হাজারহাত কালিতলা রহস্য – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়

হাজারহাত কালিতলা রহস্য – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়

গ্রীষ্মের এক অলস দুপুরে পাণ্ডব গোয়েন্দারা মিত্তিরদের বাগানে খেলা করছিল। বাগানে ঘন গাছ-পালার অভাব ছিল না। আম, জাম, বেল, কাঁঠাল ইত্যাদির গাছ তো ছিলই, তা ছাড়াও ছিল গুলঞ্চ চাঁপা টগর প্রভৃতি ফুলের গাছ। খেলতে খেলতে এক জায়গায় এসে বিশ্রাম নিল ওরা। জায়গাটা যেমনই ছায়া সুনিবিড় তেমনই মনোরম। সহজে কারও চোখেও পড়বার নয়। একসঙ্গে কয়েকটি গাছ জড়াজড়ি করে রয়েছে এখানে। একটা প্রকাণ্ড বটগাছ অসংখ্য ঝুরি নামিয়ে ছাউনির মতো করে রেখেছে। সেই বটগাছকে আশ্রয় করে গজিয়েছে একটি মাধবীলতার গাছ। একটি গুলঞ্চ গাছও বাঁধা পড়েছে সেই স্নেহবন্ধনে।

বাবলু বলল, “জায়গাটা বেশ আরামদায়ক। না রে বিলু?”

বিলু বলল, “সত্যি। প্রাণ যেন জুড়িয়ে গেল।”

ভোম্বল বলল, “তোরা বোস। আমি একটু গাছে উঠে হাওয়া খাই।”

বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, “না ভোম্বলদা, এই ভর দুপুরে গাছপালায় উঠতে যেয়ো না।”

ভোম্বল বলল, “ওসব সংস্কার রাখ তো।” বলে পাকা গেছুড়েদের মতো গাছে ওঠা শুরু করল। পঞ্চু এক পাশে দাড়িয়ে লেজ নাড়ছিল। সেও ভোম্বলের দেখাদেখি এক লাফে শক্ত মোটা একটি ডালের ওপর বসে রইল। আর ভোম্বল একটু একটু করে উঠতে লাগল একেবারে মগ-ডালের দিকে। হঠাৎ দুর্ঘটনা ঘটে গেল। গুলঞ্চ গাছের একটা অপলকা ডাল ভোম্বলকে নিয়ে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। ভোম্বল অসহায়ভাবে করুণ চিৎকার করে উঠল একটা। পরক্ষণেই গাছের অন্য একটা ডাল ধরে ঝুলে পড়ল। আর ঝুলে পড়েই বলল, “বাবলু, হেল্প মি প্লিজ। আমাকে বাঁচা।”

বাবলু বিলু তরতরিয়ে গাছে উঠে ধরে ফেলল ভোম্বলকে। বাচ্চু নীচে থেকে বলল, “তখন বারণ করলাম শুনলে না তো আমাদের কথা।”

বিচ্ছু বলল, “ভাগ্যিস নীচে পড়নি। তা হলে কী হত?”

এমন সময় বাবলুর চোখে পড়ল জিনিসটা। একটা পুটলি। বড় বটগাছের ঘন পত্র-বিশিষ্ট একটি মোটা ডালে অতি যত্নে বাধা আছে। বাবলু বলল, “কী ব্যাপার বল তো?”

ততক্ষণে বিলু ভোম্বলেরও নজরে পড়েছে। বাবলু নিজেই তখন এ-ডাল ও-ডাল করে এগিয়ে গেল সেখানে। তারপর পুটলিটা হাতে নিয়েই চমকে উঠল। কয়েক বাণ্ডিল একশো টাকার নোট বাঁধা আছে তাতে। এত টাকা একসঙ্গে ডালে বাঁধা দেখলে যে-কেউ চমকে উঠবে।

টাকার পুটলি নিয়ে বাবলু নীচে নেমে এল। বিলু, ভোম্বল, বাচ্চুু, বিচ্ছু সবাই তখন ঝুকে পড়ল সেই টাকার ওপর। একসঙ্গে এত টাকা ওরা কখনও দেখেনি। টাকাগুলো নিয়ে এখন যে কী করা যায় এটাই হল সমস্যা। প্রথমে গুণে তো দেখতে হবে। কিন্তু গোনাই বা যায় কোথায়? ওরা তখন বাচ্চু-বিচ্ছু আর পঞ্চুুকে পাহারায় রেখে সেই মাধবীলতার ঝোপের ভেতর ঢুকল। বিস্ময়ের-পর-বিস্ময়। ওরা দেখল ঝোপের মধ্যে যেন একটি ছোট সংসার পাতা আছে কার। তার মানে কেউ-না-কেউ থাকে এখানে। বাবলুরা-অযথা বিলম্ব না করে গুণতে লাগল টাকাগুলো। মোট এক লক্ষ চৌষট্টি হাজার টাকা। ওদের তিনজনেরই চোখ কপালে উঠে গেল।

বিলু বলল, “টাকাগুলো নিয়ে কী করা যায় বল তো?”

