মাসাউকি খাতাঁওরা – হুমায়ূন আহমেদ

মাসাউকি খাতাঁওরা – হুমায়ূন আহমেদ

মধ্যবিত্তদের জীবনে উত্তেজনা সৃষ্টির মতো ঘটনা বড় একটা ঘটে না। তাদের জীবনযাত্রা খাওয়া ঘুমানো এবং টিভি দেখার মধ্যেই মোটামুটি সীমাবদ্ধ। কিন্তু আমার ছোটভাইয়ের বাসায় ব্যতিক্রম হলো। তাদের বাসায় উত্তেজনা সৃষ্টির মতো একটা ঘটনা ঘটার উপক্রম হলো। শুনলাম, এক জাপানি যুবক নাকি তার বাসায় একমাস থাকবে। জাপান-বাংলাদেশ টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রামের সে একজন কর্মী, বাংলাদেশের গ্রামে দু’বছর কাটাবে। তবে পোস্টিং হওয়ার আগে বাংলাদেশের কোনো এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সঙ্গে তাকে এক মাস কাটাতে হবে, যাতে সে আমাদের রীতি-নীতি, আচার-আচরণ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পায়।

জাপানি যুবকের জন্যে আমার ছোটভাইয়ের পল্লবীর বাসায় দোতলায় একটা ঘর খালি করা হলো। জানালায় নতুন পর্দা দেওয়া হলো। বিছানায় নতুন চাদর। টেবিলে ফুলদানিতে গোলাপ। বাথরুমে টয়লেট পেপার। বিদেশি অতিথি। আদর যতের যেন ক্রটি না হয়। এই অতিথি অন্য সব অতিথির মতো নয়। সে হচ্ছে পেইং গেস্ট। যে ক’দিন থাকবে সে-ক’দিনের জন্যে টাকা দেবে। পেইং গেস্ট হলেও তার মূল কাজ আমাদের জীবনযাত্রা লক্ষ করা। আমাদের কালচার সম্পর্কে ধারণা নেওয়া। যেহেতু বাঙালি সংস্কৃতি সম্পর্কে সে ধারণা নেবে। কাজেই আমাদের সচেতন থাকতে হবে, কোনো ভুল ধারণা যেন সে না পায়।

তার সন্ধ্যাবেলা আসার কথা। বাসার সবাই বিকেল থেকে সেজেগুঁজে অপেক্ষা করতে লাগল। বাচ্চাদের উৎসাহই সবচেয়ে বেশি। তারা কথাবার্তা কীভাবে বলবে তা-ই নিয়ে মহাচিন্তিত। দোকান থেকে কুৎসিত আকৃতির বিশাল সাইজের মিষ্টি আনা হয়েছে, যাতে বিদেশি অতিথিকে মিষ্টির আয়তন দেখিয়ে ভড়কে দেওয়া যায়।

অতিথি এল সন্ধ্যাবেলা। পায়ে বুটজুতা, পরনে চকচকে সবুজ লুঙ্গি, গায়ে ফতুয়া। আমরা তাকে ভড়কাতে চেয়েছিলাম। বিচিত্র পোশাক দিয়ে শুরুতেই সে আমাদের ভড়কে দিল। অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে মাথা নুইয়ে বো করল। একবার না, কয়েকবার। তারপর হাসিমুখে পরিষ্কার বাংলায় বলল, আমার নাম মাসাউকি খাতাওরা। আশা করি আপনারা ভালো আছেন। শুভ সন্ধ্যা।

আমরা তার পোশাক দেখে মুগ্ধ। তার দুধে আলতা গায়ের রঙ দেখে মুগ্ধ। তার পরিষ্কার বাংলা শুনে মুগ্ধ। জানলাম প্রয়োজনীয় বাংলা সে জাপান থেকেই শিখে এসেছে।

হাসি-খুশি ধরনের নিতান্তই অল্পবয়স্ক একটি ছেলে। শুনেছি, জাতি হিসেবে জাপানিরা খুব বুদ্ধিমান। একে খানিকটা বেকুব ধরনের মনে হলো। সে প্রথম দিনেই তার বেকুবির অনেকগুলো প্রমাণ দেখাল। বিশাল আয়তনের সাতটি মিষ্টি খেয়ে বলল, মিষ্টিজাতীয় খাবার আমি পছন্দ করি না।

