ভাতে পড়ল মাছি – মনোজ সেন


দুপুর থেকে হিমশীতল হাওয়া বইছে, আকাশ ধূসর মেঘে ঢাকা। সন্ধ্যের আগেই অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। মনে হচ্ছে, একটু পরেই বরফ পড়তে শুরু করবে। অনীতা মুখার্জি গায়ের ওপর শালটা ভালো করে জড়িয়ে নিলেন, কিন্তু জানলার সামনে বসেই রইলেন। জানলাটা বন্ধ করবার চেষ্টা করলেন না। মুখের ওপর হিমশীতল হাওয়াটা বেশ ভালো লাগছিল। আর ভালো লাগছিল বারান্দার ওপরে লোমশ কাঠবেড়ালিদের ব্যস্তসমস্ত চলাফেরা দেখতে। শীত এসে গেছে, তাদের রসদ জোগাড় করার কাজ পুরোদমে চলেছে এখন।

ছেলের বউ সুভাঙ্গী একটু পরেই দুমদুম করতে করতে ঘরের ভেতরে এসে ঢুকল। বলল, ‘মা, একী? এই ঠান্ডার মধ্যে জানলার সামনে বসে আছেন? জানলাটা বন্ধ করে দিতে পারেননি? অসুখ বাঁধিয়ে বসবেন তো!’

বলে জানলাটা দমাস করে বন্ধ করে দিয়ে ঝড়ের বেগে বলে গেল, ‘অসুখ করলে আপনার আর কী? যত ঝামেলা তো আমাকেই পোয়াতে হবে। কিছু হয়ে গেলে আপনার ছেলে এসে আমাকেই দোষ দেবে।’

অনীতা চুপ করে রইলেন। সুভাঙ্গী আবার দুমদুম করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

বাক্যব্যয় করে লাভ কী? বছরে দু-তিনবার কয়েক দিনের জন্য এসে সুভাঙ্গী অনীতাকে সুস্থ রাখবে? তা হলেই হয়েছে। তবে মেয়েটার মনটা ভালো। পাঞ্জাবি তো, সেইজন্য কথাবার্তা একটু রূঢ়। কিন্তু, শ্বশুর আর শাশুড়ির জন্যে ওর চিন্তা বা উদবেগটা আন্তরিক।

জানলার কাচগুলো ঝাপসা হয়ে আসছিল। অনীতা তার ভেতর দিয়ে দেখলেন ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। অনীতা চোখ বুজে ইজিচেয়ারের ওপর এলিয়ে পড়লেন। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে ফেলে আসা দমদম অ্যাভেনিউর দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল।

তাঁর দিবাস্বপ্নে বাধা পড়ল। সুভাঙ্গী ঘরে ঢুকে এক গ্লাস দুধ আর দুটো বিস্কুট অনীতার ইজিচেয়ারের পাশে ছোটো টেবিলটার ওপরে রাখল। বলল, ‘খেয়ে নিন। ছ-টা বেজে গেছে।’

অনীতা বললেন, ‘রঞ্জন আর ধ্রুব এখনও এল না কেন? চিন্তা হচ্ছে। রঞ্জনের যে বয়েস হয়েছে সে কথা তো তার মনেই থাকে না। কী দরকার ছিল তার এয়ারপোর্টে যাওয়ার?’

‘চিন্তা করে কোনো লাভ আছে? এমন ঠান্ডা পড়েছে, তার ওপরে বৃষ্টি! ট্যাক্সি পাচ্ছেন না হয়তো। এয়ারপোর্ট তো কম দূরে নয়। কেন যে এই জঙ্গলের ভেতরে শহর থেকে এত দূরে বাড়ি কিনতে গেলেন, তিনিই জানেন। শহরে যখন যেতেই হবে, তখন কাছাকাছি একটা বাড়ি করলেই হত!’

অনীতা কোনো মন্তব্য করলেন না। করে লাভ নেই। সুভাঙ্গীর জন্ম, বড়ো হয়ে ওঠা, সবই বম্বেতে। কেন যে কেউ জঙ্গলের পরিবেশে থাকতে চায়, সেটা ওকে কোনোদিনই বোঝানো যাবে না।

দমদম অ্যাভেনিউও নাকি এখন শহর। অনীতার ছেলেবেলায় তার রূপ ছিল অন্যরকম। বড়ো বড়ো বাগানওয়ালা বাংলো, ঝকঝকে তারাভরা রাত্রের আকাশ, বর্ষায় ছাতিমের নেশা ধরানো গন্ধ, রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ির আওয়াজ, রাত্রি বেলা ঝিঁঝি পোকার ডাকের সঙ্গে দূরের কোনো বাংলো থেকে ভেসে আসা পিয়ানোর সুর। সেসব আজ নাকি আর নেই। শহুরে সুভাঙ্গীরা তাদের ইতিহাস বানিয়ে ছেড়েছে।

কত বছর যাননি দমদম অ্যাভেনিউতে? তা, বছর পঁচিশ তো হবেই। পনেরো বছর বয়েস হওয়ার আগেই বিয়ে হয়েছিল। তারপরে দু-তিন বছরই নিয়মিত যাওয়া হয়েছিল। পরে সেটা খুবই অনিয়মিত হয়ে যায়। যেতে ভীষণ ইচ্ছে করত, কিন্তু উপায় ছিল না। রঞ্জনের সঙ্গে দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে কালেভদ্রে দমদমের বাড়িতে যাওয়া হত। তবে, ভাগ্যক্রমে ওঁর প্রাণের বন্ধু সাবিত্রী দত্ত এখনও ওখানেই থাকে। বিয়ে থা করল না, বিন্দ্যবাসিনী কলেজে প্রফেসারি করে আর ছাত্র পড়িয়েই জীবনটা কাটিয়ে দিল। আশ্চর্য ব্যাপার হল যে, সাবিত্রীর সঙ্গে এখনও যোগাযোগ আছে, চিঠিতে। কী চিঠি লিখতে পারে! প্রত্যেক সপ্তাহে দুটো চিঠি তো আসবেই। সেইসঙ্গে আসে ফোটো। তার ফলে আজ যদি রাস্তায় সাবিত্রীর সঙ্গে দেখা হয়, তখন ওকে চিনতে অসুবিধে হবে না।

চিঠি অনীতাও লেখেন। তবে, সপ্তাহে একটা। রঞ্জন আর ধ্রুব ওঁদের চিঠি লেখা নিয়ে খুব হাসাহাসি করে।

সাতটা নাগাদ ধ্রুব বাড়িতে ঢুকল। তখন বাইরে অন্ধকার ঘন হয়ে এসেছে। অনীতার কাছে এসে বলল, ‘বাবা ফেরেনি এখনও?’

