ঘুমালেই বিপদ! – অনীশ দাস অপু

ঘুমালেই বিপদ! – অনীশ দাস অপু

ভোর চারটা বাজে। কিন্তু এখনও ঘুমাতে সাহস পাচ্ছি না।

আমার বর্তমান দুর্দশার শুরু মাস তিনেক আগে, যেদিন আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমি।

বাবা মারা যাওয়ার দুবছরের মধ্যে তাঁর জমানো সমস্ত টাকা উড়িয়ে দিই আমি। ছোটোখাটো চাকরি করতাম মাঝে মাঝে আর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবতাম আমার পছন্দের ঘোড়াগুলো যদি আরেকটু জোরে ছুটতে পারত, কত ভালোই না হতো।

অভাব অনটনে জর্জরিত আমি যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেল, সিদ্ধান্ত নিলাম এ জীবন আর রাখব না। এত কষ্ট করে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো। আর আত্মহত্যার জন্য টিউব রেলওয়ে উৎকৃষ্ট স্থান। রেল লাইনে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকো, ব্যস- তোমার সব দুঃখ-কষ্ট কাটা পড়ে যাবে রেল গাড়ির চাকার নিচে।

আত্মহত্যার সিদ্ধান্তে অটল আমি সেদিনও সান্ধ্যকালীন পত্রিকা কেনার লোভ সামলাতে পারিনি। চলন্ত সিঁড়ির দিকে এগোতে এগোতে কিনে ফেললাম সেদিনকার খবরের কাগজ। আগামীকাল বিকেল চারটায় যে ঘোড়দৌড়টা হবে, সে রেসের একটা ঘোড়ার ওপর বাজি ধরেছিলাম আমি। যদিও জানি আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে অনন্ত লোকের উদ্দেশে যাত্রা শুরু হয়ে যাবে আমার। তবু কোন্ কোন্ ঘোড় রেসে অংশ নিচ্ছে জানার লোভ সামলাতে পারছিলাম না। যদিও এই চতুস্পদ প্রাণীগুলোর ওপরে বাজি ধরতে গিয়েই গত দু বছরে ফতুর হয়ে গেছি।

যে লোকটার কাছ থেকে খবরের কাগজ কিনেছি সে আকারে ছোটোখাট, গালে মাফলার জড়ানো। কাপড়ের টুপিটা চোখ প্রায় ঢেকে রেখেছে। তার কাছে একটিই মাত্র কাগজ ছিল। তার হাত থেকে কাগজ নেয়ার সময় শিরশির করে উঠল গা। ইচ্ছে করে সে যেন ছুঁয়ে দিয়েছিল আমার হাত। তার আঙুলগুলো বরফের মতো ঠান্ডা।

সিঁড়ির সর্বোচ্চ ধাপে দাঁড়িয়ে, উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোয় স্টপ প্রেস লেখাটিতে চোখ বুলালাম আমি।

ওতে লেখা বেলা সাড়ে চারটার রেসে কাম এরর নামে একটি ঘোড়া দৌড়ে জিতেছে। আমার বুকি নিশ্চয় রেগে আগুন হয়ে যাবে দেখে আমি রেসে হাজির হইনি।

হঠাৎ দম বন্ধ হয়ে এল ব্যাপারটার মাজেজা বুঝতে পেরে। কাম এরর-এর রেস তো আজ নয়, কাল বিকেলে। ঘোড়াটার জেতার খবর আগাম ছেপে দিয়েছে এ পত্রিকা।

কপাল কুঁড়ে ঘাম বেরুল। পত্রিকাটি ফেলে দিয়েছিলাম। তুলে নিলাম আবার। হাত কাঁপছে আমার বেলা দুটোর রেসে কোন ঘোড়া জিতল দেখতে গিয়ে।

এটি একটি কোল্ট। এ ঘোড়ার নামও শুনিনি।

আগামী দিনের খবরের কাগজ নিয়ে অনেক গল্প শুনেছি আমি। কিন্তু এ পত্রিকাটি সেগুলো থেকে আলাদা…

আমার পত্রিকায় আগামীকালের তারিখ লেখা!

