অনুসন্ধানী ঝন্টুমামা – সিদ্ধার্থ ঘোষ
দরজা খোলার শব্দ পৌঁছালেও হরিনারায়ণ বইয়ের পাতা থেকে চোখ সরাননি। ইজিচেয়ারের পেল্লায় লম্বা দুই হাতলের ওপর পা তুলে তিনি লাল চামড়ায় বাঁধানো বইয়ে ডুবে আছেন। পুবের জানলার আলো তাঁকে সাহায্য করছে। গলা অবধি পাতলা একটা কম্বলের নিচে, শুধু হাতওয়ালা পশমি গেঞ্জিটুকু কষ্ট করে ধরে রেখেছে বইটা। আঙুলগুলো অবধি দেখা যাচ্ছে না।
–মেসোমশাই!
অনেক জড়তা কাটিয়ে সন্তর্পণ ডাক। বইটা দু-ইঞ্চি নেমে এল, বৃদ্ধের মাথা নড়ল না, শুধু চোখের মণি দুটো ক্লান্ত ভঙ্গিতে সরোজের মুখের ওপর নেমে এল।
–তোমাকে আমি বারণ করেছি লুঙ্গি পরে আমার সামনে আসতে।
–হ্যাঁ, মানে–এখুনি তো স্নান করতে যেতে হবে।
চোখে না দেখলে, শুধু কথা শুনে বিশ্বাস করা শক্ত, এই কথাবার্তা চলছে শীর্ণকায় সত্তর পার-করা একজন আর একটা চুয়াল্লিশ বছরের গাট্টাগোট্টা লোকের মধ্যে। হরিনারায়ণের এক মাথা সাদা চুল আর সরোজের মাথাজোড়া টাকই যেন তাদের ব্যক্তিত্বের সংঘাতের ফয়সালা করে রেখেছে।
-বলছিলাম, পরশু তো মিঠুর জন্মদিন। কয়েকজন বন্ধুকে ও সেদিন সন্ধেয় বাড়িতে খেতে বলেছে।
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেল সরোজ। যেন বেশ কয়েকবার রিহার্সাল দিয়ে এসেছে।
–মিঠুর বয়স আমার হিসাবমতো আট। তুমিই তার মাথায় জন্মদিনের পার্টির কথা ঢুকিয়েছ। দাদুভাই একটু আগেই এসেছিল–একটি কথাও বলেনি। এইভাবে স্পয়েল করো না। ব্যক্তিগত বা পারিবারিক আনন্দকে হুল্লোড়ের মধ্যে সেলিব্রেট করা আমি অপছন্দ করি। তুমি সেটা জান নিশ্চয়। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো, তুমি যা পেয়েছ, সেটা শেষ অবধি রাখতে পারবে কি না আমার সন্দেহ আছে। যেমন সন্দেহ হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত দোতলার ফ্ল্যাটটাতেও ক-দিন নিজে থাকতে পারব। তাই বলছি, তোমার-আমার সেম কেস। বার্ডস ইন এ ফেদার।
হরিনারায়ণ বইটা আবার মুখের সামনে টেনে নিলেন। আধ মিনিট নীরবে কেটে গেল। সরোজ তখনও দরজা ভেজিয়ে সরে যায়নি। অনুভবেই তা টের পেলে হরিনারায়ণ। প্রসঙ্গে ইতি টেনে দিতে বাধ্য হলেন তিনি, আমার যা অপছন্দ, তার জন্য আমি একটি টাকাও দিতে পারব না। নিজের রোজগারের টাকায় নিজের ছেলে জন্মদিনের পার্টি বসাও
-দরজাটা টেনে দাও, ঠান্ডা হাওয়া আসছে।
দরজাটা বন্ধ করে বাইরে এসেও সরোজের যেন পা নড়তে চায় না। রোজগারের টাকা। কথাগুলো ভেংচি কাটছে।
অন্যমনস্ক ছিল বলেই সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পায়নি। বিদেশি গানের সুর শিস দিতে দিতে নামছিল একটা নীল জিনসের প্যান্ট আর লাল টুকটুকে গলাবন্ধ সিন্থেটিক গেঞ্জি। ওর হাবভাব এমন যে, মুখের দিকে নজর পড়ে সবার পড়ে। পার্ক স্ট্রিটের হোটেলে ফ্লোর শো-এ ডুগডুগি বাজিয়ে নাম করেছে।
সরোজ দাঁড়িয়ে আছে দেখে একটু থমকে গেল রবি। তারপর আস্তে আস্তে পা ফেলে নামল শেষ কয়েকটা ধাপ।
গলা নিচু করে ডাকল, ব্রাদার! এদিকে শোন একবার।
চমকে গেল সরোজ। তারপর ভুরু কুঁচকে তাকাল। ইচ্ছে না থাকলেও রবির ইঙ্গিতে বাইরের দরজার দিকে সরে এল।
রবি হাসি হাসি চোখে তাকিয়ে, কী? চিড়ে ভেজাতে পারলে না?
তার মানে?
