তীব্র কৌতূহল – হুমায়ূন আহমেদ

তীব্র কৌতূহল – হুমায়ূন আহমেদ

দুটি জিনিস দেখার জন্যে আমার তীব্র কৌতূহল ছিল।

মানুষের জন্ম এবং মৃত্যু। পৃথিবীতে আসা এবং পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার দৃশ্য। জন্মদৃশ্য দেখা তো একেবারেই অসম্ভব। সামাজিক কারণেই পুরুষের পক্ষে জন্মসময়ে উপস্থিত থাকা অকল্পনীয় ব্যাপার।

মৃত্যুসময়ে উপস্থিত থাকাটা সেই তুলনায় অত্যন্ত সহজ। এই সহজ ব্যাপারটি আমার জীবনে ঘটছিল না। আত্মীয়স্বজনের মৃত্যুর খবর পেয়েছি। চূড়ান্ত অসুস্থ অবস্থায় দেখতে গিয়েছি। কিন্তু মৃত্যুর সময়টিতে কখনো কাউকে দেখিনি।

এক ডাক্তার বন্ধু হাসপাতালে কাজ করে। তাকে আমি আমার গোপন ইচ্ছার কথা বললাম। সে এমনভাবে আমার দিকে তাকালো যেন আমি একজন মানসিক রুগী। রুক্ষ গলায় বললো, মানুষের মৃত্যু দেখার কি আছে? এটা তো কোন নাটক না। তুমি কোন একটা অপারেশন দেখতে চাও, আমি ব্যবস্থা করে দি।

মানুষকে কাটা-ছেড়া করার দৃশ্য দেখার ব্যাপারে আমি কোন রকম আগ্রহ বোধ করলাম না। তাকে বলে রাখলাম, হাসপাতালে তো প্রায়ই রুগী মারা যায়। তোমরা ডাক্তার হিসেবে নিশ্চয়ই টের পাও রুগীটি কিছুক্ষণের মধ্যে মারা যাবে। এ-রকম দেখলে টেলিফোন করে দিও। আমি সঙ্গে সঙ্গে চলে আসব। আমি শুধু একবারই দেখতে চাই।

ডাক্তার বন্ধু কথা রাখল। আমাকে খবর দিল। আমি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ছুটে গেলাম। বছর চল্লিশের হতদরিদ্র এক রুগী। কনভালশান হচ্ছে–সেই সঙ্গে প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট। রুগ্ন এক মহিলা, রুগীটির স্ত্রী হবে–বিছানা ধরে আতংকে ও ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। সাত-আট বছরের দুটি শিশু। একজন অন্যজনকে জড়িয়ে ধরে আছে। ভয়াবহ দৃশ্য। রুগীকে দেখেই মনে হল মৃত্যুই তার জন্যে পরম শান্তি। যত তাড়াতাড়ি তার মৃত্যু ঘটবে তত তাড়াতাড়ি সে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে।

আমার বন্ধু বলল, আর বেশিক্ষণ নেই–তাকিয়ে দেখ অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে। অথচ রুগী অক্সিজেন নিতে পারছে না। ফুসফুস ফাংশান করছে না।

অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার–ডাক্তারদের সব ধারণা ভুল প্রমাণ করে রুগী দেখতে দেখতে স্বাভাবিক হয়ে গেল। খিচুনি বন্ধ হল। স্বাভাবিক ভাবে শ্বাস নিতে শুরু করল। আমি ডাক্তার নই। তবু স্পষ্ট দেখলাম লোকটির মুখ থেকে মৃত্যুর ছায়া সরে যাচ্ছে। মৃত্যু যেন একটা কুৎসিত ননাংরা পশু। পশুটা দাঁত দিয়ে লোকটিকে কামড়ে ধরেছিল–এখন ছেড়ে দিয়েছে। ছেড়ে দিয়ে সে থাবা গুটিয়ে বসেছে বিছানায়। যে কোন মুহূর্তে বিছানা থেকে লাফিয়ে মানুষটার গায়ে পড়তে পারে। পরাজয় মানতে সে প্রস্তুত নয়। কারণ এখন পর্যন্ত কোন প্রাণী তাকে পরাজিত করে নি। মাঝে মাঝে সাময়িকভাবে সে পরাজয় মানে, লজ্জিত এবং অপমানিত মুখ করে সরে যায়–আবার আসে।

আমি মহিলার দিকে তাকিয়ে বললাম, ভয় নেই, উনি সেরে উঠছেন। এতক্ষণ মহিলা কাঁদেন নি। এইবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন এবং ভাঙা গলায় বলতে লাগলেন–ডাক্তার সাহেব, আল্লাহ আপনের ভাল করব। আল্লাহপাক আপনের ভাল করব।

