পিশাচ – মনোজ সেন
বেলা দুটো নাগাদ তন্ময় চ্যাটার্জি আর তাঁর স্ত্রী মনীষা মালদা শহর থেকে রূপনগর গ্রামের দিকে রওনা হয়েছিলেন। ঘণ্টা দুয়েকের রাস্তা, ওঁদের আশা ছিল যে কলকাতা থেকে ওঁদের ফিলম ইউনিটের বাস ওখানে আসবার পনেরো-কুড়ি মিনিট আগেই আরামসে ওখানে পৌঁছে যাবেন। প্রযোজকমশাই কী কী ব্যবস্থা করেছেন সেগুলো বিশদভাবে দেখে নেওয়ার দরকার ছিল। পরেরদিন সকাল ছ-টা থেকে শুটিং শুরু হবার কথা। সে সময় যেন কোথাও কোনোরকম গণ্ডগোল না-থাকে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন ছিল। খ্যাতনামা চিত্রপরিচালক তন্ময় আর তাঁর প্রোডাকশন ম্যানেজার মনীষা সময় নষ্ট করা একেবারে পছন্দ করেন না।
সেদিন রবিবার। রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা। দিগন্তবিস্তৃত আমবাগানের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে যাওয়া রাস্তা দিয়ে মধ্যমগতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলেন তন্ময় আর গুনগুন করে গান গাইছিলেন— যাবই আমি যাবই, ওগো বাণিজ্যেতে যাবই। শরতের রোদ খুব একটা গরম ছিল না বটে; কিন্তু খুব গুমোট ছিল। বিশাল বাগানের মাঝে মাঝে ছোটো ছোটো গ্রাম। তার কাছে আদুড় গায়ে বাচ্চাছেলেরা হো হো করে খেলছিল, কেউ কেউ গাছের মোটা ডাল থেকে ঝুলছিল, কেউ-বা প্রবলবেগে হাডুডু খেলতে মগ্ন ছিল। তন্ময়ের ছুটে চলা লাল মারুতিটা দেখে তারা খেলা বন্ধ করে বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়ে রইল।
তন্ময়ের পাশের সিটে মনীষা চোখ বন্ধ করে ঘুমোবার চেষ্টা করছিলেন। মালদার রাজাধিরাজ হোটেলে দুপুরের খাওয়াটা একটু রাজসিকই হয়ে গিয়েছিল। ঘুম পাওয়াই স্বাভাবিক। তবে, তিনি যদি জানতে পারতেন যে একটা ভয়ংকরদর্শন ঘন কালো মেঘের অতিকায় স্তূপ নিঃশব্দে খ্যাপা ষাঁড়ের মতো তাঁদের পেছনে ধাওয়া করে এগিয়ে আসছে, তা হলে তাঁর ঘুম নিঃসন্দেহে মাথায় উঠত।
গাড়িটা যখন আর একটা গ্রামের দিকে এগুচ্ছে, হঠাৎ সূর্য মেঘের আড়ালে চাপা পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে চারদিক এমন অন্ধকার হয়ে গেল যে তন্ময়কে বাধ্য হয়ে হেডলাইট জ্বালিয়ে দিতে হল। তার পরেই উঠল প্রচণ্ড ঝড়। ধুলোবালি আর শুকনো পাতা উড়িয়ে উন্মাদ বাতাস সোঁ সোঁ করে গর্জন করতে করতে রাস্তা দিয়ে তেড়ে এসে গাড়িটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। হেডলাইট আর মাঝে মাঝে বিদ্যুতের চোখঝলসানো আলো সত্ত্বেও, তন্ময় মাতালের মতো মাথা-ঝাঁকানো গাছগুলো আর গাঁয়ের দিকে দৌড়ে-চলা কিছু ছেলের ছায়ামূর্তি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন না।
ঝড়ের হুংকারের মধ্যে মনীষা চিৎকার করে বললেন, ‘গাড়িটা থামাও! কী করছো কী? সামনের ওই ছেলেটাকে চাপা দেবে না কি?’
তন্ময়ও একইভাবে চেঁচিয়ে বললেন, ‘সেরকম কোনো বাসনা আমার একেবারেই নেই। আসলে, আমি ওই ছেলেটিকে ফলো করছি যাতে ওর গ্রামে পৌঁছে যেতে পারি। এখানে তো গাড়িটা থামানো যাবে না। একটু বাদেই গাছের ডাল ভেঙে পড়তে শুরু করবে। তার একটা যদি এই গাড়ির ওপরে পড়ে তাহলে আমাদের বাকি জীবনটা এখানেই ক্রাচ বগলে কাটাতে হবে। সেটা কি ভালো হবে, ম্যাডাম?’
‘তোমার ফাজলামো করা বন্ধ করবে? সব ব্যাপারে তোমার রসিকতা আমার একেবারেই ভালো লাগে না, বুঝেছো?’
‘বুঝেছি। তবে কিনা, আমি মোটেই রসিকতা করছি না। আর, করবই বা কী করে? ওই ছেলেটা যে আমবাগানের ভেতর দিয়ে শর্টকাট নিল। এহেন হৃদয়বিদারক একটা দৃশ্য দেখার পর কেউ রসিকতা করতে পারে? এখন এখানে একটা আশ্রয় পাই কোথায়? কিছুই যে দেখতে পাচ্ছি না ভালো করে।’
বলতে-না-বলতেই প্রবলবেগে বৃষ্টি এল আর তার একটু পরেই গাড়ির কাচগুলো ঝাপসা হয়ে গেল। ওয়াইপর চালিয়েও কোনোই লাভ হল না। তন্ময় হতাশ গলায় বললেন, ‘বাঃ, এইটাই বাকি ছিল! এতক্ষণ যাও-বা কিছু দেখতে পাচ্ছিলুম, এখন আর তাও পাচ্ছি না। শোনো ম্যাডাম, আমি সামনের দিকে তাকিয়ে আন্দাজে চালিয়ে যাচ্ছি। তুমি সামনের কাচটা মুছতে থাকো আর চারদিক দেখতে থাকো। যদি কোনো গাছকে অসদুদ্দেশ্য নিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখ, তৎক্ষণাৎ আমাকে জানাবে।’
মনীষা কোনো কথা না-বলে গলার মধ্যে একটা ভয়ানক বিরক্তির শব্দ করে একটা রুমাল দিয়ে সজোরে সামনের কাচটা মুছতে শুরু করলেন।
হঠাৎ মনীষা চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘দাঁড়াও, দাঁড়াও! একমিনিট।’
তন্ময় গভীর মনোযোগের সঙ্গে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। চমকে উঠে চেঁচিয়ে বললেন, ‘কী, কে? কোথায়? কী হয়েছে?’
ক্রুদ্ধ মনীষা বললেন, ‘সবসময় বাড়াবাড়ি কোরো না তো। আমি শুধু একটু দাঁড়াতে বলছিলুম। এতে এত চমকে ওঠার তো কোনো দরকার নেই। ওইদিকে কয়েকটা আলো দেখতে পেলুম। একটা বড়ো বাড়ি বলে মনে হল। ওখানে হয়তো আশ্রয় পাওয়া যেতে পারে।’
ততক্ষণে তন্ময়ও আলোগুলো দেখতে পেয়েছেন। মাথা নেড়ে বললেন, ‘অবশ্য, অবশ্য।’
বড়ো বাড়িটা একটি গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র। তার গেটের ওপরে সাইনবোর্ডে লেখা— নাটোরগ্রাম সরকারি স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাকেন্দ্র। তন্ময় যখন সন্তর্পণে গাড়িটা গেটের ভেতরে ঢোকালেন, তখন বারান্দার নিওন লাইটের আলোয় দেখা গেল যে, সেখানে জনা আষ্টেক লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে।
তন্ময় বললেন, ‘ও ব্বাবা! এ যে একেবারে অভ্যর্থনা কমিটি! আমাদের জন্যই দাঁড়িয়ে রয়েছে না কি?’
