মধুকর সংবাদ – মনোজ সেন


দিব্যি সাংবাদিকদের ঘরে বসে আড্ডা দিচ্ছিলুম। হঠাৎ ধনঞ্জয় এসে বলল, ‘অ্যাই টেকো, তোকে এডিটর ডাকছেন। ভেরি আর্জেন্ট।’

আমাকে টেকো বললে আমার ভীষণ রাগ হয়। তেড়েফুঁড়ে উঠে ধনঞ্জয়কে গালাগাল দিতে যাচ্ছিলুম, সে বলল, ‘এক্ষুনি যা, দেরি করলে চাকরি নট।’

ঘরে ঢুকে দেখি সেখানে ‘প্রত্যুষ’ কাগজের সম্পাদক সনৎ ঘোষ আর মালিক নটবর নন্দী দু-জনেই উপস্থিত।

সনৎ ঘোষ বললেন, ‘শোনো কালিদাস, তোমাকে একটা অত্যন্ত গোপন আর ভীষণ জরুরি কাজে ডেকে পাঠিয়েছি। এখানে যা কথা হবে তা নিয়ে কারোর সঙ্গে আলোচনা করবে না। কারণ যে কাজে তোমাকে পাঠাচ্ছি, তার কথা আগেভাগে আমাদের শত্রুপক্ষ জানতে পারলে তোমার বিপদ হতে পারে।’

আমি ঢোঁক গিলে বলুলম, ‘কাজটা কী?’

‘বলছি। তার আগে নটবরদা তোমাকে কিছু বলবেন।’

এবার নটবর নন্দী শুরু করলেন, ‘দ্যাখো কালি, তুমি তো জানো আমাদের কাগজের অবস্থা এখন অত্যন্ত খারাপ। পাঠকরা সবাই অন্য কাগজগুলোর দিকে ঝুঁকছে। কাজেই, এই কাগজটাকে যদি বাঁচাতে হয়, তাহলে আমাদের এমন একটা উত্তেজনাকর কিছু করতে হবে, যেটা আমাদের টিকে থাকা পাঠকরাই শুধু খাবে তাই নয়, অন্য কাগজের পাঠকরাও দলে দলে ফিরে আসবে।’

আমি ক্ষীণকণ্ঠে বললুম, ‘কী করতে হবে?’

উত্তর দিলেন সনৎ ঘোষ। বললেন, ‘অনেক ভেবে আমরা প্ল্যান স্থির করেছি। শোনো, তুমি নিশ্চয়ই মধুকর রাও-এর নাম শুনেছ। এর ব্যাপারে তুমি কী জানো?’

বললুম, ‘মধুকর রাওকে নিয়ে তো সারা ভারতবর্ষে তোলপাড় চলেছে। সে শুনেছি একজন নমস্য লোক— ডাকাত, খুনি, জালিয়াত, স্মাগলার কী নয়।’

‘আহা, সে তো সবাই জানে। তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কিছু জানো?’

‘ভয়ানক মারাত্মক লোক। যেমন বদরাগী, তেমনি মারকুটে। সরকারি মতে সে আজ পর্যন্ত আঠাশটা খুন করেছে, বেসরকারি মতে সেটা এক-শো আঠাশ। সে একাই কাজ করে, তার কোনো দলবল নেই আর এইভাবেই সে সারা ভারতবর্ষের সর্বত্র আতঙ্ক ছড়িয়ে চলেছে। কেবল, যখন সে ব্যাঙ্ক ডাকাতি বা অন্য কোনো বড়ো ধরনের অপরাধ করতে যায়, তখন স্থানীয় ক্রিমিনালদের সাহায্য নেয় বখরার বিনিময়ে। তারপর ছায়ার মতো বাতাসে মিলিয়ে যায়। কোথাও কোনো প্রমাণ রেখে যায় না, তাই কোনো প্রদেশের পুলিশই তার কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারেনি।’

‘কিছুদিন আগে মুম্বাই শহরে স্বর্ণকমল বলে সোনার গয়নার দোকানে তার অপারেশনের কথা পড়েছ?’

‘হ্যাঁ, আমাদের কাগজেই পড়েছি। মধুকর না কি দোকানে ঢুকে শুধু ঘোষণা করেছে যে ”আই অ্যাম মধুকর রাও” আর অমনি সবাই হুড়মুড় করে হয় মাটিতে শুয়ে পড়েছে নয়তো টেবলের তলায় গিয়ে সেঁধিয়েছে। মধুকর তখন গুনগুন করে ”ছোটাসা ঘর হোগা বাদলোঁ কি ছাও মে” গাইতে গাইতে সব টাকাপয়সা হাতিয়ে কেটে পড়েছে। আবার মুখে না কি রাজ কাপুরের মুখোশ পরে এসেছিল।’

‘সে কোথাকার লোক জানো?’

‘এক একজন এক এক কথা বলে, সঠিক বোধ হয় মধুকর ছাড়া কেউই জানে না। তবে, বেশিরভাগ লোকই মনে করে যে সে মহারাষ্ট্রের লোক। নামটাই তো ওইরকম।’

মাথা নেড়ে নটবর বললেন, ‘মহারাষ্ট্র না হাতি। সে বাঙালি, আমাদের বর্ধমানে বাড়ি। তার বাবার নাম চিন্তামণি রায়, ছিলেন সাউথ-ইস্টার্ন রেলের গার্ড। একবার ট্রেনে যেতে যেতে দেখলেন ছেলে পাঁচু ইশকুল পালিয়ে লাইনের পাশে তেঁতুল গাছের তলায় বসে গোটা তিনেক বন্ধুর সঙ্গে গাঁজা খাচ্ছে। দু-দিন পরে বাড়ি ফিরে এসে নারকোল গামড়া দিয়ে ছেলেকে এমন পেটালেন যে ডাক্তারখানা থেকে ফিরেই সে ছেলে একেবারে ভাগলবা। আর ফিরে আসেনি। তাতে তার মা খুব কান্নাকাটি করেছিলেন ঠিকই, তবে, পাড়ার সমস্ত লোক স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বেঁচেছিল। সেই বিশ্ববাঁদর ছেলেটাই আজ নাম ভাঁড়িয়ে মধুকর রাও হয়েছে।’

আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, ‘আপনি এত খবর জানলেন কী করে?’

নটবর গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘হেঃ হেঃ, তোমাদের মতো ওঁছা সাংবাদিক তো নই। তাই আমি এমন অনেক খবর জানি যা তোমরা কস্মিনকালেও জানতে পারবে না।’

আমি বিনয়ে বিগলিত হয়ে বললুম, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, তা তো বটেই। তা হলেও যদি একটু বলেন।’

‘আসলে ওই ব্যাটা পাঁচুগোপাল আমার পাড়ার ছেলে। রেল কলোনির পাশেই আমাদের বাড়ি ছিল তো।’

‘কিন্তু পাঁচুগোপালই যে মধুকর রাও সেটা জানলেন কী করে?’