অনীতা বললেন, ‘তার মানে? তোর বাবা তো তোকে আনতেই এয়ারপোর্টে গেল। দেখা হয়নি তোর সঙ্গে?’

‘না তো। কী যে করে তার ঠিক নেই। গেল কোথায়! এমনিতে চোখে ভালো দেখে না, তার ওপরে এখন বৃষ্টি পড়ে রাস্তা এত পিছল হয়ে গেছে যে পড়ে গিয়ে হাত-পা ভাঙা মোটেই অসম্ভব নয়। এর মধ্যে কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, কে জানে! আর একটু দেখব তার পরে খুঁজতে বের হব।’

তার দরকার হল না। দরজায় ঘণ্টি বেজে উঠল।

খাওয়ার টেবিলে বসে চা খেতে খেতে কথা হচ্ছিল। উপস্থিত ছিলেন রঞ্জন মুখার্জি, অনীতা, ছেলে ধ্রুবজ্যোতি আর ছেলের বউ সুভাঙ্গী। ধ্রুব বলল, ‘তোমার আসতে এত দেরি হল কেন, বাবা?’

রঞ্জন বললেন, ‘এয়ারপোর্টে যাওয়ার পথে ভাবলুম একবার ডাক্তার চৌহানের সঙ্গে দেখা করতে যাই। ডাক্তার আমার প্রেশার আর ইসিজি নিয়ে বলল, ‘আপনি এখন কোথাও যাবেন না। দোতলায় আমার ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকুন। চেম্বার বন্ধ করে আমি আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেব। ধ্রুব যথেষ্ট বড়ো হয়েছে, চল্লিশ বছর বয়েস হতে চলল। ও নিজে নিজেই বাড়ি চলে যেতে পারবে। কোনো কথাই শুনল না।’

শুভাঙ্গী বলল, ‘ভালোই করেছেন ডাক্তার চৌহান। আচ্ছা, আপনার হার্ট যখন এত দুর্বল, তখন কেন এই পাহাড়ি জঙ্গলের মধ্যে পড়ে রয়েছেন বলুন তো? আমাদের সঙ্গে দিল্লি যেতে আপনার অসুবিধে কোথায়? আপনার ছেলের ফ্ল্যাটে তো একটা গেস্টরুম আছে। সেখানে থাকবেন। কারোর কোনো অসুবিধে হবে না।’

ধ্রুব মাথা নেড়ে বলল, ‘কোনো লাভ নেই। আমি অনেক বার বলেছি। কোনো লাভ হয়নি।’

রঞ্জন বললেন, ‘দ্যাখো সুভাঙ্গী, আমি একজন জিয়োলজিস্ট। আমার জীবনের বেশিরভাগটাই কেটেছে মাঠেঘাটে, বনেজঙ্গলে, দুর্গম জায়গায়। তা সেটা এদেশেই হোক বা বিদেশেই হোক। সেই জন্যে শহরে যত আরামেই তুমি আমাকে রাখো না কেন, আমি কিছুতেই সুস্থ থাকতে পারব না। আর তোমার শাশুড়ি বিয়ের আগে দমদমে যেখানে থাকতেন, সেটাকে তো প্রায় জঙ্গলই বলা চলে। কলকাতা শহর সেখান থেকে অনেক দূরে ছিল তখন। শুনেছি এখন আর সেসব কিছু নেই। শহর এগিয়ে গিয়ে সেই শান্ত, নির্জন পরিবেশটা গিলে খেয়ে ফেলেছে।’

সুভাঙ্গী বলল, ‘দেখুন, সবই অভ্যাসের ব্যাপার। কিছুদিন শহরে থাকলেই দেখবেন ঠিক ভালো লাগবে। শহর বা জঙ্গলের কথা নয়, আমাদের উদবেগের কারণটা তো অন্য জায়গায়। এখন আপনাদের যা বয়েস বা শরীরের অবস্থা, তাতে আপনারা একেবারে কোনো সঙ্গী ছাড়া শুধু নিজেরা থাকেন বলেই আমাদের যত চিন্তা। এই তো আমরা কাল চলে যাচ্ছি। তারপর? আবার তো আপনারা শুধু দু-জন এই নির্জন বাড়িতে। একজন রাতদিনের কাজের লোকও তো রাখতে পারেন?’

‘তা হয়তো পারি। কিন্তু সেই লোক যে আমাদের ওপর চড়াও হবে না, তার গ্যারান্টি কে দেবে?’

‘সে রিস্কটা তো আছেই। এখন ভেবে দেখুন, আপনি অসুস্থ হয়ে পড়লে, মা কিছু করতে পারবেন?’

‘কেন পারবে না? ওর ক্ষমতা যে কতটা তা তোমরা জানোই না। আরে বাবা, টেলিফোনে ডাক্তার চৌহানকে, আর তোমাদের খবর তো দিতে পারবে।’

এই আলোচনা হয়তো আরও কিছুক্ষণ চলত, কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে বাধা পড়ল, হঠাৎ দরজায় কলিং বেল বেজে উঠল।

আগন্তুক একজন পুলিশ অফিসার। বসবার ঘরে একটা সোফায় বসে বললেন, ‘আমার নাম অজয় চতুর্বেদী। আমি এখানকার এএসপি। আপনি তো মিস্টার রঞ্জন মুখার্জি আর আপনি মিসেস মুখার্জি। এঁরা দু-জন কারা?’