মনীষা অবশ্য এ প্রশ্নের জবাব দেবার কোনো চেষ্টাই করলেন না।
অভ্যর্থনা কমিটির আটজনের মধ্যে একজন মধ্যবয়স্ক, চোখে স্টিলফ্রেমের চশমা, পরনে একটা লম্বা সাদা কোট। স্পষ্টত, তিনিই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তার। পাঁচজন শার্টপ্যান্ট পরা লম্বা-চওড়া যুবক, হাতে হকিস্টিক। তারা বোধ হয় কোথাও খেলা সেরে ফেরার পথে বৃষ্টিতে আটকা পড়েছে। আর, বাকি দু-জন নেপালি; লাঠিহাতে, খাকি হাফপ্যান্ট আর হাতকাটা সাদা গেঞ্জি পরা। তারা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দরোয়ান হবে। সকলেই অত্যন্ত উদবিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
তন্ময় আর মনীষা যখন গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে বারান্দায় উঠলেন, তাঁদের দেখে অভ্যর্থনা কমিটির সদস্যদের মুখের উদবেগ একেবারে আতঙ্কে পরিণত হল। সকলে প্রায় সমস্বরে চীৎকার করে উঠলেন, ‘এ কী? কে আপনারা? এখানে কী করছেন?’
এহেন অভ্যর্থনায় নবাগতরা বেশ ভড়কেই গেলেন।
তন্ময় আহত গলায় বললেন, ‘ঝড়বৃষ্টিতে একটু আশ্রয় নিতে এসেছিলুম। বুঝতে পারিনি যে আশ্বিনের আঙিনায় এমন একটা খ্যাপা শ্রাবণ এসে উপস্থিত হতে পারে। অন্যায় করেছি মনে হচ্ছে। চলে যাব?’
এবার ডাক্তারবাবু এগিয়ে এলেন। বিনীতভাবে বললেন, ‘না, না। সে কী কথা? এই ভয়ানক বৃষ্টির মধ্যে আপনাদের কি চলে যেতে বলতে পারি কখনো? আমাদের ব্যবহারটা হয়তো ভদ্রজনোচিত হয়নি, সেজন্য আমি আপনাদের কাছে ক্ষমা চাইছি। আসলে কি জানেন? আমরা এখন আপনাদের মতো অতিথিরা এখানে আসবেন সেটা একেবারেই আশা বা আশঙ্কা করছিলুম না।’
‘আশঙ্কা কেন?’ প্রশ্ন করলেন তন্ময়।
‘আমরা এখানে কিছুক্ষণের ভেতরেই একটা অত্যন্ত বিপদজনক ঘটনা ঘটতে পারে বলে মনে করছি। যদি সেই ঘটনা ঘটে তাহলে আপনাদের হয়তো আমরা রক্ষা করতে পারব না। আশঙ্কাটা সেইখানেই।’
মনীষা সজোরে ঢোঁক গিলে বললেন, ‘অত্যন্ত বিপদজনক ঘটনা? সে আবার কী? রক্ষা করতে পারবেন না কেন? ডাকাত পড়বে না কি?’
ডাক্তারবাবু বললেন, ‘আমার চেম্বারে আসুন। সব বলছি।’
ডাক্তারবাবুর চেম্বারটা ছোটো। তার ভেতরে একটা ছোটো টেবিল, গোটা দুয়েক চেয়ার আর একটা রুগি দেখার খাট। অতিথিদের নিয়ে ডাক্তারবাবু টেবিলে বসলেন। বললেন, ‘আমার নাম ডাক্তার সীতানাথ মণ্ডল, আমি এখানকার রেসিডেন্ট মেডিক্যাল অফিসার।’
ডাক্তারবাবু কিন্তু তাঁর অতিথিদের কোনো পরিচয় জানতে চাইলেন না। নার্ভাস কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজপত্র নাড়তে নাড়তে কোনো ভূমিকা না-করে সোজা তাঁর বক্তব্যে পৌঁছে গেলেন। তিনি বললেন যে, ‘গত চার-পাঁচ বছর ধরে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে নাটোরগ্রামে আর তার আশেপাশে আট থেকে দশ কিলোমিটারের ভেতরে যত গ্রাম আছে সেখানে। মনে হচ্ছে একটা অদ্ভুত জীবের আবির্ভাব হয়েছে এই এলাকায়। এখানকার সকলের ধারণা যে সেটা একটা পিশাচ। তার কারণ আছে। প্রথম দিকে এটা গ্রামের ভাগাড় থেকে মরা কুকুর-বেড়ালের মাংস খেত। গ্রামের লোকেরা যখন পাহারা জোরদার করল, তখন একদিন সেটা এখান থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে একটা মুসলমানদের গ্রামের বাইরে কবরখানা থেকে সদ্য গোর দেওয়া একটি মৃতদেহ তুলে তার সমস্ত জামাকাপড় খুলে নিয়ে চলে গেল। মৃতদেহটা নিয়ে যেতে পারেনি, পারলে হয়তো সেটাও খেয়ে ফেলত। পরদিন সেই দৃশ্য দেখে মুসলমানরা ক্ষেপে আগুন। গোলমাল থামাতে মহকুমাশাসক নিজে এলেন। মালদা থেকে পুলিশ ফোর্স এল। গ্রামরক্ষীদের সঙ্গে একসাথে সবাই চারদিকে অনেক খোঁজাখুঁজি করল। কিছুই পাওয়া গেল না। কী করেই বা পাবে? এই বিশাল আমবাগানের গোলকধাঁধায় ব্যাপারটা প্রশান্ত মহাসাগরে একটা ডিঙিনৌকো খোঁজার মতো হয়ে গেল।’
তন্ময় প্রশ্ন করল, ‘আপনি এইসব পিশাচ-টিশাচে বিশ্বাস করেন?’
ডা. মণ্ডল মাথা নাড়লেন। বললেন, ‘প্রথমে করিনি। আমি ভেবেছিলুম ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে একপাল নেকড়ে বা গোটা দুই নরখাদক বাঘ এদিকে চলে এসে এইসব জঘন্য কাণ্ড করছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। প্রথমত, এরকম কোনো জানোয়ারের পায়ের ছাপ ঘটনাস্থলে ছিল না। দ্বিতীয়ত, যেসব ছেলেরা আমবাগানের ভেতরে খেলে বেড়ায় বা যারা অনেক রাত্রে বাড়ি ফেরে তাদের ওপরে কখনো কোনোরকম আক্রমণ হয়নি।’
‘এই পিশাচটিকে কি কেউ দেখেছে?’
‘হ্যাঁ, দেখেছে যদিও খুব একটা স্পষ্টভাবে নয়। গভীর রাত্রে তারার আলোয় কিছু আতঙ্কিত মানুষ স্পষ্ট করে কীই-বা দেখবে বলুন? তবে যতই আবছায়া দেখে থাকুক-না কেন, তাদের দেওয়া জীবটির কতগুলো বর্ণনা কিন্তু মোটামুটি এক। তারা যা দেখেছে সেটা একটা অত্যন্ত শক্তিশালী কদাকার বাঁদর-জাতীয় কিছু, তার চওড়া কাঁধের থেকে ঝুলছে একজোড়া হাত— সে-দুটো প্রায় মাটি ছুঁয়েছে, মোটা মোটা বাঁকা বাঁকা দুটো পা আর সেটা সামনে ঝুঁকে প্রচণ্ড বেগে দৌড়য়। কেবল তার সাইজ সম্পর্কে এক একজনের এক একরকম মত। কেউ বলেছে সেটা হাতির মতো বড়ো, কেউ বলেছে প্রকাণ্ড গরিলার মতো আবার কারুর মতে সেটা একটা লম্বা-চওড়া মানুষের মতো। সম্ভবত, শেষেরটাই ঠিক।’
তন্ময় চিন্তিত মুখে বললেন, ‘মাংসাশী গরিলা-জাতীয় জীব? এ কিন্তু একেবারে অসম্ভব অবিশ্বাস্য ব্যাপার। আমার কিন্তু মনে হয়, এটা ইংরেজিতে যাকে বলে ম্যাস হ্যালুসিনেশন বা সার্বজনীন দৃষ্টিবিভ্রমের মতো কোনো ঘটনা।’
‘আমারও গোড়ায় তাই মনে হয়েছিল। এখন আর তা হয় না।’
‘বলেন কী? কেন?’
