নদাস বৃন্দাবন কীভাবে আস্তে আস্তে তাঁর সর্বনাশ করবার জন্য তাঁর চারদিকে ষড়যন্ত্রের জাল গুটিয়ে আনছিল। তাঁরই টাকা সরিয়ে একের পর এক তাঁর সম্পত্তি বেনামে কিনে তাঁকে সর্বস্বান্ত করে ফেলছিল। নৃশংস বিশ্বাসঘাতকতার রোমহর্ষক ছবিটা বেশ পরিষ্কার ফুটে উঠেছিল তাঁর লেখার ছত্রে ছত্রে।
ডায়েরির শেষ ক-টি পংক্তি অতি ভয়ংকর। রামানন্দ লিখেছেন, কিছুদিন যাবৎ আমি যে পিস্তলটি দিয়া রানিকে বন্দুক চালানো শিখাইতে ছিলাম তাহা পাইতেছি না। রানিকে সন্দেহ করি না, কারণ সে আজ পর্যন্ত কখনোই কোনো কিছু হারায় নাই। দুই দিন আগে বৃন্দাবন আমাকে বলিয়াছিল যে যদি আমি রানির সহিত তাহার বিবাহ দেই, তাহা হইলে আমার জমিদারিও বাঁচিবে— আমিও বাঁচিব। আমি সেই প্রস্তাব ঘৃণভরে প্রত্যাখ্যান করিয়াছি। তবে কি সে-ই পিস্তলটি হস্তগত করিয়েছে এবং আমাকে হত্যা করিবার মতলব আঁটিতেছে? এতটা দুঃসাহস বোধ হয় তাহার হইবে না। সে জালিয়াত, কিন্তু নরহত্যা করিবার মতো ক্ষমতা তাহার মতো সামান্য ব্যক্তির আছে বলিয়া মনে হয় না। সে লেখাপড়া বেশি শেখে নাই বটে, কিন্তু সে ভদ্রসন্তান। এতটা অপরাধপ্রবণতা তাহার চরিত্রে থাকিতে পারে আমার তাহা বিশ্বাস হয় না। যাহা হউক, আজ সন্ধ্যার আলোচনা শেষ হইলে কাল প্রত্যুষে রমারঞ্জনের সহিত রানিকে কার্শিয়াঙের বাড়িতে পাঠাইয়া দিব। সাবধানের মার নাই।’
সে সুযোগ রামানন্দ আর পাননি।
কালীকৃষ্ণ অপারবিস্ময়ে হৈমন্তীর পড়া শুনছিলেন। শেষ হলে বললেন, ‘এতো বিনু চৌধুরির মৃত্যুবান। লোকটাকে আমাদের মারধোর করবার তো কোনো দরকার নেই। এই ডায়েরিটাই তাকে নিশ্চিতভাবে হয় ফাঁসিকাঠে ঝোলাবে নয়তো যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে পাঠাবে। আমাদের উচিত রামানন্দ সিংহের খুনের প্রতিশোধ তাঁকেই নিতে দেওয়া।’
হৈমন্তী বলল, ‘ঠিক বলেছেন। নে অদিতি, এবার মনোরঞ্জন জ্যাঠামশাইকে ফোন করে ব্যাপারটা জানিয়ে দে। এরপর থেকে যা-কিছু করবার তা উনিই করবেন। আর ওই বন্দুকটা এবার রাখতো। ওটার আর দরকার হবে না।’
দন্তবিকাশ করে অদিতি বলল, ‘একটু পরে রাখব রে দিদি। খুব মজা লাগছে এটা নিয়ে ঘুরতে।’
চয়ন বলল, ‘তোকে যা দেখাচ্ছে না, অদিতি। একেবারে ফিয়ারলেস নাদিয়া।’
অদিতি ওকে জিভ ভেঙিয়ে টেলিফোন করতে গেল। ডায়াল করার পর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, ‘কেউ ফোন ওঠাচ্ছে না দিদি, ওরা আবার কোথায় গেল?’
হৈমন্তী বলল, ‘দশমিনিট বাদে আবার চেষ্টা করিস। মনে হচ্ছে কোথাও খেতে-টেতে গেছে।’
ওর মুখটা কিন্তু চিন্তিত হয়ে রইল।
কালীকৃষ্ণ বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। সমবেত জনতাকে সম্বোধন করে বললেন, ‘কেউ এর গায়ে হাত লাগাবে না। একে একটু জলটল খেতে দাও আর বাতাস-টাতাস করো। তবে ওর গুন্ডাগুলোকে বেঁধে রাখো। সেগুলো যেন ছাড়া না-পায়।’
একজন গ্রামবাসী চেঁচিয়ে বলল, ‘কী বলছেন কালীদা? এটাকে ছেড়ে দেব? আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন?’
কালীকৃষ্ণ সহাস্যে বললেন, ‘আমি তো এটাকে ছেড়ে দিতে বলিনি। আমি শুধু ওকে মারধোর দিতে বারণ করেছি। এটাকে টিকিয়ে রাখতে হবে, নইলে তোমরাই পরে পস্তাবে।’
এইবার বিনু চৌধুরির মুখে বুলি ফুটল। হেঁ হেঁ করে হেসে বললেন, ‘যাক, তোমরা বুঝেছ তাহলে যে আমার গায়ে হাত দিলে তোমাদেরই বিপদ? দাও, এবার আমার হাত-পায়ের বাঁধনগুলো খুলে দাও।’
হঠাৎ হুংকার দিয়ে উঠলেন কালীকৃষ্ণ। রক্তচক্ষু করে বললেন, ‘চোপ শালা, শয়তানের বাচ্চা! একটা কথা বলবি না। বললে, জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলে দেব, হারামজাদা!’
এই অপ্রত্যাশিত গর্জনের আকস্মিকতায় গ্রামবাসীরা চমকে উঠল তো বটেই আর একেবারে কুঁকড়ে গেলেন বিনু চৌধুরি। বিড়বিড় করে কী যেন বললেন, বোঝা গেল না।
ঠিক এইসময় কে যেন নীচের থেকে চেঁচিয়ে বলল, ‘পুলিশের গাড়ি আসছে, কালীদা। সঙ্গে আরও একটা গাড়ি।’
বিনু চৌধুরির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। চাপা গলায় বললেন, ‘এইবার বুঝবে কত ধানে কত চাল।’
কালীকৃষ্ণ পাত্তা দিলেন না। রেলিঙের কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘গেট খুলে দাও। ভেতরে আসতে দাও।’
চত্বরের ভেতরে প্রথমে ঢুকল একটা পুলিশের জিপ। তার থেকে নামলেন সাদা পোশাকে একজন ভদ্রলোক।
তাঁকে দেখে কালীকৃষ্ণ বললেন, ‘আরে এ যে এসডিপিও নন্দীসাহেব স্বয়ং।’
!জপের পেছনে পেছনে ঢুকল একটা কালোরঙের অস্টিন এ-ফর্টি। তার ভেতর থেকে নামলেন মনোরঞ্জন দত্ত, সুব্রত আর ইভা। থরথর করে কাঁপছিলেন ইভা, মুখ-চোখ লাল, সুব্রত তাঁকে ধরে না রাখলে বোধ হয় দাঁড়াতেই পারতেন না। তাঁদের দেখে, অদিতি প্রায় নাচতে নাচতে সিঁড়ি দিয়ে এক ছুটে নেমে গেল।
গাড়ির সামনে এসে উত্তেজনায় কম্পিত গলায় অদিতি বলল, ‘মা, ডায়েরিটা পাওয়া গেছে।’
হয়তো সে আরও কিছু বলত। কিন্তু ওকে দেখেই ইভা সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘একী? এতগুলো লোকের সামনে তুই একটা ওইটুকু হাফপ্যান্ট পরে বন্দুক বগলে লাফাচ্ছিস? একেবারে জংলি হয়ে গেছিস। তোর স্কার্ট কোথায় গেল?’