–ডোন্ট বি সিলি। মানে কী সবাই জানে। তোমার মতো স্টার ক-জনের বল। এলে ভাড়াটে হয়ে, তারপর ভাড়ার টাকা দেওয়ার ক্ষমতা নেই দেখে বাড়িওয়ালা সম্পত্তিটাই দিয়ে দিল ভাড়াটেকে। তা-ও যদি বুড়োটা ব্যাচেলার হত তাহলে বুঝতাম। নিজের ছেলেকে অবধি…
সরোজ সরে যাবার চেষ্টা করতেই রবি তার গেঞ্জিটা মুঠো করে ধরল পেছন থেকে। এবার আর তার ভঙ্গিতে রসিকতার চিহ্ন নেই।–দাঁড়াও। একটা কথা শুনে রাখ। ভোগা দিয়ে বুড়োকে ভিজিয়ে সম্পত্তি ম্যানেজ করেছ, বেশ করেছ। তুমি না থাকলেও আমি যেটুকু পেয়েছি, তার বেশি পেতাম না।
রবি দমাস করে সরাজের পিঠে আদরের থাপ্পড় কষিয়ে গলা ছেড়ে হেসে উঠল। আবার শিস দিতে দিতে বেরিয়ে গেল সে।
সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে সরোজের মনে একটা শব্দই গুনগুন করছিল। রোজগার। রোজগার। রোজগারের টাকা। ওষুধের দোকানের সেলসম্যানের এই তেতলার ফ্ল্যাটে বাস করা সাজে না। অনাত্মীয় বাড়িওয়ালার স্নেহ-ভালোবাসা ভাঙিয়ে তার বিলাসিতা করা সাজে না। কিন্তু সাহায্য করেছে বলেই সারাক্ষণ হরিবাবু সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবে। প্রতিটি মুহূর্তে বুঝিয়ে দেবে সে অযোগ্য অপদার্থ। এসবই জানা কথা, তবু মিঠুর জন্মদিনেও উপুড়হস্ত হবে না–ভাবতে পারেনি। ছেলেকেও তো দু-চক্ষে দেখতে পারে না। তাহলে কার জন্যে যক্ষের ধন আগলে বসে-থাকা! সবাইকে নিমন্ত্রণ করাও হয়ে গেছে। এখন আর পিছানোর রাস্তা নেই। সেই দীপার কাছেই হাত পাততে হবে। আবার একটা গয়না–চোখের জল–ওহ্
ঘরের কোণে প্রদীপ জ্বলছে। দীপা শাঁখে ফুঁ দিল।
-কই দাদুভাই, খাও!
মিঠু বাঁ হাতে করে চাকাওয়ালা ক্রেনটাকে ঠেলাঠেলি করছে। সারা সকাল দাদু-নাতি মিলে পাতাল রেলের কোচ নামাবার এই ব্যবস্থা করেছে। এক বছর ধরে খুঁজেপেতে হরিবাবু জোগাড় করেছেন মিঠুর জন্মদিনের উপহার–মেকানোর বাক্স। খেলনা উপহার দিতে চান না তিনি। এমন জিনিস দেবেন, যা থেকে নিজে হাতে খেলনা তৈরি করে নিয়ে খেলতে হবে।
দাদুর মুখে পাতাল রেল বসানোর গল্প শুনতে শুনতে মিঠুর খাওয়া শুরু হল।
হাঁটুর ওপর ভর রেখে ক্রেন ঠেলতে ঠেলতে মিঠু ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেল। তার মুখ থেকে নানারকম গর্জন বেরচ্ছে।
মিঠু এখনও মুখ ধোয়নি।
দীপা উঠে দাঁড়াতেই হরিবাবু তাকে ডাকলেন, একটা কথা শোন!
জড়সড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দীপা।
–কোন গয়নাটা বেচলে? কত টাকা পেয়েছ?
দীপা জবাব দেয় না।
–চুপ করে থেকো না। আমি সবই বুঝি….
–না! দীপার গলায় একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস।
–কত টাকা দিয়েছ বাঁদরটাকে?
–এক হাজার।
–হুঁ। কাল আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যাবে। আর গয়নাটা ফেরত এনে আমায় দেবে। বুঝেছ?
–কিন্তু এভাবে আপনি কত দিন সামলাবেন?
–যত দিন বেঁচে আছি। তারপরে এমন ব্যবস্থা করে দিয়ে যাব যে, সরোজ তা ভাবতেও পারবে না। চিন্তা করো না!
.
তিন তলায় সিঁড়ির মুখে একটা পাতাবাহারের টব এনে বসাচ্ছিল দীপা। এক তলায় ঘরের দরজায় তালা লাগানোর শব্দ কানে এল। তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এল দীপা। ঠিক সাড়ে চারটে। হরিনারায়ণ হয় বাইরে বেরবেন, নয় তো ছাতে উঠবেন।
বগলে বই দেখেই দীপা বুঝল আজ আর বেরোবেন না।
–মেসোমশাই, আজ বড্ড ঠান্ডা। নিউমোনিয়ার পর ডাক্তারবাবু…
–ছাড় তো ডাক্তারদের কথা। ডিসেম্বরে ঠান্ডা পড়বে না! আর তার জন্য প্রোটেকশন কি নিইনি, দেখতে পাচ্ছ না?
হরিনারায়ণ হেসে মাথার দিকে আঙুল বাড়ালেন। মাঙ্কি ক্যাপ। পায়ে পশমী মোজা। গলাবন্ধ কোট। ধুতির নিচে ড্রয়ার।
–কিন্তু আজ আর ছাতে না বসে সরকারদের বাড়ি…
–তাই তো যাব ভেবেছিলাম। কিন্তু তোমাদের পার্টি তো চলবে রাত আটটা অবধি। অতক্ষণ ওদের বাড়িতে কাটান এমব্যারাসিং।
-তার মানে আপনি রাত আটটা অবধি ছাতে বসে থাকবেন? যতক্ষণ না বাড়ি ফাঁকা হচ্ছে?
হ্যাঁ, তাতে অসুবিধে কী! বেশি হিম পড়ছে দেখলে চিলেকোঠায় ঢুকে পড়ব। সারা জীবন পদার্থবিদ্যাকেই সুয়োরানী করে রেখেছিলাম, শেষ ক-টা বছর তাই সাহিত্য নিয়েই কাটাব ঠিক করেছি। আচ্ছা, তুমি টলস্টয়ের লেখা পড়েছ? ঠিক আছে, শেষ করেই দেব তোমায়। রেসারেকশন। ওহ্ এ এক অন্য জগৎ, বুঝলে।
হরিনারায়ণ বইটাকে হাতে নিয়ে যেন আদর করলেন। তারপর গুটিগুটি পায়ে সিঁড়ি বেয়ে ওঠা।
.