উত্তরে ডাক্তারবাবু যা বললেন সেটা রীতিমতো ভীতিজনক।
‘প্রায় মাস ছয়েক আগে, এই চিকিৎসাকেন্দ্রে হঠাৎ এক রুগি মাঝরাত্রে মারা যায়। তার বাড়ি ছিল অনেক দূরের এক গ্রামে। অত রাত্রে সেখানে খবর দেওয়া নিতান্তই অসম্ভব। অতএব স্থির করা হল যে পরদিন ভোর বেলা খবর দেওয়া হবে আর মর্গ না থাকায় রুগির আত্মীয়স্বজনরা এসে না পৌঁছোনো পর্যন্ত মৃতদেহ একটা খালি ঘরে তালাবন্ধ করে রাখা হবে। পরদিন শেষরাত্রের দিকে একটা কড়কড় আওয়াজ শুনে একজন দরোয়ান বেরিয়ে এসে দেখে যে ওই ঘরের দরজা কবজা থেকে ভেঙে উপড়ে ফেলা হয়েছে আর গ্রামবাসীদের বর্ণনা মতন একটি গরিলা-জাতীয় জীব মৃতদেহ বগলদাবা করে দৌড়ে আমবাগানের ভেতর পালিয়ে যাচ্ছে। দরোয়ান তাই দেখে চীৎকার করে ওঠে। ইটও ছুড়ে মারে। কিন্তু ইটের আঘাত উপেক্ষা করে সেটা চোখের আড়ালে চলে যায়।
এর দু-তিনদিন পর স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে প্রায় দু-কিলোমিটার দূরে একটা ঝোপের ভেতরে বিবস্ত্র মৃতদেহটি আবিষ্কার করে এক বৃদ্ধা। সে ওখানে গিয়েছিল শুকনো কাঠ কুড়োবার জন্য। মৃতদেহটা অক্ষত ছিল না। এবার মহাগণ্ডগোল শুরু হয়ে গেল। মৃতের আত্মীয়েরা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করে দিল। জজসাহেব রেসিডেন্ট মেডিক্যাল অফিসারকে তাঁর কর্তব্যে অবহেলার জন্য অত্যন্ত কঠোর সমালোচনা করলেন, তাঁর কোনো যুক্তিই শুনলেন না। স্বাস্থ্যদপ্তরের বড়োকর্তারাও তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবেন বললেন, কেবল তাঁর জায়গায় অন্য লোক পাওয়া গেল না বলে বদলি করতে পারলেন না। এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় কাজ করতে আসবেই বা কে?’
তন্ময় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এসব খবর তো কাগজে কখনো বেরোয়নি। কেন?’
ডাক্তারবাবু বললেন, ‘শহরের লোকেরা এসব খবর বিশ্বাসই করে না। জজসাহেব তো বলেই দিলেন যে কতগুলো মিথ্যে গালগল্প দিয়ে আমি আমার অপদার্থতা আর কর্তব্যে অবহেলা ঢাকতে চাইছি। কলকাতায় আমার ওপরওলাদের ধারণা যে এইসব দূরবর্তী গ্রামাঞ্চলের কুসংস্কারাচ্ছন্ন অশিক্ষিত লোকেরা, তাদের মধ্যে আমিও একজন, তাদের বুদ্ধিহীন কল্পনায় পিশাচের কাহিনিটি তৈরি করেছে। পুলিশও বিশেষ উৎসাহ দেখাচ্ছে না কারণ তাদের কারবার জ্যান্ত চোরডাকাত নিয়ে। তাদের খাতায় পিশাচ বলে কিছু নেই। তারা যে ব্যাপারটা লক্ষ করছে না তা হল— এই জীবটি প্রচণ্ড শক্তিশালী আর আজকে সে না-হয় মৃত মানুষের মাংস খাচ্ছে, কাল যদি সে নরখাদক হয়ে ওঠে তাহলে তাকে সামলানো একটি অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।’
‘এই জীবটাই যে মৃতদেহের মাংস খেয়েছে, তার কোনো প্রমাণ পেয়েছেন? হয়তো তার জামাকাপড় নেওয়াই তার উদ্দেশ্য ছিল। দেহটির শরীরে যে ক্ষতচিহ্নগুলো ছিল, সেগুলোর জন্য বাগানের ভেতরে ঘুরে বেড়ানো কুকুর বা শকুনও তো দায়ি হতে পারে?’
‘হলেই ভালো। কিন্তু এখানকার লোকেরা তা বিশ্বাস করে না।’
‘মাস ছয়েক আগে এখানে যা ঘটেছিল, আজ বোধ হয় সেরকমই কিছু ঘটার আশঙ্কা করছেন আপনারা, তাই না?’
‘ঠিক তাই। আজ দুপুরে এখানে একজন বৃদ্ধা মারা গেছেন। তীব্র হাঁপানিতে ভুগছিলেন। তাঁর আত্মীয়েরা তাঁর এক ছেলেকে এখানে রেখে নিজেদের গ্রামে গেছেন সৎকারের বন্দোবস্ত করবার জন্য। তারপরেই শুরু হয়েছে ঝড়বৃষ্টি। এখন যা অবস্থা তাতে তো কাল সকালের আগে কেউ আসতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না। ফলে, আমরা পড়েছি মহাসমস্যায়। আমরা জানি যে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে না পারলে এই বৃদ্ধার গতি আগেরজনের মতোই হবে। কিন্তু কী ব্যবস্থা নেব? পুলিশে খবর দেওয়া অসম্ভব? কারণ, প্রথমত টেলিফোন কাজ করছে না, দ্বিতীয়ত কাজ করলেও এই বাদলায় সাত কিলোমিটার রাস্তা ভেঙে তাদের আসতে বয়ে গেছে।’
‘বারান্দায় কয়েক জনকে দেখলুম। তারা কারা? ক-জন আছেন আপনারা?’
‘ওদের মধ্যে দু-জন গার্ড আর পাঁচজন নাটোরগ্রাম স্পোর্টিং ক্লাব আর গ্রামরক্ষী বাহিনীর সদস্য। একজন মৃতার আত্মীয় আর একজন অ্যাটেন্ড্যান্টও ভেতরে আছে। এই নিয়ে আমরা মোট দশজন। কোনো উপায় না-দেখে আমাদের একজন গার্ড এই বৃষ্টির মধ্যে নাটোরগ্রাম স্পোর্টিং ক্লাবের সেক্রেটারির কাছে গিয়েছিল সাহায্য চাইতে। তিনি দয়া করে পাঁচজনকে পাঠিয়েছেন। তবে আমার ধারণা এই সংখ্যাটা যথেষ্ট নয়।’
তন্ময় মাথা চুলকে বললেন, ‘দাঁড়ান, একটু ভাবি। আপনি বললেন যে দশজন যথেষ্ট নয়। একটা জিনিস পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, আপনাদের এই পিশাচটি ভূত বা প্রেতের মতো কোনো বায়বীয় পদার্থ নয়। তার একটি রক্তমাংসের শরীর আছে কারণ সে, যেরকম খাবারই হোক-না কেন, খেয়ে থাকে। ধরা যাক, এই প্রাণীটি অস্ট্রালোপিথেকাস রোবাস্টাসের মতো কোনো প্রাগৈতিহাসিক নরবানর, যে লক নেস মন্সটারের মতোই মালদার এই আমবাগানে বিজ্ঞানের যাবতীয় যুক্তিতর্ক অগ্রাহ্য করে আজও টিকে আছে। তা যদি সত্যি হয়, তাহলেও কি দশজন মিলে তাকে ঠেকানো যাবে না? তার শরীর যখন আছে, তখন কিছুটা ব্যথাবোধ অবশ্যই আছে। দশজনের হকিস্টিকের প্রহার সে সহ্য করতে পারবে?’