অবিচলিত অদিতি একমাথা কোঁকড়া চুল ঝাঁকিয়ে বলল, ‘ওটা দিয়ে তো দরোয়ান বাঁধা হয়েছে। সে ওই ঝোপের ভেতরে আছে।’
‘দরোয়ান বাঁধা হয়েছে, মানেটা কী? দড়ি পেলিনে?’
‘কোথায় দড়ি? ওটা ছিঁড়েই তো দড়ি বানানো হল। ঝোপের ভেতরে কি দড়ি পাওয়া যায়?’
মা মেয়ের এই কথোপকথন শুনে সকলেই উচ্চৈস্বরে হেসে উঠলেন। মনোরঞ্জন কোনোমতে দম নিয়ে বললেন, ‘মা সবসময়েই মা। এত মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যেও ঠিক মেয়ের দিকে নজর আছে।’
ইতিমধ্যে হৈমন্তী, চয়ন আর কালীকৃষ্ণ দোতলা থেকে নেমে এসেছে।
একতলার বারান্দায় একটা নিওন আলোর নীচে কয়েকটা চেয়ার পাতা হল নবাগতদের জন্য। সেখানে বসে এসডিপিও শ্রীকুমার নন্দী গভীর মনোযোগের সঙ্গে ডায়েরিটা পড়লেন। শেষ হলে মুখ তুলে বললেন, ‘আর আমার কিছু জানবার নেই। সবই জলের মতো পরিষ্কার। একটু বাদেই এখানকার ওসি এসে যাবে। ওকে কী করতে হবে, আমি সে ব্যাপারে ইন্সট্রাকশন দিয়ে দেব। আপাতত, আমি এই ডায়েরিটা রাখছি।’
হৈমন্তী বিনীতভাবে বলল, ‘না স্যার। আমরা এটা ফোটোকপি করে তারপরে আপনাকে দেব।’
নন্দীসাহেব সহাস্যে বললেন, ‘আমি আপনার বিষয়ে যা শুনেছি, তাতে আমি এটাই আশা করছিলুম। সত্যিই আপনার সবদিকেই খেয়াল আছে। আপনি যা করলেন তাকে তো অসাধ্যসাধন বলা যায়। চল্লিশ বছর আগেকার একটা খুনের রহস্যের সমাধান করা তো একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। আপনি যে কেবল সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন তাই নয়, আপনার মায়ের মাথার ওপরে যে অপরাধের বোঝা অন্যায়ভাবে এতদিন চেপে বসেছিল, সেটাকেও সমূলে তুলে ফেলে দিয়েছেন। আপনার দাদামশায় নিশ্চয়ই আপনাকে এর জন্য ওপর থেকে আশীর্বাদ করছেন।’
হৈমন্তী লজ্জিতভাবে বলল, ‘এটা আমাদের কর্তব্য তো ছিলই, স্যার। আমরা সেটা পালন করেছি মাত্র। আর, এসব আমরা কিছুই করতে পারতুম না, যদি না কালীকৃষ্ণবাবু আর এই গ্রামের লোকেরা আমাদের সাহায্য না করতেন।’
কালীকৃষ্ণ ব্যাজার মুখে বললেন, ‘আমরা আবার কী করলুম? কেন যে দত্তসাহেব ওঁদের আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন, উনিই জানেন। আমরা তো কেবল সিনেমার ভিড়ের দৃশ্যে এক্সট্রার ভূমিকায় পার্ট করে গেলুম। আসল নায়ক নায়িকারা হলেন এঁরা। আমরা না থাকলেও এঁরা ঠিক লক্ষ্যভেদ করে ছাড়তেন। আর কী বলব স্যার, এই বাচ্চা মেয়েটি পর্যন্ত ভেলকি দেখিয়ে দিয়েছে!’
চয়ন পেছন থেকে বলল, ‘একেবারে ফিয়ারলেস নাদিয়া।’
মনোরঞ্জন বললেন, ‘তোমার কাজ এখনও শেষ হয়নি, কালী। এই মামলায় তোমাকে এখানকার সবাইকে দিয়ে সাক্ষী দেওয়াতে হবে।’
জনতা সমস্বরে গর্জন করে উঠল— নিশ্চয়ই আমরা সবাই সাক্ষী দেব। আজ আর আমাদের কোনো ভয় নেই।
মনোরঞ্জনবাবুর বাড়ির চেম্বারে বসে কথা হচ্ছিল। মনোরঞ্জনবাবু ছাড়া আর উপস্থিত ছিলেন এসডিপিও সাহেব, কালীকৃষ্ণ, সুব্রত, ইভা আর ওরা চারজন। মনোরঞ্জন দরজার দিকে মুখ করে আর বাকি সকলে তাঁর প্রকাণ্ড টেবিলের উলটোদিকে বসেছিলেন। ফলে আলোচনা শুরু হবার একটু পরেই একটি ছেলে যে নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে সকলের কথা শোনবার জন্য, সেটা আর কেউ খেয়াল করেনি। ছেলেটি স্বাস্থ্যবান, সুদর্শন, অনেকটা সুমিতের মতো, তবে তার মাথায় কোঁকড়া চুল নয়, খুব ছোটো ছোটো করে কাটা যাকে বলে ক্রু-কাট চুল। তার বয়েস বাইশ-তেইশের বেশি নয়। এর কথা পরে হবে।
হৈমন্তী সবিস্তারে কী কী করা হয়েছে এবং কে কী করেছে জানিয়ে প্রশ্ন করল, ‘জ্যাঠামশাই, আপনারা আমাদের ফোন পাওয়ার আগেই হরিজীবনপুরে চলে গেলেন কেন? কোনো খবর পেয়েছিলেন?’
দত্তসাহেব বললেন, ‘না। আমরা তোমাদের ফোনেরই অপেক্ষা করছিলুম। সন্ধ্যের মুখে তোমার মা বললেন যে একবার ও বাড়িতে যাওয়া দরকার। রেখা, মানে তোমাদের রান্নার মেয়েটি আসবে। তাকে দরজা খুলে দিতে হবে আর তাকে ওঁর কিছু বলবারও আছে। আমি তখন তোমার বাবা আর মাকে আমার গাড়ি করে পৌঁছে দিতে যাই। তোমাদের বাড়ির কাছাকাছি আসতেই দেখি, গেটের সামনে বিনু চৌধুরির গাড়িটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর দূর থেকে আবছা আলোয় মনে হল ছাদের ওপরে একটা লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। দেখেই, গাড়ি ঘুরিয়ে সোজা নন্দীসাহেবের বাংলোয় চলে গেলুম। ভাগ্যক্রমে উনি বাড়িতে ছিলেন। ওঁকে সব কথা বললুম। উনিও সঙ্গে সঙ্গে ফোর্স নিয়ে বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে দুটো লোককে আর্মস সুদ্ধ ধরে ফেললেন। তাদের দেখে তো সাহেব অবাক। দু-জনেই ফেরারি দাগি আসামি। শুধু তাই নয়, দু-জনের নামেই গোটা পাঁচেক খুনের মামলাও ঝুলে রয়েছে। সাহেব প্রথমে আমার কথাটা যে খুব একটা বিশ্বাস করেছিলেন, তা নয়। এবার লোক দুটোকে দেখে আর তাদের সঙ্গে কথা বলে, উনিই বললেন, ‘চলুন, এক্ষুনি হরিজীবনপুরে যাই। মনে হচ্ছে, ছেলেমেয়েগুলো ভীষণ বিপদে পড়েছে।’
সুব্রত নন্দীসাহেবকে বললেন, ‘আপনাকে আমাদের কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা নেই।’
ভদ্রলোক হাত নেড়ে বললেন, ‘জানাবেন না। আমি আমার কর্তব্য করেছি মাত্র। আসল খেলাটা এবার খেলবেন মি. দত্ত। বিনু চৌধুরির উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা উনিই করতে পারবেন।’
মনোরঞ্জন বললেন, ‘এখন সব কিছু নির্ভর করছে ইভামার ওপরে। ওর সাক্ষ্যটাই এই খুনের সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ।’
ক্ষীণ গলায় ইভা বললেন, ‘কিন্তু আমার যে সে রাত্রের কোনো ঘটনার কথাই মনে নেই, দাদা। সব কেমন যেন হারিয়ে গেছে।’
বিচলিত দত্তসাহেব বললেন, ‘দ্যাখো মা, তোমাকে সব কথা মনে করতেই হবে। চুপ করে থাকলে চলবে না। তুমি চুপ করে থাকলে, এই মামলা দাঁড়াবে কী করে? একটা তুচ্ছ পয়েন্টের ওপরে শয়তান বিনু চৌধুরি হয়তো পার পেয়ে যাবে। তোমার ছেলেমেয়েদের এই জীবনপণ লড়াইটা তখন ব্যর্থ হয়ে যাবে। তাই কি তুমি চাও?’
