অ্যাডাম – স্মরণজিৎ চক্রবর্তী

অ্যাডাম – স্মরণজিৎ চক্রবর্তী

হাত দুটো প্রাণপণে খোলার চেষ্টা করল সম্রাট! পারল না। পায়ের সঙ্গে বাঁধা ভারী পাথর টেনে নিয়ে যাচ্ছে ওকে জলের অতলে। ও শেষবারের মতো মাথা তুলে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করল। ওই জলের উপরে আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে ওদের, কাঁপা-কাঁপা মানুষের অবয়ব। ওরা এমন করতে পারল! এভাবে শেষ করল ওকে! এভাবে মারল!

বুক ভেঙে আসছে ওর। শ্বাস নিভে আসছে দ্রুত। মাথা ফাঁকা। পাথর ওকে টেনে নিয়ে গেল আরও গভীরতর জলে। সব আবছায়া হয়ে গেল এবার। অন্ধকার এসে দ্রুত ঢেকে দিল চারপাশ। শুধু শেষবারের মতো শ্বাস নেওয়ার আগে চোখের সামনে একটা ছোট্ট হাত যেন এগিয়ে এল সম্রাটের দিকে। মনে-মনে নিজের সন্তানের হাতটা শেষবারের মতো স্পর্শ করল ও। মনে-মনে বলল, “ঈশ্বর ওকে তুমি দেখো!”

তারপর ধীরে-ধীরে নিথর হয়ে তলিয়ে গেল জলের অন্ধকার ভাঁজে।

এই ঘটনার বেশ কয়েক বছর পরে…

এক মাস আগে। ব্যাং কোয়াং সেন্ট্রাল জেল। তাইল্যান্ড। ২০১৮।

আলো-অন্ধকারের খোপকাটা মেঝেতে বসে উপরের দিকে মুখ তুলে তাকাল হো। সলিটারি কনফাইনমেন্টের অন্ধকার সেলে দশ দিন থাকার পরে এখন এই আলোয় চোখে সব কিছু কেমন যেন ঝাপসা লাগছে।

নিজেকে সময় দিল হো। ও জানে তাড়াহুড়ো করে কিছু হবে না। শরীরকে তার সময় দিতে হবে মানিয়ে নেওয়ার জন্য। ও জানে সামনে যে বসে আছে তার হাত বেশ লম্বা। নাহলে সাত দিন আগেই ওকে সলিটারি সেল থেকে বার করে আনা হত না!

“কী রে? কাজটা করবি তো?” হাতের লাঠি দিয়ে এবার হো-কে খোঁচা দিল লি লিং।

হো চোয়াল শক্ত করল। লি লিং পুলিশের নামে কলঙ্ক! জেলের রক্ষী হয়েও কত যে অপরাধমূলক কাজ ও করে তার হিসেব নেই! এদের কি শাস্তি হয় না!

“কী রে!” লি লিং আবার খোঁচা দিল।

হো মুখ তুলে তাকাল আবার। আস্তে-আস্তে স্পষ্ট হচ্ছে দৃশ্য। সামনে দাঁড়ানো মানুষটার আবছায়া অবয়বটা দেখল ও। কেমন চেনা লাগল! ও হাসল সামান্য। তারপর ধীরে-ধীরে বলল, “ছাই! ইয়েস!”

এক

কলকাতা। ২০০৮।

কলকাতার দক্ষিণ প্রান্তের এই শ্মশানটা ছোট। সারা দিনে খুব বেশি ভিড় হয় না এখানে। আর আজ এই প্রচণ্ড বৃষ্টি বাদলের মধ্যে তো আরওই লোকজন নেই!

কপালের ছোট্ট আবটা একটু চুলকে নিয়ে কেতো বিড়িতে একটা টান দিল। দেখল, সামান্য দূরের ইলেকট্রিকের চুল্লিতে বডিটা ঢুকে গেল এবার! অল্পবয়সি একটা ছেলের দেহ। ছেলেটাকে আগেই দেখেছে কেতো। নরম- সরম মুখ, রোগা-পাতলা। মারা গিয়েছে গুলি লেগে! আজ কাঁটাপুকুর থেকে সোজাসুজি এখানে নিয়ে আসা হয়েছে বডিটা। ছেলেটার নাকি কেউ নেই, একটা অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছিল। আশ্রমের দু’-চারজন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে শেডের তলায়। কেতো দেখেই বুঝতে পারছে যে, সব বেগার ঠেলতে এসেছে। দাহ হয়ে গেলেই চম্পট দেবে।

কেতো ধীরে-ধীরে বিড়িটা শেষ করল। মৃতদেহের সম্বন্ধে সব খবর ও নিয়ে নিয়েছে। নাম, ঠিকানা, বয়স, এমনকী ভোটার কার্ডের জ়েরক্সও ম্যানেজ করে বের করে নিয়েছে এর মধ্যে।

কেতো হাসল, আমাদের দেশটা খুব মজার! সব কিছু খোলার জন্য টাকা নামক একটা চাবিই এখানে যথেষ্ট! এমন লোকজন ছিল বলেই ব্রিটিশরা আমাদের অতদিন ধরে বাঁশ দিয়ে গিয়েছিল! সময় পালটেছে। কিন্তু লোভী আর অকৃতজ্ঞ মানুষের সংখ্যা কিন্তু কমেনি।

বডি সবে ঢোকানো হয়েছে। এখনও পাক্কা পঞ্চাশ মিনিট থেকে এক ঘন্টা লাগবে। ওর তো কাজ শেষ। বডি যে চুল্লিতে ঢুকে গিয়েছে সেটার ছবিও তুলে নিয়েছে। না হলে আবার নর্টনবুড়ো ঝামেলা করবে। বলবে, “শালা তুই হাফ ডান কাজ করিস কেন? ভাগ, পয়সা পাবি না।”

বুড়ো হেভি হারামি আছে। খালি পয়সা না দেওয়ার ফিকির করে! তাই বডি চুল্লিতে ঢোকানোর সময়কার বেশ কয়েকটা ছবি ও ছোট ডিজিটাল ক্যামেরায় তুলে নিয়েছে। না, কেউ খেয়াল করেনি।

কেতো ওই জায়গাটা থেকে সরে গিয়ে একটু দূরের একটা সিমেন্টের ছাদওয়ালা ঘরের তলায় গিয়ে দাঁড়াল। এখানে বৃষ্টির আওয়াজটা কম।

ও পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে একটা নম্বর ডায়াল করল। চারটে রিং-এর পরে সেটা ধরল নর্টন।

“কাজ হয়েছে?” নর্টন সোজাসুজি জিজ্ঞেস করল।

“হ্যাঁ আঙ্কল। সব পেপার পেয়ে গিয়েছি।”

“আর ছবি?” নর্টনের গলায় সন্দেহ।

কেতো মনে-মনে হাসল। শালা খচ্চর বুড়ো, কিছু ভোলে না। ও বলল, “হ্যাঁ, সেটাও পেয়ে গিয়েছি।”

নর্টন যেন কিছুটা আশ্বস্ত হল। জিজ্ঞেস করল, “নিয়ে চলে আয় তবে। আচ্ছা, বাই দ্য ওয়ে, যে মারা গিয়েছে… দ্যাট পুয়োর চ্যাপ… কী নাম ছেলেটার?”

কেতো ভোটার কার্ডের জেরক্সটা দেখল একবার। তারপর বলল, “ইয়ে… সেন, অদম্য সেন!”

কলকাতা। এখন।

জল, চারদিকে গভীর নীল জল। আর তার মধ্যে ডুবে যাচ্ছে একজন। সূর্যের আলো জল ভেদ করে নেমে আসছে নীচে। মানুষটা তাকাচ্ছে ওই দিকে। ছটফট করছে। মাথা উঁচু করে, শরীর ঝাঁকিয়ে সে উঠে যেতে চাইছে উপরদিকে। কিন্তু পারছে না। মানুষটার দুটো হাত শরীরের সঙ্গে বাঁধা। দুটো পায়ে বাঁধা বড়-বড় পাথরের চাঁই। ক্রমশ বুকের অক্সিজেন কমে আসছে মানুষটার! কেমন একটা চাপ লাগছে। বড় পাথর মানুষটাকে দ্রুত টেনে নিয়ে যাচ্ছে জলের গভীরে। মানুষটা ছটফট করছে। বাঁচার চেষ্টা করছে প্রচণ্ড। মুখের থেকে বুদবুদ বেরিয়ে সারি বেঁধে উঠে যাচ্ছে জলের উপরে। ও কি পারবে মানুষটাকে বাঁচাতে?

প্রাণপণ ডুব সাঁতারে মানুষটার দিকে এগিয়ে গেল ও। মানুষটা কেমন নিস্পন্দ হয়ে আসছে। শরীরটা দ্রুত নেমে যাচ্ছে জলের আরও গভীরে। এই গভীরতায় আলো কমে আসছে দ্রুত। সব কেমন আবছায়া। মাথার উপরে ওই দেখা যাচ্ছে নীল-সাদা আলোর রেখা। মাছ ঘিরে ধরছে ওকে। বাতাসের অভাবে ওরও বুকের উপর যেন চেপে বসছে পাথর। ও তা-ও ডুব দিল আরও গভীরে। ভারী হয়ে আসছে শরীর। জলের চাপে মাথা ঝিমঝিম করছে। তা-ও শেষবারের মতো চেষ্টা করল ও! ডুবন্ত মানুষটাকে প্রায় ধরে ফেলেছে। আর একটু… আর একটু… ও হাত বাড়াল। সামান্য ছোঁয়া লাগল মানুষটার কাঁধে। কিন্তু ধরতে পারল না ও। ভারী পাথর টেনে নিয়ে গেল মানুষটাকে। আর ও আবছা আলোয় দেখল জলের একপাশ কেমন যেন লাল হয়ে উঠল। নিজের বুকের চাপ অগ্রাহ্য করে ও চিৎকার করে উঠল, “বাবা!”

আর চোখ খুলে স্বপ্নের উপরে ভেসে উঠল অদম্য! ঘেমে গিয়েছে একদম। ও দ্রুত একবার চারদিকে তাকাল। প্লেনের ভিতরে হলুদ আলোয় সব কেমন অদ্ভুত লাগছে। ও দেখল ওর বাঁ পাশের যুবতীটি ওর দিকে তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে। আর ডান দিকে এয়ার হোস্টেস ঝুঁকে পড়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

এয়ার হোস্টেস মেয়েটির মুখে প্রশ্ন, “সোম্‌নিলোকুইস্ট?”

অদম্য সামান্য হাসল, “ব্যাড ড্রিম। সরি!”

মেয়েটি হাসল সুন্দরভাবে, বলল, “হোপ ইট্স নট দ্য ফ্লাইট! প্লিজ় ফাস্‌ন ইয়োর সিটবেল্ট স্যার!”

অদম্য সোজা হয়ে বসল। কলকাতা এসে গেল তবে! ও সিটবেল্টটা বেঁধে রুমাল দিয়ে মুখটা মুছল একটু। পাশের মেয়েটা তাকিয়েই আছে ওর দিকে। ওর অস্বস্তি লাগল।

মেয়েটা এবার বলল, “হ্যাভ উই মেট?”

অদম্য হাসল! মাথা নাড়ল।

“শিয়োর?” মেয়েটার মুখে অবিশ্বাস, “আই অ্যাম জেনি। রিপোর্টার। আমাদের সত্যি দেখা হয়নি? কলকাতায় যে-কয়েকবার ডিজ়াস্টার হল, আমি এবিপি আনন্দ-র হয়ে কভার করেছিলাম। আপনি…”

“সরি, আমি নই,” অদম্য হেসে মুখ ঘুরিয়ে নিল। মেয়েটা ওকে চিনে ফেলল নাকি?

মেয়েটা তা-ও কয়েকবার নিজের মনে বিড়বিড় করল। তারপর চুপ করে গেল।

অদম্য চোখ বন্ধ করল একবার। আবার সেই জলরাশি আর তার মধ্যে তলিয়ে যাওয়া মানুষটা ফিরে এল। ওর বুক কেঁপে উঠল। এত বছর হয়ে গেল, তা-ও এখনও এই একটা স্বপ্নই ফিরে-ফিরে আসে ওর ঘুমের মধ্যে! কবে এর থেকে মুক্তি পাবে ও?

প্লেন থেকে নেমে বেল্টের থেকে নিজের লাগেজ নিয়ে এয়ারপোর্টের থেকে বেরোবার দরজার দিকে এগোল অদম্য।

“এক্সকিউজ় মি,” জেনি প্রায় দৌড়ে এগিয়ে এল ওর দিকে।

অদম্য দাঁড়িয়ে পড়ল।

জেনি একটা কার্ড বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এটা আমার নতুন মোবাইল নম্বর। জানি আপনার দরকার নেই। তাও, ইন কেস…”

“কিন্তু আমি..” অদম্য কিছু বলতে গেল।

জেনি ওকে বাধা দিয়ে, একটু উইঙ্ক করে বলল, “ডোন্ট ওয়রি। আই ডোন্ট নো ইউ! নো বডি নোজ় ইউ মিস্টার সেন!”

মেয়েটা ওকে চিনে ফেলেছে! অদম্য কিছু না বলে তাকিয়ে রইল।

জেনি চলে যাওয়ার আগে বলল, “কিছু নিশ্চয় হতে চলেছে। প্লিজ় ইনফর্ম মি। কেউ জানবে না কিছু। আই প্রমিস।”

অদম্য এয়ারপোর্টের বাইরে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাল। সামান্য সময়ের মধ্যেই একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল ওর সামনে। গাড়ির নম্বর মিলিয়ে তাতে উঠে পড়ল অদম্য।

ড্রাইভার তাকাল ওর দিকে। সুন্দর ইংরেজিতে বলল, “অন বিহাফ অফ মিস্টার লাল, উই ওয়েলকাম ইউ স্যার!”

অদম্য মাথা ঝোঁকাল শুধু। গাড়িটা রাতের কলকাতা চিরে এগিয়ে গেল সামনে।

স্বপ্নটা আবারও ফিরে আসতে চাইল যেন। অদম্য সামলাল নিজেকে। চোয়াল শক্ত করল। যে-কাজে ওকে ডাকা হয়েছে সেটা সহজ নয়! আর ও নিজে যে-কাজে এসেছে সেটাতেও কতটা সফল হবে ও জানে না! তবু চেষ্টা তো করবেই! বহু পুরনো হিসেব আছে একটা। সেটা মেটানোর সুযোগ এত সহজে ছেড়ে দেবে না!

দুই

উত্তর চব্বিশ পরগনার এই জায়গাটার নাম রূপনগর। খুব সুন্দর ছিমছাম শহর। গাড়ি বারাসত ছাড়ানোর পরেই কেমন যেন বদলে গিয়েছিল দৃশ্যপট। বড় ফাঁকা মাঠ। আমগাছের সারি। গরমের দুপুরের ধু-ধু রাস্তা-ঘাট! কেমন একটা নির্জন একাকিত্ব যেন! রাজার ভাল লাগছে খুব।

ও পাশে বসা লোকটার দিকে তাকাল। এর নাম পিটার। এখন আঠারো বছর বয়স রাজার। ও কি একা চলাফেরা করতে পারে না? তা-ও কে বোঝাবে কাকে! পিটারকে বলা হয়েছে রাজাকে যেন রূপনগরে পৌঁছে দেওয়া হয়।

পিটার লোকটা চুপচাপ বেশ। নিজে জার্মানির লোক হলেও কলকাতায় থাকার দরুন গায়ের রং পুড়ে বেশ তামাটে হয়ে গিয়েছে। মাথায় টাক। গালে কাঁচাপাকা দাড়ি। বয়স চল্লিশও হতে পারে আবার পঞ্চান্নও হতে পারে। লোকটা কী করে কে জানে!

গাড়িটা এখন বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বেশ বড় বাড়ি। অনেকটা জায়গা নিয়ে তৈরি। বড় লোহার দরজার পাশে লেখা আছে ‘মজুমদার ভিলা’।

রাজা গাড়ি থেকে নামতেই বড় দরজাটা খুলে যিনি এগিয়ে এলেন, তিনি যে শার্দূল মজুমদার সেটা বুঝতে অসুবিধে হল না রাজার। এই মানুষটার ডাকেই ও এসেছে!

শার্দূল বললেন, “আরে, আমি কখন থেকে ওয়েট করছি! এসো এসো।”

রাজা হাসল। তারপর পিটারের দিকে তাকিয়ে বলল, “তা হলে আমি আসি?”

পিটার একবার শার্দূলকে দেখল তারপর বলল, “শিয়োর। কিছু দরকারে ফোন কোরো। আই অ্যাম জাস্ট আ ফোন কল আওয়ে! বাই”

গাড়ি ঘুরিয়ে পিটার চলে গেলে রাজা বড় গেট পেরিয়ে বাড়ির ভিতরে পা দিল।

শার্দুল বলল, “চলো তোমায় তোমার ঘরটা দেখিয়ে দিই। ক’টা দিন এখানে থাকো। ততক্ষণে তোমার বাবার সব জিনিসপত্র চলে আসবে বিদেশ থেকে।”

রাজা তাকাল শার্দূলের দিকে। মানে জিনিসপত্র এখনও আসেনি!

শার্দূল বুঝতে পারল ওর মনের কথা। হেসে বলল, “আসলে আমরা তো জানতাম না কিছু। তোমার বাবা মারা গিয়েছে অনেক আগে। সে যে তোমার নামে কিছু রেখে গিয়েছিল আমরা জানতাম না। আর শুধু কাগজপত্র নয়, শুনলাম, একটা বাক্সও রেখে গিয়েছিল। সেইসব নিয়ে কিছু দিনের মধ্যে একজন আসবে। আজ তুমি যে এসে গিয়েছ তার একটা ছবি তুলে প্রমাণ হিসেবে পাঠিয়ে দিচ্ছি তাকে। ভদ্রলোক আসা অবধি তুমি এখানে থাকো। ছুটি কাটাও। তোমার বাবা আর আমি একইসঙ্গে চাকরি করতাম শিপ-এ। বয়সে সামান্য বড় হলেও খুব ভাল বন্ধু ছিল ও আমার। তুমিও আমার ছেলের মতোই।”

রাজা হাসল। শার্দূলের চেহারাটা পেটানো। লম্বায় প্রায় ছয় ফিট। বয়স পঞ্চাশের আশেপাশে। পরিষ্কার করে দাড়ি গোঁফ কামানো। দেখেই বোঝা যায় শক্তিশালী মানুষ!

রাজাকে নিজের ঘরটা দেখিয়ে দিল শার্দূল। সুন্দর ছিমছাম ঘর। খুব পরিচ্ছন্ন। রাজা নিজের ব্যাগটা রাখল একপাশে।

শার্দুল হাসল, “ডোন্ট ওয়রি। এখানে নিজের বাড়ি ভেবেই থাকো। আমি তো ব্যাচেলর। একাই থাকি। তুমি থাকলে আমারও কয়েকটা দিন ভাল কাটবে। কাল তোমার বাবার আর এক বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব, কেমন? টেক রেস্ট।”

“আঙ্কল…”

শার্দূল চলে যাচ্ছিল। কিন্তু রাজার ডাকে পিছন ফিরে তাকাল।

“আমার বাবাকে কারা মেরেছিল?”

শার্দূল তাকাল ওর দিকে। তারপর মাথা ঝুঁকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “থাক না ওসব কথা।”

“না প্লিজ়!” রাজা তাকাল স্পষ্ট করে।

শার্দূল বলল, “ওকে, তবে শোনো। সোমালিয়ান পাইরেটরা মেরেছিল। আর সবচেয়ে কষ্টের কী জানো? আমাকে বাঁচাতেই নিজের প্রাণ দিয়েছিল সম্রাট, আজ আমার জায়গায় আসলে সম্রাটের বেঁচে থাকার কথা! আমি ওর কাছে সারা জীবনের ঋণে আবদ্ধ! তোমার বাবা খুব বড় মাপের মানুষ ছিলেন। ইউ হ্যাভ লার্জ শুজ় টু ফিল রাজা! ভেরি লার্জ শুজ় টু ফিল!”

কলিং বেল বাজতেই সচকিত হয়ে উঠল অদম্য। ক’টা বাজে এখন! ঘড়ির দিকে তাকাল ও। রাত সওয়া এগারোটা। সে কি এল তবে?

গতকাল রাতে কলকাতায় এসেছে ও। তারপর থেকে একটা গোটা দিন হোটেলে বসে কাটিয়েছে। হোটেলটা মাঝারি মানের। ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের কাছে। ও নিজেই বলেছিল এমন একটা সাদামাটা জায়গাতেই থাকতে চায় ও। দোতলায় একপাশে ওর ঘর। এই তলাটায় খুব বেশি বোর্ডারও নেই।

অদম্য সময় নিল একটু। তারপর এগিয়ে গেল দরজার দিকে। সাবধানে জিজ্ঞেস করল, “কে?”

“আমি লাল। ওপেন ইট!”

দরজা খুলে সরে দাঁড়াল অদম্য। লাল ঘরের মধ্যে ঢুকল। লোকটা একাই এসেছে। এই রাতেও পালিশ করা জুতোয় আলো পিছলে যাচ্ছে! সুটের ভাঁজে একটুও মালিন্য নেই!