‘আপনার এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর আমার জানা নেই। আমার যা ধারণা আমি তাই বললুম। একটি ক্ষুধার্ত প্রাণীর মুখের গ্রাস কেড়ে নেবার চেষ্টা করলে সে কতটা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে এবং কতটা ব্যথা সহ্য করবে, তা আমি কি করে বলব, বলুন? আর সে অবস্থায় সে কতখানি উন্মত্ত ব্যবহার করবে, তাও বলা সম্ভব নয়। কাজেই, দশজন যথেষ্ট কি যথেষ্ট নয়, তা আমি জানি না। তবে, এটুকু জানি যে সে শান্তশিষ্টভাবে ফিরে যাবে না। একটা বড়ো রকমের অশান্তি হবেই। আর, এই কারণেই আমরা চাইছিলুম না যে আজ কোনো বাইরের অতিথি, বিশেষ করে একজন মহিলা, এখানে থাকুন।’
নাটকীয়ভাবে হাত নেড়ে তন্ময় বললেন, ‘আমাকে একজন বাইরের লোক ভাববেন না, ডাক্তারবাবু। আপনাদের এই দুঃসময়ে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই। যদি নেহাতই পরমন্তিশয়নে সমুসদগারিত হই, তাহলে দেখবেন যেন গিনেসেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে আমার নামটি ওঠে। কারণ বিগত সাড়ে তিন কোটি বছরের মধ্যে একটি অস্ট্রালোপিথেকাস রোবাস্টাসের হাতে নিহত আমিই হব প্রথম হোমো সেপিয়েন বা মানুষ।’
তন্ময়ের কথায় ডাক্তারবাবুর মুখের একটি রেখাও পরিবর্তন হল না। ব্যাজার মুখে বললেন, ‘হিজিবিজি কথা বলবেন না তো। আপনি যখন আমাদের পাশে থাকবেন, তখন আপনার স্ত্রী কোথায় থাকবেন, শুনি?’
‘কেন? এটাতো কোনো সমস্যা নয়। যে ঘরে মৃতদেহটা রেখেছেন, সেই ঘরে ওঁকে তালাবন্ধ করে রেখে দিলেই হবে।’
হাঁউমাউ করে চীৎকার করে উঠলেন মনীষা, ‘নাআঁআঁআঁ! তালাবন্ধ করে রেখে দিলেই হবে মানেটা কী? আমি এখানে আর এক মুহূর্তও থাকব না। আমি এক্ষুনি চলে যাব।’
‘কোথায় চলে যাবে? বাইরে কী হচ্ছে দেখছ না? অবস্থা তো আরও খারাপ হয়েছে। পিশাচের ভয়ে এখান থেকে বেরিয়ে আবার কোন চুলোয় গিয়ে আটকে পড়বে তার কোনো ঠিক আছে? সেখানে হয়তো দেখবে ভিজে ঢোল একটা বেহ্মদত্যি বা একানড়ে তোমার জন্যে অপেক্ষা করে বসে আছে। এখানে তো তাও মাথার ওপরে ছাদ আর পায়ের নীচে শুকনো মেঝে আছে। বাইরে আছে ক-জন হকিস্টিক হাতে জোয়ান ছেলে। এখানে আমি কাউকে ভয় পাই না, তা সে অস্ট্রালোপিথেকাস হোক আর পিথেক্যান্থ্রপাস ইরেক্টাসই হোক।’
ডাক্তারবাবু দুঃখিতভাবে বললেন, ‘আমার একটা কথাও আপনি বিশ্বাস করেননি, তাই না?’
‘আমি আপনার সব কথাই বিশ্বাস করেছি ডাক্তারবাবু, কেবল ওই পিশাচটুকু ছাড়া। কী জানেন, আমি অপ্রাকৃত কোনো কিছুতেই বিশ্বাস করি না। এই বিংশ শতাব্দীতে রূপকথার দত্যিদানা বা রাক্ষসখোক্কসের আর কোনো জায়গা নেই। তা ছাড়া লক্ষ করে দেখুন, এই জীবটি যে মানুষখেকো তার কোনো প্রমাণ কিন্তু নেই। সে আজ পর্যন্ত কোনো মানুষকে আক্রমণ করেনি। এখানে আসবার সময় দেখলুম, বাচ্চাছেলেরা নির্ভয়ে আমবাগানের ভেতর খেলে বেড়াচ্ছে। আমার বিশ্বাস, এই জীবটি একটি মানুষ। সে হয়তো তার বিকট চেহারার জন্য সকলের কাছে আসতে পারে না, এই বাগানের গোলকধাঁধার মধ্যে লুকিয়ে থাকে। সে সম্পূর্ণ জংলিও নয়। তার জামাকাপড়ের দরকার আছে আর সেই জন্যেই সে এখান থেকে মৃতদেহ চুরি করেছিল।
ডাক্তারবাবু বললেন, ‘সেটা একটা সম্ভাবনা যে হতে পারে না তা নয়। কিন্তু সে কথা কি আপনি স্থানীয় গ্রামবাসীদের বোঝাতে পারবেন? আপনার চিন্তাধারা খুবই মানবিক সন্দেহ নেই; কিন্তু সেটা ভুল কী ঠিক সেটা কে পরীক্ষা করে দেখবে বলুন? আপনি বোধ হয় বলতে চাইছেন যে জীবটি এখানে এলে আমাদের উচিত হবে তাকে চেয়ারে বসিয়ে বুঝিয়ে বলা যে দ্যাখো বাপু, তুমি যা করছো সেটা মোটেই ঠিক কাজ হচ্ছে না, কাজেই তুমি মানে মানে বিদেয় হও। এই তো আপনার বিশ্বাস, তাই না? কিন্তু, এহেন একটা মারাত্মক সৎ কাজ করার দুঃসাহস কি এখানে কারুর হবে?’
মনীষা বাধা দিয়ে জোরের সঙ্গে বললেন, ‘উনি কী বিশ্বাস করেন বা না-করেন, তাতে আমার কিচ্ছু যায়-আসে না ডাক্তারবাবু। আমি ওই মৃতদেহওলা ঘরে তালাবন্ধ হয়ে থাকব না, ব্যস। শোনো তন্ময়, হয় আমি তোমার সঙ্গে থাকব নইলে একাই বেরিয়ে যাব— এই কথা বলে দিলুম।’
তন্ময় বললেন, ‘কেন বলে দিলে তার কোনো কারণ দেখাতে পারো? এঁদের ওই পিশাচ আজ পর্যন্ত কোনো জ্যান্ত মানুষের গায়ে দাঁত বসায়নি। সে খামোখা তোমাকে তাড়া করতে যাবে কেন বলো দেখি? উলটে, তুমি যদি আমার সঙ্গে থাকো তাহলেই বরং লড়াইয়ের সময় কোনো উড়ন্ত ইটপাথরের আঘাতে তুমি পত্রপাঠ ধরাশায়ী হতে পারো। সেটা কি ভালো হবে?’
