চুন্নু মিয়ার সামনে বসে (ছদ্মবেশ-৪) – সাদাত হোসাইন


চুন্নু মিয়ার সামনে বসে আছে আছিয়া। তার পাশে দাঁড়ানো সোহরাব মোল্লা। সোহরাব মোল্লা বলল, যা যা শিখাই দিছে ঠিকঠাক মতো বলতে পারবিতো?

জে, পারব।

কী বলবি?

বলব সে আমারে দুই বছর ধইরা জোর কইরা খারাপ কাজ করত।

সে কে?

গোলাম মাওলা সাবে।

আর কী বলবি? আমার পেটে সন্তানও আসছিল। সে জোর কইরা নষ্ট করছে।

চুন্নু মিয়া টেবিল থেকে কিছু কাগজ বের করে আছিয়ার সামনে ধরলেন, তোর প্রমাণ নিয়া চিন্তা করতে হইব না। এই যে এইখানে সব আছে। সব ব্যবস্থা করা হইছে। ব্যাক ডেটে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন, রিপোর্ট, সব।

আছিয়া কথা বলল না, তাকিয়ে শুধু দেখলো।

সোহরাব মোল্লা বলল, এত ভয় কিসের তোর? সে যে একদম কিছুই করে নাই, তাতো না? এক দুইবারতো ঘটনা সত্য সত্যই ঘটাইছে, ঘটাই নাই?

আছিয়া ওপর নিচ মাথা ঝাঁকালো, জে।

তাইলে এত শরম কিসের? এত ভয় রাখলে চলত না। টাকা-পয়সাতো কম দিব না তোরে।

জে।

ঢাকায় গিয়া প্রত্যেক কথায় এমনে জে জে করলে কিন্তু হইতো না। কাট কাট উত্তর দেওন লাগব, বুঝলি?

জে।

তোরে রেগুলার মাইর ধইর করত, এইটাও বলবি, ঠিক আছে?

জে।

আর কথায় কথায় জে জে করবি না, মনে থাকব?

জে।

চুন্নু মিয়া কিছু বলতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামলে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। আকাশে আবার মেঘ করেছে। বৃষ্টি নামবে। বন্যার পানি আবার বাড়বে। এত দুশ্চিন্তা আর তার ভালো লাগে না। কোনোভাবে বাঁধ ভেঙে গেলে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষ গৃহহীন হবে। তাদের ফসল নষ্ট হবে। এলাকায় রীতিমতো দুর্ভিক্ষ লেগে যাবে। এটা হলে তার নির্বাচনের আশাও শেষ। এই বন্যার দুশ্চিন্তায় তিনি ঘুমাতে পারছেন না।

.

বিকেলে আরেক দফা লতিফুর রহমানের বাড়ি যেতে হলো তাকে। আরো ইট বালি লাগবে তার। লতিফুর রহমান অবশ্য বাধা দিলেন না। তিনি যেন বরং খুশিই হলেন। অন্তত কিছু একটাতো কারো জন্য করতে পারছেন তিনি। কেউতো একটু হলেও তার প্রতি খুশি হচ্ছে। তিনি আজকাল সবাইকেই খুশি রাখতে চান। নাসিমা বেগম বিকেলে আচমকা বললেন, তুমি যে একটা আস্ত মিথ্যুক সে কথা তুমি জানো না?

লতিফুর রহমান অবাক চোখে তাকালেন, আবার কী হলো তোমার? দেখেতো সুস্থই মনে হচ্ছে।

আমাকেত অসুস্থ বানিয়ে রাখছো তুমি। যাতে তোমার মিথ্যা চেহারাটা আমি মানুষের সামনে খুলে দিতে না পারি।

লতিফুর রহমান কথা বললেন না। তিনি করুণ চোখে নাসিমা বেগমের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

নাসিমা বেগম বললেন, সৈকত এত বছরেও কেন এ বাড়িতে আসে না, দেশে আসে না, সেটা তুমি কাউকে বলো না কেন? তোমার লজ্জা করে? লজ্জা শরম কিছু আছে তোমার?

লতিফুর রহমান চিৎকার করে ডালিয়াকে ডাকলেন। নাসিমা বেগম সাপের মতো হিসহিস করে বললেন, তোমার ডান পায়ে যে তুমি ঠিকঠাক মতো হাঁটতে পারো না, কেন হাঁটতে পারো না, ঘটনা কী ঘটেছিল সে কথা তুমি কাউকে বলেছো? কাউকে কেন বলেন না প্রফেসর সাহেব? বলেন, বলেন, লোকজনরে জানতে দেন আপনের আসল চেহারাখান?

ডালিয়া এসে দরজার কাছে দাঁড়াল। সে ঘরে ঢুকতে ভয় পাচ্ছে। লতিফুর রহমান তাকে আসতে ইশারা করছেন। কিন্তু ডালিয়া জানে নাসিমা বেগম এক্ষুনি ভয়ংকর আচরণ শুরু করবেন। সেই আচরণ সামলানো বিশাল শারীরিক মানসিক প্রস্তুতির ব্যাপার। এই মুহূর্তে সেই প্রস্তুতি তার নেই।

.

দিন কয়েকের একটানা চেষ্টায় রেজাউল হক আরো কিছু তথ্য বের করতে পারলেন লিখনের ব্যাপারে। লিখনের যেহেতু থাকার কোনো স্থায়ী ঘর ছিল না। যেহেতু বেশির ভাগ সময়ই সে ঘরের বাইরে এখানে সেখানেই থাকত, ফলে তার থাকার জায়গাগুলো একাধিকবার তল্লাশি করেও গুরুত্বপূর্ণ তেমন কিছুই পাওয়া যায়নি। যা-ও পাওয়া গিয়েছিল, তা এখনো থানা হেফাজতেই রয়েছে। সেগুলো আবারও তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখলেন রেজা। যদি কোনো কু পাওয়া যায়! কিন্তু তেমন কিছুই পাওয়া গেলো না। রীতিমতো দিশেহারা লাগছে রেজার। মনে হচ্ছে, কেসটা এই বুঝি সমাধান করে ফেলছেন তিনি, কিন্তু তারপরই সবকিছুই কেমন মরুভূমির মরিচীকার মতো আবার দূরে সরে যাচ্ছে। আলো থেকে আলেয়া হয়ে যাচ্ছে।

দীর্ঘ সময় বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত অবস্থায় বসে রইলেন রেজাউল হক। তারপর আবারও উঠে বসলেন সকল আলামত, নথিপত্র নিয়ে। কিছু একটা যেন কোথাও চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। তিনি আবারও পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে খুঁজে দেখতে লাগলেন। আর তা করতে গিয়েই আচমকা থমকে গেলেন তিনি।

মোবাশ্বেরের চায়ের দোকানের ভেতরের দিকে থাকার ছোট একখানা ঘর আছে। রাতবিরেতে এসে সেই ঘরের মেঝেতে মাঝে মাঝে ঘুমাত লিখন। সেখানে বিছানার নিচে জমিয়ে রাখা পুরনো কিছু পত্রিকা পাওয়া গিয়েছিল। সেই পত্রিকাগুলোও সংগ্রহ করেছিল পুলিশ। যদিও সেগুলোকে তেমন কোনো গুরুত্ব দেয়নি কেউই। কিন্তু আজ সেই পত্রিকাগুলোই হঠাৎ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল রেজার কাছে। তিনি ফাইলগুলো খুললেন। প্রায় বছর খানেক আগের পুরনো, মলিন, কোঁচকানো কিছু পত্রিকা রয়েছে ভেতরে। তিনি একে একে সেই পত্রিকাগুলো পড়া শুরু করলেন। পত্রিকাজুড়ে শত শত সংবাদ। রেজাউল হক জানেন না কেন, সেই প্রতিটি সংবাদ তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে লাগলেন। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলেন না। এরপর আবার পড়লেন, আবার। সন্ধ্যা থেকে সারারাত, কতবার যে তিনি সেই খবরগুলো পড়লেন, তা তিনি নিজেও জানেন না।

.

শেষ রাতের দিকে আচমকা এসআই রেজাউল হকের শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। তিনি হঠাৎই আবিষ্কার করলেন, সবগুলো পত্রিকাতেই একটা নির্দিষ্ট সংবাদ রয়েছে। লিখন কি তাহলে এই সংবাদ পড়ার জন্যই পত্রিকাগুলো কিনেছিল? এমনিতে লিখন পত্রিকা পড়ার মানুষ না। তাহলে শুধু এই নির্দিষ্ট একটি খবর পড়ার জন্যই ভিন্ন ভিন্ন তারিখের অথচ একইরকম সংবাদ আছে- এমন পত্রিকাগুলোই সে সংগ্রহ করেছিল? রেজা বারবার সংবাদগুলো পড়লেন। এবং অবশেষে তিনি নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে এই পত্রিকাগুলো কেনার কারণ ওই সংবাদই!

পরদিন ভোরে শরিফুলকে ডেকে তিনি রাগী গলায় বললেন, এই পত্রিকাগুলো যে লিখনের ঘর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, তা আমাকে আগে জানাওনি কেন?

ওগুলো দিয়ে কী করবেন স্যার?

কী করবো মানে?

এগুলো লিখনের বিছানার নিচে পাওয়া গেছিলো। সে প্রায়ই রাতবিরাতে মদ টদ খেয়ে এসে মোবাশ্বেরের চায়ের দোকানে ঘুমাতো। ওই দোকানের ভেতরের দিকে একটা ছোট্ট ঘর আছে, সেইখানে। মাটিতেই বিছানা পাতা থাকতো। একটা তোশক আর বালিশ। সেই তোশকের নিচে ফ্লোরে বিছানোর জন্য এই পেপারগুলো ছিল!

রেজা খানিক চুপ করে থেকে বললেন, হয়তো…।

কেন স্যার? কোন সমস্যা?

হয়তো তখন সে বিছানার নিচেই বিছিয়েছিল। কিন্তু পত্রিকাগুলো সে কিনেছিল অন্য কারণে।

অন্য কারণে! শরিফুল ভারি অবাক হলো।

হুম, অন্য কারণে। রেজা গম্ভীর আনমনা ভঙ্গিতে জবাব দিলেন।

অন্য কী কারণে স্যার?