বাবলু বলল, “কিছুই না। টাকা যেখানে ছিল সেখানেই বেঁধে রেখে চলে চল। পরে রাত্রিবেলা এসে ধরে ফেলব টাকার মালিককে। এখানে যে আমাদের পদার্পণ হয়েছিল এটা যেন সে কোনওরকমেই টের না পায়।” এই বলে বাবলু টাকাটা পুটলি বেঁধে যথাস্থানেই রেখে দিয়ে এল।

তারপর নৈশ অভিযান কীভাবে হবে সে সম্বন্ধে আলোচনা করতে করতে যে-যার বাড়ি চলে গেল।

রাত্রিবেলা বাড়ির লোকজন ঘুমিয়ে পড়লে ওরা সবাই চলল মিত্তিরদের বাগানে। অমাবস্যার রাত। চারিদিকে ঘুট-ঘুট করছে অন্ধকার। সেই অন্ধকারে শুরু হল অভিযান। বাবলু, বিলু, ভোম্বল তিনজনের হাতেই টর্চ। বাচ্চু-বিচ্ছু শুধু হাতে। ওরা কিন্তু সঙ্গে টর্চ থাকা সত্ত্বেও অন্ধকারে অনুমান করেই পথ চলতে লাগল। তারপর এক সময় নির্দিষ্ট স্থানের একটু দূরত্বে এসে থেমে দাঁড়াল ওরা। কারও মুখে একটি কথাও নেই।

বাবলু বলল, “হু।”

বিলু বলল, “আর এগোবি?”

বাচ্চু-বিচ্ছুর মুখ ভয়ে এতটুকু হয়ে গেছে।

ওরা এগোবে কি পিছোবে কিছুই ঠিক করতে পারল না। পঞ্চুও জিভ লকলকিয়ে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল সেই দৃশ্য। বাবলুর আদেশ না পাওয়া-পর্যন্ত কিছুই করতে পারছিল না সে।

ওরা সবাই দেখল অন্ধকারে গাছের ডালে কে যেন বসে বসে পা দোলাচ্ছে। এবং একজোড়া চোখ আগুনের গোলার মতো জ্বলছে।

বিলু বলল, “পা দোলানো দেখে আমরা ভয় পাই না। কিন্তু ওই চোখদুটো তো মানুষের নয়। ও চোখ কার?”

বাচ্চু বলল, “বাবলুদা পালিয়ে চলো।”

ভোম্বল বলল, “সেই ভাল। বাবলু, কেটে পড় ভাই।”

বাবলু বলল, “পালাবার আগে টর্চ মেরে দেখাই যাক না ওটা কী!”

এমন সময় কড়মড় কড়মড় করে একটা শব্দ উঠল। সেই সঙ্গে গরর করে একটা শব্দ। তারপরেই ‘ক্যাঁচ’।

বিলু বলল, “একটা ঢ়িল ছুড়ে দেখব?”

“না।”

বাবলুর হাতের টর্চ জ্বলে উঠল মুহুর্তের মধ্যে। পা দোলানো স্থির হয়ে গেল। পঞ্চুও তখন চিৎকার করে তেড়ে গেল সেই দিকে, “ভৌ-ভৌ-ভৌ! ভৌ-ভৌ-ভৌ। ভো-উ—উ—উ উ।”

একসঙ্গে সব কটি টর্চ জ্বলে উঠল তখন। রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে যেন খান খান হয়ে গেল। একটা ভালুক লাফিয়ে নামল গাছের ডাল থেকে। আর মাথায় রুমাল বাধা একটা লোক মাধবীলতার ঝোপের ওপর উলটে পড়ল। পঞ্চু তাড়া করল ভালুকটাকে। আর বাবলুরা ছুটে গেল লোকটিকে উদ্ধার করতে।

গাছ থেকে বে-কায়দায় পড়ে গিয়ে লোকটির সর্বাঙ্গ কেটে-কুটে-ছড়ে একশা হয়ে গেছে। খতিয়েও গেছে রীতিমতো। বাবলুরা কাছে যেতেই ভয়ে এতটুকু হয়ে গেল সে। একবার শুধু বলল, “পানি। থোড়া পানি। একটু জল।”

বাবলু বলল, “জল এখানে কোথায় পাব?”