‘কী করে? সেদিন কাগজে বেরিয়েছে দেখলুম যে মধুকর রাও কখনো টাকমাথা লোকেদের মারে না। যাদের মাথা ভরতি চুল, কেবল তাদের দেখলেই সে খেপে যায়। টেকোদের ওপরে তার কেমন একটা দুর্বলতা আছে। এটা পড়েই মনে হল যে এ তাহলে আমাদের হারিয়ে যাওয়া পাঁচুগোপাল ছাড়া কেউ হতে পারে না, কারণ তার বংশটাই টেকো বংশ। তার বাবা, মামা, বড়দা, সেজো পিসেমশাই সক্কলের মাথা জোড়া টাক। তা, অ্যাদ্দিনে তার মাথাতেও যে ওইরকম একটি জুড়ে বসেছে, তাতে তো সন্দেহ নেই। কাজেই, তার দুর্বলতা হবে না তো কার হবে? সে যাকগে, এবার কাজের কথায় এসো। তোমাকে যে কাজের জন্য ডেকে পাঠিয়েছি তা হল তোমাকে যেভাবেই হোক, এই মধুকর রাওকে আমাদের অফিসে ধরে আনতে হবে।’

আমি পড়ে যেতে যেতে কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললুম, ‘সে কী? এ তো অসম্ভব কাজ। সারা ভারতবর্ষের গোয়েন্দারা যা পারেনি, সে কাজ আমি কী করে করব? একটা ছায়াকে কি ধরা যায়?’

‘ধরতেই হবে। ইচ্ছে থাকলে সব কিছু করা যায়।’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, তা তো বটেই। তবে কি না গোয়েন্দারা—’

‘ধুত্তোর গোয়েন্দা! গোয়েন্দারাই সব পারে আর সাংবাদিকরা পারে না?’

‘আচ্ছা, এই মধুকর রাওকেই বা ধরে আনতে হবে কেন? তার জায়গায় কোনো ছোটোখাটো চোরছ্যাঁচোড় ধরলে হয় না।’

‘না, হয় না। গবেটের মতো কথা বোলো না তো। তোমাকে তো বলেইছি যে আমাদের কাগজকে যদি বাঁচাতে হয়, তা হলে ভয়ানক চাঞ্চল্যকর কিছু করতেই হবে। তা, এর চেয়ে বেশি চাঞ্চল্যকর আর কিছু হতে পারে? ভেবে দ্যাখো দেখি, আজকে সারা দেশে রোজ মধুকর রাও-এর কীর্তিকলাপের কথা কাগজে বেরুচ্ছে, ঘরে বাইরে তার কথা আলোচনা হচ্ছে। এ অবস্থায়, হজুগে বাঙালি যখন জানবে যে সেই ভয়ংকর বিভীষকা আসলে বঙ্গসন্তান, আমাদেরই ঘরের ছেলে পাঁচুগোপাল রায়, তখন সে ঘরে ফিরে এলে কী প্রচণ্ড হুজ্জুতিটাই না হবে। তার জীবন নিয়ে সিনেমা তোলা হবে, চাই কী গোটা দুয়েক উপন্যাসও লেখা হয়ে যেতে পারে। আর তাকে জনসমক্ষে হাজির করবার জন্য আমাদের কাগজের কাটতি কী ভীষণ হু-হু করে বেড়ে যাবে। উফ! আমি এর চেয়ে আর বেশি কিছু ভাবতে পারছি না, আপাতত।’

‘সে ঠিক আছে, আর ভেবে কাজ নেই। তবে কিনা তাকে এখানে নিয়ে এলেই তো তাকে পুলিশ ক্যাঁক করে ধরে শ্রীঘরে ঢুকিয়ে দেবে। তাকে নিয়ে মাতামাতির আগেই তো ফাঁসি হয়ে যেতে পারে।’

‘ছাই হয়ে যেতে পারে! তোমার যেমন বুদ্ধি! পুলিশ ধরলেই হল? কীভাবে ধরবে শুনি? তার ক্রাইমগুলো তো সবই ধোঁয়াটে, সেগুলোর কোনো প্রমাণ আছে? তাকে কেউ দেখেছে না তার আঙুলের ছাপ কোথাও পাওয়া গেছে। কাজেই ওসব তোমাকে ভাবতে হবে না। কালই বেরিয়ে পড়ো।’

‘বেরিয়ে তো পড়ব, বেঁচে ফিরব কী?’

‘খুব ফিরবে। বললুম না, পাঁচুগোপাল কক্ষনো টেকো লোকেদের গায়ে হাত দেয় না? নইলে, তোমার মতো একটা আকাট অপদার্থকে এমন একটা যুগান্তকারী কাজের ভার দিচ্ছি কী সাধে?’

‘টাকাপয়সা? মানে, ঘোরাঘুরি করতে তো খরচপাতি আছে।’

‘গণেশের কাছে কিছু টাকা রেখেছি, নিয়ে নাওগে যাও। এর বেশি আর কিন্তু কিছু পাবে না।’

সন্ধ্যে বেলা নটবরবাবুর বাড়ি গেলুম মধুকর বা পাঁচুর ব্যাপারে আরও কিছু খোঁজখবর তাঁর কাছে আছে কিনা সেটা জানবার জন্য।

জানা গেল অনেক কিছুই।

প্রথমত, চিন্তামণি রায় এমনিতে বেশ ভালেমানুষই ছিলেন; কিন্তু রেগে গেলে একেবারে ক্ষিপ্ত হয়ে পড়তেন, ফলে ছেলেদের যখন ঠ্যাঙাতেন তখন তার আর মাত্রা রাখতে পারতেন না। তাঁর সেই চণ্ডাল রাগের কিছুটা তাঁর ছেলেরাও পেয়েছিল।

দ্বিতীয়ত, পাঁচুগোপালের ছোটোমামা উমাকান্তর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল সবচেয়ে বেশি। দু-জনে প্রায় সমবয়সি। তারা অভিন্নহৃদয় বন্ধু ছিল আর এই উমাকান্তই তাকে গাঁজা খেতে শিখিয়েছিল। পরে, উমাকান্ত বড়ো হয়ে রেলের ওয়াগান ব্রেকার হয়েছিল। জেলও খেটেছিল অনেক দিন। খালাস পেয়ে গেরুয়া পরে সন্ন্যাসী হয়ে কলকাতার কাছেই পটলতলা গ্রামে আশ্রম খুলে বসেছিল। অনেক শিষ্য-শিষ্যাও হয়েছিল। সম্ভবত, সে এখনও সেখানেই আছে।

তৃতীয়ত, পাঁচুর গুষ্টিসুদ্ধু লোক বেঁটে আর গোলগাল। কাজেই, আশা করা যেতে পারে যে পাঁচুর ফিগারটাও ওইরকমই হবে।

চতুর্থত, পাঁচুর বাবা, মা, মামারা, জ্যাঠারা, সবাই ডায়াবেটিক। অতএব, সে-ও যে ব্লাডসুগারের রুগি হবে, তাতে কোনো সন্দেহই থাকতে পারে না।