রঞ্জন ধ্রুব আর শুভাঙ্গীর পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘আপনি এতরাতে এইরকম ওয়েদারে আমাদের খোঁজখবর নেওয়ার জন্যই কি এসেছেন?’

চতুর্বেদী মৃদু হেসে বললেন, ‘আমি এই অসময়ে, না-বলে কয়ে চলে আসায় আপনারা বিরক্ত হয়েছেন তা তো বুঝতেই পারছি। তবে কী জানেন? আজ বিকেলে কলকাতা থেকে একটা ফাইল আমাদের দপ্তরে এসে পৌঁছেছে। সেটা পুরোটা পড়তে একটু সময় লাগল। তারপরে সময় নষ্ট না-করে এখানে চলে আসাটা খুবই জরুরি বলে মনে হল, তাই চলে এলুম।’

‘টেলিফোনটা করলেন না সে কি আরও সময় নষ্ট হবে বলে, না আমরা যাতে গা ঢাকা দিতে না-পারি, সেই জন্যে?’

চতুর্বেদী এবার হো-হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘আপনি বুদ্ধিমান লোক, আপনার দুটো সন্দেহই সঠিক।’

ধ্রুব বাধা দিয়ে বলল, ‘ব্যাপারটা কী হচ্ছে আমি তো তার কিছুই বুঝতে পারছি না। কীসের ফাইল এসেছে কলকাতা থেকে? আপনিই বা এখানে এসেছেন কেন? কোনো তদন্তের ব্যাপারে কী? কী হয়েছে যাতে ওঁরা গা ঢাকা দেবেন?’

‘আপনি কি বুঝতে পারছেন না যে আমি কেন এসেছি? কিছুদিন আগে এই বাড়িতে যে একজন অত্যন্ত বিপজ্জনক লোক এসেছিল, আপনি কি সে ব্যাপারটা কিছুই জানেন না?’

ধ্রুব খুবই বিচলিত হয়ে বলল, ‘এই বাড়িতে একজন বিপজ্জনক লোক এসেছিল? সে আবার কে? বাবা এসব কী শুনছি? কে এই লোকটা? সে এখন কোথায়? আমাকে কিচ্ছু জানাওনি কেন?’

রঞ্জন মাথা নেড়ে বললেন, ‘দূর! বিপজ্জনক কিছু নয়। তোর নকুলমামা এসেছিল এখানে মাস খানেক আগে অক্টোবরের শেষদিকে।’

‘নকুলমামা কে?’

‘তুই চিনবি না। তোর মায়ের পিসতুতো ভাই। নকুলেশ্বর গাঙ্গুলী। থাকত বিরাটিতে। আপাতত এখন বোধ হয় হাসপাতালে আছে।’

চতুর্বেদী বললেন, ‘না জেলে আছে।’

ধ্রুব বলল, ‘জেলে? জেলে কেন?’

রঞ্জন নির্বিকার মুখে বললেন, ‘তোর দাদামশাই আর দিদিমাকে জোড়াখুনের অপরাধে। তাই না, মি. চতুর্বেদী?’

ধ্রুব ধপাস করে একটা সোফার ওপরে বসে পড়ে বলল, ‘দাদামশায় আর দিদিমাকে জোড়াখুন! বাবা আমি আর সহ্য করতে পারছি না। কী হয়েছে আমাকে একটু খুলে বলবে?’

চতুর্বেদী বললেন, ‘এসব কী, মি. মুখার্জি? আপনারা ছেলেকে কিছুই জানাননি কেন?’

রঞ্জন বললেন, ‘এটা কি একটা জানাবার মতো ব্যাপার? আমাদের তরফে সবকিছু তো মিটেই গেছে। এমনিতেই তো ওর চাকরিতে সমস্যার অন্ত নেই। তার ওপরে আমাদের জীবনের এসব ছোটোখাটো ঘটনাগুলোর কথাও যদি জানাতে থাকি, তাহলে ওর জীবনে শান্তি বলে আর কিছু থাকবে? অনীতা যদি সত্যি সত্যি খুন হত, তাহলে নিশ্চয়ই খবর দিতুম।’

ধ্রুব হাহাকার করে বলল, ‘ছোটোখাটো ঘটনা?’

চতুর্বেদী বললেন, ‘সিমলার এই আবহাওয়ায় সত্যিকারের ঠান্ডা যদি কিছু থাকে তো সে আপনাদের দু-জনের মাথা। যাই হোক, আমি বলতে এসেছি যে আমাদের ইনভেস্টিগেশন কমপ্লিট। এতদিন জামিনটা ঠেকিয়ে রাখা গিয়েছিল। এইবার, আর কিছুদিনের মধ্যে আসল খুনের মামলা শুরু হয়ে যাবে। মিসেস মুখার্জির বুদ্ধি আর পরিশ্রম এ পর্যন্ত সার্থক। এখন লোকটার একটা উপযুক্ত শাস্তি হলে সবকিছু সর্বাঙ্গসুন্দর হয়।’

ধ্রুব চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমি ঘটনাটা কী ঘটেছে সেটা জানতে পারি কি?’

রঞ্জন হাত নেড়ে বললেন, ‘বলছিরে বাবা বলছি!’

চতুর্বেদী বললেন, ‘আমিও শুনি, কী বলেন? আমারও শোনা দরকার।’

নিরুত্তাপ গলায় রঞ্জন শুরু করলেন, ‘এই বছর অক্টোবরের গোড়া থেকেই কীরকম প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়েছে, তা তো জানিস। গত দশ বছরে এরকম শীত পড়েনি। এরই মধ্যে একদিন বিকেল বেলা তোর নকুলমামা এসে উপস্থিত। বেঁটেখাটো গাঁট্টাগোট্টা লোক, বয়েস পঞ্চাশের ওপরেই হবে। তাকে দেখে তোর মা তো মহাখুশি। ছোটো ভাই বলে কথা। কত পুরোনো দিনের কথা, কত প্রশ্ন।’

ধ্রুব বলল, ‘মা, তুমি জানতে না যে ওই লোকটা দাদু আর দিদিমাকে মেরেছিল?’

