কুটুম-কাটাম – সত্যজিৎ রায়
কোথায় পেলি এটা?
আমাদের বাড়ির কাছেই ছিল, বলল দিলীপ। একটা জমি পড়ে আছে কাঠা তিনেক, তাতে কয়েকটা গাছ আর ঝোঁপঝাড়। একটা গাছের নীচে এটা পড়ে ছিল। অলোকের বাড়িতে সেদিন দেখছিলাম একটা গাছের গুঁড়িকে কেটে তার উপর গোল কাঁচ বসিয়ে টেবিল হিসেবে ব্যবহার করছে। দেখে আমারও শখ হয়েছিল। গুঁড়ির বদলে এইটে পেলাম।
ব্যাপারটা আর কিছুই না–একটা গাছের ডালের অংশ, সেটাকে একভাবে ধরলে একটা চতুষ্পদ জানোয়ারের মতো দেখতে লাগে। জিনিসটাকে চার পায়ে দাঁড় করানো যায়–যদিও একটা পা একটু বেঁটে বলে কাত হয়ে থাকে। পিঠটা ধনুকের মতো বাঁকা। একটা লম্বা গলাও আছে, আর তার শেষের অমসৃণ অংশটাকে একটা মুখ বলে কল্পনা করে নেওয়া যায়। এ ছাড়া আছে একটা এক ইঞ্চি লম্বা মোটা লেজ। সব মিলিয়ে জিনিসটাকে বেশ দেখবার মতো। দিলীপের যে চোখে পড়েছে সেটাই আশ্চর্য। অবিশ্যি আশ্চর্যই বা বলি কী করে–দিলীপ চিরকালই একটু আর্টিস্টিক মেজাজের। স্কুলে থাকতে বইয়ের পাতার ভিতর ফুলের পাপড়ি আর ফার্ণ গুঁজে রাখত। ওর সারা বাড়িতে ছোটখাটো শিল্পদ্রব্য ছড়ানো রয়েছে যাতে সুরুচির পরিচয় মেলে। ঢোকরা কামারদের কাজ দেখতে একবার বোলপুর থেকে ঘুসকরা চলে গিয়েছিল–সেখান থেকে আমাদের সকলের জন্যই একটা করে ঢেকরার কাজের নমুনা নিয়ে এসেছিল–প্যাঁচা, মাছ, গণেশ, পাত্র–যেগুলো ভারী চমৎকার।
আমি বললাম, এ ধরনের জিনিস কিন্তু তুই-ই প্রথম সংগ্রহ করছিস না। গাছের ডালের পুতুল তোর। আগে আরেকজন জমিয়ে গেছে।
অবনীন্দ্রনাথ তো? জানি। তিনি এগুলোকে বলতেন কুটুম কাটাম। এটাকে কী বলা যায় বল তো? কী জানোয়ার এটা? শেয়াল না শুয়োর না কুকুর?
নাম একটা ভেবে বার করা যাবে। আপাতত কোথায় রাখছিস জিনিসটাকে?
আমার শোয়ার ঘরের তাকে। কালই তো সবে পেয়েছি। তুই এসে গেলি বলে তোকে দেখালাম।
আমি আছি একটা বিজ্ঞাপনের আপিসে, আর দিলীপ কাজ করে একটা ব্যাঙ্কে। দিলীপ বিয়ে করেনি এখনও; আমার একটা সংসার আছে; একটি পাঁচ বছরের ছেলে আছে, তাকে সবে স্কুলে ভর্তি করেছি। দিলীপের বাড়িতে মাঝে মাঝে সন্ধ্যাবেলা আড্ডা হয়, আমাদের আরও দুই বন্ধু সীতাংশু আর রণেন আসে। ব্রিজ খেলা হয়। দিলীপ গাছের ডালটা পাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই আড্ডায় সকলকে দেখাল। রণেন প্রচণ্ড বেরসিক, তার চোখে জানোয়ার ধরা পড়ল না, বলল, মিথ্যে আবর্জনা এনে বাড়ি বোঝাই করছিস কেন? এতে কতরকম জার্মস থাকতে পারে জানিস? তা ছাড়া পিঁপড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে জিনিসটার গায়ে।
সেদিন আড্ডা চলল সাড়ে নটা পর্যন্ত। তারপর দিলীপ আমার দিকে ইশারা করে আমাকে কিছুক্ষণ থাকতে বলে অন্যদের দরজার মুখে পৌঁছে দিল। তারপর দরজা বন্ধ করে আমার কাছে আসতে আমি বললাম, কী ব্যাপার? আজ তোকে যেন একটু অন্যমনস্ক মনে হচ্ছে?
দিলীপ উত্তর দেবার আগে একটু দম নিয়ে নিল।
তুই তো শুনলে হেসে উড়িয়ে দিবি, কিন্তু আমি না বলে পারছি না।
কী ব্যাপার?
এই গাছের ডালটা। আমি অলৌকিক বিশ্বাস করি না, কিন্তু এটাকে অলৌকিক ছাড়া আর কী বলা যায় জানি না।
ব্যাপারটা খুলে বলবি?