“হ্যায়। বোতলমে।”

ওরা সবাই ধরাধরি করে কোনওরকমে ঝোপের ভেতর থেকে টেনে বার করল তাকে। লোকটা বসে বসে হাফাতে লাগল। ভোম্বল ঝোপের ভেতর টর্চ নিয়ে ঢুকতেই দেখতে পেল এক জায়গায় একটি বোতলে এক বোতল জল আছে। সেই জল এনে লোকটাকে দিতেই এক নিশ্বাসে সব জলটুকু চো-চো করে শেষ করে দিল। তারপর একটু আশ্বস্ত হলে বাবলু বলল, “কে তুমি?”

লোকটি ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার নাম ইব্রাহিম।”

“রাত্রিবেলা এখানে বসে কী করছিলে?”

লোকটি তখন বাবলুদের দিকে বেশ ভাল করে একবার তাকিয়ে নিতান্তই ছেলেমানুষ দেখে বলে উঠল, -ব-ও সব। ভাগো হিয়াসে। ঝামেলা মাৎ করো।”

ভোম্বল তখন লোকটার চুলের মুঠি ধরে ঠাস করে বসিয়ে দিয়েছে এক চড়।

চড় খেয়ে লোকটাও টিপে ধরেছে ভোম্বলকে। যেই না ধরা বাবলু, বিলুও অমনি ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর সে এক প্রচণ্ড ধস্তাধস্তি। ততক্ষণে পঞ্চুও এসে পড়েছে। পঞ্চুুর গো গো শুনে শান্ত হল লোকটি।

বাবলু বলল, “বলো তুমি এখানে কী করছিলে?”

লোকটি এবার ভালমানুষের মতোই বলল, “মেরা জিন্দগি খতম হো যায়েগা খোকাবাবু! তুম লোগ কেয়া সমঝোগে?”

বাবলু বলল, “তুমি যদি সত্যিকথা বলো তা হলে কোনও ভয় নেই। না হলে কিন্তু বিপদ হবে তোমার। ওই ভালুকটাকেই বা পেলে কোথায় তুমি?”

লোকটি তখন সব কথা খুলে বলল, সে যা বলল তা হল এই– ‘

ওর নাম ইব্রাহিম। ফৈজাবাদে ওর বাড়ি। ভালুকের নাচ দেখিয়ে পয়সা রোজগার করে ও দিনযাপন করে। কেউ কোথাও নেই ওর। ঘুরতে ঘুরতে ও কলকাতায় আসে। একদিন ও আউটরাম ঘাটে রাত কাটাচ্ছিল এমন সময় কালো মোটরে চেপে একজন লোক ওকে অনেক টাকার লোভ দেখিয়ে নিজেদের ডেরায় নিয়ে আসে। তারপর ও খেলা দেখিয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে কিছু ছেলেমেয়েকেও ওদের হাতে তুলে দেয়। ইতিমধ্যে একদিন ওদের গোপন কক্ষে ঢুকে পড়ে ও। সেখানে ঢুকে যা ও দেখল তা দেখে ওর মন-প্রাণ কেঁদে উঠল। ও দেখল একটা ঘরের ভেতর দশ-বারোটা ছেলেকে হাত-মুখ বেঁধে এক এক জনকে এক একটা হাড়ির ভেতর বসিয়ে রাখা হয়েছে। যাতে তাদের ওপরের অংশটা বাড়ে কিন্তু নীচের অংশ বাড়তে না পারে। আরও কয়েকটি ছেলে আছে। তাদের শরীরের নিম্নভাগ ছোট্ট এবং উপরিভাগ স্বাভাবিক। যে লোকটা ওকে কাজ দেবে বলে নিয়ে গিয়েছিল সেই ছিল দলের সর্দার। ওই ছেলেদের দিয়ে ভিক্ষে করিয়ে ওরা পয়সা রোজগার করে। তা ছাড়া আরও কিছু লোক আছে তারা কেউ অন্ধ, কেউ খোড়া, কারও বা গায়ে দগদগে ঘা। এদের দিয়েও ওরা ভিক্ষে করায়। এইসব দেখে ও দলের সংস্পর্শ ছেড়ে দিতে চায়। ওরা তখন মৃত্যুভয় দেখায় ওকে। মৃত্যুভয়ে ও আবার ওদের কাজ করতে রাজি হয়। কাল ও দলের হয়ে কাজ করবার নাম করে পালিয়ে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে।

সব শুনে বাবলু বলল, “বেশ, তা না হয় নিলে। কিন্তু গাছের ডালে যে অত টাকা বেঁধে রেখে তুমি উধাও হয়েছিলে সে টাকাটা পেলে কোথায় ?”