স্টেশনের প্রবেশ পথে চলে এলাম। যে লোকটা কাগজ বিক্রি করেছে, খুঁজছি তাকে। কিন্তু তার কোনো চিহ্ন নেই। ফল বিক্রেতা এক ছোঁড়াকে লোকটার চেহারার বর্ণনা দিয়ে জানতে চাইলাম। এরকম কাউকে তার চোখে পড়েছে কিনা।

এখানে কোনো হকারকে আজ দেখি নাই, ভাই, ভুরু কুঁচকে বলল সে। কোনো খবরের কাগজঅলাই আজ পত্রিকা বিক্রি করতে আসে নাই। আমি চলে এলাম ওখান থেকে।

বলাবাহুল্য সুইসাইড করিনি আমি। বদলে ফিরে এলাম বাড়ি। আগামীকালের পত্রিকার আদ্যোপান্ত চষে ফেললাম। পরদিন বিকেলের রেসের বিজয়ী ঘোড়াগুলো সম্পর্কে নোট টুকে নিলাম কাগজে, স্টক এক্সচেঞ্জের দাম লিখলাম, এমনকী কাল সন্ধ্যায় গ্ৰেহাউণ্ড রেসে কারা কারা জিতছে তাদের খবরও পড়ে ফেললাম অভিভূত বিস্ময়ে।

নাচতে নাচতে বিছানায় গেলাম আমি। আগামীকাল থেকে লসগুলো পূরণ করব আমি। আপনি যদি আগেভাগে জানতে পারেন ছটা ঘোড়দৌড়ে কোন্ কোন্ ঘোড়া জিতবে, আপনাকে ঠেকায় কে? একদিনেই তো আপনি আপনার বিনিয়োগকৃত টাকার কয়েকগুণ ঘরে তুলে আনতে পারবেন। এবং তা-ই করলাম আমি।

পরদিন সন্ধ্যায় যথারীতি চলে এলাম টিউব স্টেশনে। একটা ফ্যাসফেসে কণ্ঠ বলল, পেপার, স্যার!

সেই বেঁটে লোকটাই, গালে জড়ানো মাফলার, ক্যাপটা এমনভাবে টেনে নামানো, চোখ দেখা যায় না। তার ঠাঠা আঙুল ঘষা খেল আমার হাতে। লক্ষ করলাম লোকটার কাছে একটাই মাত্র কাগজ।

আচ্ছা… বলতে গেলাম আমি, বাধা পেলাম পেছন থেকে ধাক্কা খেয়ে। স্টেশন থেকে তড়িঘড়ি বেরিয়ে আসছিল একজন, আমাকে ধাক্কা মেরে হনহন করে এগোল সামনে। তাল সামলে পেছন ফিরলাম। নেই কাগজঅলা।

আমি এখন প্রতিটি রেসে জিতি। সেই সঙ্গে আমার স্টক ব্রোকারের কাছ থেকেও প্রচুর টাকা কামাই। কারণ আগেই বলে দিই স্টক এক্সচেঞ্জে কোন কোম্পানির দর নামবে, কোনটা উঠবে। রেস শেষে প্রতিদিন সন্ধ্যা ছটায় চলে আসি টিউব স্টেশনে, সেদিনের কাগজ কিনতে। এবং প্রতি সন্ধ্যায় মুখে মাফলার পেঁচানো কাগজঅলা বন্ধুটিকে পেয়ে যাই। তার হাতে একটিই মাত্র কাগজ থাকে আমার কাছে বিক্রি করার জন্য।

দ্রুত ধনী হয়ে যাচ্ছি আমি। আবার জেনির পাণিপ্রার্থনা করলাম। যখন ধ্বংসের শেষপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলাম, ভেবেছি ইহজীবনে জেনির সঙ্গে দেখা হবে না আমার।

জেনির বাবা মালদার পার্টি। একমাত্র মেয়েকে মধ্যবিত্ত কারও হাতে তুলে না দেয়ার ব্যাপারে কঠোর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তবে এখন যেহেতু আমার টাকা আছে, তার জামাই হওয়ার দুঃসাহস দেখাতেই পারি। কারণ জানি আমি যদি জেনিকে বিত্তবৈভবের মধ্যে রাখতে পারি, এ বিয়েতে আপত্তি করবেন না ওর বাবা। আমার এখন জেনির বাবার চেয়েও বেশি টাকা এবং দিন দিন ব্যাংক ব্যালান্স বেড়েই চলেছে, সত্যি বলতে কী, আমি পরিণত হয়েছি টক অব দ্য টাউনে। সবার আলোচনার বিষয়বস্তু এখন আমি। কাজেই ওদের বাসায় যেদিন গেলাম, সাদর সম্ভাষণ জানাল পিতা ও কন্যা।

সেন্ট মার্গারেট চ্যাপেল বিয়ের অনুষ্ঠান উদযাপনের জন্য ধার্য করা হলো। সিদ্ধান্ত নিয়েছি সুইজারল্যান্ডে যাব মধুচন্দ্রিমায়।