লাল লোকটা বেঁটে, সামান্য মোটা। গায়ের রং বেশ ফরসা। কানে বড়- বড় লোম। দেখেই বোঝা যায় শক্তিশালী খুব! লোকটা ঘরে ঢুকে ভাল করে আগে ঘরটা দেখে নিয়ে তারপর তাকাল ওর দিকে। পাশের প্লাস্টিকের একটা চেয়ার টেনে বসল।

অদম্য নিজে বসল বিছানার কোনায়।

লাল বলল, “তোমার অ্যাডভান্স অস্ট্রিয়ার ওই ব্যাঙ্কে ট্রান্সফার হয়ে গিয়েছে। চেক করে নিতে পারো। আর তোমার কাজটা হবে সামনের সানডে রাতে। এই নাও এগজ়িবিশন ফ্লোরের ব্লু প্রিন্ট।”

একটা রোল করা কাগজ এগিয়ে দিল লাল।

অদম্য খুলে এক ঝলক দেখল সেটা। তারপর সরিয়ে রেখে দিল। এভাবে দেখলে হবে না। দর্শক সেজে নিজেকে স্পটে গিয়ে দেখতে হবে।

লাল বলল, “খুব সাবধানে কাজটা করতে হবে। যে-কোম্পানির সঙ্গে কোলাবোরেট করে এই রয়্যাল জুয়েলারি এগজ়িবিশন করা হয়েছে তারা একজন সিকিয়োরিটি চিফ অ্যাপয়েন্ট করেছে এই কাজে। নাম অতন্দ্র রায়। হি ইজ় ভেরি এফিশিয়েন্ট। এক্স আর্মি। ওকে বোকা বানানো কিন্তু সোজা নয়!”

“সে দেখা যাবে,” অদম্য আর কথা না বাড়িয়ে উঠে দাঁড়াল।

লাল বুঝতে পারল ইঙ্গিতটা। ও নিজেও উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি অবাক হচ্ছি। তোমার যা রেপুটেশন তাতে এমন সাধারণ কাজ তো তুমি নাও না! তা হলে কেন এটা…”

অদম্য হাসল, “আই নিড মানি। লি লিং বলল, আপনারা হ্যান্ডসামলি পে করছেন! আর পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ইনসেন্টিভ আমাকে টেনে নিয়ে এসেছে এই কাজে। বুঝলেন?”

লাল হাসল, “শ্রেষ্ঠ ইনসেন্টিভ! মানি! টাকা! বুঝেছি! যাকগে, কিছু দরকার হলে কল কোরো। বাই।”

লাল বেরিয়ে যাওয়ার পরে অদম্য নিজের মোবাইলটা বের করল। তারপর এনক্রিপশন মোডে ঢুকে একটা মেসেজ লিখে পাঠাল— “আই অ্যাম ইন! থ্যাঙ্কস ফর এভরিথিং আদিল!”

তিন

জীবেশ সোজা তাকাল সামনে বসা শার্দূলের দিকে। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে ওর! কোথা থেকে একটা উটকো ছেলেকে ডেকে নিয়ে বসিয়েছে বাড়িতে। কী যে করে শার্দূল! ও তখনই বলেছিল এমনটা যেন না করে। অতীতকে অতীতেই রাখা ভাল।

রাজাকে নমিনি করে যে-ইনশিয়োরেন্স করা ছিল আর ব্যাঙ্কের লকারে যে-জিনিসগুলো রাখা ছিল সেগুলো আঠারো বছর হলে রাজা পাবে। একজন লইয়ার নিয়ে আসবে বিদেশ থেকে। এটা ওরা কিছুদিন আগে জেনেছে। কিন্তু তার মানে সত্যি রাজাকে খুঁজে বের করে ডেকে নিয়ে আসতে হবে! আরে বাবা সম্রাটের মৃত্যুটা কি সহজ ছিল?

জীবেশ তাকাল শার্দূলের দিকে। বলল, “এর ফল তুই ভুগবি! কেন ডাকতে গেলি ওকে? অতীত ঘাঁটলে সেই ফল ভাল হয় না।”

“কিন্তু আমি কী করে ভুলব? আমার সঙ্গে যা হয়েছে সেটা ভুলি কী করে!” শার্দূল দীর্ঘশ্বাস চাপল কোনওমতে।

জীবেশ বলল, “ছেলেটাকে আনা ঠিক হয়নি। এখনও সময় আছে। তুই ওকে ভাগিয়ে দে। জাস্ট চলে যেতে বল!”

শার্দূল বলল, “এটা আমি করতে পারব না।”

জীবেশ উঠে এসে দাঁড়াল শার্দূলের চেয়ারের সামনে। তারপর বলল, “তা হলে যা হবে সব দায় কিন্তু তোর! মনে থাকে যেন। তখন আমায় বলতে আসবি না যে, এমনটা কেন হল!”

শার্দূল বলল, “আমরা যা করেছি, তার প্রায়শ্চিত্ত করার এটাই সুযোগ। রাজা ভাল ছেলে। আমি চাই সম্রাট ওর জন্য যা রেখে গিয়েছিল সেটা ও পাক। আমি লোভ করতে গিয়ে সোমালিয়ান পাইরেটদের হাতে ধরা পড়েছিলাম। সম্রাট নিজের জীবন দিয়ে আমায় বাঁচিয়েছে, এটা আমি ভুলতে পারি না! রাজা এখানেই থাকবে ওই জিনিসপত্র না আসা অবধি! ব্যস!”

জীবেশ বিরক্ত হয়ে বসে পড়ল আবার নিজের জায়গায়। শার্দূল একটা গাধা! নিজের বিপদ ও নিজেই ডেকে আনছে!

তিন সপ্তাহ আগে। কটসওয়ল্ড, ইংল্যান্ড।

এই জায়গাটা খুব সুন্দর। বহু আগে একবার অদম্য এসেছিল এখানে। কিন্তু সেবারের সঙ্গে এবারের পার্থক্য হল, সেবার ও ঘুরতে এসেছিল ফাদার ফ্রান্সিসের সঙ্গে, আর এবার এসেছে কাজে।

ব্রিটিশ ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটা যৌথ মহড়া হচ্ছে। সেই কাজে এখানে এসেছে আদিল।

আগের কয়েকটা ঘটনার পর থেকে আদিলের সঙ্গে একটা যোগাযোগ তৈরি হয়েছে ওর। কিন্তু অদম্য জানে ভারতে যদি ও আদিলের সঙ্গে দেখা করে, আদিল ওকে গ্রেফতার করতে চাইবে। তাই এখানে, এই বিদেশের মাটিতে ওর সঙ্গে দেখা করার আয়োজন করেছে।

রাস্তার পাশে একটা ছোট্ট কাফেতে বসে একটা সুপ অর্ডার করেছে অদম্য। কিন্তু সুপ আসার আগেই আদিল চলে এল।

ওর সামনে চেয়ার টেনে বসে বলল, “এখানে কেন ডেকেছ আমায়? খুব আর্জেন্ট কিছু? আই অ্যাম ইন হারি। তাড়াতাড়ি বলো।”

অদম্য হাসল। তারপর বলল, “আমি একটা ফেভার চাই। প্লিজ় না করতে পারবে না।”

আদিল ভুরু তুলে তাকাল অদম্যর দিকে। ওয়েটার ছেলেটা সুপ রেখে গেল সামনে। আদিল “মে আই?” বলে অদম্যর অনুমতির অপেক্ষা না করেই সুপটা টেনে নিয়ে তাতে চুমুক লাগাল।

অদম্য আবার হাসল। বলল, “মাস খানেক পরে, কলকাতায় একটা রয়্যাল জুয়েলারির এগজ়িবিশন হবে। আমি চাই অতন্দ্র রায়ের কোম্পানিকে যাতে এগজ়িবিশনের সিকিয়োরিটির কাজটা দেওয়া হয় সেটা তুমি দেখবে! আমি জানি ওরা তোমার পরামর্শ নেবে এ ব্যাপারে। শাহিন, মানে তোমার ফিয়ঁসের বাবার বন্ধু ওই জুয়েলারি এগজ়িবিশনের বোর্ডে আছেন।”

আদিল চট করে তাকাল অদম্যর দিকে। তারপর সুপটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলল, “আমাদের দেশে কয়েকশো বছর থেকেও এই ব্যাটারা রান্নাটা শিখল একদম! যাক গে, তা এবার কাকে লুঠ করার ধান্দা তোমার? অতন্দ্র সিকিয়োরিটিতে থাকলে তোমার কীসের সুবিধে?”

“কিছু না। আই অ্যাম জাস্ট রিটার্নিং আ ফেভার। আই এক্সপেক্ট ইউ টু ডু দ্য সেম। এতে অতন্দ্রর রেজ়ুমে-টা উন্নত হবে।”

আদিল হাসল, “তুমি শিয়োর কিছু করবে না তো! অনেক দামি জুয়েলারি থাকবে ওখানে?”

অদম্য হাসল, “ডোন্ট ওয়রি। আমি জাস্ট একজনকে একটা কথা দিয়েছিলাম, সেটা রাখতে চাই। ব্যস।”

“ডান!” আদিল হাসল। তারপর বলল, “এভাবে বিদেশে কেন? দেশেও একবার আমাদের দেখা হোক, কেমন?”

অদম্য বলল, “তেমন সিচুয়েশন হলে হবে। বাই।”

আদিল চলে যাওয়ার পরে অদম্য শান্ত কটসওয়ল্ডের রাস্তায় একা- একা হাঁটল কিছুক্ষণ। মনে-মনে হিসেব করে নিল সবটা। গত সপ্তাহেই এই জুয়েলারি এগজ়িবিশন থেকে একটা জিনিস চুরি করার কনট্র্যাক্টটা ও নিয়েছে। পার্টি অবাক হয়েছিল। ও তো এমন সামান্য কাজ করে না। কিন্তু তা-ও ও কাজটা নিয়েছে। এটা দরকার! আর সেখানে অতন্দ্র থাকবে সিকিয়োরিটির দায়িত্বে! মজা হবে এবার। জীবনের একটা হিসেব বাকি আছে এখনও। এবার সেটা মেটানোর পালা। লুজ় এন্ডস ভাল লাগে না অদম্যর!

চার

পাঁচবার রিং হওয়ার পরে ওদিক থেকে ফোনটা ধরলেন তিনি।

পিটার বলল, “স্যার, টিল নাও হি ইজ় সেফ।”

“নো, হি ইজ় নট,” তিনি থামলেন, “ওকে নজরের বাইরে যেতে দেবে না।”

“স্যার, যখন জানেনই তখন এখানে পাঠালেন কেন ওকে?”

“সোনাকে তপ্ত হতে হয় পিটার। কাঠকে সিজ়ন্‌ড হতে হয়। মানুষকে নানা কঠিন অভিজ্ঞতায় পড়তে হয়। তুমি কাছাকাছি থেকো। আই অ্যাম কাউন্টিং অন ইউ।”

“শিয়োর স্যার,” ফোনটা কেটে পিটার তাকাল দূরের বাড়িটার দিকে। জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে দু’জনকে। শার্দূল আর জীবেশ। পিটার তাকিয়ে রইল। শুধু জানল না, পিছনে একটা বড় শিরীষ গাছের আড়াল থেকে ওকেও লক্ষ করছে একজন।

কলকাতা। এখন।

গাড়ি থেকে নেমে নিজের টাইটা ঠিক করল অতন্দ্র। সামনের কালো গ্র্যানাইটের বিল্ডিংটা রোদে চকচক করছে। ওর কোম্পানি ‘সানরাইজ় সিকিয়োরিটিজ়’- এর কাছে এই কাজটা ভীষণ প্রেস্টিজের। আচমকা এভাবে যে কাজটা ওরা পাবে সেটা ভাবতেই পারেনি ও। বলা যেতে পারে কোলে এসে পড়েছে কাজটা!

চার বছর হল সিকিয়োরিটি কোম্পানি খুলেছে অতন্দ্র। আর্মি থেকে রিটায়ারমেন্ট নিয়ে যখন ভাবছিল কী করবে তখন নিশার বাবা-ই ওকে বলেছিল এই কাজটা শুরু করতে!

নিশার সঙ্গে বছর পাঁচেক বিয়ে হয়েছে অতন্দ্রর। নিশার বাবা রাজনীতিতে আছেন। সেন্টারে প্রভাব-প্রতিপত্তি বেশ ভালই। তবে এই কাজটা সেভাবে পায়নি। আচমকাই ওকে একদিন এগজ়িবিশন বোর্ড থেকে ফোন করে ডেকে পাঠানো হয়। বলা হয় সিকিয়োরিটি ও সারভেলেন্স-এর কাজটা ওদের করতে হবে। মেঘ না চাইতেই এভাবে যে বৃষ্টি এসে পড়বে সেটা ভাবতে পারেনি ও!

আজও আসার সময় নিশা বলেছে, “বাবাকে একবার জানিয়ো যে আজ দেখা করতে যাচ্ছ! বাবা না হলে রাগ করবে?”

তা জানিয়েছে অতন্দ্র। শ্বশুরের সাহায্যে এজেন্সি খুললেও এমন একটা কাজ যে নিজে পেয়েছে সেটা জানাতে ভালই লেগেছে ওর!

অতন্দ্র লিফ্‌টের মধ্যে ঢুকে ন’ তলার বোতাম চাপল। তারপর লিফ্‌টের স্টেনলেস স্টিলের দেওয়ালে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নিল একবার।

গ্লোবাল জুয়েলস নামে একটা কোম্পানি আর কলকাতার গোল্ডেন ইনভেস্টর্স এই জুয়েলারি এগজ়িবিশনটা যৌথভাবে আয়োজন করেছে। সাত দিনের এগজ়িবিশনের জন্য মধ্য কলকাতার একটা হলও ভাড়া নেওয়া হয়েছে। আর সেটার সিকিয়োরিটির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সানরাইজ় সিকিয়োরিটিজ়কে!

বিদেশ থেকে গ্লোবাল জুয়েলস-এর লোকজন এসে আগেই কথা বলে গিয়েছে অতন্দ্রদের সঙ্গে। ওদের ব্যবস্থাপনাও দেখে গিয়েছে আর অতন্দ্রদের সাহায্যের জন্য আরও কিছু বিদেশি সিকিয়োরিটি পারসোনেলও ওরা ঠিক করে দিয়েছে।

আসলে সারা পৃথিবীর নানা রাজপরিবারের অমূল্য সব গয়না এখানে প্রদর্শিত হবে। তাতে প্রাচীন মিশরের রানি ক্লিওপ্যাট্রার মাথার মুকুট রয়েছে, রয়েছে ইংল্যান্ডের মেরি দ্য ফার্স্ট, অর্থাৎ যাকে বলা হয় ব্লাডি মেরি, তাঁর টিয়ারা, রানি প্রথম এলিজ়াবেথের হিরে আর পান্না বসানো নেকলেস, টামার অফ জর্জিয়ার ব্রেসলেট, রোমানভ রানিদের ইস্টার এগ, নুরজাহানের বসরাই মুক্তোর সেট, মারি আঁতোয়ানেতের হিরে বসানো সোনার চিরুনি, এলিজ়াবেথ অফ বাভারিয়া কুইন অফ বেলজিয়ামের চুনির কণ্ঠহার সহ আরও নানা গয়না!

এমন প্রদর্শনীর পরে প্রায় সবক’টা গয়নাই নিলামে বিক্রি হয়ে যাবে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের একটি ‘অকশন ফেস্ট’-এ!

প্রত্যেকটা গয়নাই বিদেশে প্রচুর টাকায় বিমা করানো আছে। তারপর গোল্ডেন ইনভেস্টর্স আবার সেগুলোকে এখানে এই সাত দিনের প্রদর্শনীর জন্য নিজেদের মতো করে অনেক টাকায় বিমা করিয়ে রেখেছে।

সেই বিমা কোম্পানির লোকজন ও এই গোল্ডেন ইনভেস্টর্সের সিএমডি-র সঙ্গে আজ একটা মিটিং আছে অতন্দ্রর। কিছু একটা চুরি হয়ে যাওয়া মানেই অনেক কোটি টাকার ধাক্কা!

লিফ্ট থেকে নেমে বড় কাচের দরজার দিকে এগিয়ে গেল অতন্দ্র। ফ্রস্টেড গ্লাসের দরজার উপর বড়-বড় করে লেখা আছে ‘গোল্ডেন ইনভেস্টর্স’। ও দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল।

সামনে বড় রিসেপশন ডেস্কে দুটো মেয়ে বসে রয়েছে।

অতন্দ্র গিয়ে নিজের নাম আর আসার কারণ বলল।

একটি মেয়ে সুরেলা গলায় বলল, “ও ইয়েস, মিস্টার রয়। উই ওয়্যার এক্সপেক্টিং ইউ। গো দ্যাট ওয়ে।”

রিসেপশনের সামনে থেকে সোজা একটা করিডর দেখাল মেয়েটি। একজন পিয়ন দাঁড়িয়েছিল। সে অতন্দ্রকে নিয়ে গেল আর একটা ঘরে।

এটা একটা কনফারেন্স রুম। বড় একটা ডিম্বাকৃতি টেবিলের চারদিকে ফাঁকা কয়েকটা চেয়ার রাখা আছে।

অতন্দ্র বসল একটায়। এখনও কেউ আসেনি।

কিন্তু বেশিক্ষণ বসতে হল না। ঘরের কাচের দরজাটা খুলে গেল আবার। একজন কালো সুট পরা মানুষ ঢুকল ভিতরে। মানুষটা ফরসা। বেঁটে। সামান্য মোটা।

অতন্দ্র উঠে দাঁড়াল।

লোকটা এগিয়ে এসে হাত বাড়াল, “মিটিংটা অন্য ঘরে হবে। আর আমাদের সিএমডি স্যার আসতে পারছেন না। বাকিরা এসে গিয়েছেন। আপনি আমার সঙ্গে আসুন। আর বাই দ্য ওয়ে, আমি স্যারের পারসোন্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট। কুলদীপ লাল!”

পাঁচ

সন্ধের পরে জায়গাটা কেমন যেন আবছায়া হয়ে যায়! লোকজন এমনিতেই কম এখানে, কিন্তু এই সময়টায় মনে হয় এখানে বোধহয় কোনও মানুষজন থাকেই না।

রাজা পাশে তাকাল। শার্দূল হাঁটছেন একমনে। মানুষটাকে এমন বিষণ্ণ ও দেখেনি কখনও! রাজা জানে এর কারণ। আজ ওর বাবার মৃত্যুদিন।

বাবা বলতে আবছায়া কিছু ছবি মনে পড়ে রাজার। ওর কাছে বাবার কোনও ছবি নেই। শুধু কিছু অস্পষ্ট দৃশ্য আছে।

বাবা খুব ছবি তুলতে ভালবাসত। ওর অনেক-অনেক ছবি তুলত বাবা। কিন্তু সেসব হারিয়ে গিয়েছে সময়ের বাঁকে। ওর কাছে পড়ে আছে একটাই। পাঁচ বছর বয়সের রাজা! ওই ছবিটাকেই মাঝে মাঝে বার করে দেখে ও। আর ভাবে ওই ছবির অন্যদিকে ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাবা।

“কী ভাবছ আঙ্কল?” নীরবতা ভেঙে রাজা প্রশ্ন করল।

শার্দূল বলল, “ভাবছি এখানে তোমাকে রাখা কতটা সেফ।”

“কেন?” রাজা অবাক হয়ে তাকাল।

“কারণ আছে। তুমি যে এখানে এসেছ সেটা সবার পছন্দ নয়।”

“সবার মানে?” রাজা অবাক হল।

শার্দূল কিছু একটা বলতে গেল কিন্তু তার আগেই আচমকা ফট করে শব্দ হল কাছেই। আর শার্দূল “আঃ” বলে ডান হাত দিয়ে বাঁ হাত চেপে বসে পড়ল মাটিতে।

রাস্তার পাশের আলোয় রাজা দেখল শার্দূলের বাঁ হাত দিয়ে সরু ধারায় রক্ত পড়ছে! ও দ্রুত তাকাল এদিক-ওদিক। আর তখনই দেখল মানুষটাকে। সামনের মোটা শিরীষ গাছের আড়াল থেকে একটা কালো ছায়া দ্রুত দৌড়ে চলে গেল পিছনের অন্ধকারের দিকে।

রাজা অপেক্ষা না করে দ্রুত দৌড়োল সেই দিকে।

“যেয়ো না!” পিছন থেকে যন্ত্রণা মেশানো গলায় চিৎকার করল শার্দূল।

কিন্তু রাজা শুনল না।

সামনে রাস্তাটা আবছায়া হয়ে আছে। লোকটা জোরে দৌড়োচ্ছে। রাজাও গতি বাড়াল। পায়ের নীচে পথ আধ-ভাঙা। তা-ও রাজা পিছু ছাড়ছে না।

আচমকা লোকটা ঘুরে গুলি চালাল একটা। অন্ধকারে ফট ফট শব্দের সঙ্গে দু’বার ঝলসে উঠল আলো!রাজা রাস্তার থেকে একটা পাথর তুলে ছুড়ে মারল পালটা। এবার লোকটা যেন আরও জোরে দৌড়োল।

সামনে রাস্তাটা বাঁ দিকে বেঁকে গিয়েছে। এই জায়গায় সার দেওয়া কৃষ্ণচূড়া গাছ। কয়েকটা বেঁটে আর ঝাঁকড়া আম গাছও আছে। লোকটা দ্রুত সেই বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

রাজা বাঁকের মুখে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল এবার। চারদিক শুনশান। লোকটা গেল কোথায়? ও এদিক-ওদিক তাকাল। আবছায়া রাস্তা। দূরে-দূরে দুর্বল স্ট্রিট লাইট। জনশূন্য মফস্সলের সন্ধে!

কে লোকটা! শার্দূলকে এভাবে আক্রমণ করল কেন?