‘আমি তোমার ওসব ছেঁদো কথা শুনতে চাই না। আমি তোমার সঙ্গে থাকব, নইলে চললুম।’
এবার ডাক্তারবাবু বাধা দিয়ে বললেন, ‘আমি কি একটা ছোটো প্রস্তাব দিতে পারি? আপনারা এখানেই থাকুন আর একসঙ্গেই থাকুন। কিন্তু এ বাড়িতে নয়। এই কম্পাউন্ডের ভেতরেই পঞ্চাশ মিটারের মধ্যে আমার কোয়ার্টাস। ওটা আপাতত খালি আছে কারণ আমার স্ত্রী বাপের বাড়ি গেছেন। ছোট্ট বাড়ি তবে ওখানে আপনাদের কোনো বিপদের সম্ভাবনা নেই। আপনারা আজকের রাতটা ওখানেই কাটান। অবশ্য, আপনাদের কথা দিতে হবে যে, এ বাড়ি থেকে যতই চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যাক না কেন, আপনারা কোনোমতেই বাইরে বেরুবেন না। আমরা তাহলে নিশ্চিন্ত মনে যা ঘটতে চলেছে তার মোকাবিলা করতে পারব।’
মনীষা বললেন, ‘বাঃ, এতো খুব ভালো প্রস্তাব।’
‘একটা অসুবিধে আছে। আমার কোয়ার্টাসে কোনো ইলেকট্রিসিটি নেই। ঝড় শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার ছিঁড়ে গেছে। এতে চিন্তিত হবেন না। আমি স্টোর থেকে আপনাদের দুটো টর্চ আর কিছু মোমবাতি দিয়ে দেব। আমার রান্নাঘরে কিছু কলা, টমেটো আর বিস্কুট আছে। আপনারা স্বচ্ছন্দে সেগুলোর সদব্যবহার করতে পারেন। চায়ের সরঞ্জামও আছে। তাও কাজে লাগাতে পারেন।’
কৃতজ্ঞচিত্তে মনীষা বললেন, ‘আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ জানাব ডাক্তারবাবু, জানি না।’
শেষটা কিছু তর্কবিতর্কের পর তন্ময়কে রাজি হতে হল। অত্যন্ত অসন্তুষ্ট গলায় তন্ময় বললেন, ‘এবার খুশি হয়েছ তো? এঁরা এখানে উদ্দাম মজা করবেন আর আমি ওখানে বসে বসে টমেটো চিবুব। চমৎকার! এইজন্যেই আমাদের শাস্ত্রে বলেছে, পথি নারী বিবর্জিতা।’
মনীষা বললেন, ‘তোমাকে আর শাস্ত্র আওড়াতে হবে না। এখন চলো।’
ডাক্তারবাবুর থেকে চাবি নিয়ে মনীষা আর তন্ময় তাঁর কোয়ার্টাসের দিকে রওনা হলেন। সঙ্গে গেল হকিস্টিকধারী দু-জন অত্যন্ত নার্ভাস গোমড়ামুখো পালোয়ান। তাদের সঙ্গে তন্ময়ের বাক্যালাপ করার যাবতীয় চেষ্টা বৃথা গেল। তখন প্রায় সাড়ে ছ-টা বাজে। আকাশটাও ওই পালোয়ানদের মতোই গোমড়ামুখ করে ঘন কালো মেঘের আড়ালে সূর্যদেবকে ঢেকেই রেখে দিল। মেঘের অন্তরপথে কখন যে অন্ধকার থেকে অন্ধকারে দিন চলে গেছে বোঝাই গেল না। সেই অন্ধকারে আর তুমুল বৃষ্টিতে টর্চদুটো খুব কাজে লাগল।
ডাক্তারবাবুর বাড়িটা একটা গাছপালায় ঢাকা ছোট্ট একতলা বাংলো। তার একপাশে দেওয়ালের গায়ে লাগানো একটা লম্বাটে নীচু টিনের শেড, বোধ হয় বাগান করার যন্ত্রপাতি রাখার জন্য। তার ওপরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ে কর্ণবিদারি আওয়াজ হয়ে চলেছে। তন্ময় বুঝতে পারলেন যে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যত চ্যাঁচামেচিই হোক-না কেন, তার আওয়াজ এই শব্দ ভেদ করে বাংলোতে আসতে পারবে না। তার উলটোটাও যে ঘটতে পারে— সেটা তিনি কিন্তু ভেবে দেখেননি।
ওঁরা বাংলোর সামনে ঢাকা বারান্দায় ওঠার পর দুই পালোয়ান গোমড়ামুখে বিদায় নিয়ে চলে গেল। তন্ময় যখন নীচু হয়ে দরজার তালা খুলছিলেন, মনীষা বললেন, ‘আমার ইউনিটের ছেলেগুলোর জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে। কোথায় আছে, কী করছে, কে জানে!’
দরজা খুলে বাইরের ঘরে ঢুকে তন্ময় বললেন, ‘ওদের জন্য চিন্তা করো না। ওদের গণ্ডারের চামড়া। ওদের কিছু হয় না, হবেও না। সবাই ঠিকই আছে। তুমি বরং আমার জন্যে একটু চিন্তাভাবনা করো। খিদেয় পেট চুঁই চুঁই করছে। ডাক্তারবাবু বলেছেন রান্নাঘরে কলা আছে। সেগুলোর এখনই একটা ব্যবস্থা করা দরকার।’
মনীষা ঘরে ঢুকে বললেন, ‘এখনই তোমার পেট চুঁই চুঁই করে কী করে? এই তো একটু আগে দুপুর বেলা গাণ্ডেপিণ্ডে খেলে। পাঁচ পিস মাছ, স্তূপাকার মাংস, চারটে জলভরা সন্দেশ। আমি তো ভাবছিলুম যে তুমি রাত্রেও কিছু খাবে না।’
তন্ময় দরজায় ছিটকিনি দিতে দিতে বললেন, ‘চিন্তা ও দুর্ভাবনা আমাকে ক্ষুধার্ত করে তোলে। কলা চাই। কলা কোথায়?’
‘ছেলেমানুষী কোরো না তো। যথাসময়ে তোমার কলা পাবে।’
বলে মনীষা টর্চের আলো ঘুরিয়ে বাইরের ঘরটা দেখলেন। ছোটো ঘর, চুনকাম করা দেওয়াল, ফার্নিচার বলতে গোটা তিনেক প্রাচীন চেয়ার, একটা মাঝারি টেবিল, একটা ছোটো বুককেস আর দরজার পাশে একটা নীচু গদিওলা ডিভান। ডিভানটার উলটোদিকের দেওয়ালে দুটো দরজা। একটা দরজার পেছনে আর একটা ঘর— সেটাই বোধ হয় শোবার ঘর আর অন্যটা খুলছে একটা প্যাসেজে।
তন্ময় এতক্ষণ একটা মোমবাতি জ্বালাবার চেষ্টা করছিলেন কিন্তু তাঁর ভেজা দেশলাইটটা তাতে অনবরত বাধ সাধছিল।
মনীষা বললেন, ‘ওটা বাদ দাও তো। আমি এখন রান্নাঘরে যাচ্ছি, ওখানে গোটা কয়েক শুকনো দেশলাই নিশ্চয়ই পাব। স্টোভ জ্বেলে, চায়ের জলটা চড়িয়েই একটা তোমাকে দিয়ে যাব।’
তন্ময় বললেন, ‘রান্নাঘর কোথায়, তুমি জানো?’
