চিনা রহস্য – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়

চিনা রহস্য – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়

আন্দুল রোডের ধারে বকুলতলার একটা বুনো জায়গায় পাণ্ডব গোয়েন্দারা পিকনিক করতে গেল। ভারী মনোরম জায়গা। রাস্তার ধারে গাড়ি রেখে ওরা মেতে উঠল পিকনিকে।

মাথার ওপর নীল আকাশ। আর চারদিকে ঘন সবুজের সমারোহ। একপাশে হাসখালির খাল। পঞ্চু এখানে এসে বেজায় খুশি হয়ে গেল। তাই সে বারে বারে লেজ নেড়ে লাফিয়ে ছুটে তার আনন্দ প্রকাশ করতে লাগল। কখনও খালের জলের কাছে ছুটে গেল। কখনও মাঠে নেমে গেল ছুটে। আবার কখনও বা বনের ভেতর ঢুকে আনন্দে উল্লাসে গড়াগড়ি খেতে লাগল।

সবুজ ঘাসের ওপর শতরঞ্জি বিছিয়ে বাবলু, বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু, বিচ্ছুরা বসল। বাচ্চুু-বিচ্ছুর বাবাও এসেছিলেন সঙ্গে। তিনি রুটিতে মাখন দিয়ে সকলের জন্য ভাগ করতে লাগলেন। এমন সময় হঠাৎ পঞ্চু চিৎকার করে উঠল, “ভৌ—ভৌ—ভৌ।”

বাবলু বলল, “কী ব্যাপার বল তো!”

বিলু বলল, “ও কিছু নয়। ব্যাটা ফুর্তিতে ডাকছে।”

“উহু! এ ডাক সে ডাক নয়।”

ভোম্বল তখন জোর গলায় পঞ্চুকে ডাকল, “আয়—আয়—পঞ্চু।”

পঞ্চু তখনও ডাকছে, “ভৌ—ভৌ—ভৌ—ভৌ।”

বাবুল উঠে দাঁড়াল।

বাচ্চু-বিচ্ছুর বাবা বললেন, “কী হল, উঠলে যে!”

“আসছি কাকাবাবু” বলেই বনের দিকে ছুটল বাবলু।

তার দেখাদেখি বিলু, ভোম্বল সবাই। বাচ্চু-বিচ্ছুও ছুটল। ছুটে গিয়ে ওরা দেখল বনের ভেতর এক জায়গায় একটি লোহার সিক ও ছেঁড়া কাগজ বোঝাই বস্তা পড়ে আছে। আর সেখানেই একটি গাছের ডালে একজন ছেড়া কাগজ কুড়ানোওয়ালা চিনা প্রাণপণে ডাল আঁকড়ে ঠকঠক করে কাঁপছে।

বাবলু গিয়ে পঞ্চুকে নিরস্ত করতেই চিনাটা নেমে পড়ল গাছ থেকে। তারপর সে তার ভাষায় কী সব বলল বাবলুদের। বাবলুরা তার কিছুই বুঝল না।

ভোম্বল চিনাটাকে বলল, “এই বনের ভিতর তুই কী করতে এসেছিলি বল? কাগজ কুড়োতে?”

চিনাটা আবার তার ভাষায় কী বলল।

পঞ্চু তখন বাবলুর হাত ছিনিয়ে একটি ব্যাগের উপর ঝাপিয়ে পড়ল।

এই ব্যাগটা এতক্ষণ ওদের নজরে পড়েনি। ওরা দেখল সেটা একটা ত্রিপলের বড় ব্যাগ। দড়ি দিয়ে তার মুখ বাধা। অনেকটা ডাক ব্যাগের মতো। বাবলু তাড়াতাড়ি খুলে দেখল তার ভেতরে নানা রকমের পার্শেল আছে। দেখে বাবলু বলল, “বুঝেছি। এই ব্যাটারই কাজ। ভোম্বল, ধরে রাখ ব্যাটাকে যেন পালাতে না পারে। পুলিশে দেব ব্যাটাকে।”

কিন্তু কাকে দেবে পুলিশে? বাবলুদের অন্যমনস্কতার সুযোগে চিনাটা তখন পগার পার। সে তখন তির-বেগে ছুটছে।