এই ক-টাই প্রধান, এ ছাড়া আরও অনেক কিছু জানা গেল পাঁচুগোপালের বিষয়ে।

এইসব খবরগুলোকে সম্বল করে খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার মতো মধুকর রাও ওরফে পাঁচুগোপাল রায় নামক একটি গোলগাল টাকমাথা ডায়াবেটিক অত্যন্ত বিপজ্জনক খুনে ডাকাতকে এক-শো কোটি লোকের ভেতর থেকে খুঁজে বের করতে হবে। সুন্দর কাজ। আমি ছাড়া আর কার কপালে এমন একটি কাজ জুটবে? তবে, করতে তো হবেই। যদিও জানি, এগোলে রামে মারবে আর পেছোলে রাবণে মারবে, তবু করতেই হবে। যা হওয়ার হবে।

ভেবেছিলুম, পটলতলায় একবার যাব কি না। ওখানে গেলে কোনো লাভ হবে বলে মনে হল না। স্বামী ছোটোমামানন্দজি একজন নামকাটা সেপাই, এখন অবসরপ্রাপ্ত ক্রিমিনাল। তিনি তাঁর ভাগনের কোনো খবর জানলেও সেটা একজন সাংবাদিককে গড়গড় করে বলে দেবেন, তা তো মনে হয় না। উলটে তাকে সাবধানই করে দেবেন। ফলে, ব্যাপারটার যেটুকু গোপনীয়তা আছে, সেটুকুও লোপাট হয়ে যাবে। তখন আমি ভাগনেকে খুঁজব কী, সে-ই বন্দুক বগলে আমাকে খুঁজতে বেরোবে। সেটা মোটেই আমার পক্ষে স্বাস্থ্যকর হবে না।

অতএব, চলে গেলুম বর্ধমান। সেখানে আমার কিছু বন্ধুবান্ধব আছে। তাদের একজনের আবার সাঁইপাড়াতেই বাড়ি। সেখানেও অনেক খবর পাওয়া গেল। সব লিখে নিয়ে একটা মোটা খাতাই ভরে উঠল। এইবার প্রস্তুতিটা ভদ্রস্থ রকমের তৈরি হয়েছে বলে মনে হল।

এইবার স্ট্রাটেজি।

একটা কথা সবাই জানে যে মধুকর যে শহরে কোনো ডাকাতি-টাকাতি করে, সেখান থেকে পত্রপাঠ অন্য কোনো শহরে চলে যায়। পুলিশ বহুবার শহর থেকে বেরোবার রাস্তাগুলো সিল করে দিয়েও তাকে ছুঁতে পারেনি। এর থেকে একটা কথা মনে হয় যে, সে পালায় কোনো মস্ত গাড়ি চালিয়ে শিস দিতে দিতে বা প্লেন চড়ে নয়। সে যায় হয় ট্রেনে সেকেন্ড ক্লাসে, নয়তো ভিড় ওপচানো সাধারণ বাসে। এর মধ্যে দ্বিতীয়টার সম্ভাবনাই বেশি বলে মনে হল আমার। তার একটা কারণ, ট্রেনের সময় আর তার পালানোর সময় যে মিলে যাবে সেটা নাও হতে পারে। অতএব আমাকে বাস টার্মিনাসগুলোর ওপরে নজর রাখতে হবে।

আর একটা ব্যাপার হল, তার ডাকাতিগুলোর ইতিহাস দেখলে একটা কথা পরিষ্কার হয় যে, তার কাজকর্ম সবই উত্তর, পশ্চিম আর দক্ষিণ ভারতে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, কখনোই এক প্রদেশে পরপর দু-বার নয়। পূর্ব ভারতে নয় কেন? তবে কি সে সত্যি সত্যিই বঙ্গসন্তান, না কি তার ধারণা যে এদিকে ডাকাতি করলে তার পড়তায় পোষাবে না?

সে যাই হোক, বর্ধমান থেকে ফিরে পরদিনই দুগ্গা বলে বেরিয়ে পড়লুম। মধুকরের শেষ ব্যাঙ্ক ডাকাতিটা হয়েছিল মুম্বাইয়ে। অতএব, এবারেরটা দক্ষিণে হতে পারে। তাই, চলে গেলুম আই টি সেন্টার ব্যাঙ্গালোরে। মনে হল যে এ শহরটা মধুকরের কাছে লোভনীয় হতে পারে। একটা সস্তার মেসে উঠে চোরডাকাতদের আস্তানার সন্ধানে ঘুরে বেড়াই। লাভ বিশেষ কিছুই হয় না। তার প্রধান কারণ ভাষা সমস্যা। কেবল একটা কথাই শেখা গেল— ‘চিলমারি’, অর্থাৎ শান্ত হও।

শান্ত কি আর হওয়া যায়? ব্যাঙ্গালোরে নয়, মধুকরের পরের কীর্তিটা ঘটল হায়দ্রাবাদে। আমি হন্যে হয়ে দৌড়োলুম। সেখানে থেকে গুরগাঁও। তারপর কোচিন, ম্যাঙ্গালোর, বিশাখাপত্তনম, দেরাদুন, আরও কাঁহা কাঁহা মুল্লুক। সারা দেশের যত বাস স্টেশন আর তাদের কাছে পিঠে খাবার জায়গাগুলো আমার চেনা হয়ে গেল।

কথায় বলে, যাদৃশি ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশি। তার মানেটা খুব সম্ভবত হল এই যে, যদি কেউ কোনো কাজ জান লড়িয়ে করে তবে সে-কাজে তার সিদ্ধিলাভ যেভাবেই হোক হবেই। আমার ক্ষেত্রে কিন্তু কথাটা ফলবে বলে মনে হচ্ছিল না। টাকাপয়সা প্রায় শেষ, যত্রতত্র হাবিজাবি খেয়ে শরীরের শক্তিও প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে, এমন সময় ভালো বাংলায় যাকে বলে অপ্রত্যাশিত আর আশাতীত একটা ঘটনা ঘটল।

চণ্ডীগড়ে মধুকর উদয় হয়েছিল। আমি তখন গোয়ালিয়র থেকে এসে দিল্লিতে ঘাপটি মেরে বসেছিলুম। আমার কীভাবে যেন ধারণা হয়েছিল যে তার পরের টার্গেট হবে হয় দিল্লি নয়তো রাজস্থান। আমার হিসাবটা প্রায় মিলে গিয়েছিল বলা চলে। যাই হোক, টিভিতে খবর শুনেই দৌড়োলুম চণ্ডীগড়ে। সেখানে ইন্টারস্টেট বাস টার্মিনাসে নেমে দেখি একটা বেঁটেখাটো গোলগাল টাকমাথা লোক সুটকেস হাতে অন্য একটা বাসে উঠছে। সেটা যাবে আম্বালা হয়ে রোপার। কাজেই আমিও রোপারের একটা টিকিট কেটে গুটিগুটি গিয়ে সেই বাসটায় চড়ে বসলুম। ভাবলুম, লোকটা যেখানে নামবে, আমিও সেখানে নেমে যাব। তারপর দেখা যাবে কী হয়।

আমি ওঠামাত্র বাসটা ছেড়ে দিল। সেই লোকটা আমার সামনে দু-তিনটে সিট আগে বসেছিল। দেখি সে একটা পাঞ্জাবি খবরের কাগজ খুলে পড়তে শুরু করেছে। দেখে একটু দমে গেলুম।