ইব্রাহিম টাকার কথায় কেমন যেন মিইয়ে গেল। বলল, “ও টাকা আসল নয় বাবু। জাল। আসবার সময় কয়েক বাণ্ডিল নিয়ে পালিয়ে এসেছি।”

বাবলু বলল, “কিন্তু পালিয়ে তুমি এখানে এলে কেন? দেশেও তো চলে যেতে পারতে। থানায় খবর দিতে পারতে। ”

“দেশে যাবার উপায় নেই বাবু। আমি ওদের দেশের ঠিকানাটাও দিয়ে দিয়েছি। ওরা ঠিকানা খুঁজে গিয়েও আমাকে গুলি করে মারত। আর থানায় গেলেও তো আমি নিজেই হাজতে ঢুকব। কেন না আমিও তো ওদের পাপ-ব্যবসায় সাহায্য করেছি।”

বাবলু বলল, “কিন্তু এখানেই কি ওদের নজর এড়িয়ে তুমি বাঁচতে পারবে?”

“এখানে আমি থাকব না। একটা ট্রাক ম্যানেজ করবার জন্যে আজ দুপুরে একবার বেরিয়েছিলাম। ভোর রাতে একটা ট্রাক যাবে। তাইতে চলে যাব।”

“কোথায় যাবে?”

“ময়ুরভঞ্জ।”

“ট্রাকের ভাড়া কি ওই জাল নোট দিয়েই দেবে?”

“তা ছাড়া আমার টাকা কই বাবু?”

বাবলুরা কী করবে এখন কিছু ভেবে পেল না। বিলু বলল, “আচ্ছা, ওদের ঘাটিটা কোনখানে?”

ইব্রাহিম বলল, “সানাপাড়ায়। জাহাজ প্যাটার্নের বাড়ি। বাড়ির চিলেকোঠার মাথায় একটা মাস্তুলের মতো আছে। তাইতে একটা প্যাঁচা বসানো আছে। পাথরের প্যাঁচা।”

বাবলু বলল, “কালই তা হলে সন্ধান নিতে হচ্ছে তো।”

ইব্রাহিম বলল, “দয়া করে আমার কথা যেন কিছু বলে ফেলবেন না খোকাবাবুরা। ওরা আমার জিন্দগি বরবাদ করে দেবে।” তারপর বলল, “আপনাদের একটা টর্চ একবার দিন আমায়। টাকাটা গাছ থেকে নামিয়ে নিয়ে আসি। আর দেখি সুন্দরটা গেল কোথায়।”

বাবলু বলল, “সুন্দরী!”

“আমার ভালুকটার নাম।”

“যাও যাও দেখ। না হলে কাউকে হয়তো আঁচড়ে কামড়ে বসে থাকবে।”

“না বাবু! কামড়াতে ও জানে না। ওর মুখ বাঁধা। আর আঁচড়াতেও পারে না। পায়ের নখ কাটা বলে। ভালুকটা আমার বড় প্রিয়। ওকে নাচিয়ে আমি কত পয়সা আয় করেছি। ওর মায়াতেই তো কোথাও যেতে পারি না। একা হলে এতক্ষণে হয়তো আমি হিমালয়ে চলে যেতাম।”

ইব্রাহিম বাবলুর টর্চ নিয়ে গাছে উঠল। তারপর টাকার পুটলিটা পেড়ে নামাতে গিয়ে দেখল ভালুকটা ফের ডালে শুয়ে আছে। ইব্রাহিম গাছ থেকে টৰ্চটা বাবলুর হাতে দিয়ে বলল, “বহুৎ মেহেরবানি খোকাবাবু! লোকন আমার কথা কাউকে বলবেন না কেমন?”

বাবলুরা বলল, “আচ্ছা। কিন্তু তোমার ওই জাল নোটের বাণ্ডিলটা তুমি আমাদের দিয়ে দাও।”

না খোকাবাবু না। ওটা দিলে আমি না খেতে পেয়ে মরে যাব।”

”তোমাদের মতো লোকের মরে যাওয়াই দরকার। যারা টাকার লোভে পরের ছেলেকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে শয়তানের হাতে তুলে দেয় তাদের মরা উচিত।”

“তা আপনি যাই বলুন ও টাকা আমি দিচ্ছি না।”

“দেবে না?”