তার দিকে নজর পড়তেই পঞ্চুও ছুটল উর্ধ্বশ্বাসে।

চিনাটা তখন হাসখালির পোলের ওপর। পঞ্চুু গিয়ে বাঘের মতো ঝাপিয়ে পড়ল তার পায়ে। আর সেই মুহুর্তে চিনাটাও লাফিয়ে পড়ল পোলের ওপর থেকে খালের জলে। সামান্য কয়েকটি বুদবুদ। তারপর ডুব সাঁতারে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল সে।

বাবলুরা ফিরে এল। ফিরে এসে পার্শেলের ব্যাগটাকে মোটরের ভেতর রাখল। তারপর মাখন-রুটি খেয়ে মেতে উঠল পিকনিকে।

পিকনিক শেষে ফেরার পথে পার্শেল ব্যাগটা ওরা থানায় জমা দিল।

পুলিশ অফিসার সব শুনলেন ব্যাপারটা, কীভাবে ওটা পাওয়া গেল। শুনে বললেন, “একদল ওয়াগন ব্রেকার এই সব পার্শেলের জিনিস চুরি করছে। ভালই হল এগুলো ফেরত পেয়ে। তারপর বাবলুকে বললেন—চিনের যুদ্ধের পর থেকে এই সব চিনারা গা ঢাকা দিয়েছিল। আবার একটা দুটো করে বেরোচ্ছে দেখছি। যাক, সেই চিনাটাকে এরপরে কখনও দেখলে চিনতে পারবে?”

“পারব।”

“কী করে চিনবে?”

“তার পা দেখে। আমাদের কুকুরে তার পায়ের ডিম থেকে এতখানি মাংস খুবলে নিয়েছে।”

“ভেরি গুড়। এবার থেকে তোমরা লক্ষ রাখবে ওকে আর কখনও দেখতে পাও কি না। পেলে আমাদের জানাবে। কেমন?”

বাবলুরা আচ্ছা বলে বিদায় নিল।

রাত্রি তখন কত তা কে জানে। হঠাৎ একদল পাখি বাড়ির পাশের গাছটা থেকে কলরব করে উড়ে পড়ল। সেই সঙ্গে শুরু হল কিছু কুকুরের চিৎকার। তারপরই মনে হল কে যেন বাবলুদের ঘরের দরজাটা আঁচড়াচ্ছে। আর চিৎকার করছে, “ভৌ—ভৌ—ভৌ।”

এ তো পঞ্চুর গলা! বাবলু মাথার কাছে রাখা টর্চটা নিয়ে ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ল। তারপর তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল ছাদে। চারদিকে আলো আর আলো। কোথা থেকে এল এই আলো? দূরের আকাশ পর্যন্ত লাল হয়ে উঠেছে। আগুন লেগেছে কোথাও। ওই তো জ্বলছে আগুন। লকলক করে জ্বলছে। কালীবাবুর বাজারে আগুন লেগেছে ঠিক। একবার মনে হল ঠিক হয়েছে। সকাল হলেই যেমন বাজারে জিনিসপত্তরের দামে আগুন লাগে, তেমনি ঠিক হয়েছে। পরক্ষণেই কঠোর হয়ে উঠল বাবলু। ছাদের গায়ে গায়ে ছুয়ে থাকা নারকোল গাছ বেয়ে তরতর করে নেমে এল।

বাবলুকে দেখেই ছুটে এল পঞ্চু। বাবলু পঞ্চুুকে ইশারা করল। তারপর ছুটতে লাগল দু’জনেই ছুটতে ছুটতে একেবারে বিলুদের বাড়ি।

বিলুও আগেই উঠে পড়েছিল। বাবলুকে দেখে শিস দিল সে। তারপর পাঁচিল টপকে সেও রাস্তায়। বাবলু, বিলু আর পঞ্চু তির-বেগে ছুটে চলল কালীবাবুর বাজারের দিকে। ওরা যাবার আগেই কত লোক সেখানে জড়ো হয়েছিল। বালতি বালতি জল ঢেলে আগুন নেভাবার চেষ্টা করছে সবাই। একজন ফায়ার বিগ্রেডে ফোন করে দিয়ে এল।

কত লোকের কত সর্বনাশ যে হল। বস্তির লোকেরা ঘরদোর ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে। ঘুমের ঘোরে আগে টের না পাওয়ায় কত লোক হয়তো পুড়েই মরেছে।

হঠাৎ ও কী! নোংরা একটা গলির মুখে দাঁড়িয়ে দুটো লোক অমন খিকখিক করে হাসছে কেন?