অনীতা বললেন, ‘জানতুম না তা বলব না। তাই তো ওকে যত্নআত্তি করে ঘরে এনে বসালুম। তবে, আমার মনের কথাটা যে ও জানত না, সেটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি।’

‘তুমি জেনেশুনে খুনে লোকটাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে এলে? ও তো তোমাকেও মেরে ফেলতে পারত।’

‘পারত মানে? ও তো আমাদের খুন করতেই এসেছিল।’

‘উফ! আমি অর পারছিনা। গোড়া থেকে বলো। কিচ্ছু বাদ রেখো না, প্লিজ!’

‘দূর পাগল, সব কি বলা যায়? কেবল আসল ঘটনাটাই গোড়া থেকে বলি। নকুল কাণ্ডটা করেছিল আমার বিয়ের প্রায় আঠারো বছর পরে। আমরা তখন বিদেশে আর তোর নিজের মামা প্রতুল বছরতিনেক হল মারা গেছে। নকুল থাকত বিরাটিতে। ওদের অবস্থা তেমন ভালো ছিল না বলে বাবা ওকে মাঝে মাঝেই টাকা দিতেন। সেইজন্যে, ও প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসত আর তাই পাড়ায় সকলের মুখচেনা ছিল। সবাই জানত যে ছেলেটা নিঃসঙ্গ প্রৌঢ় মামা-মামির দেখাশুনো করতে আসে। সকাল বেলা আসত আর দুপুর নাগাদ চলে যেত। তবে বাবা বা মা ওকে পছন্দ করতেন না। কারণ, ওর বিষয়ে অনেক খারাপ খারাপ কথা শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু, বাড়িতে আসতে বারণও করতে পারতেন না।’

‘কেন? আত্মীয় বলে?’

‘ঠিক তাই। নকুল এসে আড্ডা মারতে চাইত, কিন্তু বাবা আর মা ওকে বেশি পাত্তা দিতেন না। তাই দুপুর হলেই খেয়ে নিয়ে, টাকা পকেটে গুঁজে বেরিয়ে যেত।’

ধ্রুব রঞ্জনকে জিজ্ঞাসা করল, ‘বাবা, তুমি তো জানতে যে, যে লোকটা এসেছিল, সে একটা খুনি। তবু তাকে ঢুকতে দিয়েছিলে?’

রঞ্জন মাথা চুলকে বললেন, ‘আসলে আমি নকুলকে প্রায় চিনতুমই না। আমার বিয়ের সময় ও ছিল বছর পাঁচেকের বাচ্চা। আর তোর মামাবাড়িতে যখন যেতুম তোর দাদামশায়, দিদিমা আর মামা এমনভাবে আমাকে ঘিরে রাখতেন যে অন্য কারোর দিকে নজর দেবার সময়ই পেতুম না। তবে হ্যাঁ, ওঁরা মারা যাওয়ার পর তোর মা অবশ্য মাঝে মাঝে বলত যে নকুলকে হাতে পেলে কী সব যেন করবে। আমি খুব একটা পাত্তা দিইনি। তা ছাড়া, গত দশ বছর ও নামটা আর শুনিওনি। তোর মাও বোধ হয় ভুলতে বসেছিল। তাই, নকুল যখন এল, তখন সে যে কে, সে কথা গোড়ায় মনেই পড়েনি আমার।’

‘চমৎকার! তা, দিদিমা আর দাদামশায়ের যে অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল, সে কথাটা আমাকে জানানো দরকার মনে করোনি?’

‘তোর তখন বারো বছর বয়েস, আমাদের ছেড়ে ইংল্যান্ডে হোস্টেলে থেকে পড়াশুনো করছিস। সে সময় এই ভয়ংকর খবরটা তোকে দিলে সেটা কি ঠিক কাজ করা হত?’

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। আচ্ছা দাদামশাই তো সোনার ডিম পাড়া হাঁস, এই নকুল ব্যাটা তাঁকেই খুন কেন করেছিল, সেটা বলতে কি আজ কোনো অসুবিধে আছে?’

রঞ্জন ছেলের বিদ্রুপটা গায়েই মাখলেন না। বললেন, ‘না, তা নেই। খুন যে কেন করেছিল সেটা তো বোঝাই যায়। সম্পত্তির লোভে। উনিশ-শো সত্তরের পর থেকে কলকাতায় জমির দাম বাড়তে শুরু করে। কয়েক বছরের মধ্যেই তোর মামাবাড়ির জমির দাম দাঁড়ায় প্রায় চোদ্দো-পনেরো লাখ টাকায়। ওঁদের চিঠিতে জেনেছি যে জমি কেনবার জন্যে তখন অনেক লোক তাঁদের কাছে ঘোরাঘুরি শুরু করেছিল। কোনো কোনো আত্মীয়ও আসছিলেন দালাল হিসেবে। তাদের মধ্যে নকুল ছিল প্রধান। কিন্তু তাঁরা কিছুতেই রাজি হননি। এতেই তাঁদের বিপদ ঘনিয়ে এল।

নকুল দেখল যে মূল্যবান সময় চলে যাচ্ছে। প্রথম প্রথম সে বোধ হয় জমি বিক্রি করিয়ে তার দামের দু-তিন পার্সেন্ট দালালির টাকাতেই সন্তুষ্ট থাকতে চেয়েছিল। তোর মামার মৃত্যুর পরে সে দেখল যে তোর মাকে বাদ দিলে ওই সম্পত্তির ওয়ারিশান একমাত্র ভাগনে সে স্বয়ং। কাজেই জমি বিক্রির সমস্ত টাকাটাই সে পকেটস্থ করতে পারে। তখন তার বিবেক তাকে নিশ্চয়ই বুঝিয়েছিল যে এই সুযোগ হাতছাড়া করবার কোনো মানেই হয় না। মামা-মামির যথেষ্ট বয়েস হয়েছে, এই সময়ে তাঁদের মৃত্যু কয়েকটা দিন এগিয়ে আনলে কারোর কোনো অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।’