অনেক বাচ্চাকাচ্চা তার জন্যে অপেক্ষা করছে দেখে সে বাচ্চাদের আনন্দ দেওয়া অবশ্য কর্তব্যের মধ্যে ধরে নিয়ে, ডিগবাজি, পা উপরে মাথা নিচে দিয়ে দাঁড়ানো জাতীয় কিছু খেলা দেখাল এবং এক সময় হুড়মুড় করে পড়ে গিয়ে একটা চায়ের কাপ ভেঙে ফেলে ভাঙা টুকরাগুলোর দিকে খুবই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। একটা ময়লা একশ টাকার নোট মা’র দিকে বাড়িয়ে বলল, দয়া করে কাপের দামটা এখান থেকে রাখুন। কাপ ভাঙায় আমি বিশেষ দুঃখী হয়েছি।

সাতদিনের মাথায় সে ঘরের লোক হয়ে গেল। রান্নাঘরে ঘুরঘুর করে। কাঁচামরিচ ছাড়া ভাত খেতে পারে না। আমার মা অবলীলায় তাকে বলেন, দোকান থেকে আধ কেজি লবণ এনে দাও তো। সে ছুটে যায় লবণ আনতে। মশারি টানানোর জন্যে পেরেক পুঁতে দেয়। একদিন দেখা গেল ঝাড়ু হাতে প্রবল উৎসাহে ঘর ঝাট দিচ্ছে। ভিক্ষুক দরজা ধাক্কা দিলে বলছে মাফ করো।

বাসার পাশে এক ধোপার দোকানে তাকে দীর্ঘ সময় কাটাতে দেখা গেল। জানা গেল, ধোপাকে সে একশ টাকা দিয়েছে যার বিনিময়ে বোপা তাকে তার টু-ইন ওয়ানটি ব্যবহার করতে দেয়। সে সেখানে জাপান থেকে নিয়ে আসা ক্যাসেটে জাপানি গান শোনে।

তাকে বলা হলো যে, বাসাতেই ক্যাসেট প্লেয়ার আছে। সে ইচ্ছা করলে ব্যবহার করতে পারে। তার জবাবে সে বলল, এই বাসায় সে জাপানি ক্যাসেট বাজাতে চায় না। সে বাঙালি কালচার শিখতে চায়।

আমাদের সঙ্গে থেকে সে যেসব কালচার শিখল তা বাঙালি কালচারে পড়ে না। পারিবারিক কালচার হিসেবে চালানো যায়। কিছু নমুনা দেওয়া যাক।

(১) ঘুমুতে যাওয়ার এবং ঘুম থেকে উঠার কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। যার যখন ইচ্ছা ঘুমুতে যেতে পারে। কেউ রাত দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে আবার অনেকে রাত তিনটা পর্যন্ত জেগে থাকে। কেউ কেউ ওঠে সূর্য ওঠার আগে এবং প্রার্থনা করে (আমার মা)! কেউ সকাল এগারোটায় অনেক কষ্টে বিছানা থেকে নামে (আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতা), এক কাপ চা খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে।

(২) দেশের বাড়ি থেকে প্রচুর মেহমান আসে। তখন ঘরের মেঝেতে নানা ধরনের বিছানা করা হয়।

(৩) রবীন্দ্র সংগীত, হিন্দি এবং ইংরেজি–এই তিন ধরনের গান সারাক্ষণ ক্যাসেটে বাজতে থাকে। যদিও কাউকে দেখেই মনে হয় না সে গান শুনছে।

মাসাউকিকে দেখে আমরাও জাপানিদের সম্পর্কে কিছু কিছু ধারণা করলাম। যেমন—

ক) জাপানি সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা ঠিক না। তারা খানিকটা বেকুব ধরনের হয়। (উদাহরণ : একবার বাসায় একটা মিলাদ হলো। মাসাউকি সেখানে উপস্থিত। পাত্রে করে আতর-ভেজানো তুলা দেওয়া হয়েছে। সবাই তুলা। থেকে আঙুলে খানিকটা আতর মাখিয়ে নাকে দিচ্ছে। তুলার পাত্র মাসাউকির সামনে আসতেই সে পুরো তুলার টুকরা মুখে দিয়ে কপ করে গিলে ফেলে হাঁসের মতো গলা টেনে টেনে কাশতে লাগল)

খ) জাপানিরা খাদ্যের ব্যাপারে গোপালের মতো সুবোধ বালক। তাদের যা দেওয়া হয় সবই খায়। তবে তারা নুডলস খায় না। সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে এলু-বার্তা (আলুভর্তা] এবং তিরিকিরি [তরকারি]।