বিলু বলল, “বাবলু।”

“হুঁ”

পঞ্চুু অবাক হয়ে আগুনের দিকে তাকিয়ে আছে। বাবলু আর বিলুকায়দা করে পিছু হটে সেই লোকদুটোর কাছাকাছি দাঁড়াল।

একজন বলল, “সাবাস ওস্তাদ। আচ্ছা প্ল্যান বটে তোমার!”

“এ ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না শুকুর।”

“আমিও শুকুর মোল্লা। কেমন হাত বল দেখি? চটপট কাজ সেরে ফেললাম, কেউ টেরও পেল না।”

“এই জন্যেই তোমাকে আনা। লোকের সর্বনাশ করতে তোমার জুড়ি আর কেউ কি আছে?”

“ও কথা বলে লজ্জা দিয়ে না। তুমি হলে গুরু। সর্বনাশ যা কিছু তো তুমিই করছ। আমি নিমিত্ত মাত্র।”

“বেকুব। তুমি ধরালে আগুন। সর্বনাশ করলাম আমি?”

“করলে না? তোমার সঙ্গে আড়তদারদের আর আলুওলা কেষ্টর সঙ্গে গোলমাল হল বলেই তো তুমি আমাকে আগুন দিতে বললে। তোমার জন্যেই তো গোটাকতক নিরীহ লোক সর্বস্বান্ত হল।”

“খুব যে দরদ দেখছি? ব্যাটা বেইমান।”

“খবরদার ! বেইমান বলবে না।”

“একশোবার বলব। তুমি আমার মুখের ওপর কথা বলেছ।”

“ওস্তাদ, এটুকু জেনে রেখো যে, আমাদের শক্তিতেই তোমার শক্তি। বেশি বাড়াবাড়ি করলে মুণ্ডু নামিয়ে দেব। আমার পাওনাগণ্ডা এখনই বুঝিয়ে দাও।”

“বেশ, এই নাও।” বলেই ওস্তাদ প্যান্টের পকেট থেকে একটি স্প্রিং দেওয়া ছুরি বার করে শুকুর মোল্লার বুকে বসিয়ে দিল।

শুকুর মোল্লা চিৎকার করেই ওস্তাদের মুখ লক্ষ করে মারল সজোরে একটা ঘুষি। ওস্তাদ ছিটকে পড়ল। তারপর ওস্তাদ উঠে এসে মারল শুকুরের পেট লক্ষ করে স-বুট একটি লাথি। শুকুর আগেই ছুরিকাঘাতে আহত হয়ে পড়েছিল। তার ওপর ওই লাথি খেয়ে রক্তবমি করতে লাগল।

ব্যাপার দেখে বাবলু আর বিলু গেল হতভম্ব হয়ে। বিলু তাড়াতাড়ি গিয়ে শুকুরের বুক থেকে হেঁচকা টানে ছুরিটা খুলে নিল। আর বাবলু হাতের কাছে যা পেল তাই নিয়ে ওস্তাদের দিকে ছুড়ে মারতে মারতে তাড়া করল।

বিলু লেলিয়ে দিল পঞ্চুকে, “লিয়ো—পঞ্চু—লিয়ো।”

ততক্ষণে হইহই করে আরও অনেক লোক এসে গেছে। সবাই এসে ঘিরে ধরেছে শুকুর মোল্লাকে। বাবলু আর পঞ্চু তখন প্রাণপণে ছুটে চলেছে ওস্তাদকে ধরবার জন্য। কিন্তু কিছু পথ গিয়ে ওস্তাদ হঠাৎ একটি বাড়ির পাইপ বেয়ে অর্ধেক উঠে এর ওর ছাদে লাফাতে লাফাতে অন্ধকারে কোথায় যে অদৃশ্য হয়ে গেল তার আর হদিসই পাওয়া গেল না।

হতাশ হয়ে বাবলু আর পঞ্চু ফিরে এল। বিলু তখন পাশের কল থেকে আঁজলা ভরে জল এনে শুকুরের মুখে দিচ্ছে। বাবলু শুকুরের মুখের উপর বুকে পড়ে বলল, “ওস্তাদ কোথায় থাকে বলতে পার? আমরা ওকে পুলিশে ধরিয়ে দেব।”