‘ওই প্যাসেজেই কোথাও হবে। সে আমি খুঁজে নেব। তুমি বরং অন্য টর্চটা নিয়ে শোবার ঘরে যাও, ওখানেই বাথরুম থাকবে আশা করি। হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।’
‘হাত-মুখ ধোবার কী আছে? আমি যথেষ্ট ফ্রেশ আছি। আমার কলা চাই।’
‘না, হাত-মুখ না-ধুলে কলা পাবে না। আগে হাত-মুখ ধোবে তারপর প্রথমে আমরা চা-বিস্কুট খাব।’
‘উত্তম প্রস্তাব। তবে সেইসঙ্গে আমার কলা চাই।’
হাত-মুখ ধুয়ে তন্ময় যখন বাইরের ঘরে এলেন, দেখলেন মনীষা তখনও রান্নাঘর থেকে ফিরে আসেননি। ব্যাটারির বাজে খরচা বাঁচানোর জন্য টর্চটা নিভিয়ে দিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লেন। একটু পরে অধৈর্য হয়ে স্ত্রীকে ডাকতে যাবেন, হঠাৎ প্যাসেজে ধুপ ধুপ করে একটা শব্দ শুনতে পেলেন। ভারী খালি পায়ের আওয়াজ, বাইরের ঘরের দিকেই আসছে বলে মনে হল। এ তো মনীষা হতে পারে না। তন্ময়ের সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে উঠল।
শব্দটা যখন দরজার কাছে এল, তখন তন্ময় টর্চটা জ্বালালেন। তার আলোয় যে দৃশ্যটা দেখলেন তাতে তাঁর কলজেটা লাফ দিয়ে গলার কাছে উঠে এসে ধড়ফড় ধড়ফড় করতে লাগল। প্রথমেই দেখলেন একটা মুখ। অত ভয়ংকর আর কদাকার মুখ যে হতে পারে তন্ময় কোনোদিন কল্পনাই করেননি। আর তার নীচে মনীষার জ্ঞানহীন শরীর অসহায়ভাবে দুটো প্রকাণ্ড লোমশ হাতের ওপর ঝুলছে। মনীষাকে ওইভাবে নিয়ে আসছে যেটা, ওটা কি মানুষ? দেখে তো মনে হয় না। হেমেন্দ্রকুমার রায়ের লেখা ‘হিমালয়ের ভয়ংকর’-এর ছবির সঙ্গে বরং মিল আছে। মুখের গড়নে মানুষের সঙ্গে আদল আছে ঠিকই, কিন্তু ওই পর্যন্তই। তার সমস্ত কপাল আর গালভরা বড়ো বড়ো আঁচিল, বাকিটা রুক্ষ উসকোখুসকো বাদামি রঙের গোঁফ আর লম্বা দাড়িতে ঢাকা। পেশিবহুল লোমশ শরীর, প্রচণ্ড শক্তিশালী বোঝা যায়। পিঠে একটা বড়োসড়ো কুঁজ থাকার জন্য সেটা সামনে ঝুঁকে হাঁটে, সত্যিই অনেকটা কোনো প্রাগৈতিহাসিক নরবানরের মতো। দেখলে ভয় করে। তার কোমরে লুঙ্গির মতো পরা একটা অত্যন্ত রংচঙে গোলাপফুল আঁকা পুরোনো বেডকভার, যেটা স্পষ্টতই কারোর পরিত্যক্ত সম্পত্তি। তার কেবল একটা প্রত্যঙ্গই ভীতিজনক নয়, সেটা তার চোখদুটো। হিংস্র বা নৃশংস না-হয়ে তারা আশ্চর্য রকমের শান্ত আর করুণ।
তা, দানবটার চোখ যেরকমই হোক-না কেন, তাকে দেখে তন্ময় প্রায় জ্ঞান হারাতে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ সেটা কথা বলে ওঠায়, কোনোক্রমে নিজেকে সামলে নিতে পারলেন।
ঘড়ঘড়ে মোটা গলায়, কিছুটা যেন লজ্জিতভাবে থেমে থেমে দানব বলল, ‘দিদিটা অজ্ঞান হয়ে গেছে। আমি রান্নাঘরের কোনায় বসেছিলুম। দিদিটা ঘরে ঢুকে আলো জ্বালল আর আমাকে দেখেই ধপাস করে পড়ে গেল।’
হাঁকপাঁক করতে করতে তন্ময় বললেন, ‘কে, কে তুমি?’
মনীষাকে সযত্নে ডিভানে শুইয়ে দিতে দিতে দানবটা বলল, ‘জানি না তো। আমার নামটা ভুলেই গেছি। মা বোধ হয় আমাকে ছোটোবেলায় খোকা বলে ডাকত। খোকা।’
খোকা? এই ভীষণদর্শন দানবের নাম খোকা? তন্ময় হাসবেন না কাঁদবেন বুঝতে পারলেন না। কিন্তু তখন এ নিয়ে চিন্তা করবার সময় নেই। আগে মনীষার একটা ব্যবস্থা করা দরকার। দেখা গেল মনীষা বেঁচেই আছেন।
তন্ময় দানবকে বললেন, ‘খোকা, তুমি দিদির কাছে বসে থাকো তো। আমি এক্ষুনি রান্নাঘর থেকে জল আর দেশলাই নিয়ে আসছি।’
অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে দানব বলল, ‘আমি দিদির কাছে বসে থাকব?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওঁকে একলা ফেলে কোত্থাও যাবে না।’
বলতে বলতে তন্ময় দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। একটু বাদেই দুটো জলভরতি প্লাস্টিকের বোতল আর একটা দেশলাই নিয়ে ফিরে এলেন। দেখলেন সদরদরজার পাশে মেঝের ওপর দানবটা স্থির হয়ে উবু হয়ে বসে রয়েছে। তাকে দেখাচ্ছে অনেকটা আধুনিক ভাস্কর্যের ট্যাঁড়াবাঁকা বিমূর্ত মানুষের মতো।
ঝটপট একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে তন্ময় মনীষার মুখে জলের ঝাপটা দিতে শুরু করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই মনীষার জ্ঞান ফিরে এল।
চোখ খুলেই মনীষা তন্ময়কে জড়িয়ে ধরে হিঁইঁইঁইঁইঁ করে আর্তনাদ করে বললেন, ‘পিশাচ! রান্নাঘরে।’
দরজার কাছ থেকে একটা ঘড়ঘড়ে গলা শোনা গেল, ‘পিশাচ মানে কী? অনেকে আমায় তাই বলে। আমি আড়াল থেকে শুনেছি।’
আবার হিঁইঁইঁইঁইঁ। মনীষা কেঁদে উঠলেন, ‘ওরে বাবারে! পিশাচটা এই ঘরেই রয়েছে রে! ও তন্ময়, কিছু একটা করো। নইলে ওটা আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে।’
তন্ময় বললেন, ‘ও কিচ্ছু করবে না। তোমার কোনো ভয় নেই।’
ঘড়ঘড়ে গলা দুঃখিতভাবে বলল, ‘দিদি আমাকে ভয় পাচ্ছে। সবাই পায়। আমি চলে যাব?’
‘না, যাবে না।’
বলে তন্ময় খোকার দিকে তাকালেন। মোমবাতির আলোয় এই প্রথম তার সম্পূর্ণ অবয়বটা দেখলেন আর স্তম্ভিত বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন।
খোকা চোখ পিটপিট করে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হল? অমনভাবে তাকিয়ে আছো কেন? তুমিও কি আমাকে ভয় পাচ্ছ?”
‘না। কথা বোলো না তো। চুপ করে বসে থাকো।’
বলে মনীষাকে ঠেলা মেরে বললেন, ‘ওঠো, একবার তাকিয়ে দেখ।’
মনীষা দু-হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠলেন, ‘ওরে বাবারে, আমি পারব না!’
‘ধুত্তোর, পারব না। এমন সুযোগ জীবনে আর পাবে না। অন্তত আঙুলের ফাঁক দিয়ে একবার তাকিয়ে দেখ।’
অনেক ইতস্তত করে মনীষা তাই করলেন আর খোকাকে একবার দেখেই তড়াক করে উঠে বসে তন্ময়ের মতোই তার দিকে ব্যাদিত মুখে চেয়ে রইলেন।
এইবার খোকা ভয় পেল। হাত কচলাতে কচলাতে বলল, ‘তোমরা আমাকে অমনভাবে দেখছো কেন? কী করবে তোমরা? আমাকে মারবে?’
তন্ময় এই প্রশ্নের কোনো জবাব দিলেন না। মনীষাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘অসাধারণ, তাই না?’
উত্তেজিতভাবে মাথা নেড়ে মনীষা বললেন, ‘একেবারে তাই।’
‘লম্বা?’
‘একদম ঠিক।’
‘হাত-পাগুলো দেখেছ?’
‘দারুণ।’
‘এমনকী কুঁজটা পর্যন্ত ঠিক জায়গায়, তাই না?’
‘ঠিক।’
‘এ তো ফাটাবে। দারুণ ফাটাবে।’
এই বাক্যস্রোতের মধ্যে দু-একটা কথা বলবার বৃথা চেষ্টা করে দানব হতাশ হয়ে হাঁ করে দুই বক্তার দিকে তাকিয়ে রইল। স্পষ্টতই, কীসের আলোচনা হচ্ছে তার বিন্দুবিসর্গও তার বোধগম্য হচ্ছিল না। কী করেই বা হবে? অনভ্যাসের ফলে তার মগজটা দ্রুতবেগে কাজ করার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলেছিল। এদিকে তার চেহারা, শরীরের গঠন, চুলের রং ইত্যাদি নিয়ে তন্ময় আর মনীষার উত্তেজিত আলোচনা চলল বেশ কিছুক্ষণ ধরে।
অবশেষে দু-হাতে বাতাসে ঘুসি মারতে মারতে উত্তেজিত তন্ময় বললেন, ‘এইবার আমি ওই ব্যাটা লোহিতকুমার নামক উদ্ধত, অহংকারী আর লোভী ওরাং-ওটাংটাকে লাথি মারতে মারতে আমার অফিস থেকে যদি বের করে না দিয়েছি তো কি বলেছি! ব্যাটার টাকার খাঁই সুপারস্টারের মতো অথচ অভিনয় করছে না মন্তর জপছে বোঝা কঠিন।’
মনীষা সহাস্যে বললেন, ‘তা ছাড়া, পরচুলো, প্লাস্টিক মেকআপ— এসবেও কত টাকা বাঁচবে, ভেবে দ্যাখো।’
প্রবলবেগে মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে তন্ময় দানবকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি আমাদের সঙ্গে কলকাতায় যাবে, খোকা?’