রাজা দ্রুত আবার ফিরে এল শার্দূলের কাছে। দেখল রাস্তার পাশে শার্দূলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে রয়েছে জীবেশ আর একটা মেয়ে।

রাস্তার নরম আলোয় মেয়েটাকে দেখল রাজা। রোগা। মাখন কেটে বের করা মুখ। থুতনিতে একটা টোল আছে। বড়-বড় চোখে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে মেয়েটা।

রাজা শার্দূলের কাছে গিয়ে বলল, “আঙ্কল, তুমি ঠিক আছ? চলো নার্সিং হোমে যাই… এখানে থাকা সেফ নয়।”

জীবেশ বলল, “তোমায় আমি কতবার বলেছি শার্দূল, এখন বিশ্বাস হল তো! বুঝেছ তো আমি ভুল বলিনি? নেহাত আমায় মোবাইলে কল করলে, কিন্তু রোজ তো আমি না-ও থাকতে পারি!তখন? তুমি কি ভেবেছ আমাদের অতীত, অতীতেই দাঁড়িয়ে রয়েছে? অতীত তাড়া করছে আমাদের। বুঝতে পারছ না? রাজাকে এখানে ডাকা ঠিক হয়নি তোমার।”

রাজা অবাক হয়ে শার্দূলের দিকে তাকাল, “মানে! আঙ্কল, এর মানে কী?”

শার্দূল বিষণ্ণ গলায় বলল, “তুমি যে এখানে এসেছ, সেটা অনেকের পছন্দ নয় রাজা। আজ সকালেই আমি একটা থ্রেট কল পেয়েছিলাম। তাই আমি চিন্তিত ছিলাম! তুমি কি ফিরে যাবে?”

রাজা তাকাল শার্দূলের দিকে। তারপর শক্ত গলায় বলল, “না, আমি আমার যে-জিনিস নিতে এসেছি সেটা না নিয়ে যাব না। আমার বাবা কী রেখে গিয়েছে আমার জন্য সেটা আমায় জানতেই হবে।”

এবার মেয়েটা মুখ খুলল। চাপা গলায় বলল, “ও বাবা! এ যে হিরো?”


আবছায়া অন্ধকারে রাস্তার উপর ঝুঁকে টর্চ জ্বালাল পিটার। একটু এদিক- ওদিক আলো ফেলার পরে দেখতে পেল দুটো বুলেটের খোল! পিটার হাঁটু গেড়ে বসে তুলে নিল খোলদুটো। নাকের কাছে ধরল। তারপর টর্চের আলো ফেলে দেখল খোলদুটোকে! ওর চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল! এমন কেন! ও আবছায়া অন্ধকারের দিকে তাকাল। বুঝল শান্ত, নির্জন মফস্সলের মধ্যে একটা অদ্ভুত রহস্য ঘনিয়ে উঠছে! ও বুঝল ওকে আরও সতর্ক হতে হবে এবার থেকে।

ঘড়িটা দেখল লাল। রাত সাড়ে ন’টা বাজে। মাথাটা দপদপ করছে ওর! চারদিকে কেমন একটা ফাঁস যেন আস্তে-আস্তে গলায় বসে যাচ্ছে ওদের। গোটা ব্যাপারটা যে এমন হয়ে যাবে সেটা বুঝতে পারেনি!

বসকে লাল বলেছিল এভাবে চট করে এত টাকার প্রজেক্টে হাত না দিতে! কিন্তু বস কারও কথা শোনে না।

পার্ক স্ট্রিটের উপরে পুরনো একটা বাড়ি কিনে সেটাকে ভেঙে একটা সত্তরতলা বাড়ি বানাচ্ছে ওদের কোম্পানি গোল্ডেন ইনভেস্টর্স! কয়েকশো কোটি টাকার প্রজেক্ট। এদিকে ফান্ডে টান পড়েছে! ব্যাঙ্কের ঋণ বাড়তে- বাড়তে এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, আজ ব্যাঙ্ক থেকে লোকজন এসেছিল অফিসে।

তা ছাড়া মার্কেট থেকেও টাকা তোলা হয়েছে! সেটাও প্রায় চিট ফান্ডের মতো কায়দাতেই। আজকাল সরকার এই সব চিট ফান্ডের বিরুদ্ধে খুব কড়াকড়ি শুরু করেছে। এখন লোকজন যদি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারে যে, গোল্ডেন ইনভেস্টর্সের আর্থিক অবস্থা শোচনীয় তা হলে খুব ঝামেলা হবে। লোকজন প্যানিক করে টাকা তুলে নিতে চাইবে। তা হলে গোটা সংস্থাটাই ভেঙে পড়বে।

তা ছাড়া রিয়েল এস্টেট কারবারে যে লাভ ছিল সেটাও পড়তির দিকে এখন। লোকজন চাইছে না আর ইনভেস্ট করতে।

তার উপর আবার এই জুয়েলারি প্রদর্শনী ও গয়নার নিলাম! এতেও তো ওদের ইনভেস্ট করতে হয়েছে। যদিও নিলামের টাকার টোয়েন্টি পারসেন্ট ওরা পাবে। সেটাও বহু কোটি টাকার উপর। কিন্তু তা-ও এতটা রিস্ক নেওয়ার কোনও মানে নেই।

বস-এর প্ল্যান যদি কাজ করে তা হলে অবশ্য কিছুটা সুরাহা হয়ে যাবে। গোটা প্রদর্শনীর মধ্যে চারটে গয়না নিলামে বিক্রি করা হবে না। ক্লিওপ্যাট্রার মুকুট, ব্লাডি মেরির টিয়ারা, বেলজিয়ামের রানির চুনি দিয়ে তৈরি হার আর টামার অফ জর্জিয়ার ব্রেসলেট। এর মধ্যে প্রথম তিনটেকে চুরি করার জন্যই আনা হয়েছে অদম্যকে!তিনটে জিনিস মিলিয়ে মোট কুড়ি মিলিয়ন পাউন্ডের বিমা করানো আছে! অর্থাৎ প্রায় একশো আশি কোটি টাকা। বস নিলামের ভাগ ছাড়াও ওই বিমার টাকাটাও বাগাতে চায়!সঙ্গে জিনিসগুলো বিক্রি করে সেটার টাকা তো আছেই!

কিন্তু এত সিকিয়োরিটি পার করে এটা কি করতে পারবে অদম্য? লাল জানে না। শুধু জানে সামনের কয়েক মাসের মধ্যে দুশো কোটি টাকা না পেলে ওরা ঘোর বিপদে পড়বে!

বসের বাড়িটা আলিপুরে। বিরাট পাঁচিল ঘেরা বাড়ি। কিন্তু ভিতরে মানুষজন কম। বস বিয়ে করেনি। একাই থাকে!

লাল জানে এই সময়টায় বস বাইরের সুইমিং পুলের পাশে সিঙ্গল মল্ট হুইস্কি নিয়ে বসে।

“স্যার,” লাল গিয়ে দাঁড়াল সামনে।

বস বললেন, “আমি খবর পেয়েছি। ব্যাঙ্কের লোকজন এসেছিল তো?”

লাল মাথা নাড়ল শুধু।

বস বলল, “ঠিক আছে। ডোন্ট ওয়রি! অদম্য এসে গিয়েছে। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“কিন্তু অদম্য একজন ক্রিমিনাল স্যার। যদি সব ঠিক না হয়? মানে ও যদি ডিচ করে?”

বস সময় নিয়ে হুইস্কির গ্লাসে একটা বড় চুমুক দিল। তারপর বলল, “সেই জন্যই তো তুমি কালকের ফ্লাইটে ব্যাঙ্কক যাচ্ছ, তা-ই না? ওখানেই তো আছে অদম্যর ওষুধ। শোনো লাল, আমার সঙ্গে তুমি এত বছর আছ। এভাবে টেন্স হোয়ো না। সব ঠিক হবে। কাল সময়মতো চলে যেয়ো! আমাদের হাতে আর সময় নেই কিন্তু! এখন এসো। আমাকে একা থাকতে দাও।”

লাল বেরিয়ে এসে নিজের গাড়িতে উঠল। ভাবল, সত্যি, কাল ব্যাঙ্ককের কাজটা খুব গুরুত্বপূর্ণ!

ছয়

মেয়েটার নাম মধু। জীবেশের বোনের মেয়ে। এবারে উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছে। ছুটিতে এসেছে মামার বাড়িতে। সেদিন সন্ধেবেলার আলাপের পর মধুর সঙ্গে আরও একবার দেখা হয়েছে রাজার। আজ নিয়ে তিনবার হবে।

কেন তিনবার হবে? দু’-দিনে এতবার দেখা করার কী আছে? রাজা নিজেকে মনে-মনে জিজ্ঞেস করেছে! কিন্তু তাতে যে-উত্তরটা ওর কাছে ফিরে আসছে সেটা খুব একটা স্বস্তিদায়ক নয়!

বিদেশে ওর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু জন ওকে এই জিনিসটা নিয়েই বারবার বলে।

জন বলে, “রাজা, তুই মানুষ হলি না! এখনও একটা গার্লফ্রেন্ড বানাতে পারলি না? আমায় দেখ তো! অলরেডি কুড়ি জনের সঙ্গে শুয়ে পড়েছি! আর তুই? গ্রো আপ ম্যান! কার্পে ডিয়েম! ডোন্ট লুজ় টাইম। ফিল দ্য বাটারফ্লাই ফর আ গার্ল!”

জন খুব মজার ছেলে। একটু খ্যাপাও। তবে কম্পিউটারে জিনিয়াস! এই বয়সেই হ্যাকিং-এ হাত পাকিয়েছে। তবে বলে ও নাকি এথিক্যাল হ্যাকার!

মধুকে দেখলেই রাজার বারবার জনের কথা মনে পড়ে। মধুর সামনে এলেই ওর পেটের মধ্যে এক পাহাড় প্রজাপতি উড়তে শুরু করে! এসব ভাল নয়। রাজা জানে ও এখানে কাজে এসেছে। সেখানে এইসব দিকে মন না দেওয়াই ভাল।

মানুষ বোঝে কোনটা উচিত আর কোনটা উচিত নয়। কিন্তু তা-ও সে মাঝে-মাঝে নিজেকে আটকাতে পারে না!

রাজারও তা-ই হয়েছে!

এই জায়গাটায় একটা কালীমন্দির আছে। সামনে চওড়া নির্জন পথ। পাশে বিশাল একটা পুকুর আর মাঠ।

পুকুরের বাঁধানো ঘাটে বসে আছে মধু। কেন ওকে ডাকল মেয়েটা? কী বলতে চায় ও?

রাজাকে দেখে মধু হাসল সামান্য। রাজা দেখল একটু দূরে মধুর সাইকেলটা রাখা আছে।

ও গিয়ে মধুর থেকে একটু দূরত্ব রেখে বসল।

মধু বলল, “আমি কামড়াই না কিন্তু! যেভাবে বসেছ তাতে তো ফোনে কথা বলতে হবে।”

রাজা হাসল। কিছু বলল না। নিজের জায়গা থেকে উঠে এবার মধুর কাছে এসে বসল।

বলল, “কী বলবে বলো।”

মধু সময় নিল একটু। যেন নিজেকে গুছিয়ে নিল মনে-মনে। তারপর বলল, “শোনো, আমার মামা তোমায় খুব একটা পছন্দ করে না। মামা চায় না আমি তোমার সঙ্গে দেখা করি। তারপর আমি কলকাতায় থাকি আর তুমি ইউরোপের একটা শহরে। কয়েকদিন পরে চলেও যাবে। মামা বলে তুমি নাকি মূর্তিমান ট্রাবল! শার্দূল আঙ্কলের উচিত হয়নি তোমায় ডাকা!”

রাজা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “এসব তো আমি জানি। এটা বলতে ডেকেছ আমায়?”

“না,” মধু এবার তাকাল রাজার দিকে। তারপর আচমকা ওর আঙুলে নিজের আঙুল জড়িয়ে বলল, “আই ডোন্ট কেয়ার! জানি তুমি কয়েকদিন পরে ইউরোপে ফিরে যাবে। জানি আমায় আর মনে রাখবে না! জানি সেখানে হয়তো তোমার গার্লফ্রেন্ড আছে। হয়তো কেন, ডেফিনেটলি আছে। কিন্তু তা-ও আমি বলতে চাই তোমায়। বলতে চাই আজ নিয়ে মাত্র তিনবার দেখা হলেও আমি তোমায় প্রথম দেখা থেকেই পছন্দ করতে শুরু করেছি।”

রাজা সামান্য কেঁপে গেল যেন! এটা কী বলল মধু!মানে সত্যি বলল এটা!

মধু বলল, “ঠিক আছে, তোমায় কিছু বলতে হবে না। আমি আমার কথাটা বলার জন্য তোমায় ডেকেছিলাম, ব্যস! আর কিছু না! আমি এবার আসি।”

আসি বলেও কিছুক্ষণ বসে রইল মধু। রাজা কী বলবে বুঝতে পারল না ঠিক। ওর বুকের ভিতরে কেমন করছে! মেয়েটা ওকে পছন্দ করে!সত্যি করে! ও মাথা নিচু করেই রইল।

“অল রাইট, মাই ব্যাড!” মধুর গলায় চাপা রাগ!ও আর অপেক্ষা না করে উঠে পড়ল এবার। তারপর দ্রুত সাইকেলে গিয়ে বসল।

রাজা কী করবে বুঝতে না পেরে উঠে দাঁড়াল। বলল, “মধু, প্লিজ়…”

মধু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল ওর দিকে। তারপর চোয়াল শক্ত করে বলল, “যে গুলি করেছে তার পিছনে ছোটার সাহস আছে, আর একটা মেয়ের কথার জবাব দেওয়ার সাহস নেই। কাওয়ার্ড!”

রাজা বুঝল এর একটা উত্তর দেওয়া দরকার এক্ষুনি। কিন্তু তার আগেই মধু দ্রুত প্যাডেল করে চলে গেল।

নির্জন ঝিলের দিকে তাকিয়ে রইল রাজা। এমন রাজকুমারীর মতো মেয়ে ওর মতো অনাথ ছেলেকে ভালবাসে! এটা কি সত্যি! ও কী দিতে পারে রাজকুমারীকে? কোন কণ্ঠহার আর গয়নায় ও সাজাতে পারে এমন একটা মেয়েকে? ও তো নামেই রাজা! সত্যিকারের রাজা তো আর নয়!

নিশা ঘড়ি দেখল। অতন্দ্র এখনও এল না। এত বিরক্তি লাগে! এইসব শপিং ও একাই করে নেয়। কিন্তু আজ ওর যে কী মাথার পোকা নড়েছিল কে জানে! অতন্দ্রকে বলেছিল ওর সঙ্গে শপিং-এ যেতে। অতন্দ্র যদিও প্রথমে রাজি হয়নি! ও জোর করায় শেষে বলেছিল, “ঠিক আছে, আমি যাব। তবে সাড়ে সাতটা হয়ে যাবে আসতে। জানোই তো কত বড় কাজ সামনে। প্লিজ় আন্ডারস্ট্যান্ড।”

সামনে নিশার জন্মদিন। সেই উপলক্ষে একটা পার্টি দিচ্ছে ওরা। বাড়ির টেরাসেই হবে সেটা।

অতন্দ্রর সঙ্গে নিশার বিয়েটা আচমকাই হয়। একটা পার্টিতে নিশাকে দেখেছিল অতন্দ্র। সেখান থেকেই পছন্দ করেছিল নিশাকে। যদিও অতন্দ্র ওর চেয়ে বয়সে অনেকটাই বড়, তা-ও বাবা আপত্তি করেনি। খুব বড়লোক বাড়ির ছেলে অতন্দ্র। তা ছাড়া মানুষটাও খুব ভাল। নিশার প্রথমে বয়সে এত বড় একজনকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে অসুবিধে হয়েছে, কিন্তু এখন অতন্দ্রকে ভাল লাগে ওর।

ও আবার ঘড়ি দেখল। পৌনে আটটা বাজে। এখনও এল না অতন্দ্র। এদিকে ফোনও লাগছে না। এর পর তো আস্তে-আস্তে মলের দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাবে।

মোবাইলটা বের করে আবার ফোন করতে গেল নিশা। কিন্তু তার আগেই পিছন থেকে একটা হাত এসে ওর কাঁধটা ধরল।

“সরি, সরি,” অতন্দ্র লজ্জিতভাবে হাসল।

নিশা রাগের গলায় বলল, “কালকে এলেই পারতে!”

“আরে, বুঝতেই তো পারছ! কত্ত জরুরি একটা দায়িত্ব! আমার একার এজেন্সিতে অত লোক নেই। তাই বিদেশের বেশ কিছু সিকিয়োরিটি পার্সোনেলকে দেওয়া হয়েছে আমায়। যদি একটা ভুল হয়ে যায় কী অবস্থা হবে ভাবতে পারছ! সব কিছু সেন্ট্রালি আমার বায়োমেট্রিক লক দিয়ে আটকানো। ইট ইজ় সো রিস্কি। তাই তো দেখে-শুনে বেরোতে হয়। প্লিজ় আন্ডারস্ট্যান্ড। চলো এবার।”

নিশা আর অতন্দ্র পিছন ঘুরে মলের ভিতরে ঢুকতে গেল, কিন্তু সঙ্গে- সঙ্গেই একটা ধাক্কা লাগল। নিশা দেখল অতন্দ্রর ধাক্কায় একজন অন্ধ মানুষ রাস্তায় পড়ে গিয়েছে। লোকটার হাত থেকে বাটিও ছিটকে পড়েছে সামান্য দূরে। কিছু খুচরো পয়সা ছিটকে ছড়িয়ে পড়েছে! পাশে পড়ে আছে একটা লাঠি।

“সরি, সরি,” অতন্দ্র দ্রুত গিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা লাঠি আর বাটিটা কুড়িয়ে দিল।

নিশা নিজে গিয়ে লোকটাকে ধরে তুলল। লোকটার মাথায় টুপি। চোখে কালো চশমা। লোকটা কোনওমতে হাতড়ে-হাতড়ে লাঠি আর বাটিটা ধরল।

অতন্দ্র বলল, “আমি একদম দেখতে পাইনি। দয়া করে কিছু মনে করবেন না, প্লিজ়!”

লোকটা হাসল। মাথা নাড়ল। ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, “কোনও অসুবিধে নেই!”

লাঠিটা ধরে লোকটা এদিক-ওদিক তাকাল। তারপর ধীরে-ধীরে এগিয়ে গেল সামনে।

নিশা অতন্দ্রর হাত টেনে বলল, “চলো। আর কী প্রমিস করেছ মনে আছে তো? আমায় কিন্তু সেই হারটা কিনে দিতে হবে। কোনও বাহানা দেবে না।”


মলের সামনের আলো ঝলমলে ফুটপাথ থেকে পাশের গলিতে ঢুকে দাঁড়াল ও। তারপর ধীরে-ধীরে এগিয়ে গেল সামনে রাখা একটা গাড়ির দিকে।

ও এদিক-ওদিক তাকাল। এবার চোখ থেকে কালো চশমা খুলে ফেলে দিল রাস্তার পাশে রাখা নোংরা ফেলার জায়গায়। তারপর লাঠিটা ঢুকিয়ে রাখল পিছনের সিটে। সামনে ড্রাইভারের সিটে বসল ও। পাশে রাখা ব্যাগের থেকে একটা ব্লু লাইট বার করে জ্বালিয়ে আলো ফেলল বাটির গায়ে। হ্যাঁ, হাতের ছাপ উঠেছে! অতন্দ্রর আঙুলের ছাপ উঠেছে! মনে-মনে হাসল। বায়োমেট্রিক আইডেনটিফিকেশন। গোটা সিকিয়োরিটি সিস্টেমটা ডিজ়েব্‌ল করার জন্য সেন্ট্রাল কন্ট্রোল প্যানেলে এই ফিঙ্গার প্রিন্ট ফিড করতে হবে। এটাই দরকার ছিল ওর।

আর সময় নষ্ট না করে বাটিটা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিজের হাতের থেকে খুব পাতলা একটা খোসার মতো আস্তরণ তুলে ফেলল ও! ওর হাতের ছাপ কোথাও লাগেনি! তারপর গাড়ি স্টার্ট করে বেরিয়ে গেল অদম্য!

সাত

এভাবে চোরের মতো কারও বাড়িতে আসতে ভাল লাগে না রাজার। কিন্তু মধু এমন জেদ করে যে, উপায় নেই।

দুপুরের নির্জনতায় বাড়িটাকে কেমন যেন লাগছে রাজার। আজ জীবেশ নেই। জীবেশের ছেলে বিদেশে লেখাপড়া করে। স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। বছরের এই সময়টায় ছেলে নাকি ওর মায়ের কাছে আসে। তখন জীবেশ গিয়ে দেখা করে ছেলের সঙ্গে! আজ সেই দিন। তাই এখানে কাজের দিদির সঙ্গে মধু আছে একা।

বাড়িতে ঢুকেই একটা বড় বসার জায়গা। পাশ দিয়ে দোতলায় উঠে যাওয়ার সিঁড়ি। সেই সিঁড়ির পাশেই মধুর ঘর। মোবাইলে ফোন করে মধু সব কিছু পইপই করে বলে দিয়েছে।

বাড়ির কাজের দিদি দরজা খুলে দিয়ে চলে গিয়েছে নিজের ঘরে। রাজা উপরে উঠল এবার।

“তুমি এসে গিয়েছ! গুড!”

পাশের একটা বড় ঘর থেকে বেরিয়ে এল মধু।

রাজা বলল, “কী ব্যাপার বলো তো? এভাবে ডাকলে কেন?”

“বেশ করেছি ডেকেছি,” মধু ভুরু কুঁচকে বলল, “একটা কাজ করে দিতে হবে আমায়!”

“কী কাজ?” রাজা অবাক হল।

“আমার কিছু টাকা লাগবে। সেটা মামার ওই ড্রয়ার থেকে বের করে দিতে হবে তোমায়!”

“আমায়?” রাজা ঘাবড়ে গেল, “আমি চোর নাকি?”