একে একে ফুলগাছের টবগুলোতে জল দিলেন হরিবাবু। শীতকালেই বেশি দরকার। ছাতে জলের ট্যাঙ্কের সঙ্গে লাগানো কলের মুখে প্ল্যাস্টিকের নল জোড়া আছে কাজেই তেমন পরিশ্রম নেই। কিন্তু আজ আর পায়চারি করতে মন চাইছে না, রেসারেকশনের আহ্বান। তা ছাড়া অসুখ থেকে ভুগে ওঠার পর একটু হাঁটাচলা করলেই যেন টায়ার্ড লাগে।
রবি, সরোজ, দীপা, দাদুভাই এদের জন্য কীভাবে কী ব্যবস্থা করে যাবেন এখনও মনস্থির করতে পারেননি। এখন আর সে সব ভাবতে ইচ্ছা করছে না। তবে দ্রুত একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে, প্রয়োজন হলে উইলটা চেঞ্জ করা দরকার।
ছাতের দরজার পাল্লা দুটো ভেজিয়ে হরিনারায়ণ দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের দেয়ালের কোনে চলে এলেন। চেয়ার পাতাই আছে।
শীতের দিন সংক্ষিপ্ত বেলা। আলোর অবশ্য ব্যবস্থা আছে। কিন্তু জ্বালাব জ্বালাব করেও ওঠা হয়নি। সুইচটা চিলেকোঠায়। নিচে থেকে শিশুকণ্ঠের হাসিখুশির একটা দমকা কোলাহল কানে এল। মিঠুর বন্ধুরা আসতে শুরু করেছে। বইটা কোলের উপর রেখে সামনের দিকে তাকালেন হরিনারায়ণ। ওদের ওই আনন্দের রাজ্যে হঠাৎ যদি তিনি ঢুকে পড়েন, কেমন হয়? আপন মনেই ঘাড় নাড়েন–না, না, এটা একটা আদর্শের প্রশ্ন। তা ছাড়া মিঠু কখনও তার দাদুভাইয়ের উপর রাগ করতে পারবে না। আবার বইয়ের পাতায়। চোখ রাখলেন।
চিলেকোঠার দরজাটা খুলে যায়। হরিনারায়ণ জানতে পারেন না। দ্রুত পায়ে কে একজন ছিটকে সরে যায়। হরিনারায়ণ তাকিয়ে থাকলেও হয়তো তাকে দেখতে পেতেন না। কারণ সে জলের ট্যাঙ্কের নিচে ঢুকে পড়েছে। লোকটা ছাতটাকে উলটোদিকে পরিক্রমা করে এসে দাঁড়ায় হরিবাবুর চেয়ারের পেছনে। সাদা চাদরে মুখ ঢাকা। খালি পা। দু-হাতে টানটান করে ধরে রয়েছে একটা লম্বা ঝাড়ন গোছের কাপড়ের ফালি।
চোখের নিমেষে কাপড়ের ফালিটা চেপে বসল হরিনারায়ণের মুখের উপর। হাত থেকে খপ করে বইটা খসে পড়ল হাতে। কড়া বাঁধনে একটা গিঁট দিয়ে লোকটা সরে এল বাঁ পাশে। কাপড়ের ফালিটা মুখ বন্ধ করলেও চোখের আধখানা ঢাকা পড়েছিল। উত্তেজনার মাথায় কাজটা নিপুণ হয়নি।
হরিনারায়ণ আধখানা দৃষ্টিতেই দেখতে লাগলেন, লোকটা পকেট থেকে দড়ি বার করে তাঁর হাত দুটো চেয়ারের সঙ্গে কষে বেঁধে ফেলেছে। এবার বস্ত্রহরণের পালা। ড্রয়ারটা খুলে নিল। সোজা। তারপর এক হাতের বাঁধন খুলে কোটের আধখানা। তারপর এ হাত বেঁধে ও হাত খুলে পুরোটা। গায়ে জামা ছিল না। দুটো গেঞ্জি। ছুরি দিয়ে চিরে ফেলল। তারপর টেনে খুলে নিল। হরিনারায়ণের বাধা দেওয়ার শক্তি ছিল না। নিশ্চিত হবার জন্য আরেকবার কষে বাঁধল মুখের বাঁধন। হাতের বাঁধন পরীক্ষা করল। কবজি থেকে খুলে নিল সোনার ঘড়িটা। কোটের পকেটগুলোয় হাত ঢুকিয়ে দেখছে, পয়সাকড়ি আছে কি না।
দলা পাকিয়ে ছাতের ওপর পড়ে রইল কোট, মোজা, ড্রয়ার ইত্যাদি। আর শুধু একফালি ধুতি পরনে সত্তর বছরের বৃদ্ধ, সদ্য নিউমোনিয়া থেকে সেরে ওঠা রোগী চেয়ে বসে আছে ডিসেম্বরের মেঘশূন্য আকাশের দিকে।
হরিবাবুকে বিশেষ শ্রদ্ধা করেন বলেই ঝন্টুমামা জন্মদিনের পার্টিতে অ্যাবসেন্ট হতে পারলেন না। হরিনারায়ণ স্বয়ং অনুরোধ করেছিলেন। মিঠুর জন্মদিনে ওরা ছবি তোলার অনুরোধ করবেই। কিন্তু ঝন্টুমামার মতো হরিবাবুও মনে করেন না, এতে শিশুমনের কোনও উপকার হয়। ঝন্টুমামার আগমন তাই শুধু ছবি তোলার সূত্র ধরে হলেও উদ্দেশ্য একটু ভিন্ন। শিক্ষামূলক। তিনি আজ পোলারয়েড ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলবেন। বোতাম টেপার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই রঙিন ছবি দেখতে পাওয়ার আনন্দ তো আছেই, সেই সঙ্গে ঝন্টুমামা ক্যামেরার কারসাজি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেবেন।
দীপার পেছন পেছন সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ঝন্টুমামা বললেন, দেরি করে ফেলিনি নিশ্চয়?