মাথা নীচু করে কোনোমতে উদগত কান্না চেপে ইভা বললেন, ‘আমার কিচ্ছু মনে নেই, দাদা! এতদিন ধরে যা ভুলে থাকবার চেষ্টা করে এসেছি, তা আজ আর মনে করতে পারছি না।’
‘মনে করতেই হবে, মা। তোমার বাবার জন্য, তোমার সন্তানদের জন্য তোমাকে মনে করতে হবে।’
হৈমন্তী বলল, ‘জ্যাঠামশাই ঠিক কথাই তো বলছেন, মা। মনে করবার চেষ্টা করো যে সে রাত্রে কী হয়েছিল। আমরা জানি, তোমার মনের ভেতর থেকে সেই স্মৃতি মুছে যায়নি, যেতে পারে না। ভয় আর দুঃখের যে পর্দাটা তোমার স্মৃতিকে ঢেকে রেখেছে, সেটা সরিয়ে দাও।’
অনেক অনুনয়, বিনয়, অনুরোধ, উপরোধের পর ইভা বললেন, ‘বেশ, দেখছি চেষ্টা করে।’
সুব্রত বললেন, ‘বাঃ, এই তো কথার মতো কথা! তোমরা সবাই ওকে একটু সময় দাও। ও ঠিক মনে করবে।’
একটু পরে ইভা বলতে শুরু করলেন। সবাই উদগ্রীব হয়ে শুনতে লাগল।
‘সেদিন ছিল অমাবস্যা। সন্ধ্যে বেলা বাবা আর ওই লোকটা আলোচনা শুরু করল। রাত বাড়লে, বাবা আমাকে খেয়ে নিয়ে শুতে যেতে বললেন। আমি রাজি হইনি। বাবা বললেন যে আরও কিছুক্ষণ সময় লাগবে, কাজেই আমি যেন শুয়ে পড়ি। ওঁর কথা অমান্য করা সম্ভব ছিল না। তাই, আমি খেয়ে নিয়ে পাশের ঘরে আমার বিছানায় শুয়ে পড়লুম। বাবার উত্তেজিত গলা শুনতে পাচ্ছিলুম কিন্তু কিছু করবার ছিল না।’
মনোরঞ্জন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী কথা হচ্ছিল? কিছু শুনতে পেয়েছিলে?’
‘অস্পষ্ট কিছু কথা। রেগে রেগে কথা বলছিলেন বাবা। বুঝতে পারছিলুম না। তারপরে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল। মনে হল যেন একটা জোরে শব্দ হল। শব্দটা কীসের সেটা বুঝে ওঠার আগেই দরজায় খুটখুট করে আওয়াজ হল। ওই লোকটা চাপা গলায় বলল, ”রানি, দরজাটা একটু খোলো তো। তোমাকে কর্তামশাই ডাকছেন।” আমি কিছুই সন্দেহ করিনি। উঠে দরজাটা খুলে দিলুম। ওমনি, লোকটা আমার হাত ধরে টানতে টানতে বাবার ঘরের দিকে নিয়ে গেল। ঘরে ঢুকে যা দেখলুম, তার বর্ণনা আমি দিতে পারব না। শুধু এটুকু বলি যে, বাবা যে বেঁচে নেই সেটা বুঝতে পারলুম। আর দেখলুম, লোকটার হাতে রুমাল মোড়া আমার পিস্তলটা।’
এসডিপিও বললেন, ‘এতে বোঝা যাচ্ছে যে লোকটা কী ঘোড়েল আর কতটা ভেবেচিন্তে আটঘাট বেঁধে খুনটা করেছে। পুলিশ যখন পিস্তলটা পেল, সেখানে কেবল মিসেস রায়ের আঙুলের ছাপই পাওয়া গেল, আর কারোর নয়। যাই হোক, তারপরে বলুন।’
‘ওই লোকটা বলল, ”তোমার বাবা হিসাব মেলাতে গিয়ে দেখলেন যে তিনি এত টাকা চুরি করেছেন আর নয়-ছয় করেছেন যে, বিবেকের যন্ত্রণা সহ্য করতে না-পেরে আত্মহত্যা করেছেন। এখন পুলিশ আসবে। এই পিস্তলে তোমার আঙুলের ছাপ আছে। অতএব তারা ভাববে যে তুমিই তোমার বাবাকে কারোর প্ররোচনায় টাকার লোভে খুন করেছ। তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে আর তোমাকে ফাঁসিকাঠে ঝোলাবে। এখন একমাত্র আমিই তোমাকে বাঁচাতে পারি। আমি ওদের বলতে পারি যে এখানে ডাকাত পড়েছিল আর তারাই তোমার বাবাকে খুন করেছে। সেক্ষেত্রে, তোমাকে দুটো কাজ করতে হবে। এক, তোমাকে এই গল্পটা সত্যি বলে পুলিশকে বলতে হবে আর আমাকে বিয়ে করতে হবে। তাহলে আর কোথাও কোনো ঝামেলা থাকবে না। আমিও এই পিস্তলটা লুকিয়ে ফেলব, পুলিশ এটা খুঁজেও পাবে না”। ‘
হৈমন্তী বলল, ‘তুমি তখন কী করলে?’
ইভা চোখের জল মুছে বললেন, ‘আমি বললুম, ”আমি বরং ফাঁসিতে ঝুলব কিন্তু তোমাকে বিয়ে করব না”। তখন লোকটা আমাকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে গুমঘরে বন্ধ করে দিল। দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলল, ”আজ রাতটা চিন্তা করো। কাল সকালের মধ্যে যদি আমার কথায় রাজি না হও, আমি পুলিশের হাতে পিস্তলটা তুলে দেব। তারপর, যা হবার তাই হবে। গোঁয়ার্তুমি করে নিজের প্রাণটা খোয়াবে না আশা করি।” আমি সেই ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরে মাটির ওপর শুয়ে কাঁদতে লাগলুম।’
অদিতি বলল, ‘ওখান থেকে পালালে কী করে, মা? জানলা ভেঙে?’
সুমিত বলল, ‘আঃ, চুপ করতো! মাকে বলতে দে।’
ইভা বললেন, ‘জানলা? ও ঘরে তো কোনো জানলাই নেই। যাই হোক, আমার কেবলই মনে হতে লাগল যে— আমাকে পালাতেই হবে। যেভাবেই হোক। নইলে, ওই লোকটা আমাকে জোরজবরদস্তি বিয়ে করবে। আমার বাবার হত্যাকারীর সঙ্গে আমি কিছুতেই থাকতে পারব না। তা না-হলে আমাকে আত্মহত্যাই করতে হবে। এমন সময়, একটা জলের কলকল শব্দ শুনতে পেলুম। কুয়োটার কথা আমার জানা ছিল। তার ভেতরে যে চাঁদার জল আসে— তাও জানতুম। আমি হাতড়ে হাতড়ে কুয়োটার কাছে গিয়ে নীচে ঝাঁপিয়ে পড়লুম। ভাবলুম, হয় সাঁতরে নদীতে গিয়ে পড়ব নয়তো ডুবে মরে যাব। যদি এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে পারি, তাহলে পরে যা করবার তাই করা যাবে। আমি সেই নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্যে বাবার কথা ভাবতে ভাবতে সাঁতার কাটতে শুরু করলুম আর মনে মনে নিজেকে বলতে লাগলুম আমাকে পালাতেই হবে, বাবার জন্যেই আমাকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে। কতক্ষণ পরে জানি না, হঠাৎ দেখলুম মাথার ওপরে ঝকঝকে তারাভরা আকাশ। বুঝতে পারলুম, আমি সুড়ঙ্গটা থেকে বেরিয়ে এসে চাঁদায় পড়েছি। ভেবেছিলুম, স্রোতের টানে গা ভাসিয়ে যতদূর সম্ভব চলে যাব। সেইভাবে একটু এগোতেই দেখি নদীর ধারে গাছের শেকড়ে বাঁধা একটা ডিঙি। আমি দড়ি খুলে সেটার ওপর উঠে বসলুম। ছেলেবেলা থেকেই আমি ডিঙি বাইতে পারতুম। আমি সেটা মাঝনদীতে নিয়ে গেলুম। সেটা স্রোতের টানে ভেসে চলল।’
এই পর্যন্ত বলে ইভা দম নেবার জন্য থামলেন।
চয়ন চাপা গলায় বলল, ‘আহারে, কার ডিঙিটা গেল কে জানে!’