মাঝরাত্তিরে তাকের উপর থেকে একটা অদ্ভুত শব্দ শুনতে পাই–যেখানে জানোয়ারটা থাকে।
কীসের শব্দ?
একটা ফুটোর মধ্যে দিয়ে হাওয়া বইলে যেরকম শিসের মতো শব্দ হয়, কতকটা সেইরকম কিন্তু তার সঙ্গে যেন একটা কান্নার ভাব মেশানো।
তুই তখন কী করিস?
আওয়াজটা বেশিক্ষণ চলে না, কিন্তু আরেকটা ব্যাপার আছে। ওটাকে আমি দাঁড় করিয়ে রাখি, কিন্তু আজ সকালে উঠে দেখি কাত হয়ে পড়ে আছে।
সে তো হাওয়ায় পড়ে যেতে পারে।
তা পারে, কিন্তু কান্নার ব্যাপারটা? আমি আমার সাহসের বড়াই করতাম, কিন্তু এখন আর করি না। অবিশ্যি ওটাকে ফেলে দিয়ে আসতে পারি, কিন্তু জিনিসটাকে আমার সত্যিই ভাল লেগে গেছে।
আরও দুদিন দ্যাখ, তারপর আমাকে বলিস। আমার মনে হয় তুই ভুল শুনেছিস, কিংবা স্বপ্ন দেখেছিস।
দিলীপের ব্যাপারটা আমার কাছে পাগলের প্রলাপের মতো মনে হল। ছেলেটা একটু বেশি কল্পনাপ্রবণ এটা চিরকালই লক্ষ করে এসেছি। যাই হোক, তাকে রাজি করানো গেল যে সে আরও কিছুদিন দেখবে।
কিন্তু দুদিন পরেই আপিসে দিলীপের টেলিফোন পেলাম।
কে, প্রমোদ?
হ্যাঁ–কী ব্যাপার?
একবার চলে আয়–কথা আছে।
কী আর করি–বিকেলবেলা আপিসের পর দিলীপের বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম। দিলীপ বলল, বউদিকে একটা ফোন করে দে।
কেন? কী ব্যাপার?
বলবি আজ রাত্রে আমার বাড়িতে থাকছিস। কেন থাকছিস সেটা পরে বুঝিয়ে বললেই হবে।
দিলীপ কথাগুলো বলল অত্যন্ত সিরিয়াস ভাবে, তাই তার অনুরোধ ঠেলতে পারলাম না।
দিলীপকে জিজ্ঞেস করেও কারণটা জানা গেল না। তবে আন্দাজে বুঝলাম ওই জানোয়ারটা নিয়েই সমস্যা।
নিউ আলিপুরে বিংশ শতাব্দীতে এমন ঘটনা ঘটছে ভাবতে অদ্ভুত লাগে, কিন্তু অলৌকিকের যে স্থান কাল পাত্র বিচার নেই, সেটা আমি অনেক জায়গায় পড়েছি।
খাওয়াদাওয়া সেরে শোয়ার ঘরে এসে দিলীপ বলল, মুশকিল হচ্ছে কি, জানোয়ারটাকে যত দেখছি তত বেশি ভাল লাগছে–শুধু ওই গোলমালটা যদি না থাকত।
আমরা কি জেগে থাকব না ঘুমোব? আমি প্রশ্ন করলাম।
তোর যদি অসুবিধা না হয় তা হলে জেগেই থাকি। আমার ধারণা, বেশিক্ষণ জাগতে হবে না। আমি গত কদিন রাত্রে প্রায় ঘুমোইনি বললেই চলে।
আমি আর দিলীপকে ঘাঁটালাম না। যা দেখবার তা তো দেখতেই পাব স্বচক্ষে।
আমরা দুজনে খাটে বসলাম, দিলীপ ঘরের বাতিটা নিভিয়ে দিল। বাইরে চাঁদের আলো রয়েছে। ত্রয়োদশীর চাঁদ, পরশু লক্ষ্মীপুজো। সেই চাঁদের আলো জানলা দিয়ে এসে ঘরে ঢুকেছে, আর মেঝে থেকে প্রতিফলিত হয়ে সেই আলোয় দিব্যি দেখতে পাচ্ছি তাকের উপরে রাখা জানোয়ারটাকে।
সিগারেট খাওয়া চলতে পারে? আমি জিজ্ঞেস করলাম দিলীপকে।
স্বচ্ছন্দে।
দিলীপ নিজে পান সিগারেট চা কিচ্ছু খায় না।
এগারোটা নাগাদ প্রথম সিগারেট খেয়ে সাড়ে বারোটায় দ্বিতীয়টা ধরাতে যাব এমন সময় হাওয়ার শব্দটা পেলাম। মিহি শব্দ, আর তাতে একটা সুর আছে। সে সুরকে কান্নার সুর বললেই তার সবচেয়ে যথাযথ বর্ণনা হয়।
আমি আর দ্বিতীয় সিগারেটটা ধরালাম না।
শব্দটা যে তাকের দিক থেকেই আসছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
এবার আরেকটা জিনিস লক্ষ করলাম।
জানোয়ারটা যেন নড়াচড়া করছে। বারবার সামনের দিকে নিচু হয়ে পিছনের পা দুটো তাকের উপর আছড়ে ফেলছে। তার ফলে একটা খট খট শব্দ হচ্ছে।