চতুর্বেদী বললেন, ‘ঠিকই। সে তার জবানবন্দিতে বলেছে যে তার জাল দানপত্র তৈরি করাই আছে। তাতে বলা আছে যে বৃদ্ধবয়েসে নিঃস্বার্থ সেবাযত্ন করবার জন্যে আপনার দাদামশাই ওই জমি আর বাড়ি নকুলকে দান করলেন। একমাত্র সন্তান ওঁদের মেয়ে বিদেশে থাকে, দেশে আর কোনোদিনই ফিরবে না। কাজেই সম্পত্তিটা যাতে পরিবারের ভেতরেই থাকে, তাই ওই ব্যবস্থা। তার সেবাযত্নের সাক্ষীসাবুদও জোগাড় করায় কোনো অসুবিধে নেই। কিন্তু সেই দানপত্র কোর্টে পেশ করবার আগে আটঘাট বাঁধা দরকার আর তার জন্যে জানা প্রয়োজন যে তার মামা কোনো উইল করে গেছেন কি না, করা হয়ে থাকলে কোন তারিখে, আর সেই উইল এখন কোথায় আছে। সন্ধান পেলেই সেটাকে নষ্ট করতে না পারলে জালিয়াতিটা ধরা পড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা।’

ধ্রুব বলল, ‘সেক্ষেত্রে, উইলটা হস্তগত না-করেই সে খুনটা করে বসল কেন? আর তোমরাই বা জানলে কী করে যে নকুল নামক লোকটিই খুনি?’

রঞ্জন বললেন, ‘খুলে বলি। তোর মনে আছে নিশ্চয়ই যে তুই যখন লন্ডনে স্কুলে পড়িস, তখন আমাদের কোম্পানি আফ্রিকায় কাজ করছিল। কাজ চলছিল বোৎসোয়ানার এনগামিল্যান্ড জেলার রাজধানী মওন থেকে প্রায় এক-শো কিলোমিটার দূরে, সাম্বি শহর আর ওকাভাঙ্গো জলাভূমির মাঝামাঝি একটা দুর্গম জায়গায়। আমরা থাকতুম সাম্বিতে। কলকাতায় সকলের কাছে আমাদের লন্ডন অফিসের ঠিকানা দেওয়া ছিল। সেখান থেকে এ ঘটনার খবর দিয়ে তোর ছোটোকাকা সঞ্জয়ের আর নকুলের বাবা সুশীলবাবুর দুটো টেলিগ্রামের টেলেপ্রিন্টার মেসেজ যখন সাম্বিতে তোর মা-র কাছে পৌঁছোয়, তখন আটদিন কেটে গেছে। আমি ছিলুম সাইটে, সাম্বিতে ফিরে আসি রাত্রি বেলা। তোর মা টেলিগ্রামটা পায় দুপুর বেলা। মাঝের সময়টুকু ও যে কীভাবে কাটিয়েছিল আমি জানি না। আমাকে দেখেই অসুস্থ হয়ে পড়ল।

তোর ছোটোকাকার টেলিগ্রামে লেখা ছিল ওঁদের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে, পুলিশ তদন্ত করছে আর বাড়িটা সিল করে দিয়েছে। সুশীলবাবু লিখলেন যে, ঘটনাটা আত্মহত্যার, উনি দেখাশুনো করছেন, সব ব্যবস্থা ঠিকঠাক চলছে, চিন্তার কোনো কারণ নেই। তবে আমরা যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কলকাতায় চলে যাই। তার পরদিনই এল দুটো চিঠি সেই লন্ডন ঘুরে। একটা তোর দিদিমার। তাঁর চিঠিতে জানা গেল যে সুশীলবাবু আর নকুল এসেছিল কোনো জমিজমা সংক্রান্ত আলোচনা করতে, কোনো কারণে তোর দাদামশায় হঠাৎ ভীষণ রেগে যান এবং দু-জনকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। কেন যে উনি অত রেগে গিয়েছিলেন, সে ব্যাপারে কোনো কথা বলতে রাজি হচ্ছেন না।

আর একটা চিঠি এল সাবিত্রীর। তাতে সে লিখেছিল যে ঘটনার পরদিন ভোররাত্রে সে নকুলকে দেখেছিল তোর দাদামশায়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে। এই দুটো টেলিগ্রাম, তোর দিদিমার চিঠি আর সাবিত্রীর চিঠি থেকে একটা কথা বোঝা গেল যে, পূর্বপরিকল্পিতই হোক বা রাগের মাথায় হোক— খুনটা করেছে নকুল, আর তার উদ্দেশ্য হল দমদমের জমিটা কবজা করা। এটাও বোঝা গেল যে যেদিন ও কাণ্ডটা করে, সেদিন নকুল তোর মামাবাড়িতে বোধ হয় রাত্রি বেলা এসেছিল। রাস্তায় ওকে কেউ দেখে থাকলেও খেয়াল করেনি। কাজের লোক বিষ্ণুপদ থাকত বাংলো থেকে অনেকটা দূরে আউটহাউসে। সে কিছুই টের পায়নি। পরদিন খুব ভোরে নকুল যখন বেরিয়ে যাচ্ছে তখন সাবিত্রী ওকে দেখেছিল বটে কিন্তু কোনো সন্দেহই করেনি।’

ধ্রুব বলল, ‘তুমি তখন কী করলে?’