সুব্রত গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বললেন, ‘যা বলেছো। হয়তো কোনো গরিব জেলের।’
আরও কিছু হয়তো বলতেন, কিন্তু হৈমন্তীর চোখের দিকে তাকিয়ে চেপে গেলেন।
ইভা বলে চললেন, ‘কতক্ষণ পরে জানি না, হঠাৎ তারার আলোয় দেখলুম সামনে চ্যাটার্জি পাড়ার ঘাট। মনে হল, খুকির বাড়িতে গেলে মাস্টারমশাই নিশ্চয়ই আশ্রয় দেবেন। তিনি দৃঢ় চরিত্রের সাহসী মানুষ, ওই শয়তানটার ভয়ে আমাকে তাড়িয়ে দেবেন না। আমি তখন চ্যাটার্জি পাড়ার ঘাটে ডিঙি লাগিয়ে একটা খোঁটায় বেঁধে আমবাগানের ভেতর দিয়ে মাস্টারমশায়ের বাড়ি গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিলুম। একটু বাদে তাঁর ছোটো ছেলে চোখ মুছতে মুছতে দরজা খুলে দিয়ে হাঁ করে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল। তার পেছনে পেছনে এল খুকি। আমার মুখ-চোখের অবস্থা দেখে আমাকে তাড়াতাড়ি ভেতরে নিয়ে গেল। আমি তখন অঝোরে কেঁদে যাচ্ছি।’
অদিতি বলল, ‘মাকে ওই অবস্থায় দেখে তোমার কী মনে হয়েছিল বাবা?’
সুব্রত হাত নেড়ে নাটকীয়ভাবে বললেন, ‘কী মনে হয়েছিল? সে আর কী বলব? সিক্তবসনা সেই নারীকে দেখে মনে হয়েছিল যে বটিচেলির ভিনাস যেন শুক্তিতে চড়ে সমুদ্র থেকে উঠে এসেছেন। কালিদাসের ভাষায় একেবারে যাকে বলে যুবতীবিষয়ে সৃষ্টিরাদ্যেবধাতুঃ।’
ইভা ধমকে উঠলেন, ‘আঃ, কী হচ্ছে কী! চয়নের সামনে অসভ্যতা করতে সংকোচ হয় না তোমার?’
নির্বিকার সুব্রত বললেন, ‘সত্যিকথা বলব, তাতে ভয় কী মশায়?’
চয়ন হাসি চেপে বলল, ‘আপনি কিচ্ছু ভাববেন না কাকিমা। ওঁর কথা আমি কিছু বুঝতেই পারিনি। আমার সংস্কৃত ভাষায় জ্ঞান তো ”হবর্তাবা কহিপ্তাশা” মার্কা আর ওই যে কী বললেন, বঁটিতে ছোলা ভঁইস না কি যেন, সেটা যে কী বস্তু আমি তো তাই জানি না।’
হৈমন্তী চেঁচিয়ে বলল, ‘তোমরা তোমাদের রসিকতা বন্ধ করবে? মা, তুমি বলে যাও তো। ওদের কারোর কথায় কান দিও না।’
সুব্রত বললেন, ‘না। এবার আমি বলব।’
ইভা নিশ্চিন্ত হয়ে বললেন, ‘সেই ভালো। তুমি বলো।’
গলা খাঁকারি দিয়ে সুব্রত শুরু করলেন, ‘আমাদের কনফারেন্স যখন শুরু হল তখন প্রায় মধ্যরাত্রি। সেখানে উপস্থিত বাবা, আমরা দুই ভাই, মেজদা তখন কলকাতায়, খুকি আর মহারানি সিংহ। রানিজি ততক্ষণে তাঁর রাত্রের পোশাক, গোলাপি রঙের ফুলকাটা পাজামা আর ওই রকমই হাফহাতা হাওয়াই শার্টের মতো জামা ছেড়ে খুকির মেরুন রঙের শাড়ি আর সাদা রঙের ব্লাউজ পরে নিয়েছেন।’
ইভা বাধা দিয়ে বললেন, ‘আঃ, অত ডিটেলে বলার কি দরকার?’
সুব্রত বললেন, ‘আহা, ডিটেলে না বললে সঠিক ছবিটা সবাই বুঝবে কী করে? সে যাই হোক, প্রথমে উনি তাঁর সে রাত্রির অভিজ্ঞতার কথা বলে বাবাকে বললেন, ”আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাইতে এসেছি, মাস্টারমশাই। বেশি দিনের জন্যে নয়। দু-একদিন বাদেই আমি কলকাতায় চলে গিয়ে কোনো একটা ব্যবস্থা করে নেব। আপনি দয়া করে আমাকে সে ক-টা দিন এখানে থাকতে দিন।” ওর কথা শুনতে শুনতে বাবার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। বললেন, ”আমি বলব যে তুমি হরিজীবনপুরে ফিরে যাও। তুমি পালিয়ে এসে ভালো কাজ করোনি। তাতে করে সবার সন্দেহ তোমার ওপরেই পড়বে। এবং তার জন্যে তুমি কাউকে দোষও দিতে পারো না। পুলিশকে সব কথা খুলে বলো, তারা নিশ্চয়ই তোমাকে সাহায্য করবে। আর, তোমার কথামতো তারা যদি বিনুর বশংবদও হয়, তাহলেও দেশে আইনকানুন আছে, লোয়ার কোর্টের পরেও হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্ট আছে। তারা সঠিক তথ্যটা ঠিক খুঁজে বের করবে। কিন্তু, তুমি যদি পালিয়ে যাও বা লুকিয়ে থাকো, তাহলে তুমি নিজের পায়েই নিজে কুড়ুল মারবে। তোমাকে কেউ বাঁচতে পারবে না।’
সুমিত বলল, ‘অনাথনাথ ভয় পেলেন, বাবা?’