“না।”

বাবলু ডাকল, “পঞ্চু!”

পঞ্চু ইব্রাহিমের দিকে তাকিয়ে গরর করে উঠল। পঞ্চুুর রোখ দেখে নার্ভাস হয়ে পড়ল ইব্রাহিম।

বাবলু কড়া গলায় বলল, “দাও বলছি।”

পঞ্চুু কিন্তু ইব্রাহিমের দেওয়ারও অপেক্ষা রাখল না। তার ওপর আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ে হাত থেকে ছিনিয়ে নিল পুটলিটা।

বাবলু বলল, “ঠিক আছে। আজ তা হলে চলি কেমন? গুড নাইট। আর যদি নিজের মঙ্গল চাও কাল ভোর বেলাতেই চলে যেয়ো।”

এই বলে ওরা সবাই চলে গেল।

আর ইব্রাহিম ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল ওদের চলে যাওয়ার পথের দিকে।

পরদিন সকালে পাণ্ডব গোয়েন্দারা থানায় গিয়ে সব কথা খুলে বলল এবং টাকাগুলো জমা দিল পুলিশকে। টাকাগুলো দেখেই চমকে উঠলেন ওসি। বললেন, “আরে এ তো জাল নোট নয়। এ তো আসল টাকা। কিছুদিন আগে একটা ব্যাঙ্ক-ডাকাতি হয়েছিল এ সেই টাকা।”

বাবলু বলল, “তাই নাকি। কিন্তু ইব্রাহিম যে বলল…।”

“সে হয় জানত না। না হলে মিথ্যে কথা বলেছে। তবে মনে হয় জানত না। জানলে সামান্য একটা ভালুকের মোহে পড়ে থাকত না। তবে লোকটাকে ছেড়ে দিয়ে খুব ভুল করেছ। যাক। ময়ূরভঞ্জের দিকে গেছে তো ? ওকে এখনই ধরার ব্যবস্থা করছি।”

বাবলু বলল, “আমরা তা হলে আসি?”

“এসো।”

ওরা থানা থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছে এমন সময় হঠাৎ ওদের নজরে পড়ল একটা লোক সাইকেল চেপে দ্রুত মিত্তিরদের বাগান থেকে বেরিয়ে আসছে।

ভোম্বল বলল, “লোকটাকে চিনি। প্রায়ই ময়দান-গ্যালারিতে বসে থাকে সন্ধের সময়।”

বিলু বলল, “তা থাকুক। কিন্তু ও লোক এখানে কেন?”

বাবলু বলল, “বাগানে গিয়েই দেখা যাক কী ব্যাপার।”

ওরা সকলে বাগানে গিয়ে সেই মাধবীলতার ঝোপের দিকে এগিয়ে চলল। ঝোপের কাছে গিয়েই চক্ষুস্থির। দেখল ইব্রাহিম আর তার সাধের ভালুক মৃত অবস্থায় পড়ে আছে। দুজনেরই দেহে গুলির দাগ। ভালুকের ছালটা ছাড়ানো।

বাবলুরা ইব্রাহিমকে স্পর্শ করে দেখল। দেহটা শক্ত ও শীতল। তার মানে এখনকার কাজ নয়। কাল রাতেই শেষ করে দেওয়া হয়েছে ওদের।

বিলু বলল, “এখন কী করবি বাবলু?” .

“আর একবার থানায় যাব। তারপর আজই সন্ধের সময় ময়দানে গিয়ে সাইকেলে চাপা লোকটাকে ফলো করব। ইতিমধ্যে দুপুরবেলা সন্ধান নিয়ে আসব সেই জাহাজবাড়িটার। তারপর পুলিশে ইনফর্ম করে ধরিয়ে দেব দলটাকে ৷ ”

সবাই আনন্দে মেনে নিল বাবলুর কথা।

সারাদিন ধরে সবাই মিলে অনেক ঘুরেও যখন ইব্রাহিমের সেই জাহাজবাড়ির সন্ধান পেল না তখন বুঝতে পারল ইব্রাহিমের সব কথাই মিথ্যে। অন্তত ওর পরিচয়ের ব্যাপারে। আসলে ওর নাম ইব্রাহিম কিনা তাই বা কে জানে? সে যাক। মরেছে যখন আপদ চুকেছে। ঠিক ভর সন্ধেবেলা বাবলু, ভোম্বল ও পঞ্চু ময়দানে চলল লোকটাকে ফলো করতে।