-না, না। এখনও তো বন্ধুরা সবাই এসে পৌঁছায়নি। এইখানটা একটু সাবধানে। আধখানা ধাপ। দেখুন না, ঠিক দেখে দেখে এখনই লোডশেডিংটা….
আজ মনে হয় বেশিক্ষণ ভোগাবে না। সিঁড়ির ওপরে দাঁড়িয়েই মিঠু চেঁচামেচি জুড়ে দিল, মামু এসে গেছে! মামু এসে গেছে! ঝন্টুমামা ইউনিভার্সাল মামা।
তারপরেই সে ছুটে ঢুকে গেল ঘরের মধ্যে বন্ধুদের খবর দিতে। আজকে পোলারয়েড ক্যামেরাওয়ালা মামুর জন্য ওরা সকলেই উদগ্রীব।
রঙিন কাগজ আর বেলুন দিয়ে সাজানো ঘরটা মোমবাতি আর কেরোসিনের আলোয় বেশ দেখাচ্ছে।
ঝন্টুমামাকে সবাই ঘিরে ধরেছে। এই অন্ধকারে ছবি উঠবে কি না, তা-ই নিয়ে দুশ্চিন্তা।
ঝন্টুমামা বললেন, অন্ধকারেও ছবি উঠবে। কিন্তু ছবি তুলব কি না, সেটা এখনও ঠিক করিনি।
-তা হবে না! না–না–সমস্বরে আপত্তি।
সরোজ টেবিলের ওপর উপহার সাজিয়ে রাখছিল, বলল, সে কী মশাই, এইভাবে বাচ্চাদের ডিসঅ্যাপয়েন্ট করবেন…
সরোজের কথায় কান না দিয়েই ঝন্টুমামা বললেন, ছবি তুলতে পারি একটা শর্তে–যে যে তোমাদের কেকের আধখানা আমায় দেবে–তাদের প্রত্যেককে একটা করে ছবি দেব? রাজি?
–রাজি–রাজি–রাজি
–আসলে বুঝলে, আমি একটু পেটুক লোক। তার ওপর ফ্লরির কেক দেখলে আর…
হ্যাপি বার্থডে গান জুড়েছে মিঠুর বন্ধুরা। ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ে বোঝাই যায়।
এসে গেছে–এসে গেছে–এসে গেছে–আলো এসে গেছে!
মিঠুর বন্ধুরা হাততালি আর চিৎকার জুড়ে সিইএসসিকে বাহবা জানাল।
এবার কেক কাটার আয়োজন শুরু করা যেতে পারে।
রঙিন মোমবাতি বসানো ও জ্বালানো হয়েছে। মিঠু উঠে দাঁড়িয়েছে চেয়ারে। ঝন্টুমামার চারপাশে বাচ্চাদের ভিড়। এখুনি ম্যাজিক ছবি উঠবে। মিঠু সত্যিই এক ফুয়ে নিবিয়ে দিয়েছে সব মোমবাতি। তারপরেই কোনওদিকে না তাকিয়ে একছুটে ঝন্টুমামার পাশে।
ক্যামেরা দিয়ে গুরগুর শব্দে বেরিয়ে এল চৌকো ফোটোটা। তারপর সবার চোখের সামনে দেখতে দেখতে, সেটার রংগুলো আস্তে আস্তে ফুটে উঠল। আবার হাততালি।
হাততালির শব্দ মেলাবার আগেই আবার ঝুপ করে ইলেকট্রিক আলো নিবে গেল।
আবার! আবার!–এই তো এল!–ধুত্তোর!–মিই–তুই এমন ফুঁ দিলি যে, মোমবাতি তো দূরের কথা, ইলেকট্রিক বাল্ব অবধি নিবে গেল।
নানারকম মন্তব্যের মধ্যেই ঝন্টুমামা বললেন, বোধহয় লোডশেডিং নয়! ওই তো পাশের বাড়ির আলো জ্বলছে।
দীপা বিরক্ত হয়ে বলল, ঠিক বলেছেন। উফ, ফিউজ হবার আর সময় পেল না!
সরোজকে বেরতে দেখে দীপা ডাকল, ওদিকে যাচ্ছ কোথায়? ফিউজ তো আমাকেই পালটাতে হবে। তুমি বরং এই আলোগুলো ততক্ষণে জ্বাল।
ঝন্টুমামার মনে পড়ে গেল, হরিবাবু একদিন দুঃখ করে বলেছিলেন, যেমন রবি, তেমন সরোজ। এতই অপদার্থ যে, ফিউজের তারটা অবধি পালটাতে শেখেনি। বরং দীপা–সে অনেক চালাক-চতুর। একদিন দেখিয়ে দিতেই সব শিখে নিয়েছে।
দীপা একটা কেরোসিনের আলো হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল। ফিউজ বক্সটা আছে ছাতের চিলেকোঠার ঘরে। ঝন্টুমামা দেখলেন, সরোজ কিন্তু দীপার কথা কানে তুলল না। তার আত্মসম্মানে লেগেছে। বিশেষত ঝন্টুমামার সামনে দীপা ওভাবে না বললেই পারত। দরজার বাইরে থেকে চাপা গলায় দীপা আর সরোজের মধ্যে দু-চারটে কথা কাটাকাটির আভাসও পাওয়া গেল। বাচ্চাদের অবশ্য টের পাবার কথা নয়।
ঝন্টুমামা ফ্ল্যাশ দিয়ে ছবি তুলতে শুরু করলেন। আলো নিবে যাওয়ার দুঃখ ভুলে গেছে। সবাই।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই জ্বলে উঠল আলো। সেদিকে অবশ্য কারও নজর নেই।
ঝন্টুমামা ক্যামেরায় চোখ লাগিয়েও হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। খুব ক্ষীণ শোনালেও শব্দটা যদি তিনতলার ছাত থেকে এসে থাকে, তবে সেটা বেশ জোরালো আর্তনাদ।
অনেকক্ষণ হল আলো জ্বলেছে, দীপারা কী করছে?