‘না, ভয় পাবার লোক উনি ছিলেন না। উনি যা ন্যায্য বলে মনে করতেন তার থেকে কখনো একচুল নড়তেন না। ওনার বিচারে বিনু চৌধুরি যে রামানন্দের আত্মহত্যার কথাটা বলেছিল, সেটাই ঠিক। সে যে সুযোগ বুঝে রানিকে বিয়ে করতে চেয়েছে, সেটা কোনো একটা ব্যাপারই নয়। সেটা ঠেকানো কোনো কঠিন কাজ হত না। রানি অকারণে ভয় পেয়ে পালিয়ে এসে একটা আষাঢ়ে গল্প ফেঁদে বসেছে। ভেবে দ্যাখ, উনি ছিলেন একজন আদর্শবান শিক্ষক, সারাটা জীবন কাটিয়েছেন মফসসলে স্কুলে পড়িয়ে। তাঁর পক্ষে একটা ষড়যন্ত্র যে কতদূর নোংরা হতে পারে বা একটা মানুষের লোভ যে তাকে কতদূর শয়তান করে তুলতে পারে তা বুঝে ওঠা তাঁর পক্ষে প্রায় অসম্ভব ছিল। তা ছাড়া, ওঁর কথায় সেদিন যা বুঝেছি, বিনু চৌধুরিকে তিনি জানতেন একজন নিতান্ত নিরীহ বিনয়ী শান্তিপ্রিয় লোক হিসেবে। সেটাও অস্বাভাবিক নয়; কারণ বিনু চৌধুরির যিনি মালিক, যাঁর সঙ্গে তার দিনের বেশিরভাগ সময় কাটত, তিনি নিজেই তার আসল চরিত্রটা ধরতে পারেননি। সে যে কী ভয়ংকর মানুষ, সে কথা জমিদারবাবুই আঁচ করতে পারেননি, তো সেটা সংসারে অনভিজ্ঞ একজন স্কুলমাস্টার কী করে করবেন? আরও একটা কথা, তোর মা যেভাবে গুমঘর থেকে সুড়ঙ্গ দিয়ে সাঁতার কেটে পালিয়ে এসেছিল, সেটাও তাঁর বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়নি। তিনি যে ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ বা জোন ডার্কের কথা জানতেন না তা নয়, কিন্তু বাঙালি মেয়েদের মধ্যে তাঁদের মতো একজন বীরাঙ্গনা থাকতে পারে তা তাঁর চিন্তার অতীত ছিল। তিনি বাঙালি মেয়েদের ভীরুপ্রকৃতির নিতান্ত গোবেচারা বলেই জানতেন।’
হৈমন্তী বলল, ‘তারপরে কী হল? অনাথনাথ পত্রপাঠ মাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন?’
‘না। উনি বললেন, ”আজ রাত্তিরটা তুমি থাকো। কাল সকালেই আমি নিজে তোমাকে তোমার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসব। যদি তোমার সেখানে যেতে ভয় হয়, তাহলে তোমাকে থানায় নিয়ে যাব। তুমি সেখানে সব কথা বলবে, দেখবে তারাই তোমাকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করবে। লুকিয়ে থেকো না। তাতে তোমার বিপদ বাড়বে বই কমবে না। এখন যাও, গিয়ে শুয়ে পড়ো।’
‘বাঃ, চমৎকার ব্যবস্থা।’
মনোরঞ্জন বললেন, ‘তোমার ঠাকুরদাদার ওপর রাগ কোরো না, হৈমন্তী। সে যুগের কোনো বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের ভদ্রলোকই তোমার মায়ের এই অসীম দুঃসাহসিক কাজের কথাটা বিশ্বাস করতেন কি না সন্দেহ আছে। কাউকে বিচার করতে হলে তাঁর স্থান-কাল-পাত্রের কথাটা তো ভুলে গেলে চলবে না। তুমি বলো, বীরু।’
সুব্রত বললেন, ‘বাবা তাঁর রায় ঘোষণা করে শুতে চলে গেলেন। বড়দা আর মহারানিও শুতে গেল। তখন খুকি আর আমার মধ্যে একটা মিনি কনফারেন্স হল। খুকি বলল, ”রানিকে আমি ভালো করে জানি। ও মিথ্যে কথা বলছে না, ছোড়দা। ও যদি ফিরে যায়, তাহলে ওর সর্বনাশ হয়ে যাবে। তুই ওকে বাঁচাতে পারবি না?” আমি বললুম, আমারও মনে হচ্ছে যে তোর কথা ঠিক। বাবার ভুল সিদ্ধান্তের জন্য রানির মতো ফুর্তিবাজ একটা গেছো মেয়ের একটা ভয়ংকর পরিণতি যদি হয়, তাহলে সেটা সহ্য করা কঠিন হবে রে। চল, গিয়ে রানির সঙ্গে কথা বলি।’
অদিতি বলল, ‘মা গেছো মেয়ে ছিল, বাবা?’
‘একনম্বরের। খুব জেদি আর একরোখা ছিল। তোরা তোদের মাকে যেরকম দেখেছিস, ছেলেবেলায় তার ঠিক উলটোটা ছিল। ভাবতে পারবি না, আমার সঙ্গে দেখা হলেই ঝগড়া করত। আর এখন? বাইরেটা যতই নরম হোক, ভেতরটা কিন্তু সেরকমই আছে। তার পরিচয় তো তোরা পাসনি, আমি অনেকবারই পেয়েছি। তা, সে যাকগে। আমি আর খুকি গিয়ে মহারানির সঙ্গে কথা বললুম। সে শুয়ে ছিল আর জেগেই ছিল। আমি বললুম, ”আমার কালকে ভোর বেলার ট্রেনে কলকাতা যাবার কথা। সেখানে একটা ইন্টারভিউ আছে। আমার স্যুটকেস গোছানোই আছে। তুমি কি আমার সঙ্গে যেতে রাজি আছো? যদি রাজি থাকো, তাহলে আমি তোমাকে কলকাতায় পৌঁছে দিতে পারি।” একমুহূর্ত চিন্তা করে রানি বলল, ”হ্যাঁ, রাজি আছি। ভাবছিলুম আত্মহত্যাই করব। এ তো তার থেকে ভালো।” তখন তিনজনে আলোচনা করে স্থির হল যে ট্রেনে করে যাওয়া চলবে না। লোকে দেখে ফেলবে, জানাজানি হবে, পুলিশ এসে বাবাকে ধরে টানাটানি করবে। কাজেই অন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।’
একটু দম নিয়ে সুব্রত বললেন, ‘আমি খুকিকে বললুম যে আমরা তক্ষুনি বেরিয়ে পড়ব। আমরা চলে গেলে সে যেন দরজা বন্ধ না-করে। তা করলে বাবা সব বুঝতে পারবে আর খুকির হাঁড়ির হাল করে ছাড়বে। আমরা দু-জনে চুপিসাড়ে যখন বাড়ি থেকে বের হলুম, তখন অনেক রাত, আড়াইটে কী তিনটে হবে। আমবাগানের ভেতর দিয়ে চলে গেলুম ঘাটে। সেখানে তখনও ডিঙিটা বাঁধা। আমিও ডিঙি বাইতে পারতুম। রানিকে সামনে বসিয়ে বাঁধনদড়ি খুলে ডিঙি ভাসিয়ে দিলুম। ততক্ষণে আমি ভীষণভাবে তোদের মায়ের প্রেমে পড়ে গেছি।’
ইভা প্রবলবেগে আপত্তি করতে যাচ্ছিলেন। তার আগেই হৈমন্তী বলল, ‘তুমি বলতে চাও, তার আগে পড়নি?’
‘কক্ষনো না। ওকে আমি সহ্যই করতে পারতুম না। আমরা যতবার ওদের বাড়িতে গেছি, খুকির সঙ্গে দল পাকিয়ে আমার সঙ্গে গলা চুলকে চুলকে ঝগড়া করত, আমাকে বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি সব নামে ডাকত। কখনো বলত লম্বুস, কখনো বলত ঢ্যাঙাকার্তিক, কখনো বলত—’
‘ন্যাজকাটা হনুমান।’ হঠাৎ ইভা দুষ্টু হেসে বললেন।
‘ওই দ্যাখ। দেখলি তো? এমন মেয়ের সঙ্গে প্রেম হয়? একটু বড়ো হয়ে ওদিকে আর যেতুমই না। ইতিমধ্যে আমার গোঁফ গজিয়েছে। একটা বেশ পুরুষ্টু গোঁফ রাখলুম। একবার পুজোয় ওদের বাড়িতে গেলুম। ভাবলুম, আমার মোটা গোঁফ দেখে আমাকে নিশ্চয়ই সমীহ করবে। তা না, এমন হাসতে শুরু করল যে আমি রেগেমেগে একাই ফিরে চলে এলুম।’
ইভা হেসে গড়িয়ে পড়লেন।
হৈমন্তী জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা মা, তুমিও কি ওই ডিঙিতেই বাবার প্রেমে পড়ে গেলে, না আগে থেকেই কিছু ছিল?’