রেজা এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। তিনি থানা থেকে বের হয়ে হনহন করে হেঁটে চলে গেলেন ব্যাংকে। রফিকুল ইসলাম পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছেন। তার সামনে হারাধন। তিনি হারাধনকে দিয়ে আরো একজোড়া জুতা বানাবেন। কম্পিউটার থেকে জুতার ডিজাইন দেখাচ্ছেন। হারাধন চলে যেতেই রেজা বললেন, আপনি ভালো আছেন ম্যানেজার সাহেব?

রফিকুল ইসলাম বললেন, জি ভালো।

কেমন ভালো?

বেশ ভালো।

কতটুকু বেশ ভালো?

রফিকুল ইসলাম অবাক চোখে তাকালেন। তারপর আচমকা হেসে বললেন, এখানে ব্যাংক এত ভালো বিজনেস করতে পারবে সেটা কেউই ভাবেনি। অল্প কয়েকদিনেই আমাদের লেনদেন প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। সবাই খুব খুশি।

আপনি খুশিতো?

আমিতো অফকোর্স খুশি।

রেজা ঠাণ্ডা গলায় বললেন, বেশি খুশি ভালো না রফিক সাহেব। শোনেননি, যত হাসি, তত কান্না, বলে গেছেন রাম শন্না?

রফিকুল ইসলাম আচমকা থমকে গেলেন, কী হয়েছে বলুনতো রেজা সাহেব?

রেজা শান্ত, স্থির কণ্ঠে বললেন, আপনার একটু আমার সঙ্গে থানায় যেতে হবে।

.

১৭.

এনায়েত খুন হয়ে গেল পরদিন ভোর রাতে। তার লাশ পাওয়া গেল লতিফুর রহমানের বাড়ির গেটের বাইরে। লিখনের মতো তাকেও খুন করা হয়েছে গলায় তার পেঁচিয়ে। এই ঘটনায় মুহূর্তেই থমথমে হয়ে গেল পুরো শহর। লিখনের ঘটনায় যেভাবে সবাই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল, এনায়েতের ঘটনায় ঘটল তার উল্টোটা। হঠাৎ করেই যেন তীব্র আতঙ্কে চুপসে গেল পলাশবাড়ির মানুষ। এই প্রথম তারা উপলদ্ধি করল এক ভয়ঙ্কর খুনি, এক অদৃশ্য আততায়ী দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক তাদের ঘাড়ের কাছেই। তারা কেউ সেই অদৃশ্য খুনিকে দেখতে পাচ্ছে না, চিনতে পারছে না। কিন্তু খুনির স্বার্থে এতটুকু ব্যাঘাত ঘটলেই খুন হয়ে যেতে পারে যে কেউ!

লাশের পাশে দীর্ঘ সময় বসে রইলেন পুলিশের এসআই রেজাউল হক। চুপচাপ, একা, নিস্তব্ধ। তিনি উঠলেন দুপুরের পর। শরিফুল তার সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে রইল। কিন্তু একটা কথাও বললেন না রেজা। থানায় নিজের ঘরে গিয়ে দুপুরের খাবার খেলেন তিনি। তারপর উঠে এই খুনের সকল ফাইল একের পর এক আবারো দেখতে লাগলেন। তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা একে একে মনে করার চেষ্টা করলেন। এবং প্রতিবারই তিনি একটা জিনিস আবিষ্কার করলেন, সেটি হচ্ছে, যতবারই তিনি ভেবেছেন যে কেসটি সমাধান করার একদম কাছে চলে এসেছেন, ঠিক ততবারই কোনো একটি ঘটনা ঘটেছে, আর তিনি ভুল প্রমাণিত হয়েছেন। আজকের ঘটনাটিও তেমনই।

তার ধারণা ছিল, তিনি কেসের একদম চূড়ান্ত মুহূর্তে পৌঁছে গেছেন। এখন শুধু অপেক্ষা, অপরাধী ধরা পড়া কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু এনায়েতের খুন তার সব ভাবনাকে এলোমেলো করে দিয়েছে। আর সব বারের মতোই তিনি এবারো পুরোপুরি বোকা বনে গেছেন। যতবার ভেবেছেন কেসটা প্রায় সমাধান করে ফেলেছেন, ঠিক ততবারই তিনি আবৃত হয়েছেন আরো বেশি গাঢ় ধোঁয়াশায়।

.

বন্যার পানি আচমকা যেন থমকে গিয়েছিল দিন তিনেকের জন্য। ভাটার সঙ্গে কমেও গিয়েছিল বেশ খানিকটা। কিন্তু গতকাল বিকেল থেকে টানা দখিনা হাওয়া, তারপর রাত থেকেই গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। সারাটাদিনই আকাশ মুখভার করে রাখল। মেঘ ডাকল থেকে থেকে। সেই থেকে নেমে যাওয়া জল যেন আবার মন ঘুরিয়ে ফিরে আসত লাগল। সন্ধ্যার আগে আগেই অন্ধকারটাও নেমে এলো। অমাবস্যার ঘুটঘুঁটে সেই অন্ধকারে তিনখানা নৌকা চুপিসারে এগিয়ে চললো উত্তর দিকে। প্রথম নৌকায় গোলাম মাওলা স্বয়ং। তার সঙ্গে সবুর। দ্বিতীয় নৌকায় নুরু মিয়ার সঙ্গে দুই-তিন জন শ্রমিক। তৃতীয় নৌকায় আজগরের সঙ্গে আরো কয়েকজন শ্রমিক। বিরূপ আবহাওয়ার কারণে পুলিশের টহল অনেকটাই শিথীল। তবে আবহাওয়ার চেয়েও বড় ঘটনা এনায়েতের মৃত্যু। বেশির ভাগ পুলিশকেই জরুরি থানায় তলব করা হয়েছে।

নুরু মিয়া এতদিন যে সুযোগের অপেক্ষায় ছিল, আজ যেন তা সোনায় সোহাগা হয়ে ধরা দিল। পুলিশের টহল দলের চোখে পড়ার সম্ভাবনা আজ আর নেই। সম্ভাবনা নেই চুন্নু মিয়ার লোকজনের চোখে পড়ারও। আজ সবাই এনায়েতের লাশ নিয়ে ব্যস্ত। গোলাম মাওলা এই সুযোগটা হারাতে চাননি, তাই তিনি নিজেই চলে এসেছেন আজকের ঘটনা স্বচক্ষে দেখার জন্য।

অন্ধকারে চল্লিশ মিনিট নৌকা চালানোর পর উত্তর দিকের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের দেখা পাওয়া গেল। বাঁধের গায়ে নৌকা ভেড়াতেই টপাটপ লাফিয়ে নেমে গেল আজগর আর শ্রমিকেরা। সঙ্গে নামল সবুরও। তারপর আজগরের দেখিয়ে দেয়া জায়গাটাতে পৌঁছে গেল তারা। গত প্রায় মাসখানেক ধরে অত্যন্ত সাবধানে, লোকচক্ষু এড়িয়ে একটু একটু করে বাঁধের তলার মাটি সরানো হয়েছে। আজ আর ঘণ্টা দুয়েক সময় পেলেই বাঁধ ধসিয়ে দেয়া যাবে। তারপর শুরু হবে আসল খেলা। নতুন সম্ভাবনায় গোলাম মাওলার চোখ চকচক করে উঠল। গ্রামের পর গ্রাম ভেসে যাবে। ভেসে যাবে ফসলের মাঠ।

এতদিন এই বাঁধ নিয়ে চুন্নু মিয়ার বিরুদ্ধে যে প্রচারণা চালানো হয়েছিল, তা এবার নিশ্চিত করেই হালে জোর পানি পাবে। বাঁধের জন্য সরকারি বরাদ্দের টাকার সামান্য অংশই যে চুন্নু মিয়া বাঁধ নির্মাণে খরচ করেছিলেন, আর বাদ বাকি টাকা যে তিনি তার পকেটস্থ করেছিলেন, এখনই তা হাতে-কলমে প্রমাণের সময়।

অল্প টাকায় ফাঁকিবাজি করে তৈরি করা অপুষ্ট বাঁধ তাই আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বানের জলে ধসে যাবে। এই বাঁধ বিস্তির্ণ অঞ্চলের মানুষের জীবন-মরণের সীমারেখা। সেই বাঁধ নিয়ে চুন্নু মিয়া নয়-ছয় করেছেন, জনগণের কাছে এর কোনো ক্ষমা নেই। গোলাম মাওলার আর তর সইছে না। এই একটি মাত্র ঘটনার জন্য কত বিনিদ্র দিন-রাত্রির অপেক্ষা তার! এই একটি মাত্র ঘটনায় নির্বাচনের পাল্লা প্রায় শতভাগ ভারী হয়ে যাবে তার দিকে, এটি সুনিশ্চিত। তিনি জ্বলজ্বলে চোখে অপেক্ষা করছেন। তার ইচ্ছে হচ্ছে নিজেই যেন কোদাল হাতে নেমে যান। রাত দশটা নাগাদ বাঁধের একটা অংশ ধসে গেল। হু হু করে নেমে যেতে থাকল পানি। পানির গর্জনের শব্দে গোলাম মাওলার চোখেও আনন্দের পানি চলে এলো।

.