–দাঁড়াও তোমরা, এখুনি আসছি।
ঝন্টুমামা পা চালিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। ছাতের সিঁড়ির মাথায় আলো জ্বলছে। দু-তিন ধাপ উঠতেই ওপর থেকে দীপার গলা শোনা গেল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
সরোজ বারবার বলছে, চুপ কর! চুপ কর! বাচ্চারা জানতে পারলে ভয় পেয়ে যাবে। চট। করে গিয়ে ঝন্টুবাবুকে বরং পাঠিয়ে দাও! আমি বাবাকে ততক্ষণ…
সিঁড়ির বাঁক নেওয়ার সমতল জায়গাটায় দীপার সঙ্গে দেখা।
–মেসোমশাই! মেসো
দীপা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে গলার স্বরকে চেপে ধরে। তার ভঙ্গিতে, চোখের দৃষ্টিতে শুধু আশঙ্কা নয়, আতঙ্কের প্রকাশ।
ঝন্টুমামা চাপা স্বরে বললেন, এরকম করলে তো চলবে না। এক ঘর ছেলেমেয়ে রয়েছে। ব্যাপারটা কী?
মেসোমশাইকে ছাতে বেঁধে রেখে সব চুরি করে নিয়ে গেছে। দড়ি দিয়ে চেয়ারের সঙ্গে বাঁধা। গায়ে একফালি কাপড় নেই। এই শীতে, নিউমোনিয়ার রুগি। অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন…
–আপনি শিগগির চোখ মুছে নিচে যান। ওদের কিছু বুঝতে দেবেন না।
ছাতে উঠেই ঝন্টুমামার চোখে পড়ল, সরোজ হরিনারায়ণবাবুর উপর ঝুঁকে পড়ে কোটটা চাপা দিচ্ছে।
ঝন্টুমামার পায়ের শব্দ পেতেই সে সোজা হয়ে দাঁড়াল।
-একটু হেল্প করুন। আগে ওঁকে ঘরের মধ্যে নিয়ে যাওয়া দরকার। এই হিমের মধ্যে আর…
দু-জনে ধরাধরি করে হরিবাবুকে চিলেকোঠার ঘরে নিয়ে এল। সরোজ হরিবাবুকে কোলে নিয়ে বসে রইল। ঝন্টুমামা ছুটে নিচে নেমে গেলেন। একটা কম্বল গোছের কিছু দরকার। তা না হলে শোয়ানো যাবে না। সিঁড়িতেই দীপার সঙ্গে দেখা। সে চাদর, কম্বল ও কয়েকটা গরম জামা নিয়ে ওপরে উঠছিল।
–ওগুলো আমায় দিন। আপনি বরং বাচ্চাদের কোনও একটা ছুতোয় পাশের ঘরে নিয়ে যান। না হলে ওদের সামনে দিয়ে হরিবাবুকে নিচে নামানো…
–অত ভাবার দরকার নেই। আগে তো…
ক্ষতি যা হবার হয়েই গেছে। শুধু শুধু ওদের ভয় পাইয়ে কী লাভ?
ঝন্টুমামা ছাতে উঠে এলেন। একদৃষ্টে হরিবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। সরোজ।
–আপনি নিচে গিয়ে দীপাকে একটু সাহায্য করুন। ডাক্তারকে ফোন করা….
পুলিশকে খবর দেওয়া দরকার। এই দেখুন, সোনার টিসট ঘড়িটা হাওয়া। কতবার বারণ করেছি, পরো না…
–ঠিক আছে, সে দেখা যাবে, আপনি এখন…।
সরোজ কম্বলের ওপরে হরিনারায়ণকে শুইয়ে দিয়ে চলে গেল।
ঝন্টুমামা কোটটা টানটান করে বিছিয়ে দিল হরিবাবুর বুকের ওপর। দীপা বলেছিল, চোরেরা জামাটামা অবধি সব খুলে নিয়ে গেছে কিন্তু কোটটা তাহলে রেখে গেল কেন? কোটটা একটু সরাতেই চোখে পড়ল, গায়ে জামা বা গেঞ্জি নই। আশ্চর্য! জামা না হয় গরম কাপড়ের–দামি, কিন্তু কোটের চেয়ে গেঞ্জির দাম বেশি?