ভদ্রমহিলা আমাকে ডাক্তার ভেবেছেন।

মৃত্যুদৃশ্য দেখা হল না। তবে কল্পনাতীত আনন্দের মুখোমুখি হলে মানুষ কেমন করে তা দেখা হল। এই অভিজ্ঞতাও তুলনাহীন।

আমি লক্ষ্য করেছি, কিছু কিছু মানুষ থাকেন যাদের চোখের সামনে অসংখ্য মৃত্যু ঘটে। আমার মা এমন একজন মানুষ। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি–মাকে নিতে দেশের বাড়ি থেকে লোক এসেছে। মার কোন এক আত্মীয়ের অন্তিম সময় উপস্থিত। মাকে শেষবারের মত না দেখলে তার জীবন বের হচ্ছে। মা সঙ্গে সঙ্গে ছুটলেন, রুগীকে পানি খাওয়ালেন। জীবন বের হবার প্রক্রিয়া সহজ হল।

আমরা তখন কুমিল্লায় ঠাকুর পাড়াতে থাকি। বাসায় একদিন অপরিচিত এক লোক এসে উপস্থিত। হাতে ছোট্ট টিফিন ক্যারিয়ার। এসেছে ময়মনসিংহের কলমাকান্দা থেকে। লোকটির বাবা নাকি অনেকদিন আগে আমার মার হাতে কাঁচা পেঁপের ভাজি খেয়েছিলেন। এখন তিনি মৃত্যুপথযাত্রী, মার হাতের কাঁচা পেঁপের ভাজি খেয়ে মরতে চান। বাজার থেকে কাঁচা পেঁপে আনা হল। মা রাতে বসলেন। অফিস থেকে এসে সব শুনে আমার বাবা বললেন, তোমার এই বিখ্যাত ভাজি কলমাকান্দায় পৌঁছতে পৌঁছতে পচে গলে যাবে। __ মানুষটার মৃত্যু হবে ফুড পয়জনিং-এ। সেটা কি ঠিক হবে?

মা বললেন, তাই তো।

সন্ধ্যার ট্রেনে মা ঐ মানুষটার সঙ্গে কলমাকান্দা রওনা হয়ে গেলেন। রুগীর বাড়িতেই পেঁপে ভাজা হবে।

মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের পাশে থাকার আমার তীব্র কৌতূহলের কারণ একটিই–মৃত্যু কিভাবে মানুষকে গ্রাস করে তা দেখা। শেষ মুহূর্তে তার চোখের দৃষ্টি কিভাবে পাল্টে যায়। সেই মুহূর্তে সে কি ভাবে তা জানা সম্ভব নয়। সম্ভবত সে কিছুই ভাবে না। কিছু ভাবার ক্ষমতা তার মস্তিষ্কের থাকে না। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে-আসা একজন মানুষের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। ১৯৭১ সনে দালালীর অভিযোগে তার মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। একটা কাঁঠাল গাছে তাকে বেঁধে খুব কাছ থেকে পর পর দুবার গুলি করা হল। কোনবারই গুলি লাগল না। মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডার বললেন, এই লোকটার ভাগ্য তো অসম্ভব ভাল। একে ছেড়ে দেন। তাকে ছেড়ে দেয়া হল।

আমি মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসা ভদ্রলোককে বললাম, কাঁঠাল গাছের সঙ্গে যখন বাঁধা হল তখন আপনার চোখ কি খোলা ছিল? চোখ বাঁধা হয় নি?

জ্বি-না। চোখ বাঁধতে ভুলে গিয়েছিল।

তখন কেমন লাগছিল আপনার মনে আছে?

জ্বি-না, মনে নাই। তবে কোন রকম লাগতেছিল না। বন্দুকের যে দুবার গুলির শব্দ হল, একবারও গুলির শব্দ শুনি নাই।

গুলির শব্দ শুনেন নি?

জ্বি না। এটা খুবই আশ্চর্যের কথা–গুলির শব্দ শুনি নাই।

Near Death experience অর্থাৎ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে-আসা মানুষদের অভিজ্ঞতা নিয়ে অনেক বইপত্র লেখা হয়েছে। তার কিছু কিছু আমি পড়েছি। বেশির ভাগ মানুষই বলেন–তাঁরা দেখতে পান অন্ধকারে একটা টানেলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। তীব্র গতিতে যাচ্ছেন, কল্পনাতীত গতিবেগ। টানেলের অন্য প্রান্তে উজ্জ্বল চোখ-ধাঁধানো আলো। তাঁরা ছুটে যাচ্ছেন আলোর দিকে। এক ধরনের সংগীত শোনা যাচ্ছে। এইসব কি শুধুই গল্পগাঁথা? উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কল্পনা? আমি শুনেছি, অনেকেই নাকি মৃত্যুর সময় তার আত্মীয়স্বজনদের আশেপাশে দেখতে পান। তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে! আসলেই কি সত্যি ঘটে? না _ মস্তিষ্কের কারণে হারানো স্মৃতি ফিরে আসে? জানার কোন উপায় নেই।_