স্থির করলুম আম্বালায় বাস দাঁড়ালে সেইখানেই নেমে যাব আর অন্য একটা বাস ধরে সোজা দিল্লি ফিরে যাব। সেখান থেকে কলকাতা। ঢের হয়েছে। আর সহ্য হচ্ছে না। চাকরি থাক বা না-থাক, আমি ফিরে যাবই।

কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক।

আম্বালা শহরের বাইরে জিটি রোডের ওপরে একটা মস্ত বড়ো ধাবা আছে। সন্ধ্যে নাগাদ আমাদের বাস সেখানে দাঁড়াল। কন্ডাক্টর যাত্রীদের ওখানে রাত্রের খাওয়াটা সেরে নিতে বলল। ভাবলুম, এখানেই খেয়ে নিয়ে দিল্লির বাস ধরব।

বিরাট জায়গা জুড়ে ধাবা। নেমন্তন্ন বাড়ির মতো লাইন করে বেঞ্চি পাতা, সেখানে অসংখ্য লোক পাশাপাশি বসে খাচ্ছে। তাদের মধ্যে বোধ হয় ভারতবর্ষের সব প্রদেশেরই লোক আছে। বেশ কয়েক জন সাহেবসুবোকেও দেখা গেল। চার-পাঁচজন অল্পবয়সি ছেলে চরকির মতো ঘুরছে, তারা অর্ডার নিচ্ছে, খাবার দিচ্ছে, জল দিচ্ছে, খাবার জায়গা পরিষ্কার করছে, সে একটা দেখবার মতো দৃশ্য।

আমি একটা খালি জায়গা দেখে সেখানে বসতে যাচ্ছিলুম, হঠাৎ নজরে পড়ল যে, যেখানে আমি দাঁড়িয়েছিলুম সেইখান থেকে দু-তিনটে টেবিল পরে একজন পাজামা পাঞ্জাবি আর জহরকোট পরা বেঁটেখাটো গাঁট্টাগোট্টা টাকমাথা লোক একটি বিশাল চেহারার সর্দারজিকে প্রচণ্ড বকাবকি করছেন। তাঁর মাথাতেও টাক। যেটুকু কথা কানে এল তাতে বুঝতে পারলুম যে সর্দারজিটি ওই ধাবার মালিক এবং তাঁর অপরাধ হল যে তাঁর দোকানের একটি ছেলে বিশেষ করে বলে দেওয়া সত্ত্বেও খদ্দেরকে চিনি দেওয়া চা দিয়ে গেছে। সর্দারজি নীরবে নতমস্তকে ভদ্রলোকের সব কথা শুনলেন, তারপর চায়ের গেলাসটা তুলে নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন।

ততক্ষণে আমার বুকের ভেতরে আবার ভয়ানক তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। মনে হল, এইবার সিদ্ধিলাভের আর দেরি নেই। এই আম্বালাই হবে আমার গুপ্তধনের ধারাগোল। এইবার খুব সাবধানে এগোতে হবে। একটু এদিক-ওদিক হলেই সব ভেস্তে যাবে। নিজেকে বললুম, খুব সাবধান! মধুকর রাও যে টেকো লোকেদের মারে না, সেটা একটা থিয়োরি, সত্যি নাও হতে পারে। ঝটপট কী করা দরকার তার প্ল্যানটা বানিয়ে ফেলতে হবে।

আলো দেখাল অর্ডার নিয়ে আসা ছেলেটি।

আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘দ্যাখো, উধার যো নাটাসা টাকলুবাবু বৈঠা হায়, উনকো তুম চিনতা হায়?’

ছেলেটি পরিষ্কার বাংলায় বলল, ‘না, চিনি না। মাঝে মাঝে এখানে আসেন। ভয়ানক বদরাগী লোক। রেগে গেলে যা তা গালাগালি করেন।’

আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, ‘তুমি বাঙালি?’

সে বলল, ‘না, আমি এখানকারই লোক। এখানে অনেকদিন কাজ করছি আর এই ধাবায় সারা দেশের লোক আসেন। অনেক বাঙালিও আসেন। তাঁদের কথা শুনে শুনে বাংলা শিখে ফেলেছি। অন্যভাষাও কিছু কিছু জানি।’

আমি বাধা দিয়ে বললুম, ‘আমি যে বাঙালি, সেটা বুঝলে কী করে?’

ছেলেটি নির্বিকার মুখে বলল, ‘আপনার হিন্দি শুনে। অমন জঘন্য হিন্দি একমাত্র বাঙালিরাই বলতে পারে। আপনার মতো টাকমাথা ওই বদরাগী ভদ্রলোকও বোধ হয় বাঙালি তবে ওনার হিন্দি আপনার থেকে অনেক ভালো, প্রায় নির্ভুল।’

আমি ব্যাজার হয়ে বললুম, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। এখন আমার অর্ডার নিতে হবে না। আমি এখন ভদ্রলোকের পাশে গিয়ে বসছি, ওখান থেকে অর্ডার নিও।’

বদরাগীর পাশে একটা জায়গা খালি ছিল। আমি গুটিগুটি গিয়ে সেখানে বসে পড়লুম। শূন্যের দিকে তাকিয়ে স্বগতোক্তির মতো বললুম, ‘আমি গায়ে পড়ে কারোর সঙ্গে আলাপ করা পছন্দ করি না। কিন্তু, আপনার সঙ্গে আমাদের বর্ধমানের রেল কলোনির নাড়ুগোপাল রায়ের এতই মিল যে আলাপ না-করে থাকতে পারলুম না। আপনি কি চিন্তামণি রায়ের কোনো আত্মীয়?’

বদরাগীর চোখদুটো আমার কথা শুনে প্রথমে ধক করে জ্বলে উঠল। তবে সেটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য। তার পরেই আগুনটা নিভে গেল। চাপা ফ্যাসফেসে গলায় হিন্দিতে বললেন, ‘আপনি কি আমাকে কিছু বলছেন? আমি কিন্তু আপনার কথা বুঝতেই পারছি না।’

আমি বাংলাতেই স্বগতোক্তি চালিয়ে গেলুম, ‘তাই হবে। আসলে, নাড়ুদার সঙ্গে অদ্ভুত মিল আর চায়ে চিনি দেওয়ায় চটে যাওয়া দেখে আমার মনে হয়েছিল যে আপনি হয়তো চিন্তাজ্যাঠার হারিয়ে যাওয়া ছেলে পাঁচুদা। নাড়ুদাও চায়ে চিনি দিলে ফিউরিয়াস হয়ে যেত। কী জানেন, চিন্তাজ্যাঠা সবসময় পাঁচুদার কথা বলতেন। মারা যাওয়ার সময় তাঁর শেষ কথা ছিল, ” পাঁচুর সঙ্গে আর দেখা হল না। দেখা হলে বলতুম যে তোর মায়ের কথা ভেবে তুই ফিরে আয়। তার কান্না আমি সহ্য করতে পারছি না।” তা ছাড়া, চিন্তাজ্যাঠার বড়োমেয়ে কমলিকাদি মারা যাওয়ার সময় প্রবল জ্বরের ঘোরে ”পাঁচু এসেছে, পাঁচু এসেছে” বলে কেঁদে উঠতেন।’

আমার বেশ একটা ফ্লো এসে গিয়েছিল, অর্ডার নেওয়ার ছেলেটি এসে বদরাগীর সামনে এক গেলাস চা নামিয়ে দিয়ে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘এখন অর্ডার দেবেন?’