গ) এদের লজ্জাশরম একটু কম। লুঙ্গি পরে থাকে, ফট করে লুঙ্গি খুলে যায় –তারা তাতে মোটেও বিব্রত বোধ করেনা। শুধু ইয়েই ইয়েই জাতীয় শব্দ করে।

ঘ) জাপানিরা খুব রঙচঙে আন্ডারওয়ার পরে। মাসাউকির লুঙ্গি প্রায়ই খুলে যাওয়ায় তার বিচিত্র কক্ষে আন্ডারওয়ার দেখার সৌভাগ্য আমাদের সবারই হয়েছে।

মাসাউকিকে নিয়ে সবচেয়ে সমস্যায় পড়লেন আমার মা। গ্রামে তাঁর যত আত্মীয়স্বজন আছে তারা সবাই জাপানি দেখার অজুহাতে একবার করে ঢাকা ঘুরে গেল। নিতান্ত অসময়ে ছয়-সাতজন এসে উপস্থিত হয়। তাদের মুখভর্তি হাসি। তারা। খুশি খুশি গলায় বলে, জাপানি দেখতে আসছি। তাদের সেই দেখা তিন-চারদিনেও শেষ হয় না। তারা জাপানি দেখার সঙ্গে সঙ্গে চিড়িয়াখানা দেখে, ঢাকা শহর দেখে, বলাকা সিনেমাহলে সিনেমা দেখে। দেশে ফিরে যাওয়ার সময় বলে, জাপানি দেইখ্যা বড় ভালো লাগল। অতদিন খালি জাপানি জিনিস দেখছি, এখন আল্লাপাক জাপানি আদম দেখাইল। এরার সব ভালো তবে বাংলা ভাষায় একটু দুর্বল।

তারা দেশে ফিরে অন্যদের খবর দেয়। অন্যরা তখন কাপড়-চোপড় গুছিয়ে ঢাকা রওনা দেয়।

একমাস পার হওয়ার পর মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। মাসাউকি বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে। বিদায়দৃশ্য যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং হলো। মাসাউকি হড়বড় করে জাপানি ভাষায় একগাদা কথা বলল। মনে হলো, তার মধ্যে গভীর আবেগের সঞ্চার হয়েছে। কারণ কথা বলতে বলতে তার গলা ধরে আসছিল। আমরা যে তার জাপানি ভাষা একবর্ণও বুঝতে পারছি না তা তাকে বুঝতে দিলাম না। আমরা সবাই খুব মাথা নাড়তে লাগলাম। মার বাসায় কাজের মেয়ে দুজনের একজন গলা ছেড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল–মশা ভাইজান যাইতাছে [মাসাউকি বাসার বাচ্চাকাচ্চা এবং কাজের মানুষদের কাছে মশাভাই হিসেবে পরিচিত]।

মাসাউকির বিদায়ের ছ’মাস পরের কথা। কোরবানির ঈদের ছুটিতে আমরা সবাই পল্লবীর মা’র বাড়িতে জড়ো হয়েছি। এই ঈদ সবাই মিলে মা’র সঙ্গে করি–দীর্ঘদিনের নিয়ম। ঈদের দু’দিন আগে স্যুটকেস হাতে নিয়ে মাসাউকি উপস্থিত। দুটো এক শ’ টাকার নোট বের করে মা’র কাছে গিয়ে সে যা বলল, তা হচ্ছে, তাকে তিনদিনের ছুটি দিয়েছে। সে আমাদের সঙ্গে থাকতে এসেছে। দু’শ। টাকা সে দিচ্ছে খরচ হিসেবে।

মা বললেন, তুমি আমাদের একটা বড় উৎসবের সময় থাকতে এসেছ। আমি খুব খুশি হয়েছি। তুমি থাক। টাকা লাগবে না। এরপর যতবার ছুটি কাটাতে ইচ্ছা করবে চলে আসবে। তবে তোমার থাকতে অসুবিধা হবে। আমার সব ছেলেমেয়েরা চলে এসেছে। বাসা ছোট।

আমার অসুবিধা হবে না। আমি চেয়ারে ‘নিদ্রা’ করব।

বলেই সে দেরি করল না, বসার সোফায় তাঁর বিছানা পেতে ফেলল। ঈদ উপলক্ষে তাকে পায়জামা-পাঞ্জাবি উপহার দেওয়া হলো। সে নিজে গিয়ে একটা টুপি কিনে আনল। ঈদ উৎসবের নিয়ম-কানুন নিয়েও তাকে খুব চিন্তিত মনে হলো। সে কোনো নিয়ম বাদ দিতে চায় না।