“ভাল কাজ করার জন্য চুরি করা পাপ নয়! জানো জীবেশমামা মার্চেন্ট নেভিতে কাজ করত প্রথমে। সেখান থেকে ‘লুনার ডায়মন্ডস’-এ কাজ নেয়। ওদের কাজ ছিল সমুদ্রে লস্ট ট্রেজার আর ডায়মন্ড মাইন রেকি করা। সেই কাজ করতে গিয়ে কম টাকা পেয়েছে ভেবেছ! আমার মা নেই। আজ আমার জন্মদিন। এই দিনে আমি বাড়িতে থাকলে কিছু অরফ্যান বাচ্চাদের গিফ্ট কিনি। বাবা অন্যবার দেয়। বাবা এবার বিদেশে। আমি মামাকে বললাম পাঁচ হাজার টাকা দিতে! রাগ করে যা খুশি বলে দিল! এত কিপটে! এত লাখ-লাখ টাকা আছে। গরিবদের কিছু দিতে প্রবলেম কোথায়?”

রাজা কী বলবে বুঝতে পারল না। ও তাকিয়ে রইল মধুর দিকে।

মধু বলল, “আমি তোমায় একটা কথা বলেছিলাম গতকাল, সেটার তো উত্তর দিলে না। এখন একটা কাজ করতে বলছি সেটাও করছ না! তুমি কী!”

“চুরি করব?” রাজা এখনও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

মধু বলল, “হ্যাঁ, করবে! মামা মোটেই সুবিধের লোক ছিল না। আমি জানি। নানা গল্প শুনেছি। চোরের উপর চুরি করে গরিবদের হেল্‌প করলে অসুবিধে নেই। রবিন হুড তো করত! তা ছাড়া যারা সমাজের মাথা, সমাজের নিয়ম-কানুন বানায়, তারাই তো সেসব মানে না। এত স্ক্যাম। আইনের ফাঁক দিয়ে এত টাকা লুট করে যারা বেঁচে যাচ্ছে তারা কী? এ এক অন্ধকার সময়! যারা দুর্বল, অসহায় তাদের হয়ে কে লড়বে তবে? আমরা না করলে কে করবে? যারা অসৎ তাদের থেকে কিছুটা নিয়ে অসহায় মানুষদের হেল্প করা খারাপ কাজ নয়, বুঝলে! তা ছাড়া সম্পদের বণ্টন কেমন হবে কে ঠিক করবে? যাদের হাতে ক্ষমতা তারা নাকি যারা অসহায় মানুষদের সাহায্য করতে চায়, তারা?”

রাজা তাকিয়ে দেখল মধুকে। উত্তেজিত হয়ে গিয়েছে মেয়েটা। নাকের পাটা ফুলে গিয়েছে। ফরসা গাল লাল হয়ে গিয়েছে! লাল ছোট্ট ঠোঁটদুটো থিরথির করে কাঁপছে রাগে!

রাজার দম বন্ধ হয়ে এল। মনে হল… না, কিছু মনে করতে চাইল না রাজা। বলল, “ঠিক আছে। আমি দেখছি!”

পাশের ঘরে গেল দু’জনে। এটা একটা স্টাডি রুম। টেবিল-চেয়ার, বইয়ের আলমারি, সোফা সামান্য ছড়িয়ে রাখা আছে। আর আছে একটা সিন্দুক। অর্ধবৃত্তাকার একটা সিন্দুক। বেশ ভারী জিনিস। হুবহু এমন একটা সিন্দুক ও দেখেছে শার্দূলের কাছে। এটা খুলতে হবে নাকি!

“এই যে এই ড্রয়্যারটা! এতেই টাকা-পয়সা রাখে মামা!” টেবিলের পাশে একটা ড্রয়ার দেখাল মধু। বলল, “এটায় লক করা আছে! খুলছে না!”

রাজা হাঁটু গেড়ে বসে দেখল লকটা। তারপর পকেট থেকে বের করল একটা ছোট্ট ব্যাগ। সেটা খুলে পাতল টেবিলের উপর। তাতে সার-সার নানান মাপের চাবি!

মধু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ওর দিকে, “ওরে বাবা এসব কী!”

রাজা হাসল, “অরফ্যানেজে থাকি। সব সময় কি ঠিক খাবার-দাবার পাই! তাই নানান লক খোলার বন্দোবস্ত রাখতে হয় আমায়!”

“কিন্তু এগুলো কী?” মধু জিজ্ঞেস করল।

“এগুলো হল বাম্প-কি! দেখো।”

রাজা লকটা দেখে একটা নির্দিষ্ট মাপের চাবি তুলে নিয়ে ড্রয়্যারের চাবির ফুটোর মুখে রাখল। চাবিটা ঢেউ খেলানো ধরনের। তারপর একটা লোহার ছোট্ট পেনসিলের মতো জিনিস নিয়ে চাবিটার পিছনে জোরে মারল। আর চাবিটা কুট করে ঢুকে গেল গর্তে। এবার সামান্য মোচড় দিতেই খুলে গেল ড্রয়্যার!

মধু বড়-বড় চোখ করে তাকাল ওর দিকে। তারপর আচমকা রাজাকে টেনে নিয়ে ঠোঁটে চেপে ধরল নিজের ঠোঁট! রাজা হকচকিয়ে গেল একটু। কিন্তু আটকাল না নিজেকে। পালটা ও নিজেও জড়িয়ে ধরল মধুকে! ঘন, নরম বাবলগামের গন্ধ জড়িয়ে গেল শ্বাসে। পৃথিবী কেমন নিভে এল যেন!

তারপর এক সময় পৃথিবী ফিরে এল নিজের জায়গায়! মধু ঠোঁট সরিয়ে হাতের উলটো পিঠ দিয়ে মুছল মুখ! বলল, “তা আমার বার্থডে গিফ্ট কই!’

রাজা বলল, “আমি কী দেব?”

মধু হাসল, “সে আমি কী জানি! তুমি তো রাজা। রাজার মতো কিছু দেবে!”

রাজা মাথা নামিয়ে বলল, “আজ তো নেই! তবে একদিন দেব।”

মধু হাত বাড়িয়ে বলল, “প্রমিস?”

রাজা আলতো করে ধরল হাতটা। তারপর বলল, “প্রমিস!”

মধু এবার ড্রয়ারটা টেনে খুলল। রাজা তাকাল সেই দিকে! আর যা দেখল তাতে চমকে উঠল ও। দেখল জীবেশের ওই ড্রয়ারে বেশ কিছু একশো আর পাঁচশো টাকার নোটের পাশে রাখা আছে একটা পিস্তল! জীবেশের কাছে পিস্তল কেন! কী করে ও এটা দিয়ে?

ব্যাং কোয়াং সেন্ট্রাল জেল। তাইল্যান্ড। এখন।

মানুষটা বেঁটে। রোগা। সামান্য কুঁজো হয়ে হাঁটছে। নিখুঁতভাবে কামানো মাথায় আলো পড়ে পিছলে যাচ্ছে। ভুরুতেও তেমন লোম নেই। দেখে মনে হয়, কেউ যেন লালচে ডিমের গায়ে কুতকুতে চোখ আর থ্যাবড়া নাক বসিয়ে দিয়েছে! লোকটার মুখ দেখে বয়স বোঝার উপায় নেই। নাম হো!

হো কারও নাম হতে পারে সেটা জানত না লাল।

এই জেলটা পৃথিবীর অন্যতম কুখ্যাত জেল। এখান থেকে বারো বছর সাজা কাটিয়ে বেরোনো বিশাল ব্যাপার! হো আজ বেরিয়েছে। আর বেরিয়েই কাজ নিয়ে নিয়েছে!

জেলের ভিতরেই লি লিং বলে একজন পুলিশকর্মী আছে। নামে পুলিশ হলেও আসলে সে নিজেও অন্ধকার জগতের মানুষ। অর্থের বিনিময়ে নানা খারাপ কাজ করতে লি-র বাধে না। এই জগতের নানা খারাপ কন্ট্রাক্ট এই লি লিং-এর মাধ্যমে হয়। অদম্যকেও পেয়েছিল এই লোকের মাধ্যমেই। এখন হো-কেও জোগাড় করে দিয়েছে লি! বলেছে, “এই লোকটা বেরোচ্ছে সাজা শেষ করে। খুব কাজের মানুষ। ওকে আপনারা নিন!”

লাল এসেছে আজ হো-কে নিতে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে লি-র কথা শুনে ভুল হয়েছে। এমন রোগা-ভোগা কুঁজো হয়ে হাঁটা একটা লোক কী করতে পারে?

হো এসে বসল ওর সামনে। এই কাফেটা জেলের পাশে। লাল অবজ্ঞা ভরে তাকাল হো-র দিকে।

হো বোধহয় কিছু বুঝল লালের মুখ-চোখ দেখে। ও হাসল। তারপর সামনে টেবিলে রাখা একটা স্টেনলেস স্টিলের ফর্ক তুলে খুব সহজে বেঁকিয়ে গিঁটের মতো করে দিয়ে বলল, “আমার কলকাতায় যাওয়ার প্লেনের টিকিট কি কাটা হয়েছে? আর টাকাটা?”

লাল ঘাবড়ে গেল। কী সাংঘাতিক জোর লোকটার গায়ে!

ও সামান্য তুলে বলল, “স-সব রেডি!”

“আর টার্গেট?” হো তাকাল সোজা। তারপর আবার ওই ফর্কটা নিয়ে গিট খুলে সোজা করে রাখল।

লাল কী বলবে বুঝতে পারল না। শার্লক হোমসের গল্পে অনেকটা এমন জিনিস পড়েছিল। এবার চোখের সামনে দেখল। এ কি মানুষ!

ও আমতা-আমতা করে বলল, “কলকাতায় গেলে জানিয়ে দেব।”

হো কিছু না বলে এবার দাঁত দেখিয়ে হাসল। লাল দেখল হো-র সব ক’টা দাঁত চকচকে ধাতুর তৈরি!


দূরের টেবিল থেকে একজন উঠে এবার কাফের বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। লোকটা বিদেশি। মাথায় একটা বেসবল ক্যাপ। একটা মোবাইল বের করে কয়েকটা নম্বর টিপে কানে লাগাল লোকটা। বলল, “দিস ইজ় জন! দ্য গেম হ্যাজ গন টু দ্য নেক্সট লেভেল, মাইট!”

আট

এই বাগানে ভরতি বোগেনভিলিয়া ফুল। কাগজ ফুল! মধুর প্রিয় ফুল এটা। রাজা বেশ কিছু ফুল কুড়িয়েছে। আজ দুপুরে জীবেশের বাড়িতে গিয়ে অমনটা যে হবে বুঝতে পারেনি। ড্রয়ার খোলাটা তেমন কোনও ব্যাপার নয় ওর কাছে। কিন্তু ওভাবে যে মধু ওকে চুমু খাবে, বুঝতে পারেনি সেটা। এখনও কেমন একটা স্ট্রবেরি বাবলগামের স্বাদ আর গন্ধ রাজার শ্বাসের মধ্যে জড়িয়ে আছে!

আজ পয়লা মে, মধুর জন্মদিন। আজ কী দেবে ও মধুকে? ওর কাছে তেমন টাকা পয়সা নেই। থাকার মধ্যে কিছু ডলার। কিন্তু এই ছোট্ট মফস্সল শহরে কোথায় ভাঙাবে সেই ডলার!

“রাজা!”

আচমকা একটা চিৎকারে রাজার সংবিৎ ফিরল। ও মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। দেখল বাগানের মধ্যে পাতা নুড়িপথ বেয়ে হনহন করে ওর দিকে এগিয়ে আসছে জীবেশ! রাজা ঘাবড়ে গেল।

জীবেশ সটান এসে দাঁড়াল ওর সামনে। তারপর কিছু বুঝতে না দিয়ে আচমকা একটা থাপ্পড় মারল ওকে। রাজা টলে গেল।

জীবেশ চিৎকার করে বলল, “জানোয়ার! এই করতে এখানে এসেছিস? চোর! আমার ঘরে চুরি করেছিস?”

“কী হয়েছে?”

এবার পিছন থেকে শার্দূলকে আসতে দেখল রাজা। ওর গাল জ্বলছে, জীবেশের হাতের জোর বেশ!

জীবেশ চিৎকার করে বলল, “কী ভেবেছিলি তুই যে, আমার স্টাডিতে আমি ক্যামেরা লাগিয়ে রাখিনি? কী ভেবেছিলি, তুই ড্রয়ার খুলবি, মধুকে চুমু খাবি আমি জানতে পারব না! শালা আজ তোকে…”

জীবেশ আবার মারতে গেল ওকে। কিন্তু তার আগেই শার্দূল এসে আটকাল, “কী বলছ তুমি জীবেশ! রাজা কী করেছে!”

“কী করেছে?” জীবেশ রাগে গরগর করতে-করতে সব বলে দিল। শেষে যোগ করল, “আমার ওই ঘরটায় ক্যামেরা লাগানো আছে। আমি সব দেখেছি। আমি তখনই বলেছিলাম তোমায়, এই ছেলেটা ভাল না। চোর একটা! এটাকে বিদায় করো!”

রাজা চোয়াল শক্ত করে তাকাল। তারপর জিজ্ঞেস করল, “আপনার ড্রয়ারে পিস্তল কেন?”

জীবেশ বলল, “পিস্তল? নেশা করেছিস! জানোয়ার। কথা ঘোরাবার তাল! চোর একটা। শার্দূল ওকে বিদেয় করো না হলে কিন্তু বিশাল ঝামেলা হয়ে যাবে। এ ছেলে ভাল নয়। ওর বাপের যা জিনিস আসার কথা সেটা তাড়াতাড়ি এনে একে বিদেয় করো! ও আসার পরই তোমার উপর হামলা হয়েছে! ও আমার বাড়িতে চুরি করেছে! বিদেয় করো!”

রাজা বলল, “তবে পুলিশে খবর দিন। শার্দূল আঙ্কলের হাত ঘেঁষে গুলি বেরিয়ে গেল সেটাও তো পুলিশে জানানো হয়নি! ওটা কোন পিস্তল থেকে বেরিয়েছে সেটা জানা দরকার!”

শার্দূল এবার সামান্য কড়া গলায় বলল, “রাজা, তুমি ঘরে যাও। আর জীবেশ, তুমিও বাড়ি যাও এবার। আর কয়েকটা দিনের ব্যাপার। প্লিজ়।”

জীবেশ চোয়াল শক্ত করল। তারপর চলে যেতে-যেতে পিছনের দিকে তাকিয়ে রাজাকে বলল, “তোকে আমি দেখে নেব।”

রাজা চোয়াল শক্ত করে উত্তর দিল, “আর আমি বসে-বসে দেখব মনে হয়!”

প্রথম দিনেই এমন ভিড় হবে সেটা বুঝতে পারেনি অদম্য। বড় হলটার চারধারে নানা মূল্যবান গয়না রাখা আছে। সবটাই বুলেটপ্রুফ গ্লাসে ঢাকা। প্রতিটা গয়নার সঙ্গে ভাইব্রেশন সেন্সর আর প্রেশার সেন্সর লাগানো। যদি কেউ সামান্য হাতের ছোঁওয়াও দেয় তা হলেই অ্যালার্ম বেজে উঠবে!

সবাইকে এই বড় হলের বাইরে ব্যাগপত্তর রেখে ঢুকতে হচ্ছে। মেটাল ডিটেক্টর ব্রিজ আছে দরজায়। এ ছাড়াও মহিলা ও পুরুষদের আলাদা-আলাদা করে ম্যানুয়াল চেকিংও করা হচ্ছে।

অদম্য খুব সাধারণভাবে এসেছে। শুধু ওর বুক পকেটে একটা পেন আছে। তাতে মাইক্রো এইচ ডি ক্যামেরা লাগানো। প্লাস্টিক বডি, প্লাস্টিক লেন্স। এটা সিকিয়োরিটি ধরতে পারেনি।

ও চারদিকে তাকাল। সিকিয়োরিটি ক্যামেরা লাগানো সবদিকে। কিছু মোশন ডিটেক্টরও লাগানো আছে স্ট্র্যাটেজিক পোজি়শনে। ও মনে-মনে প্রশংসা করল অতন্দ্রর। খুব ভাল সিকিয়োরিটি ম্যানেজমেন্ট!

ও মাথার উপরে তাকাল। স্টিলের পাত মোড়া সিলিং। সাদা-কালো রং করা চৌকো স্টিলের পাত লাগানো আছে স্ক্রু দিয়ে। মনে হচ্ছে যেন মাথার উপর দাবার বোর্ড কেউ উলটে লাগিয়ে রেখেছে!

ঘরের কোনায় ও লালকে দেখতে পেল। লাল যেন ওকে চেনেই না এমন করে ঘুরিয়ে নিল মুখ! হাসি পেল অদম্যর! ও ভিড়ের মধ্যে মিশে ধীরে-ধীরে এক-একটা করে কাচের বাক্সের সামনে দাঁড়াতে লাগল। আলতো করে একবার ঘড়িটা দেখল। এটা আসলে একটা স্টোরেজ ডিভাইস। পেনটায় যা ছবি উঠছে সেটা এখানে স্টোর হয়ে যাচ্ছে।

অদম্য একে-একে ক্লিওপ্যাট্রার মুকুট, ব্লাডি মেরির টিয়ারা, বেলজিয়ামের রানির চুনির হার… এই তিনটে কাচের বাক্সর সামনে দাঁড়াল। বাকিগুলোর মতো এইগুলোতেও একই ধরনের সিকিয়োরিটি ফিচার লাগানো আছে। এগুলোকে বার করে নিয়ে যাওয়া সহজ হবে না!লাল ওকে যে ফ্লোর প্ল্যানটা দিয়েছে সেটা ভাল করে দেখে এসেছে অদম্য। ও জানে এই বড় হলে যে স্টিলের ফল্স সিলিং আছে তার উপর এয়ার কন্ডিশনিং ডাক্ট আছে। আর এই হলঘরটার উপরে আছে সিকিয়োরিটি রুম। সেখানে দু’জন বিদেশি রক্ষী সারাক্ষণ থাকে। তা ছাড়াও এই যে অ্যালার্ম লাগানো আছে, তার সঙ্গে কাছের পুলিশ স্টেশনের যোগাযোগ আছে। আর যোগাযোগ আছে পাশের বিল্ডিং-এ অতন্দ্রর সিকিয়োরিটি কোম্পানির অস্থায়ী অফিসের! এ ছাড়া রাতে প্রদর্শনীর পরে হলঘরের বাইরে চারজন গার্ড তো থাকবেই! এই সব পার করে চুরি করা সহজ কিছু হবে না!

যে বাড়িতে এই প্রদর্শনী হচ্ছে সেটা তেইশ তলা। প্রদর্শনী হচ্ছে চোদ্দ তলায়। তাই চুরি করে পালানোর উপায়টাও খুব সহজ কিছু হবে না!

ধীরে-ধীরে হলঘর থেকে বেরিয়ে এল অদম্য। আর কিছু দেখার নেই ওর। এবার একবার ছাদে যাবে। এই বাড়ির ছাদে একটা কাজ হচ্ছে। একটা কোম্পানি কুলিং টাওয়ার বসাচ্ছে! আগেই সেটা দেখেছিল। এবার ছাদে উঠে তাদেরকে কাজ করতে দেখল অদম্য! ও হাসল মনে-মনে! তারপর ছাদের অন্য ধারে গিয়ে দাঁড়াল। মোটা স্টিলের দড়ি দিয়ে একটা হলুদ রঙের বিশাল গ্যাস বেলুন লাগানো আছে ছাদে। গায়ে ছাপানো আছে এই প্রদর্শনীর কথা— ‘এগজ়িবিশন অফ দ্য ডিকেড!’

ও ভাল করে দেখল বেলুনটাকে। সিল্কের বিশাল বেলুন বেশ অনেকটা উঁচুতে উড়ছে! দূর থেকে মনে হবে যেন দিনের বেলায় চাঁদ উঠেছে কলকাতায়! বেলুনটার টানটান দড়িতে হাত দিল অদম্য। তারপর ধীরে-ধীরে নেমে এল ছাদের থেকে। দেখা যাক, যা ভেবেছে সেটা কতদূর করা যায়…


লাল দেখল অদম্য বেরিয়ে গেল ঘরের থেকে। এতক্ষণ ও এমন মুখ করে তাকিয়েছিল যেন ওকে চেনেই না। এবার ভিড়ের মধ্যে মিশে থাকা হো-কে চোখের ইশারা করল লাল। হো ছোট্ট করে মাথা নাড়ল। যার অর্থ ও চিনে নিয়েছে!

লাল মনে-মনে হাসল। অদম্য নিজে যেচে পড়ে লি লিং-এর থেকে এই কাজটা নিয়েছে। কিন্তু আসলে জানে না এটাই ওর জীবনের শেষ কাজ হবে। নিজেই নিজের মৃত্যু ডেকে এনেছে অদম্য সেন!

নয়

রাজা মাথা নিচু করে বাগানে বসে আছে একা। আজ ওর মন ভাল নেই। মধুর সঙ্গে ওকে আর দেখা করতে দিচ্ছে না জীবেশ। হ্যাঁ, ও মধুর কথায় ওই ড্রয়্যারটা খুলে খুব অন্যায় করেছে। জীবেশ ওকে বকুনি দিতেই পারে! কিন্তু মধু জীবেশের কথার প্রতিবাদ করবে না? মধুর জন্যই তো এমনটা করল ও!

আচ্ছা, জীবেশ ওকে এমন ঘৃণার চোখে দেখে কেন? কী ক্ষতি করেছে ও জীবেশের? কিছুই বুঝতে পারছে না রাজা। নিজেকে এখানে বেমানান লাগছে। মনে হচ্ছে কেউ পছন্দ করছে না ওকে। মধুর সঙ্গে দেখা তো হয়ইনি, আজ ফোন করেছিল কয়েকবার রাজা, কিন্তু মধু কেটে দিয়েছে ফোন।

কেন হচ্ছে এসব!

“রাজা!” পিছন থেকে ডাকল শার্দূল!

রাজা একটু চমকে উঠেই তাকাল। আরে, শার্দূলের তো কলকাতায় যাওয়ার কথা! আজ সেই উকিল ভদ্রলোক, মানে মিস্টার ব্রুকস আসবেন। তাঁকে এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করে এখানে নিয়ে আসার কথা। তা হলে এখানে কী করছে এখন!