আমি খাবার অর্ডার দিলুম।

এবার বদরাগী মাথা নীচু করে চায়ে চুমুক দিতে দিতে হিন্দিতে স্বগতোক্তি করলেন, ‘আপনার প্রবলেমটা কী?’

আমি প্রথমটা চমকে গিয়েছিলুম। সামলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘আপনি কি বাংলা বুঝতে পারেন?’

হিন্দিতে জবাব এল, ‘অল্প অল্প। হিন্দিতে অসুবিধে থাকলে আপনি বাংলাতেই বলতে পারেন।’

‘হিন্দিতে আমার নিজের কোনো অসুবিধে নেই। তবে যে শোনে, তার খুব অসুবিধে হয়। মানে, আমার হিন্দি শুনলে হিন্দিভাষীরা কিছুক্ষণের মধ্যেই হয় অসুস্থ হয়ে পড়ে নয়তো মার মার করে তেড়ে আসে।’

ভদ্রলোক মৃদু হেসে বললেন, ‘আপনি আমাকে বাংলাতেই বলুন।’

‘প্রবলেম তেমন কিছু নয়। ওয়েস্ট বেঙ্গলে বর্ধমান বলে একটা শহর আছে। সেখানে রেল কলোনির পাশে সাঁইপাড়ায় আমাদের বাড়ি। আজ থেকে প্রায় চব্বিশ বছর আগে, আমার তখন বছর ছয়েক বয়েস, রেল কলোনির একটা ছেলে, পাঁচুগোপাল রায়, কোনো কারণে তার বাবা চিন্তামণি রায়ের হাতে বেধড়ক মার খেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। আর ফিরে আসেনি। ছেলেটা যেটা জানত না, তা হল তার দুষ্টুমিটা তার বাবা কিন্তু খুব উপভোগই করতেন কারণ তিনি নিজেও ছোটোবেলায় খুব ডানপিটে ছিলেন। তিনি যে ছেলেকে মারধোর করতেন, সেটা ছিল সমাজে বাস করবার জন্য।’

‘তারপর?’

‘ছেলেটি নিরুদ্দেশ হলে, তার বাবা একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন। তিনি অনবরত নিজেকে দোষারোপ করতেন। শুধু তিনিই নন, সমস্ত পরিবারটারই সেইরকম অবস্থা হয়েছিল। সেই আঘাতটা তাঁরা কোনোদিনই সামলে উঠতে পারেননি। আমি বড়ো হয়ে ছেলেটির দাদা নাড়ুগোপাল আর ছোটোবোন কাজলদির কাছে তার অনেক গল্প শুনেছি। নাড়ুদার দিদি কমলিকাকে আমার মনে পড়ে না। শুনেছি, তিনি তাঁর ছোটোভাইকে অসম্ভব ভালোবাসতেন, তাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন। সেই ভাই নিরুদ্দেশ হওয়ায় তিনিও খুব কাতর হয়ে পড়েছিলেন।’

‘তাঁরাই কি আপনাকে পাঠিয়েছেন সেই ছেলেটির সন্ধানে?’

‘না, না। তাঁরা পাঠাবেন কোত্থেকে? ওই পরিবারের কাজলদি ছাড়া আজ আর কেউই বেঁচে নেই। তা, কাজলদিও সেরিব্রাল স্ট্রোকে আজ বছরছয়েক হল শয্যাশায়ী, কোনো অঙ্গই কাজ করে না। শুধু প্রাণটুকু আছে। তবে হ্যাঁ, বলতে পারেন যে কাজলদির ছেলে র‌্যাম্বো আর নাড়ুদার ছেলে জাম্বো আমাকে পাঠিয়েছে। এখন র‌্যাম্বোর বয়েস আট আর জাম্বোর বয়েস চোদ্দো। তাদের কাছে পাঁচুগোপাল হিরো নম্বর ওয়ান। কয়েক বছর বাদে তারা নিজেরাই তাকে খুঁজতে বের হবে। এ ব্যাপারে ওরা দু-জনেই একেবারে একমত।’

‘ওরা কি কলোনিতেই থাকে?’

‘না। তা থাকবে কী করে? চিন্তাজ্যাঠা রিটায়ার করে সাঁইপাড়াতেই বাড়ি করেছিলেন। তার দু-বছরের মধ্যেই উনি আর জ্যাঠাইমা দু-জনেই মারা যান। কাজলদি অল্পবয়েসে বিধবা হয়ে ওই বাড়িতেই এসেছিল, এখনও ওখানেই আছে। চিন্তাজ্যাঠার ছোটোভাই প্রশান্তকাকা ওদের দেখাশুনো করে থাকেন। তবে, উনি পাঁচুগোপালের ব্যাপারে খুব একটা উৎসাহী নন। বুঝতেই তো পারেন, ভাইপো ফিরে এলে তাঁকে সপরিবারে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে আর একতলার ভাড়ার টাকাটাও বেহাত হয়ে যাবে। উনি নিজে তো কিছুই করেন না, কাজেই তাঁর উৎসাহ না থাকবারই কথা।’

‘বুঝেছি। নাড়ুগোপাল মারা গেল কীভাবে?’

‘আমি ঠিক জানি না। নানা লোকে নানা কথা বলে। শুনেছি, পারাদ্বীপে গিয়েছিলেন তাঁর ব্যাবসা সংক্রান্ত কোনো কাজে। সেখানে মারা যান। কেউ বলে জলে ডুবে, কেউ বলে বন্দুকের গুলিতে আবার কেউ বলে গাড়ি দুর্ঘটনায়।’

আমার শ্রোতাটির চোখদুটো আবার জ্বলে উঠল। হিসহিস করে বললেন, ‘পুলিশ কী বলেছে?’

‘জানি না। এ ব্যাপারে রায়পরিবার কারোর সঙ্গে কোনো আলোচনা করে না।’

‘ঠিক আছে। আর কমলিকা? সে কোথায় থাকে? তার সন্তানাদি নেই?’