গরু কেনার ব্যাপারেও তার আগ্রহ দেখা গেল। সে ঘোষণা করল, গরু কেনার সময় সে সঙ্গে যেতে চায় এবং সে গরুর গোশতের একটা জাপানি প্রিপারেশন আমাদের রেঁধে খাওয়াতে চায়।

আমরা তাকে নিয়েই গরু কিনলাম। গরুর দড়ি ধরে হটিয়ে গরু বাসায় নিয়ে আসার পবিত্র দায়িত্বও তার হাতে পড়ল। সে এক বিচিত্র দৃশ্য! এক জাপানি কোরবানির গরুর দড়ি ধরে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। যে-ই দেখছে সে-ই থমকে দাঁড়াচ্ছে। বুঝতে পারছে না–এই জাপানি সাহেবকে গরুর দাম জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে কি না। যেহেতু কোরবানির গরুর দাম জিজ্ঞেস করা পবিত্র দায়িত্বের একটি, কাজেই কেউ কেউ ভয়ে ভয়ে এবং খানিকটা অস্বস্তির সঙ্গে জিজ্ঞেস করছে–গরুর দাম কত?

জাপানি তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে পড়ছে। বো করছে, তারপর গম্ভীর গলায় বলছে–ইহা কোরবানির গরু হয়। ইহার দাম অষ্ট হাজার টাকা।

গরুর দাম যতই বলা হোক, প্রশ্নকর্তাকে বলতে হবে–সস্তা হয়েছে। খুব সস্তা। খুব জিতেছেন।

প্রশ্নকর্তা নিয়মমাফিক অষ্ট হাজার টাকা দাম শুনে বলেন, সস্তা হয়েছে।

মাসাউকি বলল, অবশ্যই সস্তা হয়েছে। বারো হাজার চেয়েছিল। আমরা মূলামূলি করেছি। (মূলামূলি শব্দটি সে সম্প্রতি শুনেছে)।

গাবতলী থেকে পল্লবী–অনেকখানি রাস্তা। সারাপথই মাসাউকি গরুর দাম বলতে বলতে এল। বোঝাই যাচ্ছে এই কাজটায় সে প্রচুর আনন্দ পাচ্ছে।

বাসায় পৌঁছে সে গরুকে পানি খাওয়াল। গা ডলে দিল। পানি দিয়ে গোসল দিয়ে দিল।

আমার মা বললেন, মাসাউকি নিশ্চয়ই কোনো চাষি পরিবার থেকে এসেছে। চাষি পরিবারের ছেলে বলেই গরুর প্রতি এত যত্ন। যত্নটা আমার কাছেও বাড়াবাড়ি বলে মনে হলো। সন্ধ্যাবেলা গেল–সে কলা কিনে এনেছে। গরুকে কলা খাওয়াচ্ছে। মাথা আঁচড়ানোর চিরুনি দিয়ে গরুর গলকম্বল আঁচড়ে দিচ্ছে।

যথাসময়ে কোরবানি হয়ে গেল। মাংস রান্না হলো। সবাই খেতে বসেছি, মাসাউকির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তাকে রাস্তা থেকে ধরে আনা হলো। জানা গেল, সে রাস্তার পাশে খুব মন খারাপ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। মন খারাপের কী কারণ জিজ্ঞাসা করলাম। সে জবাব দিল না। বিদেশি অতিথি হিসেবে বিশাল মাংসের বাটি এগিয়ে দেওয়া হলো তার সামনে। সে ক্ষীণ গলায় বলল, গরুটাকে অনেক দূর থেকে হাঁটিয়ে আনার জন্যে গরুটার উপর তার মায়া পড়ে গেছে। এই গরুর গোশত সে খেতে পারবে না। গোশত না খাওয়ার এই অপরাধ আমরা যেন ক্ষমা করে দেই। সে শুধু পোলাও খাবে। তার কোনো অসুবিধা হবে না।

আমরা সবাই অবাক হয়ে মাসাউকির দিকে তাকালাম।

ঈদের পরে সে দুদিন রইল। ঘরে এত মাংস–সে একটা টুকরাও মুখে দিল না। দূর দেশের বোকাসোকা একটা ছেলে আমাদের সবার মর্মমূলে বড় ধরনের একটা নাড়া দিয়ে গেল। এর প্রয়োজন ছিল।

No comments