কিন্তু মাছ ধরার এক ট্রলার আচমকা লাইট জ্বালিয়ে ছুটে যেতে থাকল শহরের দিকে। ততক্ষণে আরো বেশ খানিকটা ধসে গিয়েছে বাঁধ। বাঁধ ভেঙে যাওয়ার এই খবর যতক্ষণে থানায় পৌঁছালো, ততক্ষণে শহরের সকল মানুষ ছুটতে শুরু করেছে বাঁধের দিকে। পলাশবাড়ির মানুষের কাছে এনায়েতের লাশের চেয়ে বহুগুণ গুরুত্বপূর্ণ এই বাঁধ। এই বাঁধ ভেঙে গেলে তাদের জীবন মুহূর্তেই মূল্যহীন হয়ে যাবে। যে করেই হোক এই বাঁধ জোড়া লাগাতে হবে। নাহলে জলে ভেসে, অনাহারে তাদের নিশ্চিত মৃত্যু। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এই খবর পেয়েও পলাশবাড়ি থানার এসআই রেজাউল হক তেমন তাড়াহুড়া করলেন না। তিনি অসংখ্য গ্রামবাসীর সঙ্গে একদল পুলিশ পাঠিয়ে দিলেন বাঁধ ঠেকাতে। আর নিজে বসে রইলেন থানায়।

আরো খানিকটা সময় যেতেই রেজাউল হক উঠে দাঁড়ালেন। তারপর হেঁটে চললেন সুনসান শহরের দিকে। তার সঙ্গে শরিফুলসহ আরো দুজন পুলিশ কনস্টেবলও রয়েছে। রয়েছেন ব্যাংক ম্যানেজার রফিকুল ইসলামও। শহরে ঢুকে দুজন পুলিশকে ব্যাংকের বাইরে সতর্ক পাহারায় রেখে তারা তিনজন ঢুকে গেলেন ভেতরে। সঙ্গে ব্যাংকের দুজন গার্ডও। রফিকুল ইসলাম তাদের নিয়ে গেলেন যেখানে টাকার ভল্টগুলো রয়েছে সেই জায়গাটাতে। ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত প্রায় একটা। নিঃশব্দ, নির্জন রাত। কেবল টিকটিক করে বয়ে যাওয়া ঘড়ির কাটাটাই যা মৃদু শব্দে সঙ্গ দিচ্ছে। গাঢ় অন্ধকারে কোনো এক অনিশ্চিত অপেক্ষায় বসে আছেন মানুষগুলো। এই বুঝি অন্ধকার ফিকে হয়ে আলো জ্বলে উঠল। এই বুঝি নিস্তব্ধতা ভেঙে খানখান হয়ে গেল বিকট কোনো শব্দে। কিন্তু কিছুই ঘটল না। কেবল ঘড়ির কাটায় বয়ে যেতে লাগল সময়।

রফিকুল ইসলামের খানিক ঝিমুনির মতো লেগে এসেছিল। চেয়ারের পেছনে হেলান দিয়ে বসে থাকলেও মাথাটা হঠাৎ বাঁদিকে কাত হয়ে পড়ল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে খপ করে তার হাতটা চেপে ধরলেন রেজা। চোখ মেলে তাকালেন রফিকুল ইসলাম। কিন্তু অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেলেন না। তবে শব্দটা শুনতে পেলেন। খুব কাছে কোথাও থেকে কংক্রিটের গায়ে ধাতব, ধারালো কিছুর ঘর্ষণের মৃদু শব্দ আসছে। শব্দটা জোরালো হচ্ছে ক্রমশই। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষায় বসে আছেন রেজা। আর ঠিক সেই মুহূর্তে রাতের নির্জন নিস্তব্ধতা ভেঙে ঘরের মেঝেটা আচমকা বিকট শব্দে ফাঁক হয়ে গেল। একটা গোলাকার গর্তের মুখ দৃশ্যমান করে কংক্রিটের মেঝেটা সরে গেল একপাশে। সেই গর্ত থেকে প্রথমে সাবধানে মাথা বের করে উঁকি দিল একটি মুখ, তারপর আরো একটি মুখ। তারপর বেড়ালের মতো নিঃশব্দে মাটির নিচ থেকে পরপর বের হয়ে এলো দুজন মানুষ!

রেজা আরো খানিকক্ষণ অপেক্ষা করলেন। তারপর অন্ধকারে একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়লেন মানুষ দুজনের ওপরে। শরিফুল ঘরের আলো জ্বালানোর আগ অবধি মানুষ দুজনের চেহারা দেখা গেল না। দীর্ঘ সময় ব্যাংকের নিচের গুহার অন্ধকারে থেকে হঠাৎ ঝলমলে আলোয় চোখ খুলতে পারছে না গুহা থেকে বের হওয়া মানুষ দু’জন। তীক্ষ্ণ আলোর টর্চ লাইটখানা তাদের চোখের ওপর স্থির ধরে আছে শরিফুল। সেই আলোতে হতবুদ্ধের মতো দাঁড়িয়ে আছে চায়ের দোকানি মোবাশ্বের আর মুচি হারাধন!

দুহাতে চোখ মুখ ঢেকে ওই ঝাঝালো আলো থেকে বাঁচবার চেষ্টা করছে তারা!

.

১৮.

পরের সারাটাদিন শরিফুল অনেক চেষ্টা করল রেজার সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু পারল না। খুব জরুরি কিছু কাজে সারাদিন ডুবে রইলেন তিনি। শরিফুলের কোনো কথাই গ্রাহ্য করলেন না তিনি। একের পর এক ফোন করতে হচ্ছে তাকে। হারাধন আর মোবাশ্বেরকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। তারা স্পষ্ট করে কিছু না বললেও যতটুকু বলেছে তার সঙ্গে নিজের অনুমান, পর্যবেক্ষণ আর যুক্তি মিলিয়ে মোটামুটি স্পষ্ট একটা ধারণা পেয়েছেন রেজাউল হক। তাদের কথার সূত্র ধরেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে আজগর আর তার সঙ্গের লোকজনকেও। উত্তরদিকের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধটা শেষ অবধি পুরোপুরি ধসিয়ে দেয়া সম্ভব হয়নি। এলাকার লোকজন মিলে আপাতত একটা ব্যবস্থা করেছে। বাঁধের ঘটনার কারণে গোলাম মাওলাকে গ্রেপ্তার করা হবে কী না সে বিষয়ে ওপর মহল থেকে এখনো স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা আসেনি। তবে তাকে বাড়িতেই থাকতে বলা হয়েছে। তার বাড়ির বাইরে পুলিশ প্রহরাও বসানো হয়েছে।

শরিফুল আরো একবার বলল, স্যার?

রেজা এবার জবাব দিলেন, বলো?

ঘটনাতো কিছুই বুঝলাম না স্যার?

কোন ঘটনা?

গতকাল রাতে যা ঘটল।

ঘটনাতো এখনো শেষ হয়নি।

আরো বাকি আছে?

হ্যাঁ।

কিন্তু স্যার যা হইল, তাওতো বুঝতে পারলাম না।

না বুঝতে পারার কি আছে?

আপনে কী করে বুঝলেন যে হারাধন আর মোবাশ্বের মিলে মাটি খুঁইড়া ব্যাংক ডাকাতির প্ল্যান করতেছে?

রেজা গম্ভীর মুখে হাতের আরো কিছু কাজ শেষ করলেন। তারপর ধীরে-সুস্থে ফাইল থেকে সেই পুরনো পত্রিকাগুলো বের করলেন। প্রতিটা পত্রিকা থেকেই নির্দিষ্ট একটি সংবাদ কেটে আলাদা করা হয়েছে। সেই পেপার কাটিংগুলো শরিফুলের সামনে মেলে ধরলেন রেজা। তারপর বললেন, এই সংবাদগুলো পড়ো।

বলেই আবারো কাজে ডুবে গেলেন রেজা। শরিফুল সময় নিয়ে পড়ল। তারপর হতভম্ব ভঙ্গিতে বলল, এ তো দেখি সবই ব্যাংক ডাকাতির খবর!

রেজা মুখ তুলে তাকালেন, হুম।

শরিফুল কৌতূহলী গলায় বলল, এই খবরের সঙ্গে লিখনের সম্পর্ক কী? আর লিখনের সঙ্গে গতকালের ঘটনার সম্পর্ক কী?

রেজা হাসলেন, বছরখানেক আগে রাজশাহীতে একটা ব্যাংক ডাকাতি হয়েছিল। মাটি খুঁড়ে ব্যাংকের যে ঘরে টাকার ভল্ট থাকে, ঠিক সেই ঘরে উঠেছিল ডাকাতরা। এই দেখো, সংবাদটা পত্রিকায়ও ছাপা হয়েছিল। দেখেছো?

জি স্যার।

ডাকাতিটা হয়েছিল বৃহস্পতিবার রাতে। কারণ, পরদিন শুক্রবার, ব্যাংক বন্ধ।

জি।

এর কিছুদিন পরে দিনাজপুরেও একদম একইভাবে ডাকাতি হয়েছিল। দেখেছো? এই যে, এই কাটিংটা দেখো।

জি স্যার।

দুটি ডাকাতির ঘটনায়ই অপরাধীরা ধরা পড়ে গিয়েছিল। তবে রাজশাহীর ঘটনায় একরাতের মধ্যে ষোল কোটিরও বেশি টাকা ব্যাংক থেকে সরিয়ে ফেলতে পেরেছিল ডাকাতরা। পরে ট্রাকভর্তি চাল কিনে নিয়ে সেই চালের বস্তায় টাকা ঢুকিয়ে ট্রাকে করে চাল নিয়ে যায় ঢাকায়।

শরিফুল বিস্মিত ভঙ্গিতে আবারো সংবাদটা পড়তে লাগল।

রেজা বললেন, ডাকাতরা ডাকাতির উদ্দেশ্যে ব্যাংকের পাশেই বছরখানেক আগে থেকে বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল। তারপর দিনের পর দিন, রাতের পর রাত নিজেদের বাড়ির মেঝে থেকে গর্ত খুঁড়ে ব্যাংকের টাকা রাখার ভল্টের মেঝে পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল তারা।

শরিফুলের বিস্ময় কাটছে না। সে বলল, কিন্তু স্যার, এইটাতো অনেক হিসাব-নিকাশের ব্যাপার।

একদম। অনেক হিসেব-নিকেশ এবং ঝুঁকির ব্যাপারও।

মোবাশ্বের আর হারাধনরা কী এই পত্রিকার খবর থেকেই বুদ্ধিটা করেছিল?

হুম। পত্রিকার খবর এবং অন্যান্য সোর্স থেকে পাওয়া এই ধরনের নানা সংবাদ আর আগের ঘটনাগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে যাচাই করে দেখেছিল এরা। তারপর পরিকল্পনা করেছিল। ব্যাংক ম্যানেজার রফিকুল ইসলামের সঙ্গেও এই জন্যই ভালো সম্পর্ক তৈরি করেছিল ওরা দুজন। এতে করে যখন তখন ব্যাংকের ভেতর-বাহির সব জায়গায় যখন তখন যেতে আসতে পারত তারা। খোঁজখবরও জানতে পারত। আর সেই অনুযায়ী প্ল্যান-পরিকল্পনাও করেছিল।

রেজা খানিক থামলেও শরিফুল কথা বলল না। রেজা আবার বললেন, এই পরিকল্পনা তারা করেছে বছরখানেক আগে। তারা কোনোভাবে জেনেছিল যে এখানে নতুন ব্যাংক হবে। তখনই তারা এই পরিকল্পনা করেছিল।

এতদূরের পলাশবাড়িতে নতুন ব্যাংক আসবে, আর সেই ব্যাংক কোথায় না কোথায় বসবে, তা তারা কীভাবে জানবে?