প্রায় দশ বছর আগে আমি একটি অসাধারণ বই পড়েছিল—The Private world of dying children. ক্যানসার হাসপাতালের একদল শিশুর নিজস্ব জগৎ নিয়ে জনৈক নার্সের লেখা দুশ পাতার বই। বইটি সে লিখেছিল তার নিজের তাগিদে। পরবর্তী সময়ে এই বইটির জন্যে তাকে মনোবিদ্যায় পি-এইচ ডি ডিগ্রী দিয়ে সম্মানিত করা হয়।

বইটিতে লেখা হয়েছে একদল শিশুর কথা, যারা জানে তারা মারা যাচ্ছে। খুব অল্প আয়ু তাদের অবশিষ্ট আছে। এই ভয়াবহ সংবাদটি তারা কি করে আত্মস্থ করে–তাঁরা কি ভাবে তাই নিয়ে লেখা অসাধারণ বই। বইটিতে ন বছর বয়েসী একটি মেয়ের কথা আছে যে তার বাবা-মার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করত। তাঁরা যখনই তাকে দেখতে আসতেন সে চিৎকার, গালাগালি করত। নার্স একদিন বাচ্চাটিকে তার এই অদ্ভুত ব্যবহারের কারণ জিজ্ঞেস করল, সে বলল–দেখ, আমি যদি খুব ভাল ব্যবহার করি তাহলে আমার মৃত্যুর পর বাবা-মা অনেক বেশি কষ্ট পাবে। সবাইকে বলবে–আমার মেয়েটা কত ভাল ছিল। বলবে আর কাঁদবে। তাই খারাপ ব্যবহার করছি। যাতে আমার মৃত্যুর পর বাবা-মার কষ্ট কম হয়। এই বই পড়তে পড়তে আমি ফুঁপিয়ে কেঁদেছি। মৃত্যুর আগের মানসিক অবস্থা সম্পর্কে আরো ভালভাবে জানার ইচ্ছা হয়েছে। ইচ্ছে হলেও সে সুযোগ কোথায়?

আশ্চর্যের ব্যাপার আমার প্রথম ইচ্ছা শিশুর জন্মদৃশ্য দেখা খুব সুন্দরভাবে পরিপূর্ণ হল। হোটেল গ্রেভার ইন বইটিতে সেই প্রসঙ্গ লিখেছি–আমার দ্বিতীয় কন্যা শীলার জন্মদৃশ্য আমাকে ডাক্তাররাই দেখালেন। আমি স্ত্রীর হাত ধরে তখন পাশেই ছিলাম। অবাক হয়ে শিশুর জন্ম দেখলাম। ডাক্তাররা তার পা উঁচু করে ধরে আছেন। প্রাসেন্টার সঙ্গে শিশুর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এখনো নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া শুরু হয়নি। ডাক্তার শিশুটির পিঠে ছোট্ট করে থাবা দিলেন। সে তৎক্ষণাৎ কাঁদতে শুরু করল। তার ফুসফুস সচল হল–নতুন একটি জগতে সে প্রবেশ করল। কত-না বিস্ময় তার চোখে!

তাকে তোয়ালে দিয়ে জড়িয়ে তার মার কোলে শুইয়ে দেয়া হল। কি অবাক কাণ্ড! সে চোখ বড় বড় করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তার চোখে পলক পড়ছে না। আমি মনে মনে বললাম, মামণি আমি তোমার বাবা। বিপুল আনন্দের এবং অসাধারণ সৌন্দর্যের এই পৃথিবীতে তুমি এসেছ–আমি তোমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি–Welcome my little angel.

আমার দ্বিতীয় ইচ্ছাটি পূর্ণ করার ব্যবস্থাও প্রকৃতি করে দিলো। আমার ছেলের মৃত্যু হল আমার চোখের সামনে। মৃত্যুর সময় সেও আমার মেজো মেয়ের মতই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল আমার দিকে–। সেই দৃষ্টি সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমি ছুটে পালিয়ে এলাম। আবারও ছুটে গেলাম তার পাশে। সঙ্গে সঙ্গে সে চোখ মেলে আমাকে দেখল। আমি আবার পালিয়ে গেলাম।

দুটি দৃশ্য দেখার আমার খুব শখ ছিল। পরম করুণাময় ঈশ্বর (?) আমার দুটি ইচ্ছাই পূর্ণ করলেন।

No comments