পায়ের কাছ থেকে চাদরটা একটু সরে গিয়েছিল। টেনে দিতে গিয়েই চমকে উঠলেন ঝন্টুমামা। পায়ের কাছে রক্ত কেন? ভালো করে দেখতেই বোঝা গেল, ডান পায়ের পাতার নিচে কয়েকটা জায়গা যেন তীক্ষ্ণ কিছুর আঘাতে ছড়ে গেছে।
ঝন্টুমামা উঠে দাঁড়ালেন। ছাতের দরজাটা খুলে দেখলেন বড় অন্ধকার। দীপা যে কেরোসিনের আলোটা এনেছিল, নামিয়ে রাখা আছে ঘরের মধ্যেই। সেটা হাতে নিয়ে ফিরে গেলেন।
হরিনারায়ণের চেয়ারটা যেমন ছিল, তেমনই রয়েছে। ঝন্টুমামা হাঁটু গেড়ে বসলেন, ডান হাতে আলো। বেশিক্ষণ কষ্ট করতে হয়নি। যা খুঁজছিলেন, পেয়েছেন। ভাঙা কাচের টুকরো। উঠে দাঁড়িয়ে উপরদিকে তাকাতেই চোখে পড়ল, এক ফালি কাঠের টুকরো থেকে ঝুলছে দুটো তার। আলোটা উঁচু করে ধরতেই তারের প্রান্ত দুটো চোখে পড়ল। ছিঁড়ে নোটাচ্ছে মাটিতে। বাবটা ভেঙে পড়েছিল। তার মানে, হরিবাবু বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু হোল্ডারটা কোথায়? শুধু ছেঁড়া তার দুটো… আলো হাতে একটু খোঁজাখুঁজি করতেই হোল্ডারটাও চোখে পড়ল। কিন্তু এত দূরে ছিটকে এল কী করে? কেউ যেন একটানে তার থেকে ছিঁড়ে ছিটকে ফেলে দিয়েছে… ঝন্টুমামা ফিরে এসে ফ্লেক্সিবল ওয়্যারের ছেঁড়া মুখ দুটো আলোর সামনে তুলে ধরলেন। হ্যাঁ–তারের মুখ দুটো গলে গেছে। পজিটিভ ঠেকে গিয়ে শর্ট সার্কিট।
ঝন্টুমামা সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। ছাতের পাঁচিলে কনুইয়ের ভর রেখে সিগারেট ধরালেন। একটা টান দিয়েই যেন আশ্চর্য হয়ে পড়েছেন। সিগারেটটাকে আঙুলের টোকা দিয়ে ছুঁড়ে দিলেন নিচে।
হাতটা নিচু করে আলোটা ধরেছেন, যাতে ছাতের ওপর সেটা পড়ে। কোমর ঠেকিয়ে মাথা নিচু করে কী যেন খুঁজছেন তিনি। হামাগুড়ি দিয়েই যেন কাজটা করতে পারলে খুশি হতেন।
হরিবাবুর চেয়ারের পাশেই ফুলের টবের নিচে হাত চালিয়ে তিনি একটা শ্বাস ফেললেন। অন্ধকার না হলে কাপড়ের ফালিটা নিশ্চয় চোখ এড়াত না। এই দিয়েই মুখ বেঁধেছিল।
ঝন্টুমামা ধীরপায়ে ছাত থেকে চিলেকোঠায় ফিরে এলেন। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ।
চোখে দেখার আগেই দীপার গলার আওয়াজ পেলেন।
-ঝন্টুবাবু! ডাক্তার আসছেন এখনই! ওঁকে কি নিচে নিয়ে যাবেন? ওঁকে…
-হ্যাঁ। সরোজবাবু এলেই… দাঁড়ান, একটা কথা জিজ্ঞেস করি। হরিবাবু কি রোজই ছাতে এসে বসেন?
দীপার মুখ থেকে সংক্ষেপে ব্যাকগ্রাউন্ডটা জেনে নিতে ঝন্টুমামার সময় লাগল না। ঝন্টুমামা চুপ করে শুনলেন। তারপর জানতে চাইলেন, আজ ছাতে ওঠার সময়ে হরিবাবু ঠিক কী কী পরেছিলেন, বলতে পারেন? মানে এই কোটটা ছাড়া…
–জামা ছিল। মাঙ্কি ক্যাপ। পায়ে গরম মোজা। ড্রয়ার।
–উনি গেঞ্জি পরেন না?
–পরেন বইকি। দু-দুটো করে। সুতির ওপরে গরম গেঞ্জি।
-হুঁ। তার মানে চোরে শুধু কোটটা রেখে বাকি সবই নিয়ে গেছে।
–কী বললেন?
–নাঃ, কিছু নয়। আচ্ছা হরিবাবু কি বাঁ হাতে লেখেন?
–কী করে জানলেন?
–নাঃ! আচ্ছা সরোজবাবু কোথায়?
–নিচে দাঁড়িয়ে আছে। ডাক্তারবাবু এলেই…
–তাহলে আপনি বাচ্চাদের সামলান। ডাক্তারবাবু আসুন, তারপরেই বরং ওঁকে নামাবার ব্যবস্থা করা যাবে।
দীপা নিচে নেমে যেতেই ঝন্টুমামা প্রায় ছুটে বেরিয়ে এলেন ছাতে। পাঁচিলের ওপর দিয়ে নিচে ঝুঁকে পড়ে ক্যামেরাটা তুলে নিয়ে শাটার টিপলেন। ফ্ল্যাশগান ঝলসে উঠল। তাঁর চোখ অবশ্য ক্যামেরায় নেই। আলোটাই দরকার। ঝন্টুমামা আবার একটু ছুটে এলেন ছাতের আরেক পাশে। আবার সেই একই ঘটনা। তবে এবার দেখা গেল তাঁর আর তাড়াহুড়ো নেই।
–এহ দুটো ছবি নষ্ট করলাম!