রেজা হাসলেন, তখন যে জিজ্ঞেস করলে, এই ঘটনার সাথে লিখনের সম্পর্ক কী?

জি স্যার।

লিখনের সম্পর্ক এখানেই।

মানে?

এই পলাশ বাড়িতে ব্যাংক আসবে, সেই ব্যাংক কোথায় বসবে, এসব তাদের জানিয়েছিল লিখন।

লিখন!

হুম। এমনকি এটাও হতে পারে যে এর মূল পরিকল্পনাটা ছিল লিখনের। অবশ্য হারাধনেরও হতে পারে। আইডিয়াটা তারা পেয়েছিল পত্রিকার ওই নিউজ থেকেই। সেই সময়ের পত্রিকার এই ব্যাংক ডাকাতি সম্পর্কিত খবরগুলো রেগুলার পড়ত তারা। এমনকি বিভিন্ন সময়ের এমন ব্যাংক ডাকাতির খবরগুলোও সংগ্রহ করতো। তারপর শুরু হয় তাদের প্ল্যানিং। হারাধন এখানে এসে মুচির দোকান দিয়ে বসে যায়। আরেক পাশে মোবাশ্বেরের চায়ের দোকান।

অত আগে থেকেই লিখন জানত কোথায় ব্যাংক বসবে?

হুম জানত। কারণ চুন্নু চেয়ারম্যান তার মামা। আর বাজারে চুন্নু চেয়ারম্যানের অনেকগুলো ভালো দোকান আছে। ফলে এখানে ব্যাংক আসলে তারা তার কোন দোকানে বা ভবনেই করতে চাইবে। তাই না?

জি স্যার।

এই জন্যই অনেক আগেই ব্যাংকের পক্ষ থেকে চুন্নু মিয়ার সঙ্গেই যোগাযোগ করা হয়েছিল। চুন্নু মিয়া সেসবের দায়িত্ব দিয়েছিলেন লিখনকে। আর লিখন তখন এটা নিশ্চিত করছিলো যে ব্যাংক যেন তাদের ভবনেই বসে। এবং কোন ভবনে কোথায় বসবে, সেটাও সে তাই আগেভাগেই জানতো’।

শরিফুল যেন এবার বিভ্রান্ত হয়ে গেল। সে বলল, তাহলে লিখনরে খুন করল কে?

হয়তো হারাধন আর মোবাশ্বেরই!

কী বলছেন স্যার! তারা কেন খুন করবে? আপনার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে লিখনতো তাদেরই লোক!।

হুম। তবে এসব কাজে যা হয়, একজন ঝামেলা তৈরি করলেই বাকি সবাই ভয়ে থাকে, যদি সে মুখ খুলে দেয়! তাহলেতো সবার বিপদ! লিখন শেষ দিকে এসে সম্ভবত কোনো ঝামেলা করেছিল।

এই জন্য প্ল্যান করে তারা লিখনকে খুন করেছে?

হুম। আর চেষ্টা করেছে যাতে খুন নিয়ে বেশি ইনভেস্টিগেশন না হয়। হলেও একদম ভিন্ন দিকে সন্দেহ চলে যায়। এই সুযোগে যত দ্রুত সম্ভব তারা তাদের কাজ সারবে।

কিন্তু স্যার, হারাধন আর মোবাশ্বেরের মতো দুইজন…।

রেজা হাসলেন, আমার ধারণা হারাধন আসলে হারাধন না। আর সে মুচিও না। এমন কাজই তার প্রফেশন।

তাহলে কে সে?

তার আসল নাম আলাউদ্দিন হাজি। সে আসলে এই কনস্ট্রাকশন লেবারদের সর্দার। কনস্ট্রাকশন লেবারদের সর্দার হওয়ায় তার জন্য খুব সুবিধা হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতে গেলে, মানুষের বাড়ি, ঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের খোঁজখবর পাওয়া তার জন্য সহজ হয়। প্ল্যানও করতে পারে খুব সহজে। তবে তার লেবারদের সবাই যে এইসব ঘটনা জানে তা না। জানে অল্প কয়েকজন। বাকিরা হয়তো তাকে ভালোভাবে চেনেও না। তারা চেনে আজগরকে। এমন লেবারদের বেশির ভাগকেই ছুটা লেবার হিসেবে ভাড়া পাওয়া যায়।

রেজা সামান্য থেমে আবার বললেন, এই ঘটনাতেও খুব অল্প কয়েকজন লেবার হারাধনকে চিনত, কেবল তারাই জানত ব্যাংক ডাকাতির কথা। বাকিরা কেউ কিছু জানত না। হারাধনের মুচির দোকানে সারাক্ষণ যে দুই-তিনজন কাজ করত, ওরা আসলে হারাধনের ঘরের মেঝে থেকে গর্ত খোঁড়ার কাজ করত, রাত দিন। হারাধন জুতা বানানোর ভান ধরে নানা ধরনের শব্দ তৈরি করত, যাতে রাতের নিস্তব্ধতায়ও কেউ গর্ত খোঁড়ার শব্দ শুনে সন্দেহ করতে না পারে!

কিন্তু সে যে এত সুন্দর জুতা বানাতো?

হতে পারে মুচির কাজটা সে ভালোই জানে! বা এমনও হতে পারে সে জুতা বাইরে থেকে বানিয়ে নিয়ে আসত। তবে নিজেরওতো কিছু কাজ জানতে হয়েছে। তার। আমার ধারণা, মানুষের চোখে ধুলো দেয়ার জন্য সে যেটা করত তাহলে অর্ডার মতো জুতার বিভিন্ন পার্ট সে বাইরে থেকে কিনে নিয়ে আসত। তারপর এখানে এনে জোড়া লাগাত। এই কাজটা সে করতে পারত। আর সঙ্গে কিছু এক্সপার্ট লোকও ছিল। তবে ভুলটাও এখানেই ছিল।

কী ভুল?

সে যে জুতার সোলগুলো লাগাত, তার সবগুলো একইরকম। বাইরে থেকে একসঙ্গে কিনে আনার কারণে এমন হতে পারে!

কীভাবে বুঝলেন?

ব্যাংক ম্যানেজার রফিকুল ইসলাম, চেয়ারম্যান চুন্নু মিয়া এবং গোলাম মাওলার জুতার সোল একইরকম। এবং সেদিন ভোর রাতে যখন আমরা লতিফুর রহমান স্যারের বাড়ির সীমানাপ্রাচীরের বাইরে চক্কর দিচ্ছিলাম, তখন সেখানে ঠিক একই রকম জুতার সোলের ছাপ আমি দেখেছি। শুধু তাই-ই না, একটা দেয়ালেও কাদা-মাটির এই সেইম জুতার ছাপ ছিল!

তার মানে ওনারা কেউ ওই বাড়িতে যেতেন? বা দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকেছিলেন?

নাহ, রাতের বেলা কাদা-জলের মধ্যে হাঁটতে হবে বলে হারাধন নিজেই সেদিন জুতা পরেই ওই বাড়িতে গিয়েছিল। ঘটনাচক্রে তার সেদিনের পরা জুতাও ছিল ওই একই সোলের জুতা!

কিন্তু হারাধন কেন ওই দিন ওই বাড়িতে গিয়েছিল?

রেজা দীর্ঘসময় চুপ করে থেকে বললেন, ডালিয়ার সঙ্গে দেখা করতে!

ডালিয়া!

হুম।

কোন ডালিয়া স্যার?

লতিফুর রহমান স্যারের বাসার কাজের মেয়ে ডালিয়া।

মানে? শরিফুল যেন রীতিমতো বজ্রাহত হয়ে গেলো। সে আর্তনাদের মতো স্বরে বললো, ডালিয়ার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলো হারাধন! কেন? ডালিয়ার সাথে তার কী কাজ? এই ঘটনার সাথে ডালিয়ার কী সম্পর্ক?

রেজা মৃদু হাসলেন, গভীর সম্পর্ক।

শরিফুল কিছুই বুঝতে পারছে না। রেজা যেন তার সাথে ইচ্ছে করেই খানিক হেয়ালিও করছেন। সে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। রেজা সামান্য চুপ করে থেকে অবশেষে বললেন, আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে, তবে ঘটনা তা-ই। সম্ভবত এই ঘটনার প্রধান চরিত্রই ডালিয়া! যদিও এখনো পর্যন্ত এটা আমার অনুমান।

শরিফুলের মুখ হা হয়ে আছে। বিষ্ময়ে তার চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে! কোনোমতে ঢোক গিলে সে আবারও বলল, ডালিয়া!

রেজা গম্ভীর গলায় বললেন, খুব খেয়াল করে শোননি বলে ভুলে গেছো, ডালিয়া বছরখানেক আগে লতিফুর রহমানের বাড়িতে থাকা শুরু করে। ঠিক ওই সময়টাতেই হারাধন এবং মোবাশ্বেরও কিন্তু পলাশবাড়িতে আসে। ডালিয়া কীভাবে এসেছিল মনে আছে? এক রাজমিস্ত্রি তাকে বোন বলে রেখে গিয়েছিল?

জি স্যার।

আমার ধারণা, এই পুরো বিষয়ের প্ল্যান পরিকল্পনা ডালিয়ার। সে এই দলের প্রধান। সমস্যা হচ্ছে, ডালিয়ার বুদ্ধি পরামর্শ বা একটার পর একটা সিদ্ধান্ত জানার তাৎক্ষণিক কোনো উপায় ছিল না হারাধনের। কারণ ডালিয়া সতর্কতাবশত কোনো ফোনও ব্যবহার করত না। এই জন্য হারাধনকে প্রায়ই রাতের অন্ধকারে দেয়াল টপকে ওই বাড়িতে ঢুকতে হতো!

তাহলে কী লিখনকে ওই বাড়িতে নিয়ে খুনের পরিকল্পনাও তারই?