রাজা সিমেন্টের বেঞ্চ থেকে উঠে এগিয়ে গেল শার্দূলের দিকে। শার্দূলকে কেমন যেন লাগছে। উসকো-খুসকো, বিধ্বস্ত! কী হয়েছে শার্দূলের?

“কী হয়েছে আঙ্কল?” রাজা অবাক হয়ে তাকাল।

শার্দূল সময় নিল একটু। তারপর স্খলিত গলায় বলল, “মিস্টার ব্রুকস… মানে উনি…”

“কী হয়েছে?”

“উনি…” শার্দূল ঢোক গিলল, “উনি মারা গিয়েছেন। মানে গতকাল দিল্লির হোটেলে ওঁকে কে যেন গলা কেটে… ওঃ…”

রাজা থমকে গেল। এসব কী! গলা কেটে খুন করা হয়েছে! কেন? ওর জন্য উইল আর কীসব যেন আনার কথা না মানুষটার? তা হলে? এদিকে ও এখানে এসেছে বলে শার্দূলের উপরও তো আক্রমণ হয়েছে। কী হচ্ছে এসব! কেন হচ্ছে? রাজা যে এখানে এসেছে সেটার জন্য কার এত রাগ! কী চায় সেই মানুষটা? রাজা তাকাল শার্দূলের দিকে। দেখল ভয়ে কেমন রক্তশূন্য লাগছে ওকে।

শার্দূল বলল, “রাজা, আমি তোমায় এখানে ডেকে এনে ভুল করেছি মনে হয়! মনে হয় ও তোমায় বাঁচতে দেবে না! তুমি চলে যাও।”

“ও মানে! কে?” রাজা চোয়াল শক্ত করে তাকাল।

শার্দূল নিজেকে সংযত করে নিল নিমেষে। তারপর, “সে আমায় জিজ্ঞেস কোরো না। আমি বলতে পারব না…” বলে এক দৌড়ে ঢুকে গেল নিজের ঘরে।

প্রায় অন্ধকার হয়ে আসা বাগানে একা ভূতের মতো দাঁড়িয়ে রইল রাজা!

স্তেঙ্কা পুগাশেভ এই প্রথম কলকাতায় এসেছে। ও একটা প্রাইভেট সিকিয়োরিটি এজেন্সিতে চাকরি করে এখন। স্তেঙ্কা একজন কোস্যাক মারসেনারি। সারা পৃথিবীর নানা অঞ্চলে প্রাইভেট সিকিয়োরিটি কন্ট্র্যাক্টরের হয়ে কাজ করে এখন একটি ব্রিটিশ সংস্থার হয়ে কাজ করছে।

এই কাজটা সহজ। যুদ্ধে যাওয়ার মতো সারাক্ষণ টেনশন নেওয়ার কিছু নেই এখানে। ওর কাজ হল সিকিয়োরিটি রুমে বসে সারারাত ওই এগজ়িবিশন হলের ভিতরে রাখা সিসিটিভি ক্যামেরায় চোখ রাখা। তবে ও একা নয়, আর একজনও নাকি আসবে। তবে তাকে ও চেনে না।

ইন্ডিয়ার একটা সিকিয়োরিটি এজেন্সি আসলে গোটা কাজটা পেয়েছে। কিন্তু ওদের সহায়তা করার জন্য গ্লোবাল জুয়েলস, ইউরোপ থেকে আরও কিছু সিকিয়োরিটি পারসোনেল ভাড়া করে এনেছে। স্তেঙ্কা তাদের মধ্যে একজন।

এই হোটেলটা থ্রি স্টার। ভালই। তবে ইন্ডিয়ান খাবার খুব স্পাইসি কাল রাতে কী খেয়েছে ও কে জানে। পেটটা একদম গিয়েছে। সকাল থেকে এই বিকেলের মধ্যে ছ’-সাতবার ওকে বাথরুমে যেতে হয়েছে। কী যে বিপদে পড়েছে! শরীরটা দুর্বল লাগছে। ওর নিজের কাছে ওষুধ থাকে। তাই খেয়ে এখন কিছুটা ঠিক আছে। ঈশ্বরের কাছে ও শুধু প্রার্থনা করছে যে, রাতে ডিউটিতে থাকা অবস্থায় যেন ওর কোনও অসুবিধে না হয়!

লিফ্‌টে উঠে গ্রাউন্ড ফ্লোরের বোতাম টিপল স্তেঙ্কা। তারপর দাঁড়িয়ে রইল। এখানে বেশ গরম। এই ইউনিফর্ম পরে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কিছু তো করার নেই! সিরিয়ায় গিয়ে যুদ্ধ করার চেয়ে এই কাজ অনেক ভাল। টাকাও ভালই দিচ্ছে এরা।

এই হোটেলটা ন’ তলা। একদম উপরের ফ্লোরে স্তেঙ্কার ঘর। সেখান থেকে লিফ্টটা এসে দাঁড়াল সাত তলায়। ‘টিং’ শব্দ করে লিফ্‌টের দরজা খুলে গেল। স্তেঙ্কা দেখল হুবহু ওর মতো পোশাক পরে লিফ্‌টে ঢুকে এল চারজন।

একটু ঘাবড়ে গেল স্তেঙ্কা। এরা কি ওর টিমে? এদের তো দেখেনি আগে! তা হলে? ওদের কোম্পানি থেকে তো মোট তিনজন এসেছে। তা হলে এতজন এখানে কারা? নাকি কোম্পানি পরে কাউকে পাঠিয়েছে!

“হাই?” মাঝারি উচ্চতার লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে হাসল।

স্তেঙ্কাও পালটা হাসল সামান্য। লোকটা ভারতীয় মনে হচ্ছে। কিন্তু ওদের দলের কি?

“পার্ডন,” ভাঙা ইংরিজিতে স্তেঙ্কা বলল, “তোমরা কি আমাদের…”

কথা শেষ করতে পারল না স্তেঙ্কা। ভারতীয় লোকটা আচমকা এগিয়ে এল ওর দিকে। তারপর চকিতে একটা ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ গেঁথে দিয়ে কী যেন একটা তরল পুশ করে দিল ওর শরীরে!

ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটে যাওয়ায় স্তেঙ্কা প্রতিরোধ করতে গিয়েও পারল না। নিমেষে ওর শরীর নেতিয়ে পড়ল। চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এল দ্রুত! শূন্যের মধ্যে হাত বাড়িয়ে কিছু ধরতে গেল স্তেঙ্কা। পারল না। শুধু একদম ঘুমিয়ে পড়ার আগে দেখল বাকি তিনজন এসে ধরে ফেলল ওকে। লিফ্‌টের মেঝেতে পড়তে দিল না!


স্তেঙ্কা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। চব্বিশ ঘন্টার আগে ঘুম ভাঙবে না! অদম্য তাকাল পাশে। জন আর ওর দুই সহকারীকে ইঙ্গিত করল চোখের।

পাঁচতলায় লিফ্টটা দাঁড়াল আবার। স্তেঙ্কার থেকে ওর ব্যাজ আর সিকিয়োরিটি ক্লিয়ারেন্স কার্ডটা নিয়ে নিল জন। এই কার্ডের ছবিটা পালটে নিয়ে এখন ও যাবে স্তেঙ্কার জায়গায়।

অদম্য আর বাকি দু’জন স্তেঙ্কার অসাড় দেহটা নামিয়ে নিল পাঁচ তলায়। তারপর দ্রুত একটা ঘরে ঢুকিয়ে নিল। এই ঘরটা গতকাল বুক করেছে ওরা।

যাক, একটা বাধা টপকাল। এদিকে যেমন স্তেঙ্কা, তেমন অন্যদিকে আর একজন সিকিয়োরিটিকেও বদলে দেওয়া হয়েছে। অদম্যর দু’জন লোক এবার সারারাত ওই সিকিয়োরিটি রুমে বসে সিসিটিভিতে চোখ রাখবে!

তবু, সময় কম। অদম্য জানে। সিকিয়োরিটি ফিচার্স অতন্দ্রর ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যবহার করে ডিজ়েবল করে রাখা যাবে মাত্র পাঁচ মিনিট। তারপরেই সেটা অ্যালার্ম বাজিয়ে দেবে চারদিকে। এগজ়িবিশন হলের পাশের বিল্ডিং-এ অতন্দ্রদের অস্থায়ী অফিসেও সংকেত যাবে। আর তখন রে-রে করে সিকিয়োরিটি গার্ডরা ছুটে আসবে চারদিক থেকে।

অদম্য সেন কতটা দক্ষ সেটা বোঝা যাবে ওই পাঁচ মিনিটেই!

দশ

পায়ে-পায়ে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল রাজা। ঘরের আলোটা মৃদু করা আছে। সোফায় বসে থাকা শার্দূলকে কেমন যেন মোম-রঙে আঁকা মানুষ বলে মনে হচ্ছে। পাশের নিচু টেবিলে একটা হুইস্কির গ্লাস রাখা।

“আঙ্কল,” নরম স্বরে রাজা ডাকল।

শার্দূল সামান্য চমকে উঠল যেন। তারপর ঘুরে ওকে দেখে বলল, “এসো, বোসো সামনে।”

রাজা পায়ে-পায়ে গিয়ে বসল। বলল, “আঙ্কল, আমি জানি আপনি আপসেট হয়ে আছেন। কিন্তু আমায় প্লিজ় বলুন। কী ব্যাপার আমায় বলুন প্লিজ়! ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছি আমি। বাবা জাহাজে কাজ করে শুনতাম। মানুষটা আসত মাঝে-মাঝে। খুব আদর করত আমায়। কত কী কিনে দিত! তারপর আবার চলে যেত। একদিন সকালে উঠে শুনলাম, আমার বাবাও আর নেই। মারা গিয়েছে। তারপর তো রাস্তার কুকুরের মতো হয়ে গিয়েছিল আমার জীবন। নিজেকে তো মেরেই ফেলতে চেয়েছিলাম ওই ছোট বয়সে। আর মরে যেতামও যদি না… যদি না…” রাজা নিজেকে সংযত করল। সামান্য সময় নিল। তারপর বলল, “আপনি আমায় বলুন কী এমন রহস্য আছে বাবার মৃত্যুতে? কেন আপনাকে গুলি করা হল? কেন দিল্লিতে খুন হলেন ওই উকিল ভদ্রলোক? বলুন আমায়। প্লিজ় আমায় আর অন্ধকারে রাখবেন না।”

শার্দূল তাকাল রাজার দিকে। কিছু একটা ভাবল সামান্য সময় নিয়ে। তারপর বলল, “শোনো তবে। আমরা তখন আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে সোমালিয়ার কাছে সমুদ্রে রেকি করছি। অনেকে বলেন যে, সোমালিয়ায় হিরে নেই। কিন্তু আমাদের কাছে খবর ছিল যে শুধু হিরে নয়, পান্না, ইউরেনিয়াম থেকে শুরু করে তেলেরও নাকি অফুরান ভাণ্ডার আছে সোমালিয়ায়। আমরা একটা বেসরকারি শিপিং কোম্পানিতে কাজ করতাম। কোম্পানিটা সেবার নতুন একটা কাজ ধরেছিল। সোমালিয়ার কোস্ট বরাবর হিরে আর ইউরেনিয়াম ডিপোজ়িট খুঁজে বের করা। আমরা সেই কাজেই ঢুকেছিলাম। টিমে আমি, জীবেশ আর সম্রাট মানে তোমার বাবা-ও ছিলেন।”

কথা থামিয়ে গ্লাসে একটু চুমুক দিল শার্দূল। তারপর আবার বলল, “আর সেই রেকি করতে গিয়েই আমরা পেয়ে যাই কিছু পর্তুগিজ় গোল্ড বুলিয়ন। আগে, আফ্রিকার উপকূল ঘুরে ইউরোপ থেকে ভারতে যেত সবাই। তেমনই একটা জাহাজ বহু আগে তলিয়ে গিয়েছিল সমুদ্রে। আর আমরা সেটাই খুঁজে পাই। সম্রাট বলেছিল, ব্যাপারটা অথরিটিকে জানাতে বা যে কোম্পানির হয়ে কাজ করছি তাদের জানাতে। কিন্তু আমি বা জীবেশ রাজি হইনি। আমাদের মনে লোভ ছিল। ভেবেছিলাম, কয়েকশো বছর জলের গভীরে পড়ে থাকা জিনিস আমরা খুঁজে পেয়েছি। তাই ওটা আমাদের। সম্রাটের সঙ্গে এই নিয়ে ঝগড়া হয় আমাদের। বিশেষ করে জীবেশের। আর এর মধ্যে আচমকা আমাদের জাহাজে জলদস্যুরা আক্রমণ করে বসে। বেশ কিছু সোনা আমরা লুকিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু বাকি সামান্য সোনাসহ আমাকে হস্টেজ করে নেয় ওরা। বলেছিল আরও সোনা দিলে তবেই আমায় ছাড়বে। তখন কেউ আমায় বাঁচাতে যায়নি। কিন্তু সম্রাট আর জীবেশ গিয়েছিল। সম্রাট নিজে আমাকে ছাড়িয়েছিল জলদস্যুদের সঙ্গে কথা বলে। কিন্তু তার পরিবর্তে সম্রাট আর জীবেশকে বন্দি করে নিয়ে যায় ওরা। শর্ত ওই একই!

“জীবেশ ফিরে এসেছিল তার দু’মাস বাদে। ফিরে আসার পর থেকে ও কেমন চুপ মেরে গিয়েছিল। অনেক জিজ্ঞেস করায় শুধু বলেছিল সম্রাটকে মেরে ফেলেছে ওরা। আর ও পালিয়ে এসেছে। এর কয়েক সপ্তাহ পরে আচমকা জীবেশ কাজ ছেড়ে দেয়। এখানে চলে আসে। পরে জানতে পারি ও অনেক টাকার মালিক হয়েছে! সম্রাটের বডি আমরা পাই আরও অনেক পরে। সেটাও খুব খারাপ অবস্থায়! কিন্তু কী করে জীবেশ পালিয়ে চলে এল আর ওই পাইরেটদের কাছে সম্রাট রয়ে গেল সেটাই আমাদের কাছে রহস্য! জীবেশকে এই নিয়ে কিছু বললে খুব রেগে যেত। বলত, ‘আমি বেঁচে গিয়ে কি পাপ করেছি? এসব অনেক আগের কথা। পরে আমিও কাজ ছেড়ে এখানে চলে আসি। আর এতদিন পরে আচমকা আমি জানতে পারি যে, সম্রাট তোমার জন্য কিছু একটা রেখে গিয়েছিল। তোমার বয়স আঠারো বছর হলে সেটা তোমার কাছে আসবে। আমার সন্দেহ সম্রাটকে সোমালিয়ান পাইরেটরা মারেনি। জীবেশ সত্যি বলছে না। আর এই যে তুমি এসেছ আর তোমার হাতে সম্রাটের কিছু গোপন কাগজপত্তর এসে পড়বে তাতেই ও ঘাবড়ে গিয়েছে খুব! ভাবছে সত্যিটা এবার বেরিয়ে পড়বে! তাই হয়তো তোমায় ভয় দেখাতে ও লোক লাগিয়ে গুলি করেছে… বা লোক লাগিয়ে দিল্লিতে…”

কথাটা শেষ না করে দু’হাতে মুখ ঢেকে মাথা নামিয়ে নিল শার্দূল। বলল, “আমার হাতে কোনও প্রমাণ নেই, কিন্তু… কিন্তু…”

রাজা উঠে দাঁড়াল। সারা শরীর রাগে কাঁপছে ওর। মনখারাপের চেয়ে বেশি রাগ হচ্ছে ওর! এটা কী শুনল ও! জীবেশ বলে লোকটা ওর বাবার মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত! আর তাই লোকটা ও এখানে আসা ইস্তক ঝামেলা করছে! এভাবে সবটা জেনে তো ও আর বসে থাকতে পারে না।

রাজা আর কোনও কথা না বলে সটান বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

“রাজা, রাজা”, শার্দূল পিছন থেকে ডেকে ওকে সামলাতে চেষ্টা করল।

কিন্তু রাজা শুনল না। ও শুনবে না আর! যা করার করবে!

জন আর ওর সঙ্গী কন্ট্রোলরুমে বসে রয়েছে। মনিটরে ওরা এগজ়িবিশন রুমের ভিতরের সবকিছু দেখতে পাচ্ছে স্পষ্ট। কিন্তু ভিডিয়ো ফিড রেকর্ড করছে না। তার বদলে আগের রাতের রেকর্ড করা শূন্য এগজ়িবিশন রুমের ফুটেজের ডেট আর টাইম ডিজিটালি কারেক্ট করে বসিয়ে দিচ্ছে এই জায়গায়। সেটা না হয় হল। সিকিয়োরিটি তো আছে! জনকে অতন্দ্রর হাতের ছাপ থেকে তৈরি সিলিকন থাম্-প্রিন্ট দিয়ে দিয়েছে অদম্য। ও সংকেত পেলেই পাঁচ মিনিটের জন্য বন্ধ করে দেবে সব সিকিয়োরিটি ফিচার্স! মানে মোশন সেন্সর, প্রেশার সেন্সর ইত্যাদি ওই পাঁচ মিনিট কাজ করবে না। আপাতকালীন সামান্য কিছু দরকারের জন্য এর ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছিল। আর সেই সুযোগটাই ব্যবহার করবে অদম্য!

কুলিং টাওয়ারের কর্মী সেজে আজ বিকেলবেলাতেই ছাদে উঠে বসেছিল অদম্য। এখন রাতেরবেলায় ছাদ থেকে নেমে এল লিফ্‌টের সামনে। তারপর লিফ্ট করে নামল এসে পনেরো তলায়।

করিডর শুনশান। কেউ নেই। ও দ্রুত চারদিকটা দেখে নিল একবার। তারপর পায়ে-পায়ে এগিয়ে গেল সামনে। এদিকের এসি ডাক্টের সঙ্গে নীচের ফ্লোরের এসি ডাক্টের একটা যোগ আছে।

ও দ্রুত হাতে ডাক্টের সামনের কভার খুলে তার মধ্যে ঢুকে আবার ভিতর থেকে বন্ধ করে দিল ডাক্টটা। তারপর ধীরে-ধীরে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেল। সামনে একটা স্লোপ। নীচের ডাক্টে যাওয়ার। ও জুতোর তলায় লাগানো ডিফ্লেটেড বাব্‌লটা ছোট্ট একটা বোতামের সাহায্যে সক্রিয় করে নিল। জুতোর তলাটা হাওয়া ভরা বুদবুদের মতো হয়ে গেল। ঢালু বেয়ে যখন নীচের তলায় পড়বে, আর পায়ে লাগবে না।

নীচের তলার ডাক্টে নেমে আগে জুতোর হাওয়া-বুদবুদ কমিয়ে নিল অদম্য। তারপর বাহুতে লাগানো ছোট্ট ট্যাবলেট স্ক্রিনটা দেখল। সামনের দিকে ডাক্টটা অনেকগুলো শাখা-প্রশাখায় ভাগ হয়ে গিয়েছে। ও স্ক্রিনে ম্যাপটা দেখে নিল একবার। তারপর দ্রুত এগোল। লাল এইসব ম্যাপই ওকে দিয়ে গিয়েছিল।

মিনিট চারেকের মধ্যে ও পৌঁছে গেল এগজ়িবিশন রুমের ডাক্টে। পায়ের নীচে ডাক্টের মেঝে আর তার নীচে স্টেনলেস স্টিলের ফল্স সিলিং। সেটা থেকে বেরোলেই আসল জায়গা!

ডাক্টের মেঝেটা স্ক্রু দিয়ে লাগানো। স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে দ্রুত সেটা খুলে ফেলল ও। তারপর হাতঘড়িতে লাগানো ছোট্ট ট্রান্সমিটারের বোতামটা টিপল। আর উপরের তলায় জনের কাছে পৌঁছে গেল সংকেত। জনও যে সঙ্গে-সঙ্গে ওই সিলিকিন থাম্-প্রিন্টটা দিয়ে সিকিয়োরিটি ফিচারগুলি বন্ধ করে দিয়েছে সেটা ওই ঘড়িতে আসা একটা সিগনালেই বুঝতে পারল অদম্য।

আর সময় নষ্ট নয়। ও দ্রুত পিঠের ব্যাগের থেকে একটা মাইক্রো লেজ়ার কাটার বের করে স্টেনলেস স্টিলের সিলিংটা কেটে ফেলল চৌকো করে। তারপর লাফিয়ে নামল ঘরের মধ্যে।


কাজ সেরে একই পথ দিয়ে পনেরো তলার করিডরে ফিরে এসেই সাইরেনটা শুনতে পেল অদম্য।

পাঁচ মিনিট হয়ে গিয়েছে!

এই সিকিয়োরিটি ফিচার্সই এমন যে এগুলি এনেব্‌ল করার বোতামটা আছে পাশের বিল্ডিং-এ অতন্দ্রর নিজের অস্থায়ী অফিসে। তাই জন এটাকে ডিজ়েব্‌ল তো করতে পারবে, কিন্তু এনেব্‌ল করতে পারবে না। ফলে সাইরেন বাজবেই।

প্ল্যান মতো, জন আর ওর সহযোগী ছেলেটা এতক্ষণে কন্ট্রোলরুম থেকে বেরিয়ে কোনও একটা জায়গায় গিয়ে লুকিয়েছে। কিন্তু অদম্যর তার উপায় নেই। ও দ্রুত ছাদের দিকে উঠতে লাগল। লিফ্টটা ও আগেই বিকল করে দিয়েছে। ও নিজে লিফ্‌টে উঠে পালাতে গেলে, সিকিয়োরিটির লোকজন নীচের থেকে সেটা বন্ধ করে দিয়ে ওকে লিফ্‌টের খাঁচায় আটক করে ফেলত। তাই এখন সবাই সমান। সবাইকে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হবে।

ছাদের উপর উঠে ছাদের দরজাটাকে ও লক করে দিল। ও জানে নীচের সিকিয়োরিটির লোকজনের কাছে এটা ভাঙা কোনও ব্যাপার নয়। কিন্তু ভাঙতে সময় লাগবে। সেই অতিরিক্ত সময়টাই ওর দরকার।

এবার ছাদের কোনার দিকে দ্রুত এগোল অদম্য। ব্যাকপ্যাকটা একবার দেখে নিল ও। মহামূল্যবান জিনিসপত্র আছে ওতে!