‘কমলিকাদি বিয়ের আগেই ওপরে চলে যান। বোধ হয় একটা খুব খারাপ ধরনের টাইফয়েড হয়েছিল। আমার তখন দশ বছর বয়েস। কমলিকাদির কোনো স্মৃতিই আমার মনে নেই। জ্যাঠাইমা তারপর থেকে কেমন যেন পাথরের মতো হয়ে গিয়েছিলেন। কারোর সঙ্গে কথা বলতেন না। স্থির হয়ে ফ্যালফ্যাল করে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতেন। তাতে একটা ভালো হয়েছিল যে, চিন্তাজ্যাঠার চলে যাওয়াটা উনি বুঝতে পারেননি।’

ইতিমধ্যে ভদ্রলোকের চা খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। উনি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘আপনার সঙ্গে আলাপ করে ভালো লাগল। আমি তা হলে এখন যাচ্ছি।’

আমি একেবারে চুপসে গেলুম, যাকে বলে ‘ধুক করে নিভে গেল বুকভরা আশা’। ভদ্রলোক যে এইভাবে চলে যাবেন, আমি সেটা একেবারেই আশা করিনি। ভেবেছিলুম, নিজের আসল পরিচয়টা না দিলেও, হয়তো আরও প্রশ্নটশ্ন করবেন আর তার ভেতর থেকে আমি ওঁকে কবজা করবার একটা রাস্তা খুঁজে বের করতে পারব। এখন তো আমার আর কিছু করবারই রইল না।

তার মানে কি, আমার সন্দেহটা ভুলই হয়েছিল। এতক্ষণ ধরে যে বকরবকর করলুম, সেই সময়টা নেহাতই বাজে খরচা হল? যাক গে, যদি তাই হয়, তা হলে তো আর ভেবে লাভ নেই। এবার তাহলে ফেরার প্রস্তুতি নিতে হয়।

রাত ন-টায় দিল্লির বাস ছাড়বে, তাই ধীরেসুস্থে খাওয়া-দাওয়া সেরে বাসস্টপের দিকে রওনা হলুম।

আমার মনের ভেতর থেকে একটা খটকা কিন্তু কিছুতেই যাচ্ছিল না। বাসস্টপের দিকে যেতে যেতে চিন্তা করছিলুম যে, আমার সন্দেহটা কি সত্যিই ভুল হয়েছিল? লোকটা যদি পাঁচুগোপাল না-ই হবে, তবে সে এত প্রশ্ন করতে গেল কেন? তা ছাড়া, লোকটির বাংলা নামের উচ্চারণগুলো বাঙালি ধাঁচের। কামালিকা না-বলে, বলল কমলিকা। কাজাল না-বলে, বলল কাজল। ধাবার ছেলেটিও বলল যে সে সম্ভবত বাঙালি। এখন অবশ্য এসব কথা ভাবার আর কোনো মানে হয় না।

অত রাতে বাস টার্মিনাসে যাওয়ার রাস্তাটা তখন নির্জন। তার দু-পাশে সার দিয়ে ঝুপসি গাছ, ফলে স্ট্রিট-লাইটের আলো তলা পর্যন্ত পৌঁছোয় না। রাস্তাটা আলো-আঁধারি হয়ে থাকে। আমি মাথা নীচু করে খানাখন্দ দেখতে দেখতে হাঁটছিলুম, হঠাৎ শুনি পেছনে বদরাগীর গলা। পরিষ্কার বাংলায় বলল, ‘এই যে মশায়, একটু দাঁড়ান তো।’

আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা বরফ-ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। বুঝলুম, এই শেষ। যা ভয় পাচ্ছিলুম, তাই হল। ওই ব্যাটা মোটেই কোত্থাও যায়নি, আমার জন্যই এই ভূতুড়ে জায়গাটায় অপেক্ষা করে বসে ছিল। এক্ষুনি ছ-টা গুলি এসে আমাকে ঝাঁঝরা করে দিল বলে। আমার সারা গায়ে কুলকুল করে ঘাম বেরোতে শুরু করল। দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই কারণ গলাটা খুবই কাছ থেকে এল। মনে হল, কথা বলে ব্যাটাকে অন্তত কিছুক্ষণের জন্য যদি আটকে রাখতে পারি, কেউ-না-কেউ নিশ্চয়ই এসে পড়বে। তাই, খুব আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়ালুম।

দেখি, একটা গাছের তলায় বদরাগী দাঁড়িয়ে রয়েছেন, তবে, সৌভাগ্যক্রমে, তাঁর দুটো হাতই খালি।

আমি কাষ্ঠহাসি হেসে বললুম, ‘ও আপনি। আমি ভেবেছিলুম অন্য কিছু।’

লোকটি একটু এগিয়ে এসে বললেন, ‘অন্য কিছু মানে?’

‘না, মানে ইয়ে, আমি ভেবেছিলুম ওই যাকে বলে অশরীরীর গলা।’

‘কেন? আপনার ভূত বলে মনে হল কেন?’

‘হবে না? এই সুদূর পাঞ্জাবে, এই নির্জন রাস্তায়, কে আমাকে বাংলায় ডাকবে, বলুন? আমাকে তো এখানে পাঞ্জাবি হোক বা বাঙালি হোক, কেউ চেনেই না। আমি তাই ভাবলুম, এটা নিশ্চয়ই ভূতের গলা। আমাকে ডেকে দাঁড় করিয়ে আমার ওপর লাফিয়ে পড়বে আর ঘাড় মটকাবে।’

একপ্রস্থ অট্টহাসি। সেটা থামলে বদরাগী বললেন, ‘সে যাকগে, আপনি চললেন কোথায়?’

‘দিল্লি। একটু পরেই একটা বাস আছে।’

‘বাস বাদ দিন তো। আমিও দিল্লি যাচ্ছি। আপনি আমার সঙ্গে চলুন। আমার গাড়ি আছে। গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে।’

‘বাঃ, সে তো খুব ভালো কথা। আমারও কিছু টাকা বেঁচে যাবে।’

গাড়িটা একটা বড়ো গাছের তলায় অন্ধকারে দাঁড় করানো ছিল। সেইদিকে হাঁটতে হাঁটতে বললুম, ‘আমি তাহলে আপনাকে ঠিকই চিনেছি, কি বলেন?’

খুব গম্ভীর গলায় বদরাগী বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি পাঁচুগোপাল রায়। আপনি ঠিকই ধরেছেন।’

‘ধরতেই হবে। আপনার সঙ্গে নাড়ুদার যা মিল, না-ধরে উপায় আছে?’

‘একটা কথা জেনে রাখুন, আমি কখনোই কাউকে আমার পরিচয় দিই না। যে পরিচয় একদিন ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে এসেছি, তাকে আবার কুড়িয়ে তুলতে চাই না। তবে, আজ যে আপনাকে সেই পরিচয় দিলুম, তার কারণ আপনার কথা শুনতে শুনতে আমার ছেলেবেলার অনেক কথা মনে পড়ে গেল। একটু বোধ হয় সেন্টিমেন্টাল হয়ে পড়েছিলুম। জানি না, যা এতদিন গোপন রেখেছি, সেটা আপনার কাছে প্রকাশ করে দেওয়াটা ঠিক হল কি না।’

আমিও খুব গম্ভীর গলায় বললুম, ‘আপনি কিছু চিন্তা করবেন না, পাঁচুদা। আমি কাউকে কোনোদিন এ বিষয়ে কোনো কথাই বলব না। তবে, একটা অনুরোধ, আপনি ফিরে চলুন।’

গাড়ি চালু করে পাঁচুদা করুণভাবে বললেন, ‘সে আজ আর হয় না।’

‘কেন হয় না? আমি বলছি বলে? র‌্যাম্বো আর জাম্বো এসে বললে তাদের ভাগিয়ে দিতে পারতেন? সবাই আপনার অপেক্ষায় বসে রয়েছে।’

মাথা নাড়লেন পাঁচুদা। বললেন, ‘নাঃ, ও কথা আর ভেবে লাভ নেই। তবে আপনাকে আমি যে পেছনে ডাকলুম, তার একটা অন্য কারণও আছে। তা হল, দিল্লি গিয়ে আমি আপনাকে কিছু টাকা দেব। সেটা আপনি কাজলের চিকিৎসা যাতে ঠিকমতো হয়, তার জন্যে উপযুক্ত লোকের হাতে দিয়ে দেবেন।’

‘কত টাকা?’