একজ্যাক্টলি। ওই বাড়ির কারো যোগসাজশ ছাড়া ওভাবে ওখানে কাউকে খুন করা সম্ভব ছিল না। বা সম্ভব হলেও এত সহজে সম্ভব হতো না। পুরো বিষয়টা একবার ভাবোতো?

জি, স্যার?

লিখনকে খুন করার সময়টায় লতিফুর রহমান যে ঘরের বাইরে বা নিচতলায় চলে যাবেন, তা কিন্তু ভাড়াটের ছদ্মবেশে আসা খুনিদের পক্ষে আগেভাগেই নিশ্চিত হওয়া সম্ভব ছিল না। ছিলো?

না। তা ছিল না!

নম্বর দুই, ধরে নিলাম কোনো না কোনভাবে কথাবার্তা বলে বা কোনো একটা ঘটনা ঘটিয়ে ওইটুকু সময়ের জন্য তারা স্যারকে ঘরের বাইরে নিয়ে এসেছিল, কিন্তু দ্যা ফ্যাক্ট ইজ, এরপর যদি ওইদিনই আরো কোনো ভাড়াটে ঘর ভাড়া নিতে আসত? তাহলে?

তাহলেতো তারা ওই ঘরটা দেখতে গেলেই লাশটাও দেখে ফেলত!

একদম।

জি স্যার।

আর সেটা যদি হতো, তাহলে খুনি সঙ্গে সঙ্গেই ধরা পড়ে যেত। কারণ, অন্য ভাড়াটেরা ঘর দেখতে এসে যখন দেখত যে বাথরুমের ভেতর কিছুক্ষণ আগে খুন করা একটা লাশ পড়ে আছে, খুব স্বাভাবিক তখন একটা হৈচৈ পড়ে যেত। আর কিছুক্ষণ আগের ঘটনা লতিফুর রহমানেরও মনে থাকত। বিষয়টা তখন একেবারেই ওপেন হয়ে যেত।

জি স্যার।

সুতরাং ডালিয়া এটা কনফার্ম করেছিল যে খুনের পর সেদিন আর কোনো ভাড়াটে যাতে বাড়ি দেখতে আসতে না পারে। এবং শুধু তা-ই না, সে এটিও জানত যে প্রফেসর সাহেবরা সবাই মিলে পরদিন বেশ কিছুদিনের জন্য গ্রামে চলে যাবেন। সো, এর চেয়ে ভালো কোনো সুযোগ আর ছিল না।

খুনটা তাহলে কে করেছিল? হারাধন বা মোবাশ্বের হলেতো প্রফেসর সাহেবের চিনে ফেলার কথা?

আমার ধারণা, খুন করার সময় ওরা ছিল না। কিংবা থাকলেও হারাধন হয়তো আলাউদ্দিন হাজি সেজেই গিয়েছিল। এই কাজ সে আগেও করেছে। লম্বা দাড়ি, চোখে সুরমা, জোব্বা পরা হাজি সাহেব দুম করে যেমন হারাধন মুচি হয়ে যেতে পারেন, তেমনি আবার আলাউদ্দিন হাজিও সাজতে পারেন বলেই আমার বিশ্বাস। আর লতিফুর রহমানের এত কিছু খেয়াল করার কথা না। সঙ্গে হয়তো অন্য দুজন শ্রমিকও ছিল। যারাও এই প্ল্যানের অংশ। তবে তাদের আলাদা করে কেউ চেনে না।

কিন্তু স্যার এনায়েততো নিরীহ মানুষ, সে খুন হয়েছিল কেন?

এখনো জানি না আমি। ডালিয়াকে গ্রেপ্তার করলে সব জানা যাবে, তবে আমার ধারণা, এনায়েত খুন হয়েছিল কারণ সে দেখে ফেলেছিল রাতের অন্ধকারে কলাপসিবল গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে হারাধনের সঙ্গে ডালিয়া প্রায়ই কথা বলে। শেষ দিন হয়তো সে হাতেনাতে ধরে ফেলেছিল। আর এ কারণেই খুনটা হয়েছিল। তা ছাড়া ওই খুনটা করে ফেললে সবার মনোযোগও সরে যাবে অন্যদিকে।

একদম!

শুধু তা-ই না, সেদিনই গোলাম মাওলার হয়ে আজগরকে দিয়ে বাঁধ কাটানোরও ব্যবস্থা করা হলো। বাধ নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল, শহর হয়ে গেল ফাঁকা। ব্যাংক ডাকাতির জন্য এর চেয়ে বড় সুযোগতো আর হয় না!

শরিফুল আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই রেজা বলল,আজ রাতে আরো একটা বাজি হয়ে যাক শরিফুল।

কী বাজি স্যার?।

আজ রাতের অন্ধকারেই ডালিয়া পালানোর চেষ্টা করবে। আমি তাকে হাতে নাতে ধরতে চাই।

.

সেই রাতেই রেজা আর শরিফুল লতিফুর রহমানের বাড়ির বাইরে অন্ধকারে ওঁত পেতে রইলেন। কিন্তু রেজার অনুমান সত্য হলো না। তিনি আবারো বাজিতে হেরে গেলেন। সারারাত মশার কামড় খাওয়াই সাড় হলো তাদের। ডালিয়া বাড়ি থেকে বের হলো না। রেজা যেন আবারও খানিকটা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ডালিয়া সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন, তার পুরোটাই তার মনের যৌক্তিক কল্পনা। তার হাতে ডালিয়ার বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো প্রমাণ নেই। এমনকি হারাধন বা মোবাশ্বেরও ডালিয়ার বিষয়ে কিছু বলেনি। অন্যসব বিষয়ে অল্পবিস্তর কথা বললেও অনেক চেষ্টা করেও এই বিষয়ে তাদের মুখ খোলানো যায়নি। রেজা তাই আজ রাতে হাতেনাতে ডালিয়াকে ধরতে চেয়েছিলেন। পুরোপুরি নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আবারো বাজিতে হেরে গেলেন। ভোরবেলা রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে তিনি থানায় ফিরতে না ফিরতেই শরিফুল কাঁচুমাচু মুখে বলল, স্যার, আমার টেকা?

.

১৯.

ডালিয়াকে থানায় ডেকে আনা হয়েছে। তার সঙ্গে এসেছেন লতিফুর রহমানও। রেজা সরাসরি কথায় চলে গেলেন, তুমি কি বুঝতে পেরেছো, তোমাকে কেন থানায় আনা হয়েছে?

ডালিয়া ডানে-বায়ে মাথা নাড়াল। তার মুখ নিচু। রেজা বললেন, লিখনকে খুনের দায়ে তোমাকে অ্যারেস্ট করা হচ্ছে!

ডালিয়া ঝট করে মাথা তুলে তাকাল, মানে?

মানে লিখনকে খুনের দায়ে তোমাকে আমরা গ্রেপ্তার করছি।

মুহূর্তেই যেন ডালিয়ার সলজ্জ, অপ্রতিভ, গুটিয়ে থাকা ভঙ্গিটা খসে পড়ল। সে স্পষ্ট গলায় বলল, এই আজগুবি কথা আপনি কোথায় পেয়েছেন?

রেজা হাসল, তুমি নিশ্চয়ই জানো যে হারাধন মুচি ওরফে আলাউদ্দিন হাজি মোবাশ্বেরসহ হাতেনাতে ধরা পড়েছে?

ডালিয়ার চোখে সামান্য কম্পন দেখা গেল। এমনিতেই তার চোখে-মুখে নিদ্রাহীনতার ছাপ। সম্ভবত শেষ কিছুদিন সে ঘুমায়নি। তারপরও যতটা সম্ভব নিষ্কম্প কণ্ঠেই সে বলল, তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী?

সেটা তুমি ভালো করেই জানো। হারাধন আমাদের সব বলেছে।

হারাধন কে?

রেজা হাসল। এই মুহূর্তে শরিফুল একটা ছোটখাটো ব্যাগ নিয়ে ঘরে ঢুকল। ব্যাগের ভেতর কিছু কাগজপত্র। অল্পকিছু জামাকাপড়। ব্যাগটা ডালিয়ার। সেদিকে তাকিয়ে রেজা বলল, তুমি রেডি হয়েই ছিলে, কিন্তু সুযোগ পাওনি, তাইতো?

ডালিয়া ঠাণ্ডা গলায় বলল, কীসের সুযোগ?

পালিয়ে যাওয়ার?

পালিয়ে যাব কেন আমি? কোথায় যাব?

রেজা আবারো হাসলেন, তুমি কিন্তু খুব সুন্দর করে কথা বলো ডালিয়া। সুন্দর, শুদ্ধ উচ্চারণ। ওই দিনের মতো অশুদ্ধ, আঞ্চলিক না।

ডালিয়া সামান্য থতমত খেয়ে গিয়ে বলল, আমি অনেকদিন ঢাকায় ছিলাম।

আর কোথায় কোথায় ছিলে?

আর কোথায় কোথায় ছিলাম মানে?

মানে আলাউদ্দিন হাজির সঙ্গে আর কোথায় কোথায় গিয়েছিলে তুমি?

আপনার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

রেজা টেবিলের ওপর একটা ছবি রাখল। ছবিটার সঙ্গে ডালিয়ার চেহারার মিল খুব স্পষ্ট না হলেও দুজন যে একই মানুষ তা বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না। রেজা বলল, এই মেয়েটাকে তুমি চেনো?