দিলীপের কথা আর অবিশ্বাস করার উপায় নেই। আমি স্বচক্ষে দেখছি ঘটনাটা। বেশ বুঝতে পারছি দিলীপ আমার পাশে কাঠ হয়ে বসে আছে, তার বাঁ হাত দিয়ে আমার শার্টের আস্তিনটা খামচে ধরে। দিলীপ এতটা ভয় পেয়েছে বলেই হয়তো আমার ভয়টা অপেক্ষাকৃত কম, কিন্তু নিজের মধ্যে ঢিপঢিপানি আমি নিজের কানেই শুনতে পাচ্ছি।
কিন্তু এর পরেই যেটা হল সেটার জন্য আমরা মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না, এবং সেটা চরম ভয়াবহ।
হঠাৎ তাকের উপর থেকে জানোয়ারটা এক লাফে সোজা একেবারে দিলীপের বুকের উপর এসে পড়ল। দিলীপ চিৎকার করে উঠেছে, আর আমি গাছের ডালটাকে খামচে ধরে দিলীপের বুক থেকে ছাড়িয়ে এনেছি। কিন্তু বেশ বুঝতে পারছি সেটা আমার মুঠোর মধ্যে ছটফট করছে। আমি তবু মনে যতটা সাহস আনা যায় এনে সেটাকে মুঠোর মধ্যেই ধরে রাখলাম। এখন বুঝলাম সেটা নিস্তেজ হয়ে পড়েছে।
এবার জানোয়ারটাকে নিয়ে গিয়ে আবার তাকের উপর রেখে দিলাম।
বাকি রাত আর কোনও গণ্ডগোল নেই। না হলেও দুজনের কারুরই ঘুম এল না। সকাল হতেই দিলীপ বলল, ওটা যেখানে ছিল সেখানেই ফেলে আসি।
আমি বললাম, আমার মাথায় কিন্তু অন্যরকম একটা চিন্তা এসেছে।
সেটা কী?
ফেলে আসবার কথাটা আমার মনে হয়নি, তবু তুই যেখানে উলটা পেয়েছিলি সেখানে একবার যাওয়া দরকার–এক্ষুনি।
দিলীপ এখনও ঠিক প্রকৃতিস্থ হয়নি। এর মধ্যে তাকে দু-একবার শিউরে উঠতে দেখেছি। সে বলল, সেখানেই তো যাব, গিয়ে জিনিসটাকে ফেলে আসব।
ফেলব কিনা সেটা পরে স্থির করা যাবে–আগে একবার জায়গাটায় চল।
ওই গাছের ডালটাকে নিয়ে?
সেটার এখনও দরকার নেই।
আমরা দুজনে বেরিয়ে পড়লাম। বাড়ি থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের হাঁটাপথ। তিনদিক বাড়িতে ঘেরা একটা পোড়ো জমি, তাতে একটা তাল, একটা কাঁঠাল, আর একটা অজানা গাছ, আর কিছু ঝোঁপঝাড়। এটা যে এখনও কেন পড়ে আছে তা জানি না।
দিলীপ আমাকে নিয়ে গেল কাঁঠাল গাছটার নীচে। একটা বিশেষ ঝোঁপের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ওর পাশেই পেয়েছিলাম ডালটা।
আমি তার আশেপাশে খুঁজতে লাগলাম।
বেশি খুঁজতে হল না। তিন মিনিটের মধ্যেই আমি হাতে করে তুলে ধরলাম একটা গাছের ডাল, যেটা বলা চলে দিলীপের বাড়িতে যেটা আছে সেটার প্রায় যমজ। তফাত কেবল যে এটার লেজ নেই।
দিলীপ প্রশ্ন করল, কী করবি এটা নিয়ে?
বললাম, আমি করব না, তুই করবি। তুই এটাকে অন্যটার পাশে রাখবি। আজও রাত্রে আমি তোর বাড়িতে থাকব। দেখি কী হয়।
দুই জানোয়ার সারারাত ধরে দিলীপের ঘরের তাকে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রইল; কোনও গোলমাল নেই।
আমি বললাম, বোঝাই যাচ্ছে দ্বিতীয়টা ওর দোস্ত। তুই দুটোর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটিয়েছিলি বলে যত গণ্ডগোল।
কিন্তু এমনও হয় বিংশ শতাব্দীতে?
আমি শেকসপিয়র আউড়ে দিলাম–স্বর্গে মর্তে এমন অনেক কিছুই ঘটে, হোরেশিও, যা তোমাদের দার্শনিকেরা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না।
এগুলোর নাম–?
কুটুম আর কাটাম।
সন্দেশ, আষাঢ় ১৩৯৪
Post a Comment