দুম দুম করে শব্দ হচ্ছে দরজা ভাঙার! সাইরেন শুনে যেসব সিকিয়োরিটির লোকজন ওকে তাড়া করেছে তারা নিশ্চয় জেনে গিয়েছে যে, গয়নাপত্তর উধাও। জেনে গিয়েছে এই পথেই পালাচ্ছে ও। কারণ নীচে তো নামেনি! আর লক করে রাখা ছাদের দরজা ওদের সন্দেহ আরও পোক্ত করে দিয়েছে।

ছাদের দরজাটা ভেঙে পড়ার আওয়াজ শুনল অদম্য। আর সময় নেই। ও আবার মাইক্রো লেজার কাটারটা বের করল। সামনেই টান করে বাঁধা দুটো স্টিলের দড়ি!

বেশ কয়েক জোড়া পায়ের শব্দ কাছে চলে আসছে দ্রুত। অদম্য স্টিলের দড়ি দুটো কেটে ফেলল দ্রুত।

পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে আরও। অদম্য আর সময় নষ্ট করল না! স্টিলের ওই দুটো দড়ি গ্লাভস-পরা হাতে পেঁচিয়ে ধরে হাওয়ায় দুলে উঠল। আর হাওয়ার টানে বিরাট হলুদ বেলুন ভেসে উঠল আকাশে। অদম্য হাওয়ায় ভাসতে-ভাসতে দেখল, ছ’ জন সিকিয়োরিটির লোক অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। দেখছে কলকাতার রাতের আকাশে বিশাল বড় হলুদ বেলুনে ঝুলে দূর থেকে আরও দূরে ভেসে যাচ্ছে একটা লোক!

লোকগুলো সংবিৎ ফিরে পেয়ে গুলি চালাচ্ছে এবার। কিন্তু গুলি লাগছে না। শিস তুলে বেরিয়ে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। অদম্য বেশ অনেকটা উপরে চলে এসেছে। লোকগুলোকে এখন চড়াই পাখির মতো লাগছে। বেলুনটা হাওয়ার টানে ময়দানের দিকে ভাসছে। মধ্যরাতের কলকাতা ছাড়িয়ে পাখির মতো উড়ছে অদম্য। আর তখনই কানে লাগানো ইয়ার পিস-এ ও শুনল জনের গলা।

জন বলল, “লুক অ্যাট ওয়ান ও’ক্লক। আমি একটা ট্রেলার নিয়ে আসছি।”

জন বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে গিয়েছে তবে!

অদম্য নীচে তাকাল। একটা লম্বা ট্রেলার রাস্তা দিয়ে আসছে। ও কোমর থেকে ছোট্ট একটা পেলেট গান বার করে এবার বেলুনটার দিকে তাক করে ছর্‌রা ছুড়ল। বেলুনটা শব্দ করে হাওয়া ছেড়ে দিল এবার। আর সঙ্গে সঙ্গে দ্রুতবেগে নামতে লাগল নীচে। অদম্য স্টিলের দড়ি ধরে বেলুনের গতিপথটা ঠিক রাখল। ওই তো ট্রেলারটার প্রায় কাছে পৌঁছে গিয়েছে। আর চল্লিশ ফুটের মতো দূরত্ব। ও সুইচ টিপে আবার সেই জুতোর তলার হাওয়া-বুদবুদ অ্যাকটিভেট করল। তারপর দড়ি ছেড়ে দিয়ে ট্রেলারটাকে লক্ষ করে লাফ মারল!

ট্রেলারের সমতল প্ল্যাটফর্মে পড়ে একটা ডিগবাজি খেয়ে নিল অদম্য। তারপর স্থির হয়ে বসল। মাথা ঘুরিয়ে দেখল ফাটা বেলুনটা হাওয়ায় উড়ে কিছু দূরে গিয়ে জড়িয়ে গেল একটা বাড়ির সঙ্গে!

জন এবার ট্রেলারটাকে ময়দানের আবছায়ায় নিয়ে গিয়ে ধীর করল একটু। আর সেই সুযোগে অদম্য নেমে গেল চট করে। চারদিক শুনশান। যাক, সবকিছু নিখুঁত প্ল্যান মাফিক হয়েছে!

অদম্য এদিক-ওদিক দেখল একবার। তারপর ময়দানের গাছেদের মাঝে অন্ধকারে মিলিয়ে যাবে বলে পা বাড়াল!

আর তখনই কী যেন এসে একটা লাগল ওর পিঠে। আহ্! সারা শরীর নড়ে উঠল অদম্যর! নিমেষে মাথা ঘুরে পড়ে গেল মাটিতে! গাঢ় অন্ধকার নেমে এল ওর চোখে।


হো বেরিয়ে এল গাছের আড়াল থেকে। ওর পাশে লাল।

লাল জিজ্ঞেস করল, “তুমি শিয়োর ও মারা গিয়েছে?”

হো হাসল। হাতে ধরা ব্লোগানটা দেখিয়ে বলল, “সাউথ ইস্ট এশিয়া থেকে আমাজ়ন, কোথাও কখনও এই ব্লোগান ফেল করে না। এর ডার্টে যে- বিষ আছে তাতে বাঘও শেষ হবে!”

লাল এগিয়ে এসে অদম্যর পিঠ থেকে ব্যাকপ্যাকটা খুলে নিল। তারপর হেঁটে গেল সামান্য দূরে দাঁড় করানো একটা গাড়ির দিকে। হো একবার তাকাল অদম্যর নিথর শরীরের দিকে তারপর লালের দিকে এগিয়ে গেল।

এগারো

সন্ধের অন্ধকারে রাজা হাওয়ার বেগে দৌড়োল। এখানে এমনিতেই রাস্তাঘাট ফাঁকা তারপর এখন প্রায় আটটা বাজে। সব কেমন শুনশান হয়ে গিয়েছে।

জীবেশের বাড়ি কিছুটা দূরে। রাস্তার অবস্থা ভাল না। পিচ ভেঙে গিয়েছে জায়গায়-জায়গায়। তা-ও তার মধ্যে দিয়ে প্রাণপণে দৌড়োল রাজা। কয়েকবার পড়ে গেল মাঝে। হাত কাটল, পা কাটল। কিন্তু ওর যেন হুঁশ নেই! জীবেশ ওর বাবার মৃত্যুর ব্যাপারে জানে! শেষ অবধি জীবেশ ছিল বাবার সঙ্গে! আর বাবাকে ওইভাবে মিউটিলেটেড অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল! কেন? কেন? কেন?

হাজার-হাজার প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরছে রাজার।

দূরে দূর্বল সাদা আলো জ্বলে আছে মাঝে-মাঝে। কিন্তু অন্ধকার তারা দূর করতে পারেনি বিশেষ!

সামনে রাস্তাটা ডান দিকে বেঁকে গিয়েছে। রাজা সেই দিকে বাঁক নিল। ওই তো দূরে দোতলা বাড়িটা দেখা যাচ্ছে! আলো জ্বলে আছে। রাজা দৌড়ের গতি বাড়াল।

সামনে লোহার গেটটা খোলা! রাজা সোজা ঢুকে গেল। গেট পেরিয়ে বাগান। তার মাঝের নুড়ি ফেলা রাস্তা দিয়ে সোজা বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল রাজা!

এ কী! বাড়ির দরজাও খোলা! রাজা এত কিছু ভাবল না। মাথায় আজ পাগল এসে ভর করেছে! ও বাড়ির মধ্যে ঢুকে এদিক-ওদিক তাকাল। শুনশান বাড়ি। কেউ নেই? নাকি আছে? ওই তো গান শোনা যাচ্ছে উপরে।

রাজা সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল দোতলায়। গানটা জোরে হল এবার। শব্দটা স্টাডির দিক থেকে আসছে। রাজা সেই দিকে এগোল। জীবেশ নিশ্চয়ই স্টাডিতে বসে গান শুনছে এখন।

স্টাডিটা অন্ধকার। রাজা পায়ে-পায়ে ঢুকল। করিডরের আবছায়া আলোয় দেখা যাচ্ছে সামনের সোফায় জীবেশ বসে রয়েছে। খোলা জানলা দিয়ে হু-হু করে সন্ধের হাওয়া ঢুকছে। গান বেজে চলেছে জোরে।

“জীবেশ আঙ্কল!” রাজা জোরে ডাকল।

জীবেশ সাড়া দিল না।

রাজার রাগটা এবার ফেটে পড়ল যেন। ও আর স্থির থাকতে না পেরে, “জীবেশ!” বলে গিয়ে ধাক্কা দিল বসে থাকা মানুষটাকে। আর জীবেশ উলটে পড়ল মাটিতে! সামনের টেবিলে ধাক্কা লেগে কাচের কিছু জিনিস পড়ে গেল সশব্দে!

রাজা ঘাবড়ে গেল এবার। জীবেশ মাটিতে নিথর হয়ে আছে!

“কে? কে ওখানে?” আচমকা আলো জ্বালিয়ে ঘরে ঢুকে এল মধু ও ওদের কাজের দিদি!

রাজা হতভম্ব হয়ে দেখল, মাটিতে একটা কাচের টেবিল-টপ চুরমার হয়ে আছে আর সেই কাচের উপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে জীবেশ। পিঠে একটা বড় ছোরা গাঁথা! রক্তে ভিজে গিয়েছে জীবেশের জামা। আর সেই রক্তের একটা অংশ লেগে আছে রাজার হাতে!

“তুমি… তুমি… মামাকে…” মধু হতভম্ব হয়ে তাকাল রাজার দিকে।

“আমি কিছু করিনি… সত্যি বলছি, আমি কিছু করিনি…” রাজা আর কী বলবে বুঝতে পারল না!

কাজের দিদিটি এবার প্রাথমিক ভয় কাটিয়ে উঠে আচমকা চিৎকার করা শুরু করল। আর দৌড়ে নীচে নেমে গেল। মধু কী বলবে বুঝতে না পেরে বলল, “তুমি শেষে… এভাবে…”

রাজা বুঝল এই অবস্থায় ওর কথা কেউ মানবে না, কেউ শুনবে না! ও তাই আর কথা না বাড়িয়ে মধুর পাশ দিয়ে এক দৌড়ে বেরিয়ে এল বাইরে। কাজের দিদি ওকে দেখে কিছুটা ভয়ে কুঁকড়ে সরে গেল৷ একপাশে! তারপর ও বেরিয়ে গেলে আরও জোরে চিৎকার করতে লাগল।

গেটের বাইরে বেরিয়ে রাজা একটু থমকাল। দেখতে পেল আশেপাশের নির্জন বাড়িগুলোর দরজা খুলে একজন-দু’জন করে মানুষজন বেরিয়ে আসছে!

ও আর কোনওদিকে না তাকিয়ে দৌড়োল অন্ধকারের মধ্যে!


পিটার অন্ধকারের মধ্যে কেমন একটা থতমত খেয়ে বসে আছে! মাথার পিছনটায় ব্যথা! কে মারল ওকে এভাবে! দেওয়ালের এপার থেকে পেরিস্কোপ দিয়ে সব তো দেখছিল। আচমকা কে মারল ওকে!

মাথাটা ভোঁ-ভোঁ করছে। বুঝতে পারছে কানের পিছন দিয়ে চটচটে একটা কিছু গড়িয়ে পড়ছে! ও হাত দিল। হ্যাঁ, যা ভেবেছে, রক্ত!

পিটার এতক্ষণ ঝোপের পাশে পড়েছিল, এবার উঠে দাঁড়াল। টলে গেল একটু। মাথাটায় বেশ ব্যথা! তা-ও মন শক্ত করে দাঁড়াল। দেখল আশেপাশে পেরিস্কোপটা নেই! স্বাভাবিক। আর তখনই শুনল একটা চিৎকার আর তার কিছু পরে দেখল রাজা বাড়িটার থেকে বেরিয়ে দৌড়ে মিলিয়ে গেল অন্ধকারের দিকে।

নিমেষে কর্তব্য স্থির করে নিল পিটার। ও টলোমলো মাথা নিয়ে দৌড়োল জীবেশের ওই ঘরের দিকে। জানালা খোলা আছে। ঢুকতে অসুবিধে হবে না। ওই ঘরে ক্যামেরা আছে। রেকর্ডিংটা চাই ওর! ওটা নিয়ে ও যাবে রাজার কাছে!

বসের বাড়িটা এই মধ্যরাতে বেশ নির্জন লাগছে!

লাল গাড়িটাকে মেন গেটের বাইরে রেখে হো-কে নিয়ে এগিয়ে গেল সামনে। তারপর দরজার কাছে গিয়ে নক করল।

একজন দরোয়ান এসে প্রথমে একটা ছোট্ট খুপরি দিয়ে ওদের দেখল। তারপর বড় দরজার মাঝের ছোট দরজাটা খুলে দিল। ওরা দু’জনে ঢুকে গেল।

এই বাড়িটা বেশ বড়। উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। ভিতরে লন, সুইমিং পুল সব আছে।

মূল বাড়িটায় আলো জ্বলছে। বস একাই থাকে এখানে। কাজের লোকজন বড় বাড়ির পিছনে একটা আউট হাউজ়ে থাকে।

তা ছাড়া এখন যে জন্য লাল এসেছে সেটাতে বসের সঙ্গে কেউ না থাকাই বাঞ্ছনীয়।

হো-কে চোখের ইঙ্গিত করে মূল বাড়ির কাচের স্লাইডিং ডোরটা ঠেলে লাল ঢুকে গেল ভিতরে!

বস বসেছিল একটা রকিং চেয়ারে। গাড়ি করে আসতে-আসতেই লাল ফোন করে খবর দিয়ে দিয়েছিল। বস জানে লালের উপর ভরসা করা যায়। আর লাল এতদিন পর্যন্ত সবরকমভাবেই বসের সব কাজে সাহায্য করে এসেছে। কিন্তু এখন বয়স বেড়ে যাওয়ায় সব কাজ নিজে আর করতে পারে না!

বস চেয়ার থেকে উঠে এগিয়ে এল সামান্য। তারপর জিজ্ঞেস করল, “কী খবর?”

“স্যার, অল ইজ় গুড?’ লাল অদম্যর ব্যাকপ্যাকটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “এই যে এইখানে আছে সব। মানে ওই তিনটে জিনিস।”

“আর ওই লোকটা! অদম্য?” বস হাতের গ্লাসটা রাখল পাশের টেবিলে।

লাল হাসল। হো-কে দেখিয়ে বলল, “ওকে জিজ্ঞেস করুন স্যার।”

বস তাকাল হো-র দিকে। তারপর জিজ্ঞেস করল, “কী করে করলে? শুনেছিলাম তো ও খুব সাংঘাতিক মানুষ! তাকে মারলে কী করে?”

হো শান্তভাবে তাকাল বসের দিকে। তারপর আচমকা কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে কোমর থেকে একটা পাতলা কিন্তু সাংঘাতিক ধারালো ছুরি বের করে নিমেষে লালকে পিছন থেকে ধরে গলার জাগিউলার ভেনটা কেটে দিল এক ঝটকায়! লালের গলা থেকে রক্তটা ফিনকি দিয়ে গিয়ে পড়ল বসের মুখে।

বস ঘটনার আকস্মিকতা আর নৃশংসতায় ঘাবড়ে গিয়ে পিছিয়ে গেল সামান্য। চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে আছে বসের!

হো হাতের লকলকে রক্তমাখা ছুরিটা নিজের জামায় মুছে ভাঙা ইংরেজিতে বলল, “এভাবে মারিনি। তবে কীভাবে মেরেছি সেটা ও বলবে?”

বস সন্ত্রস্ত মুখে তাকাল। দেখল, হো কথাটা বলে একপাশে সরে গেল নিঃশব্দে, আর একটা ছায়ামূর্তি ধীরে-ধীরে এগিয়ে আসতে লাগল ওর দিকে!

বারো

উদ্‌ভ্রান্তের মতো ঘরে ঢুকল রাজা। এদিক-ওদিক তাকাল। তারপর চিৎকার করে ডাকল, “আঙ্কল, আঙ্কল!”

“কী হয়েছে?” বাগানের দিক থেকে দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকল শার্দূল।

রাজা ঘুরে তাকাল শার্দূলের দিকে।

ওকে দেখে শার্দূল আঁতকে উঠল, “আরে হাত কেটে গিয়েছে নাকি? এত রক্ত!”

রাজা কাঁপা গলায় বলল, “না না… এটা জীবেশ আঙ্কলের রক্ত!”

“তুমি… তুমি ওকে মেরে দিয়েছ?” শার্দূল ভীত গলায় বলল।

“না না, আমি যখন গিয়েছিলাম তার আগেই মারা গিয়েছিল জীবেশ আঙ্কল। অন্ধকার ঘরে কেউ ছুরি মেরে গিয়েছিল। আমি ধরতেই মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। আমি খুন করিনি! তবে মধু আর ওদের কাজের দিদি দেখেছে আমায়… কিন্তু আমি… প্লিজ় আঙ্কল…”

শার্দূল চমকে উঠল, “মধু দেখেছে তোমায় এই অবস্থায়! সর্বনাশ! না না, আমি কিছু করতে পারব না। পুলিশ আসবে যে-কোনও সময়ে। আমি ভাবতে পারছি না! এটা কী হল! আর আমি তোমায় বিশ্বাস করব কীভাবে? তুমি আমার কথা শুনে যেভাবে জীবেশের কাছে গেলে তাতে… তাতে আমি তোমায়… ওঃ, এক কাজ করো।”

শার্দূল দ্রুত পাশের ঘরে ঢুকে গেল।

রাজা অসহায়ের মতো তাকাল শার্দূলের দিকে। ও বুঝতে পারছে শার্দূল এই ঝামেলায় জড়াতে চাইছে না। আর সেটাই স্বাভাবিক! এখন কী করবে ও? কার কাছে যাবে? কিছু বুঝতে পারছে না ও! মৃতদেহের সঙ্গে এভাবে দু’জন দেখেছে ওকে। ওই ঘরে ওর হাতের ছাপ আছে! পুলিশ ওকে ছাড়বে না। কিন্তু যে-অপরাধ ও করেইনি সেটার জন্য কেন শাস্তি পাবে ও!

শার্দূল বেরিয়ে এল ঘর থেকে। হাতে পাঁচশো টাকার কয়েকটা নোট! বলল, “এখানে পাঁচ হাজার আছে। তুমি এটা নিয়ে আপাতত কোথাও গা ঢাকা দাও! প্লিজ় এখানে থেকো না! প্লিজ়। ওই উকিল মারা গেলেন, জীবেশ মারা গেল, আমার উপর হামলা হল। তোমায় ডাকাই ভুল হয়েছে আমার! প্লিজ় তুমি এখন যাও?”

রাজা চোয়াল শক্ত করল। তারপর টাকাটা নিল। এটা দরকার। এখন এখান থেকে বেরিয়ে কোথাও একটা গা ঢাকা দেবে। মোবাইল ব্যবহার করবে না। তারপর সুযোগ বুঝে কোনও বুথ থেকে ফোন করবে পিটারকে। সে তো বলেছিল ওকে সাহায্য করবে! সত্যি করবে তো?

শার্দূল ভয়ের চোখে তাকাল রাজার দিকে। তারপর বলল, “আর এখানে থেকো না। তুমি এসো। না হলে যে-কোনও সময়ে পুলিশ এসে যাবে। প্লিজ়।”

রাজা আর সময় নষ্ট না করে নিজের ঘরে গিয়ে শুধু কাঁধের ব্যাগটা নিয়ে এল। এতেই যা কাগজপত্তর আছে। ওই সুটকেসে তো শুধু জামাকাপড়! ওটা নেবে না।

বেরোবার আগে ও শার্দূলের ঘরে গেল। দেখল বিহল শার্দূল সেই অর্ধবৃত্তাকার সিন্দুকের সামনে কপালে হাত দিয়ে মাটিতে বসে আছে।

ওকে দেখে শার্দূল বলল, “কী আর বলি? সাবধানে থেকো! আমি তো কিছু করতে পারলাম না। এসো। আর আমায় বোলো না কোথায় যাচ্ছ। পুলিশ তোমার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে আমি তাদের মিথ্যে বলতে পারব না। তুমি এসো!”

রাজা আর কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে এল। সামনে অন্ধকার জীবন। এখন কোথায় যাবে ও? ব্যাগের ভিতর ছোট ডায়েরিটায় পিটারের নম্বর আছে। কিন্তু পিটার আসবে তো?

ওদিকে পুলিশ যদি ওকে খোঁজে! যদি কেন, নিশ্চয়ই খুঁজবে। তখন কী করবে রাজা? শার্দূলের বাড়ির থেকে কিছুটা দূরে আবছায়া অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইল ও! জীবন আবার ওকে এক অনিশ্চয়তা আর অন্ধকারে এনে দাঁড় করিয়েছে। কিন্তু এবার কে বাঁচাবে ওকে? কে আলো দেখাবে?