টিউব স্টেশনে প্রতিদিন ক্ষুদ্র মানুষটির কাছ থেকে খবরের কাগজ কিনি আমি। এটা এখন রুটিনে দাঁড়িয়ে গেছে। আগে ভাবতাম জানব লোকটা কেন, কোত্থেকে এসেছে, কী তার পরিচয়। তার কাছে শুধু একটিই মাত্র পত্রিকা কেন থাকে এবং আমি স্টেশনে হাজির হওয়া মাত্র কাগজটা কেন সে তুলে দেয় আমার হাতে। কিন্তু লোকটার কাছ থেকে পত্রিকা কেনা এমন অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে, এসব নিয়ে একটুও মাথা ঘামাই না।

বিয়ের আগের দিন সিদ্ধান্ত নিলাম আর পত্রিকা কিনব না। স্টক এবং শেয়ারের দৌলতে আজ আমি দেশের শীর্ষস্থানীয় ধনীদের কাতারে। কাল বিকেল আড়াইটায় কোন্ ঘোড়া রেসে জিতবে, এ খবর জানার আমার এখন আর প্রয়োজন নেই।

জেনিকে কাল বিয়ে করছি আমি। এরপর ওই বেঁটে, নোংরা লোকটার স্মৃতি চিরতরে দূর করে দেব মন থেকে। লোকটার ঠাণ্ঠা আঙুলের স্পর্শে ভীতিকর শিহরণ থেকে মুক্ত থাকব।

তবু যথারীতি টিউব স্টেশনে হাজির হয়ে গেলাম আমি। না, রেসের কোন্ ঘোড়া জিতবে জেনে আরও টাকা কামাই করতে নয়, কৌতূহল জাগছে পত্রিকায় আমার বিয়ে নিয়ে কী খবর ছেপেছে দেখতে।

লোকটার হাতে যথারীতি সেই একটাই কাগজ। আমি কাগজটা তার হাত থেকে নিয়েছি, এই প্রথমবার সে আমার দিকে মুখ তুলে চাইল। তার কোটরাগত চোখের রঙ ধূসর, গাল চাপড়া ভাঙা। সে আজ মাফলার জড়ায়নি মুখে। মুখটা ভয়ঙ্কর মুখোশের মতো। আমি নিজের অজান্তে পিছিয়ে এলাম এক কদম, শিরদাঁড়া বেয়ে নামল ঠান্ডা বরফ জল। লোকটার দিকে তাকিয়ে আছি, মুখে ভৌতিক হাসি ফুটল তার, লম্বা, হাড্ডিসার হাতখানা স্যালুটের ভঙ্গিতে তুলল, তারপর ঘুরে দাঁড়াল। মিশে গেল টিউব স্টেশনের জনতার ভিড়ে।

কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরলাম আমি। তবে ঘরে ঢুকে জোর করে ঝেটিয়ে বিদায় করে দিতে চাইলাম লোকটার চিন্তা। ওকে ভয় পাওয়ার কী আছে? ওর সঙ্গে তো ইহজীবনে দেখা হবে না আমার। কারণ ওর কাছ থেকে আর খবরের কাগজ কিনতে যাচ্ছি না আমি। লোকটা হয়তো জেনে ফেলেছে ব্যাপারটা। তাই স্যালুটের ভঙ্গিতে বিদায় জানিয়েছে আমাকে।

খবরের কাগজ খুললাম। আগ্রহ নিয়ে পাতা ওলটাচ্ছি। বিয়ে বিষয়ক কোনো খবরই নেই। অথচ বহু সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে আমি এবং জেনি জানিয়েছি কবে গাঁটছড়া বাঁধতে চলেছি দুজনে।

কাগজের তারিখটা দেখলাম। হ্যাঁ, এটা আগামীকালের খবরের কাগজই। কিন্তু বিয়ে সংক্রান্ত কোনো খবর ছাপেনি।

হঠাৎ প্রথম পাতার একটি খবরে আটকে গেল চোখ।

ঘুমের মধ্যে বরের মৃত্যু হেডলাইনে লেখা।

বুকের মধ্যে ঘোড়ার মতো লাফাতে শুরু করল কলজে। দপদপ করতে লাগল কপালের শিরা। রক্তচাপে ফুলে উঠল।

পড়লাম আমি ঘুমের মধ্যে মারা গেছি, আমার চাকর আমাকে দেখেছে চেয়ারে বসে আছি আমি ধোপদুরস্ত পোশাক পরে, হাতে কলম। মৃত্যুর কারণ ধারণা করা হয়েছে হার্ট ফেইলিওর।

তাই আমি এ লেখাটা লিখছি জেগে থাকার জন্য। বিয়ের আর কঘণ্টা বাকি। এটুকু সময়… আমার… জেগে… থাকতে…

No comments