‘ভাবছি দু-লাখ টাকা দেব আপাতত।’

‘আমি খাবি খেতে খেতে বললুম, ‘দু-লাখ? আমাকে বিশ্বাস করে দেবেন? যদি আমি টাকাটা নিয়ে কেটে পড়ি?’

‘পড়বেন না। আমার পরিচয় পেলে, ওই টাকার একটি পয়সাও সরাতে পারবেন না।’

আমি যথাসম্ভব স্বাভাবিকভাবে বললুম, ‘আপনার পরিচয় আমি জানি। তবু বলছি, টাকাটা নিজে হাতে দিয়ে আসুন। কাজলদির অন্ধকার ঘরে আবার আলো জ্বলে উঠবে।’

‘আমার পরিচয় আপনি জানেন? কী জানেন আপনি?’

একটা গভীর নিশ্বাস নিয়ে বললুম, ‘শুধু আমি কেন, সমস্ত বাঙালি আপনার পরিচয় জানে। জানে যে আপনিই তাদের অবিসংবাদিত হিরো মধুকর রাও।’

বলতেই ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে আর্তনাদ করতে করতে গাড়িটা দাঁড়িয়ে গেল। ভাগ্যিস তখন অনেক রাত, হাইওয়েতে গাড়িঘোড়া প্রায় ছিল না বললেই চলে। নইলে একটা ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত।

মিনিটদুয়েক বাদে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘কী হয়েছে, পাঁচুদা?

পাঁচুদা তখন স্টিয়ারিঙের ওপর মাথা রেখে চুপ করে বসেছিলেন। মুখ তুলে বললেন, ‘তুমি সত্যি বলছ যে, সব বাঙালিরা আমাকে চেনে আর আমাকে হিরো মনে করে? কিন্তু সরকারের চোখে তো আমি একজন অপরাধী?’

‘তাতে কী হয়েছে? রবিনহুডও তো তাই ছিলেন। অথচ লোকে আজও তাঁকে মনে রেখেছে।’

ওপর নীচে মাথা নেড়ে পাঁচুদা বললেন, ‘হেঁ হেঁ, তা বটে। রবিনহুডও তো ডাকাতই ছিল, তাই না? আমাকেও তো তারই মতো কত বদনাম, কত অপমানই না সহ্য করে যেতে হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। সেসব রটিয়েছে ওই সরকারি পুলিশ। তবুও দ্যাখো, আমার দেশের লোক আমাকে তাদের ইয়ে মনে করে?’

‘কী বদনাম রটিয়েছে পুলিশ?’

‘এ তো দ্যাখো না, ওরা বলে যে আমি নাকি ষাট-সত্তরটা খুন করেছি। বিশ্বাস করো, আমি কিন্তু আসলে একটাও খুন করিনি। একবার একটা লোকের বুকের ওপর বন্দুক তুলেছিলুম। লোকটা ভয়ের চোটে ভিরমি খেয়ে হার্টফেল করে মরে গিয়েছিল। আমি কিন্তু গুলিই ছুড়িনি। আর একবার একটা বাড়ির সাততলার ওপরে একটা জিমনেসিয়ামে ডাকাতি করতে গিয়েছিলুম। আমার নাম শুনেই, কোথাও কিছু নেই, ইয়া তাগড়া তাগড়া জোয়ান লোকগুলো হাত-পা ছুড়ে চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে সোজা জানলা দিয়ে নীচে লাফ মেরেছিল। তাদের কেউই বোধ হয় বেঁচে নেই। আমি কিন্তু কিছুই করিনি। তবু, পুলিশ বলছে যে আমিই না কি তাদের ওপর থেকে ছুড়ে ফেলে খুন করেছি। আচ্ছা, সেটা কখনো সম্ভব? যে যেখানে বেঘোরে মারা যাচ্ছে, পুলিশ তাদের দায় আমার ঘাড়ে চড়াচ্ছে। বোধ হয়, আমাকে যে ধরতে পারছে না, সেই রাগে। কী অন্যায় বলো দেখি! এদেশে সততা বলে কি আর কিছু আছে? একজন শান্তিমতো ডাকাতি করবে, তার জো নেই।’

আমি মুখটা যথাসাধ্য করুণ করে বললুম, ‘তা যা বলেছেন।’

‘একটা কথা। আমি তো এখান থেকে সোজা বর্ধমান যেতে পারব না, কলকাতা হয়ে যেতে হবে। ওখানে পা দিলেই তো পুলিশ আমাকে ধরে জেলে ভরে দেবে। আমি জানি, ওরা দমদম, শিয়ালদা আর হাওড়া স্টেশনের ওপর কড়া নজর রেখেছে। কাজেই আমাকে ওসব জায়গায় নিজের পরিচয় দিলে চলবে না। তাহলে লোকে আমাকে চিনবে কী করে?’

‘আপনি গোপনে যেতে যাবেন কোন দুঃখে? মধুকর রাও তার আপন দেশে যাবেন বুক ফুলিয়ে। দেখবেন, ওখানে আপনাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে কাতারে কাতারে লোক অপেক্ষা করছে, ব্যান্ডপার্টি ”ধনধান্যেপুষ্পে ভরা” বাজাচ্ছে, বড়ো বড়ো নেতারা এত মালা নিয়ে আপনার জন্যে দাঁড়িয়ে আছেন যে সেই মালা পরে আপনি ঘাড় সোজা রাখতে পারবেন না।’

একটা অসম্ভব লাজুক হাসি হেসে পাঁচুদা বললেন, ‘যা! এরকমই হতেই পারে না!’

‘আলবাত হতে পারে! অবিশ্যি, তার জন্যে কিছু ব্যবস্থাপত্র করতে হবে।’

‘কী ব্যবস্থাপত্র করতে হবে? তা করবেই বা কে?’

‘আমিই করতে পারি।’

‘কী করবে?’