ডালিয়া ছবিটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আচমকা চুপ করে গেল। রেজা বলল, সেদিন পলাশবাড়ি বাজারে হারাধন মুচির দোকানে তোমাকে আমি দেখেছিলাম। তুমি পুরনো স্যান্ডেল সেলাই করতে বাজারে এসেছিলে। কী মনে করে আমি দূর থেকে মোবাইল ফোনেই তোমার কিছু ছবিও তুলেছিলাম। কাল ছবিগুলো ঢাকায় পাঠিয়েছিলাম ডিবি পুলিশের কাছে। তারা কিছুক্ষণ আগে আমাকে কনফার্ম করেছে, এর আগেও তোমার বিরুদ্ধে একাধিক অপরাধে যুক্ত থাকার প্রমাণ আছে। এই ছবিটিও তারা পাঠিয়েছে। শুধু তাই না, আমার তোলা তোমার ছবির এক কোণে ছোট্ট করে হারাধন মুচিকেও দেখা যাচ্ছিল। ঠিক এই হারাধন মুচিকেও ট্রেস করতে পেরেছে পুলিশ।

রেজা থেমে তার সামনের চায়ের কাপ থেকে পিরিচে চা ঢাললেন, তারপর এক চুমুকে পুরোটা চা খেয়ে নিয়ে আবার বললেন, একাধিক ইউনিভার্সিটি কলেজের সামনে মুচির দোকানের আড়ালে ইয়াবার বিজনেসও করেছে হারাধন। হয়তো এ কারণেই সে জুতো তৈরির কাজটা ভালোভাবেই শিখে গিয়েছিলো। অবশ্য কয়েকবার পুলিশের হাতে ধরাও পড়েছিল সে। কিন্তু টাকা পয়সা দিয়ে প্রতিবারই ছাড়া পেয়েছিল। আর এই ইয়াবা বিজনেস করতে গিয়েই তার সঙ্গে লিখনের পরিচয়। লিখনের সঙ্গে সেই সম্পর্কের সূত্র ধরেই পলাশবাড়িতেও ইয়াবা বিজনেস শুরুর কথা ভাবছিল সে। কিন্তু সেই ইয়াবার বিজনেসের বদলে হঠাৎ ব্যাংক ডাকাতির চিন্তাটা প্রথম কার মাথায়, কিভাবে এলো? তোমার?

ডালিয়া এই প্রশ্নেরও উত্তর দিল না। সে চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে রইল। রেজা বললেন, আমার ধারণা, হারাধন খুব দ্রুত বুঝে গিয়েছিল যে লিখন এখানে খুব প্রভাবশালী, কিন্তু একই সঙ্গে খানিক বোকাসোকাও সে। এখানে যে নতুন শহর গড়ে উঠছে, ইয়াবাসহ এমন আরো বিজনেস যে এখানে খুব সহজেই করা সম্ভব সেটাও সে কথায় কথায় জানিয়েছিল হারাধনকে। ব্যাংক, বীমা এইসব বড় বড় প্রতিষ্ঠানের কথাও। তাই না?

ডালিয়া অনেকক্ষণ পর কথা বলল, আমি আলাউদ্দিনের সঙ্গে কথা বলতে চাই। সে এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে, আর কিছু লুকিয়ে রেখে লাভ নেই।

ডালিয়ার চোখের দিকে চোখ রেখে রেজা ঠাণ্ডা গলায় বললেন, সে এখন আর কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।

এই প্রথম পুরোপুরি কেঁপে উঠল ডালিয়া, আপনারা তাকে কত মেরেছেন?

এখনো ততটা মারতে পারিনি, যতটা মারলে এই সব ঘটনায় সে তোমার নাম বলতে পারত, তোমার ইনভলভমেন্টের কথা বলতে বাধ্য হতো।

ডালিয়া ভেঙে পড়া গলায় বলল, ওকে আর মারবেন না প্লিজ, আমি সবকিছুই বলব।

রেজা এক চুমুকে চা-টা শেষ করে উৎসুক চোখে তাকালেন। ডালিয়া ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল, আমাকে লিখনের কথা আলাউদ্দিনই বলেছিল। আমি তখন একদিন লিখনের সঙ্গে দেখা করতে চাইলাম। সে তখন পলাশবাড়ির অনেক কথাই বলল আমাকে। আমি চাইছিলাম না আর এই ইয়াবা-টিয়াবা বা ছোট-খাটো ঝুঁকিপূর্ণ ঝামেলার মধ্যে থাকতে। আমি চাইছিলাম বড়োসড়ো কিছু একটা করে তারপর পুরোপুরি গা ঢাকা দিতে। সবকিছু শান্ত হয়ে গেলে দূরে কোথাও গিয়ে থিতু হতে চাইছিলাম। এই জীবন আর ভালো লাগছিল না আমার।

আলাউদ্দিন তোমার হাজবেন্ড?

ডালিয়া এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। সে বলল, তো ইয়াবার বিজনেসের জন্যই আলাউদ্দিন এখানে আসে। এর মধ্যেই আমি একদিন পত্রিকায় ব্যাংক ডাকাতির খবর পড়ি। বিষয়টা আমার খুব পছন্দ হয়ে গেল। আমি তখন আরো খোঁজখবর নেই। কীভাবে রাজশাহীতে, দিনাজপুরে মাটি খুঁড়ে ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে লোকগুলো প্রায় সফল হয়েও ধরা পড়ে গেল। আমি তখন থেকেই প্ল্যান করতে শুরু করলাম। তারপর ঘটনা জানালাম লিখনকে। এরপর এখানে যা যা করার দরকার তার সব ব্যবস্থা আসলে সে-ই করেছে। কনস্ট্রাকশনের জন্য আমাদের লোকজনকে লেবার হিসেবে এখানে আনা। কাজ পাইয়ে দেওয়া। আলাউদ্দিন আর মোবাশ্বেরকে দোকান দিয়ে দেয়া, সবই।

তাহলে? তাকে খুন করলে কেন তোমরা?

ডালিয়া আবারও চুপ করে রইল। রেজা বললেন, তুমি ভালো করেই জানো, এগুলো বের করা আমাদের জন্য এখন আর তেমন কোনো ব্যাপার না। হয়তো তুমি বা আলাউদ্দিন বলবে না। কিন্তু তোমাদের সঙ্গে আরো যারা আছে, তাদের সবার মুখ আটকে রাখা কিন্তু সম্ভব না! ইনফ্যাক্ট দেলোয়ার কিন্তু অনেক কিছু বলেছেও।

ডালিয়া ধীরে ধীরে আবার বলতে শুরু করল, লিখনের তখন নজর পড়ল আমার দিকে। আমার জীবনটা সে জাহান্নাম করে দিতে লাগল। একজন কনস্ট্রাকশন লেবারের মাধ্যমে প্রফেসর সাহেবের বাড়িতে আমার থাকার ব্যবস্থাও করে দিল সে। তখনো প্রফেসর সাহেবের বাড়িতে কনস্ট্রাকশন কাজ চলত। সে লেবারদের সঙ্গে নানা ছুঁতায় আসত। আর তখন আমাকেও যখন তখন তার সঙ্গে লেবারদের ঘরে যেতে হতো! সমস্যা শুরু হলো বাড়ির কাজ মোটামুটি শেষ হয়ে যাওয়ার পর। তখন আর অযথা ও বাড়িতে কারো ঢোকার সুযোগ ছিল না, আমারও বের হওয়ার সুযোগ ছিল না। এই সময়ে সে নানা হুমকিধামকি দিতো। আলাউদ্দিনের সঙ্গেও খুব বাজে ব্যবহার শুরু করল। কয়েকবার আলাউদ্দিনের গায়েও হাত তুললো সে। খুব বেপরোয়া আর খামখেয়ালি হয়ে উঠেছিল। আমাকে বলল এই বাড়ি থেকে বের হয়ে তার সঙ্গে গিয়ে থাকতে। তারপরও ব্যাংক লুটের পর টাকার ভাগ-বাটোয়ারা কেমন হবে, সেটা নিয়েও সে নানা ঝামেলা শুরু করেছিল। শেষের দিকে আর সহ্য করার মতো অবস্থা ছিল না। অথচ ততদিনে কাজও প্রায় শেষের দিকে।

ফলে খুন করা হলো তাকে? তা খুনটা কে করল আলাউদ্দিন?

ডালিয়া অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, নাহ।

তাহলে?

ডালিয়া জবাব দিল না। রেজা বললেন, তুমি?

ডালিয়া মাথা নিচু করে বসে রইল। রেজা বললেন, লিখনকে দেলোয়ারের সঙ্গে আলাউদ্দিন ওই বাড়িতে পাঠাল। কথা ছিল, তুমি লিখনের সঙ্গে জরুরি কথা বলবে, তাই না? বাড়ি ভাড়া নেয়ার কথা বলে তারা আসল। আর এই ফাঁকে লতিফুর রহমানকে নিচে ডেকে পাঠালে তুমি?

হুম। তার স্ত্রী চিৎকার চেঁচামেচি করছিল, আর ঠিক সেই মুহূর্তেই আমি ওপরে চলে গেলাম।

লিখন তোমাকে দেখে খুশি হয়ে গেল। আর তখুনি দেলোয়ার তাকে জাপটে ধরল, পেছন থেকে তুমি লিখনের গলায় তার পেঁচিয়ে ধরলে?

ডালিয়া মাথা নিচু করে রইল। রেজা আচমকা বললেন, লতিফুর রহমানের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কী ডালিয়া?

ডালিয়া এবারও কোনো কথা বলল না। সে চুপচাপ তার পায়ের নখের দিকে তাকিয়ে রইল।

.

সপ্তাহখানেক বাদে লতিফুর রহমানকে ডাকলেন রেজা। দীর্ঘসময় লতিফুর রহমানের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। তারপর হঠাৎ ঠাণ্ডা গলায় বললেন, বহু বছর আগে আপনার ছেলে সৈকত আপনাকে ছাদ থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল। সেই থেকে আপনি ডান পায়ে ঠিক মতো হাঁটতে পারেন না। এই কথা সত্য?

লতিফুর রহমান মাথা নিচু করে বসে রইলেন।

রেজা বললেন, আপনার ছেলে সৈকতের বিরুদ্ধে খুনের মামলাও হয়েছিল, রাইট?

শরিফুল বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইল। লতিফুর রহমান কোনো কথা বললেন না। রেজা বললেন, সৈকত কি আসলেই খুন করেছিল?

লতিফুর রহমান কম্পিত কণ্ঠে বললেন, নাহ!

রেজা ধুলোয় মলিন পুরনো একটি ফাইল বের করলেন, এই ফাইলটি চাইলে আপনি পড়ে দেখতে পারেন। আজ থেকে প্রায় ষোলো বছর আগে তার নামে একটা খুনের মামলা হয়েছিল। কিন্তু আগেভাগেই দেশ থেকে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছিল সে। ফলে পরে আর কখনো দেশে ফিরতে পারেনি।

রেজা লতিফুর রহমানের মুখের কাছে মুখ নিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বললেন, আপনাকে ছাদ থেকে কেন ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল সে?