ঝন্টুমামা স্বগতোক্তি করলেন। ফ্ল্যাশগানটা স্বতন্ত্রভাবে ব্যবহার করলে এটা অফ হত না। জেনে শুনেও মানুষ ভুল করতে বাধ্য হয়, তাগিদ এমনই এক জিনিস।
ডাক্তার চৌধুরীকে নিয়ে সরোজ না-আসা অবধি একের পর এক সিগারেট ধ্বংস করে গেলেন ঝন্টুমামা। হরিবাবুর পাশেই বসে আছেন। এখনও তাঁর জ্ঞান ফেরেনি।
নমস্কার জানিয়েই ঝন্টুমামা ডক্টর চৌধুরীকে জানালেন, উনি ইলেকট্রিক শক খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছেন।
-তাই নাকি! ডাক্তারবাবু ঝুঁকে পড়লেন।
সরোজ বিস্মিত হয়ে বলল, সে কী! আপনি কী করে…
–সেটা না-হয় পরেই শুনবেন। এখন…
লজ্জিত বোধ করে সরোজ, না, মানে আগে তো কিছু বলেননি তাই…
–আগে বুঝতে পারিনি তাই।
ডাক্তার পরীক্ষা সেরে বললেন, সাবধানে ওঁকে ঘরে নামিয়ে নিয়ে যাওয়াই ভালো।
ইতিমধ্যে দীপাও এসেছে। মিঠুর বন্ধুরা চলে গেছে। মিঠুও শুয়ে পড়েছে। দীপার উৎকণ্ঠা দেখে ডাক্তার সান্ত্বনা দিলেন।–এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। মনে হয় সামলে উঠবেন।
সরোজ ও ঝন্টুমামা ধরাধরি করে হরিবাবুকে নামিয়ে আনল। ডাক্তার এখনও রয়েছেন।
সরোজ ঝন্টুমামার হাত ধরে বললেন, ভাগ্যিস আজ আপনি এসেছিলেন… না হলে…
–এখনও আপনার ধন্যবাদ দেওয়ার সময় আসেনি। ঝন্টুমামার রুক্ষ স্বরে ডাক্তার চৌধুরীও মুখ তুলে তাকালেন।
ঝন্টুমামা বললেন, সরি ডক্টর! আচ্ছা, আপনি তো কিছুক্ষণ আছেন, আমরা একটু আসছি।
চোখের ইঙ্গিতে ঝন্টুমামা দীপা আর সরোজকে বাইরে ডেকে নিয়ে এলেন, আমার কয়েকটা কথা বলার আছে। এখনই তা বলা দরকার।
চলুন, ওপরের ঘরে যাই।–দীপা ডাকল।
সরোজ একটু অস্বস্তি বোধ করছে, ডাক্তারবাবুকে বসিয়ে, আমরা…
–আপনারও কথাগুলো শোনা দরকার।
তিনজনেই ওপরে উঠে এল।
ঝন্টুমামা বললেন, ছাতে ওঠার পর ঠিক কী ঘটেছিল, সেটা আমি জানতে পেরেছি। জ্ঞান ফেরার পর হরিবাবুর মুখে ঠিক যে কাহিনি শুনবেন, সেটাই আমি বলছি–মিলিয়ে দেখার সুযোগ তো পাবেনই। ঝন্টুমামা শুরু করলেন….
কতক্ষণ কেটে গেছে খেয়াল নেই। হঠাৎ যেন তন্দ্রা ভেঙে গেল হরিনারায়ণের। যেন দুর্জয় শীতের রাত্রে হঠাৎ কে মাথায় বরফ-জল ঢেলে দিয়েছে। চোখ খুলে তাকালেন। চোখের সামনে ইলেকট্রিক আলোটা জ্বলে উঠেছে। কে জ্বালল? তাহলে কি কেউ চিলেকোঠায় এসেছে….
না। পরক্ষণেই বুঝতে পারলেন, আগে কেউ জ্বালায়নি। সুইচ দেওয়াই ছিল। লোডশেডিং থাকায় ভেবেছিলেন… কানে এল, নিচের তলায় মিঠু আর তার বন্ধুরা হাততালি দিয়ে একটানা বলে চলেছে, এসে গেছে, এসে গেছে, আলো-পাখা এসে গেছে…
ইলেকট্রিক বাবের আলোটা যেন শীতটা অসহনীয় করে তুলেছে। আলো–উত্তাপ সবই তো রয়েছে–হঠাৎ যেন বাঁচার ইচ্ছা ফিরে এল হরিনারায়ণের। কোনওভাবে দীপা মিঠু যদি জানতে পারে, তাহলেই… কিন্তু সর্বাঙ্গ যেন জ্বরে অসাড় হয়ে আসছে। যতক্ষণ না সবাই চলে যাচ্ছে, কেউ তো খোঁজ করবে না হরিনারায়ণের–কিন্তু সে তো রাত আটটা বা তারও পরে… না না, অতক্ষণ যুঝতে পারবে না হরিনারায়ণের শরীর। তার আগেই তার আগেই
হরিনারায়ণ পা নাড়াতে শুরু করলেন। চোরটা শেষ পর্যন্ত পা বাঁধার প্রয়োজন আছে। মনে করেনি। সারা পায়ে ঝিনঝিনি–একটু নাড়াতেই যেন বিদ্যুতের ঝিলিক। তা হোক– পা নাড়াতেই হবে, এই ঠান্ডাকে রুখতে হলে…
বেশিক্ষণ পা নাড়াতে পারলেন না। দম বন্ধ হয়ে আসছে পরিশ্রমে। আকুল দৃষ্টিতে তাকালেন বালবটার দিকে। যদি ওটাকে বুকের মধ্যে টেনে নামানো যেত–একটু উষ্ণতা…
হঠাৎ হরিনারায়ণের চোখে পড়ল বাটার তারের দিকে। ফ্লেক্সিবল তার থেকে ঝুলছে। নিজে হাতেই ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। প্রয়োজনে নামাবার বা এদিক-ওদিক কিছুটা সরাবার জন্য বেশি করে তার রাখা আছে কুণ্ডলী করে। বাবটা যে কাঠের বাটাম থেকে ঝুলছে, তারই ওপর।
হরিনারায়ণ বাঁ পা-টা উঁচু করলেন। আরেকটু–আরেকটু–দম ছুটে গেল। একটু অপেক্ষা করলেন। আবার চেষ্টা, কোনওরকমে বুড়ো আঙুল আর তার পাশের আঙুলের ফাঁক দিয়ে তারটাকে যদি ধরা যায়… হরিনারায়ণ বাঁ হাতে লেখেন–বাঁ পায়ের ওপরেই বেশি কন্ট্রোল।
ধরা গেল শেষ পর্যন্ত, কিন্তু রাখা গেল না। আচমকা টানে বালবটা তার সমেত আছড়ে পড়ল। আবার অন্ধকার। হরিনারায়ণ ভাবলেন, শব্দটা যদি নিচে কারও কানে যায় তবে… কোনও আশা নেই, হ্যাপি বার্থডে গান জুড়েছে সকলে মিলে বোধহয় এখন কেক কাটা হচ্ছে।
চোখ বন্ধ করে ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছেন হরিনারায়ণ। কয়েক মিনিট বাদে আবার তাকালেন পায়ের দিকে। বালবটা ভেঙে খানখান। শুধু হোল্ডারটা আর তারগুলো এলে মেলোভাবে লোটাচ্ছে। আলো আর জ্বলবে না ঠিকই, কিন্তু ওই তারগুলো এখনও মরেনি। ওগুলো এখনও সজীব। পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক নিজেকে খুঁজে পেলেন। এই শেষ চেষ্টা যদি কিছু হয় তো….