‘একটা দৈনিক পত্রিকার সম্পাদককে আমি চিনি। আমি তাকে টেলিগ্রাম করে দেব যাতে আমরা যাওয়ার আগে আপনার আগমন বার্তা সবাই জানতে পারে। তখন দেখবেন যে বাঙালির ভালোবাসার জোয়ারে পুলিশ কিচ্ছু করতে পারবে না।’

‘তা হলে টেলিগ্রাম কেন, একটা ফোন করে দাও।’

‘টেলিফোন? আপনি খেপেছেন। এটা বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি, পাঁচুদা, তারও ওপরে ভারতবর্ষ। দিল্লি থেকে কলকাতায় ফোন করা যে কী বিশাল ঝামেলা, তা আপনি জানেন না? তিনদিন লাগবে একটা ট্র্যাঙ্ক কল পেতে। টেলিগ্রাম করলে সেটা অন্তত পৌঁছোবে আর দু-দিন সময় পাবে কাগজওয়ালারা। তার মধ্যে পাবলিসিটিটা হয়ে যাবে। তার পরেই আমরা দিল্লি থেকে একটা ফ্লাইট নিয়ে ওখানে পৌঁছে যাব।’

‘মানে প্লেনে? ওরে বাব্বা, আমি ওর মধ্যে নেই! প্লেনে চড়তে আমার ভীষণ ভয় করে। ইঞ্জেকশন নিতেও আমার অত ভয় করে না। আমরা ট্রেনেই যাব।’

সাত ঘণ্টা লেট করে আমাদের ট্রেন যখন হাওড়ায় পৌঁছোল তখন সন্ধ্যে হতে বেশি বাকি নেই। আমরা সকলের শেষে ট্রেন থেকে নামলুম। প্ল্যাটফর্মে তখন গোটা কয়েক কুলি আর কিছু ভবঘুরে-জাতীয় লোক ছাড়া আর কেউ নেই।

চারদিকে তাকিয়ে পাঁচুদা বললেন, ‘কই হে, তোমার কাতারে কাতারে লোক, ব্যান্ডপার্টি, সব কোথায়? কাউকেই তো দেখতে পাচ্ছি না।’

আমি মাথা চুলকে বললুম, ‘ব্যাপারটা তো ঠিক বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে, আমার টেলিগ্রামটা নিশ্চয়ই পৌঁছোয়নি। পুলিশ যদি লোকজনদের স্টেশনে ঢুকতে আটকে থাকে, তাহলে তারা তো এখানে থাকবে। তাদেরও তো কারোর টিকি দেখতে পাচ্ছি না। কিছু-একটা হয়েছে জানেন। চলুন, এখানকার টেলিফোন বুথ থেকে খবরের কাগজে একটা ফোন করে দেখি।’

উদাসীন গলায় পাঁচুদা বললেন, ‘ঠিক আছে। তাই চলো।’

ওঁর কথার সুর থেকে মনে হল, উনি রেগে যাননি, বরং একটু যেন স্বস্তি পেয়েছেন। সেটা হওয়াই স্বাভাবিক। যে লোকটি এতদিন মানুষজন এড়িয়ে চলেছেন, নিজেকে সকলের আড়ালে রেখেছেন, তিনি যে মনে মনে লোকের ভিড়, ফুলের মালা, অভ্যর্থনা সভা ইত্যাদি নিয়ে একটু উদবিগ্ন হয়ে পড়বেন, তাতে তো আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এখন চিন্তা, এখানকার টেলিফোন চালু আছে তো?’

আমার পরম সৌভাগ্য যে টেলিফোন চালু ছিল এবং এডিটর সনৎ ঘোষকে পাওয়াও গেল।

আমি অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে বললুম, ‘সনৎদা, আমি দিল্লি থেকে মধুকর রাওকে নিয়ে এসেছি। আপনারা কোথায়? আমার টেলিগ্রাম পাননি?’

হাই তুলতে তুলতে সনৎদা বললেন, ‘পেয়েছি। এবার ওই মধুকর রাওকে পরের ট্রেনে দিল্লি ফেরত পাঠিয়ে দাও। তারপর সোজা অফিসে চলে এসো।’

আমি ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে বললুম, ‘কী বলছেন কী আপনি? আপনারাই আমাকে ওকে ধরে আনতে পাঠালেন, আমি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাকে খুঁজে বের করে নিয়ে এলুম, আর এখন বলছেন ”ফেরত পাঠিয়ে দাও”? এর মানে কী?’

আবার হাই তুলতে তুলতে সনৎদা বললেন, ‘এর মানে হল তুমি যদি আর মাস দুয়েক আগে ওকে নিয়ে আসতে তাহলে তোমার টেলিগ্রামের একটা মূল্য থাকত। আজ আর নেই।’

‘সে কী? কেন?’

‘তার কারণ, মাস দুয়েক আগে বাঁকুড়ার খুন্টি পাহাড়ে এক সিদ্ধপুরুষ এসেছেন। তাঁর নাম ”অদৃশ্যবাবা”। এখন বাঙালি নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে তাকে নিয়ে পড়েছে। মধুকর রাও-এ তাদের আর কোনো ইন্টারেস্টই নেই।’

‘সিদ্ধপুরুষের নাম ”অদৃশ্যবাবা”? সে আবার কী?’

‘তিনি এক বাকসিদ্ধ মহাযোগী সাধুবাবা। তিনি দেখ-না-দেখ অদৃশ্য হয়ে যান। ধরো, নদীর ধারে গাছতলায় বসে তোমার সঙ্গে কথা বলছেন। বলতে বলতে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেলেন। তুমি দেখলে যে তিনি চোখের পলকে নদীর ওপারে একটা পাহাড়ের চুড়োয় বসে তপস্যা করছেন। অদ্ভুত ক্ষমতা। এই ঘটনা অবশ্য খুব কম লোকেরই দেখবার সৌভাগ্য হয়েছে। তবু তা দেখবার আশায় অসংখ্য লোক খুন্টি পাহাড়ে গিয়ে হত্যে দিয়ে পড়ে রয়েছে। থাকবে না-ই বা কেন? বাবা তাদের মধ্যে যার ওপরে প্রসন্ন হচ্ছেন, তার নাকি কপাল ফিরে যাচ্ছে। আমাদের দু-জন রিপোর্টারও সেখানে বসে আছে। আমরা রোজ সাধুবাবার খবর আর ছবি ছেপে যাচ্ছি। হুজুগে বাঙালি পাঠক খাচ্ছেও খুব। তুমিও শিগগিরি যাবে ওখানে অরবিন্দকে রিলিফ দিতে।’

আমি বললুম, ‘বুঝেছি সনৎদা। আর বলতে হবে না। তবে, আমি যে এত পরিশ্রম করলুম তার কী হবে?’

‘কী আবার হবে? তোমার চাকরিটা থাকবে।’

বুথ থেকে বেরিয়ে দেখি পাঁচুদা উদাস হাসি হাসি মুখে স্টেশনের বাইরে বহমান জনস্রোতের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। বললুম, ‘পাঁচুদা, খুব গোলমাল। পুলিশ গোয়েন্দারা আপনার খোঁজে একবারে খেপে উঠেছে। সেইজন্যে কোনো কাগজ আপনার কোনো খবর ছাপছে না। এখানে আসবার কথার তো প্রশ্নই ওঠে না। কাজেই, আপনি পত্রপাঠ কেটে পড়ুন; নইলে সমূহ বিপদ হতে পারে।’

পাঁচুদা কিছুমাত্র বিচলিত হলেন না। বললেন, ‘দূর দূর। কোথায় যাব? এখানে ফিরে এসে এত ভালো লাগছে যে কী বলব? বর্ধমানে এক্ষুনি যাওয়া উচিত হবে না। কিছুদিন পরে যাব। আপাতত পটলতলাতেই যাই। সেখানে স্বামী প্রবলানন্দ আছেন। যাই, তাঁর চরণে আশ্রয়ে নিই গে। তিনি ঠিক আমার একটা হিল্লে করে দেবেন।’

No comments