এহেন একটা প্রশ্নের জন্য খোকা একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। ইতস্তত করে দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলল, ‘কলকাতা? সে যে অনেক দূর। ট্রেনে করে যেতে হয়। আমি ট্রেন দেখেছি। দূর থেকে।’
‘ট্রেনে করে নয়। তুমি আমাদের গাড়ি করে যাবে।’
‘কলকাতায় গেলে থাকব কোথায়? সেখানে অনেক গাছ আছে? আমি তো গাছের ওপরে থাকি। তাই আমাকে কেউ দেখতে পায় না।’
‘তুমি গাছের ওপরে থাকো? কোন গাছ? আম গাছ তো খুব ঘন নয়। তার ওপরে বসে থাকলে তো সবাই দেখতে পাবে।’
মাথা নেড়ে খোকা বলল, ‘আম গাছের ওপর থাকব কেন? এখান থেকে অনেকটা দূরে, যেদিক থেকে সূর্য ওঠে সেইদিকে, আমবাগানের ধারে রাস্তার পাশে একটা মস্ত বট গাছ আছে। আমি তার ওপরে থাকি। আর, তারপাশে একটা বকুল গাছের ফোকরে আমার কাপড়গুলো থাকে।’
মনীষা বললেন, ‘কলকাতায় কিন্তু গাছ নেই, শুধু বাড়ি আছে। তুমি আমাদের বাড়িতে থাকবে।’
‘তোমাদের বাড়িতে? না, না। তা কী করে হবে? তোমার ছেলেমেয়েরা আমাকে দেখলে ভয় পাবে, ভিরমি যাবে। সব ছেলেমেয়েরাই পায়।’
‘কেউ তোমাকে দেখলে ভয় পাবে না। তোমার কোনো চিন্তা নেই। এবার বলোতো আমাদের বাড়িতে তোমাকে কী খেতে দেব? কী খেতে তুমি ভালোবাসো?’
বলে দুরুদুরু বক্ষে উত্তরের অপেক্ষা করতে লাগলেন মনীষা।
যে উত্তরটা এল, সেটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল। উজ্জ্বল মুখে দানব বলল, ‘কী খেতে ভালোবাসি? কী জানি! বোধ হয় ভাত, গরম ডাল আর গোল গোল করে কাটা বেগুনভাজা। মা আমাকে দিত। সে কতদিন আগে। আমি কিন্তু এখনও ঘুমের মধ্যে দেখতে পাই, রান্নাঘরের বাইরে দাওয়ায় সাদা থালায় মা আমাকে ভাত বেড়ে দিচ্ছে।’
স্তম্ভিত মনীষা বললেন, ‘তুমি এই খেতে ভালোবাসো? তাহলে কতগুলো বিচ্ছিরি জিনিস খাও কেন?’
‘কী করব? খিদে পায় যে! আমার যখন খিদে পায়, তখন আমার পেটের ভেতরে একটা আগুন জ্বলতে থাকে, ভীষণ যন্তন্না হয়। কিছুক্ষণ বাদে আমার সব কেমন গোলমাল হয়ে যায়। আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবার পর প্রথম প্রথম আস্তাকুঁড় থেকে কুড়িয়ে খেতুম। কিন্তু গাঁয়ের লোকেরা দেখলেই তাড়া করে বলে সবসময় ওদিকে যেতে পারি না। এ ছাড়া গাছের ফল খাই নয়তো খেত থেকে শশা, কলা, মুলো তুলে নিয়ে আসি। মাঝে মাঝে একটা দোকানের পেছনের গুদোম থেকে ছাতুর বস্তা তুলে আনি, তাতে অনেক দিন যায়। খালি বাড়ির রান্নাঘর থেকেও খাবার চুরি করে খাই। কিন্তু, সে তো রোজ পাই না। একবার খিদে সহ্য করতে না-পেরে একটা মরা মেঠো ইঁদুর পুড়িয়ে খেয়েছিলুম। ভীষণ খারাপ লেগেছিল কিন্তু যন্তন্নাটা কমে গিয়েছিল। সেই শুরু হল, এখন আর ঘেন্না করে না। আমি কিন্তু এসব খেতে চাই না। কিন্তু কী করব? আমের মরশুম কেটে গেলে খাবার মতো বেশি কিছু পাই না যে! যখন আর কিচ্ছু পাই না, তখন খারাপ খাবারই খাই।’
‘তুমি কখনো মানুষের মাংস খেয়েছ?’
‘না। আমি আমার গাছের তলা দিয়ে পথচলা লোকেদের বলতে শুনেছি যে পিশাচটা মরা মানুষ খায়। এটা কিন্তু ঠিক নয়। আমি মরা মানুষের জামাকাপড় নিই, সেটা ঠিক। তাদের আর সেগুলোর কী দরকার বলো? কিন্তু, তাই বলে, না না। আমি কি বাঘ-সিংগির মতো জানোয়ার নাকি?’
‘না, না, তা হবে কেন? আচ্ছা, তোমার বাবা-মা কোথায় থাকেন?’
‘কেউ নেই। সবাই মরে গেছে। প্রথমে গেল আমার মা। আমি তখন ছোটো। বাবা নতুন মা নিয়ে এল। সে কিন্তু আমাকে ভালোবাসত না। আমাকে বলত রাক্ষস। কয়েক বছর পরে বাবাও চলে গেল। নতুন মা তখন আমাকে রোজ রোজ মারত। দুষ্টুমি না করলেও মারত। অবশ্য, ওর আর কী দোষ? আমাদের তো টাকাপয়সা ছিল না। অথচ, আমি রোজকার করতে পারতুম না। কে আমাকে কাজ দেবে বলো? তা ছাড়া আমার এই কুঁজের জন্য কোনো কাজও করতে পারতুম না।’
‘তোমার আর কোনো আত্মীয় বা বন্ধুবান্ধব নেই?’
‘না। নতুন মা তো আমাকে আমার ভাই-বোনেদের সঙ্গে মিশতেই দিত না। পাড়ার ছেলেরাও আমাকে খেলতে নিত না, রাক্ষস রাক্ষস বলে ক্ষ্যাপাত। একদিন একটা ছেলে আমাকে লোহার রড দিয়ে এমন জোরে মারল যে আমি ব্যথার চোটে তাকে একটা চড় মেরে বসলুম। অমনি সে ধুপ করে মাটিতে পড়ে গেল। মরে গেল কি না জানি না। তবে, তারপরেই সবাই ইট মেরে আমাকে গাঁয়ের থেকে বের করে দিল। বলল, ফিরে গেলে আমাকে মেরে ফেলবে। তারপর থেকে এইভাবেই আছি।’
‘তুমি এখানে লুকিয়ে ছিলে কেন?’
‘আমার গাছের তলা দিয়ে কতগুলো লোক যাচ্ছিল। তারা বলছিল কী যে এখানে একজন মারা গেছে। আমি তার কাপড় চুরি করতে এসেছিলুম।’
‘কাপড় চুরি করতে গিয়েছিলে? তাও আবার ইয়ের? কেন?
‘বাঃ, জামাকাপড় পরতে হবে না? তা, আমি সেসব পাব কোথায়, বলো? তাই কাপড় চুরি করে আনি। তবে লোকে তো এখন সাবধান হয়ে গেছে। জামাকাপড় বাইরে ফেলে রাখে না। সেইজন্যে যেখান থেকে পাই, সেখান থেকেই তুলে আনি।’
বলে খোকা ফিকফিক করে হাসতে লাগল।
তন্ময় জিজ্ঞেস করলেন, ‘হাসছো কেন?’