শুকুর কী যেন ভাবল। তারপর অতিকষ্টে বলল, “বাঁশতলা ঘাট রোড। হোটেল—সা।” ব্যস। আর উচ্চারণ করতে পারল না শুকুর। চোখ বুজে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করল সে।

এর পর পুলিশ এল। দমকল এল। হইহই ব্যাপার। বাবলু, বিলু পুলিশের কাছে আগাগোড়া সব কিছু বলল। শুধু ওস্তাদের আংশিক ঠিকানাটা জানাল না।

পরদিন মিত্তিরদের বাগানে সেই ভাঙা বাড়ির ভেতর পাণ্ডব গোয়েন্দারা জড়ো হল। বাচ্চুু-বিচ্ছুর মা এক ঠোঙা চিনাবাদাম পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তাই খেতে খেতে ওদের আলোচনা চলতে লাগল।

বাবলু বলল, “আজ তোদের কেন ডেকেছি, জানিস?”

“জানি। সেই চিনাটাকে ধরবার ব্যাপার নিয়ে নিশ্চয়ই!”

না। কাল রাতে বিলু আমি আর এক শয়তানকে আবিষ্কার করেছি। সর্বাগ্রে তাকে খুঁজে বার করতে হবে।”

“বলো কী! কাল রাতে কখন?”

“কালীবাবুর বাজারে যখন আগুন লাগে।”

“কী ব্যাপার শুনি তা হলে?”

বাবলু সব বলল।

সব শুনে অবাক হয়ে গেল ওরা, “হাউ ডেঞ্জারাস!”

“তা হলেই বুঝতে পারছিস তো, এখন আমাদের করণীয় কী?”

“হ্যা। ওস্তাদকে খুঁজে বার করা। কিন্তু কীভাবে খুঁজব?”

“আজ আমরা বাঁশতলা ঘাটের দিকে বেড়াতে যাব।”

“কখন?”

“এই সন্ধের পর।”

বাচ্চু বলল, “দেখ বাবলুদা, আমি কিন্তু মনে করি এটা খুব কাঁচা কাজ হবে। কেন না, ওস্তাদ আমাদের সকলকে চেনে না। শুধু তোমাকে আর বিলুদাকে চেনে। তাই বলি তোমরা দুজনে বরং ওঁত পেতে থাকবে। যাব আমরা তিনজনে। বিচ্ছু, আমি আর ভোম্বলদা। আমরা ফিরে এসে যা বলব, সেই মতো কাজ করবে।”

বিলু বলল, “সেই ভাল। না হলে কোনওরকমে একবার চিনে ফেললে বিপদে পড়ে যাবে।”

বাবলু একটুক্ষণ কী যেন ভাবল। তারপর বলল, “না। দলছাড়া হয়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না। বিশেষ করে তোরা আমার চেয়েও ছেলেমানুষ। তোদের বুদ্ধি ঠিক কাজ করবে না। তার চেয়ে আমরা প্রত্যেকে একটা করে মুখোশ পরে যাব। সবাই ভাববে আমরা ছেলেমানুষ। তাই শখ করে পরেছি। কেউ বুঝতেই পারবে না আমাদের উদ্দেশ্য। চিনতে তো পারবেই না। তবে এবারে পঞ্চুকে আমরা দলে নেব না।”

পঞ্চুর নাম হওয়া মাত্রই সে ডেকে উঠল, “ভৌ-ভৌ—ভৌ।” আলোচনা শেষ হলে সবাই চলে গেল যে যার ঘরে।

সন্ধের পর ওরা পাঁচজনে পাঁচটি বিচিত্র মুখোশ পরে যথাস্থানের দিকে চলল। ফজিরবাজারের গা বেয়ে বাঁশতলার ঘাট। একপাশে বেঙ্গল জুট মিলের পাঁচিল, অপর পাশে তেলেঙ্গিপাড়ার বস্তি। ওদের পাঁচজনকে দেখে বস্তির লোকেরা সকলেই খুব হাসাহাসি করতে লাগল।

যেতে যেতে এক জায়গায় হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় ওরা। দেখল, সরু একটি গলির মুখ থেকে একজন চিনা কাকে যেন ধাক্কা মারতে মারতে বার করে দিচ্ছে। যাকে ধাক্কা দিচ্ছে, সে তখনও চিনাটার হাতে পায়ে ধরে বলছে, “একটা কানি কাটা পয়সা দিন না বাবু একটা দিন।”

বিলু বলল, “আরে, এ যে নিত্য পাগলা।”

বাবলু বলল, “ওই চিনেটা সেই ব্যাটা নয়তো? ও কী করে এখানে এল?”