‘আমি সঙ্গে সঙ্গে তোর মাকে নিয়ে চলে গেলুম মওনে। সেখানে ওকে হাসপাতালে ভরতি করে দিয়ে আমাদের ফিল্ড অফিসের ফোন নিয়ে বসে পড়লুম। সেই সত্তরের দশকে পৃথিবীর যেকোনো জায়গা থেকে কলকাতার ফোন পাওয়া যে কী একটা বিভীষিকা ছিল তা তোরা আজ কল্পনাও করতে পারবি না। তবে, আমাদের কপাল ভালো যে প্রায় ঘণ্টাচারেক ধস্তাধস্তির পর সঞ্জয়কে পাওয়া গেল। সব শুনে সঞ্জয় বলল যে, আমরা যেন তখন কলকাতার দিকে কোনোক্রমেই না-যাই। শান্তি স্বস্তয়ন যা হওয়ার হয়ে যাবে। তা ছাড়া তখন গেলে তোর মায়ের সমূহ বিপদের সম্ভাবনা। আর তোর দিদিমার চিঠিটার একটা ফোটোকপি যেন তৎক্ষণাৎ ওর কাছে পাঠিয়ে দিই। সেটা ও পুলিশকে দেবে যাতে তাদের তদন্তে সুবিধা হয়। সাবিত্রীর চিঠিটা গোপন রাখতে বলল, সেটা যথাসময়ে প্রকাশ করলেই হবে। তোর দিদিমার চিঠির ওপরে নকুলকে শাস্তি দেওয়া যাবে না। মাঝখান থেকে সাবিত্রী ভীষণ বিপদে পড়ে যাবে।

একেই বলে উকিলি বুদ্ধি। সত্যিই নকুলের কিছুই হল না, তবে চটপট দমদমের জমিটা দখল নিতেও ওর সাহসে কুলোল না। আমি একটা পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি সঞ্জয়কে পাঠিয়ে দিলুম যাতে সে ওই বাড়িটা ‘জনকল্যাণ মিশন’-কে ভাড়া দিয়ে দিতে পারে। পরে তোর মা সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলে আমরা একদিন চলে গেলুম ফ্রান্সিসটাউনে। সেখানে প্রফুল্ল ভট্টাচার্য বলে একজন বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। তিনি পুরোহিত বংশের ছেলে। তিনিই শ্রাদ্ধ করলেন তোর দিদিমা আর দাদামশায়ের। আমি এসবে বিশ্বাস করি না; কিন্তু তোর মা শান্তি পেয়েছিল।’

ধ্রুব বলল, ‘সেই ঘটনার পর আজ সাতাশ বছর কেটে গেছে। এরমধ্যে একবারও কলকাতায় যাওনি কেন? এত বছর ধরে নকুল তোমাদের মারবার জন্যে বসেছিল? ভারি আশ্চর্য ব্যাপার!’

‘মোটেই আশ্চর্য নয়। এই সাতাশ বছরে ওই জমির দাম বাড়তে বাড়তে আজ কোটি ছাড়িয়েছে; আর সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে নকুলের লোভ, অধৈর্য আর জিঘাংসা। তবে হ্যাঁ, একটা কথা স্বীকার করতেই হবে যে, আমি প্রথম কয়েক বছর কলকাতায় যাইনি তোর মা-র কথা ভেবে। কারণ, নানা জায়গা থেকে খবর পাওয়া যাচ্ছিল যে নকুলেশ্বর আর তার বাবা আমাদের হন্যে হয়ে খুঁজছে। অবশ্য আমাদের ধরা তাদের সাধ্যাতীত ছিল, কারণ তুই তো জানিস, এই সাতাশ বছরের মধ্যে আমরা পাঁচ বছর থেকেছি আফ্রিকায়, সাত বছর থেকেছি জার্মানি, রুমানিয়া আর বুলগেরিয়ায়, চাকরি জীবনের শেষ পাঁচ বছর থেকেছি লন্ডনের হেড অফিসে আর রিটায়ার করে গত দশ বছর এখানে। এখানকার ঠিকানা জানে একমাত্র সঞ্জয় আর সাবিত্রী। আমরা এখানে কিন্তু ভালোবেসেই আছি। নকুলের কাছ থেকে লুকিয়ে, তা নয়। সে তো আমাদের স্মৃতি থেকে প্রায় সরেই গিয়েছিল। তবে, এখন দেখছি যে গোড়ার দিকে যে সাবধানতাগুলো নিয়েছিলুম তার কোনো দরকারই ছিল না। তোর মা বুড়ো হাড়ে যে ভেলকি দেখাল, সেই ক্ষমতার কথা তখন আমার জানা ছিল না।’

কলকাতায় আমাদের না-যাওয়ার আর একটা কারণ, কলকাতার প্রতি আমাদের দু-জনের কারোরই বিশেষ কোনো টান ছিল না কোনোদিন। তোর মা সেই সময়কার কলকাতায় দু-তিনবার হয়তো গেছে, আমিও তাই। আর আমি তো প্রবাসী বাঙালি। দমদমের প্রতি আমাদের টান ছিল যে তিনজনের জন্যে, তাঁরাও তো কেউ আর নেই তখন। ওই বাড়িতে তোর মায়ের গিয়ে থাকা আর সম্ভব ছিল না।’

ধ্রুব হাত নেড়ে বলল, ‘সে আমি জানি। নকুল তোমার ঠিকানা পেল কী করে?’

‘আমার খুড়তুতো বোন শেফালির কলকাতায় বিয়ে হয়েছে। সে সিমলায় বেড়াতে এসে আমাকে কোথায় যেন দূর থেকে দেখতে পায়। কিন্তু যোগাযোগ করতে পারেনি, ঠিকানাও জোগাড় করতে পারেনি। এই খবরটা নকুলেশ্বরের কানে ওঠে। সে পত্রপাঠ সিমলায় চলে আসে। এখানকার ঠিকানা পায় কালীবাড়ির সেক্রেটারি দিলীপের কাছে।’

‘মা কী ভেলকি দেখাল?’