খোকা বলল, ‘জানো, একবার ভর সন্ধ্যে বেলায় দেখি কী, আমার গাছের তলা দিয়ে একটা ধোপা যাচ্ছে কাপড়ের বোঁচকা মাথায় করে। আমি হুপ করে তার সামনে লাফিয়ে পড়লুম। ওমনি ধোপাটা বোঁচকা ফেলে হাঁউমাউ করে, পিশাচ রে খেয়ে ফেললে রে বলে চেঁচিয়ে মেচিয়ে, ডিগবাজি খেতে খেতে পালিয়ে গেল। আমিও বোচকা নিয়ে গাছের ওপর উঠে গেলুম। তারপর আমাকে অনেকদিন আর চুরি করতে হয়নি।’
‘তুমি এ বাড়িতে ঢুকেছিলে কেন? কাপড় চুরি করতে, না খেতে?’
‘না, না। আমি তো হাসপাতালে যাচ্ছিলুম। দেখলুম সেখানে অনেক লোকজন। এই বাড়িটা খালি ছিল, তাই খিড়কির দরজা ভেঙে ঢুকে লুকিয়েছিলুম। ভেবেছিলুম, ভোররাত্রে সবাই যখন ঘুমুবে, আমি চট করে গিয়ে কাজ সারব। এখন আর সে ইচ্ছে নেই।’
সন্দিগ্ধভাবে তন্ময় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেন? ইচ্ছে নেই কেন?’
‘এখানে তোরঙ্গ ঢাকা দেওয়া এই কাপড়টা ছিল। সেটা পরে ফেলেছি। আর রান্নাঘরে অনেকগুলো কলা, টমেটো আর শশা ছিল। সেগুলো খেয়ে ফেলেছি। ব্যস, আর আমার এখন কিছু দরকার নেই।’
তন্ময় হাহাকার করে উঠলেন, ‘স—ব কলা খেয়ে ফেলেছ?’
‘হ্যাঁ। খারাপ করেছি?’
‘নাঃ, তা আর বলি কী করে? সে যাকগে। আচ্ছা, খোকা তুমি সিনেমা দেখেছ?’
খোকা পুনরায় চোখ পিটপিট করে জিজ্ঞাসা করল, ‘সিনেমা? মানে বাইস্কোপ? দেখেছি। অনেক।’
‘অনেক বাইস্কোপ দেখেছ? বলো কী? কোথায় দেখলে?’
আবার ফিকফিক করে হাসতে হাসতে, যেন একটা গুপ্তকথা ফাঁস করে দিচ্ছে এমনিভাবে খোকা বলল, ‘গাছের ওপর থেকে। শহর থেকে বাইস্কোপওয়ালারা হলদে রঙের বড়ো গাড়ি করে এসে পর্দা টাঙিয়ে বাইস্কোপ দেখায়। টিকিট কেটে দেখতে হয়। আমি কোত্থেকে টিকিট কাটব, বলো? তাই গাছের ওপর থেকে লুকিয়ে দেখি। বাইস্কোপ খুব ভালো। কত গান হয়, নাচ হয়, এক একটা বাড়ি দেখায় পাহাড়ের মতো উঁচু। জলের সাগর কী বিরাট। তাতে মস্ত বড়ো বড়ো নৌকো ভাসে। তাদের ওপর থেকে আবার কালো কালো ধোঁয়া বেরোয়, জানো? মায়ের মুখে সাগরের গল্প শুনেছি, এবার চোখে দেখলুম।’
‘তুমি ওইরকম বাইস্কোপে পার্ট করবে?’
অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে খোকা বলল, ‘পার্ট ম্যানে অ্যাক্টো করব? ওই যারা পর্দার ওপর আসে-যায়, তাদের মতো?’
‘হ্যাঁ, তাদের মতো?’
‘তুমি কি পাগল নাকি গো? আমাকে দূর থেকে দেখলেই লোকে পালায় আর অত বড়ো পর্দার ওপরে দেখলে তো সবাই ভয়ের চোটে মরেই যাবে।’
‘না, যাবে না। এমন বাইস্কোপ আছে যেখানে তোমার মতো লোকের দরকার আছে।’
‘তা হবে। কিন্তু আমাকে কে বাইস্কোপে অ্যাক্টো করতে দেবে বলো? আমি তো বাইস্কোপওয়ালাদের কাউকে চিনি না। শহরে যাইনি তো কোনেদিন।’
‘আমরা তোমাকে অ্যাক্টো করতে দেব। করবে তো? আমরা বাইস্কোপ বানাই।’
‘তোমরা বাইস্কোপ বানাও না? আমি জানতুম।’
‘তুমি জানতে? কী করে জানলে?’
খোকা সরলভাবে বলল, ‘এই দিদিটা কী সুন্দর দেখতে! একেবারে বাইস্কোপে যে দিদিরা থাকে ঠিক তাদের মতো।’
খোকার কথা শুনে মনীষা গলে জল। একগাল হেসে বললেন, ‘থ্যাঙ্ক ইউ, খোকা। তুমি তাহলে আমাদের সঙ্গে কলকাতায় আসছ তো?’
ঘাড় কাত করে খোকা বলল, ‘হ্যাঁ যাব।’
‘বাঃ, দারুণ! জানো, আমরা বাংলায় হাঞ্চব্যাক অফ নোতরদাম সিনেমা তুলছি। তুমি তাতে কোয়াসিমোদোর চরিত্রটা করবে। দারুণ মানাবে তোমাকে। যদি ছবিটা হিট করে যায়, দেখবে আরও কত জায়গায় ডাক আসবে তোমার। অনেক টাকা পাবে তুমি।’
খোকা হাঁ করে মনীষার কথা শুনছিল। কিছুই তার বোধগম্য হচ্ছিল না। কেবল শেষ কথাটা সে বুঝতে পারল। বলল, ‘আমি অনেক টাকা পাব?’
তন্ময় বললেন, ‘নিশ্চয়ই পাবে। টাকা পেলে তুমি কী করবে?’
‘চা খাব। ওই যে সবাই লাল লাল খুরিতে খায়।’
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে তন্ময় বললেন, ‘ঠিক আছে। এবার আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোনো। কাল ভোর বেলা আমরা রূপনগর বলে একটা গ্রামে যাব। তোমাকে আমাদের সঙ্গে নিতে পারব না; কারণ ওই হাসপাতালের ছেলেগুলো যদি আমাদের একসঙ্গে দেখতে পায়, তাহলে আমাদের তিনজনকেই পিটিয়ে শেষ করবে। সেজন্য, চারদিন পরে যখন আমরা ফিরব, তখন তোমাকে আমাদের গাড়িতে তুলে নেব। এখন বলো, কোথায় থাকবে তুমি?’
মাথা চুলকে খোকা বলল, ‘কোথায় থাকব? আচ্ছা বলছি। এই রাস্তার ওপরে হাসপাতাল থেকে খানিকটা দূরে একটা ভাঙা মন্দির আছে। সবাই বলে ওখানে নাকি ভূত আছে। ধারেকাছে কেউ যায় না। আমি কাল থেকে রোজ সন্ধ্যে বেলা ওখানে থাকব। তোমরা এসে ডেকো। আমি বেরিয়ে আসব।’
‘বেশ, তাই হবে।’
খোকা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘বৃষ্টি থেমে গেছে। আমি তাহলে যাচ্ছি। কেউ এসে পড়তে পারে। আমি থাকলে বিপদ হয়ে যাবে।’
বলে দরজা খুলে ঘন অন্ধকারের মধ্যে বেরিয়ে গেল।
মনীষা বললেন, ‘হয়তো ভবিষ্যতের এক বিখ্যাত অভিনেতার প্রস্থান দেখছি আমরা।’
তন্ময় মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। বললেন, ‘হ্যাঁ। আর সেইসঙ্গে প্রস্থান করল আমার একছড়া কলা।’
Post a Comment