ময়দানের আশপাশে একটু ঘোরাঘুরির পর লোকটাকে একটি অ্যাটাচি হাতে নিয়ে আসতে দেখা গেল। লোকটির মাথায় হ্যাট, মুখে চুরুট, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। আর গালের ওপর বিশ্রী একটা কাটা দাগ। সঙ্গে এক বেঁটে মস্তান।

বাবলুরা গ্যালারির পিছনে পাঁচিলের অন্ধকার মতো জায়গাটায় ঘাপটি মেরে বসে রইল। লোক দু’জন গ্যালারিতে বসলে ওরা প্রায় কুমিরের মতো বুকে হেঁটে পাঁচিলের গা ঘেঁষে ওদের কাছাকাছি গেল।

কিন্তু ওরা সেই নির্জনেও এমনভাবে ফিস ফিসিয়ে কথা বলতে লাগল যে বাবলুরা তা শুনতেই পেল না।

বাবলু বলল, “বৃথা চেষ্টা। তুই এক কাজ কর ভোম্বল। ওদের অ্যাটাচিটা ঝেড়ে আন। সন্তৰ্পণে যাবি। যাতে টের না পায়।”

ভোম্বলকে শুধু বলার অপেক্ষা। সে নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে অ্যাটাচিতে টান দিতেই লাফিয়ে উঠল লোকটা। তারপর ভোম্বলের হাত ধরে টেনে তুলে নিল গ্যালারির ওপর।

বেঁটে লোকটা বলল, “চোরের ওপর বাটপাড়ি করতে এসেছিস ব্যাটা! কদিন লাইনে এসেছিস বল?” ভোম্বল নীরব। বেঁটেটা ভোম্বলের গালে একটা চড় মারল, “বল বলছি।” গালকাটা বলল, “মারার দরকার নেই। এই রকম একটা ছেলেই আমি খুঁজছিলাম এতদিন। একে আমাদের কাজে লাগাব। তুমি যাও। আমার গাড়িটা আনার ব্যবস্থা করো।”

ভোম্বল বলল, “আমার নাম নীল আর্মস্ট্রং।”

লোকটি হেসে বলল, “গুড়। তুমি আমার মনের মতো ছেলে। আমাদের দলের হয়ে কাজ করবে তুমি!”

ভোম্বল বলল, “কত মাইনে দেবেন।”

“ধরো মাসে পাঁচশো টাকা।”

“সে তোমাকে বলে দেবোখন। কোথায় থাক তুমি?”

“৩ নম্বর আকাশ পাতাল রোড়ে।”

লোকটি এবার রেগে গেল, “বেশি ফাজলামো করো না হে ছোকরা, বুঝেছ?”

ভোম্বল তখন লোকটির অন্যমনস্কতার সুযোগে অ্যাটাচিটা হাতে নিয়েই গ্যালারি থেকে এক লাফ। বিহ্বল লোকটি একটু থমমত খেয়ে ছুটে আসতেই ভোম্বল সেটা অদূরে দণ্ডায়মান বাবলুকে ছুড়ে দিল। বাবলু সেটা লুফে নিয়েই লেলিয়ে দিল পঞ্চুুকে। পঞ্চুু বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকটির ওপর। তারপর আঁচড়ে কামড়ে এমন তাড়া লাগাল যে ময়দান থেকে পালাতে পথ পেল না বাছাধন। বাবলুরাও বিপদমুক্ত হয়ে অ্যাটাচিটা নিয়ে ফিরে এল।

বিলু-বাচ্চু আর বিচ্ছু অপেক্ষা করছিল বাবলু ও ভোম্বলের জন্যে। ওরা যেতেই উৎসুক হয়ে জানতে চাইল কি হল না হল।

বাবলু সব কথা খুলে বলল ওদের। তারপর সবাই মিলে ভেঙে ফেলল অ্যাটাচিটা। ভেতরটা তন্ন তন্ন করে খুঁজে কতকগুলো টাইপ করা কাগজ ও ঠিকানা লেখা কার্ড ছাড়া আর কিছুই পেল না। ঠিকানা যা লেখা আছে তা হাজারহাত কালীতলার দিকে।

বাবলু বলল, “দেরি নয়। আজই এবং এখনই যাব সবাই। চল।”

যাত্রা হল শুরু। পাণ্ডব গোয়েন্দার দল পঞ্চু সমেত চলে এল হাজারহাত কালীতলায়। তারপর নম্বর মিলিয়ে যেখানে এল সে এক মস্ত পাঁচিল ঘেরা বাগানবাড়ি।”