পা বাড়িয়ে তারটাকে একটু টেনে নিলেন সুবিধামতো। তারপর হোল্ডারটার মুখের বাঁ দিকে পায়ের আঙুলের ফাঁকে তারজোড়া পোরার চেষ্টা। একটু জিরিয়ে নিলেন। এবার ডান পায়ের আঙুল দিয়ে হোল্ডারটাকে হ্যাঁচকা টান–গায়ের জোরে।
হয়েছে! হয়েছে! তারজোড়া ছিঁড়ে এসেছে। ডান পায়ে কি যেন লাগল–বোধহয় ভাঙা কাচের টুকরো। লাগুক। এখন–এখন–শুধু যদি তারের মুখ দুটো একটু বেরিয়ে থাকে– মাঝে ওপরকার ইনসুলেশনের তলা দিয়ে দু-চার ফালি করে বেরিয়ে থাকে, তবেই…।
দূরের মাল্টিস্টোরি বাড়িগুলোর জানলার অতি ম্লান আলোয় ভালোভাবে কিছুই ঠাহর করা যায় না। তবু চেষ্টা তো করতে হবে। বাঁ পায়ের আঙুলের ফাঁকে আরেক গাছি তার, ডান পায়ের আঙুলের ফাঁকে আরেক গাছি তার পুরে নিয়েছেন। চেষ্টা করে যাচ্ছেন মুখে মুখে ঠেকাবার। পরিশ্রমে পা দুটো থরথর করে কাঁপে। কিছুতেই আয়ত্তে রাখা যায় না। একটু জিরিয়ে নেওয়া দরকার।
আবার চেষ্টা করেন। হচ্ছে না, হচ্ছে না–হঠাৎ চিড়িক করে একটা ক্ষীণ শব্দ কানে এল আর সেই সঙ্গে প্রচণ্ড শক খেলেন হরিনারায়ণ। হরিনারায়ণ অজ্ঞান হয়ে গেলেও জানতেন, এরপর কী ঘটবে।
নিচে থেকে ভেসে আসবে কোলাহল। আবার গেল। আবার লোডশেডিং!
লোডশেডিং যে নয়, সেটা বুঝতে অবশ্য দেরি হবে না। কারণ শুধু দোতলার আলোই নিবে যাবে। কারণ ফিউজ উড়ে যাবে–শর্ট সার্কিট হয়ে। ফিউজ পালটাতে হলে এই চিলেকোঠার ঘরেই আসতে হবে। শুধু তা-ই নয়, ফিউজ পালটাতে দীপাই আসবে।
ঝন্টুমামা আবার সিগারেট ধরালেন। দীপা মুখে আঁচল দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে!
সরোজ বললে, কিন্তু চোরগুলো…
–চোরগুলো নয়। একজন। এবং সে চোর নয়, মার্ডারার!
–কী বলছেন আপনি! আপনি তো দেখছি এক সবজান্তা মশাই!
–হ্যাঁ, তা বলতে পারেন। কারণ এমন চোরের কথা কেউ শোনেনি যে, সবচেয়ে দামি কোটটা ছেড়ে ড্রয়ার, মোজা, গেঞ্জি আর জামা নিয়ে…
–কিন্তু ঘড়িটা?
–সেটাও নিশ্চয় পাওয়া যাবে। যেমন পাওয়া যাবে ছাতের ওপর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া বেশবাসগুলো। অবশ্য সেগুলো এখন আর ঠিক ছাতের নিচে বাড়ির আশপাশে নেই। কারণ, ডাক্তার আসার জন্যে আপনি নিচে অপেক্ষা করছিলেন না। এইগুলো সরানোর এবং লুকিয়ে ফেলার জন্যই…
-মুখ সামলে কথা বলুন!
সরোজ উঠে দাঁড়িয়েছে। তার চোখে মুখে হিংস্র ভাব।
দীপা মুখ থেকে আঁচল সরিয়ে মাথা উঁচু করে তাকাল। তার চোখে আর জল নেই। চোখ দুটো একটু ছোট হয়ে এসেছে, ঠোঁটের ভাঁজে দৃঢ়তা। দীপা বলল, ঝন্টুবাবু, আমি জানি মেসোমশায়ের সোনার ঘড়িটা কোথায়! ছাতে বাবাকে ওই অবস্থায় দেখে আমি যখন আঁতকে উঠি, ও… সরোজ তখন আমায় বলল, আপনাকে ডেকে আনার জন্য। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়েই একটা শব্দ কানে এসেছিল। তখন খেয়াল করিনি। জলের ট্যাঙ্কের ঢাকনা পড়ার শব্দ। সোনার ঘড়ি ভারী দামি জিনিস–ওটাকে কি আর ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া সম্ভব… ঝন্টুবাবু, আপনি এখানে থাকুন, আমি আগে ফোনটা করে আসি।
সরোজ জানে, দীপা কোথায় ফোন করবে। ঝন্টুমামা সিগারেট ধরালেন। দীপা স্বয়ং ডিসিশনটা নিক–এইটাই তিনি চাইছিলেন। নান্য পন্থঃ। মিঠুর ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েই নিশ্চয় দীপা এতখানি শক্ত হতে পেরেছে।
[প্রথম প্রকাশ: কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান, পূজাবার্ষিকী ১৯৮৬]
Post a Comment