ইভার চোখ দুটো কেমন যেন স্বপ্নাচ্ছন্ন হয়ে গেল। বললেন, ‘আগে থেকে? নাঃ, আগে থেকে কী করে থাকবে? আমি তো ওকে জানতুম খুকির ছোড়দা বলে। ছেলেবেলায় ভীষণ ডানপিটে ছিল, আমাদের বাড়িতে এলেই, একছুটে চলে যেত গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে খেলবার জন্য। তারপর সারাদিন তার টিকিটিও দেখতে পেতুম না। আর দেখা যখন পেতুম তখন খালি ঝগড়া করতুম। ভীষণ মজা লাগত। যখন একটু বড়ো হলুম, তখন তোদের বাবা আর আমাদের বাড়িতে আসতই না। শুধু খুকির কাছে ওর নানারকম মজার মজার গল্প শুনতুম। তাই, সে রাত্তিরের আগে আমরা কোনোদিন কাছাকাছি আসিইনি। ততদিন আমি জানতুম খুকির ছোড়দা একটা এক নম্বরের পাগল আর দুষ্টু ছেলে।’
‘বুঝলুম। ছেলেবেলায় তোমরা দু-জনেই খুব শান্তশিষ্ট ছিলে। আর, এও বুঝতে পারছি যে, আমরা ছেলেবেলায় কোনো দুষ্টুমি করলে কেন তোমরা আমাদের কখনো শাস্তি দিতে না। বোধ হয়, তোমাদের ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে যেত। সে যাকগে, তারপরে ডিঙিতে কী হল?’
‘ঘন অন্ধকারের ভেতর ডিঙি বাইতে বাইতে তোদের বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করল, ”কলকাতায় কোথায় যাবে?” আমি বললুম, ”জানি না। কোথাও তো যাবার নেই। মামার বাড়িতে গেলে ওরাও আমাকে ওই লোকটার হাতে তুলে দেবে। কোনো অনাথ-আশ্রমে গিয়ে উঠতে হবে। আর কোথায়ই বা যাব?” তোদের বাবা বলল, ”সে আবার হয় না কি? তুমি এখন বড়ো হয়ে গেছ। তোমাকে তারা জায়গা দেবে কেন? না, কলকাতায় তোমার যাওয়া হতে পারে না। সেখানে তোমার বিপদ বাড়বে বই কমবে না। তার চেয়ে চলো, আমরা পশ্চিমে পালিয়ে যাই। সেখানে আমরা লুকিয়ে থাকব যতদিন না আবার এখানে ফিরে আসবার সুযোগ পাই। তুমি কি রাজি আছো? বিশ্বাস করো, আমি কোনোদিন তোমার অসম্মান করব না।” আমি চুপ করে রইলুম। তোদের বাবা বোধ হয় ভাবল যে আমি ওকে বিশ্বাস করতে পারছি না। তারপর আর কোনো কথা হল না। এদিকে আস্তে আস্তে আকাশ পরিষ্কার হয়ে এল। সেই আবছা আলোয় ওর গম্ভীর উদবিগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল যে, এ কী আশ্চর্য মানুষ! আমার জন্য একটা নিশ্চিন্ত জীবন ছেড়ে বিপদসংকুল অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যেতে চাইছে। এ কে বিশ্বাস করব না তো করব কাকে? বললুম, ”তোমার প্রস্তাবে আমি রাজি আছি।” তখন দেখি, তোদের বাবা একটা ঘাটে ডিঙি বাঁধছে। কী যেন জায়গাটার নাম?’
সুব্রত বললেন, ‘গান্ধীগ্রাম। নতুন গড়ে ওঠা উদবাস্তুদের জায়গা। ওখানে ঘাটে উঠে হাঁটতে শুরু করলুম দু-জনে। সেখানে কে কাকে চেনে? গান্ধীগ্রামের খুব কাছেই ঘোষপুর জংশন। ভেবেছিলুম ওখান থেকে মাঝে একবার ট্রেন পালটে ঘুরপথে কলকাতায় যাব। তোদের মায়ের কথা শুনে আমি বোম্বাই-এর টিকিট কাটলুম। সঙ্গে যা টাকা ছিল, তাতে টেনেটুনে দিন দশেক চলে যাবে বলে মনে হল। যখন ট্রেনে উঠলুম, আমি নিশ্চিত যে কেউ আমাদের চিনতে পারেনি।’
ইভা ফিক করে হেসে বললেন, ‘চিনবে কোত্থেকে? তোদের বাবার কথামতো আমি দিয়েছি একগলা ঘোমটা আর ও ধুতিটা হাঁটু পর্যন্ত তুলে সুটকেস মাথায় করে নিয়েছে। একেবারে সদ্যবিবাহিত চাষি পরিবার। কেউ ফিরেও তাকায়নি।’
হৈমন্তী বলল, ‘তুমি বম্বের টিকিটই কাটলে কেন, বাবা? দিল্লি, কানপুর বা মাদ্রাজ নয় কেন?’
সুব্রত বললেন, ‘তার কারণ, আমি কলেজে শুনেছিলুম যে ড. বিনায়করাও শিরোধকর বোম্বাইয়ের কাছে একটা রাবার কেমিক্যাল তৈরি করার ফ্যাক্টরি খুলেছেন। তার জন্যে লোক খুঁজছেন। এও শুনেছিলুম যে জায়গাটা একেবারে যাকে বলে পাণ্ডববর্জিত গণ্ডগ্রাম, একটিও রেস্টুরেন্ট নেই, সিনেমা হল নেই, কিচ্ছু নেই। একেবারে মরুভূমি বলা চলে। ফলে, কোনো বঙ্গসন্তান সেখানে যেতে চাইছে না। ড. শিরোধকর প্রচণ্ড পণ্ডিত ব্যক্তি কিন্তু খ্যাপাটে, কলকাতার সায়েন্স কলেজে কিছুদিন পড়িয়েছিলেন। মনে হল, আমাদের আত্মগোপন করে থাকার ওটাই আদর্শ জায়গা হবে যদি সেখানে চাকরি পাই।’
‘রাইপুরা একসময়ে ওইরকম ছিল না কি?’
‘হ্যাঁ, আজকের রাইপুরাকে দেখলে কেউ সে কথা বিশ্বাস করবে না। আর, ওইরকম একটা জায়গার অসামান্য উন্নতির কারণ কিন্তু অনেকটাই মহারাষ্ট্র রাবার কেমিক্যালস।’
‘তারপরে বলো। বম্বেতে নেমে তোমরা কী করলে?’
‘বম্বেতে নেমে? ট্রেনে একজন বিহারি ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তিনি বম্বেতেই থাকতেন। তাঁর কাছে খবর পাওয়া গেল যে দাদার স্টেশনের কাছে একটা ছোটো থাকবার জায়গা আছে। একজন বয়স্কা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মহিলা ওটা চালান। ভাড়া খুবই কম। দাদারে নেমে আমরা ওখানেই চলে গেলুম। জায়গাও পাওয়া গেল। জায়গাটা আরামপ্রদ কিছু নয়; তবে সেটাই তখন স্বর্গ বলে মনে হয়েছিল। বিকেল বেলা আমরা গেলুম ল্যান্ডলেডির সঙ্গে কিছু কথা বলতে। ভদ্রমহিলার নাম মারিয়া অ্যাপলটন। অত্যন্ত স্নেহশীল মানুষ। প্রথম দর্শনেই আমার মনে হয়েছিল যে এঁকে বিশ্বাস করা যায়। আর, তা ছাড়া উপায়ই বা কী ছিল?’
‘কী কথা হল?’