বাবলু বলল, “এই হচ্ছে শয়তানের ঘাটি। অন্তত এর পরিবেশ তাই বলে দিচ্ছে। তা যাক। এর ভেতরে আমাদের যেমন করেই হোক প্রবেশ করতে হবে। বিলু আমি পঞ্চু ভেতরে ঢুকব। ভোম্বল, তুই বাচ্চু-বিচ্ছুকে নিয়ে বাইরে থাকবি। আমার কাছে হুইসিল আছে। যদি কোনওরকম গোলমাল বুঝি তা হলে বাজাব। তোরা সঙ্গে সঙ্গে থানায় চলে যাবি। আর তোরা যদি বেগতিক বুঝিস তবে ভোম্বল তুই কোকিলের গলা করে ডাকতে থাকবি। আমরা হুশিয়ার হয়ে যাব।”

ভোম্বল বলল, “আচ্ছা।” বাবলু আর বিলু তখন পাঁচিল টপকাবার ব্যবস্থা করতে লাগল। একদিকে পাঁচিলের লাগোয়া একটা লাইট পোস্ট ছিল। তা বেয়ে বাবলু পাঁচিলে উঠল। বিলু করল কী পঞ্চুুকে দুহাতে চাগিয়ে তুলল। অমনি বাবলুও ধরে নিল পঞ্চুকে। তারপর বিলু উঠল। পাঁচিল থেকে বাগানেও নামল একই কায়দায়। একটা নারকেল গাছ বেয়ে। পঞ্চু অবশ্য লাফিয়ে নামল।

বাগানে নেমে প্রথমেই একটি কামিনী গাছের ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে পড়ল ওরা। তারপর তার ভেতরে বসে বেশ ভালভাবে চারদিক দেখে যখন দেখল কেউ কোথাও নেই তখন ওরা খুব সন্তৰ্পণে এগিয়ে চলল বাগানের মধ্যস্থিত প্রকাণ্ড বাড়িটার দিকে। কিন্তু সমস্যা হল বাড়ির ভেতর প্রবেশ করা নিয়ে। নীচের তলার দরজা ভেতর থেকেই বন্ধ। একটা কাঠালগাছ শুধু বারান্দার গা ঘেঁষে ডালপাতা মেলে বাতাসে শিরশির করছে। বাবলু আর বিলু পঞ্চুকে সঙ্গে নিয়ে সেই গাছ বেয়ে বারান্দায় নামল।

বারান্দার পাশেই একটু ছোট্ট প্যাসেজ। সেটায় ঢুকতেই ওরা ভেতর বাড়িতে চলে এল। বাড়িতে লোকজনের চিহ্নমাত্র নেই। সেকেলে চুন বালিখসা পুরনো বাড়ি। ভেতরে ঢুকেই ওরা নীচে নামবার সিঁড়ি পেল। সেই সিঁড়ি বেয়ে কয়েক ধাপ নামতেই চক্ষুস্থির হয়ে গেল দুজনের। ওরা সবিস্ময়ে দেখল একটা ঘরের ভেতর দু’জন ভয়ংকর চেহারার লোক হাত-পা ও মুখ বেঁধে হাড়ির মধ্যে বসানো কয়েকটি ছেলেকে নির্মমভাবে বেত্ৰাঘাত করছে। আর একটা থামে বাঁধা লোকের পিঠে মাঝে মাঝে ঝামা ঘষে ছাল চামড়া উঠিয়ে দগদগে ঘা করে দিচ্ছে। এ লোকটার মুখ এমনভাবে বাধা যে সে কিছুতেই চিৎকার করতে পারছে না। দেখে ওদের চোখে জল এসে গেল।

এমন সময় হঠাৎ শোনা গেল কোকিলের ডাক। বাবলু বলল, “লুকিয়ে পড় বিলু। এ ডাক ভোম্বলের। নিশ্চয়ই কেউ আসছে।” ওরা দুজন তখনই পঞ্চুুকে নিয়ে লুকিয়ে পড়ল এক পাশে একটু পরেই দেখা গেল ময়দানের সেই লোকদুটো আসছে। গালকাটা এবং বেঁটেটা ওরা ঘরে ঢুকল। গালকাটা ভেতরের লোকদের বলল, “খুব সাবধান। কালকের মার্ডারের ব্যাপারে পুলিশ আমাদের ধরবার জন্যে তৎপর হয়েছে।”

“সেটা তো আমিও ভেবে পাচ্ছি না। তার ওপর অ্যাটাচিটা খোয়ালাম।” ভেতরের সেই সাংঘাতিক চেহারার লোকদের একজন বলল, “কিন্তু আপনার সারা গা এমন ছড়ে কেটে গেল কী করে?”