লতিফুর রহমান চুপ করেই রইলেন। রেজা উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। বাইরে ঝকঝকে নীল আকাশ। মৃদু হাওয়া বইছে। বিস্তীর্ণ জলরাশির বুকে মৃদু ঢেউ। তিনি সেই জলরাশির দিকে তাকিয়ে বললেন, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে আমি সৈকতের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছি। এ কদিনে বেশ কয়েকবার তার সঙ্গে আমার ফোনে কথাও হয়েছে। রেজা জানালার কাছ থেকে সরে এসে লতিফুর রহমানের দিকে ফিরে তাকালেন, বুঝতেই পারছেন, কিছু না জেনে শুনে আপনাকে ডাকিনি আমি। আন্দাজে এতবড় ঢিল ছোঁড়ার মানুষও আমি নই।

লতিফুর রহমান মুখ তুলে তাকালেন। তার শরীর ঘামছে। সামান্য কাঁপছেও। তবে কিছু বললেন না তিনি। রেজা বললেন, আপনার বাসায় কাজের মেয়েরা থাকে না, এ কথা কি সত্যি?

লতিফুর রহমান যেন কথা বলার সুযোগ পেলেন হ্যাঁ, সত্যি।

কেন?

জানেনইতো, আমার স্ত্রী খুব অসুস্থ। এক ধরনের সিজোফ্রেনিয়াতে ভুগছে। সে। যখন-তখন যার তার সঙ্গে যাচ্ছেতাই আচরণ করে। এ কারণে কেউই তাকে সহ্য করতে পারে না। কাজের মেয়েগুলোও না। ফলে আসার কিছুদিন পর আর কেউই থাকতে চায় না।

আচ্ছা। কিন্তু একটা ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট কিন্তু আছে।

লতিফুর রহমান উৎসুক চোখে তাকালেন। রেজা বললেন, কেউ থাকে না, অথচ ডালিয়া এতদিন আপনার বাসায় রইল! বিষয়টা কেমন না? আপনার স্ত্রীর এমন ভয়াবহ আচরণ, অত্যাচার, দুর্ব্যবহার সহ্য করেও?

প্রশ্নটা শুনে লতিফুর রহমান যেন খানিক সপ্রতিভ হলেন। তিনি বললেন, সেটাতো এখন পরিষ্কার হয়েই গেছে। তার একটা সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ছিল। ব্যাংক ডাকাতি। সেটা শেষ না করে সে যাবে কী করে!

রেজা মৃদু হাসলেন, উদ্দেশ্য থাকলেও আপনার বাড়িতেই থাকতে হবে, এমনতো কোনো কথা ছিল না। ছিল?

লতিফুর রহমান জবাব দিলেন না। রেজা বললেন, দিনের পর দিন আপনার স্ত্রীর অমন ভয়ানক দুর্ব্যবহার সহ্য করেও সে কেন আপনার বাড়িতেই থাকতে যাবে? চাইলেইতো সে এখানে অন্য কোনো বাড়িতেও থাকতে পারত। পারত না?

লতিফুর রহমান দ্বিধাগ্রস্ত ভঙ্গিতে বললেন, হুম, তা পারত।

তাহলে?

এই প্রশ্নের উত্তর লতিফুর রহমানের কাছে নেই। রেজা আচমকা কথাটা বললেন, ডালিয়ার প্রতি আপনার আচরণ কেমন ছিল?

আমার!

হুম, আপনার। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত আপনি মেয়েটাকে উত্ত্যক্ত করেছেন। তারপরও মেয়েটা দাঁতে দাঁত চেপে এতটা দিন আপনার বাড়িতেই কেন পড়ে থাকল স্যার? অন্য কোথাও কেন চলে গেল না? এতকিছু ভেবেছেন আর এইটুকু ভাবেননি?

লতিফুর রহমান এবার সত্যি সত্যিই বিভ্রান্ত বোধ করছেন। রেজা বললেন, কারণ সব কাজ শেষে সে আপনাকে খুন করতে চেয়েছিল।

আমাকে! খুন! লতিফুর রহমান রীতিমতো আঁতকে উঠলেন। তার চোখজোড়া যেন কোটর ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে চাইছে।

হুম। খুন। ঠিক চলে যাওয়ার আগে।

কেন?

কারণ আপনার ছেলে সৈকত আপনাকে খুন করার জন্য মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েছিল আলাউদ্দিন হাজি ওরফে হারাধন মুচিকে।

লতিফুর রহমানের মুখ হা হয়ে গেছে। রেজা বললেন, বহুদিন থেকেই এই সুযোগটা খুঁজছিল সৈকত। নানাভাবে নানা লোকের সঙ্গে খোঁজখবরও রাখছিল। কিন্তু জুতসই কাউকে পাচ্ছিল না। অবশেষে, একজনের মাধ্যমে আলাউদ্দিনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ হয় সৈকতের। কাজটা করতে রাজি হয় সে।

শরিফুল নিজেকে আর নিবৃত রাখতে পারল না। সে হঠাৎ বলে উঠল, নিজের বাপকে খুন করতে লোক ভাড়া করেছে সে? কী বলছেন স্যার! সৈকত নিজে আপনাকে এ কথা বলেছে?

সে একাই যে পুরোটা বলেছে তা না। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বের হয় শোনোনি? তাই হয়েছে। আলাউদ্দিন, ডালিয়া, সৈকত, এই তিনজনের সঙ্গে আলাদা আলাদা কথা বলতে গিয়েই এই ঘটনা বেরিয়ে এসেছে। সৈকতের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া খুনের মামলাটা তখন আমি আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। মামলাটা করেছিল লতিফুর রহমানের কলেজের দপ্তরি।

দপ্তরি! কেন?

কারণ তার মেয়েকেই খুন করেছিল সৈকত।

সৈকত সত্যিই খুন করেছিল?

হুম।

কেন?

কারণ মেয়েটিকে ভালোবাসত সে।

ভালোবাসতো বলে খুন করেছিল?

হুম।

কিছুই বুঝতে পারছি না স্যার।

রেজা তার পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে টেবিলের ওপর রাখলেন। তারপর একটি ফোন কল রেকর্ড লাউড স্পিকারে ছেড়ে দিলেন। সৈকতের সঙ্গে তার কথোপকথন শোনা যাচ্ছে। কথোপকথনের এক জায়গায় এসে রেজা সৈকতকে জিজ্ঞেস করেছেন, তার মানে আপনার নামে হওয়া মার্ডার কেসটা মিথ্যে না?

পুরোপুরি সত্যিও নয়।

মানে?

ওপারে কোনো শব্দ নেই। একটা বিদঘুঁটে একঘেয়ে নিস্তব্ধতা। সৈকত সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না, সে ঘটনাটি খুলে বলবে কী না! অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে অবশেষে সে সিদ্ধান্ত নিল বলার। বলল, ভেবেছিলাম আলাউদ্দিন হাজি কাজটা ঠিকঠাক শেষ করতে পারবে। এ জন্যই একবারের জন্য হলেও বাড়ি আসতে চেয়েছিলাম আমি। যদি কোনোভাবে মাকে একবার দেখতে পেতাম! যদি তাকে একবার এখানে নিয়ে আসা যেত! কিন্তু যেহেতু আলাউদ্দিন কাজটা করতে পারল না। সেহেতু আর কখনোই হয়তো দেশে ফেরা হবে না আমার। আর দেশে যেহেতু ফেরা হবে না, সেক্ষেত্রে বলতেও আর দ্বিধা নেই।

রেকর্ডে আবার নীরবতা। যেন নিজেকে সামলে নিচ্ছে সৈকত। খানিক সময় নিয়ে তারপর আবার বলল সে, আমার জন্মের সময়ই মায়ের কিছু শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। তার জরায়ুও ফেলে দিতে হয়। সঙ্গে আরো নানা সমস্যায় মায়ের এক ধরনের প্রচণ্ড মানসিক ও শারীরিক স্ট্রেস শুরু হয়। প্রচণ্ডরকম নিস্পৃহ হয়ে যান তিনি। ধীরে ধীরে বাবার সঙ্গে তার স্বামী-স্ত্রীর স্বাভাবিক সম্পর্কটা আর রইল না। তখন থেকেই বিষয়টার শুরু। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, বাসায় কাজের মেয়ে এলে বেশিদিন থাকে না। এই নিয়ে বাবা আর মায়ের মধ্যে নানা সময় কথা কাটাকাটি, ঝগড়াঝাটিও দেখেছি। শেষের দিকে এসে মা কিছু বললেই বাবা। মারতেন।

সৈকত আবার থামল। তার গলা ভেজা। কেশে গলার শ্লেষ্ম পরিস্কার করল সে। তারপর বলল, কলেজ থেকেও বাবার নামে কিছু অভিযোগ আসে। যদিও তার কোনো প্রমাণ ছিল না। কিন্তু যত বড় হতে থাকি, চারপাশ থেকে একটা ফিসফিসানি টের পেতাম। বাবাকে নিয়ে আজেবাজে কথা। এমনকি আমার বন্ধুরাও বলত। অনেকে এড়িয়েও চলত। সেই থেকে বাবার ওপর নজর রাখতে শুরু করি। শিউলির ঘটনাটা ঘটে তখনই। দপ্তরী চাচার মেয়ে শিউলি। আমাদের বাড়িতে আসত। ওকে দেখলেই একটা কেমন অনুভূতি হতো আমার। কথা বলার সুযোগ খুঁজতাম। কিন্তু পেতাম না। সবসময় বাবার সঙ্গে লেগে থাকত সে। রোজ বিকেলের দিকে ছাদে শিউলিকে পড়াতেন বাবা। বাংলা ব্যাকরণ। একদিন সন্ধ্যাবেলা ছাদে গিয়েছি। আর তখনই দেখলাম দৃশ্যটা…।

সৈকতের গলা জড়িয়ে আসছে যেন। সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ছাদে কার্নিশ ছিল না। একদম শেষ প্রান্তে বাবা একটা চেয়ারে বসে আছেন। আর শিউলি তার কোলে বসা। তারপরেরটুকু আর বলতে পারব না আমি। দৌড়ে গিয়ে এক ধাক্কায় চেয়ারটা ফেলে দিলাম। তিনতলার ছাদ। শিউলির মাথাটা থেঁতলে গিয়েছিল নিচে পড়ে। কিন্তু বাবার তেমন কিছু হয়নি। ওই পাটাই যা একটু জখম হয়েছিলো!।