ভোম্বল বলল, “হ্যাঁ। হ্যাঁ। সেই তো। আমি চিনেছি। ব্যাটা নিশ্চয় এখানেই থাকে। হয়তো ওস্তাদের দলের লোকও হতে পারে।”

বাবলু বলল, “এই গলিতেই সকলে ঢুকে পড়ি আয়। হোটেলটা নিশ্চয়ই এই গলির ভেতরেই হবে।”

ওরা ঢুকল। চিনেটা সরে দাড়িয়ে ওদের রাস্তা করে দিল। গলির ভেতর ঢুকতেই ওরা এক জায়গায় দেখল, টিনের ওপর রং করে একটা নোংরা দোকানঘরের গায়ে লেখা আছে ‘হোটেল সাজাহান’।

বাবলু বলল, “আর কোনও সন্দেহ নেই। এই সেই হোটেল। শুকুর মোল্লা এর প্রথম অক্ষরটা শুধু উচ্চারণ করতে পেরেছিল সা’।”

বাবলুরা হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, এমন সময় হোটেল থেকে আর এক অতিকায় চিনা বেরিয়ে এল, “ক্যা মাংতা?”

বাবলু বলল “খানে কা চিজ কুছ হ্যায়?”

“মাটন চাপ, মোগলাই মিলেগা।”

“ঠিক হ্যায়। হাম সবকো মাটন চাপ ঔর মোগলাই একঠো করকে দে দেও।”

“থোড়া বৈঠনে হোগা।”

“বৈঠেগা।”

ওরা ভেতরে ঢুকে বসল। বাইরের চেয়ে ভেতরটা আবার আরও বেশি নোংরা।

একটু পরে সেই চিনেটা এল। পায়ে পঞ্চুর কামড়ানো ক্ষতচিহ্ন। চিনাটা এসে ওদের দিকে একবার তাকাল। তারপর কোনও কথা না বলে ঢুকে গেল ভেতরের ঘরে।

কিছু পরেই দেখা গেল আসল মালিককে। অর্থাৎ যার খোঁজে এসেছে ওরা এখানে, সেই ওস্তাদকে। ওস্তাদ চিনেটার সঙ্গে একবার দরজার আড়াল থেকে উকি মেরে ওদের দেখেই চলে গেল।

বাবলু চাপা গলায় বলল, “বিলু, হাওয়া খারাপ। আমাদের সন্দেহ করছে। ধরা পড়ে গেলুম বলে।”

“কিন্তু আমরা তো মুখোশ পরে আছি। কী করে চিনবে?”

“শয়তানের চোখকে ফাকি দেওয়া এত সহজ নয়। যাক, এক কাজ কর। তোরা বসে থাক। আমি চট করে পালিয়ে গিয়ে থানায় একটা ফোন করে দিয়ে আসি কোথাও থেকে।” এই বলে বাবলু যেই না বেরোতে যাবে অমনি দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিল কে। বাবলু ধাক্কা দিতে লাগল—“খোল, খোল। দরজা খোল।”

ওস্তাদ এবং সেই চিনাটা পিছন দিক দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকল তখন। ঢুকে বলল, “না। ও দরজা আর খোলা হবে না। তোমরা কারা? খোল মুখোশ। আগে মুখগুলো দেখি।”

বাবলু বলল, “না, খুলব না।”

“খুলবে না?” বলেই ওস্তাদ এগিয়ে এসে ওর মুখোশটাই সর্বাগ্রে খুলল।

ওস্তাদ চমকে উঠে বলল, “এই তো। এই তো সে। যাক, পাখি নিজেই এসে ধরা দিয়েছে!”