“রাজা?” আচমকা পিছন থেকে একটা গলার স্বর পেল ও।

ঘুরে তাকিয়ে দেখল পাশের ঝোপ থেকে কে যেন ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে! সামান্য সময় পরে চিনতে পারল রাজা! নিমেষে সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল ওর! আর ভরসাও পেল এই অনিশ্চয়তার মাঝে। কিন্তু কী বলবে বুঝতে পারল না। আচমকা শরীর কেমন যেন ভেঙে এল ওর। সব কষ্ট, ভয় আর ক্লান্তি এক সঙ্গে ভর করল ওর উপর।

রাজা রাস্তার মাঝে বসে দু’হাতে মুখ গুঁজে কেঁদে উঠল ফুঁপিয়ে। পিটার ধীরে-ধীরে এগিয়ে এল ওর দিকে। ওর কাঁধে হাত দিয়ে বলল, “ডোন্ট ওয়রি। হি ইজ় হিয়ার!”

বস ত্রস্ত হয়ে দেখল ছায়ামূর্তিটা ধীরে-ধীরে এগিয়ে আসছে ঘরের ভিতরে।

“অদম্য?” বস যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না!

ঘরের আলোয় এসে দাঁড়াল অদম্য!

“তুমি তো মারা… মানে, হো…” বস কী বলবে বুঝতে পারল না। জামার হাতা দিয়ে মুখে লেগে থাকা রক্ত মুছল শুধু।

অদম্য বলল, “হো আমার লোক! এই কাজের একমাস আগেই ওকে আমি ঠিক করে রেখেছিলাম। লি লিং-ও আমার কথায় লালকে হো-র কথা বলেছিল! এমন অনেক-অনেক লোক সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে যারা আমার সঙ্গে কাজ করে! আমি কোনও কাজে নামলে, সেই কাজের চারদিকের সব কিছু ঠিক করেই নামি! সব রিগ্ড থাকে! আমায় এবারও সরিয়ে দিতে চেয়েছিলে? আমায় দিয়ে কাজ করিয়ে এবারও পিঠে ছুরি মারতে চেয়েছিলে! কী ভেবেছিলে, আমায় এভাবে মারা যাবে? কী ভেবেছিলে, হো সত্যি আমায় মেরে দিয়েছে!”

বস বলল, “নিয়ে নাও, আমার যা আছে তুমি সব নিয়ে নাও। এই তোমার ব্যাকপ্যাকে যা আছে সব তোমার। যা টাকা তোমায় দেব বলেছিলাম সেটারও ডবল টাকা দেব। কিন্তু প্লিজ় আমায় মেরো না! আমি ভুল করে ফেলেছি! প্লিজ়?”

অদম্য ধীরে-ধীরে এগিয়ে গেল সামনে। তারপর ঠান্ডা গলায় কেটে-কেটে বলল, “এত কিছু আজ দিয়ে দেবে! সব দিয়ে দেবে! কেন, আজ আমায় পাঁচ হাজার টাকা ধরিয়ে আর একবার সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে হত না আঙ্কল? আঙ্কল, নাকি শার্দূল মজুমদার, কী বলব তোমায়?”

বস অর্থাৎ শার্দূল পাথরের মূর্তির মতো তাকিয়ে রইল সামনে!

অদম্য বলল, “একটা কথা মনে রেখো, আঠারো বছর বয়সের রাজাকে মারা যায়, কিন্তু আঠাশের অদম্যকে মারা যায় না! কারণ অদম্য কোনও মানুষ নয়। অদম্য একটা বিশ্বাস, একটা জেদ, অদম্য একটা পালটা লড়াই! একে কেউ কিছুতেই মারতে পারবে না। তুমি তো না-ই!”

তেরো

গলিটা ছোট। সরু। সেভাবে সূর্যের আলোও এসে পড়ে না। তার মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে এগোতে লাগল ওরা তিনজন।

রাজা এদিক-ওদিক তাকাল। নোংরা রাস্তার পাশে জল জমে আছে। স্তূপ হয়ে আছে প্লাস্টিক, ভাঙা চায়ের ভাঁড়, ময়লা কাপড়, কাদা। কেমন একটা বদ গন্ধ ছড়িয়ে আছে চারদিকে।

গলিটা সামনে গিয়ে বাঁদিকে বাঁক নিয়েছে। সেদিকে বাঁক নিল ওরা। তারপর একটা দরজার সামনে দাঁড়াল।

টিনের দরজাটা ছোট। জং-ধরা। তাপ্লিমারা আছে বেশ কয়েক জায়গায়।

পিটার কয়েকবার টোকা দিল। একটু পরে দরজাটা খুলে গেল সামান্য। একটা অল্পবয়সি ছেলে উঁকি মেরে দেখল প্রথমে, তারপর খুলে দিল পুরো দরজাটা। ছেলেটা বেঁটে, রোগা। কপালের ডানদিকে একটা ছোট্ট আবের মতো আছে। ওদের দেখে ছেলেটার চোখ উজ্জ্বল হল সামান্য। বলল, “আসুন স্যার।”

ঘরটা মাঝারি মাপের। মাথার উপর টালির ছাদ দেওয়া। ঘরের একটা দিকে একটা মোটা কালো পরদা টাঙানো। তার একপাশে একটা দাড়িওয়ালা বুড়ো লোক বসে আছে। লোকটার সামনে একটা টেবিল তাতে সারা পৃথিবীর জিনিস জড়ো করা!

ওরা ঘরে ঢুকতেই লোকটা চেয়ার থেকে উঠে এসে ভাল করে রাজাকে দেখল একবার। তারপর ওই রোগা ছেলেটাকে বলল, “টাকার কথা বলে নিয়েছিস তো কেতো? পঁচিশ হাজার লাগবে কিন্তু।”

কেতো হাসল, “পেমেন্ট নিয়েও নিয়েছি। একদম কমপিলিট!”

লোকটা আবার তাকাল রাজার দিকে। তারপর কালো পরদার দিকে ইশারা করে বলল, “ওই দিকে চলো। আর চুলটা আঁচড়ে নাও একটু। মুখটা মুছে নাও। তেলতেলে হয়ে আছে। ছবি বাজে আসবে!”

পিটার চিরুনি এগিয়ে দিল ওকে। রাজা দ্রুত চুলটা আঁচড়ে নিল। পকেট থেকে রুমাল বার করে মুছে নিল মুখ। তারপর কালো পরদার ওদিকে গেল।

লোকটা একটা হালকা নীল বোর্ডের সামনে রাজাকে দাঁড় করিয়ে দুটো বড় আলো জ্বালিয়ে দিল। তারপর খচখচ করে ছবি তুলে নিল কয়েকটা।

এবার বাইরে বেরিয়ে এল রাজা। লোকটা সাদা কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এখানে নাম সই করো। না, নিজের নাম নয়। এই নামটা! দরকার হলে পাশের ওই খাতায় কয়েকবার প্র্যাকটিস করে নাও।”

প্রথমে কয়েকবার প্র্যাকটিস করে নিয়ে রাজা নতুন নামটা সই করল। লোকটা দেখল সেটা। কীসব মাপ নিল। তারপর বলল, “কাল পাবে পাসপোর্ট। কেমন? এখন যাও।”

পিটার বলল, “কালকে মানে কিন্তু কালকে। আর কোনও প্রবলেম হবে না তো? মানে এমন নকল পাসপোর্ট তো! তাই বলছিলাম…”

লোকটা বলল, “নকল? কে ধরবে নকল! যার-যার নাম ব্যবহার করে আমি এইসব পাসপোর্ট বানাই এক সময় তারা সবাই বেঁচেছিল। এখন আর নেই! যেমন, তোমাকে দেওয়া পাসপোর্ট যার নামে সে কিছুদিন আগেই মারা গিয়েছে। আমার লোক তার যাবতীয় ইনফরমেশন কালেক্ট করে এনেছে। সেটা বেস করেই তোমার কাগজপত্র বানাব। তাই ঘাবড়িও না। এমনি এমনি আমার এই লাইনে এত নাম হয়নি! আর আমার এই বাড়ি দেখে কিছু ভেবে বোসো না। এটা আমার ক্যামোফ্লাজ। আমার কাছে নানা দেশ থেকে লোকজন আসে! এমন পাসপোর্ট বানিয়ে দেব যে, কেউ ধরতে পারবে না। কেউ না। মনে রেখো, নর্টন যা বলে সেটাই করে?”

“থ্যাঙ্কস! চলো পিটার?” পাশের থেকে এবার কথা বললেন তিনি!

নর্টন থমকাল। সাদা জামা-প্যান্ট পরা সাদা দাড়ির মানুষটাকে এই প্রথম কথা বলতে দেখল। জিজ্ঞেস করল, “আপনি স্যার কে? আলাপ হল না তো?”

মানুষটি সামান্য হাসলেন। তারপর রাজাকে দেখিয়ে বললেন, “ও আমার কাছে থাকে। অস্ট্রিয়ার ফিস নামে একটা ছোট্ট জায়গায় আমাদের অরফ্যানেজ। আমায় সবাই ফাদার ফ্রান্সিস বলে!”

“প্লিজ়, আমায় মেরো না… আমি তোমার ক্ষতি করতে চাইনি… আমি জাস্ট তোমায়… মানে আমার…” শার্দূলের কথা জড়িয়ে যাচ্ছে।

“ক্ষতি করতে চেয়েছ কি চাওনি সেটা তো তোমার কথা শুনে আমি ঠিক করব না! সেই খুনের অপবাদ আর ভয় নিয়ে পালাতে-পালাতে আমি আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছি। আর আমার বাবাকে কে মেরেছিল সেটাও আমি জেনে গিয়েছি এই দশ বছরে। জীবেশকে ছাড়ার এক মাস পরে জলদস্যুরা বাবাকেও ছেড়ে দিয়েছিল। বাবার থেকে তো কিছু পাচ্ছিল না ওরা! কিন্তু বাবাকে মারো তুমিই! কারণ ছ’টা অমূল্য ডায়মন্ড! জলদস্যুদের থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে বাবা নতুন কাজ নিয়ে চলে গিয়েছিল কঙ্গোয়! ডায়মন্ড মাইনের কাজ নিয়ে। সেই মাইনের মালিক, জিম কাতাগ্না একজন ওয়ারলর্ড ছিল। তাকে বাবা বাঁচিয়েছিল একটা গুপ্ত হত্যার হাত থেকে। সেই মানুষটা কৃতজ্ঞতা স্বরূপ বাবাকে ওই হিরেগুলো দিয়েছিল। বাবা তোমায় বিশ্বাস করে বলেছিল সেই কথা। কিন্তু তার আগে হিরেগুলো বাবা সেই উকিল ভদ্রলোকের কাছে গচ্ছিত রেখে দিয়েছিল। কথা ছিল আমার আঠারো বছর বয়সে সেগুলো আমি পাব। বলেওছিল তোমায় সেই কথা। কিন্তু তুমি সেগুলো আত্মসাৎ করতে চেয়েছিলে। বাবা দিতে অস্বীকার করলে বাবাকে তুমি ডুবিয়ে মেরেছিলে জলে! ভেবেছিলে পরে উকিল লোকটির থেকে তুমি বার করে নেবে হিরে! কিন্তু সেই লোকটিকে খুঁজেই পাওনি! হ্যাঁ, বাবা একটা ভুল করেছিল। আমার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য তোমার কন্ট্যাক্ট দিয়ে গিয়েছিল উকিলটিকে। আসলে বুঝতে পারেনি তো যে, তুমি বন্ধু সেজে পিঠে ছুরি মারবে! তাই আমার আঠারো বছর বয়স হওয়ামাত্র উকিল লোকটি যেই নিজের থেকে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করল তুমি দেখলে এই সুযোগ!

“আমিও এতদিন এমনই একটা সুযোগ চাইছিলাম। তাই যেই এই কাজটার কথা জানলাম, লি লিং-এর কাছে, আমি নিয়ে নিলাম। গত দশ বছরে তোমায় ইচ্ছে করলেই আমি মেরে দিতে পারতাম। কিন্তু আমি চেয়েছিলাম এমন একটা সময় আসুক যখন তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আমি তোমার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারব!’ অদম্য ধীরে-ধীরে সামনে এগিয়ে বলল, “আমার নামে বাবা যে জিনিসগুলো পাঠিয়েছিল সেটা নিয়ে উকিল ভদ্রলোক ভারতে আসতই না যদি না আমি ভারতে আসতাম, তাই তুমি আমায় খুঁজে ডেকে এনেছিলে তোমার কাছে। তারপর লোকটা যেই দিল্লিতে নামল তুমি তাকে খুন করালে। সব কাগজপত্র হাতিয়ে নিলে। আর নিলে আমার জন্য বাবা যে ছ’টা আফ্রিকান ডায়মন্ড পাঠিয়েছিল সেগুলো। সেগুলো বিক্রি করেই তোমার এত রমরমার শুরু! জীবেশ বোকা ছিল, ভাবত আমি ওকে দোষ দেব আমার বাবার মৃত্যুর জন্য। তাই ও আমাকে তাড়াতে চাইত বারবার। তা ছাড়া ও নিজেও তো সেই জলদস্যুদের সঙ্গে রফা করেই ছাড়া পেয়েছিল। আমার বাবা যেটা করেনি! তাই ও আমায় দেখেই রাগ করত। খারাপ ব্যবহার করত। আর তুমি সেই সুযোগটা নিয়ে ওকে মারলে। না, নিজে মারোনি। মেরেছিল ওই লাল। পিটারকেও মাথায় মেরেছিল লালই! তখন থেকেই ও তোমার সঙ্গী! পদে-পদে তুমি মিথ্যে বলেছ। এমনকী সেই যে সন্ধেবেলা তোমায় গুলি করা হয়েছিল সেটাও তোমার লাল-ই করেছিল। তাও ব্ল্যাঙ্ক কার্ট্রিজ ছিল সেগুলো। তুমি হাতে ধরা ধারালো কিছু দিয়ে নিজেই নিজের হাতে ক্ষত তৈরি করেছিলে। ভান করেছিলে কেউ মারতে চায় তোমায়। পরে পিটার রাস্তায় গুলির খোল খুঁজে পায়। ও অবাক হয়ে যায় দেখে যে, সেগুলো আসলে ব্ল্যাঙ্ক! মঞ্চ সাজানোর পর তুমি জানতে, আমায় বাবার মৃত্যুর গল্প বলে উত্তেজিত করে দিলে আমি তখনই জীবেশের কাছে যাব। সরাসরি জীবেশের নাম না করেও সেদিন বাবার মৃত্যুর দায় তুমি জীবেশের উপরই দিয়েছিলে!

“তোমার প্ল্যান কাজ করেছিল। উত্তেজিত হয়ে আমি সেদিন বেরিয়ে যাওয়ার পরেই তুমি লালকে ফোন করে দিয়েছিলে! আর আমি যাওয়ার আগেই জানলা দিয়ে ঢুকে লাল মেরে দিয়েছিল জীবেশকে। আর আমি তাতে ফ্রেমড হয়ে যাই! ব্যস, আমি পালালাম। তোমার পথের সব কাঁটা সাফ হয়ে গেল। তারপর ধাপে ধাপে তুমি এইখানে এসেছ! নানা খারাপ কাজ করে নানা মানুষকে ধোঁকা দিয়ে এখানে এসেছ! কিন্তু জানবে সব সিঁড়ির একটা শেষ ধাপ আছে! তুমি সেই ধাপে এসে পৌঁছে গিয়েছ আজ! তুমি সবার কাছে বস হলেও আমার কাছে পাতি একটা বিশ্বাসঘাতক আর ঠগ ছাড়া কিছুই নও শার্দূল!”

শার্দূল পিছিয়ে গেল এবার! ঘরের কোনায় অর্ধবৃত্তাকার সিন্দুক দেখিয়ে বলল, “যা হয়েছে ভুলে যাও! এখানে যা আছে আমি সব তোমায় দিয়ে দেব। হ্যাঁ, আমি ভুল করেছি। কিন্তু তুমি তো খুনি নও… তুমি তো ভাল…”

অদম্য হাসল, “না, আমি তথাকথিত ভাল মানুষ নই! আমি একজন খুনি! কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না আমার! যাদের আমি মেরেছি তাদের বাঁচার অধিকার ছিল না। ভাল বা খারাপ বলে কিছু হয় না। আমাদের চিন্তাধারা ভাল-খারাপ হিসেবে সব কিছু দাগিয়ে দেয়! আমি এই চুরির কাজটা কেন করতে এসেছি আমায় জিজ্ঞেস করেছিল লাল। আমি বলেছিলাম ষ্ট্রং ইনসেন্টিভ আছে আমার। ও হয়তো ভেবেছিল আমার ইনসেন্টিভ হল, টাকা! ভুল। মানুষের কাছে প্রতিশোধের চেয়ে বড় ইনসেন্টিভ আর কিছু হয় না।”

“প্লিজ়…” শাদূল পায়ে-পায়ে পিছিয়ে গেল সিন্দুকের কাছে।

“ওতে তখনও কিছু ছিল না এখনও কিছু নেই! তাই না? অমন ভারী একটা সিন্দুক তো শূন্য! ওটা দেখিয়ে আমায় কী হবে!”

“না এতে আছে! দেখো,” দ্রুত সিন্দুকের নাম্বারিং লক ঘুরিয়ে সেটা খুলে ফেলল শার্দূল। বলল, “এই দেখো।”

আর বলেই চকিতে সিন্দুকের ভিতর থেকে বার করে অদম্যর দিকে তাক করে ধরল একটা গ্লক নাইন্টিন পিস্তল! তারপর হিসহিসে গলায় বলল, “এবার! এবার বল কী হবে? অনেক বক্তৃতা শুনলাম। আর ভাল লাগছে না! সব ঠিক বলেছিস তুই! কিন্তু এবার তুই গিয়েছিস। হ্যাঁ, তোর বাবাকে আমি মেরেছি। জলে ডুবিয়ে মেরেছি। বেশ করেছি। বেশি সাধু সাজা না? সোনাগুলো আমরা খুঁজে পেয়েছি। ওটা আমাদের। ও যদি ভাগ নিত ঝামেলাই থাকত না! কিন্তু নিল কি? তারপর ওই হিরেগুলো দিতে চাইল না! কিন্তু পারল কি আটকাতে! ওকে হাত পিছমোড়া করে বেঁধে তারপর পায়ে পাথর ঝুলিয়ে ডুবিয়ে দিয়েছিলাম একটা লেকে! ও শেষবেলায় অনেকবার ‘প্লিজ়’ বলেছিল। ‘প্লিজ়’, যার কোনও মানে নেই। না, ওকে মারতে চাইনি। কিন্তু জীবন “সি-স”-এর মতো। একজন না নামলে আর একজন উঠবে কী করে! আজ যেমন তোরা দু’জন মরবি আর আমি আবার বেঁচে উঠব! শার্দূল এমন একটা প্রাণী যাকে মারা তোদের মতো পাতি গুন্ডাদের কাজ নয়! নাও ডাই।”

কথা শেষ করে, শার্দূল পিস্তলের ট্রিগার টানতে গেল, কিন্তু তার আগেই হো আচমকা ছিটকে সরে গেল একপাশে। আর ওর ছোট্ট ব্লোগান দিয়ে একটা ডার্ট ছুড়ে মারল শার্দূলের দিকে! ব্যাপারটা এতটাই দ্রুত ঘটে গেল যে, শার্দূল ট্রিগার টানার আগেই ডার্টটা গিয়ে গেঁথে গেল ওর গলার পাশে! “ওক্” শব্দ করে, নিমেষে স্থির হয়ে গেল শার্দূল! তারপর ধপ করে পড়ে গেল মাটিতে!

হো হাসল, “লো ডোজ-এ প্যারালিটিক ডার্ট। শেল ফিশ পয়জ়ন!”

অদম্য এগিয়ে গেল শার্দূলের দিকে। পিস্তলটা সরিয়ে দিল পা দিয়ে। তারপর ব্যাকপ্যাকটা তুলে সেখান থেকে ক্লিওপ্যাট্রার মুকুট আর ব্লাডি মেরি-র টিয়ারাটা বের করে পরিয়ে দিল শার্দূলের মাথায়!

হো এগিয়ে গেল সিন্দুকের দিকে। ভিতরটা ভাল করে দেখে অবাক হয়ে বলল, “আরে এটা তো সত্যি ফাঁকা! শুধু একটা বন্দুকের জন্য এমন একটা সিন্দুক!”

হাসল অদম্য। তারপর বলল, “কে বলেছে ফাঁকা! একটা আড়াই ফুট বাই আড়াই ফুটের লোহার সিন্দুক কি এতটা ভারী হয়?”

“তবে?” হো অবাক হল।

অদম্য এগিয়ে গিয়ে পকেট থেকে একটা ছুরি বের করে ঘষল সিন্দুকের গায়ে। রং উঠে গেল সিন্দুকের। আর হো অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল!

অদম্য বলল, “আসল ট্রেজার হল এটাই। সিন্দুকটা নিজেই নিরেট সোনার! রং করে রাখা হয়েছে এটাকে। একটা এমন পুরনো সিন্দুক কেন সারাক্ষণ নতুনের মতো রং করা! কেন এত দামি আসবাবের মধ্যে একদম সবার চোখের সামনে এটা রাখা! এটাকে কি এমন জায়গায় মানায়! সেই গোল্ড বুলিয়নের কিছু ব্যয় করে বাকিটা গলিয়ে জীবেশ আর শার্দূল একটা করে এমন সিন্দুক বানিয়েছিল নিজেদের জন্য!”

অদম্য দেখল শার্দূল আবার অল্প-অল্প নড়ছে! কিছু একটা বলারও চেষ্টা করছে! ও হো-কে ইশারা করল।

হো নিজের ব্যাগ থেকে নাইলনের কর্ড বার করল এবার। তারপর দ্রুত বেঁধে ফেলল শার্দূলের হাত আর পা। এবার একটা লোহার হুক বার করে গলিয়ে দিল পায়ের বাঁধনের মধ্যে দিয়ে।

“প্লিজ়…” স্থলিত গলায় বলল শার্দূল।

অদম্য আর হো এবার সিন্দুকটা ধরে ঘষে এনে হুকের অন্য প্রান্তের সঙ্গে লাগিয়ে দিল। তারপর একসঙ্গে শার্দূল আর সিন্দুকটা ঘষটে নিয়ে গেল বাইরের সুইমিং পুলের পাশে।

শার্দূল বলল, “প্লিজ় মেরো না আমায়… প্লিজ়…”

অদম্য চোয়াল শক্ত করে বলল, “বাবা তোমায় এমন করেই বলেছিল না? আজও কিন্তু প্লিজ় মিন্‌স নাথিং?”