রঞ্জন মৃদু হেসে বললেন, ‘অক্টোবরের শেষ দিকে নকুল আমাদের বাড়িতে আসে বিকেল বেলা। তখন করণ, মানে ডাক্তার চৌহান আর আমার বন্ধু ঘোড়াচৌকির রামকিশোর পুরি এখানে ছিল। নকুলকে দেখে তোর মা এত খুশি হল আর রাত্রে থেকে যাওয়ার জন্যে এমন পীড়াপীড়ি করল যে, আমার মনে হল এ নিশ্চয়ই সেই নকুল নয়, অন্য কেউ। বাঙালিদের মধ্যে একাধিক নকুলেশ্বর থাকতেও পারে। তখন একেবারেই বুঝতে পারিনি যে তোর মা ওকে দেখেই কী প্ল্যান ছকে ফেলেছে।

নকুল থেকে যেতে রাজি হল। ও বোধ হয় ভেবেছিল যে বুড়োবুড়ি যখন একা থাকে তখন কাজটা নিতান্তই সহজ হবে। রাতের খাওয়াটা ছেড়ে দেওয়াটা কোনো কাজের কথা নয়। বিশেষত এই ঠান্ডায় এরকম বাড়ির গরম খাবার পাবে কোথায়? সারারাতই তো পড়ে আছে। কাজেই খেয়েদেয়ে ধীরে আস্তে কাজ সারলেই হবে। আর, তোর মায়ের খুশি হওয়া দেখে এটাও সে স্পষ্ট বুঝেছিল যে দমদমের ঘটনায় ওকে যে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, সেসব কথা আমরা কিছুই জানি না। কাজেই, বিপদের কোনো সম্ভাবনা নেই। কিংবা হয়তো এটাও ভেবেছিল যে উইলটা একবার হস্তগত করে সরে পড়তে পারলে খুনখারাবি না করলেও চলবে।’

চতুর্বেদী বললেন, ‘আমার তা মনে হয় না। আপনারা বেঁচে থাকলে, মামলামোকদ্দমা তো হতই। সেক্ষেত্রে তার পক্ষে নিশ্চিন্তে প্রপার্টিটা ভোগদখল করা সম্ভব হত না।’

ধ্রুব বলল, ‘তারপরে কী হল?’

‘তোর মা যে কিছু করতে যাচ্ছে, সেটা বুঝতে পারলুম যখন করণ চলে যাবার সময়, তাকে বলল— ঠিক একঘণ্টা বাদে একবার এখানে আসতে পারবে, ডাক্তার? কেন, সেটা এলেই বুঝতে পারবে। এখন কোনো প্রশ্ন করবে না। কিন্তু ঠিক একঘণ্টা বাদে। তার আগেও নয়, পরেও নয়।’

করণকে তো জানিস। ভীষণ রহস্যপ্রিয় লোক। সে মহাখুশি আর উত্তেজিত হয়ে, ‘অবশ্যই আন্টি, অবশ্যই’ বলতে বলতে চলে গেল।

করণ আর রামকিশোর চলে যাওয়ার পর গল্প শুরু হল। সামান্য কিছু একথা-সেকথার পরেই থলে থেকে বেড়াল বেরোল। নকুল বলল যে দমদমের বাড়িটা জনকল্যাণ মিশনকে ভাড়া দেওয়াটা মোটেই ঠিক কাজ হয়নি। ওটা আমরা আর কোনোদিনই ফেরত পাব না। এইসব সমিতিগুলো নামেই মানুষের সেবা করে, আসলে এদের উদ্দেশ্য লোকেদের বাড়িঘর জমিজমা আত্মসাৎ করা। সময় নষ্ট না-করে এক্ষুনি ওদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা দরকার। তা, সেই কাজের ভার নকুল নিতে পারে তার মামার প্রতি কৃতজ্ঞতাবশত। তবে, তার জন্যে মামা যদি কোনো উইল করে গিয়ে থাকেন, তার দলিলটা দরকার হবে।

তাই শুনে তোর মা মহাখুশি হয়ে বলল যে নকুল যদি ভার নেয় তবে তো আর কোনো কথাই নেই। আর, উইল আছে এবং সেটা কাল সকালেই নকুলকে দেওয়া যাবে। এক্ষুনি দেওয়া যাচ্ছে না তার কারণ সেটা আছে আমাদের অ্যাডভোকেট রাকেশ খুরানার কাছে। কালীবাড়ির কাছেই তার চেম্বার। কাল সকালে একটা গাড়িভাড়া করে সবাই মিলে চলে যাওয়া যাবে। নকুল রাজি হল।’

ধ্রুব বলল, ‘রাকেশ খুরানা আবার কে? এর তো কখনো নাম শুনিনি। উইলটা কি সত্যিই তার কাছে আছে?’

‘রাকেশ খুরানা বলে একজনকেই আমার জানা আছে, সে রামকিশোরের ড্রাইভার। আর উইলটা আছে তোর মায়ের লোহার আলমারিতে। তারপরে শোন। তখন বৃষ্টিটা থেমেছে। পশ্চিম দিকের পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে শেষবেলাকার আলো একটু একটু দেখা যাচ্ছে। তোর মা আমাকে বলল যে তুমি নকুলকে নিয়ে আমাদের বাগানটা একটু দেখিয়ে এসো আর আসবার সময় বাগানের ঘর থেকে কিছু কাঠ নিয়ে এসো। উনুন ধরাতে হবে। তারপরে নকুলকে গেস্টরুমটা দেখিয়ে দিতে বলল।

হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো তোর মায়ের প্ল্যানটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। প্রথমত আমাদের বাগানে বছরের এই সময়ে এই ওয়েদারে দেখাবার মতো কিছুই থাকে না। দ্বিতীয়ত গত বছরদেড়েক হল আমাদের বাড়িতে ঘর গরম করবার জন্যে বা উনুন জ্বালাবার জন্যে আর জ্বালানি কাঠের দরকার পড়ে না, সবকিছু হয় ইলেকট্রিকে এবং তৃতীয়ত বাগানের ঘরে যে ক-টা জ্বালানি কাঠ পড়ে আছে, সেগুলো স্বভাবতই বৃষ্টির ছাঁটে অল্প-অল্প ভিজে আছে। নকুলের কাছে অবশ্য কিছুই অস্বাভাবিক লাগেনি কারণ এসব তার জানবার কথা নয়।’

ধ্রুবর মুখে একটা চাপা হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘বুঝেছি, বলে যাও।’

‘আমি নকুলকে বাগানটা ঘুরিয়ে দেখিয়ে, আমাদের লোহার হুইল ব্যারোটাতে চাপিয়ে কিছু কাঠ নিয়ে এলুম। তোর মা নকুলকে বলল যে কলকাতা থেকে দিল্লি হয়ে কালকা আর সেখান থেকে সিমলা আসতে তার নিশ্চয়ই খুব ধকল গেছে আর চানটানও হয়নি। গেস্টরুমের বাথরুমে জলের বালতিতে ইমার্শন হিটার দেওয়া আছে। সেই ঘরম জলে সে যেন অবশ্যই চান করে নেয়। তারপর ফ্রেশ হয়ে গল্প করতে করতে খাওয়া হবে। নকুল খুশি হয়ে রাজি হল।