“সে কথা আর বলো না। দুটো হাড় বজাত ছেলের কাণ্ড কুকুর লেলিয়ে দিয়েছিল। একবার এই ঝামেলাটা একটু সামলে নিই। তারপর নিজে হাতে খুন করব ওদের।”

বিলু ফিসফিস করে বাবলুকে বলল, “পালিয়ে চল বাবলু না হলে ওরা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলেই ধরে ফেলবে আমাদের।”

কিন্তু কান বটে শয়তানদের। বিলু চাপা গলায় বললেও কথাটা কানে যেতেই সাংঘাতিক লোকদুটাে ছুটে এল, “কে ! কে ওখানে?”

আর কে। বাবলু খুব জোরে হুইশিল বাজিয়েই বলল, “বিলু তুই পালা। আমি দেখছি ততক্ষণ ব্যাটাদের। পঞ্চুু আমার কাছেই থাক।”

বাবলু কিছু বলার আগেই যে লোকদুটো ওদের তেড়ে এসেছিল পঞ্চু তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আঁচড়ে কামড়ে ছিড়ে ফেলল একেবারে।

বিলু তখন চলে গেছে। লোকদুটো বাবা রে মারে করে ঢুকে পড়ল ঘরের ভেতরে। তারপর চোখের পলকে দুজনে দুটো লাঠি নিয়ে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল। একজন পড়ল পঞ্চুকে নিয়ে। আর একজন তেড়ে এল বাবলুর দিকে। পঞ্চু অদ্ভুত কায়দায় লাফিয়ে লাফিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে লাগল। আর বাবলু উপায়ান্তর না দেখে তরতরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে পালাবার চেষ্টা করল। সিঁড়ির ওপর ধাপে মস্ত একটা কাঠের পিপে বসানো ছিল। বাবলু তাড়াতাড়ি সেটাকে গায়ের জোরে উলটে গড়িয়ে দিল নীচের দিকে। যে লোকটা বাবলুকে তেড়ে আসছিল সে তখন বেকায়দা দেখে পালাতে গেল। কিন্তু ততক্ষণে পিপেটা গড়াতে গড়াতে তার ওপর গিয়ে সজোরে মারল এক ধাক্কা লোকটা হেটমুণ্ডে থুবড়ে পড়ল। গালকাটা লোকটা তখন ঘরের ভেতর চেঁচাচ্ছে, “সাংঘাতিক, কী সাংঘাতিক।”

বেঁটেট বলল, “সেই ছেলেদুটো। সেই ডেঞ্জারাস ছেলেদুটো।”

বাবলুও ততক্ষণে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। বাইরে বেরিয়েই সে দেখল চারদিকে থিক থিক করছে পুলিশ।

ভোম্বল বলল, “তোরা দুজনে পাঁচিল টপকাবার পরই আমি বাচ্চু-বিচ্ছুকে থানায় পাঠিয়েছিলাম। কে জানে কখন কী ঘটে।”

বাবলু বলল, “বেশ করেছিস।”

পুলিশের লোকেরা তখন ঘাঁটিতে ঢুকে চারজনকেই অ্যারেস্ট করেছে।

বাবলু ও সিকে বলল, “এদের একটা অ্যাটাচি আমার কাছে আছে। কাল আপনাকে দিয়ে আসব। যে সব কাগজপত্তর রয়েছে তাতে করে এদের দলের আরও অনেক কিছু ফাঁস হবে বলে মনে করি।”

ওসি বললেন—তোমাদের প্রত্যেককে আমার অভিনন্দন জানাচ্ছি। চলো তোমাদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।

পঞ্চুু সমেত পাণ্ডব গোয়েন্দারা সবাই পুলিশের জিপে চেপে বসল। বাবলুর মনে শুধু একটা রহস্যই দানা বেঁধে রইল। ইব্রাহিম তা হলে কে? তার সত্যিকারের পরিচয়টাই বা কী?

তার যে পরিচয়ই হোক, পাণ্ডব গোয়েন্দাদের জয় জয়কার। জিপ থেকে নামার পরই বিলু চেঁচিয়ে উঠল, “থ্রি চিয়ার্স ফর পাণ্ডব গোয়েন্দা।”

সবাই বলল, “হিপ হিপ হুরর রে।”

পঞ্চুও উল্লাসে ডেকে উঠল, “ভৌ। ভৌ ভোঁ।”

No comments