শার্দূল আরও কিছু বলতে গেল, কিন্তু তার আগেই অদম্য দু’হাত দিয়ে পুলের গভীর অংশে ঠেলে ফেলে দিল সিন্দুকটা। আর তার টানে শার্দূল নিজেও তলিয়ে গেল নীল কাচের মতো জলের তলায়!

অদম্য তাকিয়ে দেখল জলের গভীরে ছটফট করছে শার্দূল! ধীরে-ধীরে নিস্তেজ হয়ে আসছে।

ও হো-কে বলল, “সিকিয়োরিটি ফুটেজ মুছে দেবে যাওয়ার আগে। আর দেখে নেবে যে-দরোয়ানটাকে আমি অজ্ঞান করে ঢুকেছি সে ঠিক আছে কি না! পারিশ্রমিক পৌঁছে যাবে তোমার কাছে। কেমন?”

হো হাসল। তারপর দ্রুত পায়ে আবার ঢুকে গেল ঘরের মধ্যে! অদম্য জানে সিসিটিভি ফুটেজে যা উঠেছে সেগুলো মুছে দিতে হো-এর সময় লাগবে না বিশেষ!


নির্জন রাস্তায় বেরিয়ে এদিক-ওদিক তাকাল অদম্য। ব্যাকপ্যাকটার সামনের চেন খুলে বার করল একটা কার্ড। তারপর মোবাইলটা বার করে ডায়াল করল একটা নম্বর।

কয়েকবার রিং হওয়ার পরে ওদিক থেকে ফোনটা ধরা হল, “হ্যালো!”

অদম্য সংক্ষেপে বলল, “জেনি, শার্দূল মজুমদার আজ মারা গিয়েছে নিজের বাড়িতে। তার কাছে এগজ়িবিশন থেকে চুরি হওয়া গয়নার কয়েকটা পাওয়া গিয়েছে। এটা এক্সক্লসিভ!”

জেনি বলল, “হ্যালো, কে বলছেন? মিস্টার সেন? অদম্য! হ্যালো, হ্যালো…”

জেনি ডেকে চলল কিন্তু এপার থেকে উত্তর দিল না কেউ। শুধু একটা মোবাইল ফোন শুনশান রাস্তায় পড়ে রইল। একা।

চোদ্দো

রাজা বসে রয়েছে মাথা নিচু করে। পিটার উঠে গিয়েছে বাথরুমে। পাশে শুধু ফাদার ফ্রান্সিস রয়েছেন।

“কী হয়েছে তোর?” ফাদার হাত দিলেন ওর মাথায়, “টেনশন করিস না। তোর এই নতুন পাসপোর্ট কেউ জাল বলে ধরতে পারবে না।”

রাজা তাকাল ফাদারের দিকে। তারপর বলল, “এটা কি পাপ নয় ফাদার? এভাবে চলে যাওয়া! এভাবে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে চলে যাওয়া পাপ নয়? এভাবে নকল পাসপোর্ট তৈরি করা কি পাপ নয়?”

ফাদার মৃদু হাসলেন, তারপর বললেন, “পাপ-পুণ্য মানুষের তৈরি করা! তুই তো খুন করিসনি, কিন্তু যে-সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স আছে তাতে তোকেই খুনি বলে প্রমাণ করা সহজ হবে। তা ছাড়া এর পিছনে যে রয়েছে সে তো সর্বশক্তি দিয়ে তোকে সাজা দেওয়ার চেষ্টা করবে! একজন নিরপরাধ যেন সাজা না পায়, আমি সেটাই চেষ্টা করছি! আসল সত্যের জন্য এই সব জাগতিক আইন-কানুন মাঝে-মাঝে না হয় আমি একটু ভাঙলাম, তাতে ক্ষতি আছে বলে আমার মনে হয় না! তুই মনখারাপ করিস না?”

রাজা বলল, “তুমি সত্যি বিশ্বাস করো তো যে, আমি খুন করিনি?”

ফাদার হেসে নিজের ল্যাপটপটা বার করলেন এবার। তারপর সেটা অন করে একটা ভিডিয়ো ক্লিপ চালালেন। বললেন, “দেখ!”

আর রাজা অবাক হয়ে দেখল একটা প্রায় অন্ধকার ঘরে তোলা দৃশ্য। দেখল, জীবেশ বসে রয়েছে অন্ধকার আবছায়ায়। আর পাশের একটা জানলা খুলে বেঁটে একটা লোক উঠে এল নিঃশব্দে! তারপর জীবেশকে কিছু বুঝতে না দিয়ে ওর পিঠে বসিয়ে দিল একটা ছুরি। জীবেশ চিৎকার করতে গিয়েছিল, কিন্তু লোকটা চেপে ধরল জীবেশের মুখ! জীবেশ কিছুক্ষণ ছটফট করে নিথর হয়ে গেল। লোকটা এবার জীবেশকে সোজা করে বসিয়ে আবার জানলা দিয়ে নেমে গেল বাইরে। তার কিছু পরে ঘরের দরজায় কে যেন দাঁড়াল এসে। রাজা চিনতে পারল নিজেকে। আরে, এটা তো ও! ওই তো ও সামান্য ধাক্কা দিল জীবেশকে আর জীবেশ সামনের কাচের টেবিলটা নিয়ে পড়ে গেল মাটিতে!

রাজা বিহুল হয়ে তাকাল ফাদারের দিকে, “এটা কী? কোথায় পেলে?”

ফাদার হাসলেন, “পিটার জোগাড় করেছে। জীবেশের ওই ঘরটায় তো ক্যামেরা লাগানো আছে। পিটার ওদের লক্ষ করত আড়াল থেকে। কিন্তু ওকেও মারার চেষ্টা করা হয়!”

“এটা পুলিশকে দেওয়া যায় না?” রাজা তাকাল ফাদারের দিকে।

“এটাকে প্রমাণ করা মুশকিল। নানা প্রশ্ন আসবে। এটা অথেনটিক কিনা সেটার পরীক্ষা হবে। আরও হাজার একটা পয়েন্ট আছে! তা ছাড়া এখানে তো কারও মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না! ফলে তা দিয়ে লাভ হবে না।”

রাজা শুধু বলল, “কিন্তু মধু তো ভাবল আমি অমনটা করেছি। ওর চোখে তো আমি ছোট হয়ে গেলাম। ওর সঙ্গে না হয় আর দেখা হবে না, তা বলে ও সারা জীবন আমায় এমন একটা মানুষ ভাববে!”

ফাদার হাসলেন। রাজার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, “অমন ভাবিস না। এর কপি মধুকেও দেওয়া হয়েছে। ও তোকে অমন ভাববে না। আর বলছিস, দেখা হবে না? এ জীবনে কী হবে কে বলতে পারে! ভবিষ্যতে কত কী যে হতে পারে! মন খারাপ করিস না। জানবি তোর লড়াই সবে শুরু হল। সামনে অনেকটা পথ পড়ে আছে। সেখানে কত কী লুকিয়ে আছে! এমন মাথা নিচু করে, মনমরা হয়ে বসে থাকলে হবে না। মাথা সোজা কর। জীবনের চোখে চোখ রেখে সোজা তাকা! এ জীবন নানা সমস্যা ছুড়ে দেয় আমাদের সামনে, কিন্তু যে সেইসব সমস্যায় হতোদ্যম না হয়ে এগিয়ে যায়, জীবন তাকে পুরস্কারও দেয়! জানবি এখানে পুরনো রাজা শেষ হল, আর নতুন একটা মানুষের চলা শুরু হল। সামনে অনেক যুদ্ধ বাকি! তোর বাবার হত্যাকারীকে শাস্তি দেওয়া বাকি! চিন আপ! লুক স্ট্রেট! চল, এবার। ইমিগ্রেশন কাউন্টারে যেতে হবে! আর যাওয়ার আগে ভাল করে দেখে রাখ এই কলকাতা শহরকে। একদিন ফিরতে হবে তোকে এখানে। যা-যা হিসেব বাকি আছে, সেটা মেলাতে ফিরতেই হবে তোকে! এখন চল”

এভাবে কী করে কেউ কাউকে মারে! অতন্দ্র অবাক হয়ে যাচ্ছে এখনও! সুইমিং পুলের মধ্যে পায়ে সিন্দুক বেঁধে ডুবিয়ে মেরেছে! আবার মাথায় মুকুট আর টিয়ারা পরিয়ে দিয়েছে! কী আশ্চর্য! এই শার্দূল মজুমদারই তো এই এগজ়িবিশনটা আয়োজন করিয়েছিল! এমনকী, অতন্দ্রদের কোম্পানিকে তো শার্দূলই কাজে নিয়োগ করেছিল! আর সেই লোকটাকে এমনভাবে মরতে হল! আর যে-চোর চুরি করেছিল গয়নাগুলো সে দুটো জিনিস এভাবে ফিরিয়ে দিয়ে গেল! মৃতদেহের সঙ্গে! কেন?

বাড়িতে অনেকগুলো সিসিটিভি ক্যামেরা। কিন্তু কোথাও কোনও ফুটেজ নেই। দরজার কাছে দরোয়ানটা অজ্ঞান ছিল। পিছনের কোয়ার্টারে থাকা কাজের লোকজন কিছু জানতেই পারেনি!

আর সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হল, যে-সিন্দুকটা বেঁধে ডুবিয়ে মারা হয়েছে সেটা পুরোটা সোনার!

অতন্দ্র কিছু বুঝতে পারছে না! অবস্থার গুরুত্ব বুঝে পুলিশ কমিশনার নিজে এসেছেন! দেশি-বিদেশি প্রেসও এসে পড়েছে! অতন্দ্রর লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে! ওদের এজেন্সির নাকের ডগা থেকে কী করে চুরি গেল এতগুলো গয়না! আর সঙ্গে এই খুন!

তবে একটা ব্যাপার ভাল যে, দুটো গয়না ফেরত পাওয়া গিয়েছে!

“মিস্টার রয়, গোটা ঘটনায় আপনার প্রতিক্রিয়া কী?”

অতন্দ্র দেখল পাশে একটা মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে! হাতে বুম! পিছনে ক্যামেরা হাতে আর একজন।

ও চোয়াল শক্ত করল। এই মেয়েটাই নিউজ়টা ব্রেক করেছে। নাম জেনি। কী করে মেয়েটা খবর পেয়েছে কে জানে!

অতন্দ্র বলল, “সরি, আমি কমেন্ট করব না কিছু।”

জেনি হাসল, “আপনাদের ঘোল খাইয়ে দিয়েছে, বলুন?”

অতন্দ্র বিরক্ত হয়ে তাকাল জেনির দিকে। তারপর আর কথা না বাড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেল। শুনল পিছন থেকে জেনি বলছে, “আমার মনে হয়, এখানে আসলে কী হয়েছে সেটা কোনওদিন জানতে পারবেন না আপনারা! যে এটা করেছে তাকে ধরা যায় না!”

অতন্দ্র কমিশনারের কাছ থেকে বিদায় নিল এবার। বডি চলে গিয়েছে। পুরো জায়গাটা পুলিশ ঘিরে রেখেছে। ওর আর কিছু করার নেই!

কালকে ইনশিয়োরেন্স কোম্পানির লোকজন আসবে। তাদের সঙ্গে বসতে হবে।

গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে বাড়ি যাওয়ার নির্দেশ দিল অতন্দ্র। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করে এগোতে যাবে এমন সময় একটা লোক দৌড়ে এসে দাঁড়াল ওর গাড়ির জানলায়। লোক নয় ঠিক, একটা ছেলে। সাতাশ-আঠাশ বছর বয়স। বলল, “স্যার, কমিশনার সাহেব আমায় বললেন আপনাকে এসকর্ট করে বাড়ি অবধি পৌঁছে দিতে।”

অতন্দ্র বিরক্ত হল, “আমার এসব লাগবে না?”

ছেলেটা নীল চেকশার্টটা ঠিক করে বলল, “স্যার, আমার উপর অর্ডার আছে। প্লিজ় আন্ডারস্ট্যান্ড।

অতন্দ্র মাথা নেড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর হাতের ইশারায় ছেলেটাকে উঠতে বলল সামনের সিটে।

বাড়ি পৌঁছতে আধঘন্টার মতো লাগল অতন্দ্রর। ততক্ষণ ছেলেটা কোনও কথা বলেনি।

অতন্দ্র গাড়ি থেকে নেমে বলল, “থ্যাঙ্কস!”

ছেলেটা গাড়ি থেকে নেমে হাসল। তারপর একটা প্যাকেট এগিয়ে দিল, “এটা আপনার মিসেসের জন্য স্যার।”

অতন্দ্র অবাক হল, “কে দিল এটা?”

“আমি জানি না স্যার। বড় সাহেবরা কেউ হবেন! আমায় শুধু বলা হয়েছে এটা ম্যাডামের জন্য গিফ্ট! কী একটা অকেশন নাকি আছে আপনাদের বাড়িতে! প্লিজ় স্যার। নিন।”

অতন্দ্র নিল প্যাকেটটা। ছেলেটা হেসে আবার নীল শার্টটা ঠিক করল। তারপর চলে গেল। ড্রাইভারকে গাড়িটা গ্যারাজ করে দিতে বলে অতন্দ্র বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেল।

নিশা বসার ঘরেই ছিল। সামনে বড় টিভিতে এবিপি আনন্দ চলছে। সেখানে এই চুরি নিয়েই খবর দেখাচ্ছে! জেনি মেয়েটা কীসব বলে যাচ্ছে!

অতন্দ্র নিশার হাতে প্যাকেটটা কোনওমতে দিয়ে, “তোমায় এটা দিয়েছে, বলে স্নানঘরের দিকে চলে গেল। মাথা ভোঁ-ভোঁ করছে! স্নান দরকার অতন্দ্রর!


নিশা খবর দেখে হাঁ হয়ে গেল! চারটে মহা মূল্যবান গয়না চুরি গিয়েছে! ক্লিওপ্যাট্রার মুকুট, ব্লাডি মেরির টিয়ারা, বেলজিয়ামের রানির সম্পূর্ণ চুনি দিয়ে তৈরি হার আর টামার অফ জর্জিয়ার ব্রেসলেট! জিনিসগুলোর ছবি বারেবারে দেখাচ্ছে টিভিতে! তার মধ্যে মুকুট আর টিয়ারা পাওয়া গিয়েছে আজ, কিন্তু বাকি দুটোর হদিশ নেই!

অন্যমনষ্কভাবে অতন্দ্রর দিয়ে যাওয়া প্যাকেটটা এবার খুলল নিশা। একটা চৌকো কালো বাক্স! এটা আবার কী? নিশা দ্বিধা নিয়ে বাক্সটার ঢাকনা খুলে ফেলল! আর তারপরেই থমকে গেল একদম!

দেখল, বাক্সটার ভিতরটা কাগজ ফুলের নরম পাপড়িতে মোড়া আর তার উপর সাজানো রয়েছে একটা সম্পূর্ণ চুনি দিয়ে তৈরি কণ্ঠহার! বেলজিয়ামের রানির সেই হার!

নিশার হাত কাঁপছে! এটা কে দিল ওকে! এই ফুল! এই রানির হার! ও বাক্সটার ঢাকনার ভিতরে রাখা কার্ডটা খুলল এবার। দেখল তাতে লেখা— ‘মধুনিশা, সত্যিকারের রানির জন্য এক মিথ্যেকারের রাজার উপহার! রিমেমবার, আ প্রমিস ইজ় আ প্রমিস! হ্যাপি বার্থডে।’

মধুনিশা! কত্তদিন পরে এই নামটা শুনল ও! বিয়ের পর তো সবাই নিশাই বলে! মধু নামটা যে হারিয়েই গিয়েছে কবে! হারিয়ে গিয়েছে! নাকি হারায়নি! তাই কি এমন করে এটা পেল আজ! সেই ছেলেটাই কি? না হলে কে জানবে এই ফুলের কথা! ও তো একজন ছাড়া আর কাউকে কোনওদিন বলেনি এই ফুল ওর পছন্দ! কেউ তো আর ওকে কথা দেয়নি একদিন রানির উপহার এনে দেবে!

একদিন ভুল বুঝেছিল ওকে। কিন্তু তারপর একটা ভিডিয়ো টেপ আসে ওর হাতে। সেটা দেখার পর থেকে রাজাকে কত খুঁজেছে ও! কিন্তু পায়নি! আর সেখানে আজ এটা কী!

নিশা দৌড়ে গেল বাথরুমের দিকে। দরজায় ধাক্কা দিয়ে অতন্দ্রকে জিজ্ঞেস করল, “কে দিয়েছে এই প্যাকেটটা? কে দিয়েছে?”

অতন্দ্র ভিতর থেকে বলল, “একটা ছেলে। পুলিশের লোক বলল। এসেছিল সঙ্গে। কেন?”

নিশা উত্তর না দিয়ে খালি পায়েই দৌড়ে বেরিয়ে এল বাড়ির বাইরে, রাস্তায়।

দুপুরের শুনশান পথ। কেউ তো নেই! তা হলে কে এসেছিল? সে এসেছিল! এটা দিতে এসেছিল? কথা রাখতে এসেছিল! সে যে অপরাধ করেনি সেটা তো জানে নিশা। কিন্তু নিশা যে জানে সেটা কি সে জানে?

হাতে ধরা চুনির কণ্ঠহার ধরে দাঁড়িয়ে রইল নিশা। চোখটা জ্বালা করছে ওর! সেটা এই দুপুরের রোদের জন্য না অন্য কিছুর জন্য সেটা আর নিজেকে জিজ্ঞেস করল না ও! জীবনে কোনও-কোনও উত্তর জানতে চায় না মানুষ।


মধু এসে দাঁড়িয়েছে রাস্তায়! এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ও খুব অবাক আর এলোমেলো হয়ে গিয়েছে!

দূর থেকে দেখল অদম্য। ভাল লাগল ওর। রানির হাতেই পৌঁছে গিয়েছে রানির হার! পুলিশের নাম করায় অতন্দ্র ওকে আর সন্দেহ করেনি! গাড়িতে এতটা আসতে দিয়েছে!

ও দীর্ঘশ্বাস ফেলল এবার। ভাবল, আর তা হলে কী বাকি রইল? প্রতিশোধ তো নেওয়া হল! কথা রাখাও হল। কিন্তু এই দিয়ে তো আর দশটা অরফ্যানেজের বাচ্চার প্রতিপালন হবে না! তার জন্য চাই টাকা। অনেক টাকা। হাসল অদম্য। ওর কথা ছিল তিনটে জিনিস চুরি করার। কিন্তু টামার অফ জর্জিয়ার ব্রেসলেটটা ও নিজের জন্য নিয়ে রেখেছে! তিনটে জিনিস ও ফিরিয়ে দিল, কিন্তু এটা দেবে না। কোনও ধনীর লকারে থাকার চেয়ে এটা বিক্রির টাকায় অনেক অসহায় বাচ্চার জীবন বেঁচে যাবে! জীবনের আসল সত্যের জন্য না হয় সভ্য সমাজের আইন-কানুন একটু ভাঙল!

“দাদা, চাঁদা দেবে, রবীন্দ্রজয়ন্তী করব!” পাশ থেকে কয়েকটা ছেলে ওর নীল জামা ধরে টানল।

অদম্য শেষবারের মতো একবার দেখে নিল মধুকে। তারপর তাকাল ছেলেগুলোর দিকে। এগারো-বারো বছর বয়স হবে ছেলেগুলোর। অদম্য হাসল। পকেট থেকে একটা দু’হাজার টাকার নোট বার করে এগিয়ে দিল ওদের দিকে।

ছেলেগুলো ঘাবড়ে গেল। দু’হাজার টাকা!

কাঁপা হাতে নোটটা নিয়ে বিল বই বার করল একটা ছেলে। জিজ্ঞেস বলল, “ক-কী নাম লিখব?”

“নাম?” অদম্য হাসল আবার। তারপর ছোট্ট করে বলল, “অ্যাডাম!”

পনেরো

ইমিগ্রেশন অফিসারটি অল্পবয়সি। পরিষ্কার করে দাড়ি-গোঁফ কামানো। সুন্দর দেখতে। রাজা গিয়ে দাঁড়াল অফিসারটির সামনে। ওর টেনশন হচ্ছে! জাল পাসপোর্ট যদি ধরা পড়ে যায়! তা হলে!

রাজা আড়চোখে দেখল, দূরে ফাদার ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে আছেন। ইশারায় মাথা ঠান্ডা রাখতে বলছেন!

অফিসারটি হাসিমুখে তাকাল রাজার দিকে। জিজ্ঞেস করল, “প্রথমবার যাচ্ছ?”

রাজা হেসে মাথা নাড়াল।

অফিসারটি সব কিছু দেখে নিয়ে পাসপোর্টে স্ট্যাম্প মেরে বলল, “গুড। সব ঠিক আছে। তা নামটা… আগে এমন শুনিনি তো! কী নাম? মানে উচ্চারণটা কী?”

রাজা পাসপোর্টটা নিয়ে হাসল সামান্য। তারপর জামাটা ঠিক করে, শান্ত গলায় বলল, “স্যার, আমার নাম, সেন, অদম্য সেন!”

(এই গল্পের সমস্ত চরিত্র ও ঘটনা কাল্পনিক। বাস্তবের সঙ্গে কোনও মিল থাকলে আকস্মিক ও অনিচ্ছাকৃত।)

No comments