‘আমরা তাঁকে সবকথা খুলে বললুম। উনি মন দিয়ে সব শুনলেন। বললেন, ”তোমার কথা শুনে আমি অবাক হইনি কারণ এমন ঘটনা অসম্ভব কিছু নয়। আমি আশ্চর্য হয়েছি এই বাচ্চা মেয়েটির দুর্দান্ত সাহস দেখে। তুমি নিশ্চিন্ত মনে রাইপুরা যাও। যতদিন তুমি ওখানে থাকবে, ততদিন ও আমার কাছে থাকবে। তোমার কোনো ভয় নেই। আমার একটি মেয়ে ছিল, ইভা। অল্পবয়েসে ঈশ্বর তাকে কাছে টেনে নেন। ওকে দেখে পর্যন্ত আমার তার কথাই মনে পড়ছে। আমি ওকে ইভা বলেই ডাকব। সেইদিন থেকে তোদের মায়ের নতুন নাম হল ইভা। আমি পরদিন গোঁফ কামিয়ে ফেলে নতুন মানুষ সেজে রাইপুরা চলে গেলুম। ড. শিরোধকর কলকাতা ইউনিভার্সিটির ডিগ্রিটা দেখে কোনো প্রশ্নই প্রায় করলেন না। এমনকী আমার অ্যাপ্লিকেশন ফর্মে যে আমার পার্মানেন্ট অ্যাড্রেস দাদারের একটা গেস্টহাউস, তা নিয়েও কোনো কথা বললেন না। বললেন যে আমি যেন পরেরদিন থেকেই চাকরিতে জয়েন করি। জুনিয়র কেমিস্টের পোস্ট, মাইনে সাড়ে তিন-শো টাকা। তখনও স্টাফ কোয়ার্টাস তৈরি হয়ে ওঠেনি, ছিল কতগুলো অস্থায়ী ব্যারাক। তাদের কয়েকটা বিবাহিতদের জন্যে, কয়েকটা ব্যাচেলারদের জন্যে। তোদের মা আমার সঙ্গে এসেছে শুনে ড. শিরোধকর আমাকে বিবাহিতদের ব্যারাকের একটা জায়গা করে দিলেন। টানা লম্বা একতলা অ্যাসবেস্টস চালের ব্যারাকগুলো, প্রত্যেকটায় চারটে করে ইউনিট। এক একটা ইউনিটে একটা শোবার ঘর, একটা রান্নাঘর, একটা বাথরুম আর সামনে একটা ছোট্ট বারান্দা। কিছু নিতান্ত প্রয়োজনীয় ফার্নিচারও ছিল। আমি দেখে একটু দমে গেলুম। মনে হল, রাজপ্রাসাদ থেকে এসে তোদের মা হয়তো ওখানে থাকতে পারবে না। আমি ভুল ভেবেছিলাম। সেই অতি সাধারণ থাকবার জায়গাটা দেখে তোদের মায়ের মুখে যে আনন্দের অভিব্যক্তি দেখেছিলুম তার মধ্যে কোনো খাদ ছিল না।’
‘আমরা তো ওরকম ব্যারাক দেখিনি বাবা?’
‘দেখবি কোত্থেকে? বছর দুয়েকের মধ্যে পাকা কোয়াটার্স যখন তৈরি হল, তখন ওগুলো ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। সে তোদের জন্মের আগে।’
‘মিসেস অ্যাপলটনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল?’
‘নিশ্চয়ই। তাঁর শেষদিন পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। উনি অনেকবার এসে আমাদের বাড়িতে থেকেছেন, আমরাও ছুটিছাটায় তাঁর বাড়িতে গিয়ে থাকতুম।’
‘তাহলে সেই তোমাদের সংসারযাত্রার শুরু? তোমরা অতীতকে ভুলে গেলে না কেন বাবা? তোমরা তো নিজেরাই একটা নিজস্ব জগত তৈরি করে নিয়েছিলে। সেখানে আমরা আর রাইপুরার তোমার সহকর্মীরা ছাড়া আর তো কারোর দরকারই ছিল না।’
‘ঠিকই বলেছিস। আমরা আমাদের জীবনের যে গল্পটা বানিয়েছিলুম সেটা সকলেই বিশ্বাস করেছিল আর অকুণ্ঠ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। বিশেষ করে চয়নের বাবা আর ওর মা মাধুরী। সে কথা আমরা কোনোদিনই ভুলতে পারব না। জানিস, প্রথম প্রথম কয়েক মাস আমাদের প্রায় রান্নাই করতে হয়নি। ওঁরা জেনে গিয়েছিলেন যে তোদের মার করা রুটিগুলো তখন সাধারণত পাঁচকোনা হত। তাই, ছলছুতোয় নেমন্তন্ন করে খাওয়াতেন নয়তো খাবার নিয়ে হইহই করতে করতে আমার ঘরে চলে আসতেন। নইলে যে কী হত, কে জানে!’
‘তাহলে স্মৃতি আঁকড়ে ধরে রাখলে কেন?’
‘অতীতটাকে ভুলে যেতে পারলে তো ভালোই হত, কিন্তু সেটা তো সম্ভব হল না। চেষ্টা যে করিনি তা নয়। বাইরে থেকে দেখলে আমাদের একটা সুখী, স্বচ্ছল, সন্তুষ্ট পরিবার বলে মনে হত; কিন্তু বাধ সাধল আমাদের অবচেতন মন নামক ব্যাপারটা। সেটা আমাদের কিছুতেই ভুলতে দিল না— যা আমাদের ভুলে যাওয়াটাই হয়তো বাঞ্ছনীয় ছিল। সারাদিন তোদের মা যতই হাসিখুশি থাক-না কেন, প্রায় রোজ রাত্রে ঘুমের মধ্যে ছটফট করত, ওর বাবার নাম করে কাঁদত, মাঝে মাঝে চিৎকার করে উঠে বসত। এই মানসিক অবস্থার জন্যই আমাদের প্রথম দু-টি সন্তান… সে যাকগে। তখন আমার কেবলই মনে হত, যদি আমার কখনো যথেষ্ট টাকাপয়সা হয়, আমি কমলপুরে ফিরে যাবই আর যে আমার নিষ্পাপ স্ত্রীর ওপরে ভয়ংকর অপরাধের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে তার অন্তর্জীবনটা বিষিয়ে দিয়েছে তার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াব। সেই সুযোগ যখন এল, তখন এখানে চলে এলুম। তবে, আমাদের আর কিছু করতে হল না, যা করবার তোরাই করলি। তবে যা করলি, তা হয়তো আমিও করতে পারতুম না।’
হঠাৎ হৈমন্তী উঠে এসে ইভার পায়ের কাছে বসে পড়ল। তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘জানো মা, আমরা তোমাকে চিরকাল শান্ত নরম স্নেহপ্রবণ বলেই জেনে এসেছি। কোনোদিন ভাবতে পারিনি তোমার ভেতরে এমন দুর্জয় সাহস আর দৃঢ়তা লুকিয়ে রয়েছে। আজ আমার গর্বের শেষ নেই।’
সুমিত আর অদিতিও এসে হৈমন্তীর পাশে বসে পড়ল। সমস্বরে বলল, ‘আমাদেরও… আমাদেরও।’
দৃশ্যটা যে খুবই ভাবাবেগপূর্ণ হল তাতে সন্দেহ নেই; কিন্তু তাতে কেউই কোনোরকম অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলেন বলে মনে হল না। বরং, সকলের বিধুর মুখভঙ্গি দেখে মনে হল যেন এইরকম একটা দৃশ্যের অবতারণাই আশা করেছিলেন।
মনোরঞ্জন তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে হুংকার ছাড়লেন, ‘অ্যাই নীলু। ওখানে হাঁ করে দাঁড়িয়ে রয়েছিস কেন? জলখাবারের ব্যবস্থা করবি না?’
দরজার কাছ থেকে মোটা গলায় উত্তর এল, ‘এক্ষুনি যাচ্ছি, জ্যাঠামশাই।’
এইবার সকলের দৃষ্টি পড়ল নীলুর দিকে।
হৈমন্তী জিজ্ঞাসা করল, ‘ছেলেটি কে, জ্যাঠামশাই?’