চিনাটা বলল, “আমিও চিনি একে। এদের সঙ্গে একটা কুকুর থাকে। আজ সেটা নেই। সেদিন বকুলতলার কাছে এদের কুকুরই কামড়ে দিয়েছিল আমাকে।”

ততক্ষণে সবার মুখোশ সবাই যে যার খুলে ফেলেছে।

ওস্তাদ ওদেরকে এক জায়গায় বসিয়ে আলো জ্বালল ঘরে। হারিকেনের আলো। আর চিনাটা ওদের রক্তচক্ষু দেখাতে লাগল।

বাবলু বলল, “আমাদের আটকালে কেন? ছেড়ে দাও।”

ওস্তাদ বলল, “তা হলে পুলিশে খবর দেবার খুব সুবিধে হয়, না?”

“আমরা কথা দিলাম, পুলিশকে কোনও কথা বলব না। আমাদের ছেড়ে দাও।”

“ছেড়ে দেব। তবে এখন নয়। ঘর ভর্তি চোরাই গাজা, আফিম, কোকেন, দামি দামি পার্সেল, সোনার পাত আছে। এগুলো আগে সরাই। তারপর প্রত্যেককে মুখ-হাত বেঁধে মাঝ-গঙ্গায় টুপ টুপ করে ছেড়ে দেব।”

এমন সময় হঠাৎ চালার ওপর খড়মড় করে কীসের যেন শব্দ হল। টালির চাল তো। মনে হল কে যেন উঠেছে। ওস্তাদ চেঁচিয়ে উঠল, “চালার ওপর কে রে?”

উত্তর এল, “ভৌ-ভৌ-ভৌ।”

“কুকুর!”

বাবলু বলল, “হ্যা। আমাদের ট্রেনিং দেওয়া কুকুর। আমরা নিয়ে আসিনি ওকে। আমাদের পিছু পিছু লুকিয়ে এসেছে। যাক ভালই হয়েছে।” বলেই ঁচেচিয়ে উঠল বাবলু, “পঞ্চুু, আমরা এখানে।”

অমনি প্রত্যুত্তর হল, “ভৌ—ভৌ।”

ওস্তাদ চেঁচিয়ে উঠল, “ধর। ধর ব্যাটাকে।”

চিনাটা বলল, “ওরে বাবা। আমি পারব না। সাংঘাতিক কুকুর!”

“পারবি না?”

“তুমি যাও ওস্তাদ।”

ওস্তাদ তখন ঠাস করে চিনাটার গালে একটা চড় মেরে বেরিয়ে গেল পঞ্চুকে ধরতে।

চিনাটা রাগে থরথর করে কাপতে লাগল।

বাবলু দেখল এই সুযোগ। সকলকে একবার ইশারা করে দিয়েই টেবিলের ওপর থেকে হ্যারিকেনটা তুলে নিয়ে চিনাটার মাথায় দড়াম করে বসিয়ে দিল এক ঘা। তারপর সবাই মিলে দৌড়-দৌড়-দৌড়।

হতভম্ব চিনাটা হাউ মাউ করে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল।

বাবলুরা যখন রাস্তায় তখন ওস্তাদের নজর পড়ল ওদের দিকে। কিন্তু যেই না ছুটে ওদের ধরতে যাবে অমনি পঞ্চু এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওস্তাদের ওপর।

বাবলুরা তখন এক ছুটে একেবারে থানায়।

খবর পেয়েই পুলিশের লোকেরা এসে ঘিরে ফেলল বস্তিটাকে। আসল ঘাঁটির ভেতর থেকে প্রচুর চোরাই মাল উদ্ধার করা হল। গ্রেফতারও করা হল বহু লোককে। তাদের ভেতর সেই চিনাটা এবং পঞ্চুর কামড়ে ক্ষতবিক্ষত ওস্তাদও ছিল।

পুলিশ অফিসার বাবলুদের বুদ্ধির প্রশংসা করলেন। খবরের কাগজের লোকেরা এসে ওদের ফটো তুলল। সবাই যখন পাণ্ডব গোয়েন্দাদের প্রশংসায় পঞ্চুমুখ তখন বাবলু বলল, “না এই অভিযানের সম্পূর্ণ-কৃতিত্ব পঞ্চুুর। তাই থ্রি চিয়ার্স ফর পঞ্চু—।”

সবাই বলল, “হিপ হিপ হুরর রে।”

আর পঞ্চু? সেও আওয়াজ দিল, “ভৌ। ভৌ ভৌ।”

No comments