রেজা রেকর্ডটা বন্ধ করে দিল। পুরো ঘরে পিনপতন নীরবতা। কেউ কোনো কথা বলছে না। শরিফুল চোখ তুলে তাকাল। রেজা বললেন, মামলাটা হয় আরো বেশ কিছুদিন পরে। কিন্তু সেই সন্ধ্যায়ই বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় সৈকত। তার খোঁজ মেলে বহু বহু বছর পর। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আলাউদ্দিন হাজি ওরফে হারাধন মুচি যে পলাশবাড়িতে আসে এবং লিখনের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাও ঘটনাচক্রে নয়। সৈকতের কাছ থেকে টাকা পেয়েই সে পলাশবাড়িতে যাতায়াত শুরু করে। লতিফুর রহমান সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়ার জন্য। আর তখনই লিখনের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। কথাবার্তার একপর্যায়ে ঘটনা ডালিয়াকে খুলে বলে আলাউদ্দিন। আর তখনই ব্যাংক ডাকাতির আইডিয়াটা দেয় ডালিয়া। সেক্ষেত্রে : লতিফুর রহমানের বাড়িটাকেই তার আশ্রয় হিসেবে বেছে নেয় সে। যাতে ব্যাংক ডাকাতির কাজটা শেষ হওয়ার পর পালিয়ে যাওয়ার আগে আগে সৈকতের কাজটাও শেষ করে যেতে পারে। লতিফুর রহমানের বাড়িতে থাকার কারণে বিষয়টা তখন খুব সহজ হয়ে যাবে তার জন্য।

রেজা থামলেন। তবে পুরো ঘরে কেউ আর কোনো কথা বলল না। রেজা তার পকেট থেকে কতগুলো ব্যবহৃত ওষুধের খালি প্যাকেট বের করে টেবিলের ওপর রাখলেন। তারপর লতিফুর রহমানকে বললেন, এই প্যাকেটগুলো চেনেন, স্যার?

লতিফুর চোখ তুলে তাকালেন। মুহূর্তের মধ্যে তার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। রেজা বললেন, বছরের পর বছর নিজের স্ত্রীকে এই উচ্চমাত্রার সিডেটিভগুলো দিয়ে অসুস্থ করে রেখেছেন আপনি। যাতে ওই অসুস্থ মানুষটির কোনো অভিযোগই কেউ বিশ্বাস না করে। তাই না স্যার?

লতিফুর রহমান কথা বললেন না। তার মাথাটা ঝুলে পড়েছে কোলের ওপর।

.

২০.

বাঁধ কাটার জন্য গোলাম মাওলার বিরুদ্ধে কোনো মামলা হলো না। ওপর মহল থেকে নিষেধ করে দেয়া হয়েছে মামলার বিষয়ে। তবে পুরো ঘটনায় তার ওপর প্রচণ্ডরকম ক্ষুব্ধ হয়েছে দলের নীতি নির্ধারকরা। তার রাজনৈতির উচ্চাভিলাষও বড়সড় ধাক্কা খেয়েছে। আপাতত আর কোনো সম্ভাবনা নেই তার। লিখন খুনের ঘটনায় ডালিয়া, আলাউদ্দিন হাজি ও মোবাশ্বেরসহ ছয় জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। লতিফুর রহমানের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো অভিযোগ দায়ের করা না হলেও সবচেয়ে বড় শাস্তিটা তিনি পেয়েই গেলেন। এই পলাশবাড়িতে তার এতদিনকার স্বচ্ছ ভাবমূর্তিটা যেন নিমেষেই উধাও হয়ে গেল। তার নানা কুৎসিত ঘটনা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। সেসবের কিছু যেমন সত্য, তেমনি মিথ্যেও কম নয়। পুরো ঘটনায় রীতিমতো ভেঙে পড়লেন লতিফুর রহমান। বাড়ি থেকেই আর বের হতে পারলেন না। উপরন্তু পুলিশের মামলার ভয়ও রয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে এই বয়সে এসে এত মানসিক চাপ আর নিতে পারলেন না তিনি। এক সকালে তাকে মৃত পাওয়া গেল বিছানায়। ঘটনা আত্মহত্যা নাকি স্বাভাবিক মৃত্যু, তখনো নিশ্চিত হতে পারল না পুলিশ।

রেজা অবশ্য বিষয়টি নিয়ে আর চাপ নিতে চান না। এর মধ্যেই থানার ওসি সাহেব কাজে যোগ দিয়েছেন। ফলে কিছুটা হলেও যেন চাপমুক্ত বোধ করছেন তিনি। পুলিশ সুপার থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন প্রায় সকলেই দারুণ খুশি তার ওপর। এই মুহূর্তে মানসিক প্রশান্তির জন্য কিছুদিনের জন্য হলেও ছুটি দরকার তার। ছুটিটা পেয়েও গেলেন রেজা। এমন করে এর আগে আর কখনো বাড়ি যাওয়ার জন্য অস্থির লাগেনি তার। ছুটি পাওয়ার পরদিনই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন তিনি। তবে তার আগে দেখা করতে গেলেন গোলাম মাওলার সঙ্গে। রেজাকে দেখে গোলাম মাওলা খানিকটা অবাকই হলেন। সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে তার আদর আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। রেজা অবশ্য স্বাভাবিকভাবেই বললেন, এত ব্যস্ত হবেন না ভাই। আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারব না।

তা বললে কী আর হবে রেজা সাহেব? আজ না বেড়িয়ে যেতেই পারবেন না।

রেজা মৃদু হাসল, আজ একটু তাড়া আছে। একটা সামান্য দরকারে এসেছিলাম ভাই।

গোলাম মাওলা হাসি হাসি মুখে বললেন, আমি বুঝতে পেরেছি। ওই মাসিক খামটার ব্যাপারত?

রেজা মাথা নাড়ালেন, জি।

চিন্তা করবেন না। ওটা রেডিই আছে। আমি এক্ষুণি নিয়ে আসছি।

রেজা তাকে নিরস্ত করলেন, উঁহু। আপনাকে আনতে হবে না। আপনি বসুন।.

না না, ভাই সাহেব। তা হবে না। আপনাকে নিতেই হবে। আচ্ছা, একটা কথা বলেনতো রেজা সাহেব। অতো অল্প কটা টাকা দিয়ে আপনার কী হয়? আপনি চাইলে কিন্তু আমি আরো…।

রেজা মাঝপথে থামিয়ে দিলেন গোলাম মাওলাকে। তারপর বললেন, আমি আজ নিতে আসিনি, দিতে এসেছি।

মানে! অবাক ভঙ্গিতে বললেন গোলাম মাওলা।

মানে আমি আর আপনার কাছ থেকে এই টাকাটা নিতে পারব না।

কী বলছেন? কেন?

কারণ ওই প্রতিবন্ধী শিশুগুলোর জন্য যে স্কুলটা আমার মা চালান, ওখানে মা তাদের কাছ থেকেই সাহায্য নিতে চান, যেই মানুষগুলো মানুষ হিসেবে অন্তত কিছুটা হলেও ভালো।

আমি কিন্তু খারাপ মানুষ না ভাই…

গোলাম মাওলাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে রেজা বললেন, স্রেফ নির্বাচনে নমিনেশন পাওয়ার জন্য আপনি যে কাজটা করেছিলেন, সেটা কত ভয়াবহ অপরাধ আপনি তা জানেন না? ওই বাঁধটার সঙ্গে কত হাজার হাজার মানুষের জীবন জীবিকা, বাঁচা-মরা জড়িয়ে আছে আপনি জানেন না?

গোলাম মাওলা এবার আর জবাব দিলেন না। রেজা তার পকেট থেকে তিনখানা খাম বের করে গোলাম মাওলার সামনে রাখলেন। গত তিন মাসে এই খাম তিনখানাই মাসিক ডোনেশন হিসেবে গোলাম মাওলা দিয়েছিলেন। গোলাম মাওলা আরো কিছু বলতে চাইছিলেন, কিন্তু সেই সুযোগটা আর দিলেন না রেজা। তিনি উঠে ধীর পদক্ষেপে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

.

ছোট্ট এক মফস্বল শহর। শহরের এক প্রান্তে টিনের দোচালা ছোট্ট এক স্কুল ঘর। স্কুলের সামনে এক চিলতে মাঠ। মাঠে রংবেরঙের জামা পরে এলোমেলো ভঙ্গিতে ছুটে চলছে অনেকগুলো শিশু। দূরে একটা চেয়ারে বসে আছেন রেহানা আখতার। তার মুখ ঝলমল করছে আনন্দে। বাচ্চাগুলোর মাঝখানে পরির মতো সুন্দর একটা মেয়ে। মেয়েটার নাম অণু। বাচ্চাগুলোর সঙ্গে এই রোদে ছোটাছুটি করতে গিয়ে তার ঠোঁটের কোণে ঘাম জমেছে। শাড়ির আঁচল আলুথালু হয়ে হাওয়ায় উড়ছে। রেজা দাঁড়িয়ে আছে গেটের বাইরে। এখনো তাকে কেউ দেখেনি। তার খুব ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে ওই মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু তিনি পারছেন না। এ জীবনে কখনো পারবেন বলেও তার মনে হয় না। কী এক অদ্ভুত লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে আছে তার সারা শরীর। তিনি সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে আছেন। শিশুগুলোকে হঠাৎ তার রঙিন পাখাওয়ালা প্রজাপতি মনে হতে লাগল। আর অণু হলো সবচেয়ে বড় প্রজাপতিটা। রেজা গেটের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। মুহূর্তেই সচকিত হয়ে গেল প্রতিটি চোখ। এতক্ষণের অকপট উজ্জ্বলতা আচমকা থমকে গেল। তারপর ঝলমল করে উঠল শিশুগুলো। জলোচ্ছ্বাসের জলের মতো তারা ছুটে আসতে থাকল রেজার দিকে। পেছন থেকে তাকিয়ে আছে অনু। অনুর চোখজুড়ে আনন্দ। তার পেছনে মা। মা হাসছেন। রেজার আচমকা মনে হলো, রোজকার ভানের পৃথিবীতে, ছদ্মবেশী অসংখ্য মানুষের ভিড়ে এমন একটা পৃথিবী খুব দরকার। এমন ভানহীন, অকপট, আনন্দময়।

(সমাপ্ত)

No comments