মনোরঞ্জন বললেন, ‘ও আমার ছোটোভাইয়ের ছেলে, নীলোৎপল। গত বছর ইন্ডিয়ান ডিফেন্স অ্যাকাডেমি থেকে পাশ করে আর্মিতে জয়েন করেছে। এখন আছে পুনায়। এখানে এসেছে কয়েক দিনের ছুটিতে। নীলে, এদিকে আয়। এই বীরু জ্যাঠা আর ইভা জেঠিকে পেন্নাম কর আর নন্দীসাহেব আর বাকি সবাইকে স্যালুট।’
সুব্রত বললেন, ‘না, না, প্রণাম করতে হবে না। আমাদেরও স্যালুট।’
নীলোৎপল তাই করল বটে, কিন্তু সে যে তার চোখদুটো অনেক কষ্টে অদিতির দিক থেকে সরিয়ে রেখেছে, সেটা বুঝতে কারোরই বিশেষ অসুবিধে হল না। আর অধোবদন অদিতির অবস্থাও যে তথৈবচ সেটাও পরিষ্কার বোঝা গেল।
স্যালুটপর্ব শেষ করে নীলোৎপল বলল, ‘মিসেস রায় যেভাবে নিজেকে বাঁচিয়েছেন সেটা প্রচণ্ড সাহসের ব্যাপার তাতে সন্দেহ থাকতে পারে না। তবে, অন্যায়কে ভুলে না-গিয়ে বা অত্যাচারীকে ক্ষমা না-করে, তার সঙ্গে লড়াই করবার জন্য যে নিশ্চিন্ত জীবন ছেড়ে আবার ফিরে এসেছেন সেটা আরও অনেক বেশি দুঃসাহসের কাজ বলে আমার মনে হচ্ছে।’
বলে সে ইভাকে আবার স্যালুট করে বাড়ির ভেতরে রওনা হল।
ইভা স্মিতমুখে বললেন, ‘অদিতি, ওর সঙ্গে যা। ওকে সাহায্য কর গিয়ে।’
যেন নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও যেতে হচ্ছে, এইরকম একটা ভঙ্গি করে অদিতি উঠে দাঁড়াল। তারপর একটি সঞ্চারিনী পল্লবিনী লতার মতো নীলোৎপলের পেছনে পেছনে চলে গেল।
হৈমন্তী বলল, ‘মা আমি যা ভাবছি, তুমিও কি তাই ভাবছ?’
ইভা হেসে বললেন, ‘হ্যাঁরে। আমিও তাই ভাবছি। বড্ড ভালো ছেলে নীলোৎপল। তবে, অদিতির মাস্টার্স ডিগ্রির আগে কিছু নয়।’
মনোরঞ্জন বললেন, ‘ঠিক বলেছো, মা। ওকে আগে লেখাপড়াটা শেষ করতে হবে। তারপর সংসার। আচ্ছা, এই প্রপার্টিটা নিয়ে কী করবে এখন, সেটা কি ভেবেছো?’
ইভা বললেন, ‘উনি যা করবার করবেন। আমার এ নিয়ে ভাববার কোনো ইচ্ছেই নেই।’
মনোরঞ্জন সুব্রতর দিকে তাকালেন। সুব্রত বললেন, ‘এ নিয়ে যে কোনো ভাবনাচিন্তা করা দরকার তা আমার মাথায়ই আসেনি কোনোদিন। তবে, একটা কথা। এই বাড়িতে আমরা কখনোই থাকব না। আপনি এ ব্যাপারে কী উপদেশ দেন?’
কালীকৃষ্ণ বললেন, ‘আমি কি একটা কথা বলতে পারি?’
সুব্রত বললেন, ‘অবশ্যই। বলুন না।’
‘দেখুন, আমাদের গ্রামে প্রাইমারি এডুকেশনের কোনো ব্যবস্থাই নেই। আমাদের গ্রামের ছোটো ছেলেমেয়েরা প্রায় দু-মাইল দূরে পাশের গ্রাম ধর্মতলায় যায় সাইকেলভ্যানে চড়ে পড়তে। একটু বড়ো হলে যায় কমলপুরে। গরমের সময় আর বর্ষাকালে বড়ো কষ্ট। ইশকুল আগে ছিল। সিংহবাড়ির দানে চলত। ওই গোমুখ্যু বিনু সেটা বন্ধ করে দেয়। তাই বলছিলুম, ওই অতবড়ো বাড়ি বেকার ফেলে না-রেখে ওখানে যদি একটা ইশকুল খুলে দিতেন তাহলে ছোটো বাচ্চাগুলো খুব উপকৃত হত। তার ওপরে, আমাদের গ্রামে অনেক ছেলে-মেয়ে লেখাপড়া শিখে বেকার বসে আছে। তারাও কাজ পেত।’
‘সে তো খুব ভালো প্রস্তাব। পঞ্চায়েতকেও কিন্তু এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে।’
‘নিশ্চয়ই। সে কথা আর বলতে? এই ছেলেমেয়েদের দাদামশায়ের নামে স্কুল হবে।’
মনোরঞ্জন বললেন, ‘সত্যি খুব ভালো প্রস্তাব। তাহলে সেটাই ঠিক হল? তবে সুব্রত, সবার আগে কিন্তু তোমাদের বিয়ের রেজিস্ট্রেশনটা হয়ে যাওয়া দরকার। এ ব্যাপারে কিছু ভেবেছ?’
সুব্রত কিছু বলে ওঠার আগেই হৈমন্তী বলল, ‘বাবা-মার বিয়ের রেজিস্ট্রেশন? কেন, জ্যাঠামশাই? আমি নীতিগত কারণে এতে আপত্তি জানাচ্ছি। ওদের মতো স্বামী-স্ত্রীর আবার রেজিস্ট্রেশন কী? তার কোনো দরকার নেই। এতে যদি কেউ আমাদের বাস্টার্ড বলে তবে সেটা আমরা সগর্বে মাথা পেতে নেব। এমন বাবা-মায়ের সন্তান হওয়ার চেয়ে বড়ো গৌরব আর কিছু হতে পারে না।’
মনোরঞ্জন চোখ মটকে বললেন, ‘তুই বলতে চাস তোদের বাবা-মায়ের মধ্যে কখনো ঝগড়াঝাঁটি হয় না?’
সুমিত হাসতে হাসতে বলল, ‘বাবা-মার মধ্যে ঝগড়া হয় না? খুব হয়। আর সে ভারি মজার। বাবা হয়তো একটা গুল মারল। একটু পরেই ধরা পড়ে যায়। তখন খুব বকুনি খায়। তখন বাবা এমন একটা করুণ মুখ করে যে মা হাসতে শুরু করে দেয়। তারপরে কি আর ঝগড়া হয়?’
চয়ন বলল, ‘হৈমন্তী ঠিক কথাই বলেছে জ্যাঠামশাই। একটা কাগজে সই করলেই কি স্বামী-স্ত্রী হওয়া যায়? ঘটনাচক্রে ওঁদের প্রথাগত বিয়ে হয়তো হয়নি, কিন্তু ওঁদের মতো এমন আদর্শ স্বামী-স্ত্রী আমার তো কখনো নজরে পড়েনি।’
ইভা লজ্জিত গলায় বললেন, ‘আঃ, তোরা চুপ করবি? এ ব্যাপারটা তোদের বাবা আর জ্যাঠামশাই ঠিক করবেন। তোরা কথা বলিস না তো।’
নন্দীসাহেব বললেন, ‘আশ্চর্য! আমি হৈমন্তীকে যত দেখছি ততোই অবাক হয়ে যাচ্ছি। ওর মধ্যে আমি যেন ওর বাবা-মায়ের সাহস আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার ক্ষমতাই দেখতে পাচ্ছি।’
এরপর কিছুক্ষণ ঘরের নীরবতা। তার মধ্যে দরজার বাইরে দুটো গলা শোনা গেল।
একটা ভারী গলা বলল, ‘আপনি বম্বে থেকে আমাকে ফোন করবেন তো?’
একটি ক্ষীণ কণ্ঠস্বর উত্তরে বলল, ‘করব। আপনিও করবেন কিন্তু।’
দু-দিন পরেই চ্যাটার্জি পাড়ার একটা বাড়ির গেটে একটি শ্বেতপাথরের ফলক লাগল। তার ওপরে লেখা— অনাথ-আশ্রম।
Post a Comment