নকুল ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। একটু পরেই বাথরুমে জল পড়ার শব্দ পাওয়া গেল। অমনি আমরা হুইল ব্যারোটা ওর ঘরের দরজার কাছে এনে কাঠের টুকরোগুলোর নীচে কিছু পুরোনো খবরের কাগজ, ছেঁড়া কাপড়, গাছের আধভিজে পাতা ইত্যাদি দিয়ে কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিলুম। তার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ঘন কালো ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠে সারা বাড়ি ভরে দিল। তোর মা রান্নাঘরে ঢুকে গেল আর আমি সদর দরজাটা খুলে দিয়ে তার পাল্লার আড়ালে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে লাগলুম, ”নকুল শিগগিরি বেরিয়ে এসো, সারা বাড়িতে আগুন লেগে গেছে।” একটু পরেই নকুলেশ্বর বাবাজি একটা তোয়ালে পরে কাশতে কাশতে ঘর থেকে বেরিয়ে এক ছুটে সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে বারান্দা পেরিয়ে বাগানে গিয়ে দাঁড়াল। তৎক্ষণাৎ আমি দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিলুম। তারপর এক বালতি জল ঢেলে আগুনটা নিবিয়ে দিলুম।

বাইরে তখন আবার বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে, তারসঙ্গে ছুরির ফলার মতো বরফ-ঠান্ডা হাওয়া তো আছেই। আমরা বারান্দার আলোটা জ্বেলে দিয়ে সদর দরজার পাশের জানলাটা খুলে দিলুম। দেখি, শ্রীমান বারান্দার এককোণে দাঁড়িয়ে হিহি করে কাঁপছে। আমাদের দেখে এগিয়ে আসতেই তোর মা বলল, ‘তুমি কি ভেতরে আসতে চাও?’ নকুল প্রবলবেগে মাথা নাড়ল। তোর মা বলল, ‘আসতে দিতে পারি যদি আমার দুটো প্রশ্নের সঠিক জবাব দাও।’ নকুলের চোখদুটো ধকধক করে জ্বলে উঠল। সে ততক্ষণে বুঝে গেছে যে সে ফাঁদে পা দিয়েছে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘কী প্রশ্ন?’ তোর মা বলল, ‘আমার বাবা আর মাকে যে পিস্তল দিয়ে মেরেছিলে, সেটা এখন কোথায়?’ নকুল বলল, ‘আমি কাউকে মারিনি।’

এই কথা বলতেই আমরা জানলাটা বন্ধ করে দিলুম। আমি বললুম, ”চেষ্টা কোরো না, এই গ্রিল ভাঙতে পারবে না।” একটু পরেই জানলায় খটখট করে শব্দ হল। বাইরে থেকে ক্ষীণ কম্পিত গলায় জড়িয়ে জড়িয়ে নকুল বলল, ‘বলছি, বলছি, ওটা আমার সুটকেসে আছে। শুনেই আমি দৌড়ে ওর ঘরে গিয়ে সুটকেস খুলে দেখি সেটা সত্যিই সেখানে বিরাজমান। সেটা তোর মাকে বলতে, সে বলল, ‘তুমি ওঁদের মেরেছিলে কেন?’ ক্ষীণতর গলায় জবাব এল, ‘বাবা বলতেন যে— ভাতে পড়লে মাছি, কোদাল দিয়ে চাঁছতে হয়। তার পরেই ধড়াম করে শব্দ হল। বোঝা গেল, নকুলের পতন হয়েছে।

এর আধ মিনিটের মধ্যেই করণ এসে উপস্থিত হল। সে নকুলকে দেখেই কাউকে কোনো প্রশ্ন না-করে ড্রাইভারের সাহায্যে তাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে হাসপাতালে চলে গেল। ঘণ্টা খানেক বাদে ফিরে এল বিস্ফারিত চোখে। এখানে মিস্টার চতুর্বেদীকে জানিয়ে রাখি, করণ কলকাতার ছেলে, সেখানে জন্ম, বড়ো হওয়া। কাজেই সে খুব ভালো বাংলা জানে। সে বলল যে, গাড়িতে যেতে যেতে নকুল ভুল বকতে শুরু করে। তার কথাবার্তা শুনে করণ স্তম্ভিত। সে জানতে পারে যে নকুল আমাদের খুন করতে এসেছিল এবং প্রায় দু-যুগ আগে সে তোর দাদামশাই আর দিদিমাকে টাকার লোভে খুন করেছিল। তখন ও আমাদের গাড়িতে তুলে থানায় নিয়ে যায়। আর আমাদের বলে যে কেন যে নকুলেশ্বর ওই ঠান্ডায় শুধু একটা তোয়ালে পরে বারান্দায় বেরিয়ে নিউমোনিয়া বাঁধিয়ে বসেছিল সেটা যেন রহস্যই থেকে যায়। স্বাভাবিক, তার কারণ তো আমাদের জানবার কথা নয়।’

চতুর্বেদী বললেন, ‘মিসেস মুখার্জি খুব রিস্ক নিয়েছিলেন। নকুল যদি ঠান্ডায় জমে মরে যেত, তাহলে কিন্তু আপনাকেও বিপদে পড়তে হত।’

অনীতা বললেন, ‘আমি জানি। তবে, যে আমার পরিবারের এত বড়ো ক্ষতি করেছে, তাকে বিচারের কাঠগড়ায় তুলতে এর চেয়েও বড়ো রিস্ক নিতে আমি রাজি আছি এবং ভবিষ্যতেও থাকব।’

ধ্রুব বলল, ‘তোমরা যেমন আছ তেমনিই থাকো। ঢের হয়েছে! তোমাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে আমি আর সময় নষ্ট করতে রাজি নই।’

No comments